পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের চান্দাইকোনায় ৬৭ শতক তিন ফসলি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে বিস্মিল্লাহ চালকল (অটো রাইস মিল) স্থাপনের কাজ চলছে।
চালকলটি চালু হলে মিলের বর্জ্যে ফসলি জমিসহ এলাকার পরিবেশ নষ্ট হবে। চালকলের ধোঁয়া ও ছাইয়ে বয়স্ক ও শিশুরা শ্বাসকষ্টসহ কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে মিলটি বন্ধের দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে এস.এম সোহাগ নামের এক স্থানীয় কৃষক।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, উপজেলার চান্দাইকোনা বাজারের পাশে জনবসতি এলাকায় পরিবেশ আইন ও নিয়মনীতি না মেনে তিন ফসলি জমিতে রিয়া নামে অটো মিল গড়ে তোলা হয়েছে। এই অটো মিলের অন্তরালে আনোরুল ইসলাম গংরা বিস্মিল্লাহ নামে (অটো রাইস মিল) আরেকটি মিল স্থাপন করছে। এ মিলটি চালু হলে এর বর্জ্য মিশ্রিত দুর্গন্ধযুক্ত পানি, কালো ধোঁয়া ও ছাই বাতাসের সাথে মিশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, ইউনিয়ন পরিষদ ও পল্লী বিদ্যুৎ সাব-অফিসসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ নষ্ট হবে। একই সঙ্গে স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় জনসাধারণের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হবে। সেই সাথে নষ্ট হবে তিন ফসলি জমি। এ কারণে অপিরিকল্পিত ভাবে দুটি অটো রাইস মিল বন্ধসহ আইনগত ব্যবস্থার জোর দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় জমির মালিক এস. এম সাগর, আব্দুর রাজ্জাক শেখ, নিজাম উদ্দিন আকন্দ, জহুরুল ইসলাম আকন্দ, মামুন আকন্দ, আবু ওয়াহেদ সোহেল সরকার, আবু হাসেম, দুলাল শেখসহ বেশ কয়েকজন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার রায়গঞ্জ উপজেলায় ছোট বড় মিলিয়ে ১৫০টি চালকল রয়েছে। এরমধ্যে পরিবেশের ছাড়পত্র রয়েছে মাত্র দুটির। বাকি চালকলগুলো অবাধে চলছে। এতে ফসলি জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক অঞ্চলে স্থাপনের কারণে পরিবেশের ছাড়পত্র পায়নি অধিকাংশ চালকল। পরিবেশের ছাড়পত্র ও অনুমোদন ছাড়াই দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করে চলছে এসব চালকল মালিকরা।
জানা যায়, উপজেলার চান্দাইকোলা ইউনিয়নের মৃত কায়ছার আলী সরকারের ছেলে আনোয়ারুল ইসলাম সরকারসহ প্রভাবশালী ১৫ জন একত্র হয়ে অনুমতি ছাড়াই বিস্মিল্লাহ অটো রাইস মিল নামে একটি বড় মিল তৈরি করেছে।
মঙ্গলবার (৩ অক্টোবর) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে চোখে পড়ে রিয়া অটোরাইস মিলটি। চালকলটির চারপাশ কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল, শ্রমিকেরা কাজ করছেন। শ্রমিকদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতার বালাই নেই। তাঁদের মুখমন্ডলে কালো ছাইয়ের আস্তর পড়ে আছে। চালকলটিতে নেই বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থাও। চালকলের সব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পাশের জমিগুলোতে। চুল্লি দিয়ে ধোঁয়ার সঙ্গে তুষের ছাই চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে।
চান্দাইকোনা গ্রামের বাসিন্দা হাসান সরকার (৫০) বলেন, মিলের কাছাকাছি ১০ মিনিট দাঁড়ানো যায় না। ছাই উড়তে থাকে পুরো এলাকায়। গাছপালার পাতা কালো হয়ে গেছে। গাছে নতুন করে কোনো ফল ধরে না। এলাকায় শিশু ও বৃদ্ধরা শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে ভুগছে। মিলের ছাই উড়ে আমাদের খাবারের ভিতরে পড়ে সেই খাবার নষ্ট হয়। কিন্তু একই এলাকায় আরেকটি বিস্মিল্লাহ নামে বড় অটো রাইস মিল তৈরী হচ্ছে। এই মিলটি চালু হলে এলাকায় বসবাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
একই গ্রামের মৃত কামাল সেখের ছেলে রাজ্জাক শেখ (৫৫) বলেন, রিয়া রাইস মিলের কারণে বর্তমানে বাড়িতে বসবাস করা খুব কষ্টকর হয়ে দাড়িয়েছে। মিলের উড়ন্ত ছাই, তুষ ও কুড়া ঘরের হাঁড়ি-পাতিলে গিয়ে পড়ে। বাড়ি ঘর, গাছপালা ও ফসলি জমি ছাইয়ের আবরণে কালো বর্ণের হয়ে গেছে। মিলের কারণে এ এলাকার অধিকাংশ মানুষ চোখের বিভিন্ন রোগসহ শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা ও চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
মিলের পাশে মুদি দোকানদার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, মিলের উড়ন্ত ছাই, তুষ ও কুড়া রাস্তায় চলাচলকারী পথচারী ও বিভিন্ন গাড়ি চালকদের চোখে পড়ে নানা সমস্যার সৃষ্টি করছে। এতে অনেক সময় রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটছে।
জানতে চাইলে রিয়া অটো রাইস মিলের মালিক আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘অটো রাইস মিল চালালে কিছু ক্ষতি হবে, আবার উপকারও হবে। এখানে সব নিয়ম মেনেই মিলটি করা হয়েছে। সবকিছুর অনুমোদন আছে আমাদের। তবে মিলের কিছু সমস্যা আছে। সেগুলো দ্রুত নিরসন করবেন বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে অনুমোদনহীন তৈরী হওয়া বিস্মিল্লাহ চালকল (অটো রাইস মিল) পাটর্নার বাবু সরকার বলেন, আমাদের কোন কাগজপত্র নেই। নির্মাণ কাজ শেষ হলে কাগজপত্র তৈরী করে সকল দপ্তরে আবেদন জমা দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে চান্দাইকোনা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কামরুজ্জামান সরকার অভিযোগ করে বলেন, স্কুল খোলার সাথে সাথে কালো ধোঁয়ায় স্কুলের আশপাশে অন্ধকার হয়ে যায়। এছাড়া অন্যান্য কারণে চরম দুর্গন্ধ হয়।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ভুঁইয়াগাঁতী জোনাল অফিসের (ডিজিএম) ছোলাইমান হোসেন জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া ওই মিলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া যাবে না। তবে এক মিলের লাইন কৌশলে মালিক পক্ষ যদি অন্য মিলে নিতে চায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রায়গঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার তৃপ্তি কণা মন্ডল জানান, ওই রাইস মিলের ব্যাপারে স্থানীয়রা লিখিত অভিযোগ করেছে। এ সমস্যা দূর করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানানো হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না পাওয়া পর্যন্ত মিলটি চালু করা যাবে না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) বাবলু কুমার সূত্রধর বলেন, অটো রাইস মিল ও ইটভাটার ধোঁয়া ও ছাই পরিবেশ ও ফসলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। রায়গঞ্জ উপজেলায় এর প্রভাব বেশি পড়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পরিবেশ ও খাদ্য অধিদপ্তরকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
জেলা খাদ্র নিয়ন্ত্রক এস.এম সাইফুল ইসলাম বলেন, রায়গঞ্জ উপজেলা ছোট-বড় প্রায় ১৫০টি চাল কল আছে। তাদের মধ্যে ২টি চাল কলের অনুমোদন রয়েছে। বাকিগুলো অবৈধ।
তিনি আরও বলেন, বিস্সিল্লাহ ও রিয়া অটো রাইস মিলের কোন অনুমোদন নেই। ফসলী ফমিতে যদি কেউ চাল কল স্থাপন করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।