কোলাজ মন্তাজ

সাহিত্যে ‘নারীবাদ’



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক এক সাক্ষাৎকারে এক যুগ আগে বলেছিলেন, “এদেশের নারীবাদীরা মনে করেন ‘শি’ থেকে ‘হি’ হয়ে ওঠা বা ‘হি’র সমান অধিকার ভোগ করা। কিন্তু যে সমাজেই একজন মানুষ সিটিজেন হিসেবেই মুক্ত না সেই সমাজে আলাদাভাবে নারীমুক্তির আন্দোলন নির্বিশেষ আন্দোলন বা বিপ্লবের পথ থেকে মুখ সরিয়ে বিশেষ ইস্যু তৈরি করা।”

উনার একথার সাথে আমি সম্পূর্ণ সহমত। ফলে দেখা যাচ্ছে আমি মোটেও নারীবাদী নই। তবে কি পুরুষতান্ত্রিক? না তাও নই। আমার মতোই কথা বলেছিলেন রুশ বিপ্লবের অন্যতম নায়ক জোসেফ স্ট্যালিন। তিনি বলেছিলেন, “আমি না নারীবাদী না পুরুষতান্ত্রিক। রাষ্ট্রের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখি যে-ই ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে থাকে আমি তারই উৎখাতের পক্ষে। কারণ রাষ্ট্র না নারী না পুরুষ। একটা শোষণ-ব্যবস্থা।” কিন্তু নারীবাদের মধ্যেও তো অনেক কিসিম আছে। এর মধ্যে পলিটিক্যাল ফেমিনিজম তো খুব বেশি দূরে নয় মার্কসিজমে বর্ণিত নারী অধিকার লড়াইয়ের বিষয়ে। তাই পলিটিক্যাল ফেমিনিস্ট আমি নিজেকে দাবি করতেই পারি। নারীকে মানুষ হিসেবেই তো দেখা কাজ। তফাত করার কিছু নেই।

তবে তফাত করেছিলেন অনেক সৃষ্টিশীলরা। যেমন শেক্সপীয়রের মতে—“নৈতিক বিচ্যুতির নামই নারী।” রুশো বলেছেন—“নারী দরকারি অশুভ।” হেগেল বলেছেন—“নারীর ঘিলু ১০ আউন্স কম।” নিৎসে বলেছেন, “নারীরা বন্ধুর উপযুক্ত নয়। তারা এখনো বিড়াল কিংবা পাখি কিংবা খুব বেশি গাভী। পুরুষ নেবে যুদ্ধের প্রস্তুতি, আর নারী হবে যোদ্ধাদের প্রমোদ সামগ্রী।”—এখানেই ক্ষান্ত হননি তিনি। তাঁর প্রবল নারীবিদ্বেষের পরিচয় পাওয়া যায় তার সতর্ক বাণীতে—“যদি মেয়েদের কাছে যাও, তবে চাবুক নিতে ভুলো না।” অবসাদগ্রস্ত বোদলেয়ার প্রেয়সীকে চুমো দিতে গিয়ে দেখলেন নারীর মুখগহ্বরটা একটি পুঁজভর্তি আঠালো চামড়ার থলে। তবে রবীন্দ্রনাথ এখানে ভারসাম্য রক্ষা করতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ নারীকে করে তুলেছেন দুর্জ্ঞেয়—“অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা।” আহমদ ছফা তো বই-ই লিখে ফেললেন ‘অর্ধেক মানবী অর্ধেক ইশ্বরী’ নামে। বইটির পাণ্ডুলিপি আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, “বুঝলা, নারী হইল রহস্যের আধার।” নারীর মধ্যে রহস্য খোঁজার বিরুদ্ধে ছিলেন নারীবাদী মেরি ওলফোনস্টোন। তিনি বলেছিলেন, ‘নারীরাও একটি প্রাণীর মতো সব কিছুই করে। মলত্যাগ করে। যৌনকর্মে লিপ্ত হয়। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার সৌন্দর্য্যবোধ এত নিম্নমানের যে তারা অযথাই নারীর সৌন্দর্য্যকে রহস্যময় করে তোলে।” তা এ কথা তিনি মন্দ বলেননি। কিন্তু আমাদের লেখক ইমদাদুল হক মিলন এক ইন্টারভিউতে জানিয়েছিলেন তিনি ভাবতে পারেন না যে কোনো সুন্দরী টয়লেটে কেন পাদও মারতে পারে! হয়তো এসব চিন্তার প্রতিচিন্তা হিসেবেই প্রতিবাদী মুভমেন্ট হিসেবে শুরু হয়েছিল পশ্চিমে প্রথম নারীবাদী মুভমেন্ট।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে চুরি

নারীবাদ বা Feminism শব্দটি ফরাসি ‘Feminine’ থেকে এসেছে। এর অর্থ ‘নারী’। এই শব্দটির সঙ্গে ‘Ism’ বা ‘বাদ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে Feminism-এ পরিণত হয়। আর নারীবাদী ওইসব নারী-পুরুষকে বোঝায়, যাঁরা নারীর পক্ষালম্বন করেন অবশ্যই যুক্তির মাধ্যমে। জুডিথ অ্যাস্টেলারা তাঁর ‘Feminism and Democratic Transition in Spain’ বইতে নারীবাদ বিষয়ে বলেন, “নারীবাদ হচ্ছে সামাজিক পরিবর্তন ও আন্দোলনের লক্ষ্যে একটি পরিকল্পনা, যা নারী নিপীড়ন বন্ধ করার লক্ষ্যে চেষ্টা করে থাকে। সব কয়টি নারীবাদ সম্পর্কে আলোচনা না করে শুধু লিবারেল, মার্কসিস্ট বা সোশ্যালিস্ট এবং র্যাডিকাল নারীবাদ সম্পর্কে প্রথমে অল্পতে বোঝার চেষ্টা করব।

লিবারেল বা মডারেট ফেমিনিজম চিন্তাধারাটি এসেছে রাজনৈতিক উদারতাবাদের তত্ত্ব থেকে। মেরি ওলস্টোন ক্রাফট (১৭৫৯-৯৭) এই চিন্তাধারার অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁকে বলা হয় নারীবাদের আলোকবর্তিকা। বেটি ফ্রাইডান (The Feminine Stique-1963/The Second Stage-1981) আধুনিক যুগের, বিশ শতকের উদারতাবাদে বিশ্বাসী নারী। উদারতাবাদ নারীতত্ত্ব মনে করে, সমাজ একটি টোটাল সত্তা। নারী-পুরুষ নিয়েই সমাজ গঠিত। সমাজকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। নারী-পুরুষের মাঝে সমতা আনতে হবে। কাজেই নারীকে শিক্ষিত করে কর্মজীবী নারীতে পরিণত করতে হবে। লিবারেল ফেমিনিজম মনে করে, আইনগত বৈষম্য, চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতাই নারী-পুরুষ বৈষম্যের মূল কারণ। নারীদের অধস্তন অবস্থানটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ গ্রহণ করায় এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। অবস্থান পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সমাজ সচেতনতা এবং শিক্ষা বিস্তার। তবে নারী যত দিন আত্মসচেতন না হবে, ততদিন নারীর অধস্তনতা দূর হবে না। লিবারেল ফেমিনিস্টদের কেউই নারী-পুরুষ বৈষম্যের গোড়ার ওপর কিছু লেখেননি। মনে হয়, তাঁরা একেবারেই ধরে নিয়েছেন, প্রকৃতিগত বৈষম্যের ফলেই নারী-পুরুষ পৃথক; এবং এর ফলেই নারীর অধস্তন অবস্থা। তাঁদের মতে, উন্নত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি যতদিন পর্যন্ত আবিষ্কার না হবে, ততদিন নারীরা সন্তান জন্মদান এবং লালন-পালনের জন্য অধিকাংশ সময় ব্যয় করবেন। লিবারেল ফেমিনিস্টরা পুরুষকে তাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন না। কাজেই মাতৃত্ব এবং পরিবার তাঁদের সমালোচনার বিষয়বস্তুও নয়। তবে বর্তমানে পরিবার যেভাবে গঠিত, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার। বেটি ফ্রাইডানের মতে, যখন একজন নারী একজন মানুষের মতোই সম্পূর্ণ স্বাধীন হবেন, পরিবার তখন তাঁর ওপর কোনো অত্যাচার করতে পারবে না।

আরো পড়ুন ➥ বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ

লিবারেলবাদীরা সমাজ পরিবর্তনে বিপ্লবের কথা বলেন। কিন্তু বিপ্লবকে তাঁরা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেননি। তাঁদের মতে, বর্তমান সমাজব্যবস্থার মধ্যে থেকেও পরিবর্তন আনা সম্ভব, নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যে সমতা আনা যায়। তাঁদের অধিকাংশই মনে করেন, সমাজ সংশোধনের মাধ্যমেই ঈপ্সিত পরিবর্তনটি সম্ভব। মার্কসীয় নারীবাদে নারীসমাজের নিপীড়নের ব্যাখ্যা অপ্রতুল। মার্কসবাদে শ্রমিক শ্রেণীর ওপর বুর্জোয়া শ্রেণীর শোষণ-নিপীড়নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রচুর। কিন্তু নারীর ওপর পুরুষের নির্যাতনের ভয়াবহতা তেমনভাবে প্রকাশ করা হয়নি। আসলে মার্কসীয় নারীবাদের অপ্রতুলতার কারণেই সমাজতন্ত্রী নারীবাদের জন্ম। এই মতবাদে বিশ্বাসীরা মনে করেন, সভ্যতার ঊষালগ্নে নারীদের এই অধস্তন অবস্থানটি ছিল না। বরং সমাজে তাঁরা নেতৃত্ব দিতেন। পরিবার প্রতিপালনের দায়িত্ব ছিল প্রধানত নারীদের। পুরুষরা সেই যুগে খাবার সংগ্রহে বা শিকারে যেতেন। কিন্তু এ দুটোই ছিল অনিশ্চিত। অন্যদিকে নারীরা নিশ্চিত খাবার অর্থাৎ ফলমূল জোগাড় এবং সন্তান লালনের কর্তব্য কাঁধে নেওয়ায় সমাজ ও পরিবারের উপরের আসনটি দখল করে নিয়েছিলেন। কিন্তু সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে চাষাবাদের অগ্রগতি, নিত্যনতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার নারী জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনলেও নারীর আসনটিকে সমাজে পুরুষের চেয়ে অধস্তন করে দেয়। কারণ পুরুষ প্রযুক্তিগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। এক্ষেত্রে নারীরা ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় পুরুষতান্ত্রিক পরিবার, ব্যক্তিমালিকানা, শ্রেণীবিভক্ত সমাজ, কেউ উৎপাদক/কেউ উৎপাদিত দ্রব্যের মালিক। এগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্র পুরুষের স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে যুক্ত হয়। কালক্রমে সমাজে পরিবারের দায়িত্বও পরিবর্তিত হয়—পরিবার পুঁজি গঠনের সহায়ক ব্যক্তির মানসিক শান্তি বা ব্যক্তিত্বও বিকাশের কেন্দ্রস্থল নয়। সেই যে নারীরা বৈষম্যের শিকার হলো, যুগের পর যুগ তা-ই চলে আসছে। সব যুগ, বিশেষ করে পুঁজিবাদী যুগ নারী শোষণকে আরো তীব্রতর করেছে। পুঁজিবাদ নারীর নারীত্বকে পুঁজি করে ব্যবসা করছে, আবার পুরুষের সঙ্গে একই শ্রমে নারীকে মজুরি কম দিচ্ছে। যেহেতু ব্যক্তিমালিকানা এবং শ্রেণী বিভাজিত পুঁজিবাদ সমাজই পুরুষ প্রাধান্য এবং নারী বৈষম্যের মূল কারণ, সুতরাং নারী মুক্তি এবং নারী-পুরুষ সমতার জন্য সমাজে একটি ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ প্রয়োজন। এসব সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী চিন্তাভাবনার মূল যোগানদার ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস।

রেডিক্যাল ফেমিনিজমের ধারণা সাম্প্রতিক বিশ্বের বিশ শতকের সত্তর দশক থেকে। শুলামিথ ফায়ারস্টোন তাঁর নারীবাদী একটি বইয়ে ধারণাটি বিশ্লেষণ করেন। মতবাদে পুঁজিবাদকে নারী বৈষম্য-বঞ্চনার সোর্স হিসেবে স্বীকার করা হয় না। বরং বলা হয়, নারী-পুরুষ বৈষম্য প্রকৃতিগত। বলেন এইটা বলার পর আর নারীবাদের ভিত্তি মজবুত থাকে রেডিক্যালদের। রেডিক্যাল ফেমিনিস্টরা মনে করেন, বেশিরভাগ কর্মজীবী মহিলাই এখনো দুটো কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তাঁদের মতে, একত্রে বসবাসেও পরিবারের ধারণা অনেক কমে আসবে। ফায়ারস্টোন মনে করেন, নারী নিপীড়নের মূল যেহেতু জৈবিক, কাজেই উভয়লৈঙ্গিক সমাজ গঠিত হলে সমাজে নারীর ওপর অত্যাচার থাকবে না। কিন্তু কিভাবে এ ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠা হতে পারে? তার পদ্ধতিও র্যাডিক্যাল ফেমিনিস্টরা উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে, নারীমুক্তিতে বিপ্লবই প্রয়োজন। সে বিপ্লবই নারীমুক্তি বিপ্লব; অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লব নয়। কাজেই আমরা দেখি, সোশ্যালিস্ট ফেমিনিস্ট এবং র্যাডিক্যাল ফেমিনিস্ট—উভয়েই বিশ্বাস করেন, নারীরা বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন, নির্যাতিত হচ্ছেন। কিন্তু কেন এই অসমতা দুই দলের, দুই ধরনের মতবাদ। প্রথম দলটি মনে করে, অর্থই অনর্থের ভূমিকা পালন করছে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি তথা পুঁজিবাদ এর মূল কারণ। আর দ্বিতীয় দলটি মনে করে, পিতৃতন্ত্র অথবা পুরুষ প্রাধান্য অথবা পুরুষত্বই নারী নির্যাতনের প্রধান কারণ। তবে দুটি দলই পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা চাচ্ছে। নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতা, লিঙ্গ বিতর্ক এবং নারীবাদ একেবারেই আধুনিক প্রপঞ্চ, এবং উদ্ভব প্রায় একইসঙ্গে ইউরোপ ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে। এই শব্দবন্ধগুলি ব্যবহার শুরু হয় ১৮৩০ সাল থেকে। একধরনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে এটি ব্যাপ্ত হয় ১৯২০ সাল পর্যন্ত, এটা ছিল মূলত নারীশিক্ষা ও ভোটাধিকার অর্জনের আন্দোলন। নারীবাদের ইতিহাসে এই কাল-পরিসরকে প্রথম পর্যায় বা তরঙ্গ ধরা হয়। দ্বিতীয় তরঙ্গ বা পর্যায়ের শুরু ১৯৬০ সাল থেকে, এটি সংগঠিত আন্দোলনের কাল। এই পর্যায়ে এসে নারী স্বাধীনতার প্রশ্নটি প্রকাশ্য ও বহুমাত্রিকতা লাভ করে, শুরু হয় এর বাস্তবায়ন ও অনুশীলনও। পরিবার ও সমাজে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার, সর্বস্তরে চাকরি ও কাজ করার অধিকার, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ এবং গর্ভপাত ও জন্মনিয়ন্ত্রণের স্বাধীনতা, ইত্যাদি ছিল এর মূল বিবেচ্য বিষয়।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্য করে ‘ধনী’ ও ধনী হয়ে ‘সাহিত্য’ করার গল্প

১৯২১ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত সময়টুকুকে এই পর্যায়ের মাঝখানে সেতুবন্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই অন্তর্বর্তীকালের মধ্যেই ফ্রান্সের মহিলা দার্শনিক সিমোন দ্য বোভেয়ারের ‘দি সেকেন্ড সেক্স’ (নিজ ভাষায় ১৯৪৯ সালে, ইংরেজি অনুবাদে ১৯৫৩ সালে) বইটি প্রবাশিত হয়। সেসময় বেশিরভাগ দেশেই গর্ভপাত এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ নিষিদ্ধ ছিল। এই বইয়ের অনেক বিষয় এবং দৃষ্টিভঙ্গিই ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়, কালে কালে কিছু-কিছু অগ্রহণযোগ্যও হয়ে পড়ে, তথাপি এই বইটির নৈতিক প্রভাব নারীবাদী আন্দোলনের ওপর এখনো বর্তমান। সেসময় ‘সমমানের কাজের জন্য সমান পারিশ্রমিক চাই’ (equal pay for equal work)—এই সমানাধিকারমূলক নারীবাদী (equality feminism) ধারণার উদ্ভাবক আমেরিকান নারী নেত্রী বেটি ফ্রিড্যান, তাঁর বইটির নাম ‘দ্য ফেমিনাইন মিসটিক’, এটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। বোভেয়ারকে যেমন ইউরোপে দ্বিতীয় পর্যায়ের নারীবাদী আন্দোলনের বাতিঘর হিসেবে গণ্য করা হয়, তেমনি ফ্রিড্যানকে আমেরিকায় একই মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৯৬৬ সালে তিনি ‘ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ উইমেন’ (NOW) গঠন করে নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন।

পরবর্তীকালে বোভেয়ারের অ্যান্টি-এসেনশিয়ালিস্ট চিন্তাধারাকে এগিয়ে নিতে বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছেন আমেরিকান উগ্রপন্থী নারীবাদী চিন্তাবিদ শুলামিথ ফায়ারস্টোন। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ দ্য ডায়ালেকটিক অফ সেক্স নারীমুক্তি আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়কে গতিমান করে। এই বইতে তিনি পূর্বসূরি বোভেয়ারের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে দাবি করেন, নারীকে তার জীববৈজ্ঞানিক সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।

আরো পড়ুন ➥ শিল্পসাহিত্যে ‘স্বাধীনতা’

আমেরিকান নারীবাদী ধর্মতত্ত্ববিদ মেরি ডালির একটি বই ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয়। Gyn, Ecolog. তাঁর মতে, ধর্ম, আইন এবং বিজ্ঞান পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার হাতিয়ার। তিনি বিশেষভাবে খ্রিস্টতত্ত্বের ‘প্রভু পিতা’ (God the father) ধারণার কঠোর সমালোচনা করেন এবং একে নারীমুক্তির পথে বিরাট প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি প্রথম নারীবাদী অভিধানও লেখেন। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন, নারীরা ভালো। পুরুষরা খারাপ। প্রকৃতিগতভাবেই। আর এখান থেকেই উদ্ভূত হয়েছে ‘ইকোফেমিনিজম’ (Ecofeminism)। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শান্তিবাদী আন্দোলন এই ধারণাকে জনপ্রিয় করে তোলে। তখনই আরো দুটি ধারার মুভমন্টে শুরু হয়, যেমন, ‘সেপারেটিস্ট ফেমিনিজ’, ‘লেসবিয়ান ফেমিনিজম’। এই দুই ধারা পুরুষবর্জন করে। তবে মধ্যপ্রাচ্য, চীন এবং ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোতে যে নারীবাদী চিন্তার বিকাশ ঘটে এগুলো ইউরোপ-আমেরিকার চিন্তাধারা থেকে বেশ পৃথক।

ইসলামী নারীবাদ আবার পাশ্চাত্যীয় ধারার আধুনিক ধর্মবিমুখ নারীবাদ বিরোধী। ইসলামী নারীবাদ চেয়েছে ইসলামের মৌলিক জীবনদর্শনের মধ্যে থেকেই নারীর সকল অধিকার আদায় করতে ইসলাম সুস্পষ্টরূপে নারীকে যেসব অধিকার দিয়েছে সেগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং বিভিন্ন ইসলামী বিধানের প্রচলিত ভুল ব্যাখ্যার অপনোদন বা নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপনের মাধ্যমে। এসেনশিয়ালিস্ট ফেমিনিজম-এর অনেক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ইসলামিক ফেমিনিজম-এর সমিলতা লক্ষ্য করা যায়। এই দুটো ধারাই নারীকে নারী হিসেবেই মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চায়, নারীত্ব ও মাতৃত্ববোধ এবং প্রকৃতির সঙ্গে নারীর সাযুজ্যকে (Ecofeminism) বিশেষ গুরুত্ব দান করে। নারীবাদী আন্দোলন মুসলিম বিশ্বে শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে, প্রথমে ইরান ও মিসরে। এরপর আরববিশ্বসহ অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতেও তা ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত মিসরীয় আইনবিদ ক্কাসিম আমিনের ‘তাহরির আল-মার’ (Women’s Liberation) বইটি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। ১৯২৩ সালে হোজা শারাভি ‘ইজিপশিয়ান ফেমিনিস্ট ইউনিয়ন’ গঠন করেন। ১৯৫৬ সালে প্রেসিডেন্ট গামাল আব্দুল নাসের ‘রাষ্ট্রীয় নারীবাদ’ প্রবর্তন করেন। আরববিশ্বসহ সকল মুসলিম দেশেই নারীবাদের ইসলামী ও ধর্মনিরপেক্ষ ধারা পাশাপাশি বিকশিত হয়েছে।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে নোবেল, প্রত্যাখ্যান ও কেড়ে নেওয়ার গল্প

ঊনবিংশ শতাব্দীতে মহান সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়ের প্রস্তাবিত ‘সহমরণ বিষয় প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ’-এর মাধ্যমে হিন্দু সমাজ থেকে ‘সতীদাহ প্রথা’ চিরতরে রদ হলেও এই একবিংশ শতাব্দীতেও বিভিন্ন অমানবিক প্রথা বন্দী করে রেখেছে বাঙালি নারীকে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবিনাশী অবদানে বিধবা বিবাহ প্রচলন; বাল্যবিবাহ বন্ধের মাধ্যমে ‘নারী’ ফিরে পেয়েছিল তার আধেক মুক্ত জীবন। কিন্তু পুরোপুরি পায়নি এটা আমরা সবাই জানি।

বাংলা সাহিত্যে নারীর অবস্থান এখনো অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’র মতো—
“পূজা করি রাখিবে মাথায়, সেও আমি নই,
অবহেলা করি পুষিয়া রাখিবে
পিছে সেও আমি নহি। যদি পার্শ্বে রাখো
মোরে সংকটের পথে, দুরূহ চিন্তার
যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি করো
কঠিন ব্রতের তব সহায় হইতে,
যদি সুখ-দুঃখে মোরে করো সহচরী
আমার পাইবে তবে পরিচয়।”
১৮৭৩ সালে কুমিল্লায় নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী নারীশিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় একই সময়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে মুর্শিদাবাদের নবাব ফেরদৌস মহল এবং খুজিস্তা আখতার সোহরাওয়ার্দী কলকাতায় মেয়েদের জন্য পৃথক দুটি স্কুল করেন। বেগম রোকেয়া ১৯০৯ সালে বিহারের ভাগলপুরে মেয়েদের স্কুল করেন। সেটি ১৯১১ সালে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু সংগঠিত নারীবাদী আন্দেলন বলতে যা বোঝায় তা তখনও শুরু হয়নি, যদিও বেগম রোকেয়া তাঁর সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে সেই কাজটি সম্পূর্ণ একাকীই শুরু করেছিলেন।

নারীবাদী আন্দোলনের একটি বড় ফসলতা ‘নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব’। এটা নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। সাহিত্য সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে সম্পূর্ণ বদলে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টির প্রয়াস থেকে এই তত্ত্বের জন্ম। বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকের আগে সাহিত্যকর্ম এবং সাহিত্যবিচারপদ্ধতি ছিল পৌরুষীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন। ভার্জিনিয়া উল্ফ, জেন অস্টিন, জর্জ এলিয়ট এবং শার্লট ব্রন্টি ছিলেন ব্যতিক্রম। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বের কাজ আরো আগেই শুরু করেছিলেন ভার্জিনিয়া উলফ। তাঁর ‘একজনের নিজের ঘর (A Room for One’s Own) প্রবন্ধে তিনি নারীদের যে নিজস্বতার প্রয়োজনীয়তা, স্বাতন্ত্র্য ও অধিকারের কথা বলেন সত্তর দশকে এসে নারীবাদী সাহিত্যিকরা তারই ধারাবাহিকতায় কাজ শুরু করেন। এরপর বেভোয়ারের পর ১৯৬৯ সালে কেইট মিলার প্রকাশ করেন তাঁর জনপ্রিয় বই ‘যৌনতার রাজনীতি’ (Sexual Politics)। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ডালি স্পেন্ডারের মাদার্স অফ দি নভেল এবং জেন স্পেন্সারের দি রাইজ অফ দি উইম্যান নভেলিস্টস বই দুটি বেশ সাড়া ফেলেছিল। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যতত্ত্ব, যার শাখা-প্রশাখাও ছড়িয়েছে বেশ কিছু, যেমন ‘গে সাহিত্য’ এবং ‘লেসবিয়ান সাহিত্য।’ উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যতত্ত্ব এবং উত্তর-আধুনিক সাহিত্যতত্ত্ব নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বকে শক্তিশালী ও বহুমাত্রিক করে তোলে।

আরো পড়ুন ➥ স্ট্রিট লিটারেচার

এদিকে ১৯০৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় বেগম রোকেয়ার প্রথম বই ‘মতিচুর’ (প্রথম খণ্ড)। সাতটি চিন্তাশীল প্রবন্ধ নিয়ে এই বইটি রচিত। বেগম রোকেয়ার প্রথম ইংরেজি রচনা, ব্যঙ্গরসাত্মক রূপক রচনা Sultana’s Dream প্রকাশিত হয় মাদ্রাজ থেকে কমলা সাতথিয়া নাথান ও সরোজিনী নাইডু সম্পাদিত Indian Ladies Magazine পত্রিকায়, ১৯০৫ সালে। এটি বই হিসেবে প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালে।

বেগম রোকেয়া ‘মতিচুর’-এ লিখেছিলেন, “আমি ভগিনীদের কল্যাণ কামনা করি, তাঁহাদের ধর্ম্মবন্ধন বা সমাজবন্ধন ছিন্ন করিয়া তাঁহাদিগকে একটা উন্মুক্ত প্রান্তরে বাহির করিতে চাহি না। মানসিক উন্নতি করিতে হইলে হিন্দুকে হিন্দুত্ব বা খ্রিস্টানকে খ্রিস্টানী ছাড়িতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। আপন আপন সম্প্রদায়ের পার্থক্য রক্ষা করিয়াও মনটাকে স্বাধীনতা দেওয়া যায়। আমরা যে কেবল উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে অবনত হইয়াছি, তাই বুঝিতে ও বুঝাইতে চাই।”

তিনিই লিখেছিলেন, “যে পর্যন্ত পুরুষগণ শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে স্ত্রীলোকদিগকে তাহাদের প্রাপ্য অধিকার দিতে স্বীকৃত না হয়, সে পর্যন্ত তাহারা স্ত্রীলোকদিগকে শিক্ষাও দিবে না। যাহারা নিজের সমাজকে উদ্ধার করিতে পারিতেছে না, তাহারা আর দেশোদ্ধার কীরূপে করিবে? অর্ধ্বাঙ্গীকে বন্দিনী রাখিয়া নিজে স্বাধীনতা চাহে, এরূপ আকাঙ্ক্ষা পাগলেরই শোভা পায়! সদাশয় ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট যেমন ভারতবাসীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা সহ্য করিতে চাহেন না—আমার মনে পড়ে প্রায় ২১ বৎসর পূর্ব্বে মিস্টার মর্লি বলিয়াছিলেন, “যদি তাহারা চাঁদের জন্য আবদার করে (If they cry for the Moon), তাহা আমরা দিতে পারি না” ইত্যাদি এবং আমাদের অমুসলমান প্রতিবেশীগণ এখন সাধারণত যেরূপ মুসলমানদের দাবি-দাওয়া সহ্য করিতে পারেন না, সেইরূপ মুসলমান পুরুষগণও নারীজাতির কোনো প্রকার উন্নতির অভিলাষ স্বীকার করিতে চাহেন না।” উল্টোদিকে তসলিমা নাসরিন তার শোধ উপন্যাসে দেখান, স্বামী পরকিয়া প্রেম করে বলে স্ত্রীও পরকিয়া প্রেমে মেতে ওঠে। বা নারীদের পুরুষ বেশ্যাও তিনি খুঁজতে বলেছেন। উল্টোদিকে বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ একটি স্বল্পায়তনিক রচনা। এটিকে ছোটগল্প বলাই সমীচীন। এটি একটি ব্যাঙ্গ-রসাত্মক সৃষ্টি। একে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীও বলা চলে। নারী যে কোনো অংশেই পুরুষের তুলনায় কম নয় সেটি একটি কল্পকাহিনীর মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন বেগম রোকেয়া। এই গল্পে নারীরা তাঁদের জ্ঞান, দক্ষতা, উদ্যম এবং কর্মতৎপরতার জোরে যে দেশ গড়ে তুলেছেন সেটি ‘নারীস্থান’, অর্থাৎ নারীদের বা নারীশাসিত বা নারী-প্রাধান্যের দেশ। এখানে লেখক নারীকে পুরুষের সমান নয়, বরং তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর হিসেবে চিত্রিত করেছেন।

আরো পড়ুন ➥ তবু সে দেখিল কোন ভূত

এছাড়া বাংলা সাহিত্যে নারীবাদী রচনার মধ্যে রয়েছে আশাপূর্ণা দেবীর বিখ্যাত ট্রিলজি, প্রথম প্রতিশ্রুতি (১৯৬৫), সুবর্ণলতা (১৯৬৭), ও বকুল কথা (১৯৭৪)। মোটামুটিভাবে আশাপূর্ণা দেবীর সব লেখাই নারী কেন্দ্রিক। তবে এসব লেখা নারীকেন্দ্রিক হলেও নারীবাদী নয়।

ষাটের দশক পেরিয়ে সত্তরে পৌঁছে নারীকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যে এক লক্ষণীয় পরিবর্তন এলো। এ পর্যন্ত সাহিত্যের জগতে ঘোরাফেরা করেছে মধ্যবিত্ত মেয়েরা; গল্প উপন্যাস গড়ে উঠেছে তাদের মানসিক টানাপড়েন নিয়ে। এবারে আনাগোনা আরম্ভ হলো শ্রেণী, বর্ণ, ধর্ম, ও দারিদ্রসীমার বাইরে দাঁড়ানো মহিলাদের। এবারে শুধু মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নয়, দৈনন্দিন খাওয়া পরা, রাজনৈতিক নির্যাতন, বেঁচে থাকার তাগিদ নিয়ে সাহিত্য গড়ে উঠল। এই নতুন প্রবণতার সূচনা হয়েছিল আগেই, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (বুড়ি, ১৯৬৩; নিচু চোখে একটি মেয়েলী সমস্যা, ১৯৬৩) ও তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের (ডাইনী, ১৯৭৩) কিছু ভিন্নধর্মী রচনা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। তবে মহাশ্বেতা দেবীর হাতে এই জাতের গল্প যেন প্রাণ পেল। তাঁর গল্পে আমরা পাই পুলিশী অত্যাচারে নিহত নকশাল সন্তানের ফুরিয়ে যাওয়া মাকে (হাজার চুরাশীর মা), দোপদি মেঝেনকে (দ্রৌপদী), ধনীর ছেলের স্বাস্থ্যের খাতিরে বুকের দুধ বিক্রি করে বেঁচে থাকা যশোদাকে (স্তন্যদায়িনী)। এদের জীবনের মধ্যে দিয়ে সার্বজনীন নারীবাদের জটিলতা মহাশ্বেতা দেবী তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন। আমাদের দেশে পূরবী বসু এবং শফি আহমেদ সম্পাদিত একটি সঙ্কলনে বাংলাদেশের প্রবীণ থেকে নবীন, নানা বয়সের লেখকের একগুচ্ছ নারীবাদী ছোটগল্প আমাদের উপহার দিয়েছেন। এর অনেকগুলিই সাহিত্যের চেয়ে রাজনৈতিক জবানীর প্রতি বেশী মনোযোগী। দরিদ্র নারী আর সমাজের বৃত্তচ্যুত সংসার ঘিরে এই নারীবাদী লেখিকারা তাঁদের গল্পের জাল বুনেছেন। সেলিনা হাসান (মতিজানের মেয়েরা), নয়ন রহমান (বীরপুরুষ), রাবেয়া খাতুন (নাগমোতির হাটে), ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ (সূর্য তৃষিতা) মধ্য বা উচ্চবিত্ত সমাজের ধার ঘেঁষেননি। তাঁদের নায়িকারা বাড়ির ঝি, গ্রামের বৌ, বিক্রিত কন্যা। এঁদের অনেকেই নারী-শরীরের সরিকত্ব নিয়েও সচেতনতা আনতে চেয়েছেন। আমার শরীর আমার কাছে, অন্যের কী বলার আছে। এগুলো নারীবাদী সাহিত্যের বাইরেই রাখতে চাই আমরা।

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;