আমাদের প্রজাপতি



অধ্যাপক ড. আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ
মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে চাতুল (Monkey Puzzle) প্রজাপতি। ছবি- লেখক।

মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে চাতুল (Monkey Puzzle) প্রজাপতি। ছবি- লেখক।

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রজাপতির (Butterfly) মতো এতো সুন্দর পতঙ্গ এই ধরনীতে আর আছে কি? সম্ভবত নেই। কল্পনায় যত রঙ আঁকা যায়, তার সবগুলো রঙেরই প্রজাপতি থাকা সম্ভব। বাহারি কারুকাজযুক্ত রঙির ডানাওয়ালা পতঙ্গগুলোকে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ বাদে বিশ্বের প্রায় সবখানেই দেখা যায়। ছোট্ট বর্নিল নিরীহ পতঙ্গগুলোকে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। রঙিন এই পতঙ্গগুলো যখন নরম ডানায় ভর করে কারো পাশ দিয়ে ধীর গতিতে উড়ে যায় তখন মূগ্ধ দৃষ্টিতে না তাকিয়ে কি থাকা যায় না।

প্রজাপতি লেপিডপটেরা বর্গের সদস্য, গ্রীক ভাষায় যার অর্থ আঁশযুক্ত ডানাওয়ালা পতঙ্গ। প্রজাপতি ছাড়া এই বর্গে আরও রয়েছে মথ (Moth)। আর সেকারণেই মথ প্রজাপতির নিকটাত্মীয়। প্রজাপতির বিভিন্ন গোত্র বা পরিবারগুলোকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন- ১. সত্যিকারের প্রজাপতি (True Butterfly), ২. কাপ্তান (The Skipper) ও মথ-প্রজাপতি (Moth-Butterfly)। লেপিডপটেরার বাদবাকি পরিবারগুলোর সদস্যরাই হলো মথ। এ বর্গের ৮৯-৯৪%-ই মথ ও বাকি মাত্র ৬-১১% প্রজাপতি। প্রায় ২০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে ওদের উদ্ভব হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। বিশ্বব্যাপী ১৫-২০ হাজার প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৪৩০টি প্রজাতি তালিকাভুক্ত হলেও মোট প্রজাতি সংখ্যা পাঁচশ-এর বেশি হতে পারে। এদেশে বর্তমানে তিনটি প্রজাপতি পার্ক রয়েছে। প্রথমটি চট্রগ্রামের পতেঙ্গায়, দ্বিতীয়টি গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে ও তৃতীয়টি গাজীপুরের বাঘের বাজারে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্কের ভেতর।

পুরুষ চোরকাটা কমলা (Leopard Lacewing) প্রজাপতি। ছবি- লেখক

হাতির যেমন শুঁড় (proboscis) আছে প্রজাপতিরও তেমনি শুঁড় রয়েছে যা দিয়ে এরা ফুলের ভিতর থেকে নির্যাস বা রস (Nectar) বের করে আনে। পাপুয়া নিউ গিনির ‘রাণী আলেকজান্দ্রার বিহন’ বিশ্বের বৃহত্তম প্রজাপতি, যার প্রসারিত ডানা ২৫০ থেকে ২৮০ মিলিমিটার এবং উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকার ‘পশ্চিমা বামন নীল’ বিশ্বের ক্ষুদ্রতম প্রজাপতি (প্রসারিত ডানা ১০ মিলিমিটার)। ‘বেনুবিহন’ বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রজাপতি (প্রসারিত ডানা ১৪০ থেকে ১৯০ মিলিমিটার) ও ‘সলমা’ ক্ষুদ্রতম (প্রসারিত ডানা ২০ থেকে ২২ মিলিমিটার)। বিশ্বব্যাপী বহু সুন্দর সুন্দর প্রজাপতি ও মথ রয়েছে, যেমন- নীল প্রজাপতি, সচ্ছ প্রজাপতি, ৮৮ প্রজাপতি ইত্যাদি। এসব প্রজাপতি বা ওদের নিকটাত্বীয় কিছু প্রজাতি এদেশেও রয়েছে, যেমন- বেণুবিহন, শ্বেত ফড়িংলেজী, তিতিমৌরল, মরাপাতা ইত্যাদি। অন্যান্য সুন্দর প্রজাপতির মধ্যে রয়েছে গর্দাপেয়ারী, নিশি সিন্ধুপ, রতœচূড়, চোরকাটা কমলা, নীল শিখীপর্ণ, বিদুষক ইত্যাদি।

আমাদের প্রজাপতির মধ্যে সচরাচর যেগুলোকে দেশজুড়ে দেখা যায় তার মধ্যে উদয়াবল্লী, সাত ডোরা,  নীরদ সিন্ধু, মনমেঘা, কস্তুরী শার্দুল, নীল ডোরা, চোরকাটা কমলা, উষসী বায়স, নীল পুনম, অংশশুচপল, কমলা শিখীপর্ণ, ধূসর শিখীপর্ণ, বনবেদে, নাবিক, কৃষ্ণতরঙ্গ, গুণনকর বনপাল, কুম্ভীধনু, তৃণাঙ্গুরী, উষসী কপিল, ভোল ভ্রামরী, রাগ নকশী, হেমশুভ্র, চৈতালী দূত, তৃণ গোধুম, তৃণ বিদুষক, তিলাইয়া, কৃষ্ণতিলা, পঞ্চতিলা, তিন্নি, নীলবিজুড়ী, মলয় মশাল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দুলর্ভ ও বিরল প্রজাতির মধ্যে রয়েছে বেণুবিহন, কেশবতী, কাজল, চন্দ্রাবল্লী, হলদে খঞ্জর, শ্বেত ফড়িংলেজী, তিতিমৌরল, নীল বায়স, বনমালী, নীল শিখীপর্ণ, পালিপার্বন, দেতাবকী, নিশি সিন্ধুপ, একাঙ্ক গোধুম, বান্দর, ময়ূরী রেণূ, পীতরতœ, চাতুল, নীল খয়ের, আকাশচারী, ভাটুরে বউল, শিখা বউল, জলদ আকাশি, ছিটকুল, সূর্যচঞ্চল, স্বর্ণছরা, ছাযাকরণ ইত্যাদি। মহাবিপন্ন ও বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে স্বর্ণবিহন, সিঁদুরী পদ্মরাগ, চুমকি, সুন্দরী বায়স, শ্বেত শার্দুল, চিত্রল বায়স, সুন্দরী বনদেবী, বনবেণু, রত্মচূড়, উদয়ধনু, রক্তডানা, কৃষ্ণ অধিরাজা, কৃষ্ণ যুবরাজ, তালডিঙি, পিপুলকাঠি, উর্মিমালা, কুল মুকুল, ভাঁড় ইত্যাদি।  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাগ নকশী (Common Jezebel) প্রজাপতি। ছবি- লেখক। 

প্রজপাতি নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক সংস্কার বা কুসংস্কার রয়েছে। যেমন- কারো গায়ে প্রজাপতি বসাকে সৌভাগ্যের লক্ষণ বলে ধরে নেয়া হয়। এদেশে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক অবিবাহিত লোকের দেহে প্রজপাতি বসলে তার বিয়ের ফুল ফুটলো বলে ধরে নেয়া হয়। সাদা রঙের প্রজপতিকে কোথাও কোথাও সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করা হয়। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রজাপতি নিয়ে বহু পৌরাণিক কাহিনী বা কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। প্রাচীন গ্রীক ভাষায় Psyche (সাইকি) অর্থ হলো প্রজাপতি। Psyche-এর শাব্দিক অর্থ Soul বা আত্মা অথবা Mind বা মন। গ্রীকরা বিশ্বাস করে যে, প্রাতিটি মথ প্রজাপতি থেকে বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আত্মার জন্ম হয়। প্রজাপতি নিয়ে জাপানী মিথ হলো- যার ঘরে প্রজাপতি প্রবেশ করে, সবচেয়ে পছন্দের ব্যাক্তিটি তাকে দেখতে আসে। দু’টি প্রজাপতি একসঙ্গে উড়াকে চীনারা ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে দেখে। ফিলিপিনোরা মনে করে, কোন ঘরে যদি কালো প্রজাপতি প্রবেশ করে বা এর মথ আনা হয় বা জন্ম হয়, তবে ঐ পরিবারের কেউ মারা গেছে বা শীঘ্রই মারা যাবে। প্রাচীন ইউরোপিয়রা মনে করতো মানুষের আত্মা নেয়া হয় প্রজাপতির রূপে, তাই তারা প্রজাপতিকে খুবই শ্রদ্ধা ও ভয়ের সাথে দেখতো। আইরিশরা মনে করে, মৃত ব্যক্তিদের আত্মা স্বর্গে প্রবেশের আগ পর্যন্ত প্রজাপতি হযে থাকে। মেক্সিকোর কোন কোন আদিবাসী বিশ্বাস করে যে, প্রজাপতি হলো পৃতিবীর উর্বরতার প্রতীক। মায়া আদিবাসীরা মনে করে, মৃত যোদ্ধাদের আত্মা প্রজাপতির রূপ নিয়ে পৃথিবীতে বিরাজ করে। আসামের নাগাস অঞ্চলের লোকেদের বিশ্বাস এই যে, আত্মা পৃথিবীতে এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরিত হচ্ছে। এর সর্বশেষ ধাপে প্রজাপতি হয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই প্রজাপতির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আত্মার রূপান্তরও শেষ হয়।

মৌলভীবাজারের আদমপুর বিটে ভাঁড় (Harlequin) প্রজাপতি। ছবি- লেখক।   

প্রজাপতি দিনের বেলায় ফুল থেকে ফুলে ওড়ে বেড়ায় ও ফুলের রস পান করে। ফুলের পরাগায়ণে অর্থাৎ গাছের বংশবিস্তারে এরা বেশ সাহায্য করে। এদের পঞ্চেন্দ্রিয় উন্নত ধরনের। পূর্ণবয়ষ্ক প্রজাপতির মাথায় একজোড়া প্রায় গোলাকার যৌগিক চোখ বা পুঞ্জাক্ষি (Compound Eye) থাকে যা দিয়ে এরা চারদিক দেখতে পারে। প্রজাপতি পুঞ্জাক্ষির সাহায্যে ভিন্ন ভিন্ন রঙ ও বস্তু শণাক্ত করতে পারে। এদের লম্বা দেহটি তিনভাগে বিভক্ত, যেমন মাথা, বুক ও উদর বা পেট। উদর লম্বা বেলুনাকার যা দশটি খন্ডে বিভক্ত। সাধারণত দেহ এবং ডানার উপর ও নিচের দিকের রঙ এবং কারুকাজে ভিন্নতা থাকে। মাথার দু’পাশে একটি করে অ্যান্টেনাও রয়েছে। চোখ বাদে পুরো দেহ ছোট ছোট রোম ও চ্যাপ্টা আঁশে আবৃত থাকে। এদের ডানা চারটি ও পা তিন জোড়া।

ঠাণ্ডা মৌসুমে প্রজাপতি উড়তে পারে না। এদের স্বাভাবিক কাজকর্ম বা ওড়াউড়ি করার জন্য পরিবেশের তাপমাত্রা ২৮-২৯- সেলসিয়াস থাকা বাঞ্ছনীয়। এরা শীতল রক্তসম্পন্ন প্রাণী, তাই দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এজন্য পরিবেশের তাপমাত্রা এদের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পরিবেশের তাপমাত্রা যদি ১৩- ডিগ্রী সেলসিয়াসের কম থাকে তবে এরা নড়াচড়া করতে পারে না, এমনকি নিজেদের জন্য খাদ্য সংগ্রহেও যেতে পারে না। শীতে প্রজাপতিদের চলাফেরার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সূর্যের তাপের প্রয়োজন হয়। নতুন জন্ম নেয়া প্রজাপতি উড়তে পারে না। কারণ এদের পাখাগুলো দেহের সাথে লেগে থাকে। প্রজাপতির পুরো দেহ শুষ্ক হওয়ার জন্য কয়েক ঘন্টা সময় লাগে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাদামি শঙ্কু (Chestnut Angle) প্রজাপতি। ছবি- লেখক। 

প্রজাপতির জীবন চক্র চারটি পর্বে বিভক্ত। যথা- ১) ডিম, ২) শুককীট (বা শুঁয়াপোকা), ৩) মূককীট (বা কোকুন) ও ৩) পূর্ণাঙ্গ পতঙ্গ (বা ইমাগো)। এটিকে বলে সম্পূর্ণ রূপান্তর। প্রজাপতি ও মথের ধরনের উপর নির্ভর করে জীবন চক্রের দৈর্ঘ্য মাস থেকে বছরব্যাপী হতে পারে। জীবন চক্রের প্রথম পর্যায় হলো ডিম। ডিমের আকার ও আকৃতি ওদের ধরনের উপর নির্ভর করে। ডিম ছোট, গোলাকার, ডিম্বাকার বা নলাকার হয় ও কমবেশি সচ্ছ থাকে। স্ত্রী সচরাচর পছন্দনীয় উদ্ভিদ অর্থাৎ পোষক গাছের কচি পাতা, অঙ্কুর বা কাণ্ডে ডিম পাড়ে। বসন্ত ও গ্রীষ্ম ডিম পাড়ার উপযুক্ত মৌসুম, তবে অন্য সময়েও ডিম পাড়তে সক্ষম। স্ত্রী একসঙ্গে প্রচুর ডিম পাড়ে, তবে শেষ পর্যন্ত মাত্র কয়েকটি বেঁচে থাকে। জীবন চক্রের দ্বিতীয় পর্যায় হলো শুককীট। এটি দেখতে লম্বা পোকার মতো যার চোখ বয়ষ্কগুলোর মতো যৌগিক নয় বরং সরল। ডিম ফুটে বের হওয়ার পর প্রথমেই শুককীট ডিমের খোসাটি খেয়ে ফেলে। ওরা গাছের পাতা খেয়ে ও কয়েকবার (সচরাচর পাঁচবার) দেহের খোলস পাল্টে আকারে বড় হয় ও পরের ধাপে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। বেশিরভাগ শুককীটই গাছের ক্ষতি করে। অবশ্য কোনো কোনো প্রজাতি ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে কৃষকদের উপকারও করে। মূককীট হলো জীবন চক্রের তৃতীয় পর্যায়। এ পর্যায়ে শুককীট খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেহের চারিদিকে একটি খোলস সৃষ্টি করে এবং নিজেকে তার মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে। শক্ত খোলসের ভিতরে এটি দ্রুত পরিবর্তিত বা রূপান্তরিত হয়ে মূককীটে পরিণত হয়। এই রূপান্তরে, শুককীটের কলা, অঙ্গ, প্রতঙ্গ ইত্যাদি পরিবর্তিত হয়ে প্রজাপতিতে পরিণত হয়। এক সপ্তাহ থেকে কয়েকমাস, এমনকি বছর পর্যন্ত এটি সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। জীবন চক্রের চতুর্থ বা চূড়ান্ত পর্যায় হলো প্রাপ্তবয়স্ক ধাপ বা ইমাগো। মূককীটের ভিতরে রূপান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর উপযুক্ত সময় ও পরিবেশে সুপ্তিকালশেষে একদিন খোলস কেটে বেরিয়ে আসে প্রজাপতি। এ সময় তার দু’ডানাই ভেঁজা, নরম ও দেহের সঙ্গে ভাঁজ হয়ে থাকে। ডানা পুরোপুরি শুকানোর পর সে ওড়াউড়ি শুরু করে।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে উতলকুট (Great Mormon) প্রজাপতি। ছবি- লেখক। 

যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক প্রজাপতির মূল কাজ হলো বংশবিস্তার করা তাই সে সঙ্গী খোঁজে, মিলিত হয়, ডিম পাড়ে ও বংশবিস্তার করে। এই পর্যায়ে কিছু প্রজাপতি ফুল থেকে নির্যাস পান করে। অন্যরা গাছের রস, মল, ভিজা মাটির রস, পচনশীল ও মৃত প্রাণীজ পদার্থ এবং অন্যান্য জৈব পদার্থ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। প্রজাপতি মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাঁচে, কারণ ওদের জীবকাল গড়ে ৩-৪ সপ্তাহ। তবে, পরিযায়ী প্রকৃতিরগুলো বছরখানেকও বাঁচতে পারে। প্রজাপতিরা সাতটি গোত্রে বিভক্ত। তবে এদেশে হেডিলিডি গোত্রের কোনো প্রজাপতি না থাকায় বাংলাদেশের প্রজাপতিগুলোকে ছয়টি গোত্রেই দেখানো হয়, যেমন- ১) প্যাপিলিওনিডি বা সোয়ালোলেজী প্রজাপতি (উদাহরন- উতলকূট, অভ্রকূট), ২) নিম্ফালিডি বা চারপেয়ে প্রজাপতি (চোরকাটা কমলা, কস্তুরী শার্দুল), ৩) পিয়েরিডি বা সাদা ও হলুদ প্রজাপতি (রাগ নকশী, শুদ্ধ হরিদ্রা), ৪) লাইকিনিডি বা নীল প্রজাপতি (জলদ আকাশী, চাতুল), ৫) রিওডিনিডি বা ধাতবচিহ্নযুক্ত প্রজাপতি (ভাঁড়, বিদুষক) ও হেস্পারিডি বা অধিনায়ক (বাদামি শঙ্কু, শিকনদেও) প্রজাপতি। কোনো কোনো পুরনো শ্রেণিবিন্যাসে কিছু অতিরিক্ত গোত্র, যেমন- ড্যানাইডি, হেলিকোনিডি, লিবিথিইডি, স্যাটিরিডি, অ্যাকারিইডি, অ্যামাসথুসিইডি ইত্যাদিকে স্বীকৃতি দিলেও আধুনিক শ্রেণিবিন্যাসে এগুলোকে নিম্ফালিডি গোত্রের অর্ন্তগত উপগোত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

প্রজাপতি দেখতে বেশ সুন্দর ও বর্নিল হলেও শুককীটগুলো অনেক ক্ষেত্রেই তেমন একটা সুন্দর হয় না। তাছাড়া এরা গাছের বেশ ক্ষতি করে। অবশ্য কোন কোন প্রজাতির শুককীট ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে কৃষকদের বেশ উপকারও করে। আবার শূককীট বা শুয়াপোকা অনেক পাখির কাছেই অত্যন্ত প্রিয় খাবার। কাজেই অনেক প্রজাতির পাখিও প্রজাপতির ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। গাছের বৈচিত্র্য তৈরিতে প্রজাপতি ভূমিকা রাখে।

প্রকৃতির সুন্দর সৃষ্টিগুলোর মধ্যে ফুল, পাখি ও প্রজাপতি অন্যতম। সুন্দর এই প্রজাপতিগুলো দেখে আমরা মুগ্ধ হই। কিন্তু এদের প্রতি আমরা মোটেও সচেতন নই। আামদের দেশের শিশু-কিশোর এমনকি বড়রাও সঠিকভাবে প্রজাপতি চিনে না। এদের উপকারিতা সম্পর্কেও বিশেষ কিছু জানে না। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় উদ্ভিদ ও প্রাণী-পাখির মতো প্রজাপতিরও যে ভূমিকা রয়েছে তা অনেকেরই জানা নেই। প্রজাপতি পরিবেশের সুস্থতার নির্নায়ক। এদেশে বর্তমানে কয় প্রজাতির প্রজাপতি বিলুপ্তির দোড়গোড়ায় ও কয়টি ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে তার কোন সঠিক হিসাব নেই। কাজেই এ বিষয়ে জ্ঞানার্জন করা প্রয়োজন। তবে আমাদের প্রাকৃতিক গাছগুলোকে সংরক্ষণ করে প্রজাপতিকে রক্ষা করা সম্ভব। কেননা কিছু কিছু গাছ রয়েছে যার ওপর প্রজাপতিরা সরাসরি নির্ভরশীল। তবে কিছু কিছু প্রজাতি মারাত্মকভাবে হুমকীর সম্মূখীন রয়েছে। কাজেই এদের রক্ষা করার ব্যাপারে এখনই সচেতন না হলে এদেরকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না।

কেশবতী (Common Batwing) প্রজাপতির পাশে লেখক

 E-mail:[email protected], [email protected]

   

সাংবাদিকের ফেসবুকে পোস্ট: মিললো আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর, ইজিবাইক



রাকিবুল ইসলাম রাকিব, বার্তা২৪.কম, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) করেসপন্ডেন্ট
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

৭৭ বছরের বৃদ্ধ হাবিবুর রহমানের স্ট্রোক হয়েছে একাধিকবার। এই বয়সে যখন তার বিছানায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম করার কথা, তখন তাকে একটি রিকশার প্যাডেল মেরে অবিরাম ছুটে চলতে হয় ঢাকার রাস্তা-ঘাটে।

দিন শেষে যা আয় হয়, তার একটা অংশ নিজের জন্য রেখে, বাকিটা পাঠাতেন গ্রামে থাকা বৃদ্ধ স্ত্রীর কাছে। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে এভাবেই চলছিল তার দিনকাল।

হাবিবুরের ইচ্ছে ছিল, শেষ বয়সের সময়টা তিনি শহর ছেড়ে গ্রামে থাকা স্ত্রীর সঙ্গে কাটাবেন। কিন্ত সেখানে থাকার মতো ঘর ও জীবিকার নিশ্চয়তা না থাকায় বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতে হতো তাকে।

হাবিবুরের দুরবস্থার খবর জানার পর সে বিষয়ে ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিক জ. ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন।

সে পোস্টটি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের দৃষ্টিগোচর হয়। এরপর তার উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর উপহারের সুখবর পান হাবিবুর। পাশাপাশি হাবিবুরের কর্মসংস্থানের জন্য ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী তাকে একটি ইজিবাইক উপহার দেন।

এতে করে গ্রামের ফেরার ইচ্ছা ও গ্রামেই কর্মসংস্থানের সুযোগ মিলেছে এই অসহায় বৃদ্ধের।

হাবিবুর রহমানের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের সহনাটি ইউনিয়নে সোনাকান্দি গ্রামে।

বৃহস্পতিবার (২ মে) বিকেলে গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে জেলা প্রশাসকের দেওয়া উপহারের ইজিবাইকের চাবি হাবিবুর রহমানের হাতে তুলে দেন। পাশাপাশি সোনাকান্দি গ্রামে এই বৃদ্ধের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, বাবার মৃত্যুর পর জীবিকার তাগিদে ১৯৬৯ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন হাবিবুর রহমান। সংসারে তার স্ত্রী ও চার মেয়ে রয়েছে। মেয়েদের সবাই গরিব ঘরে বিয়ে হওয়ায় বাবাকে দেখার সামর্থ্য নেই তাদের। স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানে মাত্র আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া আর কিছু নেই হাবিবুর রহমানের। সে কারণে বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতেন তিনি। ঢাকায় মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় রাত্রিযাপন করতেন রাস্তায় রাস্তায়।

এদিকে, রিকশাচালক হাবিবুর রহমানের দুরবস্থা নিয়ে গত ২৫ এপ্রিল সাংবাদিক জ.ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। পোস্টটি নজরে আসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের। এরপরই নির্দেশনা আসে হাবিবুরকে তার এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার।

ওপর থেকে নির্দেশনা আসার পর গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ সোনাকান্দি গ্রামে গিয়ে হাবিবুর রহমানের বাড়ি পরিদর্শনে করে দেখেন, তার মাত্র আধা শতাংশ জমি রয়েছে। এটুকু জমিতে ঘর নির্মাণ করা সম্ভব না হওয়ায় বিপত্তি বাধে। এ সময় হাবিবুর রহমানের জমির পাশেই দুই শতাংশ জমি দানের ঘোষণা দেন সহনাটি ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. দুলাল আহমেদ। ইতোমধ্যে, জমির দলিল সম্পাদন হয়ে গেছে। শিগগিরই ঘরের নির্মাণ কাজ শুরু হবে।

হাবিবুর রহমান বলেন, সারাজীবন কষ্ট করেছি। আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া নিজের আর কিছুই ছিল না আমার। সাংবাদিক মামুন ভাইয়ের লেখালেখির কল্যাণে এখন বাড়ি ও একটি ইজিবাইক হয়েছে। এখন স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আমার দিন ‘রাজার হালে’ কাটবে। আমি অনেক আনন্দিত ও খুশি। সেইসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাসহ যারা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ বলেন, বৃদ্ধ বয়সে হাবিবুর রহমানের রিকশা চালানো নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক জ.ই. মামুনের একটি পোস্ট প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মহোদয়ের দৃষ্টিগোচর হয়। তার প্রেক্ষাপটে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে হাবিবুরকে নিজ গ্রামে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তার কর্মসংস্থানের জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয় একটি ইজিবাইক উপহার দিয়েছেন। এছাড়াও হাবিবুর ও তার স্ত্রীকে বয়স্ক ভাতা দেওয়ারও উদ্যোগ নে্ওয়া হয়েছে।

 

;

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম: রসে সেরা, স্বাদে সেরা!



আরিফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, টাঙ্গাইল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

চমচমের কথা শুনলে কার না জিভে জল আসে! তারপরে যদি হয় সেই টাঙ্গাইলের চমচম! তাহলে তো কথাই নেই! ছোট-বড় সব বয়েসি মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকে- টাঙ্গাইলের চমচম।

কথায় আছে, ‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের কথা তো সবারই জানা। কেবল নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও এই মিষ্টি সেরাদের সেরা। ঐতিহ্য আর বাংলার লোক-সংস্কৃতির ইতিহাসের উত্তরাধিকার টাঙ্গাইল জেলা। জানা যায়, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আনুমানিক প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস।

ইতিহাস বলছে, দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী সদর উপজেলার পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি যমুনার পানি ও গরুর দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। পরে সেখানেই মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে পোড়াবাড়িতে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। এখন পোড়াবাড়ির সে জৌলুস আর নেই।

বর্তমানে ‘টাঙ্গাইল মিষ্টিপট্টি’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া শহরের পাচঁআনি বাজরের মিষ্টির দোকানগুলোতেও চমচম তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। এখানকার প্রতিটি মিষ্টির দোকানেই এখন নির্ভেজাল পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চম চম, স্বাদে সেরা, মানে সেরা, ছবি-বার্তা২৪.কম

এই পাঁচআনি বাজারে প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানেই এখন গড়ে উঠেছে, চমচমের দোকান। চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া বলে রঙটা তার গাঢ় বাদামি। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পোড়া ইটের মতো। বাইরেটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ একেবারে নরম আর রসে টইটম্বুর। লালচে গোলাপি আভাযুক্ত ভেতরের নরম অংশের প্রতিটি কোষ কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা এ মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়। সুস্বাদু চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা।

বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বড় বড় মিষ্টির দোকানগুলোতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে ১০ মণ চমচম তৈরি হয়। বর্তমানে মিষ্টি শিল্পে টাঙ্গাইলের ঘোষ ও পাল সম্প্রদায় বংশানুক্রমিকভাবে নিয়োজিত আছে। তবে দে, নাগ ইত্যাদি উপাধিধারী অনেকেও মিষ্টান্ন তৈরিতে নিয়োজিত হয়েছেন।

টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভৌগলিক নিদের্শক ইউনিট ভৌগলিক নিদের্শক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন-২০১৩ অনুয়ায়ী, চলতি বছরের (৯ জানুয়ারি) টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমকে জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি চমচম ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিন দেখা যায়, এই সুস্বাদু চমচম তৈরির কাজে জড়িত শত শত কারিগর কাজ করছেন। আগুনের তাপে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে জ্বাল হচ্ছে চমচমের। নিজেদের তৈরি চমচম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় কারিগররাও খুশি।

বর্তমানে চমচম বিক্রি হচ্ছে, মান ভেদে তিনশ থেকে চারশ টাকা কেজি দরে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকজন ছুটে আসেন মিষ্টির দোকানগুলোতে ঐতিহ্যবাহী চমচমের স্বাদ নিতে।

মিষ্টি কিনতে আসা সাগর বার্তা২৪.কমকে বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি আমাদের ঐতিহ্য ও আমাদের গর্বের। টাঙ্গাইলের পাঁচআনি বাজারে আসলে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যাই। ছোট বড় সবাই টাঙ্গাইলের মিষ্টি পছন্দ করেন।

মিষ্টি কিনতে আসা আরেকজন হরিপদ সরকার বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম শুধু দেশেই নয়, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। আমি যেমন টাঙ্গাইলের মিষ্টির জন্য এসেছি, আমার মতো অনেকেই টাঙ্গাইলের মিষ্টি নিতে এসেছেন। এই মিষ্টির স্বাদ অন্যরকম! না-খেলে বোঝা যাবে না।

মিষ্টি ব্যবসায়ী গৌরাঙ্গ কর্মকার বলেন, আমাদের টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য পোড়াবাড়ির চমচম। প্রায় দুইশ বছর আগে থেকেই টাঙ্গাইলে পোড়াবাড়ির মিষ্টি তৈরি হয়ে থাকে। টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম দেশ ও দেশের বাইরে রয়েছে। আমাদের পোড়াবাড়ির চমচমে ভেজাল কোনো কিছু যুক্ত করা হয় না। চমচম স্বাদ হওয়ার কারণ খাঁটি দুধ, ছানা ও ময়দা দিয়ে পোড়াবাড়ির চমচম তৈরি করা হয়। এজন্য এত স্বাদ! প্রতিদিন দোকানগুলিতে ৫ থেকে ১০ মণ মিষ্টি তৈরি করা হয়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম তৈরিতে ব্যস্ত কারিগরেরা, ছবি- বার্তা২৪.কম 

মিষ্টি ব্যবসায়ী কালাচাঁদ বলেন, আমি ৪০-৪৫ বছর ধরে মিষ্টি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। মিষ্টির স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের সুনাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের মিষ্টি দেশের বাইরে পাঠাতে পারবো। আমাদের মিষ্টি চাহিদা আরো বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে আমাদের আগ্রহও বেড়ে যাবে।

সরকারের কাছে দাবি, বিদেশে এই মিষ্টি রফতানি করার ব্যবস্থা করলে আমাদের বিক্রি আরোও বাড়বে। তখন আমরা আরো বেশি বেশি মিষ্টি তৈরি করতে পারবো।

টাঙ্গাইল জেলা রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, সারাদেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা মিষ্টি ব্যবসায়ীরা অনেক খুশি। এই মিষ্টি যদি বিদেশে রফতানি করা যায়, তাহলে আমাদের ব্যবসা আরো প্রসার পাবে।

তিনি বলেন, আমার বাবা মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। বাবার হাত ধরেই মিষ্টির ব্যবসায় আসা। আমি করছি। আমার ছেলেও এই পেশায় আছে। পোড়াবাড়ির চমচমের ইতিহাস প্রায় দুইশ বছরের। টাঙ্গাইলের চমচম সুস্বাদু হওয়ার একটা কারণ হচ্ছে, গাভির দুধ চরাঞ্চল থেকে আসে। এখানকার দুধ অনেক ভালো হয় আর জলেরও একটা বিষয় আছে! দুধ, জল ও কারিগরের সমন্বয়েই এই মিষ্টির স্বাদ হয় অন্যরকম। মিষ্টিগুলো খুবই প্রাকৃতিক। এই মিষ্টি তৈরিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না।

;

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃষি কাজে ও কলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তি ছোঁয়া বিভিন্ন সেক্টরে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। তবে পরিবর্তন হয়নি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানে। বরং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে কমছে তাদের কাজের সংকুলান। কমেছে আয়-রোজগারও।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বালি ও কয়লা ভিত্তিক ব্যবসা। এক সময়ের জনপ্রিয় ও বহু লোকের কর্মসংস্থানের এই ব্যবসাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বালু লোডিং-আনলোডিং-এ যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজ হারিয়েছেন শ্রমিক। ফলে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের কদর; প্রসার ঘটেছে উন্নত যন্ত্রাংশের।

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হান্নান। দীর্ঘদিন ধরে গাবতলীতে বালু ও কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। হান্নান জানালেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তার উপার্জনের প্রভাব ফেলেছে।

যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় বেড়েছে শ্রমিকের কদ/ছবি: নূর এ আলম


এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগে ভালই ইনকাম হতো। এখন আর সেরকম ইনকাম হয় না। আগে এতো মেশিন ছিলো না সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।’

তিনি আরও যোগ করেন, তাছাড়া আগে শ্রমিক কম ছিল। তখন মেশিনও ছিলো না। শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো। কিন্তু এখন শ্রমিক বেশি, মেশিনও এসেছে। এক মেশিনে অনেক কাজ হয়; তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।

‘আগে দৈনিক দিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা ইনকাম করতে পারতাম। আর এখন সারাদিন কষ্ট করে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৬০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোন কোনদিন এর থেকে কমও ইনকাম হয়।’- বলেন এই শ্রমিক।

পাবনার বেড়ার কামরুজ্জামান ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন। টানা ১৬ বছর ধরে গাবতলী বালু ও কয়লার ঘাটে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

কঠোর পরিশ্রমের পর দিনশেষে যে মজুরি পান তা দিয়ে কোন রকমে চলে তাদের সংসার/ছবি: নূর এ আলম

‘এক একটা টালি মেরে ২ টাকা ৪ আনা হিসেবে টাকা পাই। এখন যন্ত্র আসাতে লেবারের কোন কাজ কাম নেই। সব মাল এখন মেশিনে ওঠায়। এজন্য লেবারের কাজ কমে গেছে। টালির এখন আর রেট নেই। কাজ না করেও উপায় নেই কি করবো? ঢাকা শহরে আছি কাম না করলে চলবো ক্যামনে।’- বলেন কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, এখন দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো। কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়। হবে না আগে যেখানে একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ফেলে।’

মেহনতি এই মানুষটার কাছে শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা, না করলে কোন টাকা নাই। এই জন্য আমাগো কোন ছুটির দিনও নেই। কাম করাই লাগে। এমনও মানুষ আছে ঘুম থেকে উঠে ভোরে কামে আসে। কাম না করলে সংসারই চলে না।

মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে শ্রমিকরা/ছবি: নূর এ আলম


তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে নাজমা বেগম। তার ও স্বামীর উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে নাজমার।

এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই গরমে কাজ করা যায় না। সারাদিন কাজ করলেও খুব বেশি ইনকাম হয় না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে। এই ইনকামের টাকায় পরিবার চালানো অনেক কষ্টের। তাই আপনাগো ভাই সারাদিন রিকশা চালায় আর আমি এই কয়লা-বালি টানার কাজ করি।’

আগের মতো আয় নেই জানিয়ে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘আগেতো ভালই ইনকাম করতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন বেশিরভাগ মালিক মেশিন দিয়ে মালামাল নামায় তাই আমাদের লাগে না। আর সেভাবে ইনকামও হয় না। এখন কোন দিন ৩০০ টাকা, কোন দিন ৪০০ টাকা ইনকাম করি।’

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বার্তা২৪.কম বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, সে হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়েনি। সব সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী বেতন-ভাতা না দিলে শ্রমিক বাঁচবে না। বিশেষ করে দিনমজুরদের অবস্থা করুণ। তাদের শ্রমের দামের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবে না।’

;

দাবদাহে দিনমজুররা বঞ্চিত শ্রম অধিকার থেকে

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



সাদিকুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকার আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনের কাছে তুরাগ নদীর তীরে নোঙর করা বালু‌ বহনকারী চারটি লোহার তৈরি বাল্কহেড মধ্যাহ্নের প্রখর রোদে উত্তপ্ত হয়ে আছে। এগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে প্রায় ১০০ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক দলবেঁধে মাথায় করে প্রত্যেকে প্রায় ২৫ কেজি ওজনের ভেজা বালু বাঁশের তৈরি টুকরিতে বহন করে নিয়ে নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে ফেলছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এত পরিশ্রম করেও তাদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি।

“অতিরিক্ত গরমে আমাদের ঘাম বাষ্প হয়ে গেছে,” বলেন ৫৮ বছর বয়সী আব্দুল খালেক। তিনি দুই দশক আগে নেত্রকোনা জেলা থেকে ঢাকায় এসে দিনমজুর হয়েছিলেন।

প্রখর রোদে পরিশ্রম করেও শ্রমিকদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি/ছবি: নূর এ আলম


গরমে হাঁপিয়ে ওঠা শ্রমিকরা কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ কেউ নিকটস্থ এক মসজিদ থেকে আনা বোতলে ভরা পানি‌তে চুমুক দিচ্ছেন।

গত কয়েক বছরের মতো, ২০২৪ এর গ্রীষ্মকাল এমন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা তাপপ্রবাহ মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু বেশিদিন কর্মহীন হয়ে বাড়িতে বসেও থাকতে পারছেন না। তারা যে বালু খালাস করেন, তার বাজারমূল্য বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি‌। এমনকি অপ্রাতিষ্ঠানিক দিনমজুর হওয়ায় তাদের কোন শ্রম অধিকারও নেই।

“ঈদের ছুটি শেষে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহেই বেশির ভাগ কর্মচারী ঢাকায় ফিরেছেন। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে সোমবার (২৯ এপ্রিল) সকালে আমিন বাজারে বালু খালাস শুরু হয়। গরম আবহাওয়ার মধ্যে শ্রমিকরা আসেনি,” বললেন শ্রমিকদের সর্দার (আসলে বালুর ঠিকাদারের ম্যানেজার) মশিউর রহমান।

গ্রীষ্মকাল যেন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে/ছবি: নূর এ আলম


সাধারণত এক বাল্কহেড থেকে সাড়ে নয়শো স্কয়ার ফুট বালু নামাতে ১৫০ জন শ্রমিক দুই দিন সময় নেন, অথচ মশিউর পেয়েছেন প্রয়োজনের এক- চতুর্থাংশ লোকবল।

মশিউরের কথায় মনে পড়ল আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার বার্তা। গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ ৭ বিলিয়ন কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। চরম তাপপ্রবাহে মানুষের, বিশেষ করে যারা দিনের বেলায় খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন, তাদের কাজের ক্ষমতা কমে যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টার ২.২ শতাংশ বা ৮০ মিলিয়ন নিয়মিত চাকরি ফুরিয়ে যাবে‌ শুধুমাত্র বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে।

এক নারী শ্রমিক মাথায় করে ভেজা বালু বাঁশের টুকরিতে করে  নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে নিচ্ছেন/ছবি: নূর এ আলম


ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ চরম তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে এমনিতেই এখানকার তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বেশি থাকে।‌ এরপর যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ে তবে অবধারিত ভাবে তাপপ্রবাহ সংক্রান্ত ক্ষতিকর প্রভাব বাড়বে।

২০১৯ সালে আইএলও জানিয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে তাপপ্রবাহে বাংলাদেশ মোট কর্মঘণ্টার ৪.৮৪ শতাংশ হারাবে।

কম মজুরির কর্মই যাদের নিয়তি

জামালপুর থেকে আসা চল্লিশ বছর বয়সী নার্গিস বেগম ১২ বছর আগে আমিন বাজারে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে সময় তাকে ১০ টুকরি বালু খালাসের জন্য ১০ টাকা দেওয়া হত। বর্তমানে সাত টুকরি বালু খালাসের জন্য তিনি একই পরিমাণ মজুরি পেয়ে থাকেন। ১২ বছরে এই পার্থক্য খুবই নগণ্য। অন্যদিকে বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ।

“এক ট্রাক ভর্তি সাদা বালুর (নদী খননে প্রাপ্ত পলি) দাম ছিল ২ হাজার টাকা, যা এখন ৫ হাজার টাকা। গত ১০ বছরে সিলেটের লাল বালুর দাম ৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার টাকা হয়েছে,” বলেন শ্রমিক সর্দার মশিউর।

বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ, তবে শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি/ছবি: নূর এ আলম


তাহলে শ্রমিকদের মজুরি কেন বাড়েনি, তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বালুর বাজার এখন অনেক। অনেক ব্যবসায়ী এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। ফলে আমিন বাজারের মহাজনদের (যারা শ্রমিকদের মজুরি দেন) আয় কমে গেছে। যদি তারা ভাল উপার্জন করত তবে শ্রমিকদের ভাল মজুরি দেওয়া হত”; মশিউর তার মহাজনের পক্ষ নিলেন।

লোডিং-আনলোডিং সেক্টরে যান্ত্রিকীকরণেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। এমনকি অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।

আমরা যখন শ্রমিকদের সাথে কথা বলছিলাম, তখন আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনে অন্তত পাঁচটি বেসরকারি ক্রেন দেখা গেছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল দুই।

“একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক পাঁচ ঘণ্টায় একই কাজ করতে পারে”; শ্রমিক খালেক ব্যাখ্যা দিলেন যন্ত্রায়ন কীভাবে তাদের জীবিকার উপর প্রভাব ফেলছে।

অসহনীয় আবহাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, খালেকের মতো শ্রমিকরা শুধুমাত্র তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন।

তুরাগের তীরে কয়লার স্তুপ/ছবি: নূর এ আলম


খালেকের স্ত্রী একজন ঠিকা গৃহকর্মী এবং একমাত্র ছেলে মোসলেম উদ্দিন একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু তাদের মজুরি পারিবারিক চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।

শ্রমনীতি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে বেশ কিছু পরিকল্পনা এবং নীতি আছে, যেমন জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নীতি, যেগুলো শ্রমিকের স্বাস্থ্য রক্ষার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল। বিশেষ করে, ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন এ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে স্বীকৃতি দেয়া আছে। কারণ, তাপপ্রবাহে মৃত্যুহার বৃদ্ধি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে শ্রমিকরা যাতে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতে কী করতে হবে তা পরিষ্কার নয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক কোহিনুর মাহমুদ বলেন, দিনমজুরদের নিয়োগকর্তাদের উচিত তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা, যাতে তারা তাপপ্রবাহের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারেন।

"দুর্ভাগ্যবশত, নিয়োগকর্তাদের ওপর কোন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, বালু খালাসিদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কোন শ্রম অধিকার নেই”, কোহিনুর বলেন।

তিনি শ্রমিকদের নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।

;