একজন ডা. শিশির, তার গেরিলা যুদ্ধের গল্প

  বিজয়ের ৫০ বছর



জুয়েল সাদাত
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

 

ডা. সিরাজুল ইসলাম। একজন অসাধারণ মানবিক মানুষ। একজন মুক্তিযোদ্ধা ট্রেইনার। ১৪০০ মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেইনিং করেছিলেছেন। শিশির ভাদুড়ি ছন্মনামে গেরিলা যুদ্ধ করেছেন। অসাধারণ দেশপ্রেমিক একজন চিকিৎসক মুক্তিযোদ্ধা। পরিবারের দুই ভাই যুদ্ধ করেছেন। ধার্মিক পরিবারে বেড়ে উঠা ডাক্তার ইসলাম তাবলিগের দাওয়াত নিয়ে সারা আমেরিকার মসজিদে মসজিদে কাটিয়েছেন। দারুণ গান গাইতে পারতেন। ওস্তাদের কাছে গান শিখেছেন। দাওয়াতি কাজে জড়িয়ে গান ছাড়েন। ফ্লোরিডায় ৬/৭টি মসজিদ তৈরি করেছেন। দান করেন হিসাব ছাড়া। বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা নিয়ে কোন আপোষ করেন না।  ছিলেন মরহুম শেখ কামালের বন্ধু।  একাধারে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসকও।

মন খুলে যুদ্ধের গল্প, জীবনের গল্প, নিয়ে কথা বলেছেন কমিউনিটি এক্টিভিস্ট সাংবাদিক কলামিস্ট জুয়েল সাদাতের সাথে।   

জুয়েল সাদাত - আপনার পড়াশুনা বা ছাত্র জীবন কেমন ছিল?

ডা. শিশির: নাটোরের গুরুদাসপুরে প্রাথমিক শিক্ষা। তারপর পাবনা জেলা স্কুলে পড়াশুনা করি। স্কুল জীবনে স্কাউট লিডার, আবৃত্তি, লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জড়িত ছিলাম। তারপর ঢাকা কলেজে পড়াশুনা করি। তারপর ফাস্ট গ্রেট স্কলারশিপ নিয়ে আমরা মাত্র দুজন ইস্ট পাকিস্তান থেকে লাহোরে যাই। ঢাকা কলেজে পড়াশুনা কালীন সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে কলেজের ছাত্র সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি হই। তখন মরহুম শেখ কামাল আমার সহপাটি ছিলেন। তিনি বলতেন, তোমরা মেধাবী পড়াশুনা করো। প্রযোজন মতো আমাদের সাপোর্ট কর। তিনি আমার নির্বাচনে আমাকে ভোট দিতে বলতেন সবাইকে। ১৯৬৯ সালে লাহোরে পড়াশুনার জন্য যাই। তারপর যুদ্ধের কারণে সেখানে থাকা সম্ভব না হওয়ায় ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ বাংলাদেশে যুদ্ধচলাকালীন চলে আসি। যুদ্ধের পর ঢাকা মেডিকেল থেকে ডাক্তারি পাস করি।

জুয়েল সাদাত:  আপনার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল সম্পর্ক জানতে চাই?

ডা. শিশির: পাবনা জেলা স্কুলেই আমার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জড়ানো। লেখালেখি, স্কাউটিং এর নানা একটিভিটিস, গল্প কবিতা নাটক সব কিছু শুরু স্কুল জীবনেই। তারপর ঢাকা কলেজে বড়ো পরিসরে জড়ানো। ঢাকা কলেজের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ওতোপ্রোতো জড়িত ছিলাম। সবগুলো স্টেজ শোতে আমি থাকতাম। নাটক করতাম। ঢাকার অগ্নিবিনাতে জড়িত ছিলাম।  ওস্তাদের নিকট গান শিখি।  টেলিভিশনে অনুষ্ঠান প্রযোজনা করি। স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠান করতাম। ভাল গান গাইতে পারতাম। একবার আমার এক গানের উস্তাদ অসুস্থ হলেন, উনাকে বিশেষ যত্ন নিয়ে সুস্থ করে তুলি। তারপর উনি আমাকে ও অনেক যত্ন করে গান শেখান। উস্তাদ গুল মোহাম্মদসহ আরো অনেকের  সান্নিধ্যেই গানের সব মাধ্যমেই পারদর্শিতা অর্জন করি।

জুয়েল সাদাত: মুক্তিযুদ্ধে জড়ানো কিভাবে, আর কিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেইনার হলেন?

ডা. শিশির: যখন লাহোরে ছিলাম, ২৫ মার্চের পরে একদিন হোস্টেলে আমাকে আটক করে  বলতে  থাকে  পাকিস্তান নট ফর বাংলাদেশি বাস্টার্ড। সেদিন নেপালি ছাত্ররা আমাকে মুক্ত করে। তখন তারা আমাকে মেরে ফেলতে চাইছিল। তখন প্রিন্সিপাল আমাকে বলেন  ন্যাশনাল ক্রাইসিস চলছ, তোমাদের হোস্টেলে থাকা নিরাপদ নয়। তখন অনেকেই হোস্টেল থেকে চলে গিয়েছিল। আমি যেহেতু গভর্নর স্কালারশিপে ছিলাম,  তখন তারা আমাদের আর্মির সহায়তায় দেশে ফেরত পাঠাতে চাইছিল। আমরা দুই তিন জন ছিলাম। এয়ারপোর্টে আমাদের হত্যা করতে পারে তাই অনেকেই আসেনি। আমি একা ঢাকা আসলাম ১৮  এপ্রিল ১৯৭১ সালে। পায়ে হেঁটে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চলে আসি, তিনদিন পর চলে যাই নাটোরের গুরিদাসপুর গ্রামের বাড়ি। মা বলেন, পাশের গ্রামের ১৮ জনকে  পাক আর্মি মেরে ফেলছে। তখন আমরা বাড়িতে থাকতাম না মাঠে ঘুমাতাম । কাউকে রাজি করাতে পারছিলাম না মুক্তিযুদ্ধে যেতে। মাত্র তিনজন আমরা চলে যাই বাঙালিপুর ক্যাম্পে। সেই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে পরবর্তিতে পরিচিত আব্দুল জলিল ভাই, তিনি আমার আব্বার পরিচিত সেই হিসাবে আমাকে সুযোগ দিলেন । আমার পূর্বের মিলিটারি ট্রেনিং ছিল, সেই সাথে স্কাউটিংসহ নানা রকম ট্রেনিং থাকায় তিনি আমাকে ট্রেইনার হিসাবে কাজে লাগান। তিন মাস ট্রেনিং করাই । আমরা বেশীর ভাগ সময় রাতে অপারেশন করতাম দিনে।

জুয়েল সাদাত: গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে কিভাবে জড়ালেন

ডা. শিশির: আমাদের ক্যাস্পের কাছে১০ জন মুক্তিযোদ্ধা চাইল। তখন আমাদের দশ জনকে সিলেক্ট করে। আমাদের বলা হল তোমাদের বিশেষ ট্রেনিং এর জন্য নেয়া হচ্ছে। কই যাচ্ছ?  কেন যাচ্ছ?  প্রশ্ন করতে পারবে না। আমাদের ইন্ডিয়ান আর্মির ট্রাকে করে উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য জলপাইগুড়ি হয়ে শিলিগুড়ি নিয়ে গেল। সেখানে আমরা তৃতীয় ব্যাচ হিসাবে ট্রেনিং এ যোগ দেই। সেখানে সিরাজুল ইসলাম খান, তোফায়েল আহমদ, আব্দুর রাজ্জাক ভাইদের সাথে দেখা হয়। তখন তারা বললেন তোমাদের গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্লেনে নেয়া হবে, অনেক কষ্ট, যারা কষ্ট সহ্য করতে পারবে না, তাদের যাওয়ার দরকার নাই। আমরা দশজনই যেতে রাজি হই। আমাদের আর্মির পোশাক দেয়া হয়। 

ইনু ভাইরা দ্বিতীয় ব্যাচে ট্রেনিং নেন, আমরা তৃতীয় ব্যাচে ট্রেনিং শেষ করি। তারা বললেন, এটা একটা ইন্টারন্যাশনাল ক্যান্টনমেন্ট, তাই সবার মুসলিম নাম থাকা ঠিক হবে না।  তখন সেখানে আমাদের প্রত্যেককে একটি হিন্দু নাম ধারণ করতে হয়। আমার নাম দেয়া শিশির ভাদুড়ি ৷

পরবর্তিতে আমার জীবনে শিশির নামটা রেখে দেই স্মৃতি হিসাবে৷ গেরিলা ট্রেনিং এ নানা পরীক্ষা হত ৷ আমি ভাল ইংরেজি জানতাম, আমি কর্নেল মালহাতরার ইংরেজি স্পিচ ও নানা কৌশল ট্রেনিং শিট বাংলায় ট্রান্সলেট করতাম,  তাই সেখানে ও আমাকে স্কোয়াড লিডার বানানো হয়। কর্নেল মালাহাতরা আমাকে ট্রেইনার হিসাবে রেখে দেন। তখন আমার মুক্তিযোদ্ধারা  কর্নেল মালহাতরাকে অনুরোধ করেন, আমাকে নিয়ে দেশে যেতে। কারণ  সিরাজুল ইসলাম  (শিশির)  দেশে না গেলে উনার মা চিন্তা করবেন। আর তাকে ছাড়া আমরা কিভাবে  যুদ্ধ করব।  কি মনে করে কর্নেল মালহাতরা  আমাকে দেশে পাঠান৷  গেরিলা যুদ্ধারা অনেক কৌশলী, তাদের মাধ্যমেই বড় বড় অপারেশন হত। গেরিলা যুদ্ধের কৌশলেই অনেক বড় বড় সফল অপারেশন হয়েছিল।

জুয়েল সাদাত: আপনি রাজাকারদের কিভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন? বুলেট নিয়ে নাকি আপনারা শপথ নিয়েছিলেন?

ডা. শিশির:  আমি গেরিলাযোদ্ধা ছিলাম। রাজাকারদের কাছে অনেক অস্ত্র আছে, গুলি ছিল। আমি তাদের নানা ভাবে কৌশলে আত্মসমর্পণ করাই। তারা আমাদের কাছে যে কোন কারণে বা ভয়ে হউক বা জীবনের মায়ায় হউক একত্রিত হয়। তখন কোরআন শরিফের উপর আমার হাত, তারপর তাদের হাত তারপর বুলেট রেখে শপথ করালাম। শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ মেনে চলব, দেশের সাথে বেইমানি করব না। যদি করি তাহলে এই বুলেটেই যেন জীবন যায়।

জুয়েল সাদাত: আপনারা কোন জায়গায় যুদ্ধ করেছেন?

ডা. শিশির: আমরা মূলত আগস্ট থেকে ডিসেম্বর যুদ্ধ করি। আত্রাই - গুরুদাসপুর- সিংরাই পুরো এলাকাতে নানা স্কুলে স্কুলে গিয়ে আমরা দশজনই মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেই, শেষ পর্যন্ত যার সংখ্যা দাড়ায় ১৪০০ জন। তারপর আমাদের এই বাহিনী এমন আক্রমণ করে পাকিস্তানী বাহিনী পালানোর সুযোগ পায়নি। এই সময়টাই মুক্তিযুদ্ধের অনেক সফলতা আসে। আমাদের নানা কৌশলের কারণে পাক বাহিনী দুর্বল হয়ে যায়। 

জুয়েল সাদাত : আপনাদের মানে গেরিলা যুদ্বাদের লজিস্টিক সাপোর্ট কেমন ছিল।

ডা. শিশির: আসলে অস্ত্র যুদ্ধ করে না, অস্ত্রের পেছনের মানুষ যুদ্ধ করে, আবার পেছনের মানুষ যুদ্ধ করে না। একটা আদর্শকে সামনে রেখে যুদ্ধ হয়ে থাকে। একজন গেরিলা  যুদ্ধা ১০০ জন কনভেশনাল আর্মির সমান। গেরিলা যুদ্ধ হল কৌশল। আমরা রাতে ডানে বামে গুলাগুলি করতাম, তাদের ঘুমাতে দিতাম না। রাতের পর রাত  পাকিস্তানি বাহিনী ঘুমাতে না পেরে কাহিল হয়ে পড়ত। তখন তাদের আক্রমণ করলে সহজে জয়লাভ সম্ভব হত। তারপর নানা কৌশল কাজে লাগিয়ে থানার ওসিকে কাবু করে থানার গোলাবারুদ আয়ত্ব করতে হত।  গেরিলা যুদ্ধ মানে কৌশলের নানা প্রয়োগ।

জুয়েল সাদাত:  যুদ্বকালীন সময়ে কি মনে হয়েছিল যুদ্ধ জয়লাভ সম্ভব

ডা. শিশির: গেরিলা যুদ্ধ করতে প্রচুর পড়াশুনা করতে হত। আমি অনেক পড়াশুনা করেছি। যুদ্ধের ইতিহাস পড়তে হয়। আমাদের ভাষা, কৃস্টি, মানুষের দেশপ্রেম আমাদের যুদ্ধ জয়ের উৎসাহ জোগাত। আমাদের দাবিয়ে রাখা যাবে না  এই বিশ্বাস ছিল। বন্ধু প্রতীম দেশ ভারত আমাদের শেষের দিকে সহযোগিতা করেছে। তাই যুদ্ধটা দ্রুত শেষ হয়েছে। তবে তাদের সহযোগিতা ছাড়াও আমরা যুদ্ধ জয় করতে পারতাম, একটু সময় লাগত। আর পাকিস্তান বাহিনী মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল তাদের সৈন্যদের নিরাপত্তার জন্য। সেখানেও রাজনীতি থাকতে পারে। তবে আমি বা আমরা জয়ি হব এই আত্মবিশ্বাস কাজ করত।

জুয়েল সাদাত: মুক্তিযুদ্ধা, ভুয়া মুক্তিযোদ্বা রাজাকার সম্পর্কে কিছু বলেন।

ডা. শিশির: আমি আমার থানার ৩৯ নং মুক্তিযোদ্ধা। পূর্বের ৩৮ জন কোথায় যুদ্ধ করেছেন জানা নাই। সঠিক মুক্তিযুদ্বার তালিকা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা নানা রাজনৈতিক কারণে হয়নি। তবে তা করা সম্ভব। অনেকেই যুদ্ধ না করেই মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন। যা দুঃখজনক। প্রকৃত মুক্তিযোদ্বারা কিছু পাবার জন্য যুদ্ধ করেননি।

আমরা রাজাকার আল বদরদের বুঝিয়েছি, বলেছি এই নাও স্টেনগান পাকিস্তানীদের হাতে মারা যাব কেন?  তোমরা আমাদের মার। জনে জনে বুঝিয়ে তাদেরকে নিয়েই  আমাদের যুদ্ধের জন্য এগোতে হয়েছে। দেশের ভেতরের শত্রুরাই আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তাই তাদের জন্য বেশী সময় ব্যয় করতে হয়েছে। এবং পুরো মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশী ড্যামেজ তাদের মাধ্যমেই হয়েছে।

জুয়েল সাদাত: যুদ্ধ পরবর্তি সময়ে আপনার কি ভূমিকা ছিল?

ডা. শিশির: দেশ স্বাধীন হবার পর আমাদের লিডার সম্বোধন করা হত। আমাদের সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হল দেশ পুনর্গঠনে। আমরা রাজাকারদের আলবদরদের কাজে লাগালাম। বললাম যদি কারও ঘরে লুটের মাল পাওয়া যাবে তার জন্য কঠিন শাস্তি। দু'সপ্তাহের মধ্য হিন্দুদের বাড়ি ঘর পুননির্মাণ করে দেয়া হল। অনেকেই ফিরে এসে টিনের ঘর পেয়ে গেল। যাদের টিনের ঘর ছিল না অতীতে। তখন বড়লোকদের নিকট থেকে ২০০ টাকা চাঁদা নিয়ে এই কাজটা আমরা করে দেই। গমের সিড দেই, অনেকেই কৃষিতে মনোনিবেশ করেন। আমাদের এলাকাটাকে পুনর্গঠন করি।  আমি বলেছিলাম আমার ছেলেদের  রাজাকারদের পিটাইতে পারবে, জানে মারা যাবে না।  তাদের দেশ পুনর্গঠনে কাজে লাগাই। তারপর আমি ঢাকা মেডিকেলে পড়তে চলে যাই। সেখানে তখন অবাধে নকল হত। আমি স্যারদের বলি, আমরা মেধাবী ছাত্র আমাদের সহপাটিরা কেন নকল করবে। তারপর নকল বন্ধ হয়ে। সেখানে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখি। তারপর আমি বিপুল ভোটে জেনারেল সেক্রটারি নির্বাচিত হই। অভিষেকের টাকা বাঁচিয়ে ২০০০ গাছ লাগাই। যা আজও কালের সাক্ষী।  দেশ গঠনে গ্রামে ও ঢাকায় জড়িত ছিলাম  নানাভাবে।

জুয়েল সাদাত: যুদ্ধ পরবর্তি বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের তিন বছর কেমন ছিল।

ডা. শিশির: আমাদের দেশের যুদ্ধ পরবর্তি সময়টাতে কিছু টানাপোড়ন ছিল। সর্বহারা পার্টি ও সিরাজ সিকদার অন্য মোটিভ ছিল। আবার জাতির জনকের ক্লিয়ার কনসেপ্ট ছিল কিভাবে বাংলাদেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটানো যায়। বঙ্গবন্ধু তার দৃঢ়তায় একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলেছেন। আমেরিকা আমাদের কোন সময় সহযোগিতা করেনি, উল্টো বটমলেস বাস্কেট বলেছিল। আজ সেই বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। জাতির জনক তার দৃঢ়তায় দেশকে গড়ে তুলেছিলেন। যদিও তিনি তা শেষ করে যেতে পারেন নি। অনেকেই ভেবেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী যাবে না। অনেক মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছিল উনার শাসনামলে। তবে তিনি দেশকে অনেক কম সময়ে গড়ে তুলেছিলেন। কম  সময়ে সংবিধান রচনা, নিবার্চন দেয়া, রাস্তা ঘাট  ব্রিজ কালভার্ট সবাই কিছুই করতে পেরেছিলেন নিজের দৃঢ় চেতনা নিয়ে।

জুয়েল সাদাত: যুদ্ধ পরবর্তি কালে দেশ গঠনে সাধারণ মানুষদের কি ভূমিকা ছিল।

ডা. শিশির: বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করায় বাংলাদেশ এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তারপর যারা ছিলেন, তারা নিজেদের মেধা মনন কাজে লাগিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা দাড় করান। সাধারণ মানুষ দেশ গঠনে সক্রিয় ভুমিকা রাখে। মুক্তিযোদ্বার অস্ত্র আত্মসমর্পণ করে দেশের নানা কাজে মনোনিবেশ করেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত স্বাধীন দেশটাকে সকলে গড়ে তুলেন। 

জুয়েল সাদাত: আপনার সাথে যুদ্বের প্রানবন্ত গল্প শুনে মনে হচ্ছে এ রকম কখনও শুনিনি আগে। আপনার উচিত বই লেখা। সাধারণ যুদ্ধের গল্প, গেরিলা যুদ্ধের গল্প, নানা ট্রেনিং এর গল্প। আপনার অনেক বেশি বেশি লেখা উচিত।

ডা. শিশির:  জি। আমার হাতে এখন অনেক সময়। আমি লিখব৷ সিরাজুল আলম খান ও হাসানুল হক ইনু বেঁচে আছেন। আমার লেখা গুলোর ঘটনার তারা জীবন্ত উদাহরণ। আমি ক্যাস্পে গান গাইতাম তারা শুনেছেন। একবার প্রধানমন্ত্রীর সামনে তাদের সাথে দেখা তখন সেই ক্যাস্পের গল্পের কথা উঠে আসে। তারা আমার লম্বা দাড়ি দেখে চিনতে পারেন নি। আমি শিঘ্রই লিখতে শুরু করব।

জুয়েল সাদাত: আপনি কবে আমেরিকা আসেন। ধর্মীয় ব্যাপারে আপনার সিরিয়াসনেস কবে থেকে।

ডা. শিশির:  আমি ৭৭ সালে আমেরিকা আসি। আমার মা নামাজ কালামের ব্যাপারে খুব আপোষহীন ছিলেন। নামাজ না পড়লে ভাত দিতেন না। আমি  আমেরিকায় এসে ব্যাপক পড়াশুনা করে তাবলিগে জড়িয়ে যাই৷ আমি চারমাস না পুরো সাত মাস তাবলিগে এক নাগাড়ে ছিলাম। আমি অনেক দিন হসপিটালে ও প্রাকটিসের বাহিরে ছিলাম। যখন আমার হসপিটালের চাকরি চলে যাবার নোটিশ আসে তখন আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসি।

জুয়েল সাদাত: আপনাকে দেখা গেছে ভাল গান গাইতে পারেন, আবার একজন গেরিলা যুদ্ধা। আবার আপনাকে দেখা গেল তাবলিগ জামাতে জড়িত। একটু বলবেনঅনেক গুলো মসজিদ তৈরি করেছেন।

ডা. শিশির: আমি স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের ঢাকা মেডিকেল থেকে পাস করে  ডাক্তারি পেশায় মনোনিবেশ করি । তারপর ১৯৭৭ সালে আমেরিকায় আসি। তখন এখনকার মতো বিদেশে আসা সহজ ছিল না। সরকারি ক্লিয়ারেন্স পাওয়া যেত না। তারপর ৮৭ সালে ওরলান্ডো ( ফ্লোরিডা)   আমেরিকা আসি। যেখানে আমার জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটালাম। গ্যাস্ট্রোলজির উপর ডিগ্রি নিলাম। সাথে সাথে দাওয়াতে যোগ দেই। তাবলিগ জামাতে যোগ দেই  জীবনের পরিবর্তন আসে। তারপর গান টান আর গাওয়া হয় না। অনেক মসজিদ মাদ্রাসা তৈরি করি।  দাওয়াতের জন্য সারা আমেরিকা ঘুরে বেড়াই। আলহামদুলিল্লাহ আজ গ্রেটার ওরলান্ডোতে ছোট বড় ৩৮ টি মসজিদ। একটা মজার ঘটনা বলি,  ওরলান্ডো জামে মসজিদ যেটা ডিজনি এরিয়াতে, সেটা আমার যখন মাত্র ৫০ জন্য মুসল্লি ছিলাম এই শহরে তখন ১ লাখ ডলারে জায়গা কিনে সর্বমোট ৬ লাখ ডলারে তৈরি করি। ৬০০ জনে নামাজ পড়ার জন্য বানাই। অনেকে আমাকে বলে এত নামাজি হবে না। আপনি জানেন এখন সেই মসজিদটাই আমরা ৫ হাজার মুসল্লির জন্য বানাচ্ছি।

জুয়েল সাদাত: শুনেছি আপনার গ্রামের বাড়িতে অনেক বড় কারিগরি মাদ্রাসা করেছেন।

ডা. শিশির:  আসলে আমার বড় ভাই যিনি আজ আমাদের মাঝে নাই। উনি শুরু করেছিলেন। পরবর্তিতে আমরা সব ভাই বোন এটাকে বড়ো করেছি। আমি এটার সাথে বেশী সম্পৃক্ত। অনেক বৃহৎ এলাকা নিয়ে মাদ্রাসা। যা রাজশাহী বিভাগের একটি আইডল প্রতিষ্ঠান। সেখানে হাফিজদের কারিগরি ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে ৪০ জন শিক্ষকদের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট বানিয়ে দিচ্ছি। তারা পরিবার পরিজন নিয়ে মাদ্রাসায় থাকবেন, ছাত্রদের পড়াশুনাটাও ভাল হবে। যা বাংলাদেশে প্রথম। শিক্ষকরা ফ্রি থাকার বাসস্থান পাচ্ছেন। পুরো প্রজেক্টটি বিশাল এলাকা জুড়ে। এখানে আমি একটি আন্তর্জাতিক মানের লাইব্রেরি করব, যা হবে রাজহাশী বিভাগের অন্যতম। অনেক বই কেনা হচ্ছে। ভবিষ্যতে হাজার হাজার কোরআনে হাফেজ বের হবেন, উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে। বর্তমানেও হাফেজ বের হচ্ছেন। পুরো কমপ্লেক্সটা বিরাট এলাকা জুড়ে।

জুয়েল সাদত: আপনি হোপ ফাউন্ডেশনের সাথে যুক্ত আছেন, কি কি কাজে আপনারা জড়িত।

ডা. শিশির: আমার প্রিয় মানুষ, ডাক্তার ইফতেখার মাহমুদ হোপ ফাউন্ডেশন তৈরি করেন ১৯৯৮ সালে। আমি এটার বোর্ড অব ডাইরেক্টর। কক্সবাজার ও রামুতে আমাদের ৪০ বেডের হসপিটাল আছে। আমরা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছি। ডাক্তার ইফতেখার আমাকে বড় আকারে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। হোপ ফাউন্ডেশেনর সাথে ১৬০০ ডাক্তার নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী জড়িত।

জুয়েল সাদাত: আপনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক। একটু যদি বলেন।

ডা. শিশির: শেখ কামালের সহপাটি হিসাবে সম্পর্কটা অনেক কাছের। যখনই তিনি আমেরিকায় আসতেন আমার তত্বাবধানেই উনার চিকিৎসা হত। একবার উনার গল্ডব্লাডার  অপারেশন হল, উনার ইচ্ছানুযায়ী আমি অপারেশন থিয়েটারে ছিলাম। সারা রাত পাশেই ছিলাম। শেখ রেহানা তখন শেখ হাসিনাকে জানান আমি বাড়ি যাইনি সারা রাত পাশে ছিলাম ৷ ভাইয়ের মতো সম্বোধন করেন। আমি গ্যাস্ট্রোলজির ডাক্তার একবার আপাকে বললাম, বাংলাদেশে গ্যাস্ট্রোলজির একটি বিশেষ হসপিটাল করতে পারলে ভাল  হত। তখন তিনি বলেছিলেন যদি সরকারে যাই তখন করব৷ তারপর ২০০৮ সালে তিনি  সেটার কাজ শুরু করেন। আমি এর শুরু থেকে জড়িত ছিলাম ৷ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমাকে থাকতে হয়েছিল। আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন, সেই হসপিটালটা ভাল চলছে। বৃটিশ একটি টিম সম্প্রতি ভিজিট করে এটাকে লন্ডনের চাইতেও ভাল বলে রিপোর্ট করেছেন।

আমি যেহেতু দীর্ঘদিন থেকে উনার শারীরিক সুস্থতা অসুস্থতা নিয়ে নিবেদিত। তাই তিনি আমার পরামর্শকে গুরুত্ব দেন। সেভাবেই আমার পরামর্শে  আলহামদুলিল্লাহ তিনি ভাল আছেন। আপনারা জেনে খুশি হবেন উনার বড় কোন শারিরীক অসুবিধা না।

জুয়েল সাদাত: একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে দেশের বর্তমান উন্নতিকে কিভাবে দেখেন। মুক্তিযোদ্বাদের ভাতা বেড়েছে কেমন বোধ করেন?

ডা. শিশির: স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে দেশের আশাতিত উন্নতিতে মনে হয়ে স্বাধীনতার সুফল আমরা পেয়ে গেছি। যা দেখে আমি নিজে গর্বিত। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের নিকট রোল মডেল। মুক্তিযোদ্বাদের ভাতা বেড়েছে, আজ মুক্তিযোদ্ধারা  নিজেকে অসহায় বোধ করেন না। তারা গৃহঋণ পাচ্ছেন। নানা রকম পন্থায় মুক্তিযোদ্বাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে, সেটা দেখে আনন্দিত হচ্ছি। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।

জুয়েল সাদাত:  আপনার নিকট বাংলাদেশের এই মুহূর্তে বড়ো সমস্যা কি?

ডা. শিশির: আমাদের দেশের ডেভেলপমেন্ট দেখে বিশ্বের অনেক দেখ স্তম্ভিত। জাতীসংঘ বাংলাদেশের উন্নতিকে রুল মডেল হিসাবে দেখাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক- জাতিসংঘ এর কাছে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনার নাম। তবে এখন নতুন প্রজন্মকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে হবে। যদি দুর্নীতিকে কমিয়ে আনা যায় তাহলে দেশ আরো এগিয়ে যাবে। দুর্নীতি বর্তমানে অসহনীয় পর্যায়ে, সেটাকে জিরো টলারেন্স নিয়ে আনতে হবে। তবে সম্ভাবনার বাংলাদেশ। আমাদের দেশটা আসলেই সোনায় মোড়ানো। সোনার বাংলায় সোনা ফলতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের একটি পজেটিভ রোল মডেল।

জুয়েল সাদাত - আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?

ডা. শিশির: আমি এই বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশে যাব। স্থায়ী ভাবে বসবাস করার ইচ্ছা। সেখানে অনেক কাজ, অনেক বড় বড় প্রজেক্ট অসমাপ্ত সেগুলোতে মনোনিবেশ করব। দেশের মাটিতে শেষ জীবন কাটাতে চাই। একটি গান আছে " তোরা দে না, দেনা, সেই মাটি আমর অঙ্গে " আমি সেই মাটিতেই ফিরে যেতে চাই। আমি আমার পিতা মাতার কবরের পাশেই থাকব। আমর জন্য দোয়া করবেন। যদি নিজের অজান্তে কোন ভুল ভ্রান্তি হয়ে থাকে তার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। 

জুয়েল সাদাত: আপনাকে ধন্যবাদ।

ডা.শিশির:  আপনাকেও ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ।

লেখক: জুয়েল সাদাত, সাংবাদিক কলামিস্ট, আমেরিকা, ফ্লোরিডা

  বিজয়ের ৫০ বছর

পাখি ও বন্যপ্রাণীদের দুঃসময়



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
সুন্দরবনের বিপন্ন প্যারাপাখি। ছবি: সংগৃহীত

সুন্দরবনের বিপন্ন প্যারাপাখি। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

জলবায়ু পরিবর্তনে পাখিদের সংখ্যা কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। কমেছে পাখির আবাসস্থল। ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হচ্ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী।

বৈশ্বিক পাখি বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৪২ হাজার প্রজাতি হুমকির মুখে আছে, যা মোট প্রজাতির প্রায় ২৮ ভাগ। বিগত দুশো বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমে গেছে প্রায় অর্ধেক। এভাবে চলতে থাকলে আগামী একশ বছরের মধ্যে এই বন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

সুন্দরবনের খয়রাপাখা মাছরাঙা পাখি। ছবি: সংগৃহীত

প্রকৃতি বিশেজ্ঞরা বলছে, বনের ওপর মানুষের অধিক নির্ভরশীলতার কারণে ক্রমান্বয়ে এর আয়তন অতি দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসছে। বনের আয়তনের সাথে সাথে হ্রাস পাচ্ছে এর জীববৈচিত্র। সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ, ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি এবং ৫ প্রজাতির স্তনপায়ী প্রাণী হুমকির মুখে। জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সুন্দরবনে একাধিক অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হলেও কাজে আসছে না তার সুফল।

পাখি বিশেজ্ঞরা বলছেন, এক দিকে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনে পাখি সংখ্যা কমলেও ভারত অংশে সুন্দরবনে পাখির সংখ্যা বাড়ছে। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের পাখি-বৈচিত্র্যের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ‘জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’। ‘বার্ডস অফ দ্য সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার’ নামের সেই বইটিতে এই অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রতিটি পাখি প্রজাতির ছবি-সহ বিশদ বর্ণনা নথিভুক্ত হয়েছে।

‘বার্ডস অফ দ্য সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার’ নামক বই।

বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ৪২০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে সুন্দরবনে পরিযায়ী ও স্থানীয় পাখি মিলিয়ে রয়েছে ৪২৮টি প্রজাতি। দেশে প্রাপ্ত ১২টি প্রজাতির মাছরাঙার ৯টিরই দেখা মেলে এই অঞ্চলে। সেইসঙ্গে গোলিয়াথ হেরোন, স্পুনবিল স্যান্টপিপার, হুইমবেল, লার্জ ইগ্রেট, টেরেক স্যান্ডপিপার, প্যাসিফিক গোল্ডেন প্রোভারের মতো বিরল প্রজাতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে এই অঞ্চলে।

যা ইতিবাচক দিক হিসেবেই মনে করছেন ভারতের প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। ভারতে বর্তমানে ১৩০০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। যার প্রায় এক তৃতীয়াংশই বাসিন্দা সুন্দরবনের। বৈচিত্র্যের নিরিখে গোটা ভারতের মধ্যে যা রয়েছে শীর্ষস্থানে। আবাসস্থল ও অবাধে চলাচলের জন্যে বাংলাদেশ অংশের পাখিরা ভারত অংশের সুন্দরবনে নিজেদের নিরাপদ মনে করছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

অন্যদিকে, কমতে থাকায় বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর প্রজাতির সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ১০০। এর মধ্যে পাখি প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৭২১। বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর অবস্থা কী - তা দেখার জন্য ২০১৫ সালে প্রকাশিত আইইউসিএন এর ‘লাল তালিকা’ দেখা যেতে পারে। সেখানে রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রায় ১২৫ প্রজাতির বন্য প্রাণী হুমকি বা বিলুপ্তির মুখে আছে, যা মোট প্রজাতির প্রায় ১৪ ভাগ। গত ১০০ বছরে প্রায় ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী হারিয়ে গেছে, যা এ দেশের মোট বন্যপ্রাণীর প্রায় ২ ভাগ।

  বিজয়ের ৫০ বছর

;

হাকালুকিতে কম এসেছে পরিযায়ী পাখি



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
হাকালুকিতে পাতি-সরালির ঝাঁকও কমে গেছে। ছবি: এবি সিদ্দিক

হাকালুকিতে পাতি-সরালির ঝাঁকও কমে গেছে। ছবি: এবি সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

হাকালুকিতে পাখি শিকারিদের কারণে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা দিন দিন কমছে। যার কারণে হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য অনেকটাই হুমকির মুখে।

হাওরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, নদী দূষণ, জাল বিষ টোপ ও পটাশ দিয়ে পাখি শিকার। একসঙ্গে বেশ কয়েকটি বিলে মাছ আহরণ, বিল শুকিয়ে মাছ নিধন, বিলে ২৪ ঘণ্টা পাহারা ও জলজ বৃক্ষ নিধনসহ রয়েছে নানান সমস্যা।

চলতি বছরের শীত মৌসুমের পাখিশুমারিতে সে তথ্যই জানান দিয়েছে। জানুয়ারি মাসের ২৮ ও ২৯ তারিখ দু’দিন ব্যাপী হাকালুকি হাওরে করা হয় পাখি শুমারি করে বন বিভাগ, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) যৌথ উদ্যোগে এ শুমারি করে।

বাংলাদেশে ৭১৮ প্রজাতির পাখির মধ্যে ৩৮৮ প্রজাতির পাখিই পরিযায়ী। এরা শীতকালে পরিযায়ী হয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে আসে বাংলাদেশে। আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয় হাকালুকি হাওরের মতো জলাশয়। প্রায় ১৮১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ হাওরে রয়েছে ছোট-বড় ২৭৬টি বিল। পাখিশুমারিতে তাদের জরিপে হাকালুকিতে এ বছর এসেছে প্রায় ২৫ হাজার পাখি। যা বিগত বছর থেকে অনেক কম। যা ২০২০ সালে ছিলো প্রায় ৪০ হাজার ১২৬ পাখি। মাত্র কয়েক বছর আগে দেশে ৫-৬ লাখ পরিযায়ী পাখি আসতো। এসব পাখির বেশিরভাগ মৌলভীবাজার ও সিলেটের হাওরে অবস্থান করতো।

যুগল বেগুনি কালেমের সৌন্দর্য। ছবি: এবি সিদ্দিক

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) এর পর্যবেক্ষণ বলছে, গত ২০ বছরে সারা বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমেছে ৩৫ শতাংশ। হাকালুকিতে কমেছে ৪৫ শতাংশ। ২০০০ সালের আগে হাওরে বিচরণ করতো প্রায় ৭৫-৮০ হাজার পাখি। তার ৮০ শতাংশই হাকালুকি হাওরে ছিলো।

পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাকালুকি হাওরে যে নদীগুলো মিলিত হয়েছে এখন সেই নদীগুলো প্লাস্টিক, পলিথিন, দূষিত পানি ও ময়লার ভাগাড়। পাখি কমার বিশেষ কয়েকটি কারণের মধ্যে এটি একটি। অরক্ষিত থাকায় দিন দিন কমেছে পাখির সংখ্যা। হাওরের পরিযায়ী পাখি রক্ষায় স্থানীয়দের সচেতনতা বৃদ্ধি করা, পাশাপাশি প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা থাকতে হবে। এতেই বাঁচবে পাখি।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, সিলেট এর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, প্রতি বছর হাওরে বিল ইজারা দেওয়া হয়। এ বছরও হয়েছে। এতে বেশ লোকসমাগম ঘটে। দিনরাত পাহারা দেওয়া হয়। এসব কারণে পরিযায়ী পাখিরা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে না। বিল শুকিয়ে মাছ আহরণের কারণে নষ্ট হচ্ছে হাওরের জীববৈচিত্র্য। ফলে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমছে।

  বিজয়ের ৫০ বছর

;

লালসবুজ রঙের পাখি ‘সেকরা-বসন্ত’



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
আপন মনে গাছের ডালে বসে আছে সেকরা-বসন্ত। ছবি: এবি সিদ্দিক

আপন মনে গাছের ডালে বসে আছে সেকরা-বসন্ত। ছবি: এবি সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

ছোট আকারের লাল-সবুজ রঙের বর্ণিল পাখি ‘সেকরা-বসন্ত’। এ পাখিটির ইংরেজি নাম Coppersmith Barbet এবং বৈজ্ঞানিক নাম Psilopogon haemacephala. এরা কাপিটোনিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত মেগালাইমা গণের এক প্রজাতির সুলভ পাখি। এরা বাংলাদেশের স্থানীয় পাখি।

এদের দেশের সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়। IUCN এই প্রজাতিটিকে Least Concern বা শঙ্কাহীন বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে এরা Least Concern বা শঙ্কাহীন বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বলেন, সেকরা-বসন্ত আকারে ছোট হয়। মাত্র ১৭ সেন্টিমিটার। দেহ মূলত সবুব। তবে এদের কপাল লাল রঙের। চোখের চারপাশে হলুদ দাগ দেখা যায়। গলার নিচে রঙিন দাগ দেখা যায়। দেহের উপরের অংশ সবুজ। ঠোঁট কালো এবং পা লাল বর্ণের হয়ে থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ই দেখতে একই। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির গায়ের রঙ মলিন এবং এদের দেহে কোন লাল দাগ দেখতে পাওয়া যায় না।

তিনি আরও বলেন, সেকরা বসন্ত সাধারণত একা, জোড়ায় বা ছোট দলে চলাফেরা করে। এদেরকে বাগানে, বনে বাদাড়ে দেখতে পাওয়া যায়। এরা বড় গাছের মগডালে রোদ পোহায়। গাছের গর্তে বাসা বানায় এবং সেখানে বিশ্রাম নেয়। শুষ্ক মরুভুমি ও জলাখভূমির বনে এদের সহজে দেখা যায় না।

পাখিটির খাবার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই প্রজাতির পাখিরা সাধারণত ফলাহারী। তবে এরা মাঝে মধ্যে পোকা বিশেষ করে উইপোকা খেয়ে থাকে। এদের খাদ্য তালিকায় থাকে বট গাছের ফল, জংলি গাছের ফল, জলপাই জাতীয় ফল এবং বেরি জাতীয় ফল। এরা ফুলে পাপড়িও খেয়ে থাকে।

সেকরা বসন্তের প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। এরা গাছের সরু ডালের নিচে গর্ত করে বাসা বানায়। স্ত্রী পাখি একসাথে ৩ থেকে ৪ টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলিতে তা বাবা পাখি ও মা পাখি উভয়ই দিয়ে থাকে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে প্রায় ২ সপ্তাহ সময় লাগে বলে জানান এ পাখি বিশেষজ্ঞ।

  বিজয়ের ৫০ বছর

;

বিপদ টের পেলে ঝোপের মাঝে লুকিয়ে পড়ে ‘বাংলা কুবো’



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,
বাংলা কুবোর উড়ন্ত সৌন্দর্য। ছবি: এবি সিদ্দিক

বাংলা কুবোর উড়ন্ত সৌন্দর্য। ছবি: এবি সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

বিপদের টের পেলে পাখিটি ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। কখনো ছোট দূরত্বে উড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে বাঁশবনে। তখন আর কেউ তাকে দেখতে পায় না।

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে অন্যতম এক পাখি ‘বাংলা কুবো’। বিভিন্ন বন-জঙ্গল তথা শালবন এবং চা বাগানে এদের বসবাস। অঞ্চলভেদে এ পাখির নাম কুবো, কুক্কা নামেও পরিচিত।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কমরুল হাসান বলেন, এই পাখিটির নাম অন্যান্য বাংলা নামগুলো হলো কানকুয়া, কুক্কা, ছোট কোকা, কুক্কাল বা কানাকুক্কা। ইংরেজিতে একে Lesser Coucal বলে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Centropus bengalensis। কুবো মাঝারি গড়নের ভূচর পাখি। এদের লম্বা ও শক্তিশালী পা এবং লম্বা লেজ থাকে। এরা উড়তে পটু নয়। ছেলে ও মেয়েপাখি দেখতে একই রকম। বড় কুবো কালো ও তামাটে রঙের লম্বা লেজওয়ালা পাখি। দেহের দৈর্ঘ্য ৪০ সেমি, ওজন ২৫০ গ্রাম। পিঠ তামাটে ও দেহতল চকচকে কালো। এ রকম দুটো প্রজাতি আমাদের দেশে পাওয়া যায়, একটি হলো বাংলা কুবো অপরটি বড় কুবো।

পাতার আড়ালে বাংলা কুবো। ছবি: এবি সিদ্দিক

পাখিটির স্বভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, ভূচর এ পাখি ওড়ার চেয়ে দৌঁড়াতে বেশ পটু। বাঁশঝাড়ে বসে থাকে চুপ করে। নিজেকে সবার থেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করে। এরা একটু লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। প্রয়োজনে এরা মাটিতে নেমে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঘন ঝোপ, বাঁশবন ও খেজুরগাছের আগায় পেয়ালার মতো বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সাদা, সংখ্যায় তিন-চারটি। বনপ্রান্তে ও গ্রামাঞ্চলে এদের ঢের দেখা যায়। উঁচু ঝোপের মধ্য অগোছালোভাবে বাসা তৈরি করতে পছন্দ করে।

শারীরিক গঠন সম্পর্কে তিনি বলেন, উজ্জ্বল তামাটে কাঁধ-ঢাকনি ও ডানা ছাড়া পুরো দেহই কালো। চোখ লাল, ঠোঁট, পা, পায়ের পাতা ও নখর কালো। সাধারণত একা বা জোড়ায় বিচরণ করে। মাটিতে ধীরে ধীরে হেঁটে শিকার খোঁজে। ঝোপের তলায় তলায় ঘুরে ওরা যখন খাবার খোঁজে, তখন দীর্ঘ পুচ্ছটি প্রায় মাটি ছুঁয়ে থাকে।

বেশ গভীর ও সুরেলা কণ্ঠে ধীরে ধীরে উক...উক... শব্দে ডাকে। অন্য রকম একটি ডাকও শোনা যায়। খুব দ্রুত সংগীতের ঝংকারের মতো কুপ..কুপ..কুপ করে ছয়-সাতবার ডাকে। গরমের দিনে বহুদূর থেকে ওদের ডাক শোনা যায় বলে জানান এ বন্যপ্রাণ গবেষক।

  বিজয়ের ৫০ বছর

;