কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৬)



জিনি লকারবি ।। অনুবাদ: আলম খোরশেদ
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

অই তো যায়, টু আ পেনি

[পূর্ব প্রকাশের পর] আমাদের পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, আমরা উদ্বিগ্ন পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে চিঠি পেতে শুরু করি। তার সব ক’টার সুরই এক। “তোমরা নিশ্চয়ই দেশ ছাড়তে পেরে খুব খুশি! তা তোমাদেরকে কবে নাগাদ আমরা আমেরিকায় আশা করতে পারি?”

কিন্তু আমাদের কারুরই আমেরিকার দিকে যাত্রা করার বাসনা ছিল না। আমরা এমনিতেই পূর্ব পাকিস্তান ছাড়তে চাইনি, আর আমাদের মধ্যে যাদের পুনঃপ্রবেশের ভিসা ছিল না, তারা আর কোনোদিন ফিরতে না পারার আতঙ্কে ছিল। আমরা জানি প্রভুই আমাদেরকে বাইরে নিয়ে এসেছেন, যদিও আমরা বুঝিনি এর পেছনে তাঁর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আমরা শুধু এটুকু জানি, আমরা সবাই ফিরতে চাই, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

যুদ্ধবিদীর্ণ দেশটিতে আমরা আমাদের বাড়িঘর, জিনিসপত্র, বন্ধুবান্ধব এবং আমাদের হৃদয়খানি ফেলে এসেছিলাম।

আমরা মেয়েরা যখন কেনাকাটায় আর বাচ্চাদের ফুর্তিতে রাখার প্রচেষ্টায় আনন্দেই ছিলাম, পুরুষেরা তখন আমাদেরকে ব্যাংককের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত ছিল। পরিস্থিতির জটিলতা ছিল বহুমাত্রিক। তিনটি পরিবারের কিশোরবয়সী বাচ্চারা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের মারিতে। আমরা ব্যাংককে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই, আমাদের দলের যারা পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল তাদের কাছ থেকে এরকম চিঠি পেতে শুরু করি যে, কিছু বাচ্চা খুবই আতঙ্কিত হয়ে আছে এবং তারা তাদের বাবামাকে পাশে চাইছিল। যাদের কোনো বাচ্চা ছিল না সেখানে, তাঁরা একগাদা পয়সা খরচ করে সেখানে গিয়ে বেকার বসে থেকে, পূর্ব পাকিস্তানে ফেরার অনুমতি পাবার প্রত্যাশায় দিন গোনার সম্ভাবনায় খুব একটা প্রীত ছিলেন না।

যদিও আমাদের পাকিস্তানে ফিরে যাবার একমাত্র সম্ভাবনা, যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী দেশত্যাগীদের একসঙ্গে দলবেঁধে থাকার মধ্যেই নিহিত ছিল। আমাদের যুক্তি ছিল, যেহেতু তারা আমাদের দেশ ছাড়ার জন্য উৎসাহিত করেছিল, সেহেতু নিশ্চয়ই তারাই আমাদেরকে আবার ফিরিয়ে নিতে সাহায্য করবে। তবে এটা তত সহজ ছিল না। আমেরিকার সরকার যতটা করার করছিল, কিন্তু পাকিস্তান সরকার আমাদেরকে সাহায্য করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না। আমরা তাদের সেই মিথ্যে বুদ্বুদখানি ফাটিয়ে দিয়েছিলাম, “পূর্ব পাকিস্তানে সব স্বাভাবিক রয়েছে।”  যদি সব স্বাভাবিকই থাকত, তাহলে মার্কিন সরকার কেন সবাইকে বিশেষভাবে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিল?

এই সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয় এই তথ্যটুকুও যে, আমাদের অর্ধেকেরও বেশির ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। এমনকি স্বাভাবিক অবস্থাতেও আমাদের ফিরতে অসুবিধা হবার কথা।

শহরে আমাদের ঘোরাঘুরির সময় আমরা প্রায়ই পাকিস্তান দূতাবাসের পাশ দিয়ে যেতাম। প্রতিবারই তার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মেল বিল্‌স প্রাণভরে একবার বলে উঠতেন, “জয় বাংলা”। তাঁর স্ত্রী মার্গি, এটা শত্রুর কানে গিয়ে পৌঁছানর ভয়ে এবং তা আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে ভেবে তার স্বামীকে তা বলা থেকে বিরত রাখতে চাইছিল।

“ঠিক আছে,” তিনি রাজি হন। “আমি চুপ থাকব, ভেতরে কিন্তু ঠিকই এটা উচ্চারণ করব।”

জে ওয়াল্‌শ ও মেল বিল্‌স মার্কিন দূতাবাস আর পাকিস্তান দূতাবাসের মধ্যে ছোটাছুটি করছিলেন কেবল। পরেরটাতে প্রভু আমাদের পক্ষে ছিলেন। যার দায়িত্ব ছিল এই অনুমতিপত্র প্রস্তুতের, তিনি ঢাকার মানুষ ছিলেন বলে। জে একটু হালকা বোধ করায় তাঁর সঙ্গে বাংলায় কথাবার্তা শুরু করেন। বাঙালি অফিসারের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং তিনি গলা নিচু করে গোপনে তাঁর কাছে দেশের অবস্থা জানতে চান। এরপর থেকে তিনি তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন আমাদের সাহায্য করতে, যদিও তাঁর শ্রেষ্ঠটাও আমাদের জন্য যথেষ্ট ছিল না। চূড়ান্ত অনুমোদন আসবে ইসলামাবাদের কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তর থেকে।

আমেরিকান পর্যটকেরা থাইল্যান্ডে মাত্র পনেরোদিন থাকতে পারত। তারপর তাদেরকে দেশ ছেড়ে আবার নতুনভাবে অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হতো। আমাদের পনেরোদিন অতিবাহিত হবার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিই আমরা পেনাং দ্বীপে একটা ছোটখাটো ছুটি কাটাব। আমরা যখন বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য বাসে উঠছিলাম তখন সেখানকার এক কর্মচারী জে-কে বার্তা পাঠান। এই বার্তা আমাদের আনন্দময় ভ্রমণের অনুকূল ছিল না। মার্কিন সরকার এইমাত্র তাদের ইসলামাবাদের পাল্টাপক্ষের কাছ থেকে একটা টেলেক্স পেয়েছেন এই নির্দেশসহ যে, আমরা যেন পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবেশের চেষ্টাও না করি। সেই অংশ থেকেও মিশনারিদের বার করে দেওয়া হচ্ছিল।

তখন প্রভু ছাড়া আর কোনো গতি ছিল না আমাদের। আমাদেরকে অ্যাসেম্বলি অভ গড মিশনারিদের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হলো, যারা বলতেন, “যখন তোমাদের মনে হয় যে, প্রভু ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার নেই, তার অর্থ হচ্ছে খাবার ছাড়া আর কিছু খাওয়ার নেই তোমাদের।”

আমরা ঈশ্বরের কাছেই গিয়েছিলাম। আমাদের ব্যক্তিগত এবং দলীয় প্রর্থনাগুলোতে আগের মতো আর বলছিলাম না, “প্রভু আমাদেরকে ফিরিয়ে আনুন,” বরং অনুরোধ করছিলাম, “প্রভু আমাদেরকে বলে দিন আপনি কী চান, আমরা তা-ই করব।”

জে যাদের সঙ্গে ছিলেন তারা আমাদের যাওয়ার কয়েকদিন আগে ব্যাংকক ফিরে গেল। তিনি সবে ফিরেছেন, অমনি পাকিস্তানি দূতাবাস তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে বার্তাটা দেখালেন, “এই মানুষগুলোকে পাকিস্তানে ঢোকার ব্যাপারে যা করার করুন।”

জে গোটা ব্যাপারটা দ্রুতই আন্দাজ করে ফেললেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের মনে আসলে একটা সাধারণ ভ্রমণ অনুমতির বিষয়টাই ছিল, যার মাধ্যমে বাবা-মায়েরা তাঁদের বাচ্চাদেরকে তুলে নিয়ে আবার বেরিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু তিনি কর্মকর্তাকে দিয়ে এর এমন এক ব্যাখ্যা করালেন, যার অর্থ দাঁড়ায়, “এদের সবাইকে চার বছরের জন্য বহুপ্রবেশ ভিসা দেওয়া হোক।”

আবারও ঈশ্বর আমাদের এই বিশ্বাসের প্রতিদান দিলেন তাঁর উপহারের ঝুলি খুলে। আমাদের প্রত্যেককে, যাদের স্রেফ একটি ভিসাই দরকার ছিল, এমনকি যাদের ভিসার মেয়াদ ফুরোয়ওনি, তাদেরকে সুদ্ধ সব ভিসার সেরা ভিসাটি দেওয়া হলো। সেই চার বছরের বহুপ্রবেশ ভিসাটির অর্থ হলো, আমরা ভিসা নবায়ন না করেই আগামী চার বছর যতবার ইচ্ছা আসাযাওয়া করতে পারব। আমাদের কোনো কোনো নবাগত মিশনারি জীবনেও এটা পাননি, কেননা পাকিস্তানে আসার আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁরা এটা নিয়ে আসতে পারেননি।

জে আমাদেরকে পেনাংয়ে ফোন করে সুখবরটা দেন এবং আমরা এই পুরস্কার গ্রহণের উদ্দেশ্যে ফিরতি বিমান ধরি সঙ্গে সঙ্গেই। মে মাসের ১৭ তারিখ জে আমাকে, লিনকে আর বেকিকে নিয়ে যান আমাদের পাসপোর্টে ভিসার সিল মারাতে। ফেরার পথে আমেরিকান দূতাবাসে দাঁড়ালে তখনকার কর্তব্য কর্মকর্তা জে-র দিকে তাকিয়ে বলেন, “এই লোক একেবারে চাঁদের দিকে তির ছোড়েন, তাই না?” তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলেন, “আপনার মনে হয় ওপরে কেউ আছেন আপনার হয়ে কাজ করার জন্য।”

আমাদের ভিসা ও টিকিটের জন্য অপেক্ষা করার সপ্তাহগুলোতে আমরা পত্রিকার খবর গিলছিলাম এবং যে-কেউ পাকিস্তানের ওপর কোনো খবর পড়তে থাকলে অভদ্রের মতো তার কাঁধের ওপর হুমড়ি খেযে পড়ছিলাম। নিউজ উইকের ২৬শে এপ্রিল সংখ্যার এই ধরনের খবরের বিশেষ গুরুত্ব ছিল আমাদের কাছে।

… নিষ্ঠুরতার জন্য কুখ্যাত একটি গৃহযুদ্ধে, ঝটিকা আক্রমণগুলো পরিচিত ছিল তাদের বর্বরতার জন্য। বন্দর নগরী চট্টগ্রামে, পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি বন্দিদের জোরপূর্বক ট্রাকে তুলে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে বাধ্য করে—যেটা ছিল তাদের প্রিয় শ্লোগান। এই শ্লোগান শুনে লুকিয়ে থাকা বাঙালিরা বেরিয়ে এলে, তাদেরকে নির্বিচারে মেশিনগানের গুলি করে মারে। সিলেট ও কুমিল্লা শহরে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যেরা শত শত বাঙালি কৃষকদের লাশ ফেলে রাখে যত্রতত্র শকুন ও কুকুরের খাদ্য হবার জন্য।

আমরা খবর পাই প্রতি দিন প্রায় এক লাখের মতো বাঙালি শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করছে। সেইসব হাজার হাজার শরণার্থীর বহন করে নিয়ে যাওয়া হাজারো ট্রাজেডির গল্প শুনি আমরা: বাচ্চাদের সামনে বাবা-মাকে হত্যা করা; বাচ্চাদের ওপরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সৈন্যদের বেয়নেটের ডগায় গেঁথে নেওয়া; কমবয়েসি মেয়েদের জোর করে যৌনদাসী করে রাখা; পুরুষদের চোখ উপড়ে ফেলে পিটিয়ে মারা ইত্যাদি।

এইসব নির্মমতার কথা জেনে বরং আমাদের ফেরার ইচ্ছা আরও প্রবল হয়, যাতে করে আমরা তাদের সাহায্য করতে পারি। তবে সেদিনের সেই অসহ্য গরমে ব্যাংককের রাত্রিতে প্রার্থনারত অনেকেই অনুৎসাহিত ছিল এতে। কিন্তু আমাদের তো পর্বত-চূড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। ঈশ্বর আমাদের প্রার্থনা শুনেছেন, আমাদের হাতে ভিসা এসে গেছে।

আমাদের দলের অর্ধেক সিদ্ধান্ত নেন মাঝখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় ছোট্ট বিরতি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার। মালুমঘাট ছাড়ার পর চৌত্রিশজনের আমাদের এই দলটি গত পাঁচ সপ্তাহ ধরে এতটা সময় একসঙ্গে ছিলাম যে, এমনকি ছোট্ট বারো বছর বয়সী ফিলিপ ওয়াল্‌শও, প্রথম দলের সদস্য তার পরিবারের হাত ধরে অনিচ্ছুকভাবে বলে, “আমি সত্যি মনে করি না আমাদের দল ভাঙা উচিত।”

আমরা যারা ব্যাংককে ছিলাম তারা এই সংবাদ শুনে উল্লাস করি যে, ঢাকার যাত্রাবিরতিতে ডাঃ ওল্‌সেন তাঁর নিজের পরিবার, ওয়াল্‌শ ও কেচামের পরিবারকে অভ্যর্থনা জানান এবং পূর্ব পাকিস্তানে তাঁরা কোথায় থাকবেন তার একটা ছকও আঁটেন। তাঁরা সবাই ফিরে গেছেন, আর আমরা এখানে এই গরম, গুমোট ব্যাংককে আটকে আছি।

পাকিস্তানি দূতাবাস প্রতিজ্ঞা করে যে, ঢাকা প্রত্যাবর্তনের অনুমতি আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের খবর দেবে। কিন্তু অনেক কটা দিন কেটে যায়, কোনো খবর আসে না। ২৯শে মে শুক্রবার মেল বিল্‌স দূতাবাসে আশ্রয় নেন, কিন্তু দুপুরের পরেই সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। মুসলিম দেশগুলোতে শুক্রবার দুপুরেই অফিস বন্ধ হয়ে যায়, আর কোনো সরকারই শনিবার ও রবিবার খোলা থাকে না। সেখানে কোনো সম্ভাবনাই ছিল না যে, আমরা রবিবার বিকালের বিমান ধরতে পারব।

আমরা আসলে ৩১শে মে রবিবার রাতে ইভাঞ্জেলিকাল চার্চ অভ ব্যাংককে শুরু হতে যাওয়া বিলি গ্রাহামের ছবি টু আ পেনি দেখার ওপর একটু বেশিই গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলাম, কেননা ততদিনে আমাদের কাছে কেনাকাটা করা, চিড়িয়াখানায় যাওয়া এমনকি সুইমিং পুলে সাঁতার কাটাও আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিল।

প্রার্থনার সময় অনেকেই স্বীকার করেছিলেন যে, আমাদের বিশ্বাস একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছিল। অন্যেরা ইতোমধ্যেই ফিরে গেছেন, তাহলে আমরা নই কেন? ঈশ্বর কি তাহলে চাইছিলেন না যে, আমরা ফিরে যাই? এতগুলো সপ্তাহ এখানে বেকার বসে থাকার পর আমাদেরকে কি তাহলে যুক্তরাষ্ট্রেই ফিরে যেতে হবে? আমরা কি তবে মিশনের পরিচালনা পর্ষদের এই পরামর্শকেই মেনে নেব যে, আমাদের মধ্যে যারা স্বাস্থ্যকর্মী তাদের ফিলিপিন্সে গিয়ে স্বাস্থ্য-কর্মসূচিতে কাজ করা উচিত? লিন সে-রাতে বিশেষ কিছু বলেনি। সে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছিল আগেই: ঈশ্বর আমাদেরকে ফিরিয়ে নেবেন, এই রবিবারেই!

ব্যাংককের ইভাঞ্জেলিকাল চার্চ প্রথমে তাদের প্রার্থনাসভার আয়োজন করে, তারপর সংক্ষিপ্ত বিরতি দিয়ে, রবিবারের স্কুলের ক্লাসগুলো চালায়। সকালের অধিবেশনের উপসংহারে পাদ্রি একটা বার্তা পড়ে শোনান, “এখানে যদি ডাঃ কুক বলে কেউ থাকেন, তাহলে তাঁকে ফোনে ডাকা হচ্ছে।” আমাদের ড. ডিকুক ভাবেন নামটা যথেষ্ট কাছাকাছি, তাই তিনি দৌড়ে গিয়ে সবচেয়ে কাছের যে-ফোন সেটা ধরেন। আমরা তখন রবিবারের স্কুলের উদ্বোধনী প্রার্থনাসংগীত গাইতে শুরু করে দিয়েছি, যখন তিনি আকর্ণবিস্তৃত হাসি নিয়ে ফিরে আসেন। বাকি জমায়েতকে একটা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা প্রদান করে আমরা দ্রুত হেঁটে, বলা চলে প্রায় উড়ে, চলে যাই লবিতে।

বেচারা জো ডিকুক গল্পটা একটু রসিয়ে বলারও সময় পেলেন না। পাকিস্তান এয়ারলাইন্স এতগুলো যাত্রী হারাতে চায় না বলে সরকারি কর্তৃপক্ষের ওপর বিশেষ চাপ প্রয়োগ করে। দেশে প্রবেশের অনুমতি এসে পৌঁছেছে পিআইএ অফিসে। আমরা কি বিকাল ৫টার মধ্যে তৈরী হতে পারব? পারব আমরা? অর্ধেক মহিলা ততক্ষণে লিফটে ঢুকে গেছেন প্রায়, হোটেল ত্যাগ করার জন্য, ইভাঞ্জেলিকাল চার্চ তাদের সভাটি হোটেলেই করেছিল। আমি আরো এক তলা সিঁড়ি ভেঙে বাচ্চাদেরকে ক্লাস থেকে বার করে আনি এবং জুনিয়র ক্লাসের ছাত্রদেরকে অন্যদের বিরক্ত না করে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত করি। তারা আমার সঙ্গে হলঘরে এসে দেখা করে।

“ব্যাপার কী?” দশ বছর বয়সী ড্যানি জিজ্ঞাসা করে।“

আমরা আজ বিকালে বাড়ি যাচ্ছি, ড্যানি।” আমি উত্তর করি।

“বাড়ি? মানে আমরা পাকিস্তান ফিরে যাচ্ছি? কী মজা! আমাকে ক্লাসে ফিরে গিয়ে সবাইকে তা বলতে হবে। তারা সবাই প্রার্থনা করছিল যেন আমরা ফিরে যেতে পারি।”

আমাদের প্রার্থনার এমন ইতিবাচক উত্তরের অভিঘাত আমাদের মধ্যে দৃশ্যমান হয়, আমরা যখন অতগুলি সিঁড়ি ভেঙে দ্রুত নেমে আসি।

“অই যায়, টু আ পেনি!” আমরা ট্যাক্সিতে ওঠার সময় ড্যানি বলে ওঠে। [চলবে]


কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৫)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৪)

কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৩)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১২)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১১)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১০)

 

 

ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মনের বীক্ষণে দলিত, তপশিলি, নিম্নশ্রেণির ইতিহাস



সাৰ্থক লাহা
ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মন

ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মন

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাস চর্চা দীর্ঘকাল ধরে মূলত রাজনীতি, রাজনৈতিক চিন্তা, রাজবংশ, রাজা-রাজত্বের মধ্যে সীমায়িত ছিল। আবার একইসাথে ইতিহাসের সংজ্ঞায়নে কেউ কেউ বলেছেন মহান মহান মানুষের জীবন অবতারনা বা আলোচনার নামই হল ইতিহাস। থমাস কার্লাইলের ভাষায়, 'ইতিহাস হল অসংখ্য মহান মানুষের আত্মজীবনির সারবস্তু’।

মূলত একটা সময় ইতিহাস মানে নেপোলিয়ান, আলেকজান্ডার, অশোক, সমুদ্রগুপ্ত, আকবর প্রমুখ মানুষদের জীবনীগাঁথা ও তাঁদের সময়কালকেই বোঝা হতো। কিন্তু ইতিহাসের যে অন্য অনুষঙ্গ আছে বা ইতিহাস যে সমস্ত শ্রেণির মানুষের ইতিবৃত্ত সেটা বুঝতে বেশ কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়।

মূলত গত শতাব্দীর ৮০’র দশক থেকে নিম্নবর্গের কথা ঐতিহাসিক কলমে উন্মোচিত হয়। তা সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠেছে ‘নিম্নবর্গের মানুষ কি সত্যিই কথা বলতে পারে?’- এই প্রশ্নের উত্তরে সজ্জিত উপাত্ত নিয়ে ইতিহাসে যে দলিত শ্রেনি, তপশিলি জাতির উচ্চারনও সমানভাবে প্রতীয়মান, সেই জায়গাটি বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চার আলোকে যিনি সম্মুখে আনেন তিনি হলেন অন্যতম ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মন। যার কলমে বিভিন্ন গ্রন্থে দলিত শ্রেনি, তপশিলি শ্রেণির তথা নিম্নশ্রেনির ইতিহাস, আত্মকথন, স্বকীয় রচনাগুলি পরিস্ফুটিত হয়েছে। লেখকের ‘সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ গ্রন্থটিও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।

ইতিহাসচর্চা বস্তুনিষ্ঠতা, বিজ্ঞানবাদিতা, নিরপেক্ষতা সহ নানা নতুন অনুষঙ্গ নিয়ে ক্রমশই অগ্রবর্তী হচ্ছে। ইতিহাসবেত্তাদের কলমে ক্রমশই পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস, মহামারি, বিজ্ঞান, ক্রীড়াসহ নানাবিধ চর্চা বিশ শতকে নানা আবর্ত আলোচিত হতে দেখা যায়।

মুখ্যত বাংলা ভাষায় জাতপাত, জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ বিষয়ক আলোচনার আবর্ত দীর্ঘকাল যাবৎ ইতিহাসচর্চাকারীদের কলমে অপাংক্তেয় অবস্থাতেই থেকে গিয়েছিল। ঔপনিবেশিক কালপর্বে এবং সাম্প্রতিকে কিছুক্ষেত্রে জাতিচেতনা, দলিত আন্দোলন নিয়ে লেখালেখি হলেও মূলত তা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যেই সীমায়িত। কাজেই কলকাতার গাঙচিল প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত রূপ কুমার বর্মনের ‘সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ এই গ্রন্থটি জাতপাতের ও আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিকনির্দেশক গ্রন্থ তা বলাই যায়।

লেখক মূলত সমকালীন পশ্চিমবঙ্গকে এক্ষেত্রে অনুধাবন করেছেন। অসংখ্য সাক্ষাৎকার ও ক্ষেত্রসমীক্ষা সহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযোজন এবং অসংখ্য প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্তিকরনের প্রয়াসের ফসল এই গবেষণা গ্রন্থটি। শিরোনামেই ধরা পড়েছে গ্রন্থের মূল নির্যাস। যার মধ্যে সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের জাতপাত, জাতি-হিংসা, তপশিলিদের সামাজিক স্তরীকরণে কী অবস্থা, অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, নারীদের বৈষম্যকরনের পাশাপাশি ডান-বাম রাজনীতির আবহে এই তপশিলি জাতির চিত্রপটের স্বরূপ অনুধাবন, জাতিকেন্দ্রিক রচনা, কিছু ব্যক্তিত্বের বর্ননের সাথেও সরকারী নীতি, বিভাগ স্থাপন, প্রতিস্থান নির্মান ও নামকরন প্রভৃতি নানাবিধ বিষয়ের সংযুক্তকরুন বইটিকে এক অনন্য মাত্রা দান করেছে।

রুপ কুমার বর্মনের গ্রন্থটিতে ভূমিকা, অধ্যায়ীকরন, উপসংহার, সুদীর্ঘ গ্রন্থ তালিকা সহ বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের সন্নিবিষ্টকরন পরিলক্ষিত করতে পারি। গ্রন্থ তালিকায় প্রাথমিক তথ্যাদি সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক রচনা, অফিসিয়াল ও লেখ্যাগারের তথ্যাদি ও বৈদেশিক গ্রন্থের প্রয়োগ গ্রন্থটির প্রামাণ্যতাকে নির্দেশ করে। অতিরিক্ত তথ্যাদির এই ব্যবহার গ্রন্থটিকে আরো প্রাঞ্জল করেছে।

গ্রন্থটির ভূমিকাংশে জাতপাত এবং জাতি, বর্ণবাদের উৎপত্তির ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগের বর্ণবাদের বিকাশ এবং ক্রমশই যে জাতপাতের ভারতীয় সমাজে নিম্নবর্ণীয়দের প্রান্তিকায়িত করার আভাস তার ব্যাখ্যা দেখতে পায়। লেখক ইসলামিক এবং ঔপনিবেশিক সময়কালেও গ্রন্থগুলি অবলোকন করে ভারতীয় সমাজের নিম্নবর্ণীয়দের কি অবস্থান, তারা কিভাবে জাতি বৈষম্যের শিকার সেই ব্যাখ্যা করেছেন এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন আইন এবং প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা মধ্য দিয়ে নিম্নবর্ণীয়দের অবস্থা যে ক্রমিক প্রভু-দাস সম্পর্কের (patron-client Relationship) বন্ধনে নিমজ্জিত হয়েছে। এবং প্রান্তিকিকরন হয়ে যাওয়ার যে ব্যাখ্যা সেটা আমরা দেখতে পাই এবং স্বাধীনতার সময়কালে ভারতের নিম্ন বর্ণের জাতি জাতি হিংসা অবসানের যে প্রচেষ্টা এবং সেই প্রচেষ্টায় তপশিলি জাতি এবং জনজাতীয় অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতির স্বরূপ কতটা বিকাশমূলক হয়েছে তার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এবং খুব সুস্পষ্টভাবে ভারতীয় প্রেক্ষিতে পরিবর্তনের অনুধাবন করার চেষ্টা করেছেন এবং সমকালীন পশ্চিমবঙ্গেও জাতপাতের যে ধারাবাহিকতা সেটির আলোচনা করেছেন।

বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে তপশিলি জাতি ক্রমিক কিভাবে মৌখিক তথা বাহ্যিক এবং মানসিক জাতপাতের শিকার হচ্ছে সেই নব ব্যাখ্যাও এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট।

গ্রন্থটির বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে এই জাতপাত, জাতি-রাজনীতি, জাতি-হিংসা, জাতি-বৈষম্য এই বিষয়গুলি পরিস্ফুটিত হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত, জাতি হিংসা এবং সামাজিক সংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক স্তরীকরণের ক্ষেত্রে জাতপাতের যে গুরুত্বপূর্ণ সেই ব্যাখ্যা যেমন আলোচিত হয়েছে তেমনি অন্য মেরুতে পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলে চলতে থাকা বাচিক, মানসিক, ব্যবহারগত জাতপাতের যে অন্ধকার দিক সেটি লেখক তুলে ধরেছেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্বাধীনতার পর্বে পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তনকালীন রাজনীতি জাতপাত বা জাতি রাজনীতি কে কতটা ত্বরান্বিত করেছে এবং তপশিলি জাতির বিকাশ তথা উন্নয়ন নাকি তপশিলিরা রাজনীতির শিকার হয়েছে সেই ব্যাখ্যায় আমরা মূলত সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত পর্যবেক্ষিত হতে দেখি।

গ্রন্থটির তৃতীয় অধ্যায় মূলত বাংলার নিম্নবর্ণীয়দের নিজস্ব স্বকীয় লেখনীর মাধ্যমে তাদের অবস্থা নির্ণয়ের বা নির্মাণের আলোকে উঠে এসেছে। খুব সুন্দর ভাবেই লেখক বিভিন্ন জীবনী সাহিত্য, সৃজনধর্মী সাহিত্য অবলোকন এবং ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গে নিম্নবর্ণের উত্থানের প্রশ্নটিই উত্থাপন করেছেন। গ্রন্থটির চতুর্থ অধ্যায়ে বাংলার তপশিলি সমাজের থেকে রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্বকরণ এবং বেশ কিছু নিম্নবর্ণীয় মানুষের বিস্মৃত স্মৃতির নতুন করে চর্চা এবং চর্যার জগতে আনার আলোকে রচিত হয়েছে।

জাতপাত, জাতি-বৈষম্য, জাতি রাজনীতি এই শব্দবন্ধগুলি ভারতীয় সমাজের আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমানভাবেই বহমান হয়ে রয়েছে। সমাজে অন্যকে দেখার মানসিকতা, প্রভু-দাসত্বের সম্পর্ক উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের রূপক বর্তমান বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তির যুগেও সমভাবেই জাজ্বল্যমান সেটি পরিস্ফুটিত হয়েছে। গ্রন্থটি অনুধাবন করলে আমরা এই বিষয়টির সুস্পষ্ট বর্ণনা ফুটে উঠতে দেখতে পারি। কাজেই শুধুমাত্র ইতিহাস চর্চার আলোকে বা ইতিহাস পাঠকদের কাছেই নয়, সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে এই বইটির এক অন্যকথনের গল্প বলে যে গল্প জাতপাত, জাতি হিংসা, বৈষম্য প্রভৃতি বিষয়ের সংযোজনে জাতপাতের ইতিহাসে এই গ্রন্থটির গুরুত্বকে বর্নিত করে।

অনেক প্রশ্নের জবাব রূপ কুমার বর্মনের সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ গ্রন্থটি সজ্জা, জাতি ইতিহাসের নানা আঙ্গিকে বর্ননা, নির্ভরযোগ্য গ্রন্থতালিকা এবং সার্বিক-সুস্পষ্ট বর্ননা গ্রন্থটিকে অনন্য মাত্রা দান করে। হাল আমলে দাঁড়িয়ে জাতপাতের বর্ননা, আঞ্চলিক প্রেক্ষিত, জাতি-হিংসার নানা দিকের উন্মোচন এবং বিভিন্ন তথ্যাদির প্রয়োগে সার্বিকভাবে সমকালীন বাংলার জাতপাতের ইতিহাস নির্মানের ক্ষেত্রে এক দিকনির্দেশক পাঠ হয়ে উঠেছে রূপ কুমার বর্মনের ‘সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ গ্রন্থটি।

গ্ৰন্থ আলোচনা
সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ: জাতপাত, জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ
রূপ কুমার বর্মণ
গাঙচিল প্রকাশনী, কলকাতা, ২০২২, দাম- ৪০০ টাকা
.....

সাৰ্থক লাহা, গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

;

নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা



সোমঋতা মল্লিক
নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা

নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা

  • Font increase
  • Font Decrease

“তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় না তো কভু।

আমরা অবোধ, অন্ধ মায়ায় তাই তো কাঁদি প্রভু।।"

১৪ মে, সকাল। কলকাতার রবীন্দ্র সদনে সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হল এই নজরুল সঙ্গীত। বহুল প্রচলিত গানটি এই বিশেষ দিনে আমার কাছে ধরা দেয় অন্যরূপে। সমুখে শায়িত রয়েছেন সদ্য প্রয়াত কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ শ্রীমতী কল্যাণী কাজী। নিথর দেহে পুষ্পের অঞ্জলি। তাঁকে ঘিরে তাঁর আপনজনদের এই মর্মস্পর্শী উচ্চারণ মনকে ব্যাকুল করে।

তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ ১২-১৩ বছরের আত্মিক সম্পর্ক। ছায়ানট (কলকাতা)-এর হাত ধরেই যদিও এই সম্পর্ক শুরু হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের পরিবারের একজন। তাঁর কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি তা অবর্ণনীয়। আমার জীবনে এই প্রথম নজরুল জন্মজয়ন্তী যেদিন কল্যাণী কাজী আর সশরীরে আমাদের মধ্যে নেই। একথা ভাবলেই চোখ ভরে ওঠে জলে। বছরের এই বিশেষ দিনগুলিতে তাঁর সাথে দেখা হলে মনে হত, কি অসীম ভালোবাসায় তিনি আমাদের প্রাণের কবিকে অন্তরে ধারণ করেন। আর পাঁচজন শিশুর মতো তিনিও নজরুলকে ভালোবেসেছেন শৈশবেই।


'অন্তরঙ্গ অনিরুদ্ধ' বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, "ছেলেবেলা থেকেই আমার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। 'প্রভাতী', ‘লিচুচোর’ থেকে শুরু করে ‘বিদ্রোহী', 'আমার কৈফিয়ৎ’ ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’, ‘ইন্দ্রপতন’ প্রভৃতি কবিতা বিভিন্ন বয়সে মনে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। ছবিতে তাঁর ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল আর বড় বড় ভাবালু চোখ দুটোর দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখার ইচ্ছা হত। মনে পড়ছে, একবার গৃহশিক্ষককে অনুরোধ করেছিলাম তাঁকে দেখতে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু কেন জানি না শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়ে ওঠেনি। নিয়তি সেদিন অলক্ষ্যে নিশ্চয় হেসেছিলেন। নয়ত যে মানুষটাকে শুধু মাত্র চোখের দেখা দেখবার জন্য সেদিন ব্যাকুল হয়েছিলাম - পরবর্তী জীবনে তাঁরই পরিবারের একজন হয়ে তাঁর কাছে থেকে তাঁকে সেবা করার সুযোগ পেলাম কি করে? একেই বোধহয় বলে ‘বিধিলিপি’!

এই বিরল ব্যক্তিত্বের খুব কাছের মানুষ হয়েও, দুর্ভাগ্যবশত আমি সুস্থ অবস্থায় তাঁকে পাইনি। আমি এ বাড়ীর ছোট বউ হয়ে আসার বেশ কয়েক বছর আগেই বিস্মৃতি তাঁর চেতনার ওপর কালো পর্দা টেনে দিয়েছিল। তবুও আমাদের সবার প্রিয় ‘মামনি’ প্রমীলার স্নেহচ্ছায়ায় থেকে, তাঁর যতটুকু সেবা করার সুযোগ পেয়েছি তাতেই আমি ধন্য।"


এভাবেই কাজী অনিরুদ্ধর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার সুবাদে নজরুল পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বহু অন্তরঙ্গ আড্ডায় তিনি পরিবারিক স্মৃতিচারণা করতেন।

প্রথমবার তাঁর শ্বশুরবাবা কে সামনে থেকে দেখার অনুভূতির বর্ণনা যখনই দিতেন, মনে হত আমরাও সেই সময়ে উপস্থিত হয়েছি। তাঁর কথা বলার ভঙ্গি ছিল অসাধারণ। অতি সামান্য ঘটনাও তাঁর বাচনভঙ্গিতে হয়ে উঠত অসাধারণ।

তাঁকে ঘিরেই জমে উঠত আড্ডা। কখনও কথা, আবার কখনও গেয়ে উঠতেন একের পর এক নজরুল সঙ্গীত। নিয়মিত দূরদর্শনে নজর রাখতেন কোন্ শিল্পী কিভাবে নজরুলের গান গাইছেন। বিভিন্ন চ্যানেলের প্রভাতী অনুষ্ঠান দেখতে খুবই ভালোবাসতেন। পরিচিত শিল্পী হলে অনুষ্ঠানের পরেই চলভাষের মাধ্যমে অভিনন্দন জানাতেন। এভাবেই তিনি ভালোবাসায় আবদ্ধ করে রাখতেন সকলকে।

নজরুল চর্চার সঙ্গে যুক্ত যে কোন ব্যক্তি/সংগঠনকে তিনি আপন করে নিতেন। তাঁর পূর্ণদাস রোডের বাড়িতে ছিল নজরুল প্রেমীদের নিত্য যাতায়াত। নজরুল বিষয়ক আলোচনায় তাঁর ক্লান্তি ছিলনা। যে কোন সময়, যে কোন পরিস্থিতে তিনি পাশে থেকেছেন। ২০১৭ সালে কলকাতার বুকে প্রথম নজরুল মেলার আয়োজন করে ছায়ানট (কলকাতা), উদ্বোধক কল্যাণী কাজী। শিশুদের জন্য নজরুলের লেখা ২৫টি ছড়া ও কবিতা নিয়ে ২০২১ সালে ছায়ানটের উদ্যোগে কল্যাণী কাজীর কণ্ঠে ‘শিশু কিশোরদের নজরুল’ শিরোনামে একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। পরম যত্নে তাঁর হাতে গড়া দল 'বিষের বাঁশী' ছায়ানট (কলকাতা) - এর বহু অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে।


নজরুল সঙ্গীতের শিক্ষা তিনি কিভাবে পেয়েছিলেন সেই বিষয়ে কল্যাণী কাজী স্মৃতিচারণা করেছেন, "সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিল্পী শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্রের কাছে গান শেখার সুযোগ পাই। কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে আমি সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। বাংলা গানের সাথে সাথে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও যাতে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পারি,  তিনি তার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। কিন্তু আমার তখন চটুল গানের দিকেই ঝোঁক বেশি, তাই রাগ সঙ্গীতের জটিল পথে চলতে মন চাইত না। যতদিন যাচ্ছে ততই বুঝতে পারছি গলাকে স্ববশে রেখে গান গাইতে হলে, বিশেষ করে নজরুল গীতিকে প্রাণবন্ত করতে রাগ সঙ্গীত চর্চা খুবই দরকার।

আজ সঙ্গীতের শিক্ষকতা করতে গিয়ে নজরুল গীতির সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের সব রকমের বাংলা গানের চাহিদা যে মেটাতে পারি, তারজন্য আমি আমার গুরু শ্রদ্ধেয় শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্রের কাছে বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ। সেদিন যদি তিনি জোর করে খেয়াল, ঠুংরী, দাদরা, গীত, গজল এর সাথে সাথে কীর্তন, পুরাতনী, রাগপ্রধান প্রভৃতি গান না শেখাতেন, তবে গানের অনেক ধারাই আমার অজানা থেকে যেত। কাজী নজরুলের গানের সঙ্গে প্রকৃত পক্ষে তিনিই আমায় প্রথম পরিচয় করান। প্রথম যে নজরুল গীতিটা শিখিয়েছিলেন সেটা হল হাম্বির রাগে নিবদ্ধ 'আজো কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া'। এরপর তিনি শেখালেন 'ভোরের ঝিলের জলে', 'প্রথম প্রদীপ জ্বালো', 'শাওন আসিল ফিরে', 'ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি' প্রভৃতি নজরুলের রাগভিত্তিক গানগুলো।


আমার স্বামী অনিরুদ্ধ যখন নজরুল গীতির স্বরলিপির বই 'রাগবিচিত্রা'-র প্রস্তুতি নেন, তখন আমিই হাম্বির রাগের গানটির স্বরলিপির কাজে সাহায্য করেছিলাম। তিনি গানটা জানতেন না। অপ্রচলিত গানটা পরে খুবই জনপ্রিয় হয়েছে।" 

তিনি অসুস্থ ছিলেন বেশ কয়েকমাস, কিন্তু তাঁর জীবনীশক্তি ছিল প্রবল। জীবনের বহু দুঃসময়কে তিনি জয় করেছিলেন অবলীলায়। ১২ মে ভোরে নজরুল অনুরাগীদের চোখের জলে ভাসিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি দিলেন তিনি।

তাঁর কন্যা অনিন্দিতা কাজী বলেছেন মায়ের শেষ ইচ্ছের কথা। শোকবার্তায় অনিন্দিতা লিখেছেন - "মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর নিজের বাড়িতে (৭৪ এইচ, পূর্ণদাস রোড, ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক) দাদু ও ঠাকুমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটা আর্কাইভ হবে।"

আমরা সকলেই চাই তাঁর শেষ ইচ্ছে পূরণ হোক।

সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী ও গবেষক। সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)।

;

বাজারে এলো আতিফ ওয়াফিকের বই ‘এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া’ 



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

এইচ এম আতিফ ওয়াফিক, যোগাযোগের ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ, তার সর্বশেষ বই "এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" বাজারে এসেছে। এই বইটি আজকের পাঠকদের দ্রুত-গতির বিশ্বে সঠিক আচরণের শিল্প সম্পর্কে একটি সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গি সরবরাহ করবে বলে লেখক মনে করেন।

একটি সমাজে যেখানে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, "এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" সেই ব্যক্তিদের জন্য একটি অমূল্য সম্পদ হিসাবে কাজ করবে বলে লেখক মনে করেন। বিশেষ করে আজকের স্কুল এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রী দের এই বই টি অনেক কাজে আসবে। এই বইটি পাঠকদের আধুনিক আচরণের সূক্ষ্মতা আয়ত্ত করতে সাহায্য করার জন্য ব্যবহারিক পরামর্শ এবং কার্যকরী টিপস প্রদান করে৷

"এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" যত্ন সহকারে গবেষণা করা হয়েছে, পাঠকদের সমসাময়িক শিষ্টাচারের নিয়ম সম্পর্কে সর্বশেষ অন্তর্দৃষ্টি এবং নির্দেশিকা প্রদান করে। এর সহজ ভাষা এবং উপস্থাপন উদাহরণ সহ, সমস্ত পটভূমির পাঠকদের জন্য উপযুক্ত, তারা তাদের সামাজিক দক্ষতা পোলিশ করতে চাইছে বা তাদের পেশাদার চিত্র উন্নত করতে চাইছে।

এইচ এম আতিফ ওয়াফিক একজন অন্বেষিত যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, তার আকর্ষক কথা বলার ব্যস্ততা এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ পরামর্শের জন্য পরিচিত। বর্তমানে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স এ ।

রিডিং ক্যাফে, বনানীতে বইটি উন্মোচনের সময়, জনাব ববি হাজ্জাজ (একজন অক্সফোর্ড স্কলার), জনাব সোলায়মান শুকন (একজন বাংলাদেশী যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ), জনাব শাহরিয়ার নাফীস (সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার), জনাব হাসান মাহমুদ (প্রতিষ্ঠাতা, স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ার্স), জনাব বেনজির আবরার (প্রতিষ্ঠাতা, এক্সিলেন্স বাংলাদেশ), মিসেস আফরুজা তানজি (রাষ্ট্রদূত, ওয়ান ইয়াং ওয়ার্ল্ড), মিসেস শারমিন কবির (প্রতিষ্ঠাতা, রিতু), মিসেস ইশরাত নাহের ইরিনা (প্রতিষ্ঠাতা, প্রেসক্রিপশন বাংলাদেশ), জনাব ফাহিন আরাফিন (ক্রিয়েটিভ হেড, স্বপ্ন), জনাব সালেহীন মাহবুব (বিশ্ববিদ্যালয় অনুষদ), মিসেস ফারহানা শারমিন (ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজিস্ট, রিমার্ক এইচবি), এবং আরও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী প্রিয় শিক্ষার্থীউপস্থিত ছিলেন।

;

কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'



কনক জ্যোতি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'

কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'

  • Font increase
  • Font Decrease

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তিনি একক ও অনন্য। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। যার অগ্নিঝরা লেখনি ত্রস্ত করেছে ঔপনিবেশিক শাসকদের। যার বই বার বার বাজেয়াপ্ত হয়েছে। যাকে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন।

নজরুল শতবর্ষ আগে বন্দি ছিলেন কলকাতার আলীপুর সেন্ট্রাল জেলখানায়। নজরুল বিষয়ক সংগঠন ছায়ানট কলকাতা শিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা-গবেষণার পাশাপাশি নজরুল স্মৃতিধন্য হেরিটেজ স্থান ও স্থাপনাসমূহ রক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সক্রিয় রয়েছে। ছায়ানট কলকাতার সভাপতি, বিশিষ্ট শিল্পী, সোমঋতা মল্লিক কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের নজরুলতীর্থগুলো নিজে গিয়ে সেগুলো রক্ষার প্রশাসনিক ও নাগরিক তৎপরতা চালিয়ে ছিলেন। যার ফলে এবছর নজরুল জয়ন্তীতে কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে স্থাপিত হয়েছে 'নজরুল কক্ষ'।


ছায়ানট কলকাতা সভাপতি সোমঋতা মল্লিক বার্তা২৪.কম'কে জানান, গত ১৪ ডিসেম্বর,২০২২ তারিখে ছায়ানট (কলকাতা) তথ্য সহ WBHIDCO - এর কাছে এই মর্মে আবেদন করে যে, নজরুল স্মৃতি বিজড়িত আলিপুর জেল মিউজিয়ামে কাজী নজরুল ইসলাম যে জায়গায় বন্দি হিসেবে ছিলেন, সেই জায়গাটি চিহ্নিত করা এবং নজরুল মূর্তি স্থাপন করার জন্য।

তিনি বলেন, গত ১৭ জানুয়ারি,২০২৩ তারিখে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নজরুলের আগমনের শতবর্ষকে স্মরণ করে ছায়ানট (কলকাতা) এবং আলিপুর মিউজিয়াম যৌথভাবে একটি অনুষ্ঠানও পালন করে।

শনিবার (২৬ মে) আমরা সত্যিই আনন্দিত, আমাদের এই প্রস্তাব তাঁরা বিবেচনা করেছেন এবং আলিপুর মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ' তৈরি হয়েছে, জানান সোমঋতা মল্লিক।

;