বাঙালি কাব্যচেতনায় মারমা নৃ-প্রপঞ্চ: মহীবুল আজিজের ‘গঙখাঙ রেগেখ্যঙ’

  ‘এসো মিলি প্রাণের মেলায়’


ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলা ভাষার জয়ধ্বনিতে মুখর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা ‘তাহাদের কথা’ বিস্মৃত হই! তারা হলেন- বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহ। বাংলার সমান্তরালে তাদের রয়েছে, নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, আত্মপরিচিতি।

প্রথমবারের মতো বাঙালি কাব্যচেতনায় তেমনই এক জনজাতি মারমাদের নৃ-প্রপঞ্চ উপস্থাপন করেছেন কবি ও কথাশিল্পী ড. মহীবুল আজিজ তাঁর ‘গঙখাঙ রেগেখ্যঙ’ কাব্যগ্রন্থে।

বার্তা২৪.কম’র অ্যাসোসিয়েট এডিটর ড. মাহফুজ পারভেজের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি জানিয়েছেন কাব্যের পটভূমি, মারমা ভাষাবৈশিষ্ট্য ও কবিতার বিষয়বস্তু সম্পর্কে।

মাহফুজ পারভেজ: কেন মারমা নিয়ে আগ্রহী হলেন?

মহীবুল আজিজ: ১৯৬৬ সালে আমার বাবা মোহাম্মদ আজিজউল্লাহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের জনপদ দোহাজারি’তে কৃষিব্যাংকের ম্যানেজার পদে নিযুক্তি পেলে আমাদের ঠিকানা হলো সেখানকার জামিজুরি এলাকা। এটাই দোহাজারির কেন্দ্রীয় জায়গা। বাজারের একেবারে মধ্যমণি ব্যাংকভবনটা।

বাজার ঘেঁষে একটা বড় পুকুর। পুকুরের অন্য পাড়ে আমরা থাকি ভাড়া বাসায়। সেই বাসার মালিক ভগীরথ হাজারী। আমাদের প্রতিবেশী ছিল, একটি বৌদ্ধ পরিবার। চন্দা বড়ুয়া নামে একটি মেয়ে ছিল আমার খেলার সাথী। ওদের বাসায় গেলে শোলা’র, পাথরের, ধাতুর ছোট-বড় বুদ্ধমূর্তিগুলো চোখে পড়তো। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। তারপর আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন বাজারে চেম্বার-অলা ডা. আশীষ বড়ুয়া। একবার অনেক রাতে আমার মুখ দিয়ে বিরাটাকার কৃমি বেরিয়ে এসেছিল, যেন মরণদশা হয়েছিল। মৃত্যুমুখ থেকে আমাকে বাঁচিয়েছিলেন তিনি। তো! একবার সম্ভবত প্রবারণা বা বুদ্ধপূর্ণিমার দিনে বাবা আমাদের দুইভাইকে নিয়ে ছুটির অবকাশে চলে গেলেন বান্দরবান।

সেটা ১৯৬৭ সাল। আমার বয়স পাঁচ বছর মাত্র এবং তখন রাস্তাগুলো আজকের মতো এতটা সুগম ও সুবিন্যস্ত ছিল না। মনে পড়ে, অফিসের সবুজ রঙের জিপগাড়িতে করে আমরা আমিরাবাদ, সাতকানিয়া, বাজালিয়া এইসব পেরিয়ে বান্দরবান পৌঁছেছিলাম।
সে যে কী আনন্দ আর একটা অকহতব্য উত্তেজনা! একটা নতুন জগতে ঢুকে পড়বার উচ্ছ্বাস। সেখানকার একজন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সদস্য আমাদের অভ্যর্থনা জানান, আপ্যায়নও করেন। কেবল একটা স্মৃতি বেশ জ্বলজ্বলে থাকে। বড় শক্ত মোটা বাঁশের মধ্যে বসানো দই খেতে দেওয়া হয়েছিল।

সারাদিন পাহাড়ে কাটিয়ে একটা অদ্ভুত রহস্যময় অজানার মধ্যে নিজেকে নিহিত দেখে খানিকটা বোঝা-না-বোঝার বৃত্তে অতিবাহিত করে যখন সন্ধ্যায় ফের দোহাজারি ফিরে আসি তখন অনেক ফানুস উড়তে শুরু করেছিল আকাশে।

ডা. আশীষ বড়ুয়াই বাবাকে বলেছিলেন, বান্দরবানে আমাদের বেড়াতে নিয়ে যেতে। তাছাড়া চন্দাদের বাসায় দেখা বুদ্ধের ছবি-মূর্তি, ডা. আশীষের চেম্বারে টাঙানো ক্যালেন্ডারে গৌতম বুদ্ধের ছবি এবং বান্দরবানে মারমা ঘরের বেড়ায় আঁটা বুদ্ধের চিত্র সব একটা সমাপতনে মনের মধ্যে কেমন একটা অনির্দেশ্য কৌতূহল জাগিয়ে রাখে!

সেটাই শুরু। তারপর আর যাওয়া হয় না। তখন তো অল্প বয়স। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা মণিপুরি সবই একইরকম মনে হতো। বয়োপ্রাপ্ত হতে হতে বুঝতে পারি, না, সব এক নয়! তবে পাহাড়ি জীবনের প্রতি একটা দারুণ কৌতূহল মনের মধ্যে কোথাও জেগে উঠেছিল এবং উঠেছিল নিভে যাওয়ার জন্য নয়, সেটা টের পাই।

পরে জানলাম, বান্দরবান মূলত মারমা জন-অধ্যূষিত অঞ্চল যেমন, রাঙামাটি চাকমাপ্রধান কিংবা সিলেট মণিপুরিপ্রধান বা কোথাও রয়েছে জৈন্তিয়া বা খাসিয়া।

বলা যায়, আশির দশকে আমার বন্ধু কবি হাফিজ রশিদ খান এবং আমাদের পরম সুহৃদ, যাকে আমরা ‘পাহাড়-সমতলের দূত’ বলতাম, চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া এই দুই উদাত্ত প্রাণের আহ্বানে সাড়া দিতেই আমার বান্দরবানের জনজীবনে প্রবেশ এবং সেখানে সুদীর্ঘকালের যাতায়াত। তখন কিন্তু পার্বত্যচুক্তি ছিল না।

সেইসব দিনে পাহাড়ে ঢোকা এবং বেরিয়ে আসার নির্দিষ্ট সময় বাঁধা ছিল। হাফিজ রশিদ খান, চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া এবং শৈ অং প্রু এঁরা মিলে পাহাড়-সমতলের অংশীদারিত্ব বিষয়ক অসাধারণ একটি গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেন। সেখানে আমি একটি গল্প দিই, যেটি বান্দরবানের জনজীবনাশ্রিত ‘মঙ চিঙের অলৌকিক অভিজ্ঞতা’।

এখানে বলে রাখি, সম্মান শ্রেণিতে আমার সহপাঠীরা যখন বাংলা ব্যাকরণ বেছে নেয়, আমি সেটির বিকল্প হিসেবে নিই পালি। একটা নতুন বিষয় পড়বার আগ্রহেই আমার পালি নেওয়া। পাঠ্য হিসেবে পড়তে হয়, মখাদেব জাতক, গাথাসত্তসই, মিলিন্দপঞহো, বুদ্ধের জীবনী। অশ-- ঘোষের বুদ্ধচরিত তখনই পড়ি। আরো সব বই। বান্দরবানের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীজীবন, আবার বৌদ্ধজীবন ও দর্শন এবং সেই সঙ্গে সাহিত্যপাঠের হেতু প্রকৃতির অনুষঙ্গ আমার মনে পাহাড়ি জীবনের প্রতি একটা অদ্ভুত ভালোলাগার বোধ তৈরি করে। এখনও সেই বোধ আমার ভেতরে বিদ্যমান। দীর্ঘদিন য়ুরোপে কাটিয়ে আসবার পরেও সেই আকর্ষণ ম্লান হয় না আমার!

পাহাড়ি জীবনের সারল্য নিরাভরণ সৌন্দর্য এবং আয়ত দৃষ্টি, যা আমরা নগরে বা সমতলে দুর্লভ মনে করি, হয়ত তারই সন্ধানে আমার পাহাড়ের সন্নিধান। সন্ধানের সেই উৎসাহ নানাভাবে নানা মাত্রিকতায় আমার মধ্যে সক্রিয়। ফলে, পাহাড়ের সঙ্গে সংযোগ আমি হারাই না। যথাসম্ভব বজায় রাখি। পাহাড়ি বন্ধুবান্ধব সেই সংযোগের সেতু কিংবা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যাঁরা পাহাড়-সমতলের সেতুবন্ধনের উপলব্ধি আজও জাগিয়ে রেখেছে মনে, তাদের আগ্রহে কখনও কখনও চলে যাই বান্দরবানে। অবারিত জীবনের প্রবাহে স্নাত হয়ে ফিরি। তাছাড়া পাহাড়ি কবি-লেখকদের রচনা পাঠ করবার মাধ্যমেও সংযোগ রক্ষা করা যায়। যদিও যতটা প্রত্যাশা ততটা অনুবাদ হয় না, কিন্তু হয়। আমি কেবল মারমা জীবনের কথাই বলছি না, আমাদের পাহাড়ে বসবাসরত যতগুলো নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে, সবগুলিই আমার মনোযোগের বিষয় কিন্তু জীবনে প্রথম বান্দরবান যাওয়ার কারণে এবং পরবর্তীতে সেই যাতায়াতের ধারাটা ধারাবাহিত থাকবার ফলে মারমাসংলগ্নতাই আমার ঘটে বহুল পরিমাণে। হয়ত সামনের দিনে বান্দরবানের জনজীবন নিয়ে আরও লিখবো।

মাহফুজ পারভেজ: বাংলার চেয়ে মারমা ভাষার বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য কী?

মহীবুল আজিজ: বাংলাভাষাভাষী হিসেবে কিংবা বাংলাভাষা ও সাহিত্যের মানুষ হিসেবে ভাষাসংক্রান্ত কিছু হদিস হয়ত আমাদের জানা কিন্তু তা দিয়ে ঠিক বিশেষজ্ঞতার দাবি করা সম্ভব নয়। তবে বান্দরবানে যাওয়া-আসার মাধ্যমে সেখানকার মানুষদের কথাবার্তার ধরনধারণ দেখে-বুঝে এবং খানিকটা বিচার বিশ্লেষণ করে কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা বলা যায়। এখানে এটিও বলা দরকার, বান্দরবানে মারমা ছাড়াও আরও নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস এবং প্রত্যেকেরই রয়েছে স্বতন্ত্র প্রণালী ও প্রকাশ। বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রাচ্য শাখার অন্তর্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা।

তাছাড়া বিপুলসংখ্যক মানুষের ভাষিকতার কারণে এটি আরো গুরুত্ব অর্জন করেছে বিশেষ। প্রথমত বর্ণের কথা যদি বলি, অবয়বগত বিচারে মারমা বর্ণ মায়ানমারি ভাষার বর্ণের আদলের সঙ্গে মেলে। আবার কখনও কখনও মনে হয়, দেখতে মারমা বর্ণ তামিল, তেলেগু, কন্নড়ি এইসব বর্ণের মতোই। তবে মারমা ভাষার বর্ণ সেগুলোর চাইতে খানিকটা পরে এসে সুনির্দিষ্ট লিখিত রূপ পেতে শুরু করে। একাদশ-দ্বাদশ শতকের দিকে মারমা বর্ণমালার প্রাচীন রূপটি গড়ে উঠেছিল। মারমা ভাষায় রয়েছে, ৩৩টি ব্যঞ্জনবর্ণ, ৪টি মৌলিক যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি, ১২টি স্বরবর্ণ এবং ১০টি স্বরধ্বনি বিলুপ্তকারী ব্যঞ্জনবর্ণ।

মারমা ভাষার উৎস কিন্তু বাংলার মতোই ব্রাহ্মী লিপি। বাংলার মতোই স্পৃষ্ট ও নাসিক্য ধ্বনির স্বাতন্ত্র্য মারমা ভাষায় সুস্পষ্ট। বর্গীয় বর্ণবিচারে বাংলা ও মারমার মধ্যে সাদৃশ্য যথেষ্ট। ‘ক’ ব্যঞ্জববর্ণ বাংলার মতোই মগ, মারমা, রাখাইন এবং বার্মিজ বর্ণমালার প্রথম বর্ণ। অনুস্বার এবং বিসর্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বর্ণ মারমা ভাষায়। মাং মানে এবং যা অব্যয়, কিন্তু মাং মানে আবার রাজা-ও। মাংগ্রী মানে জ্যাঠা বা বড় মামা। মাংক্যোয়েঁ মানে গৃহকর্তা। মাংক্যোয়েমাঁ-র অর্থ গৃহকর্তার স্ত্রী বা গৃহকর্ত্রী।

এছাড়া ঞ, ফ, চ, ছ, হ্ল, থ, চ¦, ত্ব এসব বর্ণ মারমা ভাষায় প্রভাবক ভূমিকা রাখে। স্বরের ক্ষেত্রে বলা যায়, চিনা ভাষায় যেমন বর্ণে প্রযুক্ত উচ্চ ও দীর্ঘ স্বর শব্দের অর্থের তারতম্য ঘটায়। মারমা ভাষাতেও সেরকম ব্যাপার লক্ষ করা যায়। চিনা ‘চা’ (হ্রস্ব স্বর) মানে হলো, একটি পানীয় যা আমরা পান করি। আবার ‘চাআআ’ (স্বরবর্ণের প্রলম্বনযুক্ত) মানে হলো গাড়ি, অর্থাৎ মূল ব্যঞ্জন অবিকৃত রেখে কেবল স্বরের হ্রস্ব ও দীর্ঘত্বের দ্বারা শব্দার্থের পরিবর্তন করা হয়। মারমা ভাষাতেও হ্রস্ব ও দীর্ঘস্বরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাকরণগত দিক থেকে বলা যায়, লিখিত বাংলা এবং মারমা ভাষার গাঠনিক কাঠামো এক নয়। ভারতবর্ষের প্রায় সব প্রধান ভাষা পাণিনি’র ব্যাকরণানুসারী। কিন্তু মারমা ভাষা তা নয়। এতে বরং প্রাচীনতাবাহিত কথকতার ভঙ্গিটি আভাসিত।

কারক, বিভক্তি, বাক্যে পদের সংস্থাপন এসবের ক্ষেত্রে মারমা ভাষার স্বাতন্ত্র্য রয়েছে অবশ্যই। বিজ্ঞানসম্মতভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাবিষয়ক গবেষণা করা গেলে মারমা ও অন্যান্য ভাষার স্বরূপ উদ্ঘাটন সম্ভব। এটা হতে পারে যোগ্যতাসম্পন্ন ও বিষয়পারদর্শী মারমাভাষীদের দ্বারা কিংবা মারমা ও বাঙালির যৌথ গবেষণার মাধ্যমে। তখন হয়ত আরো অনেক নতুনদিক বা অজানা দিক জানা সম্ভব হবে আমাদের পক্ষে। শব্দের সংখ্যার বিচারে কিন্তু মারমা ভাষার সমৃদ্ধি অনস্বীকার্য। কাজেই এ-বিষয়ে ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।

মাহফুজ পারভেজ: আপনার এই কাব্যে কী বলতে চেষ্টা করেছেন?

মহীবুল আজিজ: আমার সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ যেটির প্রকাশক ‘চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন’ গঙখাঙ রেগেখ্যঙ। এর সহজ অর্থ হলো- আকাশ ও শঙ্খনদী। রেগে অর্থাৎ বৃহৎ/বড় খ্যঙ মানে নদী বড় নদী, মারমাদের নিকটে শঙ্খ হলো বড় নদী রেগেখ্যঙ। আর ছোট নদী মানে রিনিখ্যঙ।

নামের মাহাত্ম্যের কথা বলতে গেলে বলবো, আসলে বাংলাভাষী কারো কাব্যের শিরোনামটাই পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীর ভাষাশ্রিত হতে পারে, সেটা আমার ধারণাতে ছিল না। মারমা জনপদ ও জীবনের প্রতি আশৈশব আকৃষ্ট আমি বেশকিছু কবিতা লিখি মারমাদের মূল ভৌগোলিক সংস্থান বান্দরবানের প্রেক্ষাপটে। এটি আমার ২১শ কাব্যগ্রন্থ।

বইয়ের পাণ্ডলিপি তৈরি করতে গিয়ে দেখলাম, আশি শতাংশ কবিতাই বান্দরবানের প্রকৃতি মানুষ খাবার পোশাক সংস্কৃতি এসবকে ধারণ করেছে। এমনকী সমতলের নরনারীর প্রেমের পরিপ্রেক্ষিতও পাহাড়ি প্রকৃতি ও প্রেক্ষাপট। কাজেই তখন একটা সুযোগ এলো বইয়ের শিরোনামেই যদি সেই মুখ্যতাকে ফুটিয়ে তোলা যায়, তাহলে সেটা কেমন হয়!

আমার বন্ধু কবি হাফিজ রশিদ খান বললো, হ্যাঁ, ধারণাটা ভালোই হয়। হাফিজ পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীর ভাষা-সাহিত্য-সমাজ এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ। দীর্ঘদিন কর্মসূত্রেও কাটিয়েছে বান্দরবানে। ফলে, ওর পরামর্শ আমার আত্মবিশ্বাস খানিকটা বাড়িয়ে দেয়। বস্তুত এ-বই এক অর্থে পাহাড়ি জনজীবনের প্রতি মুগ্ধতার প্রামাণ্য কাব্যিক প্রতিবেদন। আবার, অন্যভাবে বলতে পারি, এতে একটা সমন্বয়চেতনারও প্রকাশ আছে। পাহাড়ের প্রকৃতি জীবন এসবের প্রতি আমাদের আবেগ ও মুগ্ধতার নানামাত্রিক প্রকাশ আমরা লক্ষ করে থাকি। কিন্তু পাহাড়ি জীবন ও সংস্কৃতির মধ্যে ক্ষণকালীন আনন্দ অন্বেষণের বিষয়টাই আমাদের মধ্যে মুখ্য! আমরা পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীর জীবনের সংস্কৃতি বা জীবনের মৌল ধর্ম এসব বিষয়ে ততটা উৎসুক নই।

পাহাড়ের মানুষদের জীবন সমাজ ও সংস্কৃতির যে স্বাতন্ত্র্য কিংবা তাদের জীবনের অভাব দীনতা বা চাহিদা ইত্যাদি নিয়ে আমরা তত আগ্রহী নই। আমরা পাহাড়কে ততটাই ভালোবাসি, যতটা পাহাড় আমাদের ক্ষণকালীন আনন্দের জন্য আরামের জন্য প্রয়োজন। পাহাড় কেবল প্রকৃতিই নয়, অরণ্যঘেরা সৌন্দর্যকেন্দ্রই নয়, সেখানেও জীবন আছে যে-জীবন শত-শত বছরের অবিরাম চক্রায়ণের মধ্য দিয়ে আজও প্রবহমান। সে-জীবন আমরা চাই বা না-চাই, বদলেছেও যথেষ্ট।

কিন্তু সেই প্রবহমানতা সেই বিবর্তনের ব্যাকরণ কি আমরা পাঠে আগ্রহী, এইসব প্রশ্নই আমার মধ্যে ঘুরপাক খায় কিন্তু আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ, যার সেরকম কোনো ক্ষমতা নেই কিন্তু হ্যাঁ, আমার শব্দের সাম্রাজ্যের সৃষ্টিকর্তা তো আমিই। তাই ভাবলাম আমার একজনের প্রচেষ্টার মধ্যে, হোক সে সংখ্যায় ন্যূনতমই, তবু সেই একক প্রচেষ্টার আয়তনে দুই মেরুর দূরত্বকে কিছুটা সময়ের জন্য ঘুচিয়ে দিয়ে পাশাপাশি আনা যাকই না কেন। পাশাপাশিই তো আমরা। দীর্ঘকালের ইতিহাস আমাদের এই প্রতিবেশিত্বের। প্রতিবেশীরাই তো পরস্পর পরস্পরের নিকটজন। কাজেই নৈকট্যকে আত্মস্থ করবার একটা দায়ও তো থেকে যায়।

পাহাড়ি জীবন ও সমাজের বিষয়াবলি আজ আর দূরতর বা অচেনা উৎসের উপাদান নয়, বরং তা একটি সমান্তরাল অভিযাত্রারই বাস্তবতা। সেই বাস্তবতাকে আমি চেষ্টা করেছি, আমার পক্ষে সবচাইতে সহজ উপায় ও উদ্ভাবনা দিয়ে প্রকাশ করতে।

আমার কবিতা থেকে কিছু প্রসঙ্গ সংক্ষেপে তুলে ধরা যেতে পারে, যেখানে মারমা জীবন ও প্রকৃতি কিংবা বৃহত্তর অর্থে পাহাড়ের অনুষঙ্গ যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তার কিছুটা অনুভব করা যাবে।

কবিতাটার শিরোনাম ‘শোনো সখি’ “শোনো সখি, পাহাড়েও ঢের বিচিত্রতা আছে,/ এলে দেখবে একই সবুজের নানা মাত্রায় তারা বাঁচে।/ চাকমা মারমা তঞ্চঙ্গ্যা ও বম মুরং বা ..,/ বনের আড়াল থেকে চমকে দেবে তোমায়.. হাই ব্রো!/ ঐ যে পাহাড়ি ধেয়ে যায় নদী জল স্বচ্ছতোয়া,/ তারই তীরে বসে কেশবিন্যাসে এক রমণি পাংখোয়া।/ স্বামী তার চিং থোয়াই, শ্রমে চাষ কওে জুম-টিলা,/ সন্তর্পণে শোনো গান…/ নি পোয়েইটি লেহাং তোং তিলা।”

এরকম সব উপমা, চিত্র, দৃশ্যকল্প যেখানে মানবিক কিংবা সাংস্কৃতিক প্রতিভাসের অন্বেষণ চলেছে কিংবা ধরুন ‘পাহাড়ে হেলান দিয়ে’ কবিতায় প্রকৃতিঘেরা জীবনের ঐশ্বয্যও যে কম নয় বরং সুন্দরতামণ্ডিত সেটা বলবার চেষ্টা আছে “পাহাড়ে হেলান দিয়ে আজ তুমি আমায় ভালোবাসো,/ খেতে দেবো তোমায় থানচি পাহাড়ের মুরগির লাক্সো।/ আঠালো চালের উপাদেয় খাদ্য এনেছি এ মুড়ি,/ বিনি চাল থেকে নিকষিত বারি বানিয়েছে শুনি।” নিশ্চয়ই মনে পড়বে সেই চর্যাপদের যুগের সিদ্ধাচার্যদের উচ্চারণে “এক সে শু-িণী দুই ঘরে সান্ধই,/ বিঅন বাকলত্ বারুণি বান্ধই।” উৎসব আনন্দ সংস্কৃতি সব মিলেমিশে যায় পাহাড়ি জীবনের আয়তনে ‘দাঁড়াও তুমিও’ কবিতাটি বারো পংক্তির, শেষের স্তবকটাই উদ্ধৃত করা গেল “পি- নিয়ে খাড়া বুদ্ধানুসারীরা সূর্য পাহারায়,/ প্রস্তুত শ্রমণ কঠিন চীবর নব উত্তরীয়।/ উর্ধ্ব থেকে নেমে গেরুয়া আলোক নিসর্গে গড়ায়,/ দাঁড়াও তুমিও, পেম্মং শরণং সম্বোধি হে প্রিয়।”

এরকম সব পংক্তি রয়েছে এ বইতে এ বইয়ের অনেকগুলো কবিতাতেই। তাই পাঠকের পক্ষে বোঝা সম্ভব, বইয়ের রচয়িতা পাহাড়ি জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু এই গ্রন্থনা কিংবা এই বিম্বনের অভিমুখ অবশ্যই সমন্বয়ধর্মী ও ইতিবাচক। আপনি নিশ্চয়ই পল গগ্যাঁ’র কথা জানেন, যিনি তাহিতি দ্বীপকে অমর করে রেখে গেছেন তাঁর চিত্রশিল্পে।

ফরাসি গগ্যাঁ তাহিতিতে জীবন কাটাতে গেছেন প্রথমত জীবনের অন্বেষণে এবং পরত জীবনকে শিল্পে রূপান্তরের অধ্যবসায়ে। আমার একক ও ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে আমি চেষ্টা করেছি আমাদের এই দেশেও যদি সঠিক সন্ধান করি জীবনের বিচিত্র বিচিত্রতর রূপ ছড়ানো রয়েছে। জীবন তো আর নিজে থেকে আমাদের নিকটে আসবে না, আমাদেরই যেতে হবে জীবনের নিকটে। আর এই যাওয়াটা খুব সহজ বা চকিত অন্বেষণের ব্যাপার নয়, এর জন্য লাগে আবেগ মানসিকতা ও জীবনবোধ। আমি সেটি অর্জন করবার চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।

মহীবুল আজিজ, ‘গঙখাঙ রেগেখ্যঙ’, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন, ২০২৪.

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

  ‘এসো মিলি প্রাণের মেলায়’

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

  ‘এসো মিলি প্রাণের মেলায়’

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

  ‘এসো মিলি প্রাণের মেলায়’

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

  ‘এসো মিলি প্রাণের মেলায়’

;