স্মরণীয় ১০ জন যারা পেয়েছিলেন রাষ্ট্রের অবমাননা ও অবিচার (পর্ব ১)

কোলাজ মন্তাজ



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

পেছনে ফিরে দেখি। কী দেখি? অতীত। কিন্তু যে দলছুট হয়ে স্রোতে ভাসা মানুষের ভিড় থেকে চলে যায় অনেক আগে তাকেও তো পেছনে ফিরে তাকাতে হয়। পা সামনে এগুনো। কিন্তু একটি মুখ মুখ ফিরিয়ে দেখছে। সে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের সব বেদনা। একটু আলো জ্বেলেছিল। আমরা হয়তো বুঝিনি। হয়তো ড্যাশ ড্যাশ ড্যাশ। কিন্তু তার ওই দলছুট হয়ে এগিয়ে যাওয়ায় কম যন্ত্রণাবিদ্ধও হয়নি। মনে রেখেছি সেইসব মুখদের! তাদের অনেককেই তদানীন্তন সমাজ, শাসক, তথা রাষ্ট্রের চরম অবমাননা এবং অবিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এত এত মুখ। বলি মাত্র ১০ জনের কথা এ কিস্তিতে।

 

সক্রেটিস

সক্রেটিস এত গরীব ছিলেন যে প্রতিরাতে বাসায় ফেরার পর তাকে স্ত্রীর কাছে শুনতে হতো, ‘তুমি একটা কদাকার। মরো না কেন? বিষ খেতে পারো না!’ দেখতে খুব বিশ্রি ছিলেন। বিয়ে করেছিলেন কেন সেটিও জানতেন না। হয় না, হয়ে গিয়েছিল। সক্রেটিস সত্য ও যুক্তির কাছে সৎ ও একনিষ্ঠ থেকে অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি; বরং সেই বিষ মানে হেমলক খেয়ে অমর হয়ে গেলেন সবার মাঝে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০ সালের দিকে সক্রেটিসের জন্ম গ্রিসের এথেন্স নগরীতে এলোপাকি গোত্রে, ছিলেন প্রাচীন গ্রিক ফিলোসফার। তিনি নিজে গরীবের গরীব কিন্তু সারাজীবন সকলকে বিনা পয়সায় শিক্ষা দিতেন। এত বড় পণ্ডিত, কিন্তু তাঁর মধ্যে অহংকারের লেশমাত্র ছিল না। কেউ তাঁকে রাগ করে কথা বলতে শোনেনি; নিজের সামান্য কর্তব্যটুকুও অবহেলা করতে দেখেনি। প্রথম জীবন কেটেছে ভাস্করের কাজ করে। সক্রেটিস কোনো এক সময় সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। প্লেটোর বর্ণনায় সক্রেটিস বলেন, তিনি তিন তিনটি অভিযানে এথেনীয় সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছেন। এই অভিযানগুলো ছিল যখাক্রমে পটিডিয়া, অ্যাম্ফিপোলিস এবং ডেলিয়ামে। তিনি কখনো কোনো পেশা অবলম্বন করেননি, কারণ তিনি ঠিক তা-ই করবেন যাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন আর তা হচ্ছে দর্শন সম্বন্ধে আলোচনা। প্লেটোর লেখায় দেখা যায় সক্রেটিস কখনোই শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ নেননি। বরঞ্চ তিনি তার দরিদ্রতার দিকে নির্দেশ করেই প্রমাণ দিতেন যে, তিনি কোনো পেশাদার শিক্ষক নন।

সক্রেটিসের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিল তিনটি। ১. দেশের প্রচলিত দেবতাদের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন। ২. নতুন নতুন দেবতার প্রবর্তন করার চেষ্টা। এবং ৩. তিনি(সক্রেটিস) যুবকদের নৈতিক চরিত্র কলুষিত করে তাদের বিপথে চালিত করছেন।

আরো পড়ুন ➥ বিখ্যাত সৃষ্টিশীলদের অবসাদ ও স্যাটায়ার

এথেন্সের তিনজন খ্যতিমান পুরুষ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন। অভিযোগকারী তিনজনের নাম ছিল মেলেটাস, লাইকন এবং এনিতাস। প্রথমজন ছিলেন মধ্যম শ্রেণীর কবি, দ্বিতীয়জন ছিলেন বক্তা এবং তৃতীয়জন গণতান্ত্রিক নেতা।

সে সময় বিচারসভায় কোনো আইনজীবী থাকত না। অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত নিজেই নিজের পক্ষ সমর্থন করতেন। বিচারসভায় প্রথমে ওই তিনজন তাঁদের অভিযোগ বর্ননা করতেন—তারপর সক্রেটিস উঠে দাঁড়িয়ে বলেন নিজের কথা। সে এক বিচিত্র বিচার কাহিনী। ৫০০ জন জুরির সামনে বিচার। ৬০ ভোটের ব্যবধানে সক্রেটিস অপরাধী হিসাবে বিবেচিত হন। প্রথমেই তাঁর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হয়নি। বিচারের শেষ মুহূর্তে শাস্তি এড়াতে না পারলেও মৃত্যুদণ্ডকে এড়াতে পারতেন সক্রেটিস। তখন এথেন্সের বিচার ব্যবস্থায় অপরাধ চিহ্নিত হবার পর অপরাধীকে জিজ্ঞেস করা হতো, সে কী শাস্তি চায়। পাঁচশো জুরির উপস্থিতিতে সক্রেটিসকেও জিজ্ঞেস করা হলো, “আপনি কী শাস্তি চান।” কিন্তু যেহেতু তিনি নিজেকে অপরাধী মনে করতেন না তাই তার জবাব ছিল, “আমি দোষ করিনি কোনো। আমাকে পুরস্কৃত করা উচিত। প্রাইটেনিয়াম হলে (পাবলিক হল) আমার জন্যে বিশেষ ভোজের আয়োজন করা যেতে পারে।” প্রথাগতভাবে যা করা হতো গ্রিসের বীরদের জন্য। তাতে জুরিরা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন, তাঁরা মনে করলেন, সক্রেটিস এই বিচারকে প্রহসন মনে করছে এবং তাঁদের উপস্থিতির সম্মান দিচ্ছে না। ফলে উচ্চারিত হলো, মৃত্যুদণ্ড। প্রথমে তাঁর বিরুদ্ধে জুরি ছিলেন ২৮০ জন এবং স্বপক্ষে ছিলেন ২২০ জন। তাঁর ওই উত্তর শুনে বিরুদ্ধে হয়ে গেল ৩৩০ জন। মৃত্যুদণ্ড বা শাস্তি নিয়ে সক্রেটিসের উদাসীনতার এখানেই শেষ নয়। শিষ্য আর বন্ধুরা চেয়েছিলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ডের আগে জেলে আটকে না রেখে জামিনে মুক্তি দেওয়া হোক। তখন এ প্রথাও ছিল। সক্রেটিস জামিন হিসেবে দিতে চেয়েছিলেন এক দীনা (রৌপ্যমুদ্রা)। তাঁর বন্ধুরা তৎক্ষণাৎ ব্যক্তিগত দায়িত্বে তিরিশ দীনা দিতে চাইলেন। কিন্তু সে প্রার্থনাও না-মঞ্জুর হয়েছিল। বিচারের প্রায় একমাস পর মৃত্যু হয় সক্রেটিসের, এসময় তিনি কারাগারে বন্দী ছিলেন। সক্রেটিসের মৃত্যুর সালটি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯। মৃত্যুর আগে প্রার্থনা শেষ করে হেমলক তুলে নিলেন ৭০ বছরের সক্রেটিস। পান করে নিলেন সবটুকু হেমলক রস, এক নিঃশ্বাসে। কেউ বিষ পান করলে মুখভঙ্গি বিকৃত হয়। কিন্তু সক্রেটিসকে দেখে তা বুঝার উপায় নেই। তার মুখ বিন্দুমাত্র বিকৃত হয়নি। জলপানের মতো পান করেছিলেন তিক্ত বিষ। উপস্থিত সকলেই তার মৃত্যুতে উচ্চস্বরে কেঁদেছিলেন, এমনকি জেল কর্মকর্তার দু’চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত। কিন্তু সক্রেটিসের চোখে না ছিল কোনো কান্না। না কোনো বিকার। শুধু একবার তার স্ত্রীর দিকে দৃষ্টি গিয়েছিল। কে জানে!

সেনেকা

স্টোয়িক দর্শনের অন্যতম এই পথিকৃৎ ও অসংখ্য ট্র্যাজেডি নাটকের রচয়িতার নাম সেনেকা। মৃত্যুও ছিল আরেক ট্র্যাজিক। পুরো নাম লুইস অ্যানিয়াস সেনেকা। তাঁর বাবার নামও কিন্তু লুইস অ্যানিয়াস সেনেকা। এজন্য সেনেকাকে অনেকে ‘সেনেকা দ্য ইয়াঙ্গার’ও বলে থাকেন। খ্রিস্টের জন্মের ৪ বছর পর অধুনা স্পেনের কর্ডোবায় জন্মেছিলেন সেনেকা। এর পরপরই পরিবারসমেত তারা চলে আসেন রোমে। শৈশব-কৈশোরে অ্যাটালাস ও সোশনের কাছে অলঙ্কারশাস্ত্রের সাথে স্টোয়িকও পাঠ নিয়েছিলেন সেনেকা। ছোটকাল থেকেই ক্ষীণকায় সেনেকার অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকত। ২১ বছর বয়সে মিসরে যান। খালার ঐকান্তিক শুশ্রূষায় সুস্থ হয়ে সেনেকা ১৫ বছর পর পুনরায় ফিরে আসেন রোমে। রোমে ফেরার বছরই প্রত্যক্ষ ভোটে সেনেকা নির্বাচিত হন ম্যাজিস্ট্রেট। বাগ্মীতা ও দার্শনিক উৎকর্ষের রোমে অল্প সময়ে বেশ ভালোই প্রভাব কামিয়েছিলেন তিনি। পরের বছর (৩৭ খ্রিস্টাব্দ) যখন ক্যালিগুলা এলেন সম্রাটের গদিতে, বেঁধে যায় দুজনের ব্যক্তিত্বের সংঘাত, যা পরে রূপ নেয় শত্রুতায়। সম্রাট কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েও ভাগ্যগুণে বেঁচে যান সেনেকা।

৪১ খ্রিস্টাব্দে ক্যালিগুলাকে হত্যা করে ক্ষমতায় এলেন ক্লডিয়াস। কিন্তু সম্রাটের সাথে বিরোধের চিত্রটা যেন পাল্টাল না। ক্লডিয়াসের স্ত্রী মেসালিনা এবার অভিযোগ দাগলেন ম্যাজিস্ট্রেট সেনেকার প্রতি। সেনেকা নাকি ব্যাভিচারে জড়িয়েছেন ক্যালিগুলার বোন জুলিয়া লিভিয়ার সাথে! ফলাফল, কর্সিকা দ্বীপে সেনেকাকে পাঠানো হলো শাস্তিস্বরূপ।

সেসময় তিনি মাকে চিঠি লিখতেন সান্ত্বনা জানিয়ে। এই চিঠিগুলোতে প্রতিফলিত হতো সেনেকার স্টোয়িক দর্শনের আত্মোপলব্ধি। স্টোয়িকবাদের স্রষ্টা হিসেবে পপুলার সেনেকা হলেও খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৩০০ বছর আগে এর জন্ম সিটিয়ামের দার্শনিক জেনোর হাত ধরে। সিটিয়ামের ‘স্টোয়া পয়কিলে’ নামক খোলা এক আর্ট গ্যালারিতে প্রথম এই দর্শনের প্রচার শুরু করেছিলেন জেনো। ‘স্টোয়া’ থেকেই তাই এলো ‘স্টোয়িসিজম’ নামকরণ।

জেনোর পর এই দর্শনকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রদান করতে ভূমিকা রাখেন মূলত তিন দার্শনিক—এপিক্টেটাস, সেনেকা ও অরেলিয়াস।

স্টোয়িকবাদ অনুযায়ী, আমাদের জীবন আসলে কোনো বাহ্যিক ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয় না, বরং সে ঘটনাটিকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা কিভাবে নিচ্ছি, তার ওপরই নির্ভর করে সমস্ত কিছু। ধরা যাক, আপনার ক্লাসের নোট খাতা হারিয়ে গেছে এবং আপনি ব্যথিত, কেননা পরীক্ষা আগামীকাল। কিন্তু এখানে আপনার কষ্ট পাওয়ার কারণ কিন্তু নোটখাতা নয়, বরং পরীক্ষায় কম নম্বর পাবার শঙ্কা। এখন স্টোয়িকবাদ কী বলে? স্টোয়িকবাদ আপনাকে বলবে ভাবনায় ইতিবাচকতা আনতে। ব্যাস, আপনি সুখী! দ্বিতীয়ত, কোনটি আপনার নিয়ন্ত্রণে আর কোনটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তা অনুধাবন করুন। এর দ্বারা ইচ্ছাশক্তিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন আপনি, কাজেকর্মে সফলও হবেন। যেমন ধরুন, আপনি একজনকে ভালোবাসেন, সে আপনাকে প্রত্যাখ্যান করছে কেননা আপনি মদ্যপান করেন ও বহুগামী। এখন আপনার তো তার মনের ওপর হাত নেই। কিন্তু নিজের মদ ছাড়ার ব্যাপারে তো নিয়ন্ত্রণ আছে। সুতরাং আপনি আপনার কাজটাই করেন দেখুন না! কাজ হলেও হতে পারে। যাক সেনেকার কথায় ফিরে যাই। আট বছর পর সেনেকাকে নাটকীয়ভাবে ফিরিয়ে আনেন সম্রাট ক্লডিয়াসের চতুর্থ স্ত্রী অ্যাগ্রিপিনা। সন্তান নিরোকে পরবর্তী সম্রাট বানাবার জন্য ক্লডিয়াসের কাছে সমস্ত তদবিরই করেছিলেন অ্যাগ্রিপিনা। সেই নিরোরই শিক্ষক নিযুক্ত করা হলো সেনেকাকে। ৫৪ খ্রিস্টাব্দে নিরো যখন ১৭ বছর বয়সে সম্রাট হলেন তখন আফ্রানিয়াস বুরাস ও সেনেকা সম্রাটের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। উপদেষ্টার উপদেশ নিরো কানে নিতেন যৎসামান্যই। সেনেকা, বুরাসের বাধা সত্ত্বেও মাকে হত্যা করতে তাই বাধেনি নিরোর। তবুও বুরাসের মৃত্যু অবধি তিনি নিরোর অনুগতই ছিলেন। অথচ একসময় নিরোর দালালিই করেছেন। পরে চাকরি ছেড়ে দেন। ৬২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাটের চাকরি ছেড়ে সেনেকা পুরোদমে লেখালেখিতে সঁপে দিলেন নিজেকে। দার্শনিক গ্রন্থ ‘অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ’-তাঁর সেরা মৌলিক (আপাত) কাজ। স্টোয়িকবাদ নিয়ে তাঁর অন্য ভাবনাগুলো এসেছে মাকে লেখা ও লুসিয়াসকে লেখা ৬৯টি চিঠিতে।

আরো পড়ুন ➥ মহান শিল্পীদের ক্ষত ও ভালোবাসাসমূহ

সম্রাটের উপদেষ্টা থাকাকালেই সেনেকা লিখেছিলেন রাজনৈতিক প্রহসন ‘দি আপোকোলোসিন্টোসিস’ এবং নাটক ‘ফিড্রা’। অবসরের পর ৬২-৬৫ খ্রিস্টাব্দ অবধি তিনি লিখেছেন অসংখ্য ট্র্যাজেডি নাটক ও গল্প। ‘দ্য ট্রোজান উইমেন’, ‘মেডিয়া’, ‘দ্য ফিনিশিয়ান উইমেন’, ‘দ্য ম্যাড হারকিউলিস’। তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয় ‘ইডিপাস’ ও ‘আগামেমনন’ ছিল যথাক্রমে গ্রিক উপন্যাস ‘সফোকলস’ ও ‘অ্যাসকাইলাস’ অবলম্বনে রচিত। তাঁর লেখায় ভার্জিল ও ওভিডের প্রভাব ছিল বলার মতো। এত ট্র্যাজেডি যার কলম থেকে বেরিয়েছে, তাঁর জীবনটাও ওই ট্র্যাজেডি দিয়েই শেষ হয়েছিল। ৬৫ খ্রিস্টাব্দে গায়াস কালপার্নিয়াস পিসো আর সেনেকার ভাতিজা লুকান মিলে ষড়যন্ত্র করেছিলেন নিরোকে হত্যা করবার। ভাতিজার সূত্রে কিভাবে যেন সেনেকার নামও জড়িয়ে পড়ে সেই ষড়যন্ত্রের অভিযোগে। ফলাফল, সেনেকার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিলেন নিরো। তবে শিক্ষাগুরু হওয়ায় খানিকটা ‘দয়া’ করেন নিরো। জল্লাদ নয়, সেনেকার দণ্ড পালনের ভার দেওয়া হলো স্বয়ং সেনেকাকেই। সহজ মরণের জন্য দু’হাতের রগ কেটে ফেলেন সেনেকা। ভীষণ ক্ষীণকায় হওয়ায় রক্তপাতও তেমন হচ্ছিল না। এই দৃশ্য দেখে সেনেকার স্ত্রী পম্পিয়া পলিনাও হাত কেটে ফেলেন, তাকে অবশ্য উদ্ধার করেছিল সম্রাটের রক্ষীরা। যা-ই হোক, রগ কেটেও না মরতে পারায় সেনেকা পান করেন হেমলক বিষ। কাকতালীয়ভাবে তাতেও মৃত্যু হচ্ছিল না তাঁর, শুধুই যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। শেষে সেনেকাই সৈন্যদের অনুরোধ করেন তাকে গরম পানির চৌবাচ্চায় ফেলতে। আজীবন শ্বাসকষ্টে ভোগা , ইনহেলার নেওয়া, সেনেকার শেষ নিঃশ্বাসটিও সেই চৌবাচ্চাতেই পড়েছিল। এই সেনেকাই বলেছিলেন, “দুঃখ করো না, বাঁচো।’ নিমলেন্দু গুণের একটা কবিতা আছে এ শিরোনামে। 

দান্তে

দান্তে ছিলেন ইতালিয়ান কবি, গদ্য লেখক এবং রাজনৈতিক চিন্তাবিদ। ফ্লোরেন্সের স্থানীয় ভেনেশিয়ান ভাষায় তাঁর তিন খণ্ডে লেখা জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’তে তৎকালীন গির্জার (চার্চের) ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সমসাময়িক রাজনীতির ব্যঙ্গাত্মক রূপ তুলে ধরা হয়েছিল। সেই জন্য দান্তেকে রোমে আটক করে রাখে পোপ। ফ্লোরেন্সে তার বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। দান্তের অনুপস্থিতিতেই তার অজান্তে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে বিচার করা হয় এবং রায়ও দিয়ে দেওয়া হয়। ১৩০২ সালের ২৭ জানুয়ারি, তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচ হাজার ফ্লোরিন জরিমানা, দুই বছর ফ্লোরেন্স শহরে ঢোকার ওপরে নিষেধাজ্ঞা, দুই বছরের নির্বাসন দণ্ড এবং বাকি জীবনে আর কোনো দিন রাজনীতি করতে পারবেন না, এমনই শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু দান্তে এই বিচার বা রায় কোনোটাই মেনে নেননি। পরে ১০ মার্চ ফের রায় দেওয়া হয় যে, দুই বছর নয়, আর কোনোদিনই দান্তে ফ্লোরেন্সে ফিরতে পারবেন না, অর্থাৎ আজীবন নিষিদ্ধ। যদি ফেরার চেষ্টা করেন তাহলে শহরের সীমানায় ঢুকতেই তাকে গ্রেফতার করা হবে এবং জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হবে। এর পরের বছর এই রায়ের সঙ্গে আরো যুক্ত করা হয় তার ছেলেদের বয়স যখন চৌদ্দ বছর হবে তখন তাদেরও শহর থেকে চলে যেতে হবে। এর বারো বছর পর ১৩১৫ সালে তার সন্তানদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়। তবে, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা পালিয়ে বাবার কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয়। বিশ বছর ছেলেদের নিয়ে এক দেশ থেকে অন্যদেশে ঘুরে বেড়ান গৃহহীন হয়ে। অবশেষে ১৩২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাভেন্নাতে তিনি মারা যান। মারা যাওয়ার আগে বলেছিলেন, “জগত মায়াময়। কিন্তু জগতকে আমি মায়ার চোখে না দেখে জ্ঞানের চোখে দেখে কাটিয়েছি বলে আমার কোনো আপোষ নেই। কষ্ট নেই।”

ব্রুনো

ইতালীয় দার্শনিক ও বিশ্বতত্ত্ব বিশারদ। ব্রুনো কোপার্নিকাসের সুরুজকেন্দ্রিক মতবাদকে সমর্থন করেছিলেন যা ছিল বাইবেলের ‘সুরুজ পৃথিবীর চার পাশে ঘোরে’ মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত ফলে যা হবার তাই হলো। গির্জার পাদ্রীদের প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়েন তিনি। কিন্তু কোনোরকম নতিস্বীকার না করে হাসি মুখ মৃত্যুকেই বরণ করে নিয়েছিলেন ব্রুনো। যদিও এখন কোপার্নিকাস-ব্রুনোর সেই মতবাদই বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং খ্রিস্টান পাদ্রীরাও সেই বৈজ্ঞানিক সত্যকে মাথা পেতে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। ভ্যাটিকানের পোপও ভুল স্বীকার করেছে। পোপও বলতে বাধ্য হয়েছে, ব্রুনোর প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি পোপ অষ্টম ক্লেমেন্ট, ব্রুনোকে একজন ধর্মদ্রোহী বলে রায় দেয় এবং তাঁকে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে রোমের কেন্দ্রীয় বাজার ক্যাম্পো দ্য ফিওরি-তে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে প্রকাশ্য দিবালোকে সবার সামনে খুঁটির সাথে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়। ব্রুনো বলেছিলেন, “আমি সত্য উচ্চারণ করে যাবই। তোমরা আমায় আজ মেরে ফেলছো, কিন্তু আগামীকালই আফসোস করবে। কেননা আমি তোমাদের সত্য চিনাতে চেয়েছিলাম।”

পল গগাঁ

গগাঁ ১৮৮৮ সালে তাঁর অন্যতম বিখ্যাত চিত্রকর্ম সৃষ্টি করেছিলেন, ‘উপদেশের দৃষ্টি’ (ভিশন অফ দ্য সার্মন)। তিনি বলতেন যে তাঁর ধমনীতে বইছে ইনকাদের রক্ত এবং তিনি অত্যন্ত পছন্দ করতেন মদ্যপান। তিনি নিজেই নিজের সমাধিও তৈরি করেছিলেন। গগাঁ একসময় সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হন। বেশ্যাগমন করতেন। তিনি এক বেশ্য, যার নাম ভিভিয়ানা, তাকে নিজের ছোটবোনও বানিয়েছিলেন। একবার তাকে আর্থিক সাহায্য করতে গিয়ে চুরিও করেছিলেন। গগাঁ ইউরোপীয় সমাজের পরিকাঠামো থেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন এবং ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে তাহিতিতে চলে যান। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে পল গগাঁ ‘হিভা ওয়া’র দক্ষিণ উপকূলে অতুয়ানে চলে যান, যেটি ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ার অন্তর্গত মার্কেসাস দ্বীপপুঞ্জের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ। অতুয়ানে অবস্থানকালে গগাঁ, মারি রোজ ভাইওহো নামে ১৪ বছর বয়স্ক এক নাবালিকা যুবতীর সাথে থাকতেন। এবং তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি একজন শিশু যৌন উৎপীড়নকারী ছিলেন (পেডোফিল)। অতুয়ানে বসবাসকালে গগাঁ আরো বেশি সমাজচ্যুত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ফরাসি উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় অধিবাসীদের পক্ষ নিয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে কর প্রদান বন্ধ করতে এবং তাদের বাচ্চাদের ফরাসি স্কুলে পাঠানো বন্ধ করার জন্য প্ররোচিত করেছিলেন। তিনি সমকামিতার পক্ষে আন্দোলনেরও নেতৃত্ব দেন। কারণ তাঁর মতে সেই ফরাসি স্কুলেগুলো কেবলমাত্র মন্দ শিক্ষা দেয়। রাজ্যপালকে ব্যঙ্গ করার জন্য তাকে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। তার এই কাজের জন্য তাকে ৫০০ ফ্রাঙ্ক জরিমানা করা হয়েছিল এবং তিন মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। ৮ মে ১৯০৩, ৫৪ বছর বয়সে পল গগাঁ একেবারে একা, কপর্দকশূন্যভাবে তাঁর গৃহে মারা যান। অতুয়ানের তার সমাধিতে তাঁর সিরামিক ভাস্কর্য ওভিরি’র প্রতিলিপি স্থাপন করা হয়, যেটা তিনি প্যারিসে থাকাকালীন নিজেই নিজের সমাধির জন্য তৈরি করেছিলেন।

স্মরণীয় ১০ জন যারা পেয়েছিলেন রাষ্ট্রের অবমাননা ও অবিচার (পর্ব ২)

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;