জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ থেকে রোজিনা ইসলাম

  সালতামামি


দেবদুলাল মুন্না
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

শান্তিতে নোবেলজয়ী ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা চলতি বছরের ১১ অক্টোবর বিবিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমাদের (সাংবাদিক) অনেক ক্ষেত্রে সাহায্য দরকার। এখন সাংবাদিক হওয়াটা অনেক বেশি কঠিন ও বিপজ্জনক।

মারিয়া ফিলিপাইনের সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট র‌্যাপলারের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ২০১২ সালে আরও কয়েকজনের সঙ্গে র‌্যাপলার প্রতিষ্ঠা করেন মারিয়া। ফিলিপাইন পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানে শত শত মানুষকে হত্যা করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ করে জনপ্রিয়তা পায় র‌্যাপলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির অর্থ ফিলিপাইনে পাচার বিষয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করে র‌্যাপলার। বাংলাদেশের ওপর আল-জাজিরাও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে সাবেক সেনাপ্রধানের প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল।

এছাড়া ফ্রান্সের টিভি চ্যানেল ফ্রান্স টুয়েন্টিফোরেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। সব মিলিয়ে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ২০২১ সালে আরও এক ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। এই সূচক তৈরি করেছে বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)। তালিকায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় সবার শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে এবং সবার নিচে অবস্থান করছে ইরিত্রিয়া।

আরএসএফের সেক্রেটারি ক্রিস্টোফ ডিলোয়ার এক বিবৃতিতে বলেছেন, গুজবের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকরী ভ্যাকসিন হলো সাংবাদিকতা। তবে দুর্ভাগ্যবশত, এই ভ্যাকসিনের উৎপাদন ও বিতরণ প্রায়ই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, কারিগরি এমনকি মাঝে-মধ্যে সাংস্কৃতিক কারণেও ব্যাহত হয়।

আরএসএফের সূচক অনুযায়ী, এ বছর ইরিত্রিয়া, উত্তর কোরিয়া, তুর্কমেনিস্তান, চীন ও জিবুতিতে সাংবাদিকতা সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে। উল্টোদিকে স্বাধীন সাংবাদিকতার চর্চা ভালো যে দেশগুলোতে হয়েছে সেগুলো হচ্ছে নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সাংবাদিকতা নিরপেক্ষতা হারিয়েছে বলে দাবি করেছে ওয়ার্ল্ড জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন। এ সংস্থার মুখপাত্র স্ট্যানলি রড্রিকস বলেন, বাংলাদেশে যেমন রাজনৈতিক দলের পক্ষে কাজ করে অনেক গণমাধ্যম তেমনটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় থেকে দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র বাকস্বাধীনতার কথা বললেও সাংবাদিকরা বিভিন্ন ফোরামে নগ্নভাবে পক্ষপাতিত্ব করে গেছেন এবং যাচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছিলেন উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। গোপন নথি ফাঁস করার অভিযোগে কি করুণ পরিণতি তাকে পেরুতে হচ্ছে তা এখন বোঝাই যাচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের উচ্চ আদালতে উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ফেরত পাওয়ার আপিলে জয় পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাজ্যের আপিল বিভাগ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর এ রায় দেন। এই রায়ের ফলে ব্রিটিশ কারাগার থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যার্পণ হওয়ার কাছাকাছি অর্থাৎ প্রায় শেষ ধাপে চলে এসেছেন অ্যাসাঞ্জ।

এই বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্যের একটি নিম্ন আদালত অ্যাসাঞ্জকে প্রত্যার্পণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। বলা হয়, অ্যাসাঞ্জের মানসিক স্বাস্থ্য মার্কিন বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অবস্থায় নেই। এ রায়ের পর যুক্তরাজ্যের উচ্চ আদালতে আপিল করে যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন আইনজীবী জেমস লুইস বলেন, অ্যাসাঞ্জের গুরুতর অথবা স্থায়ী মানসিক অসুস্থতার কোনো ইতিহাস নেই। অ্যাসাঞ্জ এমন কোনো অসুস্থ রোগী নয় যে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না।

অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক অ্যাসাঞ্জ ২০১০ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লাখ লাখ সামরিক ও কূটনৈতিক গোপন নথি ফাঁস করে বিশ্বজুড়ে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন।

কয়েক বছর ধরে লন্ডনে ইকুয়েডর দূতাবাসে বসবাস করছিলেন অ্যাসাঞ্জ। গত ১১ এপ্রিল দূতাবাস থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ পুলিশ। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মতো এতো ভয়াবহ অবস্থা না হলেও কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে। তার বিরুদ্ধেও গত ১৭ মে অভিযোগ আনা হয় তথ্য চুরির। জিজ্ঞাসবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। ‘অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট’ মামলা হয়। পরে তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। করোনা সংক্রান্ত বিশেষ গোপনীয় তথ্য রোজিনা জেনে ফেলেছিলেন । এ নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিবেদনও প্রকাশ পায়। এ জন্য চলতি বছরের নভেম্বরে সাহসী সাংবাদিকতার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান রোজিনা ইসলাম। এ পুরস্কার দিয়েছে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামভিত্তিক সংস্থা ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড।

মরক্কোর সাংবাদিক ওমর রাদি এক দশকের বেশি সময় থেকে মরক্কোয় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করছেন। দেশটির অনিয়ম ও কেলেঙ্কারি ফাঁস করেছেন। দীর্ঘদিন হয়রানির পর তাকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন কারাগারে।

বেলারুশের ‘কারেন্ট টাইম’ টিভির সাংবাদিক রামান ভাসিউকোভিচ গত বছর দেশটির নির্বাচনে জালিয়াতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের খবর প্রচার করেছিলেন। পরে তাঁকে গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হলে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন । কিন্তু তিনি দমে যাননি। তিনি দেশটিতে অবস্থান করে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো সরকারের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করছেন।

ভারতের ২২ বছর বয়সী ভাট বুরহান একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি কাশ্মীরে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর দুর্দশা, ভারতের কৃষক আন্দোলন, কৃষকদের আত্মহত্যা, নয়াদিল্লিতে করোনার টিকা না পাওয়ার বিষয়গুলো তুলে ধরার কারণে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পুলিশ তাকে খুঁজছে। ফ্রান্সের প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২১ সালের চিত্র তুলে ধরে এসব তথ্য জানিয়েছে। আরএসএফ ২৫ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, গ্রেফতার-হত্যার ঘটনা নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। এ সংস্থার মতে, চলতি বছর রেকর্ডসংখ্যক সাংবাদিক গ্রেফতার হলেও কমেছে সাংবাদিক মৃত্যুর হার।

এ বছর ৪৬ জন সাংবাদিক নির্যাতনে মারা গেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনের মতো দেশগুলোয় এ বছর তুলনামূলক স্থিতিশীলতা থাকায় সাংবাদিক সাংবাদিক নিহত হওয়ার ঘটনা কমেছে।

নির্যাতন ও গ্রেফতারের পেছনে বড় কারণ হিসেবে দেখছে করোনা মহামারিতে অনিয়মের খবর প্রকাশ করাকে। বিভিন্ন দেশে ৪৮৮ জন সাংবাদিক গ্রেফতার হয়েছেন। ২০২০ সালের তুলনায় এই সংখ্যা ২০ শতাংশ বেশি। আর চলতি বছরে বিভিন্ন দেশে হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৬ সাংবাদিক।

সাংবাদিক গ্রেফতারে এগিয়ে থাকা তিনটি দেশ হচ্ছে, চীন, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম।

চীনে ১২৭ জন সাংবাদিক চলতি বছরে গ্রেফতার হয়েছেন। ৫৩ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করে তালিকায় দ্বিতীয় মিয়ানমার আর ২৩ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করে তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। এছাড়া বেলারুশে ৩২ ও সৌদি আরবে গ্রেফতার হয়েছেন ৩১ জন সাংবাদিক।

আরএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪৬ সাংবাদিকের মধ্যে অধিকাংশকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। শতকরা হিসেবে এই সংখ্যা ৬৫। এছাড়া চলতি বছরে অপহরণের শিকার হয়েছেন ৬৫ জন সাংবাদিক। এর মধ্যে ৬৪ জনই অপহৃত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের তিন দেশে। সিরিয়ায় অপহৃত হয়েছেন ৪৪ জন। ইরাকে ১১ ও ইয়েমেনে অপহৃত হয়েছেন ৯ জন। আর একজন সাংবাদিক অপহৃত হয়েছেন ফ্রান্সে।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে চীনে বেশি সাংবাদিক নির্যাতনের কারণ হিসেবে বলছে, চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সংবাদ সংগ্রহে ছুটে গিয়েছিলেন সাংবাদিক ঝ্যাং। করোনার সংক্রমণ প্রথম প্রকাশ্যে এনে সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিলেন তিনি। কীভাবে সেখানে করোনায় আক্রান্ত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে সে ছবি তুলে ধরেছিলেন ঝ্যাং। আর সে কারণেই কারাগারে যেতে হয় তাকে। সেখানে অনশন ধর্মঘট করে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন ৩৮ বছর বয়সী সাংবাদিক ঝ্যাং ঝান।

চীনা সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরার পর সাংবাদিককে আটক করছে। এমনকি উইঘুর মুসলিমদের এলাকায় যেতেও অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে।

আরএসএফের প্রতিবেদনের সঙ্গে অমিল রয়েছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) ২০২১ এর বার্ষিক প্রতিবেদনে। শুধু মারা যাওয়া সাংবাদিকের তালিকায় দু সংস্থার তথ্য দুরকম। সিপিজে বলছে, ২৪ জন সাংবাদিক মারা গিয়েছেন। আর চলতি বছরের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ২৯৩ সাংবাদিককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

সিপিজের নির্বাহী পরিচালক জোয়েল সিমন এক বিবৃতিতে বলেন, এ নিয়ে ষষ্ঠবার বিশ্বজুড়ে রেকর্ডসংখ্যক সাংবাদিক কারাবন্দী করার তথ্য তালিকাভুক্ত করল সিপিজে। এসব তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে পাওয়া গেছে।

জোয়েল সিমন বলেন, বেশির ভাগ দেশে সরকার তথ্য নিয়ন্ত্রণ করতে বদ্ধপরিকর ও এ কাজ করার জন্য তারা সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হচ্ছে।এ বছর প্রথমবারের মতো চীনের আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হংকংয়ে কারারুদ্ধ সাংবাদিকদের তালিকাভুক্ত করেছে সিপিজে।

গত ২৫ বছরের মধ্যে ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক গ্রেফতারের ঘটনা ঘটলেও মধ্যপ্রাচ্যে তুলনামূলক কম নির্যাতন হয়েছে। কারণ সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড ও এর বিচার। যদিও এবছর বিচারে অভিযুক্তদের সাজার মেয়াদ কমিয়ে দেওয়ার ফলে নতুন বিতর্কের সূচনা হয়েছে। খাসোগি হত্যার জন্য সৌদি যুবরাজ সালমান সারাবিশ্বে সমালোচিত হোন। এসব তথ্য ওয়াল্ড জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের।

২০২১ সালের চিত্র তুলে ধরে আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) জানায়, চলতি বছরে যে পরিমাণ নারী সাংবাদিককে আটক করা হয়, এ সংখ্যক নারী সাংবাদিককে অতীতে কখনো আটক করা হয়নি। চলতি বছর নারী সাংবাদিক আটক হয়েছেন ৬০ জন, যা ২০২০ সালের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ বেশি। ভারতীয় সাংবাদিক বারাখা দত্ত সিএনএনকে ২৪ ডিসেম্বর দেওয়া এ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘নারী সাংবাদিকদের শুধু আটকই করা হয়নি। আটকের সময় বিভিন্ন দেশে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা যৌন হেনস্থাও করেছে।’

হেনস্থার শিকার নারী সাংবাদিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, বেলারুশের সান্দ্রে ইভাচিভ, মিয়ানমারে অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক শ্যান পেত্রেই, চীনে ভারতীয় সাংবাদিক দেবযানী শেঠী।

চলতি বছর যেসব সাংবাদিক মারা গিয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- গুস্তাভো শানচেজ কাবেরা। গত জুনে মেক্সিকোতে গুস্তাভো শানচেজ কাবেরাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যার আগে তিনি পানি চেয়েছিলেন ও একবার তার মায়ের সাথে সেলফোনে কথা বলতে চেয়েছিলেন। সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। আরেকজন হচ্ছেন দানিশ সিদ্দিকী। তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ফটো সাংবাদিক ছিলেন । গত জুলাইয়ে তিনি আফগানিস্তানে তালেবানের হামলায় নিহত হন। তাকে হত্যার আগে তালেবানিরা বলেছিল, মুসলমান হয়ে মুসলমানের বিপক্ষে কলম ধরা বিধর্মীর কাজ।

আমাদের দেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রও (আসক) চলতি বছরের প্রথম নয় মাসের (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২১) প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত নয় মাসে ১৫৪ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

আর্টিকেল-১৯ এর হিসেবে, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা হয়েছে ২৫টি ৷ আসামি করা হয়েছে ৪৮ জনকে ৷ গ্রেফতার হয়েছেন ১১ জন ৷ এই সময়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মোট মামলা হয়েছে ১৮৮টি ৷ আসামি করা হয়েছে ৩৫৩ জনকে ৷ এ সংস্থাটি সংবাদমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে।

আর্টিকেল-১৯ এর দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক ফারুক ফয়সাল ডয়েচে ভেলেকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি করাই হয়েছে ভয় দেখানোর জন্য৷ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলাগুলো হয়রানিমূলক ৷ তাই যারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ করে তাদের শাস্তির জন্য আলাদা আইনের দাবি করছি আমরা ৷

কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)-এর তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ২৯ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। এরমধ্যে সবচেয়ে আলোচিত সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড।

   

ইতিহাসে ২৮ মার্চ: বর্ণবাদের প্রতিবাদে কিংয়ের পক্ষে ২৫ হাজার মানুষ



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

  • Font increase
  • Font Decrease

মানব ইতিহাস আমাদের অতীতের কথা বলে। আজ যা কিছু বর্তমান তার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল আমাদের অতীতের কারণেই। সেই অতীতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ছাপ রেখে যায় ইতিহাসের পাতায়।  

আজ ২৮ মার্চ, ২০২৪। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখঅ যাবে, আজকে ঘটেছিল নানা ঐতিহাসিক ঘটনা। জেনে নেয়া যাক, কি ঘটেছিল আজকের তারিখে!

*মার্টিন লুথার কিং ছিলেন বর্ণবাদের বিপরীত আন্দোলনকারী আফ্রিকান নেতা। ১৯৬৫ সালে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। সেখানে ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ তাকে সমর্থন করে মিছিলে নেমেছিলেন আজকের তারিখে। এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে আলাবামায় জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার তৈরিতে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।    

*যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ায় থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক কেন্দ্রে ১৯৭৯ সালে পানির পাম্প ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে চারপাশে তেজস্ক্রিয় বাষ্প এবং আয়োডিন ছড়াতে শুরু করে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে কর্মরত ৫০০ জন কর্মী এই বাষোপর সংস্পর্শে আসায় শারীরিক সমস্যার আশঙ্কায় ছিল। আমেরিকার জনগণ এই ঘটনায় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে।  

*১৯৮৬ সালে অ্যাচেসন এবং লিলিয়েনথাল পারমারবিক শক্তি সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে পারমাণবিক শক্তির নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা উল্লেখ করেন তারা। ২৮ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের সেই রিপোর্টটি প্রকাশ করে।

*হিলসবোরো দুর্ঘটনায় প্রায় ১শ লোকের প্রায় গিয়েছিল ১৯৯১ সালে। শেফিল্ডে পিষ্ট হয়ে ৯৬ জন লিভারপুল ফুটবল সমর্থক নিহত হন। এছাড়া আরও দেড় শতাধিক ভক্ত আহত হন। এই বিপর্যয়ে আদালতের রায়ে অসন্তুষ্ট ছিল নিহতদের পরিবার। তাই, আজকের তারিখে তারা রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিল।

*১৯৩৬ সালে শুরু হওয়া স্পেনের গৃহযুদ্ধ ১৯৩৯ সালের ২৮ মার্চ শেষ হয়েছিল।

  সালতামামি

;

তালপাতার পাখায় ঘোরে সংসারের চাকা



মাহবুবা পারভীন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বগুড়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আঁকাবাঁকা রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তালগাছ। যা দেখে মনে পড়ে যায় রবী ঠাকুরের কবিতা ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।’ বলছি বগুড়ার কাহালু উপজেলার আড়োলা গ্রামের কথা। বর্তমানে গ্রামটি তাল পাখার গ্রাম নামে পরিচিত। এই গ্রামে প্রবেশ করতেই দেখা যায় নারী-পুরুষ সবাই তালপাতা দিয়ে পাখা বানানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গরমে তালপাতার পাখার বাতাস গা জুড়িয়ে যায়।

বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের পাশাপাশি দুটি গ্রাম। একটির নাম যোগীরভবন, অপরটি আড়োলা আতালপাড়া। ইতোমধ্যে গ্রাম দুটি পাখার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, দুটি গ্রামে একেক পাড়ায় একেক ধরনের পাখা তৈরি হয়। যোগীরভবন গ্রামে নারীরা তৈরি করেন হাতলপাখা বা ডাঁটপাখা। আর আড়োলা আতালপাড়ায় তৈরি হয় ঘোরানো পাখা বা ঘুন্নী পাখা আর পকেট পাখা। পাখা তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন দুটি গ্রামের সব নারী। শীতের শেষে বসন্তকালে, অর্থাৎ ফাল্গুন মাস থেকে পাখা তৈরির কাজ শুরু হয়।

পাখা তৈরিতে ব্যস্ত নারী

গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বাড়ির উঠানে রং তুলির আঁচড়ে ঘুরানো পাখা রাঙিয়ে তুলছেন সখিনা বেগম। রাঙানো পাখা বাঁধায় করছেন গোলজার। বাঁধা হয়ে গেলে পাখাটি বিক্রি করবেন তিনি।

হাতপাখার গ্রামে এবার ২০ লাখ পাখা বিক্রির প্রস্তুতি চলছে। এই পাখা চৈত্র মাস থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত বিক্রি হবে।

গ্রামের নারী-পুরুষ, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা অবসর সময়ে পাখা তৈরির কাজ করেন। বংশ পরম্পরায় এই দুই গ্রামের মানুষ তালপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন বলে জানান গ্রামের বাসিন্দারা। গরমে ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে দিন দিন বাড়ছে পাখার চাহিদা, সেই সঙ্গে বাড়ছে পাখা তৈরির কাজের পরিধি।

আড়োলা গ্রামের খন্দকার বলেন, দাদার আমল থেকে তারা তাল পাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন। কৃষি কাজের পাশাপাশি তালপাখা তৈরির কাজ করেন তিনি। তার স্ত্রীও সংসারের কাজের ফাঁকে রঙের আচর দিয়ে তাল পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করে থাকেন। আকরাম আকন্দ বলেন, গত বছর তিনি পাখা বিক্রি করে সংসার খরচ বাদে এক লাখ টাকা সঞ্চয় করেছেন। তার মতে গত বছর দুই গ্রাম থেকে ১৫ লাখ তালপাখা বিক্রি হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এবার চাহিদা বাড়ায় ২০ লাখ পাখা বিক্রি হবে বলে তিনি জানান।

জানা যায়, তালগাছের পাতা (স্থানীয় ভাষায় তালের ডাগুর) দিয়ে তিন ধরনের পাখা তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে নাম দেয়া হয়েছে- পকেট পাখা, ঘুরানী পাখা এবং ডাগুর পাখা।

পাখা তৈরিতে তালের পাতা ছাড়াও বাঁশ, সুতা এবং লোহার তার প্রয়োজন হয়। পাখা তৈরির পর বিভিন্ন রঙের আচর দিয়ে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়। ১০ টাকায় কেনা তাল গাছের একটি পাতা বা ডাগুড় দিয়ে তৈরি হয় বড় পাখা বা ডাগুর পাখা ২টি, ঘুরানী পাখা ৪টি এবং পকেট পাখা ৬টি।

তালপাতার পাখা

পাখা তৈরির কারিগর জানান, বছরের আশ্বিন মাস থেকে শুরু হয় বাঁশ এবং তালপাতা সংগ্রহের কাজ। এরপর বাঁশ ছোট ছোট আকারে কাটতে হয়। তালপাতাও কেটে পাখা তৈরির উপযোগী করা হয়। ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে পাখা তৈরির কাজ। চৈত্র মাসের শুরু থেকে পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বাহারি রঙ করে বিক্রয় উপযোগী করা হয়।

রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, সৈয়দপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা আসেন তালপাখা কিনতে।

যোগীর ভবন গ্রামের মামুনুর রশিদ বলেন, তিনি প্রতি বছর ১৭ থেকে ১৮ হাজার ডাগুর পাখা তৈরি করেন। এই পাখাগুলো বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। গত বছরের তুলনায় এ বছর পাখার চাহিদা বেশি বলে জানান মামুনুর রশিদ। তিনি বলেন, একটি তাল পাতা বা ডাগুরের দাম ১০ টাকা হলেও বাঁশ ও রঙের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খরচ বেড়ে গেছে।

আতাইল পাড়া গ্রামের পারভীন, মর্জিনা, সাবিনা, বেবি, সুমি জানান, তারা প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি হাত পাখা তৈরি করে বিক্রি করেন। বছরের ছয় মাস সংসারের কাজের ফাঁকে হাতপাখা তৈরির কাজ করে তারা বাড়তি আয় করছেন। এইসব নারীরা তাদের সৌখিন জিনিস কিনে থাকেন নিজের টাকায়।

পকেট পাখা ১১ টাকা, ঘুরানী পাখা ২০ টাকা এবং ডাগুর পাখা ৩০ টাকা দরে ব্যাপারীরা পাইকারি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা আবার বিভিন্ন মেলা কিংবা হাটে বাজারে খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন।

গরমের সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার কারণে হাতপাখার চাহিদা বাড়ছে বলে পাখা কিনতে আসা ব্যাপারী করিম জানান। শহর এবং গ্রামে তীব্র গরম থেকে একটু প্রশান্তি পেতে ধনী-গরিব সবাই হাত পাখার ব্যবহার করে আসছেন যুগ যুগ ধরে।

  সালতামামি

;

ইতিহাসে ২৭ মার্চ:স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

  • Font increase
  • Font Decrease

সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের সাথে বছরের পর বছর কেটে যায়। বর্তমান হয় অতীত। তার সাথেই তৈরি হয় ইতিহাসের। মানব সভ্যতায় ঘটে যাওয়া ইতিহাস হয়ে থাকে জাতির কাছে স্মরণীয়। প্রতি বছর যখন ক্যালেন্ডারে একই তারিখগুলো ফিরে আসে, মানুষ পুরনো ঘটনার স্মৃতিচারণ করে।

আজ ২৭ মার্চ, ২০২৪। বিগত বছরগুলোতে এই তারিখে ঘটা অনেক ঘটনা হয়েছে স্মৃতিতে অমলিন। ইতিহাসের পাতায় জুড়ে গেছে নতুন নতুন ঘটনা। চলুন জেনে নিই,আজকের তারিখে কি ঘটেছিল!    

১৯৭৭ সালে স্পেনে টেনেরিফ বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। ডাচ এয়ারলাইনের সেই দুর্ঘটনায় কাউকেই জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। রানওয়েতে দু’টো জেট বিমানের সংঘর্ষে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে উৎপন্ন বিধ্বংসী দাবানলে সর্বমোট ৫৮৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়।

বিশাল এক ঢেউয়ের আঘাতে ১৯৮০ সালে উত্তর সাগরের প্ল্যাটফর্ম ধসে পড়ে। রিগটি ডান্ডি থেকে ২৩৫ মাইল পূর্বে সেই আবাসন প্ল্যাটফর্ম দুর্ঘটনায় ১২৩ জন শ্রমিক মারা যান।

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে কমিউনিটি পার্টির অনেক রাশিয়ান উচ্চতর কর্মকর্তা পরাজিত হন। তৎকালীন সময়ে এই ঘটনাকে একটি বিদ্রোহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।     

১৯৬৩ সালে ব্রিটেনে রেললাইন কম ব্যবহৃত হওয়ার কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপুল ক্ষতি হয়। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মোট রেলব্যবস্থার এক-চতুর্থাংশ সেবা কমিয়ে দেওয়া হবে। এই নিয়ে সুদূরপ্রসারী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল ২৭ মার্চ।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

  সালতামামি

;

আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয় ‘পাক বিধান’



সম্পাদকীয় বিভাগ, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক যে দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়, স্বল্প সময়েই এর প্রবক্তাদের উচ্চাশা কোটি কোটি অধিবাসীদের দুরাশায় পরিণত হয়। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়, তা পাকিস্তানি শাসকদের সীমাহীন অবিচার আর দুঃশাসনে এক নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র ধারণ করে। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ধ্বনিতে মোহিত করা অধুনা পূর্ববঙ্গবাসীর আকাঙ্খা বছর গড়াতেই দুঃস্বপ্নের রূপ নেয়। শুরু হয় নব্যঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকদের কবল থেকে নিজেদের স্বাধিকার আদায়ের প্রাণান্তর চেষ্টা। আমরা জানি, পূর্ববঙ্গের ন্যায্যতা প্রশ্নে উদাসীন পিন্ডির শাসকদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে গড়ে উঠা প্রতিরোধ আন্দোলন ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবির মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি পায়। ভাষা আন্দোলনে শহিদদের রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে বাংলা। ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ‘মুক্তিযুদ্ধে’ ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তে ও দুই লক্ষ নারীদের চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয় চূড়ান্ত মুক্তি।

আজ ঐতিহাসিক ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে আমরা জানার চেষ্টা করব ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলিতে স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল বাঙালি জাতি কি আত্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুক্তিসংগ্রামের পথে ধাবিত হয়েছিল। ১০ চৈত্র ১৩৮৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯) কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ তাদের সম্পাদকীয় পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেছে সেই সময়কার দৃশ্যপট। স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ আয়োজনে বার্তা২৪.কম পুনঃপ্রকাশ করছে আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয়।

গত চার মাস ধরিয়া পাকিস্তানে যে তুলকালাম কা- চলিয়াছে নানা জন নানা ভাবে তাহার ব্যাখ্যা করিতে চাহিবেন এটাই স্বাভাবিক। কেহ বলিতেছেন, পাকিস্তান আর একটি বিয়াফ্রা বা ভিয়েৎনাম সৃষ্টি হইতে চলিয়াছে। মৌলানা ভাসানিরও মনে হয় তাহাই অভিমত, তিনি গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়াছেন, বলিয়াছেন, সে মহৎ কর্মে কুড়িলক্ষ পাকিস্তানীর জান কোরবানি করিতে তিনি তৈয়ার। লারকানরি আমুদে-যুবা ভুট্টো ‘প্লেবয়’ হিসাবে খ্যাত হইলেও আগুন লইয়া খেলায় কতখানি মাতিবার সামর্থ্য রাখেন, সে বিষয়ে অনেকেরই বিলক্ষণ সন্দেহ। বিশেষতঃ, পশ্চিম পাকিস্তানে শুধু ফৌজীদের ঘাঁটি নয়, মওদুদি তথা মোল্লাদেরও ছাউনি পড়িয়াছে। শুধু ভুট্টোর ধারণা নাকি পাকিস্তানে ‘বিপ্লব’ চলিয়াছে, এবং এ বিপ্লব যদিও অন্তরে ঐশ্লামিক, লক্ষ্যে-সমাজতান্ত্রিক।

চারিদিকে সকলের মুখে মুখে যখন ‘‘বিপ্লবের’’ ফুলঝুরি, তখন পাক-আইনমন্ত্রী সৈয়দ মহম্মদ জাফর অনায়াসে প্রস্তাবিত শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিগুলিকেও আখ্যা দিতে পারিতেন-‘‘বিপ্লব’’। একসঙ্গে শাসনতন্ত্রের নব্বুইটি অনুচ্ছেদের পরিবর্তনের চিন্তা আপাতদৃষ্টিতে নিশ্চয়ই প্রকৃতিতে বিপ্লবাত্মক। ১৯৫৮ সনের অক্টোবরে আয়ুব যখন আচমকা গদীয়ান হন , সে ঘটনা অন্যের চোখে বিশুদ্ধ সামরিক অভ্যুত্থান হইলেও পাকিস্তানে বলা হয় ‘অক্টোবর রিভলিউশন’, আইনমন্ত্রী নির্দ্বিধায় ফেডারেল ব্যবস্থা নামক বিলটির নাম দিতে পারিতেন ‘‘মার্চ রিভলিউশন’’-আয়ুব এক জনমে দুইটি বিপ্লবের কৃতিত্ব লাভ করিতেন!

জাফর সাহেব আয়ুব খাঁর তরফ হইতে যে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথা শুনাইয়াছেন তাহার সারমর্মঃ পাকিস্তান এক যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হইবে। সরকার পরিচালনা করিবেন মন্ত্রিসভা; তাহার শীর্ষে থাকিবেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতিও থাকিবেন একজন, তবে তিনি থাকিবেন রবার স্ট্যাম্প মাত্র। তাঁহাকে নির্বাচন করিবেন রাজ্য আইনসভার সদস্যবৃন্দ। অন্যরা সকলে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটে নির্বাচিত হইবেন, ইত্যাদি কথাবার্তার ধরণ দেখিয়া মনে হইতে পারে চৌদ্দমাস ধরিয়া বিস্তর কাঠখড় পোড়াইয়া মাথা খাটাইয়া ১৯৬২ সনে আয়ুব যে শাসনতন্ত্র তাঁহার দেশকে উপহার দিয়েছিলেন সেটির খোলনলচে বুঝি সবই পাল্টাইতে চলিয়াছে। বলা হইয়াছে পরিকল্পিত নূতন শাসনতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যÑইহা এককেন্দ্রীয় নয়, ফেডারেল বা যুক্ত রাষ্ট্রীয়; দ্বিতীয়ত ইহাতে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার স্বীকৃত, তৃতীয়ত স্বীকৃত জনসাধারণের ভোটাধিকারের দাবিও।

শেষোক্ত অধিকারটি নিশ্চয়ই পাক নাগরিকদের কাছে মস্ত পাওনা, এক যুগেরও পরে তাঁহারা একটি মৌলিক অধিকার পাইতে চলিতেছেন। এবিষয়ে পুনর্বিবেচনা করিয়া দেখিবার জন্য আয়ুব অবশ্য ১৯৬৩ সনে একটি কমিশন বসাইয়াছিলেন। তাহারাও বলিয়াছিলেন-প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার মানিয়া লওয়া সঙ্গত। আয়ুব তাহাতে রাজী হইতে পারেন নাই, আর একটি কমিটী বসাইয়া সিদ্ধান্তটিকে নিজের পছন্দসই করাইয়া লইয়াছিলেন। আইনমন্ত্রী জাফর বলিয়াছেন-আগামী মাসেই জাতীয় পরিষদে একটি ‘বিল’ আনিয়া সকলকে ভোটের অধিকার দেওয়া হইবে। ‘‘ঠগের বাড়ির নিমন্ত্রণ: না আঁচাইলে বিশ্বাস নাই’Ñতবু মনে হইতেছে নীট লাভ এইটিই।

যুক্তরাষ্ট্রের যে রূপরেখা মিলিয়াছে তাহাতে মনে হয়, খোল নলচে পালটাইলেও কলকেতে সেই পুরনো তামাকই পুড়িবে। নলটি প্রেসিডেন্টের নয়, প্রধানমন্ত্রীর মুখে লাগানো থাকিবে-এই যা। প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানের ‘এক ইউনিট’ কর্তার ইচ্ছায় অতঃপর দুই হইবে হয়তো কিন্তু জনসাধারণের ইচ্ছা অনুযায়ী ‘বহু’ হইতেছে না। দ্বিতীয়ত কেন্দ্রীয় সংসদে সব ত্যাগের সমনাধিকার , অর্থাৎ চলতি নিয়মই বহাল থাকিবে, আসন জনসংখ্যার অনুপাতে বন্টিত হইতেছে। ফলে পূর্বের উপর পশ্চিমীদের আধিপত্য থাকিয়াই যাইবে।

পাক শাসনতন্ত্রে অমুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার অধিকার নাই, নয়া-শাসনতন্ত্রে বাঙালী মুসলমানের পক্ষে সে সম্ভাবনা সামান্য। সাত কোটি বাঙালীর উপর পাঁচ কোটি পশ্চিম পাকিস্তানীর শাসন শোষণ চলিতেই থাকিবে। বিশেষত, পাক সামরিক বাহিনীতে বা দেশরক্ষা ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি মিলে নাই। পাকিস্তানের সামরিক খরচ বাজেটের শতকরা ষাট ভাগের বেশী সেখানে টাকা দিতে হয় পূর্ব পাকিস্তানকেও কিন্তু বাহিনীতে তাহার ভূমিকা নামমাত্র। পশ্চিম পাকিস্তান তাহার আসল বল হাতের ওই মুগুরটি হাতছাড়া করিবে কি?

খাঁটাইয়া দেখিলে সন্দেহ থাকে না, আয়ুব স্বায়ত্বশাসনের ধোঁকা দিতেছেন মাত্র। যে আঞ্চলিক স্বাধীনতার কথা জাফর শুনাইয়াছেন, অন্য ভাষায় পুরনো শাসনতন্ত্রেও সে-সব প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের দুই অঙ্গে বৈষম্য তবু বাড়িয়াছে বই কমে নাই। মোটকথা শেখ মুজিবর রহমান যে ছয়দফা চাহিয়াছিলেন তাহার সামান্যই দেওয়ার উদ্যোগ দেখা যাইতেছে। শেখ মুজিবর তাহার ইঙ্গিত পাইয়াই গোলটেবিল বৈঠকের ফলাফলকে আখ্যা দিয়াছিলেন-শূণ্য। তিনি এবং তাঁহার দল নাকি একটি বিকল্প ফেডারেল শাসনতন্ত্রের খসড়া রচনা করিতেছেন।

আগামী মাসে জাতীয় পরিষদের বৈঠকে তাহা উত্থাপিত হইবে। তদানুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানে গঠিত হইবে চারিটি রাজ্য, পূর্বে একটি। কেন্দ্রীয় আইনসভায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মানিয়া লওয়া হইবে। সরকারী ‘‘বিল’’ এবং এই বেসরকারী ‘‘বিল’’-দুইয়ের ভাগ্যই কিন্তু এখন অবধি অনিশ্চিত। আয়ুবের মতলব নাকি-যাবতীয় পরিবর্তনের প্রস্তুতি আগামী বছর ২৩ মার্চের মধ্যে শেষ করা-এক যুগ পরে প্রেসিডেন্টের তখনই বানপ্রস্থে যাত্রার ইচ্ছা। তাঁহার দ্বিতীয় বাসনা, সব পরিবর্তনই নিয়মতান্ত্রিক পথে হোক। কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করিতেছেন, পাক জাতীয় পরিষদের সম্মতি লইয়া শাসনতন্ত্র সংশোধন সম্ভব নাও হইতে পারে।

দুই পাকিস্তানেরই প্রতিনিধি সংখ্যা সেখানে সমান, সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে আয়ুব কি প্রয়োজনীয় দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন পাইবেন? আর মুজিবুরের ‘‘বিল’’ যদি পাস হইয়া যায়, তবে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা কি তাহা মানিয়া লইবেন? সুতরাং লক্ষণ দেখিয়া মনে হয় না পাকিস্তানের সংকট কাটিবার মুখে। বরং মনে হইতেছে, প্রকৃত সংকট ক্রমে আরও ঘনাইয়া আসিতেছে। দিশাহারা আয়ুব পশ্চিম পাকিস্তানে গভর্নর বদল করিয়াছেন, পূর্ব-পাকিস্তানেও মোনেম খাঁর বদলে নূতন গভর্নর নিযুক্ত হইয়াছেন হুদা।

পশ্চিম হইতে পুবে সৈন্য আমদানির কথাও শোনা যাইতেছে। পাকিস্তান কোন্ পথে চলিয়াছে? বিলাতের একটি কাগজ বলিতেছে-বিচ্ছিন্নতার পথে। নূতন শাসনতন্ত্রে জোড়াতালির যতো চেষ্টাই করা হোক, একটি সত্য আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট, ধর্মীয় ঐক্য খানিকদূর অবধি কাজে লাগে, বেশীদূর নয়। যদি তাহা না হইত তবে লাহোর অধিবেশনের আটশ বছর পরে, পাকিস্তান-স্বপ্নের তথাকথিত ঐতিহাসিক জন্মতারিখের দুইদিন আগে পাক নেতাদের এই মেকি ‘ফেডারেল-ইজম’ এর স্তোকবাক্য শুনাইতে হইত না!

প্রকাশকাল: সোমবার ১০ চৈত্র ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯): আনন্দবাজার পত্রিকা

সংগ্রহ: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

  সালতামামি

;