কোলাজ মন্তাজ

সাহিত্যে চুরি



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

সাহিত্যে অন্য লেখকের ‘ভাব’ বা ‘ধারণা’ বা পুরো বিষয়টিই চুরি করার অভিযোগ আছে। অভিযোগ পুরনো। চুরিও পুরনো পেশা। তাই দুটিই চলছে এখনো। এ অভিযোগ থেকে রেহাই পাননি বিশ্বসাহিত্যের অনেক সেরা সাহিত্যিকরাও। তবে জর্মন কবি গ্যাটে বলেছেন, সাহিত্যে তালি মারা (মানে একজায়গা থেকে এক ভাব নিয়ে অন্য জায়গা থেকে অন্য ভাব নিয়ে মিশেল করা) আর্ট। একে চুরি বলা ঠিক না। কারণ বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল এখানে খাটাতে হয়। শুধু হুবহু চুরি না করলেই হয়। লাতিন শব্দ ‘প্লেজিয়্যারিয়াস’-এর অর্থ হচ্ছে সাহিত্য ভাবনা চুরি বা অপহরণ।

বাংলায় এর যথার্থ শব্দ কী হবে আমি জানি না। তাই সরাসরি চুরিই ব্যবহার করছি। ইংরেজ নাট্যকার বেন জনসন ১৬০১ সালে শব্দটিকে ইংরেজি সাহিত্যে পরিচয় করিয়ে দেন। পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কারণ তাঁরই এক বন্ধু ‘ডিফল্টার’ নামে তাঁর এক নাটক ফরাসি ভাষায় হুবহু চুরি করে লিখেছিলেন। সেই বন্ধুর নাম, ফ্লবে আত্র। তবে যেসব লেখকেরা চুরির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে বড় একটা অংশ অভিযোগ অস্বীকার করে যা বলেন সেটি হচ্ছে—“বিষয়টি ঘটেছে কাকতালীয় বা ভাবনার সাযুজ্যের” জন্য। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, “আর্টস ইজ আ মিউটেশান”—মানে শিল্পের রূপান্তর ঘটানো যায়। এর জন্য কী লাগে হে? শব্দের ডিনোটেটিভ বা শাব্দিক অর্থ আড়াল করা। এই আড়াল করাকে বলা হয় ইউফেমিজম। এই ইউফেমিজমের ভেতরেই থাকে প্যারাফ্রেজিং, সাবকন্সাস প্যারাফ্রেজিং, ডাইল্যুশান ইত্যাদি। যেমন একটা উদাহরণ দেওয়া যায় , কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বিদ্রোহী কবিতার জন্য বিশেষ খ্যাত। নজরুলের এ কবিতার “বলো বীর—/ বলো উন্নত মম শির,/ শির নেহারি আমারি নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!/ বলো বীর—/ বলো মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি/ চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/ খোদার আসন আরশ ছেদিয়া,/ উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!/ মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!/ বলো বীর—/ আমি চির উন্নত শির।”-এর জায়গায় একসময় ভবকুমার প্রধান লিখেছিলেন ‘অসমছন্দ’ কবিতাটি। কবিতাটি এমন: “আমি ব্যাঙ/ লম্বা আমার ঠ্যাং/ ভৈরব রভসে বর্ষা আসিলে ডাকি যে গ্যাঙোর গ্যাং/ আমি ব্যাঙ/ আমি পথ হতে পথে দিয়ে চলি লাফ/ শ্রাবণ নিশায় পরশে আমার সাহসিকা/ অভিসারিকা/ ডেকে ওঠে ‘বাপ বাপ’।”

আরো পড়ুন ➥ বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ

অবশ্য সেসময় প্যারোডির নামেও এসব লেখা হতো। সজনীকান্তের কাব্যপ্রতিভা তো প্যারোডি করতে করতেই ফুরাইল বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। প্রশ্ন হলো কেন এরকম চুরি করেন সাহিত্যিকরা? এর জবাবে টি এস এলিয়ট বলছেন, “অপরিণত কবিরা অনুকরণ করেন; পরিণত কবিরা চুরি করেন।” অথচ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ব্রিটেনের অখ্যাত কবি ম্যাডিসন কেইনের কবিতা চুরির। বিশ্বখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের এমন কিছু নাম এ তালিকায় আসবে অনেকেই জেনে হোঁচট খাবেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে শেক্সপিয়র। ভায়া পাবলো নেরুদা থেকে ২০০২ সালে তাঁর ‘লাইফ অব পাই’ উপন্যাসের জন্য ম্যান বুকার পুরস্কার জেতা ইয়ান মার্টল হয়ে ড্রান ব্রাউন, জীবনানন্দ দাশ ও আমাদের দেশের হেলাল হাফিজসহ অসংখ্য।

এডগার এলান পো ও ন্যাথানিয়েল হর্থনের গল্পের মিল রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গল্পে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রবিবার’ গল্পটি হুবহু এলান পো-র ‘দি এথিস্ট’ গল্পের কার্বন কপি। এদিকে পাবলো নেরুদাও বসে নেই। তিনি উঠতি বয়সে রবীন্দ্রনাথের ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’-কে “In my sky at twilight you are like a cloud” এবং ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’-কে “Come with me, I said, and no one knew” শিরোনামে প্যারাফ্রেজ করে লিখেছিলেন। পরে অবশ্য ভুল স্বীকার করেছিলেন। আর শেক্সপিয়র? তাকে নিয়ে এতকাল এমন একটি গল্প প্রচলিত ছিল যে, এক যোদ্ধা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ঘোড়ায় চড়ে পালানোর সময় তাঁর কাছ থেকে একটি ব্যাগ পড়ে যায় সেই ব্যাগে কিছু পাণ্ডুলিপি ছিল। সেগুলো থেকেই নাকি শেক্সপিয়র লিখেছেন। ওগুলোকে গালগল্প হিসেবে শেক্সপিয় ভক্তরা চালালেও এখন তারা কি বলবেন যে শেক্সপিয়ার মহাচোর ছিলেন না ? অতি সম্প্রতি তাঁর সৃষ্ট কিং লিয়ার, ম্যাকবেথ, রিচার্ড তৃতীয়, হেনরি পঞ্চম এবং আরো সাতটি মোট এগারোটি নাটক যে চুরি করে লেখা আজ তা প্রমাণিত। এটি ধরা পড়েছে প্লেজ্যারিজম সফটওয়্যার Wcopyfind-এর সাহায্যে। ভাবুন অবস্থা! চুরি করলে কিন্তু মাফ নেই। বেরিয়ে গিয়েছে প্রযুক্তির বদৌলতে চোর ধরার সফটওয়্যারও।

ভূমেন্দ্র গুহরায়কে একবার কথায় কথায় জীবনানন্দ বলেছিলেন, “তুমি কি কুম্ভীলকবৃত্তির কথা বলছো? তুমি যে সমাজে বাস করো, সে সমাজের ভাষাও তোমার জিভে চলে আসে।... তুমি যদি অ্যাডগার অ্যালান পো-র, ইয়েটসের, কিটসের বা এলিয়টের সমাজে বাস করো, তোমার জিভে কী ভাষা আসবে? সেই ভাষাই চলে আসে জিভে। তাকে কুম্ভীলকবৃত্তি বলে না।” এ কথা বলার কারণ কী? কারণ হচ্ছে ভূমেন্দ্র গুহরায় জীবনানন্দকে বলেছিলেন, “তোমার কবিতার সঙ্গে অনেকে কিটস, ইয়েটসের কবিতার মিল খুঁজে পান। এটি কেন?” চলুন দেখি তেমন মিল। যেমন, কিটসের সনেট, ‘অন ফার্স্ট লুকিং ইন টু চ্যাপম্যানস হোমার’—
Much have I traveled in the realms of gold
And many goodly states and kingdoms seen;

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্য করে ‘ধনী’ ও ধনী হয়ে ‘সাহিত্য’ করার গল্প

এই লাইন দুটি পড়ার পর কি আপনার জীবনানন্দের ‘অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে’ লাইন মনে পড়ছে না? এখানে চুরি কিন্তু হুবহু করা হয়নি। তবে কী করা হয়েছে? করা হয়েছে কিছুটা সরাসরি আর কিছুটা বাক্যাংশ পাল্টে। যাকে বলে ডাইলিউশান। এ ডাইলেশনের কথা শুরুতেই বলেছি। ইয়েটসের ‘He reproves the Curlew’ কবিতায় জীবনানন্দের ‘হায় চিল’ কবিতার মিলটি কেমন দেখা যাক—
O, CURLEW, cry no more in the air,
Or only to the water in the West;
Because your crying brings to my mind
Passion-dimmed eyes and long heavy hair
That was shaken out over my breast:
There is enough evil in the crying of wind.

অবশ্য জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে অনুসরণ করেই লিখে গিয়েছেন দুই বাংলার অনেক কবি। এরমধ্যে বাংলাদেশের নব্বই দশকের তিন/চারজন কবিও রয়েছেন।

আমাদের দেশের হেলাল হাফিজের জনপ্রিয় কবিতা, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। এটির সঙ্গে অদ্ভুত মিল রয়েছে রোমান কবি অভিদের ‘লাভ অ্যান্ড ওয়ার’ কবিতার তিন নম্বর লাইনে। সেই লাইনটি এমন, “ইয়ুথ ইজ ফিট ফর ওয়ার”। অভিদ, লাস্ট-অ্যান্টিকুয়িটি ও মধ্যযুগের শুরুর দিকে পশ্চিমের সাহিত্যে প্রভাবশালী কবি ছিলেন। ছিলেন জনপ্রিয়ও। হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ বই ব্যাপক জনপ্রিয়। এই বইকে সিমন দ্যা বোভেয়ারের ‘সেকেন্ড সেক্স’ বইয়ের নকল বলে থাকেন অনেকে। কিন্তু এখানে হুমায়ুন আজাদ হুবহু নকল করেননি। সিমন দ্য বোভেয়ারের ‘সেকেন্ড সেক্স’, ফেমিনিস্ট কেইটমিলারের রচনাবলির অংশবিশেষ ও সেকেন্ড ওয়েভ নারীবাদীদের মূল বিষয়টিই ছিল নারীর যৌন স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। তারা মনে করতেন এর মাধ্যমেই পুরুষতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফাটল ধরানো যাবে। হুমায়ুন আজাদও একই সুরে কথাবার্তা বলেছেন। মানে তিনি মূলভাবটা চুরি করেছেন বলা যায়। তাঁর ‘আমার অবিশ্বাস’ বইয়ের খনি যে ব্রার্টন্ড রাসেলের ‘হোয়াই আই এম নট এ ক্রিশ্চিয়ান’ এবং ইবন ওয়ার্কের ‘হোয়াই আই এম নট এ মুসলিম’—সেটি যারা ওই দুটি বই পড়েছেন তারা সহজেই ধরতে পারবেন। ওয়ার্কের বইতে ইসলামের ‘প্যাগান’ অরিজিন সংক্রান্ত একটি বিস্তৃত অধ্যায় আছে। হুমায়ুন আজাদ একই ইস্যুতে যে তথ্যগুলো উল্লেখ করেছেন তাঁর অনেকগুলোই এই অধ্যায়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে অবশ্য ড. আজাদের পক্ষে তাঁর ভক্তরা বলতেই পারেন আমেরিকান নাট্যকার উইলসন মিজনার কথা। মিজনার বলছেন, “একজনের লেখা বা ভাবনা অনুকরণ যদি দূষণীয় হয়, তবে দুজন বা ততোধিক লেখকের ধারণা বা ভাবনার অনুসরণ কী করে গবেষণার স্বীকৃতি পেতে পারে? তাহলে তো আর গবেষকদের ভাতই নেই। গবেষণা মাত্রই চুরি।”

আরো পড়ুন ➥ শিল্পসাহিত্যে ‘স্বাধীনতা’

মিজনার মন্দ বলেননি। গবেষকদের ক্ষেত্রে মাফ করা যায় কারণ তারা নতুন কিছু সৃষ্টি করছেন না। কিন্তু কবি-সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে কি মাফ করা যায়? কারণ তারা তো নতুন ভাষা তৈয়ার করবেন। যে কথাগুলো এতক্ষণ বললাম মিজনারের বক্তব্যের পর সেগুলো আমার নয়। বলছেন শিল্পসাহিত্যের বড় ওস্তাদ আর্নেস্ট ফিশার। সেই হিসেবে এই লেখা বা বইয়েও আমি চোর নই। শুধু তথ্য উপাত্ত খুঁজেছি আমি। এর বেশি কিছু নয়। তসলিমা নাসরিনের লেখা খুবই নিম্নমানের বলে খুব অল্প পড়েছি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ভারতের সুকুমারী দেবীর লেখা থেকে চুরি করার, এটা অনেকেই জানেন। কানাডীয় লেখক ইয়ান মার্টল ‘লাইফ অব পাই’ উপন্যাসের লিখে ম্যান বুকার জেতেন। কিন্তু ওই উপন্যাসটি ব্রাজিলের জনপ্রিয় লেখক মোআসির শ্লেয়ার এর ‘ম্যাক্স অ্যান্ড দ্য ক্যাটস উপন্যাসের কাট এন্ড পেস্ট। অবশ্য এরকম খ্যাতির জন্য চুরিকে মনোবিদরা বলছেন এটিও একধরনের মানসিক অসুস্থতা। কী মুশকিল, মানসিক অসুস্থতাই হয়ে যাবে লেখার জন্যে? খ্যাতির জন্যে? হলে হবে। সমস্যা হবে আপনার? ধরা না পড়লেই হলো। বাংলায় এমন কথা চালু আছে না, ‘চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ো ধরা’। ধরা পড়লেই যতসব বিপদ। ধরা পড়ে বিপদেই পড়েছিলেন ২০১১ সালে আমেরিকার লেখক কোয়েন্টিন রায়ান তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অ্যাসাসিন অব সিক্রেটস’ প্রকাশিত হওয়ার পর। কারণ ১১ জন লেখক তাঁর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ করেন। ঘটনা সত্যি হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করে কোয়েন্টিন রায়ান সব বই বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেন। ১৯৯৭ সালে আমেরিকার বেস্ট সেলার জ্যানেট ডাইলে স্বীকার করে নেন যে, তাঁর ‘নাইনটি থ্রি বডিস রিপার’ উপন্যাসটি, যেটি বিক্রি হয়েছিল দুশো মিলিয়ন কপি, সে উপন্যাসটির অনেক অংশ আরেক ঔপন্যাসিক নোরা রবার্টসের উপন্যাস থেকে চুরি করা। অপরাধ স্বীকার করতে গিয়ে তিনি টিভি সাক্ষাৎকারে কান্না করতে করতে বলেছিলেন, “লেখালেখিতে ক্রমাগত অপরের ভাবনা নকল বা অনুসরণ করা আমার জন্যে মনস্তাত্বিক এক বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। আমার বইয়ে নোরা রবার্টসের যেসব ধারণা বা অংশের নকল আমি করেছি, তা নকল করার ইচ্ছে আমার কোনো সময়ই ছিল না। এ সমস্যা নিয়ে আমি বর্তমানে মনোবিদের শরণাপন্ন হয়েছি। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না—এ আশ্বাস দিতে পারি আমার পাঠকদের।” মার্কিন মনেবিদরা এ রোগটির নাম দিয়েছেন, ‘স্কাপিসট্রি’।

এ রোগে ভুগতেন আমেরিকান উপন্যাসিক হ্যারল্ড কোয়োরল্যান্ডার। এরজন্য তাকে মাশুলও কম দিতে হয়নি। আমেরিকান উপন্যাসিক অ্যালেক্স হ্যালি ১৯৭৭ সালে হ্যারল্ড কোয়োরল্যান্ডারের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগে মামলা করেন। আদালতে দায়ের করা মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, হ্যারল্ড কোয়োরল্যান্ডারের দ্য আফ্রিকান উপন্যাসটির প্রায় ৮০ পৃষ্ঠা অ্যালেক্স হ্যালির উপন্যাস রুটস থেকে হুবহু নেওয়া। নিউইয়র্কের আদালতে মামলা বিচারাধীন অবস্থায় কোয়োরল্যান্ড ছয় লাখ ৫০ হাজার ডলারের বিনিময়ে আপোস করেছিলেন অ্যালেক্স হ্যালির সঙ্গে। এরপর আর লেখালেখি নিয়মিত করেননি হ্যারল্ড কোয়োরল্যান্ডার। বিদায় নেন এ জগৎ থেকে। অস্কার ওয়াইল্ড বিশ্বখ্যাত। তিনি আবার হ্যারল্ড কোয়োরল্যান্ডারের মতো এত কাবু হওয়ার মতন মানুষ ছিলেন না। তিনি চুরি করার পর স্বীকার করে বলেছেন যে, “অপরের ধারণা যুক্ত করে চূড়ান্ত সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠা লেখকের অধিকারের মধ্যে পড়ে।” তাঁর বই ‘দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে’র ধারণাগুলো লেখক জেকে হাইসম্যানের এগেনস্ট দি গ্রেইন (এ রিবোর্স) বই থেকে নেওয়া বলে অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এরপরই অস্কার ওয়াইল্ড সেকথা বলেছিলেন, এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি প্রেস তেকে প্রকাশিত একটি সংখ্যায়।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে নোবেল, প্রত্যাখ্যান ও কেড়ে নেওয়ার গল্প

বাংলার বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের ধাঁচটাও ছিল অস্কার ওয়াইল্ডের মতো। তবে বঙ্কিম চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পরও বেপরোয়া। স্বীকারই করেননি। বঙ্কিমের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ করেন প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক তারকনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানান বঙ্কিম ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে ওয়াল্টার স্কটের ‘আইভ্যানহো’র বহু অনুচ্ছেদ সরাসরি টুকেছেন। দুর্গেশনন্দিনীর আয়েষা চরিত্রটি নাকি হুবহু ‘রেবেকা’র নকল। কিন্তু বঙ্কিম তাঁর সুহৃদ-ত্রয়ী চন্দ্রনাথ বসু-শ্রীশচন্দ্র মজুমদার-কালীনাথ দত্তকে বলেছিলেন, ‘আইভ্যানহো’ জীবনে কোনোদিন উল্টেও দেখেননি এবং আমলা বলেই মামলা করে দিয়েছিলেন তারকনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। পরে তারকানাথ জেল খাটবেন না মাফ চাইবেন এরকম ত্রাহি অবস্থায় পড়েছিলেন। তবে বঙ্কিমবন্ধু কালীনাথ দত্ত পরে স্বীকার করেছিলেন যে তিনি দুই বই-ই পড়ে বলেছেন বঙ্কিম লাইনের পর লাইন চুরি করেছেন। বঙ্কিমের জীবদ্দশাতেই দুর্গেশনন্দিনীর ১৩টি সংস্করণ শেষ হয়। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরও অভিযোগ করেছিলেন, বঙ্কিমের ‘বিষবৃক্ষ’ নাকি তাঁর ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ উপন্যাসের অক্ষম অনুকরণ। দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর ‘স্বপ্নপ্রয়াণে’র পাণ্ডুলিপি ‘বঙ্গদর্শনে’ ছাপানোর জন্য পাঠিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়: “তিনি সবগুলি ছাপান নাই। কিন্তু তাঁহার বিষবৃক্ষের মধ্যে ঠিক সেইরকম ছবির অবতারণা করিয়া বসিলেন।... বাড়ির মধ্যে গৃহস্থ বধূ গাড়ি হাঁকাইলেন, এ চিত্র একেবারে সুশোভন হইল না। কিন্তু এইরকম চিত্র সমাবেশের আইডিয়াটা যে তিনি আমার রচনা হইতে পাইয়াছিলেন, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নাই।”

লেখকদের চুরি করার ব্যাপারে অনেক মামলার ইতিহাসও আছে। যেমন আলফ্রেড হিচককের ‘১৯৪০ : রেবেকা’ উপন্যাসটিও চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিল। লেখক এডউইন ম্যাকডোনাল্ড আদালতে অভিযোগ করেছিলেন, হিচককের ‘রেবেকা : ১৯৪০’ তাঁর ‘ব্লাইন্ড উইডো’ উপন্যাস থেকে নকল করেছেন। শেষে বিচারকেরা দুটি উপন্যাসের ভেতর কোনো মিল খুঁজে পাননি। লেখক ইয়ান ফ্লেমিং -এর ‘সেক্স, সেডিজম অ্যান্ড স্নোবারি’ বইটির বিরুদ্ধে ভাবনা চুরির অভিযোগ করেছিলেন লেখক কেভিন ম্যাকগ্লোরি। ম্যাকগ্লোরি আদালতকে জানিয়েছিলেন ‘সেক্স, সেডিজম অ্যান্ড স্নোবারি’ বইটি লিখেছিলেন ইয়ান ফ্লেমিং, তিনি এবং অপর লেখক জ্যাক হুইটিংহাম মিলে। কিন্তু ইয়ান ফ্লেমিং অন্যদের নাম বাদ দিয়ে নিজের নামেই বইটি প্রকাশ করেন। অভিযোগ সত্যি হওয়ায় আদালত ‘সেক্স, সেডিজম এবং স্নোবারি’ বইয়ের প্রকাশককে পঁয়ত্রিশ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। লেখক ড্যান ব্রাউনের ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ বইটির বিরুদ্ধেও ভাবনা চুরির অভিযোগে দু-বার মামলা হয়। ড্যান ব্রাউনের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ আনেন লেখক মিখাইল বাইগনেট। তিনি ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ বইটিকে তাঁর ‘দ্য হলি ব্লাড অ্যান্ড দ্য হলি গ্রেইল’ বইয়ের অনুকরণ বলে অভিযোগ করেন। দ্বিতীয় অভিযোগটি আনেন লেখক লুইস পারডু। তিনি ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ বইটির ধারণা তাঁর ‘দ্য ভিঞ্চি লিগাসি’ (১৯৮৩) থেকে নেওয়া বলে অভিযোগ আনেন। দুটো মামলাই বিচারকেরা খারিজ করে দেন অভিযোগ সঠিক নয় প্রমাণিত হওয়ায়। এছাড়া লেখকদের যেসব ভাবনা চুরির কথা জানা যায়, এর মধ্যে রয়েছে একাদশ শতকে ইরাকের বিখ্যাত লেখক আল খতিব আল বাগদাদির জীবজন্তুদের নিয়ে লেখা বই ‘আল জাহিদ’র কথা। বইটি কম-বেশি অ্যারিস্টটলের লেখা ‘কিতাব আল হাইওয়ান’-এর অনুকরণ বলে অভিযোগ রয়েছে। ভারতের কাব্য বিশ্বনাথনের লেখা প্রথম উপন্যাস ‘হাউ অপাল মেহতা গট কিসড’ উপন্যাসটির বিরুদ্ধে একাধারে অন্য পাঁচটি উপন্যাসের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ চুরির অভিযোগ উঠলে ওই লেখক বাজার থেকে সব বই প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। পাকিস্তানী লেখক কিমরান হাফিজের বই ‘ডার্কনেস’ এর বিরুদ্ধে খুশবন্ত সিংয়ের ‘দ্য সানসেট ক্লাব’-এর হুবহু নকল ধরা পড়ায় কিমরান এই তো বছর তিনেক আগে ২০১৭ সালে লাহোরে নিজ বাসায় সুইসাইড করেন এবং সুইসাইড নোটে লিখে যান, “আমি কেবলই লেখক হতে চেয়েছিলাম। চোর নয়।”

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;