কোলাজ মন্তাজ

সৃষ্টিশীলদের বন্ধুত্ব ও বিবাদ



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমার কাছে এখনো জগতের সেরা বন্ধু কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস। তাদের বন্ধুত্বের বড় কারণ মনে হয় দুজনেই জগতের সব মেহনতি মানুষের শোষণ থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন। তাদের বন্ধুত্বের বড় ভিত্তি বৃহত্তর। শুধু ‘আমি কেন্দ্রিক’ না।
কিন্তু বন্ধুত্ব নিয়ে আপনার কী ভাবেন? যেমন ধরুন একটা উদাহরণ দিই—
বন্ধু কে ?
অসুস্থ মানুষ ও চিকিৎসক বন্ধু।
কেন?
অসুখ।
কেন? অসুখ কেন হবে বন্ধুত্বের সেতু?
কারণ, বিপদে বন্ধুর পরিচয়। রোগীকে রোগমুক্ত করেন ডাক্তার। তাই।
তাহলে অসুখ মানে খারাপ। বিপদ। বিপদ দিয়ে শুরু হয় বন্ধুত্ব?
সে তো বটেই।
তবে স্বাস্থ্য কী?
স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য যা কিছু উপকারী সেও বন্ধু।
স্বাস্থ্য ভালো রাখে সুইমিং, জগিং, অষুধ । সেসবও তবে বন্ধু?
কেন নয়? তারাও বন্ধু।
কিন্তু তারা কি আমার প্রাণের ভাষা বুঝবে?
না বুঝলে বিপদে তাদেরই লাগে কেন?
তাহলে আমার স্বাস্থ্য যদি ভালো থাকে তবে তো সুইমিং, জগিং, অষুধ বা অসুখ বন্ধু নয়?
না তখন অসুখ তোমার এনিমি। তোমার বন্ধু স্বাস্থ্য।
এরমানে বন্ধুত্বও পরিবর্তনশীল?
অবশ্যই।

এতটুকু পড়ে কী মনে হচ্ছে আপনার? বন্ধুত্ব আসলে কী? উপরের যে কথাগুলো পড়লেন সেসব আমার না। এরকম ডায়লগের ভেতর দিয়ে উত্তর খুঁজেছিলেন ফিলোসফার প্লেটো। বইটির নাম, ‘ক্রাইসিস অব ফ্রেন্ডশিপ’। লেখা খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে। তবে কার্ল মার্কস এমন বন্ধুত্বের বাহাসে আস্থা রাখতেন না। তিনি ‘এথনোলজিক্যাল নোটবুক’-এ ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের মতো মতাদর্শিক বন্ধু না পেলে শ্রেণীসংগ্রামের লড়াইয়ের পথ খুঁজে পেতে কষ্ট হতো বলে স্বীকার করেছেন।

ফের ঝামেলা দেখা দিল, লক্ষ করুন। মতাদর্শ মালটা আবার কী? মানে ইজম মানেই তো কারাগার। এখন একই কারাগারের বাসিন্দা হয়ে বন্ধু হলে তো সে বড় সীমাবদ্ধ। আপনি অন্য কারাগারের বাসিন্দাদের বন্ধু করতে রাজি নন। বন্ধুত্বের দরজা আটকিয়ে দিলেন—এ হয় কিছু?

ব্রার্টান্ড রাসেলের মত ছিল এমন—“সব মতাদর্শই একেকটি কারাগার। তাই মতাদর্শিক বন্ধুত্ব কোনো বন্ধুত্বই না।” এসব তর্ক শেষ হবার নয়। তবু বন্ধুত্ব হয়। কখনো আজীবনের জন্য স্থায়ী হয়। কখনো বন্ধু শক্রুতে পরিণত হন। বন্ধুত্বের দুটি তত্ত্ব আছে। একটি হলো, উপযোগিতাভিত্তিক অন্যটি আনন্দভিত্তিক। আমার ধারণা উপযোগিতাভিত্তিক বন্ধুত্বই ছিল কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের মধ্যে। আর আনন্দভিত্তিক বন্ধুত্ব ছিল আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও গারট্রুড স্টেইনের মধ্যে। ১৯২০-এর দশকে প্যারিসে গারট্রুড স্টেইন ছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ফ্রেন্ড ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড’। হেমিংওয়ে দম্পতিকে প্রবাসজীবনে অনেক সাহায্য করেছেন গারট্রুড স্টেইন। কারণ নিছকই হেমিংওয়ের সঙ্গতা তিনি উপভোগ করেন। ১৯২৪ সালে হেমিংওয়ে বিয়ে করবেন তখন তিনি গারট্রুড ও তাঁর নারীসঙ্গী এলিস টোকলাসকে তাঁর ‘গডপ্যারেন্টস’ হতে বলেন। তাঁরা সানন্দে রাজি হন। লেসবিয়ান গারট্রুড স্টেইন ছিলেন প্যারিসের সবচেয়ে পরিচিত বিত্তশালী নারী। তিনি পরে এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, “হেমিংওয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব নিছক আনন্দের জন্যে। আমাদের মধ্যে অনেক অমিল ছিল। যেমন আমি সমকামী। আর সে সমকামিতা পছন্দই করত না।”

নারী সমকামী বন্ধুর কথা যখন এসেই গেল তখন সমকামী বিট প্রজন্মের দুই প্রধান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ও জ্যাক ক্যারুয়াকের কথা বলি। এখানে বলে রাখি গিন্সবার্গ যদিও পরে তার পুরুষ সঙ্গী অরলভস্কির সাথে ঘর বেঁধেছিলেন এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাদের বাসায় বেড়াতে গেলে গিন্সবার্গ অরলভস্কিকে ‘নিজের স্ত্রী’ পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু তারও আগে গিনসবার্গের সাথে জ্যাক ক্যারুয়াকের ভালো বন্ধুত্ব ছিল। এবং তারাও দুজনেই সমকামী ছিলেন। তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে একসময় রগরগে আলোচনা হতো সাহিত্যআড্ডায়। ট্রুম্যান ক্যাপোট ও হারপার লি-কে নিয়েও কম আলোচনা হয়নি সাহিত্যমহলে। একটি গল্প বলি, হারপার লি তখনও বিখ্যাত লেখক হিসেবে যশ কুড়াননি। সেসময়ই বিখ্যাত তার বন্ধু ট্রুম্যান ক্যাপোট। তারা ছিলেন শৈশবের বন্ধু। আদি ও অকৃত্রিম। মারা যাওয়ার আগে পর্যন্তও তাই ছিলেন। তো হলো কী, একসময় হারপার লি-র অসাধারণ জনপ্রিয় উপন্যাস ‘টু কিল আ মকিং বার্ড’ প্রকাশিত হলো। সেসময় বাজারে তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে দুজনেরই পরিচিতরা রটিয়ে দিল বইটি আসলে ট্রুম্যানের লেখা। কেউ বললেন, তা নয়, ট্রুম্যান ভালোভাবে সম্পাদনা করেছেন। হারপার লি এ বিষয়ে কিছুই বললেন না। ট্রুম্যান সত্য ঘটনা বলতে চাইলেও কেউ বিশ্বাস করলেন না। এ ঘটনার পর হারপর লি আর লেখেননি। কিন্তু সত্যটি জানা গেল অনেক পরে। নিজের খালাকে লেখা ট্রুম্যানের একটি চিঠি অনেক বছর পর ছাপা হলো কাগজে। চিঠিটি ‘টু কিল আ মকিং বার্ড’ প্রকাশের আগে লেখা। তিনি লিখেছেন, হারপার লি-র উপন্যাসটি পড়ে তিনি মুগ্ধ। তিনি আরো লিখলেন, “হারপার লি আসলেই একজন শক্তিশালী লেখক।”

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে ‘নারীবাদ’

এমন বন্ধুত্বকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? ফ্রেডরিখ নিৎসে বলেছেন, বন্ধু হচ্ছে ‘আমি’ এবং ‘আমাকে’র মাঝখানের একটি সত্তা। মানে বন্ধুর আয়নায় নিজের মুখ দেখা। মানে রিলেশনশিপের সমঝোতা। মানে নিজের ভেতরে বন্ধুকে দেখা। কিন্তু নিৎসে তেমন রাজনৈতিকভাবে হয়তো বন্ধুত্ব বা যে কোনো রিলেশনকে ব্যাখ্যায় যাননি। যেমনটি কার্ল মার্কস দেখেছেন বা জ্যাক দেরিদা দেখেছেন। দেরিদার একটি বইয়েরই নাম, ‘দ্য পলিটিকস অব ফ্রেন্ডশিপ’, বন্ধুত্বের রাজনীতি। ‘ও মাই ফ্রেন্ড, দেয়ার ইজ নো ফ্রেন্ড’—এই বক্তব্য সামনে রেখে দেরিদা বন্ধুত্বের রাজনীতি কেমন সেটি দেখাতে চেয়েছেন। তিনি এই বইতে বলছেন, “বন্ধুত্বেরও একটা রাজনীতি থাকে। সহবস্থানে থেকে অন্যপক্ষকে গুরুত্বহীন করার। এখানেই বন্ধুত্বের সম্পর্কে রাজনীতি ক্রিয়াশীল।” কথাটি তো মন্দ বলেননি। এমন কথা বহু বহু বছর আগে এরিস্টোটল বলেছিলেন। এরিস্টোটল বলেছেন, “বন্ধুত্ব ও গণতন্ত্র সাংঘর্ষিক। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্র বন্ধুত্বকে সন্দেহের চোখে দেখে। এবং চূড়ান্ত গণতন্ত্র বা ন্যায়বিচারসহ অন্য উপাদানগুলা তাদের শক্তিতে সক্রিয় হয়ে উঠলে বন্ধুত্বের জন্য শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি হয়। নাগরিকরা কোনো বিষয় আর আপোষে, দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্বের সূত্রে নিষ্পত্তি করতে চান না। তখন তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ন্যায়বিচারের কথা বলে বিচারক হয়ে ওঠে। গণতন্ত্রে আইনের চোখে সবাই সমান। কেউ কারো বন্ধু হলে অন্য আরেকজনের চেয়ে তাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া গণতন্ত্রে কঠিন।” (সূত্র: এরিস্টোটলের রাজ্যে বন্ধু: গোপিকানাথ বসু, এক্ষণ প্রকাশন)

কিন্তু দেরিদা তার বইতে বলছেন, “বন্ধুত্ব শক্রু তৈরি করে। আর এটাই বন্ধুত্বের রাজনীতি।”

দেখা যাচ্ছে এরিস্টোটল ও জ্যাক দেরিদার চিন্তার মধ্যে মিল রয়েছে। রাজনীতিগতভাবে না দেখে একটা প্রতিক্রিয়া দেখব এখন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের। ২০১০-এ মারিও ভার্গাস য়োসার সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তিতে প্রতিক্রিয়া হিসেবে লাতিন আমেরিকার আরেক নোবেলজয়ী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের টুইটার বার্তা ছিল “এবার আমরা সমকক্ষ”। দেরিদাপন্থীদের কাছে এই টুইট বার্তার মাজেজা অন্যরকম হলেও গণমাধ্যমগুলো অবশ্য এ মন্তব্যের পেছনের কারণটুকু বুঝে নিয়েছিল সাধারণভাবেই। পেরুর মারিও ভার্গাস য়োসা এবং কলম্বিয়ার গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মধ্যে একসময় যেমন তুমুল বন্ধুত্ব ছিল, তেমনি ঘটনাচক্রে তারা পরস্পর মুখদর্শন পর্যন্ত স্থগিত রাখেন। যদিও নিজমুখে এরা কেউই একে অন্যের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত করেননি, তথাপি অনেকেই ধারণা করে থাকেন য়োসার স্ত্রীর প্রতি নজর দেওয়াই ছিল মার্কেজের চোখে কালো দাগ বসিয়ে দেওয়া য়োসার ঘুষির কারণ। সম্পর্কের ইতি বস্তুত সেদিন থেকেই এবং তা জারি ছিল শেষ পর্যন্ত। এরকম একটি মুখরোচক ঘটনার কারণেই মারিও ভার্গাস য়োসার নোবেল প্রাপ্তির পরপরই গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নামও উঠে এসেছে গণমাধ্যমগুলোতে। সেসব জটিল হিসেবনিকেশে না গিয়ে বন্ধুত্ব ও বন্ধু থেকে শক্রতে পরিণত হওয়া চরিত্রগুলো আসেন দেখি।

ফরাসি কবি গিওম আপোলিনেয়ারের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব ছিল শিল্পী পাবলো পিকাসোর। মাঝেই মাঝেই তারা বিভিন্ন দেশ ঘুরতে বেরুতেন। হোটেলের এক রুমেই থাকতেন। প্যারিসের রাস্তায় একই রঙের পোশাক পরেও হাঁটতে দেখেছেন অনেকে যারা তাদের চিনতেন। এমনই গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল ফিলোসফার সক্রেটিসের সঙ্গে এক যৌনকর্মীর। নাম, থিওজেট। থিওজেট যাতে ওই পেশা ছেড়ে দেন এজন্য সক্রেটিস অনেক চিঠি লিখেছেন তাকে। কিন্তু থিওজেট বারবারই প্রশ্ন করতেন, “এই পেশা ছেড়ে দিলে আমি কিভাবে চলব? আমার আয়?” সক্রেটিস এর ফয়সালা করতে পারেননি। থিওজেট বন্ধু সক্রেটিসকে বলেছিলেন, “বন্ধু, আপনিই আমার ব্যবসায়ে একমাত্র ক্লায়েন্ট হন তবে?” সক্রেটিস ছিলেন নিরুত্তর। যদিও এমন কথাও শোনা যায় যে সক্রেটিস বলেছিলেন, যেভাবে তাঁর জ্ঞানপিপাসু শিষ্যরা নিয়মিত তাঁর কাছে ভিড় জমায়, থিওজেট যদি তা করতে রাজি থাকেন, তাহলে তিনি তাঁর বন্ধু ও ব্যবসায়ের অংশীদার হতে সম্মত থাকবেন। কিন্তু সক্রেটিসের চরিত্র বিবেচনায় বন্ধু হিসেবে তিনি থিওজেটের কাছে নিরুপায়ই ছিলেন। নিরুপায় ছিলেন বন্ধুত্ব রক্ষায় রালফ ওয়াল্ডো এমার্সন। তবু বন্ধুত্ব টিকিয়ে রেখেছিলেন আজীবন হেনরি ডেভিড থোরিও-র সাথে। কারণ হেনরি ডেভিড থোরিও একসময় নেশাসক্ত হয়ে পড়েন। নেশার জন্যে আড্ডা থেকে সামান্য জিনিসও চুরি করতেন। সেসবের জন্য বন্ধুরা তাকে বয়কটেরই ঘোষণা দিল। কিন্তু বাধ সাধলেন রালফ ওয়াল্ডো এমার্সন। তিনি অন্য বন্ধুদের মিথ্যা বললেন, “সে (হেনরি ডেভিড থোরিও) যা কিছু চুরি করে সেটি তো আমার জন্য। আমার খরচাপাতিতে সে আমাকে আর্থিক সাহায্য করে। অতএব তাকে বয়কট করলে আমিও আর তোমাদের বন্ধু নেই।” রালফ ওয়াল্ডো এমার্সন তার অন্যসব বন্ধুকে ত্যাগ করলেন হেনরি ডেভিড থোরিও-র সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করার জন্যে। পরে ডেভিড থোরিও তার কাছে জানতে চাইলেন, “তুমি এমন করলে কেন, আমি নেশা করি। তুমি তো করো না। কেন এক নেশাখোর বন্ধুর বদনামকে প্রশ্রয় দিলে।” এমার্সন মুখ ফিরিয়ে শুধু বলেছিলেন, “জানি না, আমি তোকে ভালবাসি। তুই কেন নেশা করিস সেটি স্পর্শ করে আমাকেও। তোর বেদনা বন্ধু হিসেবে আমারও।” দুজনেরই কথা হচ্ছিল নিচারা পাহাড়ের উঁচু ঢালে। কথাগুলো এমার্সন মুখ ঘুরিয়ে বলেছিলেন। তার গাল বেয়ে পড়ছিল ফোঁটা ফোঁটা কয়েক বিন্দু কান্না।

এছাড়া বন্ধু হিসেবে সেরা জুটি ছিলেন শার্লট ব্রন্টি ও এলিজাবেথ গাসকেল, জে আর আর টেলেকিচ এবং সিএস লিউইস, ক্রিস্টোফার আইশারহুড ও ডব্লিউ এইচ আডন, গুন্টার গ্রাস এবং জন আরভিং। গুন্টার গ্রাস মারা যাওয়ার পর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে তার বন্ধু জন আরভিং বলেছিলেন, “আমি হয়তো লেখালেখি করতাম না। আমাকে লেখায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন চার্লস ডিকেন্স আর হাতে ধরে বলা যায় শিখিয়েছিল আজ যে মারা গেল, আমার বন্ধু গুন্টার গ্রাস। আজ থেকে আমি বন্ধুহীন। আমার ভেতরের কথাগুলো শেয়ার করার আর কেউ থাকল না।”

টি এস এলিয়ট এবং এজরা পাউন্ড। এই দুই কবি ইংরেজিতে মর্ডানিজমের প্রারম্ভিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন কাব্য জগতে। তাদের বন্ধুত্ব ছিল অন্যতম। এজরা পাউন্ড একটু দক্ষিণপন্থী রাজনীতির পক্ষে ছিলেন। উল্টোদিকে এলিয়ট রাজনীতিবিমুখ ছিলেন, কিন্তু মানবতাবাদী, ফ্যাসিস্টদের বিপক্ষেই তিনি ছিলেন সোচ্চার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এক রূপান্তরিত পৃথিবীতে মানুষের অসহায়ত্বকে এলিয়ট তুলে এনেছেন ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’, ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড, দ্য হলৌ মেন’সহ তার বিভিন্ন কবিতার বইয়ে। জন্ম তাঁরও এজরা পাউন্ডের মতো আমেরিকায়। পরিচয়ও দুজনেরই ওখানেই। পরে দুজনেই স্থায়ী হন ব্রিটেনে। পরিচয়ের দিন তাঁরা ওয়াশিংটন ডিসির একটা কফিশপে বসে কফি খাচ্ছিলেন। পাশাপাশি। তখন এজরা জানতে চান, “কী করেন আপনি?” এলিয়ট জবাবে বলেন, “কবিতা লেখি।” এজরা মজা করে বলেন, “এটা কোনো করা হলো? পেশা তো না আর।” এলিয়ট ফের জবাবে বলেন, “আমি পেশাদারী না। আমি কবিতার নোশাখোর একটা মানুষ।” সেকথা শুনেই এলিয়টকে জড়িয়ে ধরেন পাউন্ড। এরপর বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব এমনই যে এলিয়ট ব্রিটেনে স্থায়ীবসবাস শুরু করলে পাউন্ডও সেখানে স্থায়ী।

ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ, টনি মরিসন এবং অ্যাজিলা ডেভিস, পল ভ্যালেরি ও আঁতুর রেবো; হেনরি মিলার এবং লরেন্স ভারেল, ভ্লাদিমির নবোকভ, এডমুন্ড উইলসন নরম্যান নেইমার ও জ্যাক অ্যাবট, ভিক্টর হুগোর সঙ্গে পিয়ানোবাদক ফ্রানৎস লিজ, ফ্রানৎস কাফকা ও ম্যাক্সেব্রড এমন অনেক বন্ধুত্বের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

জীবনে বন্ধুত্ব ও শিল্পের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন প্রখ্যাত ইংরেজ কবি লর্ড বায়রন। তিনি কবি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর সঙ্গে প্রখ্যাত রোমান্টিক কবি পার্সি বিশি শেলির বন্ধুত্ব হয় কাকতালীয়ভাবে। বায়রনের সঙ্গে শেলির বন্ধুত্ব হয়ে গেল প্রথমবারের আলাপচারিতায়। যদিও এর আগে শেলি বায়রনের ভক্ত ছিলেন, কিন্তু তাদের দেখা সেবারই প্রথম। এরপর শেলি এবং বায়রন দুজন একসঙ্গে প্রচুর সময় কাটিয়েছেন লেক জেনেভার পাড়ে। তারা নতুন নতুন জায়গা ও ঘটনার খোঁজে বেরিয়েছেন। শেলি লিখেছেন, বায়রনের সাহচার্য তাকে কবিতা লেখার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছিল। শেলির ‘হেইম টু ইন্টেলেকচুয়াল বিউটি’ তাদের দুজনের নৌ-ভ্রমণ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই লেখা। অপর এক বন্ধুর কাছে লেখা চিঠিতে শেলি বায়রন সম্পর্কে লিখেছেন: “সে খুবই মজার মানুষ, কিন্তু অপমান ও অন্যায়ের শিকার।” বায়রনের বন্ধুত্ব শুধু শেলির সঙ্গে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তাঁর পরিবারের সঙ্গেও হয়েছে। এক বৃষ্টির রাতে ভৌতিক গল্পের আসরে বায়রন সেখানে উপস্থিত অন্যদের একটি করে ভূতের গল্প লেখার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। সেখানে পার্সি বিশি শেলির স্ত্রীও ছিলেন। সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেই ম্যারি শেলি লিখে ফেললেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’।

আলবেয়র কামু ও জাঁ পল সার্ত্রে দুজনই প্রভাবশালী দার্শনিক ও সাহিত্যিক। কিন্তু তাদের মধ্যে চিন্তার অমিলও ছিল অনেক। যেমন, মানুষের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে দুই জনের দুই মত। দুজনেই অস্তিত্ববাদী হলেও সার্ত্রে শেষে সমাজতান্ত্রিক হন। কামু হননি। এভাবেই দুজনের বিরোধের শুরু। নোবেল পুরস্কার জেতার পর কামু একবার বলেছিলেন, “সার্ত্রের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অসাধারণ। কারণ আমরা কেউ কারো মুখ দেখি না।” আবার সার্ত্রেকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কামুকে আগে দেওয়া হয়েছে বলেও রটনা রয়েছে। কিন্তু গাড়ি দুর্ঘটনায় কামু মারা গেলে সার্ত্রে ধীরে ধীরে অনুধাবন করেন, কামুই ছিল তার শেষ বন্ধু। সার্ত্রে ও কামুর মতো চার্লস ডিকেন্স ও হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের বন্ধুত্ব টেকেনি শেষঅব্দি। দুজনের প্রথম দেখা ১৮৪৭ সালের জুলাই মাসে। এরপর নয় বছর দেখা হয়নি তাদের। ডিকেন্স বন্ধুকে লেখেন: “নয় বছরে ভেবো না তুমি ইংরেজদের মন থেকে হারিয়ে গেছো। তোমার অবস্থান তাদের অন্তরে আরো পোক্ত হয়েছে। এসেই একবার দেখে যাও।” হ্যান্স চলে যান। ডিকেন্সের বাড়িতে তাঁর জন্য বরাদ্দ কক্ষটিতে থাকলেন। থিয়েটারে গিয়ে ডিকেন্সের অভিনয় করা নাটক দেখে চোখের পানি মুছলেন। তবে দ্বিতীয় দিনই ঘুম থেকে উঠে তাঁর দাড়ি কামিয়ে দেওয়ার মতো কাউকে না পেয়ে অসন্তুষ্ট হলেন তিনি। ডিকেন্সের বড় ছেলেকে দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি আনিয়ে শহর থেকে শেভ করে এলেন। ডিকেন্স ও হ্যান্সের বেড়ে ওঠা এবং সাংস্কৃতিক পরিচিতি ভিন্ন ধরনের হওয়ায় প্রতিদিনই জমা হতে থাকল অসন্তোষ। ওদিকে দুই সপ্তাহের জন্য এসে হ্যান্স রয়ে গেলেন পাঁচ সপ্তাহ। যেদিন তিনি বিদায় নিচ্ছেন, দেখলেন, দরজায় একটি কাগজে ডিকেন্স লিখে রেখেছেন—“এই কক্ষে হ্যান্স পাঁচ সপ্তাহ ছিলেন। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে কয়েক যুগ।”

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে চুরি

বন্ধুত্বে ফাটলও ধরেছে এমন উদাহরণ কম নয়। কম হওয়ার কথাও নয়। যেমন, জন কিটস ও লর্ড বায়রন। তাদের বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছিল। বায়রন ছিলেন উন্নাসিক ও উচ্চবিত্ত। অন্যদিকে কিটস ছিলেন নিতান্তই মধ্যবিত্ত। ফলে বায়রনের সফলতা কিটসকে ঈর্ষান্বিত করত সবসময়। কেউ কারো কাজের প্রশংসা করতেন না। জন লে কার ও সালমান রুশদি ভালো বন্ধু ছিলেন। সালমান রুশদির ১৯৮৯ সালে ‘দি স্যাটানিক ভার্সেস’ বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর ইসলামপন্থী উগ্রবাদীরা তার মুণ্ডু চেয়েছিল ‘নাস্তিক’ ঘোষণা দিয়ে। এরপর ১৯৯৭ সালে যখন গার্ডিয়ান-এ তার বন্ধু লে কার একটি লেখায় রুশদির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন, তিনি কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারেন না। অভিযোগের জবাব দেন সালমান রুশদি। তিনি বলেন, “তিনি এত উদারপন্থী আমার জানা ছিল না। যতটুকু জানি সে তো বেশ্যাগমন করে এবং উপাসনালয়ে যায় না।” এর উত্তরে লে কার জানান, “রুশদির ওপর করা আক্রমণের বৈধতা নিয়ে আমার কোনো সমর্থন ছিল না। আমি ছিলাম ধর্মের পক্ষে। কোনো আইনই বৈধতা দেয় না এমন মহৎ ধর্মকে অপমান করার।”

ড্যারেক ওয়ালকট ও ভি এস নাইপল ভালো বন্ধু ছিলেন। কিন্তু খ্যাতির বিড়ম্বনার কারণে কিনা জানা যায়নি একসময় ওয়ালকট নাইপলের বিরুদ্ধে অনেক বিরূপ সমালোচনা করেন। ২০০৮ সালে এক আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে ড্যারেক ওয়ালকট একটা কবিতা ‘দি মনগুজ’ পাঠ করেন। কবিতাটি শুরু হয় এভাবে:
“আমাকে কামড়েছে। আমার ইনফেকশন এড়াতে হবে
নয়তো আমি মরে যাব; নাইপলের উপন্যাসের মতোই।
তার শেষ উপন্যাসটা পড়লেই বোঝা যাবে যা বলছি আমি।”
নাইপল কী এমন করেছেন যে জন্য ওই কবিতা দিয়ে আঘাত করলেন ওয়ালকট? কেন এত ক্ষেপেছিলেন ওয়ালকট বন্ধু হয়ে? কারণ নাইপল তার উপন্যাস ‘অ্যা রাইটার্স পিপল’-এ ওয়ালকটের উদ্দেশ্যে বলেন, “একজন মানুষ যার অনেক প্রতিভা থাকলেও তিনি উপনিবেশিক ধারণা দ্বারা বেষ্টিত।”

রবীন্দ্রসংগীতে সখী মানে (বন্ধু)কে এভাবেই বলা হয়েছে—“ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে।” এই বন্ধু, সখা, ও সই নিয়ে বাংলা গান ও কবিতার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কবি জসীমউদদীন আহমেদ ‘আমার বাড়ি’ কবিতায় বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেছেন এভাবে—
“আমার বাড়ি যাইও ভোমর,
বসতে দেব পিঁড়ে,
জলপান যে করতে দেব শালি ধানের চিঁড়ে।
শালি ধানের চিঁড়ে দেব,
বিন্নি ধানের খই,
বাড়ির গাছের কবরী কলা
গামছা বাঁধা দই।”


বাংলা ভাষায় সনেটের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি হিন্দু কলেজে পড়ার সময় ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, ভোলানাথ চন্দ্র, বঙ্কুবিহারী দত্তরা তার সহপাঠী ও বন্ধু ছিলেন। কখনো ফারসি গজল গান গেয়ে, কোনোদিন বিলেতি দোকানে চুল কাটিয়ে, কখনো শেক্সপিয়র-বায়রন আবৃত্তি করে তিনি বন্ধুদের চমকে দিতেন। আবার শিক্ষকের প্রতি সরব অশ্রদ্ধা, মদ্যপান, অমিতব্যয়িতা সবই ছিল তার নাটকীয়। গুঞ্জন রয়েছে বন্ধু গৌরদাস বসাকের সঙ্গে সমকামী রিলেশনও গড়ে তুলেছিলেন। এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘সেইসময়’-এ। মাইকেলের বিদেশ থেকে ফেরার পর এবং অতিরিক্ত মদ্যপানসহ আর্থিক সংকটে যখন তার বিপর্যস্ত অবস্থা তখন বন্ধুর মতো তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন একজন ঈশ্বরচন্ত্র বিদ্যাসাগর। তিনি টাকা পয়সা দিয়ে মাইকেলকে সবসময় সাহায্য করতেন। পঞ্চানন নামের একজন একদিন বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন, “আপনি মাইকেলের মতো মদ্যপকে টাকা দেন বিপদে পড়লে, কই আমাদেরকে তো সাহায্য করেন না?” জবাবে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, “আগে মাইকেলের মতো যোগ্যতা অর্জন করে এসো, তবে সাহায্য করব।”

আমাদের দেশে একসময় ভালো বন্ধু ছিলেন কবি শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ। কিন্তু একসময় তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে মতাদর্শিক কারণে। শামসুর রাহমান মনে করতেন তার বন্ধু আল মাহমুদে ‘ইসলামী মৌলবাদী’ হয়ে গেছেন। কলকাতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধুত্ব নিয়ে রয়েছে অনেক কাণ্ড-কীর্তি। তারা দুজনে একসাথে বহু জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। রাতে মদ খেয়ে শক্তি বন্ধু সুনীলের বাসায় গিয়ে বন্ধুপত্নী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়কে ম্যানেজ করার জন্য বলতেন, “আপনার সামনে এলেই আমার সব মাতলামি ছুটে যায়।” (শক্তিকে নিয়ে স্বাতীর লেখা, আনন্দবাজার পত্রিকা) একদা রাতের কলকাতাকে শাসন করতেন তারা। তাদের বন্ধু ছিলেন আমাদের দেশের বেলাল চৌধুরী। পঞ্চাশের দশকে সৈয়দ শামসুল হক-কাইয়ুম চৌধুরীর মধ্যে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব টিকে ছিল দীর্ঘদিন। আবার ষাটের দশকে এসে আবুল হাসান-নির্মলেন্দু গুণ, নাট্যজন মামুনুর রশীদ-মহাদেব সাহা—এই চারজনের বন্ধুত্বময় জীবনের বিচিত্র গল্প কতই না মনকাড়া!

একদিনের একটা গল্প বলি, তখন কবি গুণ ও মামুনুর রশীদ বয়সে তরুণ। থাকেন তেজগাঁও পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের হোস্টেলে। এক সকালে দুই বন্ধু পুরান ঢাকায় গিয়েছেন। আড্ডা সেরে পড়ন্ত বিকেলে ফেরার পথে দুজনেই টের পেলেন অতি ক্ষুধার্ত তারা। কী করা। তো, গুণ মামুনুর রশীদকে বললেন, “আয়, একটা হোটেলে ভাত খাই। খাওয়ার পর আমি যা করি তা-ই শুধু করবি। চল।” দুজনে হোটেলে ভাত খেলেন। মামানুর রশীদ ভাবলেন গুণের কাছে নিশ্চয়ই টাকা আছে। হাত মুখ ধুয়ে গুণ এগিয়ে গেলেন ক্যাশ কাউন্টারের দিকে। পেছনে মামুনুর রশীদ। গুণ তাকে বললেন আগে যা। মামুনুর রশীদ আগে গেলেন। এবার ক্যাশ কাউন্টারের সামনে গিয়ে গুণ বললেন, “এই বিল কত হয়েছে?” ম্যানেজার বিল বলার আগেই গুণ এমন একটা ভাব নিয়ে যেন পান খাবেন হোটেলের একদম লাগোয়া পান সিগারেটের দোকানে সেভাবে এগুলেন। ম্যানেজার বিল বললেন। কত কে জানে। দে দৌড়। রাস্তায় তেমন ভিড় নেই। দুজনই দৌড়ে বায়তুল মোকাররমের কাছাকাছি এসে থামলেন একটা গলিতে। মামুনুর রশীদ কবি গুণের দিকে তাকিয়ে আছেন, গুণ শুধু বললেন, “বন্ধু, জীবনটা এই দৌড়ই।”

২১ আগস্ট ১৯১১। ল্যুভ মিউজিয়াম থেকে চুরি হয়ে যায় লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘মোনালিসা’। পরদিন শিল্পী লুই বেরুদ মিউজিয়ামে গিয়ে দেখলেন, পাঁচ বছর ধরে ‘মোনালিসা’ যেখানে শোভা পাচ্ছিল, সেখানে দেয়ালে কেবল চারটি পেরেক, শিল্পজগতের সবচেয়ে আলোচিত এই নারী নেই। প্রথমে মনে করা হলো, ল্যুভের কোনো বিজ্ঞাপনী প্রয়োজনে ছবি তুলতে হয়তো ‘মোনালিসা’কে অন্য কোথাও সরানো হয়েছে; কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমন কিছু ঘটেনি বলে জানালেন। অর্থাৎ ‘মোনালিসা’ চুরি হয়ে গেছে। গোটা সপ্তাহের জন্য বন্ধ হয়ে গেল ল্যুভ মিউজিয়াম।

গিওম আপোলিনেয়ার একবার ল্যুভ পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। সুতরাং পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করল, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুরল জেলে। গিওম পুলিশি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে শিল্পী পাবলো পিকাসোর নাম বলে দিলেন। গ্রেপ্তার হলেন তিনিও। অবশ্য চুরির সঙ্গে তাঁদের কারোরই কোনো যোগসূত্র না পাওয়ায় একসময় ছেড়ে দেওয়া হয় দুজনকেই। উদ্ধারকৃত ‘মোনালিসা’ ৪ জানুয়ারি ১৯১৪ ল্যুভে ফিরে আসে।

গিওমের মৃত্যুর ৩০ বছর পূর্তিতে পিকাসো আবার তাঁকে স্মৃতি থেকে এঁকেছিলেন। গিওমকে এঁকেছেন অঁরি রুশো, মাতিসে, মার্ক শাগাল, মিখাইল লারিনোভ, জুয়ান গ্রিস, জ্যা ম্যাটজিঞ্জার, মার্সেল জর্জিও চিরিকো এবং অভিন্নহৃদয় বন্ধু পিকাসো তো বটেই।

‘শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু, হে প্রিয়’—রবীন্দ্রনাথ শুধু বাণীতে সন্তুষ্ট থাকতে চাননি, প্রাণে তাঁর পরশও চেয়েছেন। একটা সময় ছিল সানন্দে, সগর্বে বন্ধুর কথা বলা যেত। তারপর কী যে হলো, বেশ জোর দিয়ে বন্ধুর দাবি যিনিই করুন, নারী বা পুরুষ—আমরা কিছুটা সন্দিহান হয়ে উঠি।

একালের বন্ধুত্বের যে ব্যাখ্যাই থাক না কেন, সেকালের অন্তত ১০ জন শ্রেষ্ঠ মানুষ বন্ধুত্বের গুরুত্ব ও মহিমা প্রচার করেছেন এবং বলেছেন, হীনম্মন্য মানুষের জন্য বন্ধুত্ব নয়। তাঁরা হলেন হোমার, সোপোক্লেস, হেরোডোটাস, হিপ্পোক্র্যাটস, অ্যারিস্টোফেনস, ইউরিপিডেস, সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও ইউক্লিড।

আরো পড়ুন ➥ বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ

সৃজনশীল মানুষের বন্ধুত্বের কাহিনী শতসহস্র বছরের দূরত্ব ডিঙিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছায়। রোমান লেখক প্লিনি দ্য এন্ডার (মূল নাম গাইয়াস প্লিনিয়াস সেকান্দার) তাঁর লেখকবন্ধুর জন্য আক্ষরিক অর্থেই জীবন দিয়েছেন। তাঁর জন্ম ২৩ খ্রিস্টাব্দে, মৃত্যু ২৫ আগস্ট ৭৯ খ্রিস্টাব্দে। রোমান লেখক এবং প্লিনির নারী বন্ধু রেকটিনার একটি বার্তা তাঁর কাছে পৌঁছে: বিসুবিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং লাভাক্ষরণ শুরু হয়েছে, রেকটিনা ও পম্পোনিয়াসকে উদ্ধার করতে হবে। প্লিনি যখন তাঁদের উদ্ধার করতে গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছান, বিসুবিয়াসের অগ্নিক্ষরণ শুরু হয়। তাঁর নৌকার মাঝিরা তাঁকে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। প্লিনির মুখ থেকে বের হলো সেই ঐতিহাসিক জবাব, “ফরচুন ফ্যাভার্স দ্য ব্রেভ”। তীরে নেমে তিনি পম্পোনিয়াসকে আলিঙ্গন করলেন, কিন্তু কোথাও রেকটিনাকে পেলেন না। আবার অগ্ন্যুৎপাত শুরু হলো। তিনদিন পর আগ্নেয়গিরি শান্ত হলে দেখা গেল জমাট লাভার মাঝখানে প্লিনি দ্য এন্ডার বসে আছেন, এতটুকু ক্ষতও তাঁর দেহে নেই। কিন্তু তিনি নিষ্প্রাণ। বিসুবিয়াস পম্পেই ও হারকুলিয়াম নগর দুটিকে ধ্বংস করে দেয়। রেকটিনারও কোনো হদিস মেলেনি। কোনো সন্দহ নেই, প্লিনি দ্য এল্ডার এবং রেকটিনার বন্ধুত্ব ধ্রুপদ ধরনের। পরবর্তীকালের গবেষকেরা দুজনের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কের সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দেননি।

খ্রিস্টজন্মের শতবর্ষ আগের বিখ্যাত লেখক মার্কাস সিসেরো বন্ধুত্ব নিয়ে তাঁর বিখ্যাত অভিসন্দর্ভ De Amicitia তাঁর বন্ধু টাইটাস পম্পিনাস এট্টিমাসকে উৎসর্গ করেন। টাইটাস ও সিসেরোর মধ্যে বহুসংখ্যক পত্রবিনিময় হয়েছে এবং তা গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। সিসেরো দর্শন, আইন, রাষ্ট্রনীতি, প্রশাসন, সাহিত্য—প্রায় সব বিষয়েই লিখেছেন। বেন জনসন ও উইলিয়াম শেকসপিয়ারের চরিত্র হয়ে উঠেছেন মার্কাস সিসেরো।

প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও সিসেরোর পথ ধরে বন্ধুত্বের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিকের বিশ্লেষণ করেছেন সেইন্ট অগাস্টাস (৩৪৫-৪৩০), সেইন্ট থোমাস একুইনাস (১২২৫-১২৭৪), আল গাজ্জালি (১০৫৮-১১১১), ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬)

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;