কোলাজ মন্তাজ

সাহিত্য করে ‘ধনী’ ও ধনী হয়ে ‘সাহিত্য’ করার গল্প



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের ধনী লেখক হন ফোর্বস ম্যাগাজিনের জরিপে আর সেরা বই বিবেচিত হয় টাইমের বিবেচনায়। বাংলা সাহিত্যে শুধুমাত্র লেখালেখি করে ধনী হয়েছিলেন মাত্র দুইজন। একজন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অন্যজন হুমায়ূন আহমেদ। বর্তমানে বিশ্বের ধনী লেখক হ্যারি পটারখ্যাত জে কে রাউলিং। তিনি বছরে ৯৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছেন। ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য কার্সড চাইল্ড’ বইটির জন্য প্রচুর পরিমাণে টাকা আয় করেন তিনি। বইটি ২০১৬ সালের সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করেছিল। তাছাড়া হ্যারি পটারের জন্য ইউনিভার্সাল স্টুডিও, ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস এবং হোয়ার টু ফাইন্ড দেম সিনেমা দুটির জন্যও নগদ অর্থ পেয়েছেন রাউলিং। ১৯৯৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত তিনবার ধনী লেখকের তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করেছেন এই কল্পকাহিনী লেখক।

জে কে রাউলিং

বিশ্বজুড়ে হ্যারি পটারের সিরিজগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। প্রাপ্তবয়স্কদেরও রূপকথার জগতে দিনরাত বিচরণ করতে বাধ্য করেছেন। জীবনের একটা পর্যায় পর্যন্ত তাঁকে অনেক কঠিন সময়ের মুখোমুখী হতে হয়েছে। একটি কন্যা সন্তানসহ তাঁকে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেই তিনি শুধুমাত্র অর্থ আয়ের উদ্দেশ্যে লেখালেখি শুরু করেন। পরপর ১২টি প্রকাশনা সংস্থার ফিরিয়ে দেওয়ার পর অবশেষে ১৩ নম্বর সংস্থাটি বইটি প্রকাশ করতে সম্মত হয়, এরপর শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়া। ব্রিটেনে জন্ম নেওয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে কাজ করতে রাউলিং ১৯৯০ সালে পর্তুগালে পাড়ি জমান। সেখানে তাঁর পরিচয় হয় পর্তুগিজ সাংবাদিক জর্জ আর্নেটসের সাথে। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁরা বিয়ে করেন এবং ১৯৯৩ সালে জেসিকা নামে তাঁদের একটি মেয়ের জন্ম হয়। জেসিকার জন্মের অল্পকিছুদিনের মধ্যেই জর্জের সঙ্গে রাউলিংয়ের দাম্পত্য কলহ শুরু হয় এবং তা বিবাহবিচ্ছেদে গড়ায়। জর্জের সাথে সম্পর্কের ইতি ঘটিয়ে রাউলিং জেসিকাকে নিয়ে স্কটল্যান্ডের এডিনবুরোতে ফিরে এসে তাঁর ছোটবোন দাইয়ের সাথে থাকতে শুরু করেন। স্কটল্যান্ডে ফিরে রাউলিং তাঁর মেয়েকে নিয়ে দারুণ আর্থিক অনটনের শিকার হন। মেয়ে এবং নিজের জন্য কোনোভাবেই যথেষ্ট অর্থের যোগাড় করতে না পেরে অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যেই তিনি হ্যারি পটারের প্রথম বইটি লিখতে শুরু করেন। ব্রিটিশ লেখক ও সিনেমার চিত্রনাট্যকার জোয়ান রাউলিংয়ের জেকে রাউলিং ছদ্মনাম নেওয়ার পেছনে কিন্তু একটা ইতিহাস আছে। একজন নারীর লেখা বই কম বিক্রি হতে পারে এই কারণে তিনি তাঁর মূল নামের বদলে শুধুমাত্র আদ্যক্ষর দিয়ে তাঁর ছদ্মনামটি তৈরি করেন। তাঁর মূল নামের সাথে কোনো মধ্যবর্তী নাম (middle name) না থাকলেও তিনি ছদ্মনামের সাথে ‘K’ অক্ষরটি যোগ করেন তাঁর দাদী ক্যাথরিনের সম্মানে।

আরো পড়ুন ➥ শিল্পসাহিত্যে ‘স্বাধীনতা’

তাঁর জন্ম ১৯৬৫ সালের ৩১ জুলাই। বাবা ছিলেন এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়ার পিটার জেমস রাউলিং, এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল এ্যান রাউলিং। ১৯৯৭ সালে তাঁর প্রথম বই ‘হ্যারি পটার এ্যান্ড দি ফিলোসফারস্ স্টোন (Harry Potter and the Philosopher’s Stone)’ প্রকাশিত হওয়ার আগে তিনি তাঁর এক সন্তানকে নিয়ে স্কটল্যান্ডের এডিনবুরোতে অর্থনৈতিকভাবে খুবই বাজে অবস্থায় বসবাস করতেন। কিন্তু শিশুতোষ রূপকথার বইটি প্রকাশ হওয়ার পর রাতারাতি আন্তর্জাতিক বেস্টসেলারে পরিণত হয় এবং রাউলিং পরিণত হন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন বড় লেখক হিসেবে। ১৯৯৯ সালে যখন হ্যারি পটারের প্রথম তিনটি বই নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্টসেলার তালিকার প্রথম তিনটি জায়গা একসাথে দখল করে নেয় তখন পৃথিবীর সাহিত্যজগৎ আরো একবার নড়েচড়ে বসে। এরপর একে একে হ্যারিপটার সিরিজের আরো চারটি বই বের হয়—এবং প্রতিটি বই আগেরটির থেকে বেশি সাফল্য লাভ করে। হ্যারি পটার সিরিজের মোট সাতটি বই আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৪৫ কোটি কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছে। হ্যারি পটারের বইগুলো থেকে বানানো প্রতিটি সিনেমাই ব্লকবাস্টার হিট। ছবিগুলো সবগুলো মিলিয়ে আয় করেছিল ৭.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রথম সিরিজের সফলতার পর রাউলিং এরপর একে একে আরো বেশ কয়েকটি বই বের করেন। ২০১২ সালে বের হওয়া তাঁর ‘ক্যাজুয়্যাল ভ্যাকেন্সি (Casual Vacancy)’ বইটি দারুণ প্রশংসা কুড়ায়—যার প্রধান কারণ ছিল হ্যারি পটারের ছায়া থেকে সম্পূর্ণভাবে এই বইয়ের মাধ্যমে তিনি বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন। বইটিতে ফ্যান্টাসির বদলে ছিল নির্মম বাস্তবতার এক অদ্ভুত প্রতিফলন। অনেক পাঠক অবশ্য হ্যারি পটারের মতো কিছু একটা আশা করে বইটি পড়া শুরু করে হতাশও হয়েছিলেন। এরপর ২০১৩ সালে রবার্ট গ্যালব্রেইথ (Robert Galbraith) ছদ্মনাম নিয়ে “Cuckoo’s Calling” নামে আরো একটি বই বের করেন তাঁর বিখ্যাত নামের ছায়া থেকে বের হয়ে এসে। ২০১৬ সালে তিনি আরো একবার হ্যারি পটারের জগতে প্রবেশ করেন মঞ্চনাটক ‘হ্যারি পটার এ্যান্ড দি কার্সড চাইল্ড (Harry Potter and the Cursed Child)’ এবং সিনেমা ‘ফ্যান্টাসটিক বিস্টস্ এ্যান্ড হয়্যার টু ফাইন্ড দেম (Fantastic Beasts and Where to Find Them)’-এর মাধ্যমে। প্রথমটির গল্প গড়ে উঠেছে হ্যারি পটার সিরিজ শেষ হওয়ার ঊনিশ বছর পরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে, আর ফ্যান্টাস্টিক বিস্ট-এর কাহিনী গড়ে উঠেছে হ্যারি পটার সিরিজের ঘটনা শুরুর বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

ড্যান ব্রাউন

ড্যান ব্রাউনও ধনী লেখকদের একজন। জনপ্রিয় মার্কিন থ্রিলার লেখক। জন্ম ১৯৬৪ সালের ২২ জুন। তার বেশিরভাগ উপন্যাসই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ওপর নিজের কল্পনা মিশ্রিত। তিনি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠেন দ্য ভিঞ্চি কোড বইটি লিখে। ২০০৩ সালে এই বইটি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। এ পর্যন্ত তাঁর লেখা বই বিশ্বের ৫২টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং ২০ কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিনের বিচারে পৃথিবীর প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির অন্যতম তিনি। তার লেখা উল্লেখযোগ্য বই হলো ডিজিটাল ফোর্টট্রেস, ডিসেপশন পয়েন্ট, দ্য ভিঞ্চি কোড, অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডেমন্স, দ্য লস্ট সিম্বল ও ইনফার্নো। তার গল্পের গতি এবং বাঁক সত্যিই পাঠককে মুগ্ধ করে। বিস্মিত হয়ে উপভোগ করতে হয় তার বইগুলো। কিন্তু তার জীবনও সুখের ছিল না একসময়। আর্থিক অনটনে ভুগতে হয়েছে তাকেও। আসুন তার মুখেই শুনি তার কথা—

“আমি যখন বড় হচ্ছিলাম, তখন আমাদের বাসায় টেলিভিশন ছিল না। তাই আমি যা পেতাম, তা-ই পড়তাম। আমার সবচেয়ে পুরনো স্মৃতি হলো মেডেলিন এল ইঙ্গলসের অ্যা রিঙ্কল ইন টাইম বইটি। এটি নিয়ে আমি বুঁদ হয়ে থাকতাম। আমার মনে পড়ে, আমি যখন বইটি অর্ধেক শেষ করেছি, মা তখন এসে বললেন, এখন ঘুমানোর সময়। কিন্তু আমি বইয়ের চরিত্রগুলো নিয়ে এতটাই চিন্তিত ছিলাম যে সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। পরদিন যখন বইটি শেষ করলাম, তখন আমার চোখে পানি। কারণ, সেটা ছিল একটা সুখের সমাপ্তি। বইটির আবেগ আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল, প্রতিটি চরিত্রকে আমি অনুভব করছিলাম। এসব সেই মুহূর্ত, যখন আমি গল্প বলার জাদু এবং ছাপার অক্ষরের শক্তিকে বুঝতে শিখলাম। আমি প্রকৃতপক্ষে অসংখ্য বইয়ের মধ্যে বড় হয়ে উঠেছি। আমি এবং আমার বোন প্রতি সপ্তাহে এক্সেটার পাবলিক লাইব্রেরিতে যেতাম এবং দুই হাত ভর্তি করে আমাদের পছন্দের বই নিয়ে বাসায় ফিরতাম। এগুলোর মধ্যে থাকত ড. সিউস, রিচার্ড স্কারি, কিউরিয়াস জর্জ, মেডেলিন এবং বাবার। আমরা যখন বড় হয়ে উঠছিলাম, আমার মনে পড়ে, প্রতি রাতেই মা-বাবা আমাদের গল্প পড়ে শোনাতেন। তাঁদের মুখেই আমার অনেক গল্প শোনা—‘মেক ওয়ে ফর ডাকলিং’, ‘দ্য ভেলেভটিন র্যাবিট’, ‘চিকেন স্যুপ উইদ রাইস’। কিন্তু যে গল্পটি আমার ছোট্ট মনোজগৎকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল, সেটি ছিল ‘হোয়ার দ্য ওয়াইল্ড থিংগস আর’। আমার পরিবারে অগডেন ন্যাশের কবিতা খুব পড়া হতো, যেটা আমার লেখার ওপর অনেক প্রভাব ফেলেছে।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে নোবেল, প্রত্যাখ্যান ও কেড়ে নেওয়ার গল্প

আমার প্রিয় লেখকদের মধ্যে আছেন জন স্টেইনবেক। তাঁর গল্পের স্থানগুলো আমাকে মুগ্ধ করে। আমি বিস্মিত হয়ে উপভোগ করি রবার্ট লুডলামের গল্পের জটিল পটভূমি। শেক্সপিয়ার তাঁর ভাষাশৈলি দিয়ে চিরকালই আমাকে পথ দেখিয়ে এসেছেন। আমি প্রচুর নন-ফিকশন পড়ি। এর কারণ রিসার্চ ও আনন্দ লাভ করা। কিন্তু যখন আমি ফিকশন পড়ি, আমি সব সময়ই থ্রিলার পড়ি। যে থ্রিলারগুলো শুরুর কয়েক অধ্যায়ই আমাকে ধাঁধায় ফেলে দেয়, সেগুলোই আমার সবচেয়ে পছন্দের। আমি মনে করি, একটি ভালো থ্রিলার অবশ্যই আমাকে বাস্তব জগৎ সম্পর্কে কিছু শেখাবে। কোমা, দ্য হান্ট ফর রেড অক্টোবর, দ্য ফার্ম—এই থ্রিলারগুলো আমার মনে চিরস্থায়ী দাগ কেটেছে, বাস্তব জগৎকে নতুনভাবে বুঝতে শিখিয়েছে; একই সঙ্গে চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাবমেরিন প্রযুক্তি ও আইন সম্পর্কে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমি যখন কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে বের হলাম, আমার হাতে দুটি পথ খোলা ছিল। দুটিই ছিল আমার ভালোবাসার কাজ—গল্প লেখা অথবা গান লেখা। আমি বেশ কিছুদিন হলিউডে ছিলাম, গান লেখার জন্য। কিন্তু গানের জগতে আমি খুব বেশি সাফল্য পাইনি। কলেজ থেকে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে লেখা আধুনিক উপন্যাস পড়িনি, চিরন্তন ক্লাসিক উপন্যাসগুলোই ছিল আমার আকর্ষণের কেন্দ্রে। ১৯৯৪ সালে তাহিতিতে ছুটি কাটানোর সময় আমি সিডনি শেল্ডনের লেখা ডুমসডে কন্সপিরেসি-এর একটি পুরনো কপি সাগরপাড়ের একটি দোকানে পাই। বইটির প্রথম পৃষ্ঠা পড়া শুরু করলাম, এরপর দ্বিতীয় পৃষ্ঠা—এভাবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমি বইটি শেষ করি। এটি শেষ করে একটি চিন্তাই আমার মাথায় আসে—আরে, এটা তো আমি লিখতে পারি। এভাবেই গল্প লেখার জগতে আমার প্রবেশ। ডিজিটাল ফোর্টট্রেস (১৯৯৬) ছিল আমার লেখা প্রথম উপন্যাস। আমি খুবই ভাগ্যবান ছিলাম। কারণ, পাঠকেরা বইটি পছন্দ করেছে। যদি তারা না করত, হয়তো আমি আবার গান লেখার জগতে ফিরে যেতাম। আমি একজন শিক্ষক এবং প্রচুর বই পড়েছি। এই বইগুলোর কাহিনী ও চরিত্রবিন্যাস নানাভাবে সজ্জিত হয়েছে। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমি এগুলো নিয়ে আলোচনা করি। এতে করে আমি আমার গল্পে নতুন ধারণা পাই এবং এটা আমার গল্পকে আরো সমৃদ্ধ করে। যারা নতুন লিখছে কিংবা স্বপ্ন দেখছে যে একদিন তাদের লেখাও ছাপা হবে, তাদের জন্য একটাই পরামর্শ থাকবে, আর সেটা হলো বাজারে বিক্রির জন্য বই লেখো। কিন্তু এর মানে এটা নয় যে তোমাকে গোয়েন্দা গল্পই লিখতে হবে। ব্রিজেস অব মাডিসন কাউন্টি অথবা কোল্ড মাউন্টেইন—বইগুলো কিন্তু ব্যবসায়িক সাফল্যের কথা ভেবেই লেখা। লেখার ক্ষেত্রে দুটি জিনিস সব সময়ই মেনে চলতে হবে। প্রথমত, চিত্রপটকে কাহিনীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। দ্বিতীয়ত, চিত্রপটকে আকর্ষণীয়ভাবে সাজাতে হবে। তুমি যদি কোনো স্কুলের কাহিনী লেখো, কিন্তু সেই স্কুলের কোনো গোপন ঘটনা কিংবা স্কুলের কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য না বলো, তাহলে তোমার কাহিনী অনাকর্ষণীয় হতে বাধ্য। এটা খুবই মজার, যখন আমি সাহিত্যের কোনো আঙিনায় নিজেকে স্থান দেব, সেটা ভাবি। কিন্তু আমি কেবল সে রকম গল্পই লিখি, আমি নিজে যে রকম গল্প পড়তে চাই। সহজ কথায় বলতে গেলে আমি নিজের জন্যই লিখি।’’

স্টিভেন কিং

মার্কিন লেখক স্টিভেন কিংয়ের বই বিক্রি হয় বিশ্বজুড়ে। তার মোট বিক্রিত বইয়ের পরিমাণ ৩৫ কোটি কপির বেশি। তিনি ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল বুক ফাউন্ডেশন মেডেল পান। এছাড়াও তিনি ব্রাম স্টোকার অ্যাওয়ার্ডস, ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি অ্যাওয়ার্ডস, ব্রিটিশ ফ্যান্টাসি সোসাইটি অ্যাওয়ার্ডস লাভ করেন। তার অনেক বই থেকে চলচ্চিত্র, টিভি সিরিজ, মিনি সিরিজ, কমিকস নির্মিত হয়েছে। তার লেখা বিখ্যাত দুটি ছোটগল্প হচ্ছে ১৯৮২ প্রকাশিত অ্যাপ্ট পিউপিল, ২০০২ সালে প্রকাশিত ১৪০৮ অল দ্যাট ইউ লাভ উইল বি ক্যারিড অ্যাওয়ে। আর বিখ্যাত উপন্যাসগুলো হলো—ক্যারি, দ্য শাইনিং ইট, দ্য ডার্ক টাওয়ার, রিটা হেওয়ার্থ অ্যান্ড শশাঙ্ক রিডেম্পশন, আন্ডার দ্য ডোম, দ্য বডি। তিনিও বিলিওনার। নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের সম্পর্কে এভাবে বলেন, “আমি কখনো ভাবতে পারতাম না গল্প লেখেই ধনী হওয়া যায়! তাও আবার হরর মুভি। এখন বিজ্ঞানের যুগ। মানুষ তো জানে হররের যুগ নেই আর। তবু কেন পড়ে হরর গল্প বা দেখে মুভি? আমার ধারণা মানুষের অবচেতনে এমন কিছু কাজ করে যে সে একটু রহস্য পছন্দ করে। আমি পাঠকের কাছে এ রহস্যই বিক্রি করে ধনী হয়েছি। আমার কৈশোর সুখের ছিল না। যে এলাকায় থাকতাম সেটি ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, বিষণ্ণ। আমাদের পরিবারে অনেক সময় বিকালে নাস্তা করার অবস্থাও ছিল না। তাই রাতের খাবার এমন এক সময় খাওয়া হতো যে না সন্ধ্যা না রাত। সেসব দিনকে এখন খুব মিস করি।’’

জন গ্রিশাম লিগ্যাল

জন গ্রিশাম লিগ্যালকে বলা হয় থ্রিলার ফিকশনের রাজা। নব্বই দশক থেকে প্রতি বছরই একটি করে প্রকাশিত হওয়া গ্রিশামের বই নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার লিস্টে স্থান পেয়েছে। তাও আবার ১ বা ২ নম্বর অবস্থানে থেকেই। নব্বইয়ের দশকে লেখক জন গ্রিশাম ক্যারিয়ারের চরম ফর্মে ছিলেন। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত বিশটিরও বেশি থ্রিলারের সব বই ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। নব্বই দশকের থ্রিলার লেখক বলতেই সবার আগে চলে আসে এই লেখকের নাম। প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত টানটান উত্তেজনার একটি অবিশ্বাস্য লেভেলের থ্রিলার জন গ্রিশামের ‘দ্য পার্টনার’। এটির মতো আরো অসাধারণ থ্রিলার রয়েছে এই লেখকের। দ্য পার্টনারের চমত্কার কাহিনী ছাপিয়ে উঠে এসেছে কিভাবে অতি সূক্ষ্মভাবে একটি ক্রাইম করতে হয় এবং সেই ক্রাইম থেকে কিভাবে নিজেকে মুক্ত করতে হয়। তার বয়স যখন সাত তখন তিনি পরিবারের সঙ্গে মিসিসিপিতে বসবাস শুরু করেন। তিনি একটা সময় হতাশা তেকে ড্রাগস নেওয়া শুরু করেছিলেন। সেসময়ই অপরাধজগতের কিছু বন্ধু জুটে যায়। যদিও তিনি নিজে কোনো অপরাধ করেননি কিন্তু অপরাধী বন্ধুদের গল্প শুনতেন এবং যতটুকু যেভাবে পারেন সাহায্য করতেন। এ জন্যই অপরাধ জগৎটা তার মুখস্থ। এগুলোই পরবর্তী সময়ে তাঁকে থ্রিলারে নিয়ে আসে। এখন সুখী মানুষ। বিলিওনার। ড্রাগস তো তরুণ বয়সেই রিহ্যাবে গিয়ে ছেড়েছিলেন। এখন সানসেটের পর বেলকনিতে বসে সমুদ্রের জোয়ার দেখতে দেখতে মাত্র ছয় আউন্স হুইস্কি খান।

জেমস পেটারসন

জেমস পেটারসন নামের সঙ্গে অনেকেই খুব বেশি পরিচিত নিশ্চয়ই। বিখ্যাত সাহিত্যিক জেমস পেটারসন রচিত অ্যালেক্স ক্রস সিরিজের বইগুলো প্রায় ২৫ বছর ধরে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে। এর প্রত্যেকটি বই সব সময় বেস্ট সেলার হয়ে এসেছে। তবে এর মধ্যে অ্যালং কেম এ স্পাইডার-এর কথা না বললেই নয়। এর কাহিনীতে দেখা যায়, এক নিখোঁজ মেয়ে, নাম ম্যাগি রোজি। যার বাবা-মা নৃশংসভাবে খুন হন। কিন্তু খুনি থাকেন প্রাথমিক স্কুলের এক সাধারণ শিক্ষক, যে কিনা নিজেকে অতি বুদ্ধিমান মনে করেন। তিনি একের পর এক খুন করেই যান। এই খুনিকে খুঁজতে বের হন বিখ্যাত গোয়েন্দা অ্যালেক্স ক্রস। এরপরই ঘটতে থাকে নানা রোমহর্ষক ঘটনা। ১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ জেমস পেটারসন জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তার বয়স প্রায় ৭১ বছর। তিনি প্রতিদিন ভোরে উঠে লিখতে পছন্দ করেন। তার লেখনীর শক্তি অসাধারণ এ কথা বলাই বাহুল্য। থ্রিলার, রহস্য উপন্যাস, রোমান্স ইত্যাদি নানা রকম লেখায় তিনি ইতোমধ্যে কিংবদন্তি। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য সিরিজ হলো ‘উইমেন্স মার্ডার ক্লাব’। এই সিরিজের সর্বশেষ বই ১৬ সডোকশন এবারে নিউইয়র্ক টাইমস-এর সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

আরো পড়ুন ➥ সৃষ্টিশীলদের খেয়ালিপনা

এর কাহিনী অনেকটা এ রকম—পনেরো মাস আগেও আদরের ছেলে আর চৌকস স্বামীকে নিয়ে ডিটেকটিভ লিনসে বক্সারের জীবন ছিল ছবির মতো। সানফ্রানসিসকোতে এক বোমা হামলায় নিহত হলো ১৫ জন। লিনসে তার স্বামীর সহায়তার বোমা হামলাকারীকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়। কিন্তু এই মামলা যখন কোর্টে ওঠে, তখন সরকারি উকিল গাফিলতি থাকার ইঙ্গিত করে আঙুল তোলেন লিনসে ও তার স্বামীর বিরুদ্ধ। লিনসে নিজেকে ও তার স্বামীকে নির্দোষ প্রমাণে কিভাবে ষড়যন্ত্রের জাল খুলল, এই নিয়েই কাহিনী। বর্তমানে শিশুদের বই পড়তে উৎসাহিত করতে এবং অভিভাবক ও শিক্ষকদের শিশু-কিশোরেরা কী বই পড়তে পারে, তা জানাতে তিনি রিডজকিডোরিড (readzkiddoRead.com) নামের একটি ওয়েবসাইট চালু করেছেন।

ই এল জেমস

ব্রিটেনে যৌনতানির্ভর উপন্যাস লিখে ধনী হয়েছেন এক নারী, যার নাম ই এল জেমস। এ বইয়ের মাধ্যমেই ই এল জেমস বিশ্বের সেরা ধনীর তালিকায় প্রবেশ করেন। বইটির বিষয়বস্তু যৌনতা। ‘ফিফটি শেডস অব গ্রে’ বইয়ের পাতায় পাতায় রয়েছে টানটান উত্তেজনা। ব্যবসায়ী ক্রিস্টিয়ানো গ্রের সঙ্গে সাহিত্যের ছাত্রী অ্যানাস্টাসিয়া স্টিলের প্রেমের গল্প নিয়ে রচিত হয়েছে এই উপন্যাসটি। বহুল বিক্রিত এই উপন্যাসটির অপর দুটি সিকুয়েন্স হচ্ছে ‘ফিফটি শেডস ডার্কার’ আর ‘ফিফটি শেডস ফ্রিড’। এই তিনটি বই মিলে একটি রেকর্ড করেছে তা হলো, তিনসপ্তাহে এই সিরিজের তিনটি বইয়ের মোট দেড় কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। এই সিরিজ নিয়ে চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছে। এটি বানিয়েছে চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সাল।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে জেনারেশন

ইএল জেমসের ইরোটিক এই উপন্যাসটির কাহিনী গড়ে উঠেছে কলেজ শিক্ষার্থী আনাস্তাসিয়া স্টিলির দিকে থেকে। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগে তিনি রহস্যময় এবং বিয়ের উপযুক্ত শতকোটিপতি ক্রিস্টিয়ান গ্রের ইন্টারভিউ নেন তার স্কুল পেপারের জন্য। তিনি সাংবাদিকতায় পড়ছিলেন না। ইন্টারভিউটি নেওয়ার কথা ছিল সাংবাদিকতায় পড়ে তার এমন এক রুমমেটের। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় আনাস্তাসিয়া তার হয়ে ইন্টারভিউ করতে যান। প্রথম দেখার পর থেকেই আনা ক্রিস্টিয়ান গ্রেতে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। ক্রিস্টিয়ান যখন আনার টেপ রেকর্ডার নিয়ে উসখুস করেছিলেন তখন স্নায়বিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় আনা চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছিল এবং ঘাম ঝরতে শুরু করে। তার সামনে কথা বলতে গিয়েও আনা তোতলাতে শুরু করেন। আর ক্রিস্টিয়ানের শান্ত কিন্তু কঠোর মেজাজ আনার হার্টবিটও বাড়িয়ে দিচ্ছিল কয়েকগুণ। স্বাভাবিকভাবে ক্রিস্টিয়ানও আনার প্রতি ঝুঁকে পড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু ঠিক কী কারণে তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না। আনা ছিল অস্থির প্রকৃতির। কলেজের পড়া শেষ করার পর কী করবে সে ব্যপারেও তার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আর আনা কিছুটা অগোছালোও ছিল। কিন্তু কথা বলার ফাঁকে আনা যখনই তার নিচের ঠোঁটটি কামড়ে ধরতেন তা দেখে কী এক অজানা কারণে যেন ক্রিস্টিয়ান নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারতেন না। এরপর একদিন ক্রিস্টিয়ান আনার কর্মস্থলে গিয়ে হাজির হন। প্রায়ই দামি সব উপহার কিনে পাঠান। ব্যক্তিগত হেলিকপ্টারে করে ঘুরতে নিয়ে যান। এতে আনার আশেপাশের অন্যান্য পুরুষরা ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। রোমান্টিক মনে হচ্ছে কি এতটুকু জেনে আপনাদের? মোটেই কিন্তু তা না। এখানে এসেই রয়েছে আখ্যানের বড় মোচড়।

আরো পড়ুন ➥ স্ট্রিট লিটারেচার

একটা সময়ে ক্রিস্টিয়ানের অবিবাহিত থাকার কারণ জানা যায়। তিনি আসলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দাসত্ব ও আধিপত্য চান। তিনি ধর্ষকামী ও মর্ষকামী লোক। আনাকেও ক্রিস্টিয়ান তার নিজের প্রতি আনুগত্যশীল বানাতে চায়। আনার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার প্রস্তাব দিয়ে একটি গোপন চুক্তির খসড়া তৈরি করেন ক্রিস্টিয়ান। এতে নিরাপদ শব্দ এবং সীমা আছে। আর দুজনকে যেসব বিচিত্র ধরনের যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হতে হবে তার বিস্তারিত বিবরণও দেওয়া আছে। আনা ওই চুক্তিতে সাক্ষর করবেন কি করবেন না তা নিয়ে আনার সিদ্ধান্তহীনতার বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়।

ড্যানিয়েল স্টিল

আমেরিকান লেখক ড্যানিয়েল স্টিলের আসল নাম ড্যানিয়েল ফার্নান্দেজ ডমিনিকিউ স্টুয়েলিয়েন স্টিল। তিনি বিশ্বের আরেক নারী ধনী লেখক। তার জন্ম আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। তার বাবা জার্মান, মা পর্তুগিজ। ড্যানিয়েলের শৈশব কেটেছে ফ্রান্সে। কিশোরী বয়স থেকেই লেখালেখির সঙ্গে জড়িত এই লেখক। তখন থেকেই কবিতা লেখার হাতেখড়ি। তিনি সাহিত্য ডিজাইন ও ফ্যাশন ডিজাইনের ওপর পড়াশোনা করেন। পারসন স্কুল অব ডিজাইনে ১৯৬৩ সালে এবং নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। সম্প্রতি তিনি বেস্ট সেলিং লেখকের তালিকায় নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর লেখা বই ৮০০ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। এই বই থেকে তার আয় ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘গোয়িং হোম’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ৯৫। বিশ্বের ৪৭টি দেশে ২৮টি ভাষায় তাঁর লেখা অনূদিত হয়েছে। নারী লেখকদের মধ্যে মাত্র ২৬ বছর বয়সেই ভেরোনিকা রথ ফোর্বসের শীর্ষ তালিকায় ধনী লেখক হিসেবে নিজের স্থান করে নিয়েছেন। তিনি জার্মান এবং পোলিশ বংশোদ্ভূত। বর্তমানে তাঁর বয়স ২৯। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা এ লেখকের বর্তমান আয় ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৯৪ কোটি টাকা প্রায়। তাঁর জনপ্রিয় বই ‘ট্রিলোজি ডিভারজেন্ট’ থেকে তিনি আয় করেন ৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর তাঁর লেখা থেকে তৈরি ইনসারজেন্ট চলচ্চিত্রটি সারা বিশ্ব থেকে আয় করে ২৯৫ মিলিয়ন ডলার।

পলা হকিন্স

ব্রিটিশ লেখক পলা হকিন্স সৌভাগ্যবানদের একজন। বিশ্বের সেরা ধনী লেখকদের তালিকায় রয়েছে পলা হকিন্সের নাম। ফোর্বস সাময়িকীতে প্রকাশিত বিশ্বের সবচেয়ে ধনী লেখকের তালিকায় স্থান পেয়েছেন তিনি। ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক পলার জন্ম ও বেড়ে ওঠা বর্তমান জিম্বাবুয়ের হারারেতে। তিনি লন্ডন ও অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেন। বর্তমানে বসবাস করছেন সাউথ লন্ডনে। ফোর্বস-এর তথ্যানুযায়ী পলা হকিন্সের ‘দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন’ উপন্যাসটি এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১ কোটি ২০ লাখ কপির বেশি বিক্রি হয়েছে। তাঁর নতুন উপন্যাস ‘ইনটু দ্য ওয়াটার’ বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বজুড়ে হৈচৈ পড়ে যায়। উপন্যাস দুটি প্রসঙ্গে এই লেখক বলেন, “দুটি উপন্যাসই মনস্তাত্ত্বিক সাসপেন্স উপন্যাস। তারপরও একটি অপরটি থেকে খুব ভিন্ন, কারণ ইনটু দ্য ওয়াটার অনেক বেশি মৌলিক। গল্পটি একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করা হয়েছে, তারপরও আমার এ গল্পে অনেক বেশি চরিত্র আছে।”

জ্যাকি কলিন্স

বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জ্যাকি কলিন্স। তিনিও বিশ্বের ধনী লেখকদের মধ্যে অন্যতম। ২০১৫ সালে ৭৭ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু এখনো তার বইগুলো বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছে। মৃত্যুর আগে দীর্ঘ সাত বছর স্তন ক্যান্সারে ভুগছিলেন তিনি। কিংবদন্তি এই লেখক জীবনের শেষ কয়েকটি দিন লস অ্যাঞ্জেলেসের বাসভবনেই ছিলেন। তার বোন জোয়ান কলিন্স একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী। জোয়ান কলিন্স বলেন, “জ্যাকির মৃত্যুর খবরে আমি একদম ভেঙে পড়েছি। ও আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল। জ্যাকি স্কুলে পড়ার সময়ই লিখতে শুরু করেন। তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ফুল অব ম্যারেড ম্যান’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। প্রথম বই দিয়েই বাজিমাত করেছিলেন এই লেখক। বইটি বেস্ট সেলার হয়েছিল তখন। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দুই হাত ভরে লিখে গেছেন জ্যাকি।

রিচার্ড চার্লস নিকোলাস ব্রানসন

এদের যাদের কথা বললাম তাঁরা সবাই কিন্তু লেখালেখি করেই ধনী হয়েছেন। কিন্তু ধনী হওয়ার আগে লেখেননি এক অক্ষরও অথচ ধনী হওয়ার পর লিখে লেখকখ্যাতি পেয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। যেমন ‘লুজিং মাই ভার্জিনিটি’ হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম সেরা একজন ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী রিচার্ড চার্লস নিকোলাস ব্রানসনের লেখা আত্মজীবনীমূলক একটি বই। রিচার্ড ব্রানসন ভার্জিন গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে প্রায় ৪০০টি কোম্পানি রয়েছে। এয়ারলাইন্সের ব্যবসার জন্য তিনি অধিক বেশি বিখ্যাত। তার এই বইটি বেশ আনন্দদায়ক ও অনুপ্রেরণামূলক। তিনি তার প্রাথমিক জীবনের প্রায় ৪৩ বছরের বিভিন্ন ঘটনা, এই বইটিতে তুলে ধরেছেন। তিনি এই বইটিতে এমনভাবে বর্ণনা তুলে ধরেছেন, একজন পাঠকের এই বইটি পড়ার সময় মনে হবে, তিনি যেন রিচার্ড ব্রানসনের সঙ্গে গল্প করছেন। একজন বন্ধু অন্য বন্ধুর সঙ্গে যেমনভাবে কথোপকথন করে থাকে, অনেকটা প্রায় তেমন ভঙ্গিতেই ব্রানসন বইটিতে আলোচনা তুলে ধরেছেন। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। মূলত রিচার্ড ব্রানসনের প্রাত্যহিক নোটবুক থেকে লেখাগুলোকে একত্রিত করে, লুজিং মাই ভার্জিনিটি বইটির রূপ দেওয়া হয়েছে।

বিল গেটস

বিশ্বের শীর্ষ ধনী ও মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের বিখ্যাত একটি বই হচ্ছে ‘বিজনেস অ্যাট দ্য স্পিড অব থট।’ এই বইটি ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়। বইটি প্রকাশ হওয়ার পরই বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ৯৫ শতাংশ পাঠক এই বইটি পড়ে সন্তুষ্ট প্রকাশ করেছে।

হলেন ওয়ারেন বাফেট

‘দ্য এসেস অব ওয়ারেন বাফেট’ নামের বইটি লিখেন বিশ্বের আরেক শীর্ষ ধনকুবের হলেন ওয়ারেন বাফেট। যিনি বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডারদের প্রতিবছর বার্ষিক চিঠি লিখে থাকেন। এই চিঠিতে তিনি তার ব্যবসায়িক চিন্তাচেতনা এবং বিনিয়োগ ও বাজার ব্যবস্থা সম্পর্কে তার মতামত ও চিন্তা-ভাবনাগুলো তুলে ধরেন। আর এই চিঠিগুলোই একত্রিত করে ১৯৯৭ সালে দ্য এসেস অব ওয়ারেন বাফেট বইটি প্রকাশ করা।

মাইকেল ডেল

বর্তমানে ডেলকে অন্যতম শীর্ষ কম্পিউটার ও প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এই ডেল কোম্পানিরই প্রতিষ্ঠাতা হলেন মাইকেল ডেল। যিনি মাত্র ১ হাজার ডলার দিয়ে ব্যবসা শুরু করে, বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় একটি কম্পিউটার ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন। তাঁর জীবনের লড়াইয়ের বিভিন্ন ঘটনা এবং তাঁর সফলতা অর্জনের কৌশল নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘ডিরেক্ট ফ্রম ডেল’ বইটি। তিনি তাঁর ব্যবসায়িক জীবন শুরু করার আগে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন।

সাম ওয়াল্টন

‘মেড ইন আমেরিকা’ হচ্ছে সাম ওয়াল্টনের আত্মজীবনীমূলক বই। ১৯৯২ সালে তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। সাম ওয়াল্টন খুবই ছোট একটি দোকানের মাধ্যমে তার ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তারপর তিনি হয়েছিলেন ওয়াল-মার্টের মতো বিখ্যাত সাম্রাজ্যের মালিক। ওয়াল-মার্টকে বিশ্বের অন্যতম বড় রিটেইল স্টোর হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তিনি কিভাবে ছোট একটি দোকান থেকে এরকম বিশাল প্রতিষ্ঠানের মালিক হলেন; এই সাফল্যময় গল্পেরই বর্ণনা তুলে ধরেছেন এই বইটিতে। এ পাঁচ ধনকুবেরের এ পাঁচটি বইয়ের সাহিত্যমূল্য যদিও নেই তবু পাঠকের কাছে সমাদৃত মোটিভেশনাল চরিত্রের জন্যে।

সর্বকালের সেরা ১০ বিক্রিত বই

এবার সর্বকালের সেরা ১০ বই হিসেবে বেশি বিক্রিত বইয়ের একটা তালিকা দিয়ে শেষ করা যায়। তবে এসব বইয়ের লেখকরা লিখে ধনী হতে পারেননি, সাহিত্যিক হিসেবে সমাদৃত। যেমন, লিও তলস্তয়ের ‘আনা কারেনিনা’ ও ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, গুস্তাভে ফ্লবার্টের ‘মাদাম বোভারি’।


আরো পড়ুন দেবদুলাল মুন্নার দুটি গল্প
জবাফুলের দুনিয়া
ধুসাইলা


ভ্লাদিমির নাবোকভের ‘ললিতা’, মার্ক টোয়েনের ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন’, উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’, স্কট ফিজেরাল্ডের ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবাই’, মারসেল প্রোস্টের ‘ইন সার্চ অব লস্ট টাইম’, অ্যানটন শেকভের ‘দ্য স্টোরিজ অব অ্যানটন শেকভ’, জর্জ ইলিয়টের ‘মিডলমার্চ’। যে বইগুলোর নাম নিলাম এগুলো টাইম ম্যাগাজিনের সর্বশেষ সেরা বই।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;