কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৫)



জিনি লকারবি ।। অনুবাদ: আলম খোরশেদ
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

মালুমঘাট থেকে পলায়ন

[পূর্ব প্রকাশের পর] ২৬শে এপ্রিল, সোমবার

রাষ্ট্রদূত মি. হামেল ও তাঁর স্ত্রী এবং আরো কজন দূতাবাসকর্মী বিমানবন্দরে আসেন আমাদেরকে বিদায় জানাতে। “আপনাদের ব্যাংকক যাত্রা শুভ হোক।” তাঁরা বলেন।

আমাদের আনন্দ ও বিস্ময়কে কল্পনা করতে চেষ্টা করুন, যখন আমরা বিশাল ব্যাংকক বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ জনতার ভিড়ের ভেতর থেকে ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ড অ্যালাইয়েন্স মিশনারি অতিথিনিবাসের ম্যানেজার, রেভারেন্ড বিল কার্লসনকে বেরিয়ে আসতে দেখি! তিনি একটি ট্রাক ও দুটো ভক্সওয়াগন বাস নিয়ে এসেছিলেন আমাদেরকে গেস্ট হাউসে নিয়ে যাবার জন্য।

চমৎকার অতিথিনিবাসটিতে বনি কার্লসন আমাদেরকে নম্রভাবে অভ্যর্থনা করেন এবং আমাদের যার যার ঘরে পৌঁছে দেন। আমরা তখন আর শরণার্থী ছিলাম না, আমরা তখন মার্কিন পর্যটক।

সে-রাতে পরে বনি আমাদেরকে একপাশে ডেকে নিয়ে বলেন, “আমি আরো তিনটা দলকে তাদের দ্বিতীয় স্বদেশ থেকে উদ্ধার করে এনেছি: ভিয়েতনাম, লাউস ও কাম্পুচিয়া থেকে। আমি জানি, তোমরা যতটা না অনুধাবন করতে পারছো, তার চেয়ে অনেক বেশি চাপের মধ্যে রয়েছো। আমি তাই বলব, ব্যাংককের যা কিছু নৈসর্গিক ও সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য রয়েছে সেগুলোর স্বাদ নাও বরং এই সুযোগে।

আমাদের খুব পছন্দ হয় তাঁর পরামর্শ, এবং আমরা সেই অনুযায়ী শহরের দৃশ্যাবলি দেখতে বেরোই ও নানারকম আনন্দ করি। অবশ্য সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল কেনাকাটা করা, বিশেষ করে আমার ও লিনের জন্য। আমাদের একটা ভালো অজুহাতও ছিল: আমরা আসার সময় যেসব জিনিসপত্র আমাদের সেই বিখ্যাত ব্যাগে ভরতে পারিনি, সেগুলোর অভাব পূরণ করা।

কোনো এক কেনাকাটা অভিযান থেকে ফেরার পর আমি একটা আনন্দের খবর পাই যে, আমার বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল, এবং তারা আবার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফোন করবে। তাদেরকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারাটা, যে আমরা সবাই নিরাপদে আছি, এর অনুভূতিটাই চমৎকার, কেননা গত কয়েক সপ্তাহে যোগাযোগ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।

কার্লসনেরা আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করার জন্য নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দিয়েছিলেন। তাঁরা আমাদের জন্য অসাধারণ সব খাবারের বন্দোবস্ত করেছিলেন এবং সবসময় গাড়ি ও তথ্যাদি দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। একুশটি বাচ্চার চঞ্চলতা তাঁরা সহ্য করেছিলেন, সঙ্গে সম্ভবত সমান অস্থির তেরোজন প্রাপ্তবয়স্কেরও। সত্যি বলতে কি, যেহেতু স্বীকারোক্তি প্রদান অত্মার সুস্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণকর, আমি স্বীকার করছি যে, আমাদের অতিথিনিবাসে এক সপ্তাহ থাকাকালীন সময়ে একমাত্র যে-জানালাটি ভাঙনের শিকার হয়েছিল, সেটি ভেঙেছিলাম আসলে আমি। আমি বিশুদ্ধ বাতাস ঘরে ঢোকাতে গিয়ে বোধহয় একটু জোরেই তাতে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিলাম, আর অমনি ফটাস!

আমাদের নিজস্ব মিশন এসোসিয়েশন অভ ব্যাপ্টিস্টস থেকে আসা খবর অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য ব্যাংককে। মিশনের নেতা ও কর্মীরা ছিলেন বিশেষ উৎসাহী। চেরি হিল, নিউ জার্সির সদরদপ্তর থেকে আমাদের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে এবং আমাদের জন্য অব্যাহত প্রার্থনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাঠানো অনেক চিঠিপত্র পেয়েছিলাম আমরা। আর বাস্তব চিন্তায়, তাঁরা আমাদের জন্য ক্রেডিট কার্ড এবং অগ্রিম অর্থ উত্তোলনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পরিবার ও বন্ধুদের কাছে আমাদের সংবাদ ও তথ্যাদি পৌঁছানোর ব্যবস্থাও করেছিলেন।

একদিন অতিথিনিবাসে ফিরে আসার পর বনি কার্লসন জানালেন, “আপনাদের আরো সদস্য আসছেন আজ।”

এই কথা বলা শেষ করতে না করতেই গুর্‌গানসদের বহন করে একটা ট্যাক্সি এসে ঢোকে। নিজেদের অভিজ্ঞতাগুলো ভাগ করে নিতে উদগ্রীব এবং মার্চের সেই সন্ধ্যায় তাঁদের শেষ দেখার পর কী কী ঘটেছিল জানতে আকুল আমরা সবাই একসঙ্গে কথা বলে উঠি।

জাহাজ তাদেরকে কোলকাতা নিয়ে গিয়েছিল, যেখানে রিপোর্টাররা অবতরণকারী যাত্রীদের পাকড়াও করে তাদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য। কয়েকজন বিদেশি বাঙালিদেরকে সমর্থন করে, কিন্তু আমাদের মিশনারিরা বলেন, “আমরা কিছু বলতে অস্বীকার করছি, যারা বাংলাদেশে রয়ে গেছেন তাঁদের নিরাপত্তার কথা ভেবে।”

গুর্‌গানস ব্যাখ্যা করে বলেন, জাহাজের যাত্রীদেরকে তাঁদের যার যার দূতাবাস আতিথেয়তা দেয়, যতদিন না তাঁরা কোলকাতা থেকে অন্যত্র যাত্রা করেন। গুর্‌গানসরা দেরি না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করাচির উদ্দেশে রওনা হন এবং সেখান থেকে উত্তরে যান তাঁদের কন্যার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য।

ভিক, ডন ও রিড তখনও পূর্ব পাকিস্তানে রয়ে গিয়েছিলেন। অনেক পরেই কেবল আমরা জানতে পারি, সেই দিনগুলোতে সেখানে থাকার অর্থ আসলে কী ছিল।

তাঁর ব্যক্তিগত ডায়রিতে ডা. ডন কেচাম হৃদয় খুলে বর্ণনা করেন সেইদিনগুলোর কিছু ঘটনা। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ, সেসবের একটি ঘটনা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য।

“২১শে এপ্রিল, সকাল সাড়ে পাঁচটা”

“সাতসকালেই আমি তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে গিয়ে বাংলাদেশি কর্মচারীদের আমাদের দ্রুত দেশত্যাগের কথা জানাই। এটা তাদের একেবারে কাঁপিয়ে দেয়, এবং তাদেরকে বারবার এই কথা বলে আশ্বস্ত করতে হয় যে, ভিক ও আমি কোথাও যাচ্ছি না। বাড়ি ফিরে এসে শেষ মুহূর্তের কিছু কাজ সারি, তিনটা গাড়ি ও ট্রেলারে মালপত্র ভরি এবং রওনা হয়ে যাই।”

“জে ওয়াল্শ (যে খুব চেয়েছিল রয়ে যেতে কিন্তু দলের সঙ্গে তাকে যেতেই হচ্ছিল ভ্রমণের দাপ্তরিক দায়িত্বাদি পালনের জন্য।) একটা ল্যান্ডরোভার চালাচ্ছিলেন, যেমনটা করেছিলাম আমি ও জো ডিকুক। আমরা একজন দেশি ড্রাইভারকেও সঙ্গে নিয়েছিলাম আমাদের নিজেদের জন্য একটি গাড়িকে ফিরিয়ে আনার কাজে। ঈশ্বর আমাদেরকে একটি মেঘাচ্ছন্ন, বৃষ্টিভেজা দিন উপহার দিয়েছিলেন। যাত্রীবোঝাই গাড়ির ভেতরের গরম কমিয়ে কিছুটা ঠান্ডা করার পাশাপাশি তা বিমান থেকে গুলিবর্ষণের সম্ভাবনাও কমিয়ে দিয়েছিল।”

“স্বাভাবিক অবস্থায় বার্মার সীমান্ত বন্ধই থাকে, তবে বার্মা সরকার পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে দলে দলে শরণার্থী যাওয়াতে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল কিছুটা। যুক্তরাষ্ট্র সরকারও তাদেরকে আমাদের আগমনের কথা জানিয়ে রেখেছিল, ফলে সীমান্তে তারও প্রস্তুতি নিতে হচ্ছিল তাদের। বাইবেলের শ্লোক ১০৫ এর কথা না ভেবে পারছিলাম না আমি:

‘যখন সেখানে খুব কম সংখ্যক, হ্যাঁ খুব কম সংখ্যক মানুষ ছিল দলে, এবং তার মধ্যে ছিল অচেনা লোকজনও।
যখন তারা এক দেশ থেকে আরেক দেশে যায়, যখন এক জনগোষ্ঠী থেকে আরেক রাজার দেশে;
তিনি তাদের ক্ষতি করতে দেন না কাউকে, হ্যাঁ তিনি রাজাদেরও ভর্ৎসনা করেন এজন্য;
এই বলে, যে, আমার আপন মানুষকে তুমি স্পর্শ কোরো না, ক্ষতি কোরো না আমার নবির।”
ধন্যবাদ প্রভু।

“জে নৌকার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। জোয়ার ছিল না, তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত নৌকোয় মাল ভর্তি করা হয় এবং যাত্রীরা তাতে উঠে পড়েন। সবাই ওঠার পর আমি সেখানে গিয়ে পৌঁছাই, যেহেতু আমি টাকা পয়সা ভাঙানোর কাজ করছিলাম বাজারে। ফলত আমি আমার পরিবারের শেষ চুম্বনের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হই। কিট, ঈশ্বর মঙ্গল করুন তাঁর, ছিল খুবই সাহসী। সে কখনোই দমে যায়নি। ডেভিড ও মার্টি বাবাকে ছেড়ে যাবার কষ্ট, আর তিন মাইল চওড়া নদী নৌকায় পাড়ি দেবার উত্তেজনার দোলাচলের মধ্যে দুলছিল। আমার বেকি কেঁদে ফেলেছিল।”

“নুহের নৌকো ধীরে স্রোতে ভেসে গিয়েছিল এবং ভারী বুক নিয়ে আমি তীরে দাঁড়িয়ে ছিলাম একা।”

“আমরা তিনটা গাড়ি নিয়েছিলাম, কিন্তু এখন কেবল দুজন ড্রাইভার থাকাতে আমি আমার গাড়িখানি এক দেশি বন্ধুর কাছে রেখে আসি। ফেরার পথে কীসব দৃশ্যই না চোখে পড়েছিল আমাদের! রাস্তার দুপাশে স্রোতের মতো হেঁটে যাচ্ছিল গরিব হিন্দু শরণার্থীর দল। বাবা বহন করছেন গৃহস্থ সামগ্রী, অন্তঃসত্ত্বা কোনো নারী একটি বাচ্চাকে কোলে ও আরেকটি অনিচ্ছুক শিশুকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সবার গতিমুখ দক্ষিণ দিকে, বহুমাইল দূরের কোনো অজানা গন্তব্যের পানে।”

“চমৎকার মেঘেদের অনাগোনা ছিল আকাশে! দিনটা কী করে এমন সুন্দর আর হৃদয় কিভাবে এতখানি ভারী হতে পারে? আমি ভাবি। গ্রামের দিকটা কী শান্তিপূর্ণ... কে বিশ্বাস করবে যে, সেখানে একটা যুদ্ধ চলছিল? একদল সৈন্য, গম্ভীর, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সামনে কী অপেক্ষমাণ, তা ভেবে খানিকটা উদ্বিগ্ন।”

“সন্ধ্যা ৬টা। হাসপাতালে ফেরত আসা। গাড়িবারান্দায় দেশি কর্মীদের ভিড়, আমাকে ফিরে আসতে দেখে তাদের মুখ উজ্জ্বল। সূর্যাস্তের দিকে শেষ একশত গজ গাড়ি চালানো আমার, আর ঈশ্বর আমার জন্য বিশেষ করে সুন্দর এক সূর্যাস্ত রচনা করেছিলেন। আমি নিজেকে এতক্ষণ চেপে রেখেছিলাম, কিন্তু সেই সূর্যাস্ত আমার সব বাঁধ ভেঙে দিয়েছিল। আমি গাড়ি থামিয়ে কিছুক্ষণ কেঁদে নিই।”

“ডা. কেচামের অবশ্য তাঁর হৃদয়ের সবচেয়ে নিকটবর্তী বিষয় নিয়েও মাথা ঘামানোর মতো সময় ছিল না। বিপদগ্রস্ত দেশি কর্মীদের দায়িত্ব এবং কেবল তাঁর ও ভিক ওল্‌সেনের ওপর পুরো হাসপাতালের ভার, তাঁকে সারাক্ষণ দখল করে রাখত।”

“এই দুজনকে আরো পুরোপুরিভাবে ঈশ্বরের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার জন্যই বোধ হয় ভিক একটি ফালতু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়েন, যার কারণে তাঁর ওপর একটা অস্ত্রোপচার পর্যন্ত করতে হয়।”

“একেবারে পুরোপুরি গলে যাওয়া একটা কনুই,” ডন কেচাম বর্ণনা করেন।
পরে, ভিক আমাদের সবাইকে লেখেন, “আমি খুবই আনন্দিত যে, তোমরা কেচামের থেকে যাওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিলে।”

“পুলের তলা দিয়ে অনেক পানিই বয়ে যাবে, আমরা আমাদের জোরপূর্বক দেশত্যাগের সময় সংঘটিত এই দুর্ঘটনা, এবং মালুমঘাট ও চট্টগামের আরো অনেক সংকট সম্পর্কে জানার আগে।”

“জীবিত কৃতজ্ঞ বাঙালিরা এখনো নিঃস্বার্থ আমেরিকান মিশনারিদের বীরত্বের কথা বলে। অনেক হিন্দুকে আশ্রয় দিয়ে এবং আরো অনেকের জন্য মিলিটারিদের সঙ্গে দেনদরবার করে, মালুমঘাটে ডন কেচাম ও ভিক ওল্‌সেন, এবং চিটাগাংয়ে রিড মিনিখ ঈশ্বরের কৃপায় সেই দিনগুলোতে বহু মানুষের প্রাণ বাঁচানোর নায়ক হয়েছিলেন।”

কেবল তাদের প্রাণই বাঁচেনি, অগুণিত ক্ষেত্রে তাদের বিষয়সম্পত্তিও রক্ষা পেয়েছিল বৈকি। আবারও আমি ডা. কেচামের ডায়রি থেকে পড়ছি:

৮ই মে

দিনটা বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই শুরু হয়েছিল, কিন্তু শেষের দিকে একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। বিকেল চারটার দিকে খবর আসে মিলিটারিরা ডুলাহাজরার দিকে বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে। আমি আমার মোটরসাইকেলে লাফিয়ে উঠে দ্রুতই সেই গ্রামের ভেতরে গেলাম সেখানে কী হচ্ছে দেখার জন্য। মিলিটারি তখন চলে গেছে, তবে যাওয়ার আগে গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী এক হিন্দু পরিবারের বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। বাঁশের ঘর দুতিনটা পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে যায়, তবে কাদা ও সিমেন্ট দিয়ে বানানো মূল বসতভিটাটি তখনও টিকে ছিল। সেটাও জ্বলছিল, তবে তখনও কিছুটা অক্ষত ছিল। আমি সেখানে গিয়ে দেখি অন্তত জনাপঞ্চাশেক লোক বাক্সপ্যাটরার তালা ভেঙে লুটতরাজ চালাচ্ছে।

“কী করা যায়? নীতিগতভাবে আমার কিছু করা উচিত, আমি তাই কিছু লোককে দৈহিকভাবে বাধা দিয়ে, বাকিদেরও তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হই এবং দ্রুত হাসপাতালে গিয়ে একটা গাড়ি ও কিছু লোকজন নিয়ে আসি যতটা পারি তাদের জিনিসপত্র উদ্ধার করার জন্য। প্রতিবেশি পড়ে গেলে তাকে লাথি মারা বিষয়ে, একটা বাণীও প্রচার করি আমি। তারপর আমি তাদেরকে বলি যে, সব জিনিসপত্র হাসপাতালে তালাবদ্ধ করে রাখা হবে যতদিন না তার বৈধ মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া যায়, এই বলে আমি স্থানত্যাগ করি। হাসপাতালের কর্মচারীরা, ঈশ্বরের অশীর্বাদে, অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল সেদিন, যেহেতু আমি তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলাম।”

এটা অনেক ঘটনার একটি মাত্র যেখানে দেশিরা ডন ও ভিকের ওপর অবিশ্বাস্য আস্থা রেখেছেন। তাঁরা তাঁদের মূল্যবান জিনিসপত্র এনে হাসপাতালে রেখেছেন, একটা রশিদ পর্যন্ত চাননি তার জন্য। এঁরা আমেরিকানদের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের বেলায় একেবারে শিশুর মতো ছিল।

অন্য দিকে, ‘থাইল্যান্ডের আমেরিকান পর্যটকেরা’, তাদের সব চিন্তা ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ে, যে-তিনজন সেখানে পড়ে রয়েছেন তাঁদেরকে নিয়ে, আর কত তাড়াতাড়ি আবার সেখানে ফিরতে পারা যাবে, তা নিয়ে। [চলবে]


কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৪)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৩)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১২)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১১)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১০)

   

গড়তে চান বই পড়ার অভ্যাস?



মোঃ শরীফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

  • Font increase
  • Font Decrease

লাইব্রেরিগুলো আজকাল ফাঁকা পড়ে থাকে। ক্যাম্পাসের আড্ডায় বই, সে বড়ই হাস্যকর! বই পড়ার মতো সময় হয়ে ওঠে না কারোরই! আমাদের বর্তমান সময়টা কেড়ে নিয়েছে মোবাইল আর ইন্টারনেট। অথচ বই পড়ার গুরুত্ব কমবেশ সকলেরই জানা।

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য বই কতটা জরুরি সেটা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু একটি বই পড়ার জন্য যে সময় প্রয়োজন, প্রয়োজন উপযুক্ত স্থান। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, সঠিক বই নির্বাচন।

বই পড়া শুরুর ক্ষেত্রে নতুন পাঠকরা নানান সমস্যার সম্মুখীন হন। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পেরে অনেকের আর বই পড়াই হয় না। আজকের আলোচনায় আমরা জানব কীভাবে একটি বই পাঠ করা যায়, গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস।

সময়: বই পড়ার কথা বললেই সবাই এক বাক্যে বলবে, ‘সময় নেই!’ সময় নিয়ে আমাদের অভিযোগের বড় কারণ হলো, নিজের কাজগুলো গুছিয়ে না করা। প্রতিদিন মাত্র ২০-৩০ মিনিট সময় দিয়েই কিন্তু গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস। সময় না পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়া। তাই, সকাল কিংবা সন্ধ্যা হাতের ফোনটা দূরে সরিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বসে যান বই নিয়ে।

পরিবেশ: উপযুক্ত পরিবেশ বই পড়ার মনোযোগ বাড়িয়ে দেয়। জানালার পাশে, বেলকনিতে কিংবা বাসার ছাদে বই পড়ার স্থানটি যেন হয় নির্জন এবং শান্ত। আজকাল বিভিন্ন পার্কে ‘নীরব বই পাঠ কর্মসূচি’ দেখা যায়। চাইলে যোগ দিতে পারেন তাঁদের দলেও। বই পড়ার পাশাপাশি পরিচয় হবে বইপ্রেমী মানুষদের সাথে।

বই নির্বাচন: বই পড়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছে যেমন জরুরি তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক বই নির্বাচন। এক্ষেত্রে নিজের ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিন। যেসব গল্প আপনাকে আকর্ষণ করে শুরুতে সেই বইগুলোকেই আপনার পাঠ্য তালিকায় রাখুন। 

পাঠাগার: পাঠাগারে গেলেই যে বই পড়তেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বইয়ের সাথে সময় কাটালে এক সময় সেটা ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হবে। আর ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে কখন যে দু’য়েক পাতা পড়ে ফেলবেন, নিজেই টের পাবেন না! তাই বই পড়ার অভ্যাস গড়তে চলে যান পাঠাগারে। বই না পড়ুন, অন্তত সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা তো হবে!

সোশ্যাল মিডিয়া: আমরা সবকিছুতেই সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করি। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ার সুষ্ঠু ব্যবহার আপনার অভ্যাস গড়ার বড় সহায়ক। ফেসবুকে সাহিত্য তথা বই বিষয়ক বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনা হয়, হয় বই বিষয়ক আড্ডাও। এসব গ্রুপে যুক্ত হয়ে বাড়াতে পারেন বইয়ের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা।

ধারাবাহিকতা: বলা হয়ে থাকে টানা ২১ দিন কোনো কাজ করলে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। বই পড়ার ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। অভ্যাস গড়তে হলে ধরে রাখতে হবে ধারাবাহিকতা। সামান্য হলেও প্রতিদিন পড়ুন। এই ধারাবাহিকতায় আপনার বই পড়াকে অভ্যাসে পরিণত করবে। 

বই পড়ার অভ্যাস রাতারাতি তৈরি হবে না। এজন্য প্রয়োজন ধৈর্য্য এবং অধ্যাবসায়। নতুন পাঠকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছুদূর পড়ার পর বইটি আর ভালো লাগে না। এক্ষেত্রে ধৈর্য্যহারা হওয়া যাবে। জোর করে সে বই পড়ার প্রয়োজন নেই।

বই মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ায়। বই পড়ার অভ্যাস গড়তে পারলে জীবনে উন্নতি সাধন অবধারিত। একাডেমিক পড়ার বাইরেও বইয়ের বিশাল একটি জগত রয়েছে। সেই জগতে মানুষ জানার জন্য পড়ে, পড়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য। বই পড়লে মানসিক চাপ হ্রাস পায়, হয় মস্তিস্কের ব্যায়াম, বাড়ে শব্দ ভান্ডার ও স্মৃতি শক্তি। বই পাঠকের চিন্তার জগতকে বিস্তৃত করে, বৃদ্ধি করে বিশ্লেষণ ক্ষমতা। বই পড়ার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশ হয়। তাই বই হোক প্রত্যেক মানুষের উত্তম বন্ধু এবং বইয়ের সঙ্গে হোক আমাদের মিতালি।

;

মায়ের সমাধির খোঁজে



মহীবুল আজিজ
মায়ের সমাধির খোঁজে

মায়ের সমাধির খোঁজে

  • Font increase
  • Font Decrease

কন্ডাক্টরকে বললাম, এখানে নামিয়ে দিন,
এখানে এই মিয়াপাড়ায় আমি নামবো—
মিয়াপাড়া কবরস্থানে শুয়ে আছে আমার মা।
মায়ের কবর দেখতে এলাম আটান্ন বছর পরে,
জ্যাঠা বলেছিলেন, গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে একটু গেলে
একটা গোলাপ গাছ ঘেঁষে কবরটা,
কবরের আগে আমাকে গোলাপ গাছ খুঁজতে হয়—
জ্যাঠা চলে গেছেন তা-ও বত্রিশ বছর।
ডানদিকে ঘুরতেই জড়িয়ে ধরে তাজা গোলাপের ঘ্রাণ,
পাশাপাশি চারটা কবর, চারটাতেই গোলাপের পাহারা;
এত কবর এত কবর, কবরে ভর্তি কবরস্থান—
কোথায় শেষ শয্যা নিয়েছিলেন আমার মা!
হাওয়ায় পাতা দোলে গোলাপের, চারটাই একসঙ্গে,
চারটা গাছ থেকেই মুখবাড়ানো গোলাপ ডাক দেয়—
এইখানে এইখানে এইখানে—কোন্খানে!
উবু হবো কবরের মাটি নিতে
কিন্তু চারটাই ডানদিকে, চারটাই গোলাপের পাশে,
প্রতিটি কবর থেকে একটি একটি মুঠো নিয়ে
পলিথিনের চারটে ব্যাগে রাখি।
একবার মনে হয় প্রথমটাতে,
তারপর মনে হয় দ্বিতীয়টাতে,
আবার মনে হয় তৃতীয়টাতে
এবং মনে হয় চতুর্থটাতে সন্ধান রয়েছে মায়ের।
মা সুপ্ত থেকে যান অনির্দিষ্ট মাটিতে ,
তবে কোন্ মানবের মাটি ধরে রাখি বুকের কাছে!
ঠিক তখন বিস্ময়ের মতন একটি ফুটন্ত গোলাপ
গাছ থেকে ঝরে পড়ে দ্বিতীয় কবরে,
সংশয়ী মন বলে, তবে কী গোলাপই বার্তাবহ মায়ের!
অদৃষ্টে অবিশ্বাসী মন দোলে সংশয়ে,
তখন আরেকটি গোলাপ ঝরে পড়ে চতুর্থ কবরে।
অর্থাৎ দুই যোগ দুইয়ে এসে আমার আর হিসেব মেলে না,
জ্যাঠা বলেছিলেন, কবরটা গেটের ডানদিকে ঘুরতেই
এবং গোলাপের পাশে।
বত্রিশ বছরে চতুর্গুণ হয়েছে গোলাপ
কিন্তু এক ও অবিভাজ্য আমার মা’কে
এই গোলাপের কারণেই খুঁজে পাই না আমি—
ফিরে আসি শুধু গোলাপের ঘ্রাণ নিয়ে।

১১-০৯-২০২৩

;

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল



শরীফুল আলম
অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

  • Font increase
  • Font Decrease

 

আমি সীজার হতে চাইনি
তবুও তুমি ক্লিওপেট্রাই থেকে গেলে
অহেতুক লড়াইয়ে তুমি জয়ী হতে চেয়েছিলে
সম্ভবত একেই পরিযায়ী প্রেম বলে
আলো আঁধারীর খেলা বলে
স্বপ্ন আর জেগে থাকা বলে ,
সমাপ্তি কিম্বা বিবিধ, তা সে যাই হউক
এই সহজ কথাটি
আমরা কেউ কাউকে সহজ ভাবে বলতে পারিনি
অথচ তুমি ফ্রিজিডেয়ারটি বন্ধ করে রাখলে
আর বললে, "নোটেড ",

নিউইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
হ্যাঁ, এটাই সত্যি
তুমি লৌহশৃংখলে অনুজ্জ্বল এক ডিমলাইট
সুচারু মোহের অভাবে তুমি প্রমত্তা নদী
বাবুই পাখীর বাসার ন্যায় তুমি ঝুলে থাক আমার স্বপ্নে
যা হতে পারতো নির্মল এক সবুজের প্রান্তর ।

তুমি ওঁত পেতে থাকা বাঁশপাতার ফাঁকে পূর্ণিমা
আমি তোলপাড় করে ছুটে চলা এক্সপ্রেস ট্রেন
দলছুট শালিক,
আজ কোন বৈভব নেই
ভালোবাসাবাসি নেই ,
কবিতাও ইদানিং প্রিয় লাগেনা
তবু স্নায়ুরা জেগে থাকে
মনে হয় হলুদ পাতায় যেন ক্লোরোফিল
আমিও প্রবণতায় ফিরে যাই সাইবেরিয়া ।

আনচান মনে কত আকুলতা
কালবৈশাখীর তান্ডব
যেন বাতাসে কাঁপন ধরে,
এসো সখা,
এই শ্রাবণে আবার রিডিজাইন করি,
স্যাটেলাইটে প্যারালাল বার্তা পাঠাই
ভুলে যাই অর্ধেক রিয়েল আর অর্ধেক ভুল
প্লাবনে অবাধ্য ঢেউয়ের উছ্বল ।

________________________________________

 ৯ সেপ্টেম্বর । ২০২৩।
নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।

 

;

পাট পাতার পেলকা সজনে শাকের শোলকা



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সোনালী আঁশ বা পাটের দেশ বাংলাদেশ। এক সময় আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। পাটোয়ারী পরিবারগুলো তো বটেই মৌসুমি পাটের ব্যবসায়ীরাও সমাজে মযার্দা পেত। কারণ, যারা পাটের ব্যবসা করতেন তাদের হাতে থাকতো প্রচুর টাকা। তখন পাটকলে যারা চাকরি করতেন তাদের পরিবারেরও অনেক সচ্ছলতা ছিল। নাইলন ও পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হলে পাটের গুরুত্ব কমে যেতে শুরু করে। পাটের চট, রশি, শাড়ি আজকাল কেউ ব্যবহার করতে চায় না। দেশের বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলগুলোর বড় বড় যন্ত্রপাতি মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে প্রতি বছর গ্রীষ্মের শুরুতে পাট শাকের চাহিদা বেড়ে যায়।

কারণ, পাট পাতার বহুবিধ গুণ। পাট শাক তেতো ও মিষ্টি দুটোই সমভাবে মানুষের কাছে প্রিয়। পাট শাক দিয়ে তৈরি এক ধরণের জনপ্রিয় খাবারের নাম ‘পেলকা’। এই পেলকা ভাজা চালের গুঁড়ো, খাবার সোডা, কাঁঠালবিচি, গোটা রসুন ও কাঁচা মরিচ দিয়ে মিশিয়ে তৈরি করে সাদা ভাতের সাথে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। এই রান্নায় নানা ধরণের মশলা ব্যবহার করা হয়। যেগুলো বেশিরভাগ ঘরে তৈরি ভাজা উপকরণের ঢেঁকিছাটা সুগন্ধি গুঁড়ো বা শিলপাটায় পেষানো মিহি মশলা। সাধারণত: পেলকা ও শোলকা রান্নার আগে সরিষা, মেথি, ধনে, মৌরি, কালোজিরা ইত্যাদি ভেজে এই বিশেষ মশলা তৈরি করা হয়। সবকিছুর সংমিশ্রণে ভারী স্যুপের মতো করে সবুজ রংঙের এই রান্না সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। যার ফলে পেলকার স্বাদ হয় খুবই অনন্য ও লোভনীয়।

অনেকে পাটের মৌসুমে পেলকা খাওয়ার লোভে শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এই বিশেষ রান্নার আয়োজন করতে বায়না ধরে থাকেন। অনেকে পাট শাকের শুকতানি তৈরি করে শুকিয়ে সারা বছরের ভেষজ খাবার হিসেবে যত্ন সহকারে ঘরে সংরক্ষণ করেন। গ্রামের অনেকের কাছে পাট শাকের শুকতানি ভেজা পানি নানা রোগের মহাষৌধ হিসেবে বিবেচিত। অধুনা শহরের বহুতল ছাদ বাগানে পাট শাকের আবাদ করতে দেখা যাচ্ছে।

আরেকটি বিশেষ খাবারের নাম শোলকা। যেটি কচি সজনে পাতা দিয়ে তৈরি কর হয়। পাট শাকের তৈরি পেলকা মৌসুমি রান্না। কিন্তু সজনে পাতার তৈরি শোলকা সারা বছরব্যাপী রান্না করে খাওয়া যায়। বিশেষ করে বারোমাসী সজনে গাছ বাড়িতে থাকলে তো কোন কথাই নেই।

তবে কালের স্রোতে সৌখিন এসব খাবার হারিয়ে যেতে বসেছে। ব্যস্ত কর্মজীবি মানুষ আজকাল সামনে যা পায় তাই ঝট্পট খেয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। পেলকা ও শোলকা রান্নার মতো সময় ও ধৈর্য্যধারণ করার ক্ষমতা আজকাল গ্রামীণ গৃহবধূদেরও নেই। বাজার থেকে পাট শাক কিনে কোন শহুরে পরিবারে রান্না হলে বাচ্চারা সেটা তিতা বলে খেতে চায় না। কিন্তু বিদেশি তিতো চকোলেটযুক্ত দামি চকোপাই বা আইসক্রীম তাদের কাছে খুবই প্রিয়।

এভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে পাট পাতা ও সজনে পাতা দিয়ে তৈরি জনপ্রিয় খাবার দুটো। কিন্তু অবাধ ইন্টারনেটের এই যুগে আবারো পাট ও সজনে পাতা দিয়ে তৈরি বিশেষ খাবার নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছে। কচি পাট পাতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে শক্তিবর্ধক ভেষজ ওষুধ ও টনিক। আর সজনে পাতা ‘সুপার ফুডের’ তালিকায় নিজের নাম লিখিয়ে সারা বিশ্বে আলোড়ন তৈরি করে ফেলেছে।

একজন জাপানিজ গবেষক আফ্রিকা থেকে সজনে পাতা এনে গবেষণা করে এই মিরাক্কেল শাক থেকে ‘মরিঙ্গা পাউডার’ তৈরি করে এর বহুবিধ গুণ প্রচার করেছিলেন। সজনে গাছকে তিনি অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য উদ্ভিদ হিসেবে জানতেন। কিন্তু বাংলাদেশে ‘ড্রামস্টিক ট্রি’বা সজনে গাছ এত সহজলভ্য এবং এতটাই সুপরিচিত যে তিনি সেটা জানতে পেরে ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। সজনে পাতা নামক ‘সুপার ফুডের’প্রতি আমাদের দেশের মানুষের অজ্ঞতা ও অবহেলা তাকে খুবই বিস্মিত করে তুলেছিল।

সজনে পাতা নামক ‘সুপার ফুডের’ প্রচার ও এর চাহিদার দিকে লক্ষ্য করে আজকাল সজনে বাগান তৈরির হিড়িক পড়ে গেছে। সজনে বাগান কেন্দ্রিক কারখানা গড়ে উঠেছে। সেসব কারখনায় মহিলা শ্রমিক সহ অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সজনে পাতার পাউডার—এর ব্যাপক গুণকীর্তন চালু থাকায় বাজারে এর চাহিদা বেড়ে গেছে বহুগুণ।

প্রচারে প্রসার—এই তত্ত্ব যেন সজনে পাতাকে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। সাইবার জগতের এই বিরাট সাড়া আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোন জাগরণ তৈরি করেছে কবলে মনে হচ্ছে না। আগেকার দিনে পাট পাতা ও সজনে পাতা দিয়ে নানাব্যঞ্জন রান্না করা হতো। পরিবারের সদস্যরা সেগুলো মজা করে খেতেন। তাই তখন এত রোগ—বালাই হতো না। এটি মূলত: একটি সাধারণ প্রচলণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ।

আজকাল মানুষ কৃত্রিম খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বিভিন্ন ক্ষতিকর কেমিক্যাল ও বাহারি রং মেশানো খাবার পাতে না হলে আধুনিক মানুষের মন ভরে না। আধুনিক মশলার মধ্যে আসলে কি কি উপাদান মিশ্রিত রয়েছে তা যাচাই করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। ভেজালের এই যুগে বিএসটিআই—এর প্রতীক লাগানো কতকিছুই হরদম জব্দ করে জরিমানা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে উন্নয়নের অতিপ্রচার দেখে বিদেশিরা বাংলাদেশের দিকে ঘন ঘন তাকানো শুরু করেছে। তবে ঋণ ও ক্ষমতা লাভের জন্য তাদের দিকে আমরা আরো বেশি করে তাকিয়ে থাকি। এই পরনির্ভরশীলতা আমাদেরকে আরো বেশি পঙ্গু করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এবছর দেশের একদিকে দারুণ খরা, অন্যদিকে হঠাৎ বন্যা শুরু হয়েছে। কেউ বষার্কালে গভীর নলকূপের পানিতে সেচ দিয়ে রোপা আমন ধানের চারা লাগাচ্ছে আবার কারো বীজতলা তলিয়ে গেছে ঢলের পানিতে। এরই মাঝে এডিস মশা দেশের সব জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়ায় সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২৩ পর্যন্ত রেকর্ড সংখ্যাক ৬৫৭ জন মারা গেছেন। মফস্বলের হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে জীবন বাঁচাতে হন্যে হয়ে ছুটে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার দিকে।

ঢাকায় গিয়ে হাসপাতালের বেডে জায়গা না পেয়ে মেঝে, বারান্দায়, ওয়েটিং রুমে মাদুর পেতে রোগী নিয়ে শুয়ে আছেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যখন কোন জটিল রোগীর জন্য জরুরি ভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজন তখন। মফস্বল থেকে আসা অধিকাংশ রোগীর আত্মীয়—স্বজন রক্ত দেয়ার ব্যাপারে সজাগ নন। রক্ত দেয়ার কথা শুনলেই তারা অনেকে আঁৎকে উঠেন। কেউ কেউ কান্নাকাটি শুরু করে দেন। এছাড়া বাইরে থেকে রক্ত সংগ্রহ, খরচ বহন ইত্যাদির জন্য তারা মোটেও প্রস্তুত নন।

এরই মাঝে রাজপথের একটি লেনে একটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের মিছিলের লম্বা লাইন যখন ৪—৫ মাইল লম্বা হচ্ছে তখন পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে সরকারি দলও অপর দিকের বাকি লেনটি দখল করে মিছিল শুরু করে দিচ্ছে। ডেঙ্গুর হটস্পট রাজধানী ঢাকায় সারা দেশ থেকে ভাড়ায় মানুষ ডেকে এনে সম্মেলন ও মিছিল করাচ্ছে সরকারি দলও! এর ফলে প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ ডেঙ্গু।

অন্যদিকে দেশে কেউ যেন কিছকেইু ঠিকমতো পাত্তা দিতে চাচ্ছে না। স্থানীয় জনগণের উপলব্ধিকে পাত্তা না দেয়া আমাদের দেশজ উন্নয়ন অবনমনের প্রধান কারণ বা অন্তরায় হিসেবে আবিভূর্ত হয়েছে। এদেশে কেউ তার নিজের দোষ সহজে স্বীকার করতে অভ্যস্ত নয়। তাই মিথ্যা-জালিয়াতির বেসাতিতে বিপদ বেড়েই চলেছে চারদিকে। সেজন্য অতিদ্রুত পারস্পরিক দোষারোপ ও পরনির্ভরশীলতা পরিহার করে দেশজ তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক গবেষণা করে, দেশজ সম্পদ রক্ষা করতে হবে।

আমরা যখন ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা মেনে ঘুমিয়ে থাকি তখন অন্যেরা এসে ধরে উজাড় করে দেয়। আমরা যখন জাল ফেলি তখন নদী মাছশূন্য। বিদেশি লুটেরাদের হাতে উজাড় হচ্ছে জাতীয় মৎস্য সম্পদ। ইলিশ মাছের শুধু এক ভিডিও সব ইউটিউবারদের ‘তুমি সুড়ংঙ্গে’ ছড়াছড়ি। অথচ ইলিশের এই ভরা মৌসুমে কাঁচাবাজার ইলিশ শূন্য। বাড়ছে অবৈধ রোহিঙ্গা অভিবাসীদের ফুলে ফেঁপে উঠা সংখ্যার মতো বিষফোঁড়া। মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে ইয়াবা আসা বন্ধ হলে শুধু কক্সবাজার জেলাতেই দশ হাজার মানুষ বেকার হয়ে যাবে বলে ভাষ্য দেন কোন বিচারক!

খুব দ্রুত আধুনিক হবার জন্য শোলকা পেলকার মতো দেশজ খাবার ত্যাগ করে যখন দুর্বল শরীর নিয়ে কালাতিপাত করছি ঠিক তখন জাপানিজ গবেষকের উদ্ভাবিত সজনে পাতার পাউডার আমাদেরকে নবজীবন দান করতে পারবে বলে সেই আশায় সেদিকে হন্যে হয়ে দৌড়াচ্ছি। তবে শোলকা—পেলকার মতো দেশজ খাবার গ্রহণ করে মেরুদণ্ড সোজা করে চলতে শুরু না করলে বৈশ্বিক উজানের হঠাৎ ঢল এসে সাতকানিয়ার নতুন রেললাইন বাঁকা করে দেয়ার মতো ঘটনা আরো ঘন ঘন জেঁকে বসতে থাকবে বৈ—কি?

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

 

;