কোলাজ মন্তাজ (শেষ পর্ব)

রাইটার্স ব্লক



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

সাহিত্যিক লিখতে চান। কিন্তু পারছেন না লিখতে। কী সমস্যা? লেখা কোনোভাবেই আসছে না। একেই ইংলিশে বলে ‘রাইটার্স ব্লক’। বাংলায় কী বলা যায়? লেখকের বন্ধ্যাত্ব! ঘটনাটি কেমনভাবে ঘটে দেখা যাক।

মার্শেল প্রুস্তের ‘ইন সার্চ অব লস্ট টাইম’-এর প্রথম খণ্ড বেরিয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশকের কাছে জমা দেওয়া কিন্তু তৃতীয় খণ্ড লেখার সময় ১৭ পৃষ্ঠা লিখে আটকে গেলেন এক শীতের রাতে। টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। তিনি পরপর তিনটা চুরুট শেষ করলেন রিভলভিং চেয়ারে বসে হেলেদুলে। কিন্তু না একটি কালো অক্ষরও বেরুলো না তার কলম থেকে। উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দূর পাহাড়ের দিকে অন্ধকার দেখলেন। একটু ওয়াইন খেলেন। না কাজ হচ্ছে না। শ্বাসকষ্ট যেন বাড়ছে। ভাবলেন, ছোটবেলার হাঁপানি রোগটা কি তাড়া করে আসছে কিনা! শুয়ে পড়লেন। পরদিন সকালে বসলেন লিখতে। হলো না। এভাবে পাক্কা নয়দিন কেটে গেল। না পারছেন কিছু লিখতে, না পারছেন অন্য কোনো কাজে মনোযোগী হতে। দশমদিনে তিনি পাক্কা চারঘণ্টা ফুন্তে শহরে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ালেন। সেইরাতে লিখতে বসলেন। কালো কালো অক্ষরগুলো আবার ঝরতে থাকল তার কলমে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার আত্মজীবনীর এক জায়গায় লিখেছিলেন, সেদিন সকাল থেকেই মাথায় লেখাটা চেপে বসেছিল। তাই সকালে মা বাজারে যেতে বললেও আর যাননি। বিশেষ করে লেখার চেয়েও বেশি ভাবনা ছিল কড়া রোদ নিয়ে। ফিরতে ফিরতে রোদ চড়ে যাবে সেই ভয়েই বাজারে যাননি। কিন্তু বেলা বারোটায় যখন সিগারেটের প্যাকেটের শেষ কাঠিটায় আগুন ধরালেন তখন তার মাথায়ও যেন আগুন ধরল। লেখা আর এগোয় না। তখন তিনি সেই কড়া রোদ মাড়িয়ে গিয়ে সিগারেট আনতে গেলেন। এরপর ফিরে এসে ওই লেখা টানা চারদিন লিখতে পারেননি। ওই একবারই হয়েছিল তার এ সমস্যা।

ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির ‘শাইনেস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক বার্নার্ডো কার্দুসি বলেছেন, “রাইটার্স ব্লকের নমুনা লেখকভেদে ভিন্ন ভিন্নরকম হয়। ফলে সমস্যার বিষয়ে—যাদের হয়, তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে যারা হুট করে লেখালেখি একেবারেই ছেড়ে দেন সেটি ঘটে লেখকের নিত্য আবিষ্কারের নেশার ঘোর কেটে গেলে।”

আমাদের মাহমুদুল হকের ঘোরও কি তবে কেটে গিয়েছিল? জীবন আমার বোন, কালো বরফ, নিরাপদ তন্দ্রা, খেলাঘর, অনুর পাঠশালা, মাটির জাহাজ প্রভৃতি উপন্যাস আর ‘কালো মাফলার’, ‘প্রতিদিনি একটি রুমাল’, ‘হৈরব ও ভৈরব’ প্রভৃতি গল্পের আমাদের মাহমুদুল হক একসময় লেখালেখি ছেড়েই দিয়েছিলেন। সারাদিনরাত ঘরেই বসে থাকতেন। কোথাও যেতেন না। কারো সাথে মিশতেন না। তিনি এক ইন্টারভিউতে বলেন, “আমি তো সবসময় বিশ্বাস করে এসেছি, শিল্পীদের লোভ থাকতে নেই। লোভ থাকলে শিল্প হয় না। আমি শুধুমাত্র সাহিত্য জগতের ভণ্ডামি দেখে লেখালেখি থেকে দূরে সরে এসেছি, সেটা বলা ঠিক হবে না। এটা একটা কারণ ছিল বটে, তবে আরো কারণ নিশ্চয়ই আছে। আগেই তো তোমাকে বলেছি, আমি শেষের দিকে এসে একঘেঁয়েমিতে ভুগছিলাম। আর তাছাড়া একটা সময় এসব কিছুকেই ভীষণ অর্থহীন মনে হচ্ছিল আমার কাছে। কী করছি, কেন করছি, এসবের ফলাফল কী, আদৌ এসব করার কোনো অর্থ হয় কি না, এই সব আর কি! সব মিলিয়ে লেখালেখিটা আর ভালো লাগেনি। অবশ্য একবারে পরিকল্পনা করে, সিদ্ধান্ত নিয়ে লেখালেখি বন্ধ করেছিলাম তা নয়। এরকম তো সব লেখকেরই হয় যে, মাঝে মাঝে ক্লান্তি আসে, মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করে, মাঝে মাঝে বন্ধ্যাত্বও দেখা দেয়। আমার সেটাই হয়েছিল। কিন্তু সব লেখকই সেই সময়টি পেরিয়ে আবার লেখালেখিতে ফিরে আসেন। আমার আর ফিরে আসা সম্ভব হয়নি।”

রাইটার্স ব্লক থেকে পার পাননি বহু বিখ্যাত লেখক। ভারতের কমলকুমার মজুমদারও এ সমস্যায় ভুগে লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন। স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ, ফিটজেরাল্ড, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ভার্জিনিয়া উলফ, লিও টলস্টয়, জোসেফ কনরাড প্রমুখ প্রবাদপ্রতিম লেখকদেরও রাইটার্স ব্লকের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ উইলিয়াম ওর্ডসওর্থের সাথে ‘লিরিকাল ব্যালাডস’ লিখেছিলেন। তার প্রায় সকল কবিতাই বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে লেখা হয়েছে। এর পরবর্তী সময়ে যে কোনো লেখার প্রতিই তার একপ্রকার অনীহা লক্ষ করা যায়। তার অবশিষ্ট জীবন তিনি আফিম সেবন করে কাটান। তার এক বন্ধু তার কাছে একবার জানতে চেয়েছিলেন, কেন তিনি আর আগের মতো লেখেন না। উত্তরে কোলরিজ বলেছিলেন, “প্যারালাইসিস আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ হবার জন্য তার দুই হাত একসাথে ঘষা একই কথা।” মাত্র ৩২ বছর বয়সে তার জন্মদিনের পরের দিন নোটবুকে তিনি লিখেছিলেন, “So completely has a whole year passed, with scarcely the fruits of a month.—O Sorrow and Shame. . . . I have done nothing!”

এবার যে গল্পটি শোনাব সেটি অনেক রহস্যময়। পড়ে ভাববেন এমনও হয়! জোসেফ মিশেল একসময় একজন নিজেকে সেরা কল্পকাহিনীলেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। নিউইয়র্কার ম্যাগাজিনে তার সব লেখা প্রকাশিত হতো। মজার ব্যাপার তিনি এত খ্যাতি পেয়েছিলেন অন্য এক রাইটার্স ব্লকে আক্রান্ত হওয়া লেখকের ডায়েরি লিখে। সেই ডায়েরিটি ছিল জো গুল্ড নামের আরেক বিখ্যাত লেখকের। জো গুল্ড ‘প্রফেসর সি-গাল’ হিসেবেও সাহিত্যমোদীদের কাছে পরিচিত। তো, জো গুল্ড একসময় দাবি করেছিলেন, ‘ওরাল হিস্টোরি’ হচ্ছে সবধরনের ইতিহাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। ‘ওরাল হিস্টোরি’র মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন তার সমসাময়িক মানুষ ও আশেপাশের সবকিছুর দৈনন্দিন জীবনকে লেখনীতে প্রকাশ করা। জোসেফ মিশেল অত্যন্ত আকর্ষণ বোধ করেন জো গুল্ডের এমন কথায়। তিনি জো গুল্ডকে নিয়ে একটি বই লিখে ফেলেন। নাম, ‘জো গুল্ড’স সিক্রেট’। এ বইতে জো গুল্ডের জীবনী উঠে আসে। এ বই থেকে জানা যায়, জো গুল্ড আসলে ওরাল হিস্টোরি বলে কিছু লেখেনইনি কখনো। তিনি যা লিখেছেন তা শুধুই তার প্রতিদিনের রুটিন। কখন ঘুম থেকে উঠতেন, কী নাস্তা করতেন, আর কী কী করতেন এমনকি সেক্সের বিষয়ও। এ বইটি ছিল ৯ কোটি শব্দের। কিন্তু কথা হলো জো গুল্ড মারা যাবার পর জোসেফ মিশেল বইটি লেখেন। জো গুল্ড লেখক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন এবং একসময় লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছিলেন। আর সেই লেখালেখি করবেন না বলে অজুহাত দিতেন যে ওরাল হিস্টোরিই আসল। রহস্য কিন্তু তারপরও আছে। কারণ জোসেফ মিশেল ‘জো গুল্ডস সিক্রেট’ লেখার পর আর একলাইনও লিখতে পারেননি। এমনকি এ বইটিও প্রকাশ করতে পারেননি। দিনরাত মদ খেতেন না লিখতে পারার বিষণ্ণতায়। তার অন্য অপ্রকাশিত লেখার সাথে এ বই সংগ্রহ করা হয় এবং ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয়। জোসেফ মিশেল ১৯৯২ সালে ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছিলেন, “জো গুল্ডের সাথে এত বছর কথা বলতে বলতে একভাবে সে আর আমি একই ব্যক্তি হয়ে গেছি।” রীতিমতো সাসপেন্স।

সাসপেন্স কম নয় হার্পার লি-র সাহিত্য জীবনে। আমেরিকার বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে ১৯৬০ সালে হার্পার লি লিখেছিলেন উপন্যাস ‘হাও টু কিল অ্যা মকিংবার্ড’। ৪০টি ভাষায় অনূদিত হয় এই বই। পুলিৎজার পুরস্কার জেতেন। প্রকাশকদের ভিড় তার দরোজায়। কিন্তু একি হায় তিনি লিখতে পারছেন না আর। ওই বইটিই ছিল তার প্রথম ও শেষ সাফল্য। প্রকাশকদের অগ্রীম দেওয়া টাকা ফিরিয়ে দিচ্ছেন। তারা ভাবছেন এক বই লিখে এত দেমাগ কেন। কিন্তু হারপার লি-র কী আর করার ছিল। তিনি পরাজিত। ২০১৫ সালে, তার ৮৯ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তার উপন্যাস ‘গো সেট অ্যা ওয়াচম্যান’। এটি ‘হাও টু কিল অ্যা মকিংবার্ড’-এর আগেই লেখা হয়েছিল।

হারপর লি তার এক বন্ধুর কাছে বলেছিলেন, “আমি আর লিখতে পারছি না। আমার প্রায় ৩০০ জন বন্ধু রয়েছে যারা প্রায়ই কফি পানের ছুতোয় চলে আসে। আমি ভোর ৬টায় ওঠার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তখন সব ৬টায় জাগা ব্যক্তিরা এক জায়গায় জড়ো হয়!” হার্পার লি একা সময় পাচ্ছিলেন না এবং তার লিখতে না পারার পেছনে তিনি এই ভিড়বাট্টাকে দায়ী করেছিলেন। ২০১৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তবে আরেকটা গল্প বলি, সেটি হচ্ছে ইসরাইলী লেখক ইবাদি খোরাসানকে নিয়ে। তিনি ২০০১ সালে একটি বই বের করলেন, বইটির নাম, ‘ট্রাভেলার’। মানে ইংরেজি নাম এটি। অনুবাদক জেমস লয়েড। ওই বছর বেশ বিক্রি হলো বইটির। কিভাবে জানি এক বোদ্ধা পাঠক তার বিরুদ্ধে মামলা করলেন আলবেয়ার কামুর আউটসাইডার ও খলিল জিবরানের দ্য প্রোফেট বইয়ের ভাব মিশিয়ে নকলের। প্রমাণিতও হলো। এরপর আদালতে ইবাদি খোরাসান এটি স্বীকার করলেন। সেই যে আর লিখতে পারলেন না। পারলেনই না। ২০১৫ সালে নদীতে ঝাঁপিয়ে সুইসাইডই করলেন তিনি। কারণ তার লেখকখ্যাতি ছিল ঈর্ষণীয়। কিন্তু ওই মামলার পর থেকেই তিনি আর লিখতে পারেননি।

১৯৯১ সালে টাইম ম্যাগাজিনে ‘রাইটারস ব্লকের ৩০ বছর’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধটি পাবেন তাদের আর্কাইভে গেলে। সেখান থেকে জানতে পারি হারোল্ড ব্রডের গল্প। নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনের স্বনামধন্য ছোটগল্প লেখক, যার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য রানওয়ে সোল’। এর আগে ছোটগল্প লিখে নাম কুড়িয়েছিলেন। কিন্তু যেই ‘দ্য রানওয়ে সোল’ উপন্যাসটি লিখতে গেলেন শুরু হলো যতসব বিপত্তি। বারবার লেখেন। বারবার কাটেন। একসময় দেখেন আর লিখতেই পারছেন না। মানে উপন্যাসের শেষ পরিণতি টানতে পারছেন না। বিশ্বাস করেন, এ বইটি প্রকাশিত হতে লাগে ৩০ বছর! কিন্তু ৩০ বছর ধরে তিনি লড়াই করে যান তার উপন্যাসটিকে শেষ করতে। ১৯৯১ সালে প্রকাশ পাওয়া ৮৩৫ পৃষ্ঠার দীর্ঘ এই উপন্যাসট জনপ্রিয়ও হয়নি। সমালোচকরাও বিরূপ সমালোচনা লেখেন। পরে এইডসে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৬ সালে মারা যান। অবশ্য অসুস্থ জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘দিস ওয়াইল্ড ডার্কনেস: দ্য স্টোরি অফ মাই ডেথ।’ সেই বইটি অবশ্য পাঠকপ্রিয় হয়েছিল।

রাইটার্স ব্লককে এড়িয়ে চলার জন্য গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজ বলেছিলেন, “তাড়াহুড়ো করে শেষ করার দরকার নেই। আপনি খেলছেন আপনমনে। এমনভাবে লিখে যান। তবেই সমস্যা হবে না।” স্টেফান কিংয়েরও ওইরকমই কথা, তিনি বলেছেন, “আটকে গিয়েছি, ঠিক আছে, অন্য কিছুতে মন দিই, তা লেখালেখি না-ও হতে পারে। সেক্সের সময় যদি তীব্র উত্তেজনা কাজ করে তবে যেমন সফল সঙ্গম হয় না তেমনই লেখালেখিতে অতি সিরিয়াস হওয়ার দরকার নেই। যা হওয়ার হবে তো। এ মুডে লিখলেই আর সমস্যা নেই।” মারিও ভার্গাস য়োসার কথা আবার এদের চেয়ে ভিন্ন। তিনি বলেছেন, “লিখতে পারছি না, তাই বলে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ব, কখনো না। জোর করে প্রেরণা-ট্রেরনা ছাড়াই লিখে যাব, পরে দেখা যাবে।” তার কথার সঙ্গে মিলে যায় উইলিয়াম ফকনোরের কথা। ফকনোর বলছেন, “লেখা তো আর আধ্যাত্মিক কিছু না। যে আজ পারব কাল পারব না! লেখালেখি একটা টেকনিক। সেই টেকনিকটা রপ্ত করেন। দেখবেন আপনার কোনো সমস্যা নেই।” ফকনোরের মতোই যেন মার্কিন কবি উইলিয়াম স্ট্যাফোর্ডের কথা। তার কথা, “এ রোগে সবাই কেন আক্রান্ত হবে? যাদের কল্পনাশক্তি দুর্বল, মেধা অল্প, যাঁদের লেখার মান যথেষ্ট নিচু (লো এনাফ) তাদের জন্য এ সমস্যা।” এরমানে কি তবে রবীন্দ্রনাথ, লিও টলস্টয়, বোদলেয়ার, ভারতের সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ বা আমাদের দেশের আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে মেধাবী সাহিত্যিক বলব না? কেন বলব না? আলবত বলব। এখানে উইলিয়াম স্ট্যাফোর্ডের বা ফকনোরের কথাকে ইগনোর করব আমরা। রবীন্দ্রনাথ এসব সমস্যা কাটাতেন যখন তার গদ্য বা কবিতা লিখতে সমস্যায় ভুগতেন তখনই গান লিখে। এ কাজটি আমাদের দেশের হুমায়ূন আহমেদও করেছেন। তিনি লেখালেখিতে যাতে একঘেয়েমি না আসে সেজন্য নাটক, মুভি বানাতেন, এমনকি গানও লিখেছেন। এসব কথা তিনি তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন। আমরা দেখি অনেক বিখ্যাত লেখকই এই সমস্যা দ্রুতই কাটিয়ে ওঠেন। তাদের কাজ সেরা কি না সেটাই বিবেচ্য। মার্কেজ ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লিখে না’—এই ছোট লেখা লিখতেই সময় নিয়েছিলেন চার বছর। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ অলীক মানুষ লেখার মাঝপথে অনেক দিন কলম বন্ধ করে বসে ছিলেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস খোয়াবনামা উপন্যাসের গোড়ার দিকের কয়েক চ্যাপ্টার লিখে মাসের পর মাস বসে ছিলেন। ঢাকা ছেড়ে বগুড়ায় গিয়ে করতোয়ার পাড়ে ঘুরে বেড়াতেন। এবং নদীপাড়ে ঘুরতে ঘুরতেই আবার কালো অক্ষরগুলো চলে আসত। তিনি লিখতে বসতেন এবং সফলভাবে এ উপন্যাসটি আমাদের সামনে হাজির করেছেন। দস্তয়ভস্কি যখন এ সমস্যায় ভুগতেন তখন ব্রথেলে যেতেন ঘনঘন। সকাল সন্ধ্যা কাটাতেন। ‘জুয়াড়ি’ লেখার সময় এমন হয়েছিল। টানা ১৩ দিন ছিলে ব্রিটেনের একটি ব্রথেলে। এরপর রাশিয়া ফিরে গিয়ে সেই বিখ্যাত ‘জুয়াড়ি’ লিখে শেষ করেন।

কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় তখনই যখন মনে এ প্রশ্ন ঢুকে পড়ে ‘কেন লিখব?’ এই সিনড্রোমই মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক বার্নার্ডো কার্দুসি বলেছেন, “এই সিনড্রোম শুরু হয় কসমিক লোনলিনেস থেকে। তখন শুধু মনে হয় সবই রিপিটেশন রিপিটেশন।”

রিপিটেশনই ভেবেছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। ভারতের দেবেশ রায়, বোদলেয়ার, আর আমাদের দেশের কথাসাহিত্যিক রশীদ করিম। তাই একসময় লেখালেখিরে জীবন থেকেই নির্বাসন নেন। ভিক্টর হুগোর কথাই ভাবুন। বা আমাদের মাইকেল মধুসূদনের কথা। হুগোর বাবা ছিলেন সম্রাট প্রথম নেপোলিয়নের অধীনে একজন সেনা কর্মকর্তা। সেই সুবাদে অল্প বয়সেই বাবার সাথে ইতালি, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন। প্যারিসের একটি প্রিপারেটরি স্কুলে তাঁকে ভর্তি করানো হয়েছিল। সেই স্কুলটিতে মাত্র তিন বছর লেখাপড়া করেছেন হুগো। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন বলতে এটুকুই। হুগোর সাহিত্য জীবনের সূচনা কবিতা দিয়ে। প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮২২ সালে। প্রকাশের পরপরই এটি ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এরপর একে একে রচিত হয় ট্রাজেডি, অপেরা, অনুবাদসহ নানান সৃষ্টি। তাঁর রচনার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ছিল মানুষের মুক্তি। ফ্রান্সের জনগণকে অন্ধকার আর গ্লানি থেকে মুক্তির আলোয় আলোকিত করে সমাজ রূপান্তরের স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। এজন্যে হুগোকে সমাজ সংস্কারকও বলা হয়ে থাকে। সম্রাটের স্বেচ্ছাচারিতা তাঁকে ভীষণভাবে পীড়া দিত। হুগো রাজা লুইস নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে তীব্র শ্লেষ জানান তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। এরপর স্বেচ্ছায় দেশ ছেড়ে চলে যান। গারনসি দ্বীপে দীর্ঘ ঊনিশ বছর নির্বাসিত জীবনযাপনকালে তিনি রচনা করেন বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লা মিজারেবল’, ‘দ্য ম্যান হু লাভস’, এবং ‘টয়লার্স অব দ্য সি’। স্বদেশে ফেরার পর জনগণ তাকে বিপুল সম্মানে অভিষিক্ত করে। তার অন্যান্য বিখ্যাত রচনাসমূহের মধ্যে রয়েছে ‘হ্যাঞ্চব্যাক অব নতরদাম’, ‘এর্নানি’, ‘লুই ব্লা’, ‘রিগোলেত্তো’ ইত্যাদি। ১৮৮৫ সালের ২২ মে ৮৩ বছর বয়সে হুগো মারা যাওয়ার আগে সুস্থ থাকতেই স্বেচ্ছা নির্বাসনে আবার দ্বীপে চলে গিয়েছিলেন। যাবার আগে বলেছিলেন, “একজন লেখককে সারাজীবনই লিখতে হবে কেন? লেখকেরও তো অন্যান্য পেশাজীবীদের মতো অবসরে যাওয়া উচিত।” একথা বলেছিলেন ঠিকই কিন্তু তার বন্ধু দিম্য স্ত্রেসে পরে জানান, “হুগো আর লিখতে পারছিলেন না। তার কাছে লেখালেখি কেন, জীবন ও জগতকেই মনে হতো তুচ্ছ।” সেই জীবনকে তুচ্ছ ভেবেই শেষের দিকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার প্রতিভাকে অপচয়ই করেছেন। কেশব দীক্ষিত তার ‘বাংলার দুঃখ মাইকেল মধু’ বইতে জানাচ্ছেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত নীরবে লেখালেখি থেকে কোনো ঘোষণা না দিয়েই সরে পড়েছিলেন। শুধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন, “জীবনকে কাব্যময় করতে গিয়ে জুয়ো মনে হয় বেশি খেলে ফেলেছিলুম। তাই আজ কাব্য’র প্রতি এত বিরাগ আমার আর এই বিরাগ আমাকে মাতালে পরিণত করেছে। কম টাকা নিইনি তো আপনার কাছ থেকে। কী লাভ হলো আপনার বা আমার বা বাংলাসাহিত্যের।”


কোলাজ মন্তাজ ১. মহান শিল্পীদের ক্ষত ও ভালোবাসাসমূহ
কোলাজ মন্তাজ ২. বিখ্যাত সৃষ্টিশীলদের অবসাদ ও স্যাটায়ার
কোলাজ মন্তাজ ৩. স্মরণীয় ১০ জন যারা পেয়েছিলেন রাষ্ট্রের অবমাননা ও অবিচার (পর্ব ১)
কোলাজ মন্তাজ ৪. স্মরণীয় ১০ জন যারা পেয়েছিলেন রাষ্ট্রের অবমাননা ও অবিচার (পর্ব ২)
কোলাজ মন্তাজ ৫. শীতে পাওয়া সাহিত্য
কোলাজ মন্তাজ ৬. সাহিত্যে জ্বলে নেভে ফ্যাসিস্ট ও বিপ্লবীর চরিত্র
কোলাজ মন্তাজ ৭. চে, বিপ্লব ও বাজার
কোলাজ মন্তাজ ৮. সাহিত্যে যৌনতা
কোলাজ মন্তাজ ৯. তবু সে দেখিল কোন ভূত
কোলাজ মন্তাজ ১০. স্ট্রিট লিটারেচার
কোলাজ মন্তাজ ১১. সাহিত্যে জেনারেশন
কোলাজ মন্তাজ ১২. সৃষ্টিশীলদের খেয়ালিপনা
কোলাজ মন্তাজ ১৩. সাহিত্যে নোবেল, প্রত্যাখ্যান ও কেড়ে নেওয়ার গল্প
কোলাজ মন্তাজ ১৪. শিল্পসাহিত্যে ‘স্বাধীনতা’
কোলাজ মন্তাজ ১৫. সাহিত্য করে ‘ধনী’ ও ধনী হয়ে ‘সাহিত্য’ করার গল্প
কোলাজ মন্তাজ ১৬. বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ
কোলাজ মন্তাজ ১৭. সাহিত্যে চুরি
কোলাজ মন্তাজ ১৮. সাহিত্যে ‘নারীবাদ’
কোলাজ মন্তাজ ১৯. সৃষ্টিশীলদের বন্ধুত্ব ও বিবাদ
কোলাজ মন্তাজ ২০. সাহিত্যে যুদ্ধ

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;