পরিযায়ী পাখি: এদেশের প্রজনন পরিযায়ী কোকিলেরা



আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ
ঢাকার মিরপুরস্থ জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে অস্থির লাল-ডানা ঝুঁটিয়াল কোকিল। ছবি- লেখক।

ঢাকার মিরপুরস্থ জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে অস্থির লাল-ডানা ঝুঁটিয়াল কোকিল। ছবি- লেখক।

  • Font increase
  • Font Decrease

 

সাতাশ কি আটাশ বছর আগে সর্বপ্রথম লাল-ডানার ঝুঁটিয়াল পাখিটির ছবি দেখেছিলাম। পরবর্তী বছর দু’য়েক বিভিন্ন স্থানে বেশ ক’বার পাখিটির সন্ধান করেছিলাম। কিন্তু, দেখা পাইনি। এরপর বহু বছর গড়িয়ে গেছে; বহু জায়গায় ওকে খুঁজেছি, কিন্তু ফলাফল একই।

বর্ষায় সুন্দরবনের রূপ দেখতে ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই ‘অভিযাত্রিক সুন্দরবন’-এর ব্যানারে দশজনের টিমে সুন্দরবন গেলাম। পরদিন সকালে লঞ্চের সঙ্গে থাকা কোসা নৌকায় জামতলী খালে ঢুকলাম। আধঘন্টার মতো খালে ঘুরে কিছু পাখির ছবি তুলে যখন খয়েরি-মাথা সুইচোরার ছানার ছবি তুলছি ঠিক তখন লাল-ডানায় পাখিটিকে চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যেতে দেখলাম। পাখিটি উড়ে গিয়ে খালপাড়ের কেওড়া গাছে বসল। দ্রুত ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে ক্লিক করলাম। কিন্তু, সে দ্রুত উড়ে যাওয়ায় দলের একজন ছাড়া বাকিরা ছবি তুলতে ব্যর্থ হলো। দুপুরে দ্বিতীয়বারের মতো জামতলী গেলাম। সমুদ্র সৈকত থেকে ফেরার পথে আরও দু’বার ওকে কয়েক সেকে-ের জন্য দেখলাম। কিন্তু, দু’বারই ও গাছের ঘন পাতার আড়ালে হারিয়ে গেল। বাঘের ভয়ে ওখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। কাজেই ছবিও তোলা হলো না। এরপর টানা তিনবছর ওর খোঁজ নেই। 

 শূককীট মুখে লাল-ডানা ঝুঁটিয়াল কোকিল। ছবি- লেখক

বিরল একটি কোকিলের ছবি তোলার জন্য এ বছরের ২০ মে মিরপুরস্থ জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে গেলাম। ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম লাল-ডানার ঝুঁটিয়াল পাখিটিকে গত দু’দিন ধরে অনেকেই দেখেছে। আমরা যখন বেলা এগারটায় পল্লবীর গেটের কাছে লেকের পাশে পাখির ছবি তুলছি সে সময় এক সুহৃদ ফোনে জানাল তারা পাখিটিকে দেখেছে। প্রায় এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দ্রুত সেখানে পৌঁছলাম। কিন্তু ততক্ষণে পাখিটি ঝোপের আড়ালে চলে গেছে। এমনিতেই দূরন্ত পাখিটি গাছের আড়ালে-আবডালে থেকে প্রজাপতি ও মথের শুঁয়াপোকা ধরে খায়। বেলা ১১:৩৫ মিনিটে একযোগে ৭-৮ জনের ক্যামেরার শাটার গর্জে ওঠতেই একটি গাছের পাতার আড়ালে ওকে লাফালাফি করতে দেখলাম। তবে অনেক চেষ্টার পরও অস্থির পাখিটির পরিষ্কার ছবি তুলতে পারলাম না। মিনিট বিশেক চেষ্টার পর অবশেষে অধরা পাখিটির ছবি তুলতে সক্ষম হলাম। এত বছর খোঁজাখুঁজি ও চেষ্টার পর যার ছবি তুললাম সে হলো এদেশের দুর্লভ প্রজনন পরিযায়ী পাখি লাল-ডানা বা লাল-পাখা কোকিল। আজকে এই পাখিসহ কোকিল গোত্রের সকল পরিযায়ী তথা গ্রীষ্মের প্রজনন পরিযায়ী সদস্যদের নিয়ে গল্প সাজিয়েছি।

কোকিল পরভৃত অর্থাৎ কুকুলিফরমেস (Cuculiformes) বর্গের পাখি। এই বর্গের কমবেশি ৪০ ভাগ পাখি, যাদের বেশির ভাগই পুরনো বিশ্ব অর্থাৎ এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকায় বাস করে, তারা বাসা তৈরি করে না; তাই বংশবৃদ্ধির জন্য ওরা অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে ও নিজেদের বংশবৃদ্ধির কাজটি অন্য পাখিকে দিয়ে করিয়ে নেয়। এজন্য ওদেরকে শাবক পরজীবীও (Brood Parasite) বলে। এই বর্গে মোট ১৪৭ থেকে ১৫১ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এই বর্গের একমাত্র গোত্রের নাম পরভৃত বা কুকুলিডি (Cuculidae)। এদেশে এই গোত্রের মাত্র বিশ প্রজাতির পাখির বাস, যার বেশিরভাগই কোকিল (Cuckoo)। এই বিশ প্রজাতির বেশিরভাগ পাখিই বাসা বানায় না। তবে এদের মধ্যে ব্যতিক্রম হলো বনকোকিল বা মালকোহা (Malkoha) এবং কানাকুক্কা বা কুকাল (Coucal), কারণ তারা অন্যান্য পাখির মতো বাসা বানায়, ডিম পাড়ে ও ডিমে তা দিয়ে ছানা ফোটায়। এই গোত্রের অনেক প্রজাতির পাখির ক্ষেত্রেই স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে বেশ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বেশকিছু প্রজাতি বংশবৃদ্ধি করার জন্য গ্রীষ্মকালে এদেশে আসে যাদেরকে গ্রীষ্মের প্রজনন পরিযায়ী (Summer Breeder) বলে। এদেশে প্রাপ্ত এই গোত্রের ২০টি প্রজাতির মধ্যে দুটি বনকোকিল ও দুটি কানাকুক্কা এবং বাকি ১৬টি প্রজাতি কোকিল। এই কোকিলগুলোর মধ্যে যারা গ্রীষ্মকালে এদেশে প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি করতে আসে তাদের সম্পর্কেই এখানে আলোচনা করব।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গাছের ডালে চাতক পাখি। ছবি- লেখক।  

তবে প্রজনন পরিযায়ী কোকিলদের নিয়ে আলোচনার আগে আবাসিক, পরিযায়ী ও প্রজনন পরিযায়ী পাখি বলতে কি বোঝানো হয় তা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। এদেশের পক্ষীতালিকায় এখন পর্যন্ত ৭২২ প্রজাতির পাখি নথিভুক্ত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কমবেশি ৩৪০টি প্রজাতি আবাসিক; অর্থাৎ ওরা সারাবছর এদেশে থাকে, ডিম পাড়ে ও ছানা তোলে। এছাড়াও ৩৭০ প্রজাতিরও বেশি পাখি পরিযায়ী অর্থাৎ বছরের কোনো একটি নির্দিষ্ট সময় এদেশে আসে, বসবাস করে ও সময়মতো মূল আবাসে ফিরে যায়। এসব পাখি এদেশের মানুষের কাছে আগে, এমনকি এখনও, ‘অতিথি পাখি’ নামেই পরিচিত। এদেরই এক বিরাট অংশ আসে শীতে, যারা শীতের পরিযায়ী নামেও পরিচিত। এসব পাখি মূল দেশে আবাসস্থল বসবাস অনুপযোগী হওয়া, খাদ্যের অভাব ও শীতের কবল থেকে বাঁচার জন্যই বাংলাদেশসহ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার অন্যান্য দেশে পরিযায়ন করে। এটা ওদের জীবনচক্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে ওরা সচরাচর শীতের আবাসে বংশবিস্তার করে না; অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে, যেমন- কুড়া বা পালাসেস ফিশ ঈগল এদেশে আসে শীতকালে, ডিম-ছানা তোলে ও ছানাদের বড় করে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়।

রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার বিজয়নগরে শুককীট খাচ্ছে চাতক পাখি। ছবি- লেখক

এছাড়াও বেশকিছু পরিযায়ী পাখি এদেশে অনিয়মিত। ওরা অন্যদের মতো প্রতিবছর আসে না, বরং ৫ বা ১০ বছর পর পর আসে। তাই ওরা যাযাবর, ভবঘুরে বা অনিয়মিত পরিযায়ী হিসেবে পরিচিত। ওদের সংখ্যাও নেহাত কম না, এদেশের মোট পরিযায়ী পাখির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এছাড়াও কোনো কোনো পাখি অন্য দেশে পরিযায়নের এক পর্যায়ে এদেশে স্বল্প সময়ের জন্য বিশ্রাম নিতে আসে, যেমন- বাদামি চটক, বন খঞ্জন, লাল-পা তুরমতি ইত্যাদি। ওরা পন্থ-পরিযায়ী (Passage-migrant) নামে পরিচিত। এই পাখিগুলো মূলত সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরে অন্য কোনো দেশে পরিযায়নের পথে এদেশে কিছুদিনের জন্য যাত্রা বিরতি করে ও ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চে মূল দেশে ফিরে যাওয়ার সময়ও আরেকবার এদেশে যাত্রা বিরতি করে।

যদিও পরিযায়ী পাখি বলতে মূলত শীতের পাখিগুলোকেই বোঝায়, তথাপি কিছু পাখি গ্রীষ্মেও পরিযায়ন করে, যেমন- বিভিন্ন প্রজাতির কোকিল, সুমচা, সুইচোরা, মাছরাঙা ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রজাতির কোকিল এদেশে মার্চ থেকে এপ্রিলে আসে, অন্য উপযুক্ত পাখির বাসায় ডিম পাড়ে, ছানা তোলে এবং ছানাসহ সকলেই আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরে শীতকালীন আবাসে চলে যায়।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে পান্না কোকিল। ছবি- লেখক

আগেই বলেছি কোকিলরা বাসা বানায় না। ওরা ডিমে তাও দেয় না এবং ছানাদেরও লালন-পালন করে না। ববং ওরা অন্য উপযুক্ত পাখির বাসায় ডিম পাড়ে এবং তাদের মাধ্যমে নিজেদের বংশবৃদ্ধির কাজটি করিয়ে নেয়। কোকিলের বিভিন্ন প্রজাতি, যেমন- কোকিল, পাপিয়া, চোখ গেল, বউ কথা কও, পান্না কোকিল, বেগুনি কোকিল, বাদামি কোকিল, সরগম, ফিঙ্গে কুলি প্রভৃতির স্ত্রী পাখিরা নিজেদের জন্য উপযুক্ত পোষক বা ধাত্রী পাখির বাসায় ধাত্রীর পাড়া ডিম ফেলে দিয়ে ঠিক একই রঙের প্রায় সমান আকারের ডিম পাড়ে। বংশ রক্ষা নিশ্চিত করতে একটি পোষকের বাসায় ডিম না পেড়ে একাধিক বাসায় ১-৩টি করে ডিম পাড়ে। এসব শাবক পরজীবী পাখির ডিম সচরাচর পোষক পাখির ডিমের আগে ফোটে ও পরজীবী পাখিদের সদ্যফোটা চোখ অফোটা ছানারা পোষক পাখির অফোটা ডিম বা সদ্যফোটা ছানা পিঠ দিয়ে ঠেলে ঠেলে বাসা থেকে নিচে ফেলে দেয় যেন ওরা এদের খাবার বা যতেœ ভাগ বসাতে না পারে। আর এভাবেই ছানাগুলো পোষক বাবা-মায়ের যত্নে একদিন বড়ো হয়ে ওঠে। অথচ পোষক পাখি তা টেরই পায় না।

বাসা না বানানো এই কোকিলদের মধ্যে যারা আবাসিক এবং পন্থ-পরিযায়ী নয়, কিন্তু প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি করার জন্য অন্য দেশ থেকে গ্রীষ্মকালে এদেশে আসে ওদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লাল-ডানা ঝুঁটিয়াল কোকিল, চাতক ও পান্না কোকিল। এছাড়াও আরও যেসব প্রজাতির কোকিল এদেশে প্রজনন পরিযায়ী হয়ে আসে সেগুলোর মধ্যে বউ কথা কও, ধূসর-পেট কোাকিল ও বেগুনি কোকিল অন্যতম। তবে, প্রকৃতি সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন-এর মতে ওরা এদেশের আবাসিক পাখি। এছাড়াও এ তালিকায় ছোট কোকিলকেও অর্ন্তভুক্ত করা যায়। তবে, এদেশে গ্রীষ্মের অনিয়মিত এই পরিযায়ী পাখিটির প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির কোন চাক্ষুস প্রমাণ না পাওয়ায় লাল-ডানা ঝুঁটিয়াল কোকিল, চাতক ও পান্না কোকিলের মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে। 

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়রণ্যে পান্না কোকিল। ছবি- লেখক

এক. লাল-ডানা ঝুঁটিয়াল কোকিল: ফিচারের শুরুতে লাল ডানার খোপাধারী যে কোকিলটির গল্প বলা হয়েছে সে হলো লাল-ডানা বা লাল-পাখা ঝুঁটিয়াল কোকিল। এটি এদেশের দুর্লভ প্রজনন পরিযায়ী কোকিল। পশ্চিমবঙ্গে বলে গোলা কোকিল। ইংরেজি নাম Chestnut-winged Cuckoo বা Red-winged Crested Cuckoo । বৈজ্ঞানিক নাম Clamator coromandus। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত।

লাল-ডানা কোকিল চাতক পাখির মতোই লম্বালেজী ঝুঁটিদার কোকিল। হাঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন একটি লালচে চাতক। দেহের দৈর্ঘ্য ৩৮-৪৬ সেন্টিমিটার ও ওজন ৬৬-৮৬ গ্রাম। কালো মাথায় কালো ঝুঁটি, চোখ ও চঞ্চু কালো। পিঠের উপরটা ও লম্বা লেজ চকচকে নীলচে-কালো। ডানার উপরটা ও প্রান্ত লাল। গাল ও গলা হালকা লালচে। ঘাড়ের উপর অর্ধ সাদা বন্ধনী। বুক-পেট সাদা। চোখের মনি গাঢ় বাদামি। পা ও পায়ের পাতা ধূসর। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি ফ্যাকাশে, দেহের উপরটা লালচে ফুটকিযুক্ত ও ঝুঁটি ছোট। 

গ্রীষ্মকালে দেশের সব ধরনের বনাঞ্চল ও বনের আশেপাশের গাছপালাসম্পন্ন এলাকায় দেখা যায়। সচরাচর একাকী বা জোড়ায় থাকে। ঘন ঝোপ বা পাতাঘেরা গাছে লুকিয়ে থাকে বলে সহজে নজরে আসে না। প্রধানত শুঁয়াপোকা ও নরম দেহের কীটপতঙ্গ খায়। দ্রুত ডানা ঝাপটে গাছ থেকে গাছে ঘুরে বেরায়। স্ত্রী সচরাচর নীরব। পুরুষ অন্য সময় নীরব থাকলেও প্রজনন ঋতুতে উঁচ্চ কন্ঠে ‘ব্রিপ-ব্রিপ-ব্রিপ---’ শব্দে ডাকে।

মার্চ থেকে আগস্ট প্রজননকাল। বাসা না বানানো অন্যান্য কোকিলের মতো ওরাও না বানায় বাসা, না দেয় ডিমে তা, না করে ছানাদের যত্নে। সচরাচর ছাতারে বা পেঙ্গা পাখির বাসায় ওদের ডিমের সঙ্গে মিলিয়ে ২-৩টি নীল ডিম পাড়ে। ছাতারে বা পেঙ্গার ডিম ফোটার আগেই ওদের ডিম ফোটে। আয়ুষ্কাল চার বছরের বেশি।

দুই. চাতক: এটি এদেশের সচরাচর দৃশ্যমান প্রজনন পরিযায়ী খোঁপাধারী কোকিল। পিঁউকাহা, পাপিয়া বা পাকড়া কোকিল নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Pied Cuckoo, Pied Crested Cuckoo বা Jacobin Cuckoo বৈজ্ঞানিক নাম Clamator jocobinus । পূর্ব আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার পাখিটি প্রতি গ্রীষ্মে এদেশে প্রজনন করার জন্য পরিযায়ী হয়ে আসে। পাখিটি বছরের পর বছর একই সময়ে একই জায়গায় পরিযায়ন করে। 

চাতক লম্বালেজি ঝুঁটিয়াল কোকিল। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের গড় দৈর্ঘ্য ৩৩ সেন্টিমিটার যার মধ্যে লেজই ১৬ সেন্টিমিটার । ওজন ৬৫-৭০ গ্রাম। মাথায় কালো ঝুঁটি, দেহের উপরটা কালো ও নিচটা সাদা। লেজের ডগা সাদা। ডানার প্রান্তে সাদা ছোপ থাকে। চোখ বাদামি ও চঞ্চু কালো। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল ধূসর-কালো। নখ কালো। স্ত্রী ও পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠ ধূসর-বাদামি, গলা-বুকে ধূসর ও দেহতলে পীতাভ আভা থাকে। গ্রীষ্মকালে এদেশের বন, বাগান, আবাদি জমি, খামার, ঝোপঝাড় সর্বত্রই ওদের দেখা যায়। সচরাচর একাকী, জোড়ায় বা ৫-৬টির ছোটো দলে থাকে। ঘন ঝোপ বা পাতাঘেরা গাছে লুকিয়ে খাবার খায়। প্রজাপতি ও মথের শূককীট, ছারপোকা, উঁইপোকা, পিঁপড়া ইত্যাদি প্রিয় খাবার। স্ত্রী সচরাচর নীরব। তবে, পুরুষ চাতক ‘পিউ---পি-পি-পিউ---’ শব্দে ডাকে।

মার্চ থেকে জুলাই প্রজননকাল। পুরুষ চাতক পূর্বরাগের সময় সুরেলা কন্ঠে গান গায়। পরভৃত গোত্রের বেশিরভাগ প্রজাতির মতো ওরাও বাসা বানায় না। আর ডিমে তা দেয়া বা ছানার যতœ নেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। ছাতারে (Babbler), বুলবুল (Bulbul), ফিঙে (Drongo) পোষক পাখি অর্থাৎ এসব পাখির বাসায় স্ত্রী চাতক চুপিসারে বাসাপ্রতি ২-৩টি করে ডিম পাড়ে, পোষক পাখির ডিমের রঙের সাথে মিল রেখে। ডিম ফোটে পোষক পাখির ডিম ফোটার আগে। ছানারা পোষক পাখির যত্নে বড়ো হয়ে উঠে। আয়ুষ্কাল চার বছরের বেশি।

আরও পড়ুন:

আমাদের প্রজাপতি

বাঘের থেকেও বিরল পাখি সুন্দরী হাঁস

পরিযায়ী পাখিরা আসছে


তিন. পান্না কোকিল: এটি বিরল ও সুদর্শন গ্রীষ্মের প্রজনন পরিযায়ী কোকিল। সবুজাভ কোকিল নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Asian Emerald Cuckoo বা Emerald Cuckoo । বৈজ্ঞানিক নাম Chrysococcyx maculatus । প্রতি গ্রীষ্মে পাখিটি এদেশে আসে ডিম-ছানা তোলার জন্য; যদিও না বানায় বাসা, না দেয় ডিমে তা। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, চীন, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় দেখা যায়।

কোকিল গোত্রের অন্যতম ছোট এই সদস্যটির দেহের দৈর্ঘ্য ১৭-১৮ সেন্টিমিটার ও ওজন ২৩-৩০ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী-পুরুষের পালকের রঙে ভিন্নতা থাকে। পুরুষের পিঠের উপরটা চকচকে পান্না-সবুজ, তাতে থাকে সোনালি-ব্রোঞ্জ আভা। থুতনি, গলা ও বুকেও তাই। বুক-পেটের নিচটা সাদা, তাতে ধাতব ব্রোঞ্জ-সবুজ ডোরা। লেজের নিচটা ধাতব সবুজ, তাতে সাদা ডোরা। স্ত্রীর মাথা ও ঘাড়ের পিছনটা সোনালি লাল। পিঠের পালক ব্রোঞ্জ-সবুজ। গলা-বুক-পেটে সাদার উপর বাদামি-ব্রোঞ্জ ডোরা। লেজে খয়েরি-কালো ডোরা, ডগা সাদা। চোখের রং গাঢ় লাল। চঞ্চু কমলা-হলুদ, আগা কালো। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল গাঢ় বাদামি-সবুজ। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের উপরটায় থাকে লাল-বাদামি ডোরা। থুতনি, গলা ও ঘাড়ে থাকে লালচে কালো দাগ। দেহের নিচটায় রয়েছে অনুজ্জ¦ল সাদা ও বাদামি ডোরা। 

 পান্না কোকিল প্রধানত চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। তবে নিচু ভূমি ও পাহাড়ের ১,৫০০ মিটার উঁচুতেও দেখা যায়। ওরা একাকী বা ৪-৬টির দলে বিচরণ করে। গাছের মগডালে পাতার আচ্ছাদনে লুকিয়ে থাকে, তাই সহজে চোখে পড়ে না। পিঁপড়া, শুঁয়াপোকা ও নরম পোকামাকড় খেতে পছন্দ করে। পূর্ণিমা রাতে পুরুষটি ‘চিরর্র-চিরর্র---’ শব্দে ডাকে।

এদেশে ওরা এপ্রিলের মাঝামাঝি আসে ও জুলাইয়ের শেষে চলে যায়। প্রজনন মৌসুমে পুরুষটি দিনভর ‘চিরর্র-চিরর্র-চিরর্র-চিরর্র---’ শব্দে ডাকতে থাকে। মৌটুসি (Sunbird)  বা মাকড়সাভূকের (Spiderhunter) বাসায় একটি করে সাদার উপর বাদামি বা লালচে ছিটযুক্ত ডিম পাড়ে। যদিও ওদের ডিম আকারে কিছুটা বড়ো হয়, কিন্তু ডিমের রং পোষক বা ধাত্রী পাখির মতোই। পোষকের ডিমের আগেই এই ডিম ফোটে। আয়ুষ্কাল চার বছরের বেশি।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে পান্না কোকিলের ছবি তোলারত অবস্থায় লেখক

E-mail:[email protected], [email protected]

   

প্রকৃতিতে শোভা ছড়াচ্ছে ‘সোনালু ফুল’



ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নওগাঁ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সবুজের ফাঁকে উঁকি দিয়ে হলুদ আভায় মুগ্ধতা ছড়ানো ফুল সোনালু। নজরকাড়া সৌন্দর্যে মুখরিত এই ফুল পথিকের মনে এনে দিচ্ছে প্রশান্তির ছোঁয়া। পরিবেশ ও প্রকৃতির শোভা বর্ধনে সোনালু দারুণ এক নিসর্গ মায়া এনে দিয়েছে। এই ফুলের দেখা মিলছে নওগাঁর বিভিন্ন পথে প্রান্তরে।

মঙ্গলবার (৭ মে) বিকেলে সরেজমিন দেখা যায়, নওগাঁ শহরের বরেন্দ্র অফিসের পাশে থোকায়-থোকায় হলুদ আভায় ঝুলে আছে সোনালু। ফুলের মাথা হতে লম্বা লতার মত বড় হয়েছে।

শীতকালে সব পাতা ঝরার পর বসন্তে একেবারেই মৃতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে গাছটি। গ্রীষ্মের শুরুতে দু’একটি কচিপাতার সাথে ফুল ফুটতে শুরু করে। হলুদ সোনালি রঙের অসংখ্য ফুল সারা গাছজুড়ে ঝাড় লণ্ঠনের মতো ঝুলতে দেখা যায়।


জানা যায়, সোনালু গাছের পাতাঝরা মাঝারি আকৃতির । এটি আট থেকে ৯ মিটার উঁচু হয়। হলুদ বরণ এ ফুল দেখতে যেমন আকর্ষণীয় তেমনি আছে তার বাহারি নামও। পরিচিত নামগুলো হলো সোনালু, সোনাইল, সোঁদাল, বান্দরলাঠিসহ আরো অনেক। ফুল থেকে ধীরে ধীরে লাঠির মত কালো রঙের ফল হয়ে সেটি কয়েক সেন্টিমিটার অব্ধি লম্বা হয়ে থাকে।

পথচারী আলমগীর বলেন, সোনালু দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আর শহরের মধ্যে চোখে পড়েনা বললেই চলে। যতবার দেখি খুব সুন্দর লাগে। মনের মধ্যে এনে দেয় এক প্রশান্তি। 

স্থানীয় বাসিন্দা মিঠু বলেন, আমি মোবাইল দিয়ে প্রচুর ছবি তুলেছি এই ফুলের। আমার খুব ভালো লাগে সোনালু ফুল। তবে এই ফুল যেন হারিয়ে না যায় সেজন্য আমাদের গাছ লাগানো উচিৎ। আমাদের বাড়ির আশেপাশে অনেক সোনালু গাছ আছে যা আমাদের মুগ্ধ করে।


নওগাঁ সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এনায়েতুস সাকালাইন বার্তা২৪.কমকে বলেন- এটি মূলত সৌন্দর্য বর্ধনে রোপণ করা হয়। গ্রাম বাংলায় এই ফুলকে বাদর লাঠি গাছ বলেও ডাকা হয়। এটির বৈজ্ঞানিক নাম 'কেসিয়া ফিসটুলা (Cassia Fastula)। এই উদ্ভিদ বাংলাদেশে অনেক জাতের আছে। ফুলটার জন্য বেশি খ্যাতি রয়েছে বলে অনেক জায়গায় লাগানো হয়। গাছের কাঠগুলো জ্বালানি কাজে ব্যবহার করা হয়।

;

দৌলতদিয়ায় মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে কৃষ্ণচূড়া



সোহেল মিয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজবাড়ী
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রখর তাপপ্রবাহের বিরূপ প্রভাবে বিপর্যস্ত প্রকৃতি। কোথাও নেই শান্তি। গ্রীষ্মের রুক্ষতা আর সব ক্লান্তি ছাপিয়ে আপন মহিমায় সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে কৃষ্ণচূড়া ফুল। জানান দিচ্ছে শিল্পের দ্যোতনা। পাশাপাশি প্রশান্তির বার্তা বয়ে দিচ্ছে জনমনে।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় দেখা যায় কৃষ্ণচূড়ার এমন সৌন্দর্য। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দৌলতদিয়া অংশের দুই পাশে শোভাবর্ধন করছে কৃষ্ণচূড়া ফুল। শত কষ্টের মাঝে এই মহাসড়ক পার হওয়ার সময় হাজারো পথচারীদের হৃদয়ে প্রশান্তির হাতছানি দেয় এই কৃষ্ণচূড়া ফুল। দৌলতদিয়া ঘাট দিয়ে প্রতিদিন শত শত যানবাহন এ মহাসড়ক দিয়ে চলাচল করে।এ সড়কে যাতায়াতকারীদের নজর কাড়ছে লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল।


সরেজমিন দেখা যায়, মহাসড়কের দু’পাশের গাছগুলো ছেয়ে গেছে লাল কৃষ্ণচূড়ায়। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন বৈশাখের প্রখর রোদ্দুরের সবটুকু উত্তাপ গায়ে মেখে নিয়েছে রক্তিম পুষ্পরাজি; সবুজ চিরল পাতার মাঝে যেন আগুন জ্বলছে। এই আগুনেই সেলফি তুলতে ব্যস্ত পথচারীরা। নিজেদেরকে কৃষ্ণচূড়ার সাথে একাকার করে স্মৃতিময় করে রাখতে ব্যস্ত সবাই।

দৌলতদিয়া ৭ নম্বর ফেরিঘাটের বাইপাস সড়ক থেকে শুরু করে ক্যানাল ঘাট এলাকার মহাসড়কের দুইপাশে ছেয়ে গেছে লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল। গ্রীষ্মের দাবদাহে মানুষ আর পশু পাখি যখন বেসামাল,ঠিক তখনই কৃষ্ণচূড়ার ফুলে বিচিত্র রূপ নিয়েছে দৌলতদিয়ার মহাসড়ক। এ যেন কৃষ্ণচূড়ার রঙে মেতেছে সড়কটি। কৃষ্ণচূড়া ফুলে ভরা গাছগুলো নজর কাড়ছে দর্শনার্থীসহ এই মহাসড়ক দিয়ে যাতায়াতকারী যাত্রী ও পথচারীদের।


স্থানীয়রা জানান, প্রতি বছরই দৌলতদিয়া ঘাটের এই অংশটুকুতে (ঢাকা-খুলনা মহাসড়ে) সৌন্দর্য বিলায় কৃঞ্চচূড়া। পুরো এলাকা কৃষ্ণচূড়া ফুলের লাল রঙে রঙিন হয়ে যায়। প্রখর রোদে মনে হয় যেন প্রকৃতিতে আগুন লেগেছে। পড়ন্ত বিকেলে পূর্ব আকাশের রক্তিম আভায় কৃঞ্চচূড়া মিশে যেন একাকার হয়ে যায়। প্রতি বছর এই সময়ে ঘাটের বাইপাস সড়ক নতুন রূপে সাজে। দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এখানে আসেন ছবি তুলতে।

পথচারীরা জানান, ফুলগুলো দেখলে মন প্রশান্তিতে ভরে যায়। গাছের ছায়া ও বাতাসে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। প্রখর রোদের মধ্যেও যেন এখানে একটু সবুজের শান্তি পাওয়া যায়।

;

নগরে ফুলের জলসা, গ্রীষ্মের উত্তাপে সৌরভ, স্বস্তি 



মানসুরা চামেলী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
হাতিরঝিলে নাগরিক পর্যটকদের স্বাগত জানায় উচ্ছল জারুল, রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া ও সোনাইল/ছবি: নূর এ আলম

হাতিরঝিলে নাগরিক পর্যটকদের স্বাগত জানায় উচ্ছল জারুল, রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া ও সোনাইল/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

চারিদিকে খাঁ খাঁ রোদ্দুর। যেন বইছে গনগনে আগুনের ফুলকি। চারপাশের পরিবেশ ফুটন্ত কড়াইয়ে মতো টগবগে। দাবদাহের তেজে ব্রহ্মতালু ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তাপদগ্ধ চরাচর ক্লান্ত, স্তব্ধ, স্থবির। বৈশাখের রুদ্র রূপে বিপর্যস্ত নাগরিক পরিসর আর জনজীবন। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় উচ্চারিত গ্রীষ্মের প্রতিচ্ছবিই দেখা যাচ্ছে রাজধানীর প্রকৃতিতে: 'প্রখর তপনতাপে, আকাশ তৃষায় কাঁপে,/বায়ু করে হাহাকার।’

পরিস্থিতি যখন এমনই খরতাপে পোড়া ও তামাটে, ঠিক তখন একপশলা বৃষ্টির ছোঁয়া ঢাকা নগরীর পথে পথে জাগিয়েছে খণ্ড খণ্ড ফুলের জলসা। গ্রীষ্মের এই রংবাহারের উজ্জ্বলতা এবং সৌরভ; নাগরিক বিড়ম্বনা মুছে বুলিয়ে দিয়েছে অনিন্দ্য স্বস্তির পরশ।

সাদা গোলাপীর মিশলে সোনাইল—দূর থেকে মনে হয় পুষ্পিত পোস্টকার্ড/ছবি: নূর এ আলম


নগরের ইটপাথর, কংক্রিটের কংকালের মধ্যে তাপ ও দূষণের সাম্রাজ্যে নানা রঙের বর্ণিল ফুলের বৃন্ত ও পত্রালীতে খেলা করছে মুক্তি ও স্বাধীনতার আরাম। কৃষ্ণচূড়ার বুনো ঘ্রাণ, টগরের শুভ্রতা এবং সোনালুর স্নিগ্ধ সৌন্দর্য দাবদাহে পীড়িত রাজধানীতে বসিয়েছে ফুলের জলসা। নিয়ে এসেছে রঙের উল্লাস। গন্ধের মাদকতা। ভালোলাগার এক অনির্বচনীয় অনুভূতি।

উচ্ছল জারুল


গ্রীষ্মের তপ্ত রোদের মধ্যেই শুক্রবার ও শনিবার ছুটির জোড়া দিনে হাতিরঝিলের নাগরিক পর্যটকদের স্বাগত জানাল উচ্ছল জারুল, রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া, কনকচূড়া ও সাদা গোলাপীর মিশলে সোনাইল। খুব কাছ থেকে দেখলে মনে হাতিরঝিলে ‘সোনাইল ব্লসম উৎসব’ চলছে। আর দূর থেকে মনে হয় পুষ্পিত পোস্টকার্ড।

কৃষ্ণচূড়ার বুনো ঘ্রাণ, টগরের শুভ্রতা এবং সোনালুর স্নিগ্ধ সৌন্দর্য দাবদাহে পীড়িত রাজধানীতে বসিয়েছে ফুলের জলসা/ছবি: নূর এ আলম


হালকা বাতাসে সোনাইল দুলুনির সমান্তরালে গুঞ্জরিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়' গানের শিহরণ জাগানিয়া আবেশ। হাতিরঝিলের পথে পথে হেঁটে ক্লান্ত হলে ছায়া দিতেও প্রকৃতি তৈরি হয়ে আছে। ফুলে ভরা মেঘশিরীষ গাছ প্রসারিত শাখা ও পল্লবে কাছে টানছে পথিকের মনোযোগ। এখানে জারুলের এমন অপূর্ব রূপ— চলতি পথে গাড়ি থামিয়ে, হাঁটতে হাঁটতে থমকে গিয়ে ক্যামেরাবন্দী করছেন নগরীর মানুষ।

নানা রঙের বর্ণিল ফুলের বৃন্ত ও পত্রালীতে খেলা করছে মুক্তি ও স্বাধীনতার আরাম/ছবি: নূর এ আলম


‘কি বলব- এত গরম, সহ্য করার মতো না। আমার বাসা মধুবাগে। প্রায় হাতিরঝিলে বাতাস খেতে আসি। এত ভালো লাগে বোঝাতে পারব না। তার সঙ্গে বাহারি ফুল তো রয়েছেই। অনেক ফুল চিনি না— কিন্তু ব্যাপারটা অসাম’, বলছিলেন হাতিরঝিলের বেঞ্চ বসা ইরাব নামের এক টগবগে যুবক। এখানকার প্রকৃতি যেন অগোচরে ইরাবের মতো অনেক তরুণ-যুবককে প্রকৃতিপ্রেমী ও ভাবুক বানিয়ে দিয়েছে।

নতুন শহর পূর্বাচলের সড়কে করবী/ছবি: নূর এ আলম


গ্রীষ্মের এই রূপ শুধু ঢাকার পর্যটন-হটস্পট হাতিরঝিলে নয়, প্রাচীন ও রমনীয় রমনা পার্ক, কলোনিয়াল আরবান নস্টালজিয়া মিন্টো রোড, আধুনিক এয়ারপোর্ট রোড, কুড়িল, স্থাপত্যকলার নান্দনিক সংসদ ভবন এলাকা ও ক্রিসেন্ট লেকসহ যেদিকে চোখ যায়- শুধু চোখে পড়ে ফুলের হাসি, রঙের খেলা। ইন্দ্রিয় স্পন্দিত হয় উদ্ভিদজাত গন্ধে ও সৌরভে।

কুড়িলে কৃষ্ণচূড়ার উচ্ছ্বাস/ছবি: নূর এ আলম


নগরীর সর্বাধুনিক সংযোজন মেট্রোরেলে বা এক্সপ্রেস ওয়ে থেকে বিস্তৃত রাজধানীর দিকে তাকালে সুবিশাল দালান-কোঠা আর সবুজের ফাঁকে মাথা চাড়া দিচ্ছে জারুল, কৃষ্ণচূড়া ও গ্রীষ্মকালীন গাছপালার উচ্ছ্বাস। কোথাও কোথাও ছাদবাগানের বিভা। ফুলে ফুলে রঙিন এসব দৃশ্য প্রাচ্যের রোমান্টিক নগরী ঢাকার প্রাচীন স্মৃতি মনে দোলা দেয়। ক্ষণিকের জন্য বর্ণিল ফুলে ছাওয়া এক অন্য ঢাকা হৃদয়ের অলিন্দে জায়গা করে নেয় সুভাষিত আবাহনে।

সবুজ পাতা ছাপিয়ে সোনালি রঙের ফুলে সেজেছে সোনালু গাছ/ছবি: নূর এ আলম


সংসদ ভবন এলাকা ও ক্রিসেন্ট লেকে গেলে তো মনে হবে সুনীল আকাশের পানে চেয়ে কৃষ্ণচূড়া বলছে- ‘কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে-/আমি ভুবন ভোলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে’। এখানে চোখে পড়ে লেকের দু’ধারে কৃষ্ণচূড়ার সুদৃশ্য বীথি-  ‘ডাক দিয়ে যায় পথের ধারের কৃষ্ণচূড়ায়।’ বাতাসে কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ঝরে রঙিন হয়ে ওঠা চলার পথ।

চন্দ্রিমা উদ্যান; গাছের পাতার সবুজ রঙ আজ যেন আরও গাঢ় হয়েছে


এমন মনোরম প্রকৃতিতে ক্রিসেন্ট লেকে গরম নিবারণে নেমে পড়েছে একদল ডানপিটে কিশোর। যারা কৈশারকাল উদযাপনে মেতেছে। 

পাশেই চন্দ্রিমা উদ্যান; গাছের পাতার সবুজ রঙ আজ যেন আরও গাঢ় হয়েছে। গত রাতে ঝরেছে বহু প্রতীক্ষার বৃষ্টি। দীর্ঘ তাপদাহে পোড়ার পর বৃষ্টির পরশ পেয়ে গাছগুলো যেন- প্রাণ পেয়েছে। চড়া রোদে স্নিগ্ধ হয়ে দেখাচ্ছে সবুজ পাতা। নেতিয়ে পড়া ফুল আড়মোড়া ভেঙে সুভাষ ছড়াচ্ছে। প্রাণবন্ত সবুজ পাতার ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছে হরেক রঙ ও রূপের ফুল।

কংক্রিটের নগরীতে কৃষ্ণচূড়ার স্পর্শ/ছবি: নূর এ আলম


‘শোনো বন্ধু শোনো,/ প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা/ ইটের পাঁজরে, লোহার কাটায়/দারুণ মর্মব্যথা।/এখানে আকাশ নেই,/এখানে বাতাস নেই,/ এখানে অন্ধ গলির নরকে/মুক্তির আকুলতা।/জীবনের ফুল মুকুলেই ঝরে...।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তার গানে নগরীকে তুলনা করেছেন ইটপাথরের প্রাণহীন গলি হিসেবে। যেখানে ব্যস্ততার ফাঁকে লুকিয়ে থাকে নানা কষ্ট। তবে এমন প্রাণহীন নগরীতে প্রশান্তির গান ধরেছে আগুন ঝরা কৃষ্ণচূড়া, সোনালু আর জারুল। সঙ্গে অফুরান শোভা ছড়িয়েছে ডুলি চাপা, বরুণ, নাগলিঙ্গম, মাধবীলতা ও কাঠগোলাপ। গরমে ওষ্ঠাগত জীবনে ঢাকার প্রকৃতির রূপ-রস মনে শান্তির সু-বাতাস বইয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে নগরীর ফুলের নৈসর্গিকতা উপভোগ করার সবচেয়ে ভালো সময় ছুটির দিন।

হাতিরঝিলের পথে দেখা মেলে কাঠগোলাপের


‘উষ্ণ তাপমাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবুজ ও মনোরম পরিবেশ তৈরির দিকে জোর দেওয়া প্রয়োজন’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন।

তিনি বলেন, ঢাকার প্রকৃতিকে মনোমুগ্ধকর করতে দেশি ফুলের গাছ দিয়ে সাজালে আরো ভালো হত। পরিকল্পিতভাবে ১০টি প্রধান অ্যাভিনিউকে ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো যেতে পারে। তাহলে শোভা বর্ধনের পাশাপাশি মানুষকে প্রশান্তি দিত- এই নগর।

সোনালুর ছায়া মাখানো পথ/ছবি: নূর এ আলম


মাঝে মাঝে এই ঢাকা, একদিন স্বপ্নের দিন হয়ে, ফুলের জলসার মুগ্ধতা দগ্ধ নাগরিক জীবনের সকল গ্লানি মুছে দিয়ে যায়।  

;

হারিয়ে যাওয়া বিয়ের আংটি খুঁজে পেলেন ৫৪ বছর পর!



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

৫৪ বছর পর হারিয়ে যাওয়া বিয়ের আংটি খুঁজে পেয়েছেন ম্যারিলিন বার্চ (৭৬)। তিনি যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের পন্টারডাউইর বাসিন্দা।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম স্কাই নিউজের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

ম্যারিলিন বার্চ স্কাই নিউজকে বলেন, এতো বছর পর আংটিটি খুঁজে পাওয়া সত্যিই অবাক করা বিষয়। ১৯৭০ সালে পারিবারিক খামারে গরুকে খড় খাওয়ানোর সময় আংটিটি হারিয়ে গিয়েছিল। পরে অনেক খোঁজার পরও না পেয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভেবে নিয়েছিলাম এটা আর কখনো পাবো না।

তবে শনাক্তবিদ কিথ ফিলিপসের মনে ছিল অন্য কিছু। তিনি খামারের লোকজনকে বিভিন্ন সময় সেখানকার ভূমি খননের পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। তাঁর হিসাবে, সেখানে মাটির নিচে অনেক মূল্যবান জিনিস থাকতে পারে।

সেখান থেকে পাওয়া বিভিন্ন মুদ্রা এবং বিটের টুকরা আমাদের দেখাতেন। কিন্তু আংটিটির খোঁজ মেলেনি। 

ম্যারিলিন বলেন, ‘এক সন্ধ্যায় ফিলিপস যখন খামার ত্যাগ করছিলেন, আমি তাঁকে ঠাট্টাচ্ছলে বলি, ফিলিপস শোনো, যেসব আবর্জনা তুমি উদ্ধার করেছ এসব ফেলো। যাও, আমার বিয়ের আংটিটি খুঁজে বের করতে পার কি না, দেখো।’

এ কথা শোনার পর তারা দুজনেই তখন হেসেছিল। তবে এক সপ্তাহ বা তারও কিছু সময় পরে ফিলিপস ম্যারিলিনের আংটিটি নিয়ে হাজির হন।

ম্যারিলিন বলেন, আংটিটিকে খামারের মাঠে মাটির প্রায় ৮ ইঞ্চি নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে সেটিকে তিনি ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করেছেন এবং তখন থেকেই তিনি এটিকে আঙ্গুল দিয়ে রেখেছেন।

মিসেস বার্চের স্বামী পিটার বার্চ গত জানুয়ারিতে ৮০ বছরে পা দিয়েছেন। সে উপলক্ষে অনুষ্ঠান করার কথা ছিল। কিন্তু এমন ঘটনার পর সব আয়োজন স্থগিত করা হয়েছে। এখন সবকিছু এই আংটিটি ঘিরেই হচ্ছে।

;