আগুন শুধু পোড়ায় না, কিছু বিষয় আঙুল দিয়ে দেখায়ও

  সীতাকুণ্ডে ডিপোতে আগুন



হাসান হামিদ
বিএম ডিপোর আগুন

বিএম ডিপোর আগুন

  • Font increase
  • Font Decrease

 

পত্রিকায় দেখি প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও আগুন লাগে। পুড়ে মারা যায় মানুষজন। এই খবর আমাদের দেশে নতুন নয়। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের এক পরিসংখ্যান বলছে, সারাদেশে বছরে আনুমানিক ৬ লক্ষ লোক আগুনে পুড়ে যায়। আগুনে পুড়ে গড়ে প্রতিদিন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিতে আসেন ২০ থেকে ২৫ জন। আর ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ৬ বছরে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৮৮ হাজারের মতো। এতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এসবে প্রাণহানি হয়েছে ১ হাজার ৪ শ' জন, আহত হয়েছে অন্তত ৫ হাজার মানুষ। প্রতিদিন যেসব খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এর মধ্যে ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু বাদ যায় না। এসব নিয়ে সরকারের কী ভাবনা তা জানি না। তবে এমন খবর পড়তে পড়তে এখন আর আমাদের মনেই হয় না, একটি মানুষের মৃত্যু মানে শুধু তার চলে যাওয়া নয়; পাশাপাশি একটি পরিবারের সারা জীবনের হাহাকার রচনা হওয়া। অথচ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে পাটের গুদাম পুড়েছিল বলে বঙ্গবন্ধু নিজে দৌলতপুরে গিয়ে পোড়া পাট ধরে কেঁদেছিলেন। কিন্তু এখন এতো যে মানুষ মারা যায়, পরবর্তীতে কে রাখে তাদের খবর?

সর্বশেষ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে গত শনিবার রাত আনুমানিক এগারোটায়। বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ঘটনাস্থলের আশপাশের অন্তত চার বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিস্ফোরণ-আগুনে নিহত হয়েছেন অন্তত ৪৯ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৯ জন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যও আছেন। অন্যদের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে তারা নিহত হয়েছেন। আর যারা মারা গেছেন তারা প্রায় সকলেই পরিবহনশ্রমিক এবং ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর বাইরে এই ঘটনায় আহত হয়েছেন ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের সদস্যসহ দুই শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী। কেন ঘটেছে এই বিস্ফোরণ? প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ডিপোর কনটেইনারে থাকা রাসায়নিকের কারণে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই কনটেইনারে ছিল হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামের রাসায়নিক যৌগ। যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পারক্সাইড বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে। বিএম ডিপোতে হাইড্রোজেন পারক্সাইডবাহী কনটেইনার ছিল ২৬টি। ডিপোর টিনশেডে এবং প্লাস্টিকের বিভিন্ন জারে এই রাসায়নিক ছিল। আগুন লাগার পর কনটেইনারে থাকা রাসায়নিকভর্তি জার ফেটে যায়। এতে হাইড্রোজেন পারক্সাইড বের হয়ে কনটেইনারের সংস্পর্শে আসে। অক্সিজেন নির্গত হয়ে পানি ও আগুনের সংস্পর্শে কনটেইনারের ভেতরে তাপমাত্রা বেড়ে বিস্ফোরণ ঘটে। কনটেইনার ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে স্প্রিন্টারের মতো। এতে বিস্ফোরণের তীব্রতা বেড়ে যায় ভয়াবহভাবে।

পত্রিকার খবরে পড়েছি, বিএম কনটেইনার ডিপোর আশপাশের অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকায় বসবাসকারীরা বেশির ভাগই শ্রমিক। এলাকার বসতঘরগুলো টিনশেডের। এখানকার বাড়িঘরের অনেকের দরজা খুলে পড়ে গেছে, ঘরের বেড়া উড়ে গেছে কিংবা জানালার কাচ ভেঙে গেছে। বিস্ফোরণের তীব্রতা এত মারাত্নক ছিল যে এতে এই এলাকার ঘরবাড়ির দরজা-জানালাই শুধু ভেঙে যায়নি, টেলিভিশন, ফ্রিজ ও বৈদ্যুতিক পাখাও নষ্ট হয়েছে। প্রায় তিন দিন চলছে এই অগ্নিকাণ্ডের, এখনও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলা যাচ্ছে না। কারণ কেউ কেউ বলছেন এখনো ধোঁয়া উড়ছে। আবার কখন কী ঘটে, সেই ভয়ে দুই রাত ধরে অনেকেই ঘুমাতে পারছেন না। কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন আতঙ্কে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স সম্প্রতি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে ঘটা অগ্নিদুর্ঘটনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে তারা বলেছে, বাংলাদেশে প্রায়ই নিরাপত্তার নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়। বিশেষ করে শিল্পখাতে। ২০০৫ সালের পর থেকে এখানে কারখানা ও বিভিন্ন ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ফলে শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের প্রতিবেদনে কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের কথা বলা হয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সুগন্ধা নদীতে একটি লঞ্চের ইঞ্জিন রুম থেকে আগুন লেগে অন্তত ৩৮ জনের মৃত্যু হয়। লঞ্চটি ঢাকার সদরঘাট থেকে বরগুনায় যাচ্ছিল। এ বছরের জুলাই মাসে রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জের একটি জুস তৈরির কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ৫২ জন নিহত ও ২০ জন আহত হন। ২০২১ সালের মার্চ মাসে কক্সবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১৫ জন নিহতের পাশাপাশি ৫৫০ জন আহত হন। তাছাড়া বাস্তুচ্যুত হয় ৪৫ হাজার মানুষ। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকার সামান্য বাইরে একটি মসজিদের গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণ হয়। ওই ঘটনায় নিহত হন ১৭ জন ও আহত হয় কয়েক ডজন। নামাজ যখন প্রায় শেষের দিকে তখন মারাত্মক দুর্ঘটনাটি ঘটে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার কাছে একটি ফ্যানের কারাখানায় আগুন লাগে। যাতে কমপক্ষে ১০ জন মানুষ নিহত হন। আর নভেম্বরে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে গ্যাসের পাইপ লাইন বিস্ফোরণে সাতজন নিহত ও আটজন আহত হন। একই বছর মার্চ মাসে ঢাকার একটি ২২ তলাবিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় কমপক্ষে ১৯ জন নিহত ও ৭০ জন আহত হন। এ সময় ভবনটিতে বহু মানুষ আটকা পড়েন। আর ২০১৯ সালে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে দুইটি ভয়াবহ প্রাণঘাতী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসময় পুরান ঢাকার একটি এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৭০ জনের প্রাণহানি হয়। তাছাড়া চট্টগ্রামের একটি বস্তিতে আগুন লেগে দুই শতাধিক ঘর পুড়ে যায়। এতে আটজন নিহতের পাশাপাশি ৫০ জনের বেশি আহত হন। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি টেক্সটাইল কারখানায় আগুন নেভানোর আগেই ছয় শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার উপকণ্ঠে একটি প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১৩ জনের মৃত্যু ও কয়েক ডজন আহত হন। ২০১২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের ইতিহাসে হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে। ঢাকার তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন শ্রমিক নিহত ও ১৫০ জনেরও বেশি আহত হন। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে কারখানাটিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকার বাইরের একটি ক্রীড়া পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ২৬ জন নিহত ও প্রায় ১০০ জন আহত হন। একই বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার উপকণ্ঠে একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ২১ শ্রমিক নিহত ও প্রায় ৫০ জন আহত হন। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রামে একটি টেক্সটাইল কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৬৫ জন শ্রমিক নিহত ও কয়েক ডজন আহত হন। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার বাইরে একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ২২ জন নিহত ও ৫০ জনের বেশি আহত হন। এগুলো কেবল গত কয়েক বছরে বড় অগ্নিকাণ্ডের তথ্য। এর বাইরে ছোট ছোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিদিন।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে সারা দেশে আঠারো হাজারেরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং এতে  অর্ধ শতেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। আর এসব অগ্নিকাণ্ডে দেশের ক্ষতি হয়েছে ৪৩০ কোটি টাকার মতো, যা উদ্বেগজনক। কলকারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে এক হাজারের মতো, আর দোকান-পাটে প্রায় দুই হাজার। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু হওয়ার পর গত দুই দশকে ৭০০ গার্মেন্টস শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমাদের মনে আছে, তাজরীন ফ্যাশনে লাগা আগুনে ১১১ জন শ্রমিকের পুড়ে মারা যান। গুরুতর অগ্নিদগ্ধ হন আরও অনেক শ্রমিক। বাঁচার আশায় ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে পঙ্গু হয়ে যান কেউ কেউ। এরপর কারখানায় নিরাপদ কর্ম-পরিবেশ এবং নিরাপত্তা নিয়ে দেশে-বিদেশে বিস্তর কথা-বার্তা হলেও, থেমে নেই কারখানা দুর্ঘটনার খবর।

আমাদের দেশে বহুবার অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনায় সবারই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এতবড় বড় প্রতিষ্ঠানে যেখানে হাজার হাজার কর্মী কর্মরত, সেখানে কেন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে না? কোনো আইন নেই? আর কেমিক্যালের মজুদ কেন এমন অনিরাপদে থাকবে? এখন আরও যেসব এলাকায় এসব মৃত্যুকূপ আছে, তার কতটুকুইবা সরানো হবে! মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি এসব অগ্নিকাণ্ডে অর্থনৈতিক ক্ষতিও কিন্তু কম নয়। আমরা একবারও ভাবি না, ক্রমাগত  অগ্নিকাণ্ডের ফলে  দেশের বিভিন্ন শিল্প খাতে ভয়াবহ অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষত পোশাকশিল্পে আগুনের কারণে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, সেজন্য বিদেশীরা এই খাতে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবে স্বাভাবিক। আর এভাবে ক্রমশঃ শিল্পের বাজার ছোট হয়ে আসবে। বেড়ে যাবে বেকারত্বের হার; আর সেইসাথে বৃদ্ধি পাবে অপরাধকর্ম। এভাবে অর্থনৈতিকভাবে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এখনো সময় আছে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেবার। আমাদের ভাবতে হবে, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায়ই আসলে কী? আর অবশ্যই সরকারি কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি নাগরিক হিসেবে আমাদের সচেতন হতে হবে। তাছাড়া এই ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সেজন্য সরকারকে আরও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

অতীতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা আমরা কি ভুলে গেছি? হ্যাঁ, ভুলে গেছি! আমরা কি সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েছি? না, নেইনি। আমরা এমনই সব খুব দ্রুত ভুলে যাই। আমরা সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোর ঘটনাও ভুলে যাবো, যেমন আমরা প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার পর কিছুদিন খুব সোচ্চার হই এবং তা ভুলেও যাই; যেমন নিরাপদ সড়কের দাবির কথা আমরা এখন প্রায় ভুলে গিয়েছি। কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক খুললেই শুধু ধ্বংসস্তুপের ছবি আর স্বজনহারা মানুষের আহাজারি। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সংবাদকর্মীদের পরিশ্রম ও ব্যস্ততা উল্লেখ করার মতো। সাধারণ মানুষও এগিয়ে এসেছেন সাধ্য মতো। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২ লাখ টাকা করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিছুদিন পর প্রধানমন্ত্রী হয়তো কয়েকজন কিংবা কয়েকটি পরিবারের দায়িত্বও নেবেন। কিন্তু যে শিশু আর কোনোদিন বাবা বলে ডাকতে পারবে না, যে মা কোনোদিন তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবেন না, যে ভাই আর কোনোদিন তার ভাইকে পাবেন না, যে পিতা কোনোদিন সন্তানের সফলতায় অহংকার করতে পারবেন না, যে স্ত্রী আর ফিরে পাবেন না তার স্বামীকে; তার কিংবা তাদের সেই ক্ষতি কি কোনোদিন পূরণ করা সম্ভব? সম্ভব নয়। তবে এই ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই ব্যবস্থা করা কিন্তু সম্ভব। আমরা একটু সচেতন হলেই এই ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলতে পারি। আমাদের সেই বোধের উদয় কবে হবে?

*লেখক- কথাসাহিত্যিক।

   

ত্রিদেশীয় সীমান্ত অঞ্চলে সংঘাত নিরসন ও উন্নয়ন ভাবনা



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারত সীমান্ত সংলগ্ন দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এই অঞ্চলের সংঘাত যেন বেড়েই চলছে। এর শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে প্রাণ ভয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমনের মধ্য দিয়ে। প্রায় রোহিঙ্গা শূন্য রাখাইনে এরপর কিছুদিন শান্তি বিরাজ করলেও এক বছরের মধ্যেই আরকান আর্মির (এ এ) সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষ শুরু হয়। এর এক পর্যায়ে মিয়ানমার বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় এই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ও প্রতিবেশী দুদেশের মধ্যে অনভিপ্রেত ঘটনার সৃষ্টি হয়। মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সংঘাত মাঝে মাঝেই সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে হুমকি সৃষ্টি করছে যা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষার অন্তরায়।

২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকে প্রায় তিন বছর ধরে মিয়ানমারে সশস্ত্র বিপ্লব চলমান, মিয়ানমারের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে চলছে। চলমান পরিস্থিতি যাচাই করতে মিয়ানমারের জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং, স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিলের (এসএসি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সারা দেশে চলমান শাসন সম্পর্কে জনমত জরিপ করার জন্য প্রেরণ করেছে বলে জানায়। সামরিক শাসনের বিরোধীদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী অভিযানের অংশ হিসাবে চলমান গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং প্রাণঘাতী বিমান হামলার পর এই জনমত জরিপটির বিষয় আলোচনায় আসে। মিন অং হ্লাইং এসএসির জাতিগত সদস্যদের কাচিন, কায়াহ, চিন, মোন, রাখাইন এবং শান রাজ্য এবং জাতিগত অঞ্চলে পাঠায়। তারা স্থানীয় ধর্মীয় নেতা, ব্যবসায়ী মালিক, সামাজিক সংগঠনের সদস্য এবং সম্প্রদায়ের প্রবীণদের চলমান শাসনের সাথে সহযোগিতা করার আহ্বান জানায়।

২৮ সেপ্টেম্বর স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিলের এক বৈঠকে জান্তা প্রধান ১৫ অক্টোবর দেশব্যাপী যুদ্ধবিরতি চুক্তির অষ্টম বার্ষিকীতে বিদেশি সরকার প্রধানদেরকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা বলেন। সেই অনুষ্ঠানে কিছু দেশের সরকার প্রধান এবং কিছু দেশ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে জানা যায়। থেইন সেইনের শাসন আমলে আটটি জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন দেশব্যাপী এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি (এনসিএ) স্বাক্ষর করেছিল। ক্ষমতাচ্যুত ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি সরকারের সময় আরও দুটি দল এতে যোগ দিয়েছিল। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন, চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং অল বার্মা স্টুডেন্টস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট নামের তিনটি প্রধান স্বাক্ষরকারী কারেন, মন ও চিন রাজ্যের পাশাপাশি বাগো অঞ্চল ও মধ্য মিয়ানমারের জনগণ জান্তার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের প্রাচীনতম ও সবচেয়ে শক্তিশালী জাতিগত সংগঠন কেএনইউ এনসিএকে অকার্যকর ঘোষণা করে।উল্লেখ্য যে, সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেমিয়ানমার গৃহযুদ্ধে জর্জরিত।

মিয়ানমারসামরিক বাহিনী সেপ্টেম্বর মাসে কাচিন এবং উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যে তাদের আক্রমণ জোরদার করে। দেশজুড়ে ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের মুখোমুখি হওয়ার প্রেক্ষিতে সামরিক বাহিনী তাদের প্রতিরক্ষামূলক কৌশলে কিছু পরিবর্তন আনে।এই সংঘর্ষের ফলে উভয় রাজ্যেই প্রচুর সৈন্য ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। গত তিন মাস ধরে সেনাবাহিনী দেশটির অন্যতম শক্তিশালী জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ) এবং তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির (টিএনএলএ) বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে । অনেক বিশ্লেষকের মতে, সাগাইং ও মাগওয়ে অঞ্চলে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কেআইএকে ক্রমবর্ধমান সশস্ত্র প্রতিরোধে সহায়তা করা থেকে বিরত রাখার জন্য সরকারি বাহিনী তাদের উপর এই হামলা চালায়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের পর থেকে কেআইএ সরকার বিরোধী কয়েক হাজার তরুণ কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) কে ম্যাগওয়ে এবং সাগাইং অঞ্চলে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করেছে।

চীন সীমান্তবর্তী টিএনএলএ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত এলাকার নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে জান্তা সৈন্যদের সাথে সামরিকপন্থী মিলিশিয়া গ্রুপ মোতায়েন করেছিল। উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যে জান্তার পাল্টা হামলার কারনে রাজ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। এসব হামলায় বিমানবাহিনীও অংশ নিয়েছিল। সেপ্টেম্বর মাসে সরকারি বাহিনী ও টিএনএলএ’র মধ্যে ৪২টি সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। সামরিক সরকার ড্রোন হামলা এবং শহুরে অভিযান সহ প্রতিরোধ গোষ্ঠী এবং ইএওগুলির নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণের মুখোমুখি হচ্ছে। এসব ঘটনা সারা দেশে শাসকগোষ্ঠীকে হুমকির মুখে ফেলেছে এবং ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে। টিএনএলএ উত্তর শান রাজ্যের মুসে এবং কুটকাই টাউনশিপ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ায় চীনের সাথে প্রধান বাণিজ্য পথ মান্দালয়-মিউজ হাইওয়ের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণকে হুমকির মুখে ফেলেছে। কেবল মাত্র রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি এবং জান্তা অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে বিধায় সেখানে আক্রমণ বন্ধ আছে।

জুলাইয়ের শুরুতে কাচিন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আরও ১০ টি ব্যাটালিয়ন পাঠানোর পরপরই সেখানে সংঘর্ষ শুরু হয়। কেআইএ, কাচিন রাজ্যের রাজধানী মাইটকিনা থেকে ওয়াইংমাও এবং ভামো ও মায়োথিট পর্যন্ত দুই দিকে অগ্রসর হওয়া জান্তা সৈন্য ও সামরিক বহরের ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এইসব আক্রমণের ফলে বেসামরিক নাগরিকরা মাইটকিনা-ভামো হাইওয়ে ব্যবহার করতে পারছে না। সরকারি সৈন্যরা কেআইএর সদর দফতর লক্ষ্য করে আক্রমণ পরিচালনা করতে গিয়ে রাজ্যের অন্যান্য অংশ থেকে সৈন্যে সমাবেশ ঘটায়, এর ফলে অন্য এলাকাগুলোতে সৈন্য ঘাটতি দেখা দেয়। কেআইএ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সেনাদের উপস্থিতি না থাকা এলাকাগুলো দখল করে নেয়। সেপ্টেম্বর মাসে কাচিন রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক সংঘর্ষে হয়েছে। কেআইএ বেশ কয়েকটি জান্তা ফাঁড়ি দখল করার ফলে সরকারি সৈন্যদের ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর থেকে জান্তা দক্ষিণ-পূর্ব মিয়ানমারে ৬০টিরও বেশি সামরিক শিবির হারিয়েছে বলে ২৬ সেপ্টেম্বর কারেন পিস সাপোর্ট নেটওয়ার্ক (কেপিএসএন) কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা ৮ সেপ্টেম্বরে তাদের হিউম্যানিটারিয়ান আপডেটে জানিয়েছে যে, অভ্যুত্থানের পর থেকে পূর্ব বাগো ও তানিনথারি অঞ্চল এবং কারেন ও মন রাজ্যে মোট ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৬০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্ট বা এসিএলইডি নামের একটি সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে মিয়ানমারকেবিশ্বের সবচেয়ে সংঘাতপ্রবণ দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এ গবেষণায় বলা হয় যেবিশ্বের সবচেয়ে বেশি সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে মিয়ানমারে। কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গাদের ওপরে নৃশংস নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের দেশ ছাড়া করার পর এখনো সেখানে আঞ্চলিক সন্ত্রাস, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরে নির্যাতনের ঘটনা এবং রাজনৈতিক হানাহানি চলছে।

জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং আগামী বছরের অক্টোবরে দেশব্যাপী আদমশুমারি এবং সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা দেয়ার পর মিয়ানমারের অভিবাসন মন্ত্রী মিন্ট কিয়াং বেইজিং সফর করে আসন্ন আদমশুমারি পরিচালনা এবং মিয়ানমারে একটি ইলেকট্রনিক-আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম চালু করতে সহায়তা চায়। এর আগের আদমশুমারি পলিচালনায় জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল এবং বেশ কয়েকটি উন্নত দেশ মিয়ানমারকে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল। বর্তমান সামরিক সরকার এই কাজে সাহায্যের জন্য বেইজিংয়ের সহায়তা চাইছে। মিয়ানমার সরকার ২০২৪ সালের অক্টোবরে জাতীয় আদমশুমারি করবেএবং এর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানায়, তাই অনেক বিশ্লেষকের মতে মিয়ানমারেরপ্রস্তাবিত নির্বাচন ২০২৫ সালের আগে হওয়ার সম্ভাবনা কম।

মিয়ানমারের আরেক প্রতিবেশী দেশ ভারতের মণিপুরে ও অশান্তি বিরাজ করছে। গত মে মাসে মণিপুরের জাতিগত সংঘাতের পর থেকে ভারত-মায়ানমার সীমান্তে অস্ত্র চোরাচালান ও যুদ্ধের সরঞ্জামাদির প্রবাহ বেড়েছে বলে জানা যায়। ভারতের দাঙ্গাপীড়িত মণিপুরের সঙ্গে মিয়ানমারের ৯৫ কিলোমিটার এবং মিজোরামের সঙ্গে মিয়ানমারের ৫১০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, এই অঞ্চলের কিছুটা বাংলাদেশেরও সীমান্ত ঘেঁষা। মিয়ানমার থেকে ভারতের মিজোরামে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাচার নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে বলে সেখানকার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে ভারত কত্তৃক পরিচালিত চোরাচালান বিরোধী অভিযানেঅবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাজেয়াপ্ত করা হয়। প্রতিবেশী দেশের সশস্ত্র সংঘাতের প্রভাব এবং সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে আসা মানুষেরা আন্তঃসীমান্ত নেটওয়ার্ক এবং চোরাচালান সম্পর্কে উদ্বেগ বাড়িয়ে চলছে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ শান্তি ও স্থিতিশীলতা জরুরি। চীন রাজ্যের পালেতোয়া টাউন শিপে মিয়ানমার বাহিনী ও আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে সংঘর্ষের কারণে শত শত মানুষ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে গেছে। বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের অনেকেই ভারতে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা যায়। প্রতিবেশী মণিপুরের চলমান জাতিগত সংঘাতে মিয়ানমারের নাগরিকদের সহায়তার সম্ভাবনা কেবারে অস্বীকার করাও যাবে না। এক কথায় পুরো এই অঞ্চলজুড়ে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির বদলে সংঘাত ও অশান্তি বিরাজ করছে।

এত কিছুর মাঝেও কিছু কিছু আশার আলো দেখা যায়, প্রায় তিন বছর বন্ধ থাকার পর এই বছর শান রাজ্যে মিয়ানমারের বিখ্যাত হট এয়ার বেলুন উৎসব পুনরায় শুরু হবে বলে নিশ্চিত করেছেন আয়োজকরা। আগামী ২১-২৭ নভেম্বর শান রাজ্যের রাজধানী তাউংগির আওয়ায়ার হট এয়ার বেলুন স্কোয়ারে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এই অনুষ্ঠানটি স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে পর্যটন শিল্পকে আকর্ষণীয় করবে ফলে স্থানীয় অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসলে এই অঞ্চলে যোগাযোগ, বাণিজ্য ও পর্যটন খাতে ব্যাপক উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে দক্ষিন ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে দ্রুত যাতায়াত ও পরিবহনের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে যা এই অঞ্চলে বাণিজ্য প্রসারিত করে সমৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। ভু- কৌশলগত গুরুত্ববহ এবং প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ামারের এই অঞ্চলে পাহাড়, বনাঞ্চল, সমতল, নদী ও সাগর রয়েছে যা একত্রে একটা মনোরম পর্যটন অঞ্চল হতে পারে। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ দেশগুলোর উন্নয়নেও অবদান রাখতে পারে। একই সাথে এই অঞ্চলে যোগাযোগ এবং সাংস্কৃতিক সংযোগ এক অভাবনীয় উন্নয়নের সূচনা করতে পারে যা এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে জাতিগত সহিংসতা ছেড়ে আমরা কি সহমর্মিতা ও উন্নয়নের কথা চিন্তা করতে পারি না?

 

  সীতাকুণ্ডে ডিপোতে আগুন

;

কফি আবিষ্কারের গল্প, পানের ইতিহাস মজার ও গোলমেলে



মারিয়া সালাম
কফি আবিষ্কারের গল্প, পানের ইতিহাস মজার ও গোলমেলে

কফি আবিষ্কারের গল্প, পানের ইতিহাস মজার ও গোলমেলে

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ আন্তর্জাতিক কফি দিবস। কফি আবিষ্কারের গল্প আর কফি পানের ইতিহাস বেশ মজার আবার গোলমেলে। ধারণা করা হয়, কফি আবিষ্কার হয়েছে ৮৫০ সালের দিকে ইয়েমেন বা ইথিওপিয়ায়। কফির চাষ আর বাজারজাতকরণ শুরু হয় প্রথম ইথিওপিয়ায়। শুরু যেখানেই হোক, ধীরেধীরে কফি সেবন অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

প্রথম দিকেত কফি রেস্তোরাঁর কথা জানা যায় চতুর্দশ বা পঞ্চদশ শতকের দিকে। ইস্তাম্বুলের কাছাকাছি শহরগুলোতে ব্যাপকভাবে কফি জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

আরব দেশগুলোতে কফি ‘কাবেহ খানাহ’ বা ‘কিভা হান’ নামে পরিচিত ছিল। কফি পান করাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় জমজমাট আড্ডা। আড্ডা থেকেই চিন্তার আদান-প্রদান শুরু হয় এবং এই আড্ডা শাসকদের বেশ ভয় দেখিয়ে দেয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মক্কায় সব ধরনের কফি রেস্তোরাঁ এবং মুসলমানদের জন্য কফি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

অটোমান সাম্রাজ্যে কফি খুবই জনপ্রিয় ছিল। সেই ভয়ে, সুলতান চতুর্থ মুরাদ একে অবৈধ ঘোষণা করেন। এমনকি কফি পান করা অবস্থায় কাউকে ধরা হলে তার শিরচ্ছেদের নির্দেশও দেওয়া হতো। এতকিছুর পরেও কফি পানকারীকে তার অভ্যাস থেকে বিচ্যুত করা যায়নি।

ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে ভেনিস দিয়ে ইউরোপে যাত্রা শুরু করে কফি। সেখানে এর প্রচলন আর জনপ্রিয়তা বাড়লে, চার্চও ভীত হয়ে উঠে। তারা কফিকে “শয়তানের নির্মম আবিষ্কার” বলে অভিহিত করে।কফির ইতিহাস নিয়ে পল ক্রিস্টালের একটা বই আছে। বইটির নাম “কফি: আ ড্রিংক ফর দ্য ডেভিল”।

কফি যে 'অলওয়েজ আ ড্রিংক ফর ডেভিল' তাতে আমি মোটামুটি নিসন্দেহ। কেন? সে গল্পটা বলি-  একবার না বুঝেই, বিনা কারণেই একজনকে কফির দাওয়াত দিয়ে ফেললাম। কেন দিলাম, সে প্রশ্নের উত্তর আল্লাহই জানেন। দাওয়াত দিয়েই বুঝলাম মস্তবড় ভুল হয়ে গেল। খুব অনিচ্ছাসত্ত্বেও গেলাম দেখা করতে, নির্দিষ্ট সময়ের একঘন্টা পরে। ঝিপঝিপ বৃষ্টি, সেদিন সন্ধ্যা পড়ে গেছে সময়ের অনেক আগেই। আমি রিকশা থেকে নামতেই দেখি সেই অতিথি দাঁড়িয়ে। খুবই নিম্নমানের একটা কফিশপে বসলাম আমরা কারণ, সেখানে এর চেয়ে ভালো কোন রেস্তোরাঁ দেখলাম না। আমি নিজের উপরেই খুব বিরক্ত ছিলাম, কি করব বুঝতেই পারছিলাম না। টেক্সট করে আরেক বন্ধুকে আসার অনুরোধ করলাম। টুকটাক কথা দিয়ে শুরু হয়ে গল্প জমে গেল। উঠব, উঠছি করতে করতে তিনকাপ কফি হয়ে গেল। এরমধ্যেই বন্ধু এসে হাজির। তার তোড়জোড়েই খুব জমে যাওয়া আড্ডা ভেঙে বাধ্য হয়েই রাত এগারোটায় রেস্তোরাঁ থেকে বের হলাম। ফিরতি পথে পুরা রাস্তাই বলতে বলতে আসলাম, কফি অবশ্যই শয়তানি পানীয়। প্রতিদিন সকালে উঠে কফি খেতে খেতে এখনও বলি, অবশ্যই কফি শয়তানি পানীয়।

  সীতাকুণ্ডে ডিপোতে আগুন

;

কক্সবাজারে ওভার ট্যুরিজমের আর্থ-সামাজিক প্রভাব



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি মনোরম উপকূলীয় শহর কক্সবাজার দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বের অন্যতম পর্যটন স্থান হিসেবে হয়ে পরিগণিত হয়ে আসছে। বঙ্গোপসাগর বরাবর ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ অবারিত বালুকাময় উপকূলরেখার জন্য পরিচিত, কক্সবাজার কয়েক দশক ধরে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের জন্য একটি আকষর্ণীয় স্থান হয়ে উঠেছে। যাই হোক, আদিগন্ত সৈকত এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা হাজির হয়েছে – আর তা হল ওভারট্যুরিজম বা অতি-পর্যটন।

কক্সবাজারকে প্রায়ই পৃথিবীর অন্যতম পর্যটন স্থান হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এর সূর্যস্নাত সৈকত, প্রশান্তিদায়ক তরঙ্গ এবং প্রাণবন্ত স্থানীয় সংস্কৃতি বিশ্বের সমস্ত কোণ থেকে পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছে। শহরটি বিলাসবহুল রিসর্ট থেকে শুরু করে বাজেট-বান্ধব আবাসন, ভ্রমণকারীদের জন্য বিভিন্ন রকম উপাদেয় খাবারের পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে গর্বিত। শহরের আইকনিক সমুদ্রের তীরে প্রমোনেড, যা লাবনি পয়েন্ট নামে পরিচিত, স্থানীয় উপাদেয় খাবার, হস্তশিল্প এবং সীশেল স্যুভেনির বিক্রি করে এমন বিক্রেতাদের দ্বারা ভরা একটি ব্যস্ততাপূর্ণ কেন্দ্র।

তদুপরি, কক্সবাজার সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রবেশদ্বার হিসাবে কাজ করে, যা বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর প্রবাল প্রাচীরের আবাসস্থল। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মতো প্রধান শহর থেকে এর প্রবেশযোগ্যতা পর্যটকদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও পর্যটনের বৃদ্ধি অনস্বীকার্য সুবিধা নিয়ে এসেছে, এটি এই বৃদ্ধির স্থায়িত্ব এবং স্থানীয় সম্প্রদায় এবং পরিবেশের উপর এর প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগও সৃষ্টি করেছে।

অতি-পর্যটন, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। এটি এমন পরিস্থিতিকে বোঝায় যেখানে অত্যধিক সংখ্যক পর্যটক একটি গন্তব্যে যান, যা পরিবেশ, স্থানীয় সংস্কৃতি এবং বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মানের ক্ষতি করে। অত্যধিক পর্যটনের নেতিবাচক পরিণতি কক্সবাজার বিভিন্নভাবে ভোগ করছে।

প্রথমত, কক্সবাজার ভ্রমণকারী পর্যটকদের বিপুল সংখ্যা এই অঞ্চলের ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে। সমুদ্র সৈকতের ক্ষয় যা একসময় একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ছিল, সমুদ্রের খুব কাছাকাছি হোটেল এবং রিসর্ট নির্মাণের কারণে এটি আরও তীব্র হয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের কারণে এই অঞ্চলের আদি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যা পর্যটকদের আকর্ষণ করত তা ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, শহরটির অবকাঠামো পর্যটকদের আগমনের সাথে মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে। যানজট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমস্যা এবং অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন সুবিধা দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় সরকার এবং কর্তৃপক্ষ পর্যটন শিল্পের চাহিদা পূরণের জন্য অবিরাম চেষ্টা করছে, যার ফলে এই শহরের স্থায়ী বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার ওপর এর প্রভাব পড়ছে।

কক্সবাজারে অতি-পর্যটনের আর্থ-সামাজিক প্রভাব জটিল এবং বহুমুখী। যদিও পর্যটন এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক সুযোগ এনে দিয়েছে, এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য বিভিন্ন চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। পর্যটন নিঃসন্দেহে স্থানীয় অর্থনীতিতে অর্থ যোগান দিচ্ছে। এটি আতিথেয়তা, পরিবহন এবং খুচরাসহ বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি তৈরি করেছে। পর্যটকদের অবিরাম আগমনের কারণে ছোট ব্যবসা, যেমন রেস্তোরাঁ এবং স্যুভেনির শপগুলি সমৃদ্ধ হয়েছে৷ উপরন্তু, বর্ধিত অর্থনৈতিক কার্যকলাপ কিছু বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে।

পর্যটন খাতও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ খুলে দিয়েছে। দর্শনার্থীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় উপকৃত হয়ে স্থানীয়রা তাদের নিজস্ব গেস্টহাউস এবং রেস্তোরাঁ চালু করেছে। এর ফলে অনেকের আয় বেড়েছে এবং জীবিকার উন্নতি হয়েছে।

যদিও পর্যটন অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে এসেছে, এই খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা স্থানীয় অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলেছে। মৌসুমী পর্যটনের কারণে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সারা বছর আয়ের ওঠানামা অনুভব করে। অফ-পিক সিজনে, অনেক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করে, যার ফলে ব্যবসার মালিক এবং তাদের কর্মচারী উভয়ের জন্যই অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়।

কক্সবাজারে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় স্থানীয় জনগণের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। পর্যটন খাত থেকে আবাসন এবং জমির চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে সম্পত্তির দাম বেড়েছে, সাধারণ বাসিন্দাদের জন্য বাড়ি ও জমি কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মিশ্র অনুভূতি তৈরিতে অবদান রেখেছে, কারণ তারা তাদের শহরকে প্রাথমিকভাবে পর্যটকদের জন্য পরিবর্তিত হতে দেখেছে।

কক্সবাজারে অতি-পর্যটন শুধু শহরের ভৌগোলিক ল্যান্ডস্কেপই পরিবর্তন করেনি বরং এর সাংস্কৃতিক বুননেও প্রভাব ফেলেছে। পর্যটকদের আগমন ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক চর্চাকে হ্রাস করেছে। পর্যটক-বান্ধব অভিজ্ঞতার চাহিদা প্রায়ই স্থানীয় রীতিনীতি এবং ঐতিহ্যের পণ্যীকরণের দিকে নিয়ে যায়, যা দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য নিছক দৃশ্য পণ্যে পরিণত করে।

অধিকন্তু, বহুজাতিক চেইন হোটেল এবং বিদেশী মালিকানাধীন ব্যবসার উত্থান স্থানীয় সংস্কৃতিকে আরও সংকোচিত করেছে। ঐতিহ্যবাহী বাজার এবং খাবারের দোকানগুলির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলির দ্বারা ছেয়ে গেছে, যা স্থানীয় অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্রতাকে নষ্ট করে দিয়েছে। এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে কক্সবাজারের পরিচিতি ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে।

কক্সবাজারে অতি-পর্যটনের পরিবেশগত প্রভাব সম্ভবত সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়। উপকূলরেখা বরাবর হোটেল এবং রিসর্টের অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কাঠামো উল্লেখযোগ্য সৈকত ক্ষয়ের দিকে পরিচালিত করেছে। এই ভাঙন শুধুমাত্র শহরের পর্যটন আকর্ষণকেই হুমকির মুখে ফেলে না বরং স্থানীয় জেলেদের জীবিকাকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে, কারণ সমুদ্রে তাদের প্রবেশাধিকার ব্যাহত হয়।

অধিকন্তু, পর্যটকদের ফেলে দেয়া প্লাষ্টিক কাপ, পানির বোতল ও অন্যান্য দ্রব্যাদি প্রচুর পরিমাণে বর্জ্য তৈরি করে, যা প্রায়শই সমুদ্র এবং আশেপাশের অঞ্চলকে দূষিত করে। অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকাঠামো এবং অনুশীলনের ফলে সমুদ্র সৈকতে এবং শহরে দৃশ্যমান আবর্জনা দেখা দিয়েছে। এটি শুধুমাত্র পরিবেশেরই ক্ষতি করে না বরং পর্যটকদেরও নিরুৎসাহিত করে যারা আদি
প্রাকৃতিক পরিবেশ খুঁজতে আসে।

কক্সবাজারে অত্যধিক পর্যটন সমস্যা সমাধানের জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন যা পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের সাথে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখে। পর্যটকদের আগমনকে আরও দক্ষতার সাথে পরিচালনা করার জন্য পর্যটন ব্যবস্থার উন্নতি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার মতো বিষয়গুলোতে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উপকূলরেখার কাছাকাছি হোটেল ও রিসর্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে কঠোর প্রবিধান প্রয়োগ করা এবং দায়িত্বশীল নির্মাণ কাঠামো অনুশীলনের প্রচার করা সৈকত ক্ষয় কমাতে সাহায্য করতে পারে। পর্যটন পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থানীয় সম্প্রদায়কে জড়িত করা নিশ্চিত করতে পারে যে তাদের স্বার্থ বিবেচনায় নেওয়া হয় এবং তারা শিল্প থেকে উপকৃত হয়।

পর্যটন ব্যতীত অন্যান্য শিল্পকে সমর্থন করে এমন অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করে পর্যটনের মৌসুমী দুর্বলতা হ্রাস করতে পারে। সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং স্থানীয় অভিজ্ঞতার সত্যতা প্রচার কক্সবাজারের অনন্য পরিচয় বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে।

দায়িত্বশীল এবং টেকসই পর্যটন অনুশীলন সম্পর্কে পর্যটকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পরিবেশ ও সংস্কৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমাতে অবদান রাখতে পারে। এলাকাটি টেকসইভাবে ধারণ করতে পারে এমন সর্বাধিক সংখ্যক পর্যটক নির্ধারণ করা এবং পিক সিজনে দর্শনার্থীদের অবস্থানের সময়সীমা নির্ধারণ করা কিছু পরিবেশগত চাপ কমিয়ে দিতে পারে।

একটি শান্ত উপকূলীয় শহর থেকে একটি ব্যস্ত পর্যটন কেন্দ্রে কক্সবাজারের অভিযাত্রা অতি-পর্যটনের কারণে একটি চ্যালেঞ্জের তৈরি করেছে যা এই শহরের টেকসই পর্যটনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যদিও পর্যটন অর্থনৈতিক সুযোগ এনে দিয়েছে, এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের উপর গভীর আর্থ- সামাজিক এবং পরিবেশগত প্রভাবও ফেলেছে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং স্থায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে যাতে কক্সবাজার তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভ্রমণকারীদের জন্য একটি আশ্রয়স্থল হয়ে থাকে। এই মনোরম উপকূলে টেকসই পর্যটনের একটি রূপরেখা প্রণয়ন সরকারি, বেসরকারি, ব্যবসায়ী ও পর্যটকসহ সকল স্টেকহোল্ডারের অন্যতম দায়িত্ব।

ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

  সীতাকুণ্ডে ডিপোতে আগুন

;

রোহিঙ্গা সংকটে ত্রান সহায়তার নিম্নমুখী প্রবণতা রোধে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দীর্ঘ ছয় বছরেরও বেশী সময় ধরে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহায়তা নিম্নমুখী এবং এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলে এই বৈশ্বিক সংকটটির গুরুত্ব কমে আসার প্রবনতা দেখা যাচ্ছে। মানবিক বিবেচনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সেই মহানুভবতার কথা বিবেচনায় না নিয়ে, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন না করে ইদানিং বাংলাদেশের সমালোচনা করার প্রবনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যা কারো কাম্য নয়। এ বছর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউ এফ পি) রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা ৩৩% কমিয়ে প্রতিমাসে মাথাপিছু ৮ ডলারে নামিয়ে এনেছে, ফলস্রুতিতে ৪৫% রোহিঙ্গা পরিবার পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না এবং কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা অপুষ্টিতে ভুগছে। জাতিসংঘের কোর্ডিনেশন অব হিউমেনিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্সের পরিসংখ্যান মতে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এ বছর  জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের(জেআরপি) ৮৭৬ মিলিয়ন ডলার চাহিদার বিপরীতে এখন পর্যন্ত মাত্র ২৬৮ মিলিয়ন সহায়তা পাওয়া গেছে যা চাহিদার এক তৃতীয়াংশ। এই পরিস্থিতি নিরসনে,  মানবাধিকার সংস্থা ফোর্টিফাই রাইটসের পরিচালক জন কুইনলি জানায় যে, দাতাদেশগুলোর বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের সুযোগ নিশ্চিত করা উচিত। 

বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মতে, ২০২২ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলার বিষয়টি সর্বোচ্চ আর্থিক মানবিক সহায়তার মধ্যে ছিল। বর্তমানে রোহিঙ্গা সমস্যাটি আনুষ্ঠানিকভাবে জরুরি পরিস্থিতি নয় এবং তাঁরা একে এখন প্রলম্বিত পরিস্থিতি হিসেবে মনে করে। এর ফলে মানবিক জরুরি তহবিল এখন বিশ্বজুড়ে চলমান অন্যান্য জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে অনেক জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হলেও প্রধান দাতা দেশগুলোর সামগ্রিক সাহায্য বাজেট কমে যাওয়ায় অনেক মানবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

২০২২ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক রোহিঙ্গা সহায়তা তহবিলের ৪০% আসত যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার পরিমাণ ছিল ৩৩৬ মিলিয়ন ডলার, এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের থেকে সহায়তা কমে ১০০ মিলিয়ন আসায় তহবিল সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা এবং তাদের আশ্রয়দাতা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ১.৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে এবং তাদের এই সমর্থন চলমান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমারের অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানায় এবং সমগ্র অঞ্চল জুড়ে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ কমাতে সম্ভাব্য সব বিকল্প খুঁজতে অবিচল থাকার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের সহায়তায় মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জন্য অতিরিক্ত ১১ কোটি ৬০ লাখ ডলার মানবিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, এই সংকট মোকাবেলায় দেশটি এ পর্যন্ত মোট ২.২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা প্রদান করেছে।

যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির প্রথম নারী সভাপতি এলিসিয়া কিয়ার্নস বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়ে জানান যে, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চাপের মাধ্যমে মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করতে আরও কাজ করা প্রয়োজন। যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) স্থায়ী আন্ডার সেক্রেটারি স্যার ফিলিপ বার্টন জানান যে, মিয়ানমারে অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দাতা স্থানীয়দের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গা সমস্যার একটি দীর্ঘ মেয়াদী সমাধানের জন্য মিয়ানমারে চাপ অব্যাহত রেখেছে যাতে রোহিঙ্গারা নিরাপদ, স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণভাবে মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে। এফসিডিও কক্সবাজার ও ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা, বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যবিধি এবং স্যানিটেশন পরিষেবা ও রান্নার জ্বালানি নিশ্চিত করতে ৩০ লাখ পাউন্ড প্রদানের ঘোষণা দেয়, এই সহায়তা কার্যক্রম ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দাতা বাংলাদেশি মানুষের জন্য ৩৬৫ মিলিয়ন পাউন্ড আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ইউএনএইচসিআর, হিউম্যান রাইট ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এবং এনজিওগুলোর মতো বিশ্বসম্প্রদায়ও মিয়ানমারকে কার্যকরভাবে চাপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই সংকট আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও অস্থিতিশীল করে তুলছে। মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ টম অ্যান্ড্রুজ জানায় যে,  আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও রোহিঙ্গাদেরকে পর্যাপ্ত সমন্বিত সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং  জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর আর্থিক অনুদান কমিয়ে দেওয়ায় রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে জেনেভাতে আসন্ন গ্লোবাল রিফিউজি ফোরামে রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিতে অংশীদারদের আহ্বান জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর। এটি একটি বৃহত্তর মানবিক সংকটে আর্থিক সহায়তার হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরে।

বাংলাদেশ, মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টি চলমান রাখার পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা যেন বিশ্ব ভুলে না যায় সেজন্য বৈশ্বিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুটি সামনে রাখতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ চলমান রেখেছে।  ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যেকার ভিসা সেবা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) অধীনে কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা অব্যাহতি পুনর্বহাল করা হয়েছে। এই সমঝোতা স্মারকের অধীনে উভয় দেশের কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীরা ভিসার প্রয়োজন ছাড়াই সর্বাধিক ৯০ দিনের জন্য ভ্রমণ করতে পারবে। এই সিধান্তের ফলে সরকারি সফর সহজতর হওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চলমান উদ্যোগের প্রস্তুতি হিসেবে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে একটি ট্রানজিট ক্যাম্প ও একটি রিপ্যাট্রিয়েশন ক্যাম্প নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহন করা হয়েছে বলে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তসংলগ্ন এলাকা থেকে আসা রোহিঙ্গাদের তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে ফেরত পাঠানো হবে। প্রত্যাবাসন শুরু হলে রোহিঙ্গাদের প্রথমে ঘুমধুমের ট্রানজিট ক্যাম্পে আনার পর সেখান থেকে রিপ্যাট্রিয়েশন ক্যাম্পে নেয়া হবে। সেখানে দুই দেশের দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন হলে তাদেরকে মিয়ানমারে পাঠানো হবে।

সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানান যে, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক হতাশার জন্ম দিয়েছে। এই অবস্থা চলমান থাকলে এটি আমাদের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে সেখানে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে আগ্রহী, সেজন্য রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে যাওয়া নিশ্চিত করতে তিনি সবার কাছে আহ্বান জানান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের  সমর্থন চেয়েছেন। ফ্রান্স, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক ও মালদ্বীপ এই সাতটি দেশ মামলার প্রতি সম্মতি দিয়েছে।

২০ সেপ্টেম্বর, ১৮তম এশিয়া কোঅপারেশন ডায়লগ (এসিডি) পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন চলমান রোহিঙ্গা সংকট ও মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায়। রোহিঙ্গারা যাতে দ্রুত তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করার জন্য সমাধান খুঁজে বের করার উপর গুরুত্বারোপ করেন এবং রোহিঙ্গা সঙ্কটের ইস্যু আলোচ্যসূচির শীর্ষে রাখতে অনুরোধ জানান। কক্সবাজারে থাকা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার নিরাপদ প্রত্যাবাসনে জাপানের সহায়তা  চেয়েছে বাংলাদেশ। জাপানের সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্য এবং জাপানের বিদেশি সহায়তা কমিটির (ওডিএ) প্রধান নাকানিশি ইয়োসুকে সেপ্টেম্বরে তার বাংলাদেশ সফরের সময় এই আহ্বান জানানো হয়। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য বন্ধু প্রতীম দেশগুলো ভুমিকা রাখতে পারে। একই সাথে তাঁরা রোহিঙ্গাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করে মিয়ানমারে তাদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের জন্য প্রস্তুত করতে পারে। চলমান পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রগুলো তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা দিয়ে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের ত্রান সহায়তা চলমান রাখার জন্য খাদ্য ও অর্থের সংস্থান নিশ্চিত করতে পারে। 

সম্প্রতি দি ইয়থ কংগ্রেস রোহিঙ্গা (ওয়াই সি আর) নামে রোহিঙ্গাদের স্বার্থনিয়ে কাজ করা একটা সংগঠনের কথা জানা যায়। এই সংগঠনটি প্রায় এক বছর ধরে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এই সংগঠনটি প্রত্যাবাসন ও রোহিঙ্গাদের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং মিয়ানমারে তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির দিকে গুরুত্ব না দিয়ে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর ও আরও কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের নেয়া পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে যা অনাকাঙ্ক্ষিত। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তায় তাদের সক্ষমতার বিষয়ে প্রতিবেদন থেকে কিছু জানা যায় নাই। বহু দশক ধরে পরিকল্পিত ভাবে রোহিঙ্গাদেরকে প্রান্তিক জনগুষ্টিতে পরিণত করা হয়েছিল ও তাদের নাগরিক অধিকার সহ অন্যান্য মানবিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে তাদেরকে এই অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ অবশ্যই সম্ভব এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে এই প্রান্তিক জনগুষ্টিকে কর্মক্ষম শক্তিতে পরিনত করা যেতে পারে। এই সংগঠনটি এসব উদ্যোগ নিতে পারে।  আশা করা যায় তাঁরা রোহিঙ্গাদের ক্রমহ্রাসমান আর্থিক ও খাদ্য সহায়তার বিষয়টি সম্বন্ধে অবগত এবং এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরনে ইতিবাচক ভুমিকা রেখে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তাদের আগ্রহ ও সহানুভুতির বাস্তব রূপ দিবে।

আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি, আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রন নিশ্চিত করতে তৎপর। এখানে রোহিঙ্গা সমস্যার মত একটা জটিল সমস্যা চলমান থাকবে তা কারো কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশ  আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে এই সংকট সমাধানে আঞ্চলিক, বৈশ্বিক সহ সব ধরনের উদ্যোগে সহায়তা ও সমর্থন দিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মানবিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে এই ইস্যুটিকে জরুরি পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচনায় রাখতে হবে। চলমান প্রেক্ষাপটে এসব উদ্যোগের পাশাপাশি ত্রান সহায়তার নিম্নমুখী প্রবনতা রোধে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহনের বিষয়টি এই সঙ্কটের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

 

  সীতাকুণ্ডে ডিপোতে আগুন

;