ঘরে থাকার উপহার পৌঁছে দিচ্ছে ছাত্রলীগ

  বাংলাদেশে করোনাভাইরাস


স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রংপুর
ছাত্রলীগের উদ্যোগে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ

ছাত্রলীগের উদ্যোগে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রাণঘাতী করোনার সংক্রমণ রোধে সরকারি বিধিনিষেধ মেনে ঘরে থাকা কর্মহীন নারী-পুরুষদের খাদ্য সহায়তা দিয়েছে রংপুর জেলা ছাত্রলীগ।

সোমবার (১৩ এপ্রিল) রাতে রংপুর নগরের মুলাটোল পাকারমাথা হকের গলি ও সেনপাড়ার কর্মহীন একশ' পরিবারকে ঘরে থাকার উপহার স্বরুপ খাদ্যসামগ্রী বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেন ছাত্রলীগ নেতারা।

রাতের বেলা ঘুম থেকে উঠে ত্রাণ সহায়তার প্যাকেট হাতে পেয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন কর্মহীন এসব মানুষ।

করোনা সংক্রমণ এড়াতে ঘরের বাইরে বের না হয়ে সবাইকে নিজের পরিবার, প্রতিবেশী, সমাজ ও দেশের স্বার্থে ঘরে থাকতে আহ্বান জানান রংপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান সিদ্দিকী রনি।

তিনি বলেন, করোনার বিরুদ্ধে সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই যুদ্ধ জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ঘরে থেকে ভালো থাকার যুদ্ধ। সরকার জনগণের মঙ্গলের জন্যই সবাইকে ঘরে থাকতে উদ্বুদ্ধ করছে। খাবার নিয়ে চিন্তা না করে ঘরে থাকুন। ঘরে থাকার উপহার বাড়ির দরজায় পৌঁছে যাবে।

খাদ্য সহায়তা প্রদানকালে রংপুর জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শরিফুল ইসলাম শরিফ, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা পারভেজ জিয়ন, সাংগঠনিক সম্পাদক আদনান হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

গেল দুই সপ্তাহে রংপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও মহানগর এলাকায় প্রায় দেড় হাজার কর্মহীন, হতদরিদ্র, দিনমজুর, শ্রমিক, দুস্থ পরিবারের মধ্যে চাল, ডাল, তেলসহ প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেট বিতরণ করেছে ছাত্রলীগ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়ে আসা পর্যন্ত করোনা যুদ্ধে ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা।

   

পুরুষের সমান কাজ করেও কম মজুরি নারীদের 

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
পুরুষের সমান কাজ করেও কম মজুরি নারীদের 

পুরুষের সমান কাজ করেও কম মজুরি নারীদের 

  • Font increase
  • Font Decrease

পুরুষদের সমান সারাদিন মাঠে রোদে পুড়ে কাজ করি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির কাজ শেষ করে এখানে কাজে আসতে হয়। স্বামী দুই বছর আগে মারা গেছে, এখন অভাবের সংসারে দুই মেয়ে নিয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতেও ২৫০ টাকা মজুরি পেয়ে কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে সংসার চলে— এভাবেই বলছিলেন ইটভাটার শ্রমিক খাদিজা বেগম।

খাদিজা বেগম নীলফামারী সদরের কচুকাটা বন্দরপাড়ার মৃত আজগার আলীর স্ত্রী ও দুই সন্তানের জননী। 

খাদিজা বেগমের পরিশ্রমে দুই মেয়ে ও তার মুখে দুমুঠো ভাত উঠে। পুরুষের সমান কাজ করেও অর্ধেক মজুরি পান তিনি। বর্তমান সমাজে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারি-বেসরকারিভাবে সভাসেমিনার করা হলেও পাঠ পর্যায়ে নেই এর প্রতিফলন। কর্মক্ষেত্রে নারীদের বেতন বৈষম্য দূরীকরণের নেই কোন পদক্ষেপ। তবে দেশের শিক্ষা, কৃষি, অর্থনীতিসহ সব সেক্টরে নারীর পদচারণা রয়েছে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে নারীর হাতের ছোঁয়ায় কৃষিতে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।

জেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে জানা যায়, নারীরা পুরুষের মতই ফসলের পরিচর্যা, তামাকের মিল কাজ, ধানের চারা রোপণ, মাটি কাটা, সড়ক সংস্কারের কাজ করেন। পুরুষের সাথে সমানতালে কাজ করলেও বেতন পান অর্ধেক। পুরুষেরা দিন শেষে পেয়ে থাকেন ৫০০ টাকা, আর নারীরা ২৫০ টাকা। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করেও বেতন বৈষম্যের শিকার তারা।


জেলা শ্রমিক উন্নয়ন সংগঠনের তথ্যমতে, জেলায় প্রায় দশ হাজার নারী বাসা-বাড়ি, কৃষি, হোটেলসহ বিভিন্ন স্থানে কাজ করছেন। তাদের মধ্যে কৃষি ও হোটেল বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা নারীরা বেতন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। 

এ-বিষয়ে খাদিজা বেগম আরও বলেন, অভাবের সংসারে অর্ধেক বেতন, খুব কষ্টে আছি । আমার মত অনেক নারীই পুরুষের সমান কাজ করেও অর্ধেক মজুরি পায়। আমরা পুরুষদের সাথে সমান তালে কাজ করি তবুও আমাদের বেতন কম দেওয়া হয়। সমান বেতন হলে ভালোই সংসার চলত।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা রহিমা বেগম বলেন, আমাদের ছুটি নেই। কাজে না এলে মজুরি নেই। বাজার, কেনাকাটা, থাকা, সব নিজেদের। কিছু সময় শরীরের অবস্থা এত নাজুক থাকে যে বাকি সময় অন্য কোনও কাজ করার ক্ষমতা থাকে না। এ কাজ করে কোনোমতে সংসার চলে।

নীলফামারী জেলা শ্রমিক উন্নয়ন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আজহারুল ইসলাম বলেন, নারী-পুরুষ একসাথে কাজ করে, তবু মালিকরা তাদের কম মজুরি দেয়। আমরা বিভিন্ন সময়ে সভায় তাদের সমান মজুরি দেওয়ার দাবি করি। নারী পুরুষের সমান মজুরি দিতে আমরা আগামীতে বিভিন্ন কোম্পানির মালিকদের সাথে বসব৷

নীলফামারী জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, সরকারি কাজ টিআর, কাবিখা, কর্মসৃজনসহ বিভিন্ন প্রকল্পে নারী পুরুষের সমান মজুরি দেওয়া হয়। বেসরকারি ও মালিকানাধীন কাজেও নারী পুরুষের সমান মজুরি এবং বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করছি।

  বাংলাদেশে করোনাভাইরাস

;

আমাদের আবার মে দিবস

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



এসএম জামাল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কুষ্টিয়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমাদের আবার মে দিবস! কাজে আসলে কাজ শেষে ট্যাকা (টাকা) পাই, আবার কাজে না আসলে ট্যাকা নাই। আমরা অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে থাকলেও কেউ দেখে না, খবরও নেয় না। ইটভাটা মালিকও খবর নেয় না। এই আমাদের কষ্টের জীবনে আবার মে দিবস। এসব দিবস-টিবস আমরা বুঝি না।

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মশান এলাকার ইটভাটা শ্রমিক মহিন উদ্দিন। তার বাড়ি মিরপুর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে।

বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন তিনি। আগে ইট মাথায় করে আনা নেওয়ার কাজ করতেন, এখন ইট তৈরিতে পারদর্শী তিনি। প্রতি হাজার ইট তৈরি করলে পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন ৮শ' টাকা। এক্ষেত্রে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আবার একটু বেশি পাওয়ার আশা রাত অবধি কাজ করেন তিনি। তাতে করে কোন কোন দিন এক হাজার টাকা আয় করে থাকেন।

আজ মহান মে দিবস। দিনটা শ্রমিকদের। ‘শ্রমিক-মালিক গড়বো দেশ; স্মার্ট হবে বাংলাদেশ’- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সারা দেশে পালিত হচ্ছে এই মে দিবস। কিন্তু সে হিসেব নেই গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর যারা সত্যিকার অর্থে শ্রমিক। এই বিশেষ দিনেও কাজ করেই যাচ্ছেন এসব ইটভাটা শ্রমিকরা।


তবে এই মে দিবস পালন কেবল জেলা ও উপজেলা শহরেই করে থাকে সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা যখন ছুটিতে, তখন ইটভাটা শ্রমিকরা গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদের মধ্যে কাজ করে থাকেন। সকাল পেরিয়ে দুপুরের খরতাপে মাথা থেকে কপাল চুইয়ে মুখ গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। সারা শরীর জবজবে ভেজা। জীর্ণশীর্ণ শরীরটা দেখলেই বোঝা যায় কেমন খাটুনি খাটতে হয় তাদের।

মঙ্গলবার দুপুরে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইটভাটায় গিয়ে শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞের এমন চিত্রই দেখা গেল। তারা জানালেন, ইটভাটায় অমানবিক কষ্টের কাজেও এ হাসি-খুশিটাই তাদের জীবনকে সচল রেখেছে।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুখে হাসি নিয়ে কাজ করলেও তাদের দুঃখের সীমা নেই। একে তো স্বল্প মজুরি, তার উপর বছরের অর্ধেকটা সময়ই কাজ থাকে না, বাকি সময়টা খুঁজতে হয় অন্য কাজ। তারপরও পেটের জ্বালায় বারবার ফিরে আসেন এই ঘাম ঝরানো শরীর পোড়ানো কাজে।

এসব শ্রমিকদের সাথে মে দিবস নিয়ে আলাপ করলে তারা জানান, মে দিবস কী? মে দিবসের ছুটির কথা শুনে তারা শুধু হাসেন। সমাজের অনেকে হাসতে না জানলেও খেটে খাওয়া এ শ্রমিকরা প্রাণ খুলে হাসতে জানে! তারা ইটভাটা শ্রমিক, মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরিতে দিনভর শ্রম দেন তারা। সবারই এক কথা কাজ করলেই টাকা কাজ না করলে টাকা নেই। তাই আমাদের এই মে দিবসেও ছুটি নেই।

ইটভাটা শ্রমিক মিনারুল ইসলাম বলেন, সকালে কাজ শুরু করি। শেষ করার কোনো সময় নেই। সর্দার যতক্ষণ মনে করেন কাজ করান। কিন্তু বেশি কাজ করলেও বেশি টাকা দেয় না। প্রতিবাদ করলেই বাদ দিয়ে দেয়। তাই দিনশেষে মজুরি ওই ৫০০ টাকাই। এ দিয়ে চাল-ডাল, তরি-তরকারি কিনতে গেলে পকেটে আর কিছু থাকে না। এভাবেই দিন যায়, বছর ঘুরে। বাজারে সব কিছুর দাম বাড়লেও, মজুরি বাড়ে না’।

শাহীনসহ আরও বেশ কয়েকজন শ্রমিক জানান, বছরের ছয় মাস ইটভাটাগুলোতে পুরোদমে কাজের ব্যস্ততা থাকে। আর বাকি ছয় মাস কেউ ক্ষেতে-খামারে কাজ করেন। আবার কেউ বা রিকশা, ভ্যান, ভাড়ায় অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। আবার অনেকে বেছে নেন রাজমিস্ত্রি জোগালি কিংবা দিনমজুরির কাজ।

শ্রমিকরা জানান, বছরের নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ইট বানানোর কাজ করতে হয় তাদের। আর এই কাজটি চুক্তি ভিত্তিতে হয়ে থাকে। এ কাজে আসতে হয় মাঝির (সর্দার) মাধ্যমে। পুরো ছয় মাসের জন্য মালিকের হয়ে মাঝিই শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেন।

ইট পোড়ানোর জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করছিলেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক। কথা হয় মানিক আলী নামের এক শ্রমিকের সঙ্গে। তার বাড়ি মিরপুর উপজেলা খন্দকবাড়ীয়া এলাকায়।

মজুরি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মানিক আলী বলেন, রোদে শুকানো ইটভাটার কাছ থেকে ক্লিনের ভেতর আনা এবং সারিবদ্ধ করে কাঁচা ইট সেটিং করা, সেই কাজে মজুরি প্রতি হাজার ইটে ১৫০ টাকা। প্রতি চেম্বার ১৫ হাজার ইট দিয়ে সাজানোর জন্য অন্তত ১০-১২ জন শ্রমিক দরকার হয়। দিনশেষে এসব শ্রমিকের আয় হয় ৪৫০-৫৫০ টাকা।

এভাবেই ধাপে ধাপে প্রক্রিয়া শেষ করে সেসব ইট পোড়ানোর পর তা বাজারজাতকরণ করা হয়ে থাকে। ট্রলিতে করে ইটভাটা থেকে এসব ইট বাড়ি পৌঁছানোর জন্য ট্রলি প্রতি হাজারে ৩৫০-৫০০ টাকা নিয়ে থাকেন ট্রলি চালকরা। প্রতি ট্রলিতে ২ হাজার ইট নেওয়া যায়।

ভাটার ইট ট্রলিতে করে ক্রেতার বাড়ি পৌঁছে দেন জসিম উদ্দিন। মিরপুর উপজেলার বলিদাপাড়া এলাকায় বাড়ি তার। তিনি জানান, আমি ট্রলিচালক। সাথে আরেকজনকে নিয়ে ট্রলিতে ইট উঠানো ও নামানোর কাজ করি। শ্রমিক দিবস কী জানি না। মাসে ১০-১২ হাজার টাকা আয় করি এবং আমার সাথে যে থাকে তারও আয় ৭ হাজার টাকা হয়। কাজ থাকলে ভোর ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ও কাজ করি। তখন বেশি টাকা পাই।

মেসার্স এমবিএ ব্রিকসের মালিক মুকুল বলেন, শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্দারের সঙ্গে চুক্তি করতে হয়। সর্দার প্রয়োজন অনুযায়ী শ্রমিক নিয়োগ করেন। শ্রমিকদের নিয়োগ, মজুরি, ছুটি সব সর্দারই দেখেন।’

এবি ব্রিকসের ম্যানেজার আজাদ জানান, গতবারের থেকে এ বছর ইটের দাম কম। গতবছর ১০ হাজার টাকা ইট বিক্রি হলেও এ বছর ৮ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। ফলে বেশ লোকসানে পড়তে হচ্ছে আমাদের।


তিনি বলেন, আগে শ্রমিকদের অল্প টাকা আয় হলেও এখন বেড়েছে। আগে যেসব শ্রমিক আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা উপার্জন করতো, এখন তারা ৬শ টাকা থেকে কেউ কেউ ১ হাজার টাকাও আয় করছে।

জাতীয় শ্রমিক লীগ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও শ্রমিকনেতা আমজাদ আলী খান বলেন, অনেক সংগঠন রয়েছে। তবে ইটভাটায় কর্মরত শ্রমিকদের কোন সংগঠন নেই। যদিওবা নির্মাণ শ্রমিক নামের একটা সংগঠন রয়েছে। তবে ইটভাটার শ্রম সংগঠন না থাকায় নির্যাতিত নিষ্পেষিত হতে হয় তাদের। যারা ঘাম ঝরিয়ে শ্রম দিয়ে যায় তারাই হলো শ্রমিক। মূলধারার শ্রমিকদের থেকে কোন অংশেই কম নয় এসব ইটভাটার শ্রমিক। আগামীতে তাদের নিয়েও পরিকল্পনা করা হবে। যাতে তারা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।

কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. এ এস এম মুসা কবির বলেন, যারা ইটের ভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তাদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়। দিনের বেলা রোদ উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নিচে কাজ করতে হয় তাদের, রয়েছে কয়লা কিংবা কাঠের আগুনে ইট পোড়ার তীব্র তাপ। ইটভাটায় কাজ করা এসব শ্রমিকদের কোনো ভালো আবাসস্থল থাকে না। ইটভাটার পাশেই টিন দিয়ে ছাপরা ঘর তুলে কোনোমতে তাদের রাত পার করতে হয়। স্বাস্থ্য সচেতনতা না থাকায় তারা কিছুদিন পর পর অসুস্থ হয়ে পড়েন।

এই তীব্র গরমে আধা ঘণ্টা পরপর পানি পানের পরামর্শ এবং তপ্ত দুপুরে কাজ না করার পরামর্শ দেন তিনি।

আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর, কুষ্টিয়ার উপ-পরিচালক মো. জহিরুল হোসেন বলেন, কুষ্টিয়াতে ইটভাটা শ্রমিক সংগঠন নেই। চাইলে যে কেউই ট্রেড বা শ্রমিক সংগঠন করতে পারে। ইটভাটায় শ্রমিকরা চরমভাবে ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হলেও শ্রমিকরা পেটের দায়ে রোদে পুড়ে এ কাজ করছে। তাদের নেই সাপ্তাহিক ছুটি, নেই কোনো নিয়োগপত্র, নেই কোনো কর্মঘণ্টা, শ্রমিক রেজিস্ট্রার নেই, নেই ছুটির রেজিস্ট্রার, নেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা উপকরণ। তারা এখনো জানে না মে দিবস কী।

সুনির্দিষ্ট শ্রম কাঠামোতে আনা হলে এসব শ্রমিক উপকৃত হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কুষ্টিয়ার ৬টি উপজেলায় মোট ইটভাটার সংখ্যা ১৯১টি।

  বাংলাদেশে করোনাভাইরাস

;

বেনাপোল বন্দরে পণ্য খালাসে সুরক্ষা সামগ্রী পায় না শ্রমিকেরা



আজিজুল হক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বেনাপোল(যশোর)
বেনাপোল বন্দরে পণ্য খালাসে সুরক্ষা সামগ্রী পায় না শ্রমিকেরা

বেনাপোল বন্দরে পণ্য খালাসে সুরক্ষা সামগ্রী পায় না শ্রমিকেরা

  • Font increase
  • Font Decrease

বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের বেনাপোল বন্দরে শ্রমিকদের বড় ভূমিকা থাকলেও তাদের ভাগ্য উন্নয়নে কথা রাখেনি কেউ। এমনকি নিরাপদে পণ্য খালাসের সুরক্ষা সামগ্রীও জুটে না তাদের। ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত, দূষিত পরিবেশে স্বাস্থ্য ঝুঁকি আর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে সারাবছর কাজ করতে হয় তাদের। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছেন তারা।


জানা যায়, স্থলপথে ভারতের সাথে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যে হয় বেনাপোল বন্দর দিয়ে। আমদানির পরিমাণ বছরে ৪০ হাজার কোটি, আর রফতানি ৮ হাজার কোটি টাকা। বন্দরে এসব পণ্য খালাসের সাথে জড়িত রয়েছে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের কেন্দ্র বন্দরটি। আর এ রাজস্ব আহরণে বড় ভূমিকা রাখছে বন্দরশ্রমিকরা। সপ্তাহে ৭ দিনে ২৪ ঘণ্টা পণ্য খালাসের কাজ করতে হয় তাদের। শ্রমিকদের সুরক্ষা সামগ্রীর অভাবে ভারী মালামাল থেকে শুরু করে এসিডের মত পণ্য উঠানো-নামানোর কাজ করতে হয় ঝুঁকি নিয়ে। পরিবেশ দূষণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি তো আছেই। বন্দরে আগুন লাগলে নেভাতেও বড় ভূমিকা থাকে এই শ্রমিকদের। ভারী পণ্যের চাপায়, এসিডে পুড়ে জীবনও হারিয়েছে কয়েকজন। কাজের নিরাপত্তায় হেলমেট আর গ্লাভসের দাবি থাকলেও এ পর্যন্ত সরবরাহ করেনি সংশ্লিষ্টরা। পায়নি চিকিৎসা সেবায় প্রত্যাশিত হাসপাতাল। নেই বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা।


বন্দর পরিদর্শনে এসে অনেকেই শ্রমিকদের ভাগ্য উন্নয়নে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও এ পর্যন্ত কথা রাখেনি কেউ, এমন ক্ষোভ রয়েছে শ্রমিকদের।

কয়েকজন বন্দর শ্রমিক জানান, ভারী পণ্য খালাসে নিরাপত্তামূলক সরঞ্জাম মেলে না। খালি হাতে এসিড ও হেলমেট ছাড়া পাথর খালাস করতে হয়। ন্যায্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত।

বেনাপোল হ্যান্ডলিংক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অহিদুজ্জামান ওহিদ বলেন, বেনাপোল বন্দরে আমদানি, রফতানি পণ্য উঠানো-নামানোর কাজে ৯২৫ ও ৮৯১ দুটি শ্রমিক ইউনিয়নের অধীনে প্রায় ২ হাজার শ্রমিক রয়েছে। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে বন্দরশ্রমিকদের ভূমিকা বেশি। তাদের অধিকার বাস্তবায়নে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।


বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামছুর রহমান বলেন, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিদাওয়া পূরণে সংশ্লিষ্টদের আরও আন্তরিক হতে হবে।

বেনাপোল বন্দর পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, ইতিমধ্যে শ্রমিকদের জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও বিশ্রামে ব্যবস্থা করা গেছে। বন্দরে শ্রমিকসহ সর্বসাধারণের জন্য একটি হাসপাতাল ও স্কুল তৈরির জন্য জায়গা অধিগ্রহণে কাজ চলমান আছে।

  বাংলাদেশে করোনাভাইরাস

;

‘শ্রমিকদেরকেও উন্নয়নের হিস্যা দিতে হবে’

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

নারী অধিকারকর্মী ও আলোকচিত্রী তাসলিমা আখতার বলেছেন, উন্নয়নের ভাগীদার যদি শ্রমিকরা না হন তবে সেই উন্নয়নকে টেকসই উন্নয়ন বলা যাবে না। শ্রমিকদেরকেও তাদের উন্নয়নের হিস্যা দিতে হবে।

‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড ২০১৪’ বিজয়ী খ্যাতিমান এই আলোচত্রী ও আলোকচিত্র সাংবাদিকতার শিক্ষক মনে করেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সব কিছুর দাম বাড়ছে, এটা সবাই স্বীকার করছে। কাপড়-সুতা-বিদ্যুত সবকিছু বেশি দামে কিনছেন, শুধুমাত্র শ্রমিকের শ্রমটা কম দামে কেনা হচ্ছে। এটা তো হতে পারে না।

মহান মে দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে বার্তা২৪.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তাসলিমা আখতার। কথা বলেছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।

বার্তা২৪.কম: আমাদের রাষ্ট্র শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় কতটা সচেষ্ট হতে পেরেছে?

তাসলিমা আক্তার: মে দিবসের ১৩৮ বছর হতে চললো। এই দিবসের সূচনাই হয়েছিল শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা শ্রমের স্বীকৃতির দাবিতে। আমরা যদি বাংলাদেশের দিকে তাকাই, রাষ্ট্র কতটা শ্রমিকবান্ধব তা বোঝার চেষ্টা করি, শ্রমিকদের অবস্থার দিকে তাকালেই তা বোঝা যাবে। ১৩৮ বছরেও এখন পর্যন্ত কাগজে-কলমে ৮ ঘন্টা কাজের স্বীকৃতি আছে। কিন্তু বাস্তবে কি বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিক বা অন্য শ্রমিকরা ৮ ঘন্টা কাজ করে বাঁচার মতো মর্যাদাপূর্ণ মজুরি পান? ৮ ঘন্টার পরেও তাদের বাধ্যতামূলক ওভারটাইম করতে হয় এবং শ্রমিকদের বলার কোন সুযোগই থাকে না যে তারা বলবে, ‘আমি কাজ করব না’। কেউ যদি বলে ওভারটাইম করবে না, তাহলে তার চাকুরি থাকবে না। এটা একটা ব্যাপার আবার ওভারটাইম না করলে সে বাঁচতেও পারে না। শ্রমিকরা আসলে ৮ ঘন্টা কাজ করে না, শ্রম আইন অনুযায়ী ১২ ঘন্টা কাজ করতে পারে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে শ্রমিকরা ১৪-১৫ ঘন্টাও কাজ করে। তাহলে এই রকম একটা অমানুবিক জীবন-যাপন আমাদের শ্রমিকরা করছে। যেখানে ৮ ঘন্টা কাজ করে মর্যাদাপূর্ণভাবে বাঁচা যায় না। এই রকম একটা পরিস্থিতিতেই আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, মালিকরা এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সেই ১৩৮ বছর আগে শিকাগোতে যে শ্রমিকদের দেখা গিয়েছিল-মনে হয় যেন সেই শ্রমিকরাই আমাদের দেশে অন্যভাবে আছেন। রাষ্ট্রের শ্রমিকদের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি তাকে মানুষ হিসাবে, নাগরিক হিসাবে মর্যাদা দেওয়ার সেটা না দিয়ে শ্রমিকদের কেবল মেশিন হিসাবে দেখা হয়। মানুষ হিসাবে গণ্য করা হয় না। বর্তমান পরিস্থিতিটা এই দাঁড়িয়েছে।

বার্তা২৪.কম: শ্রমজীবী মানুষের অধিকারকে সংহত না রেখে আমরা কি উন্নত দেশে পৌছাতে পারব?

তাসলিমা আক্তার: এখন উন্নয়নের সংজ্ঞা যাঁরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছেন তাদের কাছে এক রকম, যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক আছেন তাদের কাছে একরকম। আমরা তো মনেকরি, শিল্পমালিক বা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাঁরা আছেন তাদের ব্যক্তিগত উন্নয়ন দিয়ে তো আর উন্নয়নের মাপকাঠি নির্ধারণ করা সম্ভব না। একটা দেশের কতটা উন্নয়ন হয়েছে তা বড় সেতু বা মেট্রোরেল দেখিয়েই হবে না। সেতু বা মেট্রোরেল নিশ্চয়ই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেগুলোর সঙ্গে যদি আমাদের দেশের যাঁরা সেতু তৈরি করছেন, মেট্রোরেল তৈরি করছে যে শ্রমিকরা-তাদের জীবনটা আসলে কোন জায়গায় আছেন? তারা কি অবস্থার মাঝে আছেন? আমাদের দেশের যে শ্রমিকরা অর্থনীতিতে বা বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে তারা কতটুকু দাম পাচ্ছেন? সেই জায়গাগুলো দেখলে আমার মনে হয় যে আমাদের যারা শিল্প মালিক বা সংসদ সদস্য যারা আছেন-তাদের জীবনমান ও অর্থনৈতিক অবস্থার যতটা উন্নয়ন হয়েছে, অন্যদিকে দেশের আপামর শ্রমজীবী মানুষের জীবনের উন্নয়ন কিন্তু ঘটেনি। যদি ঘটতো তাহলে আজকে দেখা যেত, আমরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি ২৫ হাজার বা ৩০ হাজার দাবি করেছিলাম, আমরা এটা থেকে দর কষাকষি করতে চেয়েছি। কিন্তু দেখা গেল সাড়ে ১২ হাজার টাকা করা হয়েছে যা আমাদের প্রস্তাবের ধারেকাছেও নেই। এই বেতনে শ্রমিকদের পক্ষে বেঁচে থাকাই মুশকিলজনক। শ্রমিকরা যে বেতন পাচ্ছেন, তাদের তো ৮ ঘণ্টা কাজ করলে চলছে না। এখন তাদের কাজের চাপ-টার্গেটের চাপ এত বাড়ানো হয়েছে, তাতে আগে শ্রমিকদের যতটা ক্লান্ত-অবসন্ন দেখতাম কাজের চাপে; এখন তাকে আরও ভয়াবহ ক্লান্ত দেখি। এখন অনেক সময় শ্রমিকদের সূর্যের আলোটা দেখার সুযোগও হয় না। এ রকম একটা অবস্থার মধ্যে শ্রমিকরা আছেন। এই মজুরি বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের জীবনের কোনো বিশেষ পরিবর্তন আসলে হয়নি। সে তো তার বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো, ভালো বাসায় থাকা-তিন বেলা ভালো খাওয়া বা ঘুমানো কিছুই করতে পারছে না। তাকে ৮ ঘন্টার বেশি কাজ করতে হচ্ছে এবং এমন একটা অবস্থা...রাত পর্যন্ত কাজ করে এসে বাসায় কাজ করে; তারপর রাতে ঘুমাতে পারে না বিদ্যুত না থাকায়। মধ্যবিত্তরা তো এক রকম অবস্থার মধ্যে থাকেন। শ্রমিকরা তো ভয়াবহ দূর্ভোগের মধ্যে জীবনযাপন করছে। উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে পোশাক কারখানার মালিকরা বলেন, আমাদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কারখানা ভবন আগের চেয়ে অনেক টেকসই ও নিরাপদ হয়েছে। আমরাও মনে করি যে এগুলো ইতিবাচক দিক। কিন্তু শ্রমিকের জীবনমানের উন্নয়ন কারখানার ইটপাথরের সঙ্গে যুক্ত থাকে না। শ্রমিকরা মর্যাদাপূর্ণ জীবন পাচ্ছে কিনা সেটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়নের সংজ্ঞাটা কেবল ভবনের সঙ্গে যুক্ত নয়। অনেক বড় ও স্বাস্থ্যসম্মত ভবন, গাছপালা কিংবা মেট্রোরেল কিন্তু শ্রমিকের জীবনের পরির্তন আনছে না। এক্সপ্রেসওয়েসে কিন্তু শ্রমিকরা যেতে পারছেন না। মেট্রোরেলেও কিন্তু শ্রমিকরা যেতে পারেন না-যে টাকা ভাড়া দিতে হয়। পদ্মা সেতুতেও যে টোল দিতে হয় সেটাও কিন্তু কম নয়।

বার্তা২৪.কম: রাজনৈতিক দলগুলোর শ্রমিকস্বার্থ দেখার জন্য সংগঠন রয়েছে। তারা কি শ্রমিকদের কণ্ঠস্বর কতটা হয়ে উঠতে পেরেছেন?

তাসলিমা আক্তার: একটি গভীর প্রশ্ন। গত ১৫ বছর ধরে আমরা যে শাসনের মধ্যে বা পরিবেশের মধ্যে আছি। আমরা নিজেরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য লড়াই করছি, ভোটাধিকার থাকলে পোশাক শ্রমিকরাও ভোটব্যাংক হিসাবে বিশাল জায়গায় থাকতেন। ফলে যেখানে কথা বলার অধিকার থাকে না, সেখানে কিছু আশা করার থাকে না। সেখানে ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক উন্নয়ন করাটিই আমরা দেখি। শ্রমিকদের উন্নয়নটা করা হচ্ছে না। শ্রমিকরা যদি কথা বলে সেটা আসলে এই জবাবদিহিতাহীন রাষ্ট্রে প্রতিফলিত হয় না। যেটা হয় সেটা হচ্ছে শ্রমিক আদোলনকে যত বেশি ভাগ করা যায় ততোটই হয়ত ভালো, যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের জন্য।

বার্তা২৪.কম: তার মানে রাজনৈতিক দলগুলি কি সংগঠনগুলি তৈরি করে শ্রমিকদের কণ্ঠকে রোধ করার জন্য?

তাসলিমা আক্তার: সকল শ্রমিক সংগঠন বা দলের কথা আমি বলছি না। সংগঠনগুলির প্রত্যেকেরই রাজনীতি থাকে, তাতে আপত্তি নাই। কিন্তু যে দল জনগণের কথা বলে না, জনগণের পরোয়া করে না কেবল মুখে মুখে কথা বলে-তারা রাষ্ট্রকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে। তবে কোন রাজনীতি আমাদের আন্দোলনকে বিভক্ত করে সেটাও বুঝতে হবে।

বার্তা২৪.কম: আমরা দেখি বর্তমানে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কথা বলা অনেক বাম রাজনৈতিক দলের চরিত্রেও পরিবর্তন এসেছে...

তাসলিমা আক্তার: জনগণের শক্তি হিসাবে বা গণতন্ত্রের শক্তি হিসাবে যদি আমি কথা বলি আর কাজটা যদি না করি তাহলে নামটা গুরুত্বপূর্ণ নয়...যদি ক্ষমতার সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে যারা জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয় তাহলে তো প্রগতিশীল বাম শক্তি হিসাবে দাবি করার সুযোগ থাকে না। সেরকম যদি হয় যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হয়ে ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে নিজেদের আখের গোছানো বা দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে তাদের অনেক হিসাব নিকাশ করতে হয়। সেখানে শ্রমিকদের স্বার্থটা লঙ্ঘিতে হবেই। ক্ষমতায়ও যাঁরা আছেন গত ১৫ বছর ধরে তারা যেভাবে আছেন, তাদের সঙ্গে যারা যুক্ত আছেন-তারাও শ্রমিকদের স্বার্থের কথা যতটা মুখে বলছেন বাস্তবে সেটার কোন প্রতিফলন আমরা দেখছি না। যদি দেখতাম তাহলে ২০২৩ সালে আন্দোলনে যে চারজন শ্রমিককে গুলিতে মারা যেতে হল সেটা দেখতাম না। যেখানে কথা বললেই আমাকে গুলি খেতে হবে, প্রতিবাদ করলে চাকুরি হারাতে হবে-এরকম একটা ভয়ের রাজনীতির পরিবেশ নিশ্চয়ই একটা গণতান্ত্রিক দেশে থাকে না। শ্রমিকরা এখন প্রতি মুহুর্তেই ভয়ের মধ্যে থাকেন। কোনভাবে যেন শ্রমিকরা সচেতন হতে না পারে সেকারণে নানা রকম প্রলোভন ও ভয়ভীতি এবং শ্রমিক নেতৃত্ব দূষিত করার জন্য যা যা করা দরকার সেগুলো আমরা দেখছি।

বার্তা২৪.কম: ‘দুনিয়ার মজদুর-এক হও’ স্লোগান নিয়ে রাজধানী ঢাকায় অনেক রাজনৈতিক দল রাজপথে সরব হয়ে কোথাই যেন মিলিয়ে গেলেন... তাদের কণ্ঠ কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। এই যে মূল্যবোধের পচন সেটা শ্রমিক আন্দোলনকারীদের হতাশাকে আরও বাড়িয়ে দেয় কিনা...

তাসলিমা আক্তার: স্লোগানটি শুধু শ্রমিক আন্দোলনেরই নয়, জনগণের স্বপক্ষের সব আন্দোলনে এতে ঐক্য খোঁজে পায়। শুধু দেশের নয়, সারা বিশে^র শ্রমিক আন্দোলনের স্লোগান। আমরা মনে করি যে, স্থানিকভাবে ও বৈশি^ক -সবভাবেই আমাদের লড়াই করা দরকার। বৈশ্বিক পর্যায়ে এই স্লোগানের যে সংহতি তা বার বার মনে করিয়ে দেয়। একটা দেশে যদি গণতন্ত্র থাকে, জবাবদিহিতা থাকে-তখন শ্রমিক আন্দোলনও শক্তিশালী হতে পারে। যদি জবাবদিহিতা না থাকে, ভয়ের রাজনীতি থাকে-সেখানে শ্রমিকদের নানাভাবে বঞ্চিত করার প্রচেষ্টাই দেখি।

বার্তা২৪.কম: রানাপ্লাজা দুর্ঘটনার পর শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ কতটা নিশ্চিত করতে পেরেছে রাষ্ট্র?

তাসলিমা আক্তার: ওই ঘটনার পর আমিসহ অনেক আলোকচিত্রীই ছবি তুলেছিলেন। ওই ঘটনার সাক্ষী হিসাবে সারা দুনিয়ার সামনে এসেছে এবং পোশাক শ্রমিকদের জীবনের পেছনে যে নির্মম নিষ্ঠুরতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়েও একটি বড় প্রশ্নবোধক হয়ে রয়েছে। আন্তর্জাতিক যে ভোক্তারা আছেন তাদের কাছেও...তারা যে টি শার্ট বা জামা পড়ছে তাদের ক্রেতারা জানতে পেরেছে। আমরা দেখেছি ওই ঘটনার ১১ বছর পরেও সোহেল রানাসহ আসলে যারা দোষীরা তারা শাস্তি পান নাই। ক্ষতিপূরণ আইন মাত্র ১ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ বা আড়াই লাখ করা..সেটা কোন মর্যাদাপূর্ণ ক্ষতিপূরণ না। যদি এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা থাকতো তাহলে তাদের শাস্তি হতো। এখন আইনের শাসন বলে কিছু কাজ করে কিনা সেটাই তো একটা সন্দেহের ব্যাপার। কে গ্রেপ্তার হবেন, কে জামিন পাবেন-কে পাবেন না, কোন মামলার দ্রুত রায় হবে, কোনটার হবে না-এই প্রত্যেকটা জিনিস বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিবেশ সেখানে আমাদের কাছে মনে হয়, পুরোটা একটা রাজনৈতিক বিষয় হয়ে গেছে। আইন নিজে চলতে পারছে না। সেইখানে সরকারের যে সদিচ্ছা সেটার অভাবের কারণেই আসলে রানাপ্লাজার ঘটনার পরেও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। যদি করা যেত তাহলে শিল্প মালিকরা সতর্ক হতে পারতো। তাদের যদি বড় অংকের ক্ষতিপূরণ দিতে হতো, তাহলে সতর্ক হতো। ২ লাখ বা আড়াই লাখ টাকা যদি একটা গার্মেন্টস মালিককে দিতে হয় তাহলে তার বেশি সমস্যা হবে না। আবার যদি দেখা যায় তাজরীনের মালিকের মতো জামিনে বের হয়ে মৎসজীবী লীগের সভাপতি হওয়া যায় তাহলে সমস্যা কি? এই জিনিসগুলো বিবেচনায় আনার দরকার। সরকারের সদিচ্ছাটা আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখি যে, গার্মেন্টস মালিকদের একটা বড় অংশই সংসদে আছেন, উনারা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং এই শাস্তিগুলো হলে হয়ত তাদের ওপর চাপ তৈরি হবে। এই একটা চক্রে মধ্যে মনে হয় আমরা আটকে আছি। আমাদের নতুন পথ খুঁজতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কারা আসলে আমাদের (শ্রমিকদের) পক্ষে আর কারা আমাদের পক্ষের হয়ে দিনশেষে কাজ করছে না, সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে শ্রমিক এলাকাগুলোতে প্রলোভন দেখিয়ে নেতৃত্বকে কেনাবেচা করা হচ্ছে, সেই প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে হবে।

বার্তা২৪.কম: রানাপ্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর বহির্বিশ্বের চাপে পোশাক কারখানাগুলোতে কর্মপরিবেশের কিছু উন্নয়ন হয়েছে, পর্যায়ক্রমে আরও হচ্ছে, এটা কোন আশাবাদ তৈরি করছে কিনা?

তাসলিমা আক্তার: আমি মনে করি কিছু পরিবর্তন তো অবশ্যই হয়েছে। রানাপ্লাজা দুর্ঘটনার পরে মালিকরা বলেছিলেন, ৫০ বিলিয়নের শিল্পে পরিণত করবেন ৫০ বছরে, এখন আবার বলছেন ১০০ বিলিয়ন ডলারের শিল্পে পরিণত করবেন। এখন বড় বড় কারখানাগুলো আগের চেয়ে অনেক ভালো। কিছুৃ গ্রিণ ফ্যাক্টরিও হয়েছে। এটা আমি ইতিবাচক মনে করি। কিন্তু এই উন্নয়নের ভাগীদার কেন শ্রমিকরা হচ্ছেন না এটাই আমার কথা। আমরা মনেকরি শিল্পের বিকাশ হওয়া দরকার, বাংলাদেশে যারা মালিকপক্ষ আছেন তারা করোনার সময়ে অনেক ঝুঁকি নিয়ে কারখানা চালু রেখেছেন, তাই অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও গার্মেন্টসগুলো বন্ধ হয়নি। রফতানিখাতের মধ্যে এটাই সাসটেইনিং। এটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য ভালো বিষয়। বিজিএমইএ পোশাক শ্রমিকদের জন্যও কাজ করছে। এগুলো ভালো দিক। নতুন একটা পরিবেশ তৈরি হবে। সেই পরিবর্তন যদি হয় কেবল মালিকদের সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা, সেই শিল্প আসলে কিভাবে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন করবে? এই পরিবর্তনকে আমরা তখনই উদযাপন করতে পারব যখন আমাদের শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন হবে। এই উন্নয়নের পেছনে যদি আমাদের শ্রমিকদের জীবন বলিই দিতে হয় শুধু তাহলে, তারুণ্যের ক্ষয় করতে হয়-মজুরি আন্দোলনে জীবন চলে যায়, তাহলে আসলে কিছু হবে না। এই উন্নয়নের ভাগীদার যদি শ্রমিকরা না হয় তা হলে সেটা কিভাবে টেকসই উন্নয়ন হলো? শ্রমিকরা তো তাদের উন্নয়নের হিস্যা চায়। শ্রমিকদেরও উন্নয়নের হিস্যা দিতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সব কিছুর দাম বাড়ছে, এটা সবাই স্বীকার করছি। কাপড়-সুতা-বিদ্যুত সবকিছু বেশি দামে কিনছেন, শুধুমাত্র শ্রমিকের শ্রমটা কম দামে কেনা হচ্ছে। এটা তো হতে পারে না। সুতরাং শিল্পের বিকাশের জন্যই শ্রমের মর্যাদাপূর্ণ মজুরি প্রয়োজন। যাতে ৮ ঘন্টা শ্রমেই শ্রমিকরা তা লাভ করতে পারেন। আন্তর্জাতিক যেসব ক্রেতারা আছেন তাদেরকেও যাতে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা যায় তার জন্য..যে প্রোডাক্টটা তারা কিনেন তা যেন ন্যায্যদামে কিনেন সেসব বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করার জন্য পোশাক শিল্পের মালিকদের আরও দক্ষতা বৃদ্ধি করা দরকার। শ্রমিকদের দুরবস্থার জন্য আন্তর্জাতিক ক্রেতাদেরও দায় আছে। অনেক সময় দেখি বিদেশি ক্রেতারা সচেতনতামূলক কথা বলেন, তারা শ্রমিকের ভালো চান-এমনভাবে তারা বলেন-যেন শ্রমিকদের জীবনমানের ভালো রাখার দায় কেবলমাত্র দেশীয় মালিকদের। তারা তাদের দায়টাকে অস্বীকারের চেষ্টা করেন। নিশ্চয়ই শ্রমিক ও মালিকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে কিন্তু এটা যেহেতু গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনের অংশ সেখানে বিদেশি ক্রেতাদের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা লাভের সিংহভাগই নিয়ে যান। সেই জায়গাতে তাদেরকেও যাতে জবাবদিহিতার জায়গায় আনা যায় সেই চেষ্টা করা উচিত। আমাদের মালিকরা ভাবেন কেবল তারাই ফুলেফেঁপে সম্পদশালী হবেন, আর শ্রমিকরা নিঃস্ব হবেন। বেশিরভাগ শ্রমিক ৩০-৩৫ বছর বা ৪০ বছর পর আর কাজ করার স্পৃহা থাকে না, অল্প বয়েসেই তারা বৃদ্ধ হয়ে যান, শক্তি ক্ষয় হয়ে যায় সেটা নিশ্চয়ই আমরা কখনো চাইব না।

  বাংলাদেশে করোনাভাইরাস

;