রনথাম্বোরের রয়েল বেঙ্গল বাঘ



আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ
-রয়েল বেঙ্গল বাঘের রাজকীয় চাহনি। ছবি- লেখক।

-রয়েল বেঙ্গল বাঘের রাজকীয় চাহনি। ছবি- লেখক।

  • Font increase
  • Font Decrease

দুই হাজার উনিশ সালের জুলাইয়ের ঘটনা। বর্ষায় সুন্দরবনের রূপ দেখার জন্য দশজনের টিমে ছোট্ট লঞ্চ ‘এম বি গাংচিল’-এ ওঠেছি মংলা জেটি থেকে। সকালে মেঘলা আকাশ মাথায় নিয়ে দুপুর নাগাদ হাড়বাড়িয়া ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রে পৌঁছুলাম। ঘন্টাখানেক ঘোরাফেরার পর যখন লঞ্চে উঠব এমন সময় দু-তিন ফোঁটা বৃষ্টির পানি মাথায় এসে পড়ল। তবে সেই অর্থে বৃষ্টি হলো না। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় কটকটার উদ্দেশ্যে লঞ্চ ছাড়ল। লঞ্চ উল্টো দিকে ঘুরে জয়মনির গোল হয়ে শেলা নদী দিয়ে কটকায় যখন পৌঁছুল তখন সন্ধ্যা হয় হয়।

সুন্দরবন অভিযানের দ্বিতীয় দিন সকালের হালকা রোদের আলোয় কটকা টাওয়ারের প্রায় পঞ্চাশ গজ সামনে একটি ঝুনঝুনি বা বন অতসী গাছে সুন্দরী বায়স (সুন্দরবন ক্রো) নামের মহাবিপন্ন এক প্রজাপতির ছবি তুলছিলাম। ছবি তুলতে তুলতে উড়ন্ত পতঙ্গটির পিছু পিছু আমরা ক’জন বনের এতটাই গহীনে চলে গেলাম যে সুন্দরবনের স¤্রাটের কথা মাথায়ই এল না। প্রজাপতিটির প্রজনন ক্ষেত্র আর আমাদের জাতীয় পশু সুন্দরবনের স¤্রাট রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাংলা বাঘের বাড়ি যে একই জায়গায় তা ছবি তোলায় মশগুল আমরা ক’জন খেয়ালই করিনি। অথচ এর আগে যতবার কটকা এসেছি, সবসময় স্থানটি এড়িয়ে চলেছি। সেকারণেই দেশের সবচেয়ে বিরল ও মহাবিপন্ন সুন্দরী বায়স বা সুন্দরবন ক্রো প্রজাপতির প্রজনন ক্ষেত্রটিও কখনও দেখিনি। বিশ্বের আর কোথাও এই প্রজাপতিটিকে দেখা যায় না।

রনথাম্বোরের ঘাসঝোপে রয়েল বেঙ্গল বাঘ। ছবি- লেখক।  

সেদিন সুন্দরবনের সম্রাটের বাড়িতে যা দেখলাম তাতে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ঝুনঝুনি বাগানে মহাবিপন্ন পতঙ্গটির মেলা বসেছে যেন! মহা আনন্দে যখন ছবি তুলছিলাম, তখন আমাদের সুন্দরবন ভ্রমণের গাইড ফেমাস ট্যুর বিডির কর্ণধার তানজির হোসেন রুবেল কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল এক ঝলকের জন্য সে ও বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী নাজিম সুন্দরবনের সম্রাটকে হেঁটে যেতে দেখেছে। রক্ত হিম করা এ সংবাদে মুহূর্তেই প্রজাপতির প্রাকৃতিক বাগান মানবশূণ্য হয়ে পড়ল। সবাই প্রাণ হাতে নিয়ে দ্রুত ঘাটে বাঁধা ইঞ্জিন নৌকার দিকে ছুটলাম কটকা অফিসের পাশে নোঙর করা ছোট্ট লঞ্চ ‘এম বি গাংচিল’-এ ওঠার জন্য। সেদিন লঞ্চের প্রায় সকলেই বাঘ আতঙ্কে ছিলাম। এরপরও দুপুরে ভয়ে ভয়ে কটকা থেকে জামতলী সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত একবার ঘুরে এসেছিলাম, তবে সম্রাটের কোনো হদিস পাইনি।

গত আটাশ বছর ধরে নিয়মিত সুন্দরবন যাচ্ছি প্রকৃতি-পাখি-প্রজাপতি-বন্যপ্রাণী দেখতে ও ওদের ছবি তুলতে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির বিরল ও দুর্লভ পাখি-প্রাণীর প্রচুর ছবি তুলতে পারলেও পায়ের ছাপ ও মল ছাড়া বাঘ মামার কোন ছবি তুলতে সক্ষম হইনি। বেশ কয়েকবার সম্রাটের বেশ কাছাকাছি থেকেও তাকে দেখতে ব্যর্থ হয়েছি, ছবি তোলা তো দূরের কথা। একবার বাঘের বৈঠকখানাখ্যাত কচিখালীতে এক বাঘিনীর গর্জন শুনেছিলাম। দু’বছর আগে বাঘের খোঁজে পাঁচদিন সুন্দরবন ঘুরে ব্যর্থ হয়ে ঘরে ফিরলাম। এর ঠিক একমাস পর আমাদের টিম সুন্দরবনের হোমরা বা সুন্দরী খালে গাছের ডালে বসা এক বাঘের দেখা পেল। প্রায় ঘন্টাখানেক সময় ধরে তারা ওর ছবি তুলল। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেদিন আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম না।

তবে, বার বার সুন্দরবন গিয়ে ছবি তুলতে ব্যর্থ হলেও ভারতের ‘রণথামভোর জাতীয় উদ্যান’ আমাকে হতাশ করেনি। ওখানে পরপর দুদিন দুটি আলাদা স্থানে গিয়ে দুটি ভিন্ন বাঘের দেখা পেয়েছি ও চমৎকার সব ছবি তুলেছি। সুন্দরবনে না দেখলেও রণথামভোরে বাঘ দেখে আমি তৃপ্ত একারণে যে, ওখানকার ও আমাদের সুন্দরবনের বাঘ জিনগতভাবে সবচেয়ে কাছাকাছি। বিশ্বের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সমন্বয়ে সম্পন্ন এক গবেষণার ফলাফলে জিনগতভাবে রণথামবোরের বাঘের সঙ্গেই সুন্দরবনের বাঘের সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া গেছে। এবার রণথামভোরের বাংলা বাঘ দেখার সে গল্পই বলছি।

ঘাসবনে সচকিত বাংলা বাঘ। ছবি- লেখক।  

ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালের ঘটনা। ছয় জনের টিমে মারুতি জিপসি গাড়িতে ভারতের রাজস্থানের সারিস্কা টাইগার রিজার্ভে ঘুরছি রয়েল বেঙ্গল বা বাংলা বাঘের সন্ধানে। এই সংরক্ষিত এলাকাটি রাজস্থানের আলওয়ার জেলায় অবস্থিত। ৮৮১ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল বনটি কাঁটাওয়ালা শুষ্ক জঙ্গল, শুষ্ক পর্ণমোচী, তৃণভূমি ও পাথুরে পাহাড়ের সমন্বয়ে গঠিত। একসময় এটি আলওয়ার রাজ্যের শিকারের ক্ষেত্র ছিল যা ১৯৫৮ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে এখানে ২০টি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বাস। তবে, সারাদিন ধরে বিশাল বনের বিভিন্ন স্থান ঘুরে বহু প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও পাখি দেখলেও বাঘের কোন চিহ্ন দেখলাম না। বিফল মনোরথ হয়ে জয়পুর শহরে ফেরত এলাম।

পরদিন সকালে জয়পুর থেকে সাওয়াই মধুপুর শহরের দিকে রওয়ানা হলাম। উদ্দেশ্য ওখানকার বিখ্যাত ‘রণথামভোর জাতীয় উদ্যান’-এ রণথামভোরের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের খোঁজ করা। এখানকার বাঘরা এ নামেই পরিচিত। দুপুরে রণথামভোর প্যালেস হোটেলে পৌঁছে ব্যাগপত্র রেখে লাঞ্চ না সেরেই ‘রণথামভোর জাতীয় উদ্যান’-এর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা ক্যানটার-এ (ছাদখোলা ২০ জন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ট্রাক) ওঠলাম। ফোর হুইল ড্রাইভ জিপ (মারুতি জিপসি) জোগাড় না হওয়ায় বিশজনের সঙ্গে বাধ্য হয়েই ক্যান্টারে করে পার্কে ঢুকলাম। এত মানুষের সঙ্গে যে কি বাঘ দেখব সে চিন্তায়ই মন ভেঙ্গে পড়ল।

ক্যানটার এগিয়ে চলল। নানা ধরনের পাখি-প্রাণীর দেখা পাচ্ছি। কিন্তু, ছবি তোলায় মনোনিবেশ করতে পারছি না। এত কষ্ট করে এত দূর এসেও যদি রণথামভোরের রাজার দেখা না পাই তাহলে এ দুঃখ কোথায় রাখব? ক্যান্টরে ঘুরছি প্রায় ঘন্টা দেড়েক হলো। এরমধ্যে রাজার কোন গন্ধও পাচ্ছি না। ধরেই নিয়েছি আজ দেখা হবে না। কাল সকালে জিপসি পাব। কাজেই কালকের অপেক্ষায়ই থাকতে হবে। এমন সময় ফিরতি পথে আসা একটি জিপসির গাইড বলল বেশ কিছুটা সামনে ওরা মামার দেখা পেয়েছে। এটা শোনামাত্রই ড্রাইভার দ্রুত ক্যান্টর ছোটাল। পনের মিনিটের মধ্যেই আমরা জায়গামতো পৌঁছে গেলাম।

শিকার খাওয়ার পর রনথাম্বোরের ঘাসবনে ঘুমিযে থাকা বাঘ মামা। ছবি- লেখক।  

প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবনের প্রথম মামার দেখা পেয়ে ক্যানটারের সবাই বেশ উত্তেজিত। ওখানে আরও ৪-৫টি ক্যান্টর-জিপসি দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের সামনে একটা ছোট খাল। সেই খালের মাঝে পাথর খ-ের উপর একটি ছোট কুমির বসে আছে। তারপর এক চিলতে জমি। ওখানে ৩-৪টি তিতির খাবার খাচ্ছে। তারও খানিকটা উপরে শুকনো ঘাসের উপর রাজকীয় ভঙ্গিতে রণথামভোরের রাজা বসে আছে। যাক, অবশেষে রাজার দেখা পেলাম। জীবনে এই প্রথম বনের খোলা প্রান্তরে সত্যিাকরের বুনো বাংলা বাঘ দেখলাম, গত সাতাশ বছর সুন্দরবন ঘুরেও যার দেখা পাইনি। বিকেলের হালকা রোদে মনপ্রাণ ভরে মামার ছবি তুললাম।

পরদিন ভোরে কনকনে শীতে আবারও ‘রণথামভোর জাতীয় উদ্যান’-এ ঢুকলাম ৬ জনের টিমে জিপসি করে। মামার খোঁজে ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরির পর একটি পয়েন্টে গিয়ে ৪-৫টি জিপসি একত্রিত হলো। সবাই বলাবলি করছে আশেপাশে কোথাও মামা লুকিয়ে আছেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি না। পাশেই একটি পুরনো একতলা বিল্ডিং। অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর শেষমেষ বিল্ডিংয়ের ছাদে ওঠার অনুমতি মিলল। ছাদে ইতোমধ্যেই ভিড় লেগে গেছে। লম্বা লেন্সের ক্যামেরা হাতে ছাদভর্তি ব্যাঘ্র আলোকচিত্রীদের ভিড় বাড়তে লাগল। শেষ পযর্ন্ত বহু কষ্টে ছাদের একপাশে দাঁড়ানোর মতো একটা জায়গা পেলাম। যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে দেহটাকে যতটা বাইরের দিকে বাঁকোনো যায় বাঁকিয়ে ১৫০-৬০০ মিমি লেন্স মামার দিকে তাক করলাম। ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হবে। সকালের তীক্ষ্ণ রোদে মামার ঝলমলে সোনালি-হলুদ বর্ণের উপর কালো ডোরা চোখে পড়ল। আর যায় কোথায়, শাটারে ক্লিকের বন্যা বয়ে গেল। এই বাঘটির চাহনি গতকালেরটির থেকেও রাজকীয়! রণথামভোরের রাজার চমৎকার কিছু ছবি তুলে জিপসি চেপে ফিরতি পথ ধরলাম।

আসছে ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস বা আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবস। বাঘ সংরক্ষণে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতিবছর দিনটি পালন করা হয়। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত বাঘ সম্মেলনে এই দিবসটির সূচনা হয়। সে সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী শেখ হাসিনাও উপস্থিত ছিলেন। বিশ্বব্যাপী এই দিবস পালনের মূখ্য উদ্দেশ্য বাঘের প্রাকৃতিক আবাসভূমি রক্ষা ও বাঘ সংরক্ষণের জন্য মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে বাঘ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনা ও ভীতি দূর করা। বাঘ বাংলাদেশের জাতীয় পশু হওয়ায় এই দিবসের গুরুত্ব এদেশে অনেক বেশি। একসময় সারাদেশজুড়ে বাঘের উপস্থিতি থাকলেও বর্তমানে বাঘ এদেশে অত্যন্ত বিরল ও মহাবিপন্ন প্রাণী ও বিশ্বব্যাপী বিপন্ন বলে স্বীকৃত।

রনথাম্বোরের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ঝিমুনি। ছবি- লেখক।  

আগে সারাদেশের বনজঙ্গলে বাঘ বাস করলেও পঞ্চাশের দশকের পর এদেরকে সুন্দরবন ছাড়া দেশের অন্য কোথাও দেখা যায় নি। সর্বশেষ ১৯৬২ সালে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধায় শেষ গ্রামীণ বনের বাঘটি মারার পর এদেশের গ্রামে আর কোন বাঘ দেখার রেকর্ড নেই। বাংলাদেশে সর্বমোট কতগুলো বাঘ আছে এ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। বিভিন্ন সময় এদেশের সুন্দরবনে বাঘ শুমারির মাধ্যমে ৩০০-৫০০টি বাঘের উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে ক্যামেরাট্র্যাপভিত্তিক বাঘ শুমারিতে সুন্দরবনে ১০৬টি বাঘের অস্তিত্ব ধরা পড়ে, যা ২০১৮ সালের শুমারিতে ৮% বেড়ে ১১৪টি হয়। এটিই এখন এদেশের বাঘের সর্বমোট সংখ্যা। তবে, আগের তুলনায় ইদানিং সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারনা। কারণ, গত দু’বছর ধরে প্রায়ই বাঘ সুন্দরবন ভ্রমণকারীদের নজরে আসছে। সূত্র মতে, বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘের আরেকটি ক্যামেরাভিত্তিক শুমারি চলমান যার ফলাফল ২০১৪ সালের ২৯ জুলাই জনসমক্ষে প্রকাশ করবে বাংলাদেশ বন বিভাগ। তবে আশার কথা, সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিভাগের মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা, যেমন- কাসালং রিজার্ভ ফরেস্ট ও সাঙ্গু-মাতামুহুরি অভয়াণ্য এবং সিলেট বিভাগের ভারতীয় সীমান্তবর্তী পাথারিয়া হিল রিজার্ভ ফরেস্টে বাঘের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

বাঘ এদেশে ব্যাঘ্র বা বাঘ মামা নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম Tiger বা Bengal Tiger। সুন্দরনের বাঘকে Royal Bengal Tiger বলেই ডাকা হয়, যা বৃটিশদের দেয়া। ফ্যালিডি গোত্রের সদস্য বাঘের বিজ্ঞানভিত্তিক নাম Panthera tigris। পৃথিবীতে বাঘের একটিই প্রজাতি। যদিও ইতোপূর্বে বিজ্ঞানীরা বাঘকে ৮টি (তিনটি বিলুপ্তসহ) উপপ্রজাতিতে বিভক্ত করেছিলেন, কিন্তু সম্প্রতি দুটি উপপ্রজাতিতে পুনঃশ্রেণিভুক্ত করেছেন, যেমন- মহাদেশীয় (Continental- Panthera tigris tigris) ও সুন্দা (Sunda- Panthera tigris sondaica) বাঘ। মহাদেশীয উপপ্রজাতিটিকে এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে পাওয়া যায়, যা বাংলা, মালয়ান, ইন্দোচীনা, আমুর, ক্যাস্পিয়ান (বিলুপ্ত) এবং দক্ষিণ চীনা (কার্যকরীভাবে বিলুপ্ত) বাঘের জনসংখ্যা নিয়ে গঠিত। অন্যদিকে, সুন্দা উপপ্রজাতিটিকে (যা একসময় ইন্দোনেশিয়ার সুন্দা দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন অংশে পাওয়া যেত), শুধুমাত্র সুমাত্রায় পাওয়া যায় এবং জাভা ও বালিতে বসবাসকারীগুলো বর্তমানে বিলুপ্ত।

সুন্দরবনের বাঘকে ঘিরে রয়েছে নানা গল্প, কিংবদন্তী বা মিথ (Myth)। বনের বাওয়ালি (অর্থাৎ কাঠুরে), মৌয়াল (বা মধু সংগ্রহকারী), জেলে ও আশেপাশের এলাকার লোকদের ধারণা বাঘের নাম মুখে নিলে তাকে অপমান করা হয়; এতে তাদের অমঙ্গল হবে। তাই বিভিন্ন বিশ্বাস মতে এর বিভিন্ন নাম রয়েছে। বড় মামা, বড় শিয়াল, বনরাজা, বড়কর্তা, বড় সাহেব, গাজী ঠাকুর, বড় পাইক এসবই বাঘের এক একটি নাম।

অলস ভঙ্গিতে রনথাাম্বোরের রাজা। ছবি- লেখক।  

রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বেঙ্গল টাইগার বিড়াল পরিবারের প্রাণী। বিজ্ঞানীদের মতে বাংলা বাঘ ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ১২,০০০ বছর আগে আবির্ভূত হয়। বাঘের পূর্বপুরুষের নাম খড়গ-দাঁতি বা তলোয়ার-দাঁতি বাঘ (Saber-toothed tiger)। এদের উপরের চোয়ালের ছেদন দাঁত দুটো দেখতে তলোয়ারের মতো ছিল যা দিয়ে সহজেই শিকারকে বিদ্ধ করা যেত। তারপর অনেক বছর গড়িয়ে গেছে। উপরের চোয়ালের ছেদন দাঁত ছোট হয়ে বর্তমান আকারে এসেছে। উৎপত্তি হয়েছে বর্তমানকালের বাঘ প্রজাতির। এরপর উৎপত্তি হয়েছে বাঘের দুটি উপপ্রজাতি ও জনসংখ্যাগুলো; অবশ্য ইতোমধ্যে কোন কোনটি হারিয়েও গেছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও বাঘের শিকার ঘায়েল করার ক্ষমতা কিন্তু কমেনি এতটুকুও। তবে কোনো কারণে বাঘ এই দাঁত হারালে আর স্বাভাবিক নিয়মে শিকার করতে পারে না। জীবনরক্ষার জন্য তাকে বেছে নিতে হয় ভিন্ন পথ। যাক সে কথায় পরে আসছি।

বাঘ সবচেয়ে বড় বিড়ালজাতীয় প্রাণী। লেজবাদে দেহের দৈর্ঘ্য ১৪০-২৮০ সেন্টিমিটার (সেমি), লেজ ৬০-১১০ সেমি ও উচ্চতা ৯৫-১১০ সেমি। বাংলাদেশের জাতীয় পশুর দেহের লোম সোনালি বা কমলা ও তাতে চওড়া কালো ডোরা থাকে। দেহতলের মূল রং সাদা। লম্বা লেজটিতে থাকে কালো ডোরা। পুরুষের মাথার দুপাশে থাকে লম্বা লোম। চোখ অত্যন্ত উজ্জ্বল। বিশাল আকারের মাথাটা গোলাকার। ১৮০-২৮০ কেজি ওজনের বাঘ মামা অত্যন্ত শক্তিশালী। নিজের থেকে দু’তিনগুণ বেশি ওজনের পশু শিকার করে অনায়াসেই টেনে নিয়ে যেতে পারে।

সুন্দরবনের সম্রাট বাঘ নির্জন অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকা আর নিঃসঙ্গতা পছন্দ করে। তাছাড়া সে চলেও একা। দক্ষ সাঁতারুও বটে। মল-মূত্রের মাধ্যমে নিজের বিচরণ এলাকা চিহ্নিত করে। এই গন্ধ পেলে অন্য কোনো বাঘ সেখানে যায় না। তাছাড়া তার নির্দিষ্ট এলাকায় অন্য কোনো বাঘকে সে বরদাস্তও করে না। মূত্র ছাড়াও বাঘ গাছের বাকল আচঁড়েও নিজের সীমানা নির্ধারণ করতে পারে। বাদাবন, চিরসবুজ ও কনিফার বন, শুষ্ক কণ্টকময় বন, উঁচু ঘাসবন ইত্যাদি এলাকায় বাঘ বাস করে। দিনে কাঁটায় ভরা হেতাল গাছের আড়ালে শুয়ে থাকে। নদী বা খালের পাড়ে জন্মানো অত্যন্ত ঘন গোলপাতার বনও মামার প্রিয় জায়গা। বাঘ যেমন হিংস্র তেমনি বুদ্ধিমানও বটে। সাধারণত ভোরবেলা ও সন্ধ্যায় শিকারে বের হয়; কখনও কখনও রাতে। মামা শিকারও করে একা, আর ভোজও সাড়ে একা।

চিত্রা হরিণ, বুনো শুয়োর, বানর, সজারু, গিরগিটি, বড় পাখি ইত্যাদি প্রিয় খাবার। তবে খাদ্যের অভাবে মাছ, কাঁকড়া ইত্যাদিও খায়। তবে এরা কিন্তু জন্মসূত্রে মানুষখেকো হয় না। বরং মানুষকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে শক্তি কমে এলে, কোনো কারণে আহত হলে (সজারুর কাঁটায় আহত হওয়াটা সচরাচর দেখা যায়), ছেদন দাঁত বা কুকুর দাঁত ভেঙ্গে গেলে, জেলে-বাওয়ালি, বাজ-ঈগল-বানরের অত্যাচারে, মৌমাছির হুলের জ্বালায় এদের মাথা ঠিক থাকে না। আর তখনই মানুষকে আক্রমণ করে। অনেক সময় বনের চরে কবর দেয়া মৃত জেলে-বাওয়ালির মাংস খেয়েও মানুষের নোনা মাংসের স্বাদ পায় যা আর কোনদিন ভুলতে পারে না। ফলে পরিণত হয় মানুষখেকোতে। সন্তানহারা বাঘিনীও রাগে-দুঃখে, প্রতিহিংসায় মানুষখেকো হতে পারে। আবার মানুষখোকো বাঘিনীর শিকার করা নরমাংস খেয়ে বাচ্চারাও যে নোনা স্বাদ পায় তার ফলে বড় হয়ে মানুষখেকোতে পরিণত হতে পারে।

মামা কখনোই পিছু হটতে জানে না। একবার কোনো শিকারকে তাক করলে ঝাঁপিয়ে পড়বেই। তবে, ব্যর্থতার বিন্দুমাত্র আশংকা থাকলে সেই শিকার ধরা থেকে বিরত থাকে। আবার নতুন করে পজিশন নেয়। শিকারের জন্য দেড়-দুই কিলোমিটার চওড়া নদীও পার হতে পারে। মামা কোনো শিকারকেই সামনের দিক থেকে ধরে না। পেছন থেকে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়াই তার স্বভাব। তাছাড়া বাতাসের বিপরীত দিক থেকে আক্রমণ করে বলে শিকার বাঘের গন্ধ টের পায় না। দেহ বিশাল হলেও শিকার ধরার মুহূর্তে তা কুঞ্চিত করে ছোট করে ফেলে। মাটিতে কয়েকবার লেজ দিয়ে আঘাত করে। পায়ের থাবায় লুকানো নখ বের করে আনে। লেজ পাকিয়ে খাড়া করে নেয়। পায়ের তলায় নরম মাংসপিন্ড থাকায় শিকারের একবারে আগ মুহূর্তেও কোনো শব্দই হয় না। এরপর হঠাৎ করেই বিশাল এক হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের উপর। শিকার ধরে তাতে দাঁত বসিয়ে টেনে শ’খানেক মিটার দূরে নিয়ে যায়। সেখানেই ভূড়িভোজ সারে। ভোজশেষে পেটপুরে পানি পান করে। তারপর দেয় লম্বা ঘুম। ভোজ একবারে শেষ করেতে না পারলে তা মাটি, পাতা দিয়ে লুকিয়ে রাখে ও অন্য সময় খায়। একবারে প্রায় ২৫-৩০ কেজি মাংস খেতে পারে। সুন্দরবনের সৌন্দর্য রয়েল বেঙ্গলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পচাব্দী গাজীর নাম। সুন্দরবনের এই কৃতি সন্তান প্রায় ষাটটি বাঘ শিকার করেছেন, যার বেশিরভাগই ছিল মানুষখেকো।

বাংলা বাঘের ছবি তোলার পর রনথাম্বোরের ঘাসবনে লেখক। ছবি- লেখক (সেলফি) 

বাঘ বছরের যে কোনো সময়ই প্রজনন করতে পারে। এ সময় মামার গগনবিদারী বা আকাশ কাঁপানো হুংকার শোনা যায়। সে হুংকারে কেঁপে ওঠে বন-জঙ্গল, খাল-নদী আর বনের পশু-পাখি। বাঘিনী ১০৪-১০৬ দিন গর্ভধারণের পর ৩-৫টি অন্ধ বাচ্চার জন্ম দেয়। এ সময় সে অত্যন্ত নিরিবিলি জায়গায় আশ্রয় নেয়। আমাদের মধ্যে একটি ধারনা প্রচলিত আছে যে, পুরুষ বাঘ বাচ্চাদের খেয়ে ফেলে, তাই বাঘের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বাঘিনী সতর্কতার সাথে বাচ্চাদের রক্ষা করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি ঠিক নয়। কারণ পুরুষ বাঘ কখনোই তার ঔরশজাত বাচ্চাকে খায় না, বরং রক্ষা করে। তবে, সে অন্য বাঘের বাচ্চা খায়। আর একারণেই জন্মানোর পর অর্ধেক বাচ্চাও বড় হতে পারে না। বাচ্চাহারা বাঘিনী অত্যন্ত হিংস্র ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়। জন্মের প্রায় দশ দিন পর বাচ্চাদের চোখ ফোটে। এরা প্রায় আট সপ্তাহ মায়ের দুধ পান করে। এরপর মায়ের শিকার করা খাবারে মুখ লাগায়। ধীরে ধীরে মায়ের কাছ থেকে শিকার করা শেখে। বাঘিনী এক-দেড় বছর বাচ্চাদের চোখে চোখে রাখে। আর আড়াই-তিন বছর বয়সে যখন দ্বিতীয়বার এদের দাঁত গজায় তখন থেকেই এরা পুরোপুরি স্বাধীন। আর মায়ের সঙ্গে থাকে না। পুরুষ বাচ্চা ৪-৫ ও স্ত্রী ৩-৪ বছরে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। এরা দু’তিন বছরে একবারমাত্র প্রজনন করে। বাঘ ১৫-২০ বছর বাঁচে।

একটি কথা জেনে রাখা ভালো। আমাদের দেশের চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কগুলোতে যেসব রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে তার একটিও কিন্তু আমাদের সুন্দরবনের নয়, বরং সবগুলোই এসেছে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্ক থেকে। যদিও ভারতীয় সুন্দরবন, রণথামভোর, সারিস্কা ও অন্যান্য কয়েকটি এলাকার বাঘের সঙ্গে বাংলাদেশের বাঘের খুব মিল, কিন্তু অন্যান্য এলাকার বাঘের সঙ্গে জিনগত পার্থক্য দেখা যায়। সূত্র মতে, বর্তমানে যদিও এদেশের বাঘ রক্ষার জন্য বেশকিছু প্রকল্প চলমান রয়েছে, তথাপি এদেশের গৌরব সুন্দরবনের সম্রাট চোরা শিকারিদের হাত থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়। কাজেই এ ব্যাপারে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; অন্যথায় একদিন হয়ত সুন্দরবনের সম্রাট ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ চিরতরে হারিয়ে যাবে পৃথিবীর বুক থেকে। সেটা নিশ্চয়ই কারো কাম্য নয়।

   

কটিয়াদীতে ২ বছরে ৫০ পুকুর ভরাট, পরিবেশে বিরূপ প্রভাব



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

কয়েক বছর আগেও কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার পৌর এলাকায় ছিল ২৫টির বেশি পুকুর। বর্তমানে সেখানে চার থেকে পাঁচটি পুকুর টিকে আছে। এর মধ্যে দুটি অর্ধেক ভরাটের পথে। সবগুলো পুকুরের বয়স শতবর্ষ ছুঁইছুঁই!

এছাড়াও উপজেলা জুড়ে সেই একই অবস্থা। দুই বছরে প্রায় ৫০টি পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। পুকুর কমতে থাকায় পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর। এ কারণে পানি সংকটে পড়েছে প্রাণীকুল।

অপরদিকে, গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল এ বাজার ও আবাসিক এলাকায় আগুন লাগলে পানির সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে। ফলে, ক্রমশই সমস্যার গভীরতা বাড়ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আইন অমান্য করে অবাধে একের পর এক পুকুর ভরাট করে সেখনে বাণিজ্যিক প্লট ও বহুতল আবাসিক ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে।
গত দুই বছরে পৌর এলাকায় কম করে হলেও ১০টি পুকুর ভরাট হয়েছে। জমির মালিকেরা কখনো গোপনে, কখনো প্রকাশ্যে এসব পুকুর ভরাট করছেন। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর ও পৌরসভার তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।

প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি।

কোনো ব্যক্তি এ বিধান লঙ্ঘন করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালের সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ।

এলাকাবাসী সূত্রে ও অনুসন্ধানে জানা যায়, যে পুকুরগুলো ভরাট হয়েছে বা হচ্ছে, সেগুলির মধ্যে রয়েছে কটিয়াদীর পৌর এলাকার ভোগপাড়া কুড়িবাড়ি, পশ্চিমপাড়া মেতির বাড়ি, কান্তিবাবুর বাড়ি সংলগ্ন, লোকনাথ মন্দির সংলগ্ন (ভরাট চলমান), ত্রিরত্ন মন্দির সংলগ্ন, বাসট্যান্ড পুকুর, লালিবাড়ি, রাধানাথ সাহা বাড়ি মোড়, বীরনোয়াকান্দি মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় দুটি পুকুর, পশ্চিম পাড়া দুটি), বীরু সাহার পুকুর (ভরাট চলমান)।

এছাড়াও অর্ধশত ছোট জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে। পৌর এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে আরো অনেক পুকুর ভরাট হয়েছে ও হচ্ছে। তাদের কোনো ধরনের বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট দফতরেও নেই সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য।

উপজেলার সবকটি ইউনিয়নগুলোর চিত্র সেই একই রকম। প্রতিনিয়ত অনেক পুরনো পুকুর ভরাট হচ্ছে। জালালপুর কুটির বিল, দুর্গা বিলসহ আরো অনেক বিল প্রতিদিন বেদখল হচ্ছে।

কটিয়াদীর (কিশোরগঞ্জ) পৌর এলাকায় চলছে পুকুর ভরাটের কাজ, ছবি- বার্তা২৪.কম

এমন কী পৌর এলাকার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত আড়িয়াল খাঁ নদের চড়িয়াকোনা অংশে মাটির বাঁধ দিয়ে ও স্থাপনা করে দখল করে রাখা হয়েছে। আইনের তোয়াক্কা না করে এবং সংশ্লিষ্টদের তদারকির গাফিলতি ও অদক্ষতার সুযোগে এভাবেই জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।

পৌরসভার পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা সুজিৎ ঘোষ ও আব্দুর রহিম বলেন, এলাকায় কয়েকটি পুকুর ছিল। কিন্তু রাতারাতি সেগুলো ভরাট করে চড়া দামে জমি বিক্রি করে দিয়েছেন মালিকেরা। তাদের কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তা পানিতে তলিয়ে যায়।

কটিয়াদী সরকারি ডিগ্রি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক শাহ্ আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, 'পানি ও প্রকৃতি একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। জলাধার না থাকলে প্রাণীকুল ও প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করবে। আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে যাবে। এছাড়াও আগুন লাগলে পানির অভাবে বড় সমস্যার কারণ হবে। প্রশাসনসহ এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন থাকতে হবে। পুকুর-জলাশয়গুলো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’

কটিয়াদী ফায়ার সার্ভিস স্টেশন অফিসার আতিকুল আলম বলেন, ‘পুকুর ভরাটের খবরটি আসলেই দুঃখজনক! পানির অভাবে আগুন নেভাতে গিয়ে আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়। আমাদের যে গাড়ি, তাতে ১৮শ লিটার পানি ধারণ করা সম্ভব। এটা দিয়ে ২০ মিনিট পানি দিতে পারবো। বাকি পানির জন্য পুকুর বা জলাশয়ের প্রয়োজন পড়বে। স্থাপনা করার সময় ফায়ার সেফটি বিষয়ে সবাইকে খেয়াল রাখা জরুরি’।

কিশোরগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মতিন জানান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পুকুর ভরাটের কথা জানতে পারেন না। জেলা শহরে কয়েকটি পুকুর ভরাট বন্ধ করে দিয়েছেন।

তিনি জানান, কটিয়াদীর বিষয়টি খোঁজ নিয়ে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস করে এভাবে ভরাট করতে দেওয়া হবে না।

তবে তিনি এটাও জানান যে, লোকবল সংকটের কারণে তাদের রুটিন তদারকি করা সম্ভব হয় না। কিন্তু ঘটনা জানতে পারলে তারা ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন বলে জানান এই পরিচালক।

 

 

;

তাপদাহ থেকে প্রাণীদের রক্ষায় করণীয়



ড. আ ন ম আমিনুর রহমান পাখি প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ
-গরমের সময় পোষা পাখি সান কনিউরের বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। ছবি: লেখক

-গরমের সময় পোষা পাখি সান কনিউরের বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। ছবি: লেখক

  • Font increase
  • Font Decrease

গত ২০ এপ্রিলের (২০২৪) ঘটনা। পাখিসংক্রান্ত একটি প্রকল্পের কাজে উত্তরা, দিয়াবাড়ি ও আশেপাশে ঘুরছি। প্রচণ্ড খরতাপ। তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁই ছুঁই। মাথায় হ্যাট থাকায় অন্তত কিছুটা রক্ষা। প্রচণ্ড রোদ্রতাপে ক্যামেরা গরম হয়ে উঠেছে। পাখির খোঁজে হাঁটছি। হঠাৎই উঁচু ঘাসের ভিতর থেকে একটি কুকুর বেড়িয়ে এলো। এরপর মুখ হা করে জিহ্বা বের করে হাঁপাতে লাগল। মনে মনে বললাম ‘ঘাসের ভিতর ছিলি তো ভালোই ছিলি, কেনই-বা এই খরতাপে বেরিয়ে এলি, আর কেনই-বা জিব বের করে হাপাচ্ছিস’?

পাখির খোঁজে আরেকটু সামনের দিকে হাঁটতে থাকলাম। হাঁটাপথে বেশকিছু ভাতশালিককে খাবার মুখে হন্তদন্ত হয়ে উড়ে যেতে দেখলাম। বাসায় নিশ্চয়ই ওদের ছানা রয়েছে, তাই এতো তাড়াহুড়ো। একটি গোশালিককে লেকের পাড়ে হা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। আর দুটিতে দ্রুত পানিতে ঝাঁপ দিয়ে যেন প্রচণ্ড গরমের হাত থেকে বাঁচল। খানিকটা এগুনোর পর আরেকটি শালিককে সানশেড দেয়া বিদ্যুতের কোন একটি যন্ত্রের উপর দাঁড়িয়ে হা করে থাকতে দেখলাম। স্পষ্ট বোঝা গেল সানশেডের ভিতরে থেকেও সে হাঁপাচ্ছে। এরপর অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে একটি মরা গাছের সামনে এলাম। গাছে একটি সাদা চিল বসে ছিল। ওর ছবি তুলতে তুলতে সামনে এগুচ্ছি। এক সময় সেও দেখলাম মুখ হা করে আছে।

প্রচণ্ড গরমে কুকুর হাঁপাচ্ছে

তারপর আরেকটু সামনে এগুলাম। বেশ গরম, সহ্য করার মতো নয়। শার্ট পুরোপুরি ঘামে ভিজে গেছে। ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে হঠাৎই একটি শিয়াল বেরিয়ে এল। আর যায় কোথায়? ক্যামেরায় ক্লিকের বন্যা বয়ে গেল। খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সেও মুখ হা করে হাঁপাতে লাগল। এরপর ধীরে ধীরে সামনের ঘাসবনের ভিতর মিলিয়ে গেল। আমরাও আর গরম সহ্য করতে না পেরে গাড়িতে উঠে ফিরতি পথ ধরলাম।

এতক্ষণ বিভিন্ন পাখি-প্রাণীর হা করে থাকা বা হাঁপানোর যে গল্প বললাম তা আর কিছু নয়, গত ক’দিনের প্রচণ্ড তাপদাহের ফল। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী দেশে আগামী আরও বেশকিছু দিন মৃদু (৩৬-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস), মাঝারি (৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ও তীব্র (৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপদাহ চলমান থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এই তাপদাহ থেকে বাঁচার জন্য আমরা মানুষেরা কত কিছুই না আবিষ্কার করেছি। বৈদ্যুতিক পাখা, এয়ার কন্ডিশনার, ছাতা, ঠাণ্ডা পানীয় এবং আরও কত কি!

অতিরিক্ত তাপমাত্রায় হাঁপাচ্ছে ভাত শালিক

তীব্র গরমে মানুষের মতো প্রাণীদেরও অনেক কষ্ট হয়। তবে সে কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য তারাও নিজস্ব কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করে। তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি হলেই মানুষ ঘামতে থাকে; তবে শরীর থেকে ঘাম বেরিয়ে গেলে দেহ শীতল হয়ে যায়। কিন্তু মহিষ ও শুকরের ঘামগ্রন্থি কম থাকায় ওরা শরীর ঠাণ্ডা করতে কাদায় গড়াগড়ি করে। সাহারা মরুভূমিতে ফেনেক নামে এক ধরনের খেঁকশিয়াল বাস করে। আকৃতিতে এটি আমাদের দেশের খেঁকশিয়াল থেকে বেশ ছোট। কিন্তু ওর কানগুলো দেহের তুলনায় বেশ বড় হয়। আর এই বিশাল আকারের কান ওদের দেহ থেকে তাপ নিঃসরণে সাহায্য করে।

মুখ হা করে গরমের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টারত সাদা চিল

প্রাণীদের দেহের পশম বা লোম সাধারণত দেহ উষ্ণ রাখতে সাহায্য করে, কিন্তু বিশালদেহী হাতির দেহের ছোট ছোট লোম দেহ শীতল রাখতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, কুকুর তার দেহের তাপমাত্রা কমায় জিহ্বার মাধ্যমে। তবে এতকিছুর পরেও অতিরিক্ত এই তাপদাহ থেকে খামারভিত্তিতে বা কৃষকের ঘরে পালিত গবাদি প্রাণী, হাঁসমুরগি (পোল্ট্রি), পোষা পাখি ও প্রাণীদের রক্ষা করতে আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। 

তাপদাহে কাতর শিয়াল

এগুলো সঠিকভাবে মেনে চললে এসব পাখি-প্রাণীরা প্রচণ্ড তাপদাহজনিত পীড়ন বা চাপ থেকে রক্ষা পাবে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

০১. গবাদিপ্রাণী, পোল্ট্রি ও পোষা পাখি-প্রাণীর ঘর শীতল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পাখি-প্রাণীর ঘরের চাল টিনের তৈরি হলে চলের উপর ভেজা কাপড়, চট বা বস্তা বিছিয়ে দেয়া যেতে পারে ও মাঝে মাঝে তাতে পানি ছিটিয়ে ভেজা রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেসঙ্গে ঘরের ভিতরে ভেজা কাপড়, চট, বস্তা ইত্যাদি ঝুলিয়ে রেখে ঘরের তাপমাত্রা কমানো যেতে পারে।

০২. পাখি-প্রাণীর ঘরের ভিতর পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে, এজন্য প্রয়োজনে বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

০৩. গবাদি বা পোষা প্রাণীকে দিনের মধ্যে একাধিকবার গোসল করানো যেতে পারে অথবা পানি ছিটিয়ে শরীর ভিজিয়ে দেয়া যেতে পারে। এতে প্রাণী বেশ আরাম পাবে।

০৪. পাখি-প্রাণীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার পানি সরবরাহ করতে হবে। পানির সঙ্গে উপযুক্ত পরিমাণে লবণ/ভিটামিন সি/ইলেট্রোলাইট/গ্লুকোজ ইত্যাদি মিশিয়ে দেয়া যেতে পারে।

 গরম কমানোর চেষ্টায় হাতি

০৫. গবাদিপ্রাণী বা গরু-মহিষকে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত আবদ্ধ ঘর বা খোলা মাঠে না রেখে গাছের বা প্রাকৃতিক ছায়ায় রাখা যেতে পারে।

০৬. তাপদাহের সময় গবাদিপ্রাণীদের খড় ও অতি পরিপক্ক শক্ত আঁশযুক্ত খাবারের পরিবর্তে নরম ও কচি ঘাস প্রদান করা যেতে পারে। খাদ্য হজমের সময় যাতে তাপমাত্রা বেড়ে না যায় সেজন্য দুগ্ধ উৎপাদনকারী গাবদিপ্রাণীকে কম আঁশযুক্ত ও উচ্চ শক্তিসম্পন্ন খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করলে তা তাপদাহজনিত পীড়ন (হিট স্ট্রেস) কমাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

বড় আকারের কানের মাধ্যমে গরম কমায় মরুভূমির ফেনেক খেকশিয়াল

০৭. অতিরিক্ত গরমের সময় গবাদিপ্রাণীকে খাদ্য সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে দিনের শীতল সময়ে খাদ্য সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়া যেতে পারে।

০৮. সম্ভব হলে খণিজ মিশ্রণ ব্লক সরবরাহ করা যেতে পারে।

০৯. প্রচণ্ড গরমের সময় কৃমিনাশক ও টিকা প্রদান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তাছাড়া অতিরিক্ত গরমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রাণী পরিবহন বন্ধ রাখা উচিত। এ কাজগুলো দিনের অপেক্ষাকৃত শীতলতম সময়ে করা যেতে পারে।

খামারে লাল চাঁটগেয়ে গরুর খাদ্য ব্যবস্থাপনা

১০. যে কোন ধরনের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রাণীসম্পদ দপ্তর অথবা ভেটেরিনারি সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, বন্যপ্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ বায়োটেকনোলজি ল্যাব গাইনিকোলজি, অবস্টেট্রিক্স অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ বিভাগ, বশেমুরকৃবি, সালনা, গাজীপুর-১৭০৬।
E-mail: [email protected] 

;

তাজিয়াকাটা চরের রাজকাঁকড়া



অধ্যাপক ড. আ ন ম আমিনুর রহমান পাখি ও বন্যপ্রাণী চিকিৎসা ও প্রজনন বিশেষজ্ঞ
-কক্সবাজারের মহেশখালীর তাজিয়াকাটা চরে রাজকাঁকড়া।

-কক্সবাজারের মহেশখালীর তাজিয়াকাটা চরে রাজকাঁকড়া।

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশেষ কিছু বিরল পরিযায়ী পাখির খোঁজে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছি। কিন্তু কুমিল্লায় এসে হাইওয়ে রেঁস্তোরায় বিরতির পর গাড়ি মহাযানজটে পড়ল। রাত প্রায় আড়াইটা বাজে। এত রাতে কেন এত যানজট তা বোধগম্য হলো না। অনেক চেষ্টার পর জানা গেল কিছুক্ষণ আগে একটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি রাস্তায় উল্টে পড়ে থাকার কারণে জানজটের সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই এগুলো না সরানো পর্যন্ত যানজট বাড়তেই থাকবে। অতএব, কোনো দুঃশ্চিন্তা না করে লম্বা একটা ঘুম দিলাম। বাস জার্নিতে ঘুম দেয়া আমার জন্য কোনো ব্যাপার না। ভালোই ঘুম হলো। আর সেই ঘুম ভাঙ্গল চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর শাহ আমানত সেতু পার হওয়ার পর বাস যখন জ্বালানি নিতে পেট্রোল পাম্পে থামল তখন। কিন্তু আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘড়ির দিকে তাকাতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সকাল নয়টা বাজে। অথচ সকাল আটটায় কক্সবাজার পৌঁছার কথা ছিল। এর ফিশারি ঘাটে গিয়ে স্পিড বোটে ওঠার কথা। অথচ এখনও আমরা মাত্র চট্টগ্রাম পার হয়েছি।

যা হোক, শেষমেষ বাস কক্সবাজার পৌঁছল দুপুর ঠিক একটায়। ফলে সোনাদিয়া যাওয়া হলো না। কাজেই বিরল পরিযায়ী সৈকত পাখি দেখার পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। হোটেলে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে সোজা ফিশারি ঘাটে চলে গেলাম। হাতে মাত্র দু’ ঘন্টা সময়। গাইড গিয়াস উদ্দিনকে ফোন দিয়ে তার পরামর্শে বেলা তিনটায় মহেশখালীর তাজিয়াকাটা চরের দিকে স্পিডবোট ছোটালাম। পথে বদরকৈতর (Brown-headed Gull), ছোট পানকৌড়ি (Little Cormorant) ও গোতরা (Common Green Shank) দেখে আধ ঘন্টা পর তাজিয়াকাটা চরে পৌঁছুলাম।

তাজিয়াকাটা চরে নেমেই গোতরা, লাল-পা পিউ (Common Redshank), বড় ও ছোট টিটি জিরিয়া (Greater & Lesser Sandplover) ইত্যাদি সৈকত পাখির ছবি তুলে যে যার মতো চরের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়লাম নতুন পাখির সন্ধানে। প্রায় ঘন্টাখানেক পাখি খোঁজার ও ছবি তোলার পর আমাদের সঙ্গে আসা অপু নামে একজনের মোবাইল ফোনের মেসেজ পেয়ে ওর দিকে ছুটলাম।

মহেশখালীর তাজিয়াকাটা চরে জীবিত জীবাশ্ম রাজকাঁকড়ার পার্শ্বচিত্র

অপুর কাছাকাছি আসতেই সে বলল- ‘স্যার, কচ্ছপের মতো দেখতে এটা কী?’ কাদা পানিতে পড়ে থাকা প্রাণীটিকে পরীক্ষা করেই আনন্দে ফেটে পড়লাম! আরে, এ যে দেখছি এক জীবিত জীবাশ্ম! নতুন পাখি খুঁজতে এসে এমন এক প্রাণীর দেখা পাব ভাবতেই পারিনি! জীবিত জীবাশ্মটির ছবি তুলে ও ভিডিও করে সূর্য ডোবার আগে বাকি সময়টুকু কাজে লাগানোর জন্য সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। সেখানেও পেলাম আরেকটি জীবিত জীবাশ্ম। সেটির ছবি তুলতে তুলতে আলো পড়ে এলো। এরপর আমরা সবাই স্পিড বোটের দিকে এগিয়ে গেলাম।

তাজিয়াকাটা চরে দেখা জীবিত জীবাশ্মটি আর কেউ নয়, এদেশের এক সংকটাপন্ন অমেরুদণ্ডী প্রাণী রাজকাঁকড়া। সাগর কাঁকড়া বা অশ্বক্ষুরাকার কাঁকড়া নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Mangrove Horse-shoe Crab, Round-tail Horse-shoe Crab বা Sunderban Mangrove Horse-shoe Crab। নামে যদিও কাঁকড়া, আদতে এটি কাঁকড়ার চেয়ে বরং কাঁকড়াবিছা (Scorpion) ও মাকড়সার (Spider) নিকটাত্মীয়।

জীবিত জীবাশ্ম রাজকাঁকড়ার সামনের অংশ

সন্ধিপদী (Arthropods) পর্বের ম্যালাকোস্ট্রাকা (Malacostraca) শ্রেণীর জিফোসুরা (Xiphosura) বর্গের লিমুলিডি (Limulidae) গোত্রের প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Carcinoscorpius rotundicauda। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে প্রাণীটির দেখা মেলে।

রাজকাঁকড়ার দেহ মূলত তিন ভাগে বিভক্ত, যেমন- প্রোসোমা বা মাথা (ঘোড়ার ক্ষুরাকারের সামনের অংশ যাতে মস্তিষ্ক, মুখ, হৃৎপিণ্ড, স্নায়ুতন্ত্র ও গ্রন্থিতন্ত্র সুরক্ষিত থাকে; এছাড়াও মাথায় রয়েছে দুটি যৌগিক চোখসহ মোট নয়টি চোখ এবং আরও কিছু লাইট রিসিপটর), অফিস্তোসোমা বা উদর (প্রোসোমার পিছনের কাঁটাযুক্ত ত্রিকোনাকার অংশ যা প্রাণীটির চলাফেরা, নিরাপত্তা ও শ্বাসপ্রশাসের কাজ চালায়) ও টেলসন বা লেজ (লম্বা, চোখা ও গোলাকার লেজটি দেখতে যতই ভয়ংকর হোক না কেন, আদতে এটি না বিপদজনক, বিষাক্ত বা কাঁটা ফুটানোর জন্য ব্যবহার করা হয়; বরং লেজের মাধ্যমে এরা পিঠে চাপ দিয়ে উল্টে যাওয়া দেহকে সোজা করে থাকে)।

তাজিয়াটায় প্রাপ্ত প্রথম রাজকাঁকড়াটি উল্টে যাওয়ার পর নিচের অংশগুলো দেখা যাচ্ছে

যুগ যুগ ধরে জীববিজ্ঞানীদের কাছে এটি জীবিত জীবাশ্ম হিসেবে পরিচিত। কারণ, এর শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম বছরের পর বছর ধরে পরিবর্তিত হলেও শারীরস্থানিক গঠন অর্থাৎ বহিঃকংকালের তিনটি অংশ প্রোসোমা, অফিস্তোসোমা ও টেলসন প্রায় ৪০০ মিলিয়ন সময় ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে। রাজকাঁকড়ার ৪০০ মিলিয়ন বছরের পুরনো জীবাশ্ম দেখতে হুবহু বর্তমানকালের রাজকাঁকড়ার মতোই।

পৃথিবীতে রাজকাঁকড়ার যে চারটি প্রজাতি রয়েছে তাদের মধ্যে আমাদের দেশেরটি ক্ষুদ্রতম। অন্যান্য প্রজাতির মতো এটিরও স্ত্রী পুরুষের চেয়ে আকারে বড় হয়। স্ত্রী ও পুরুষের প্রোসোমা যথাক্রমে ১৬ ও ১৪ সেন্টিমিটার (সেমি) চওড়া হয়ে থাকে। আর গোলাকার লেজটিও প্রায় ১২ থেকে ১৪ সেমি হতে পারে। এদের ছয় জোড়া পা রয়েছে। সামনের একজোড়া পা খাবার ধরার কাজে ও বাকি পাঁচ জোড়া পা চলাফেরার কাজে ব্যবহার করে। দেহের উপরের রং জলপাই-বাদামি ও নিচের অংশের রং খয়েরি।

তাজিয়াকাটা চরের পাড়ে প্রাপ্ত দ্বিতীয় রাজকাঁকড়াটির দেহের উপরের অংশ

রাজকাঁকড়া দেশের পূর্বাঞ্চলীয় উপকূল, যেমন- কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, সোনাদিয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া দ্বীপপুঞ্জ এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল, যেমন- সুন্দরবনে দেখা যায়। এরা জীবনের বেশিরভাগ সময় সাগর বা নোলাজলের তলদেশে কাটায়। নিশাচর এই প্রাণীটি উপকূলীয় অগভীর জলের পলিময় নরম ও বেলে মাটিতে বাস করে। সচরাচর জলজ কীটপতঙ্গের শূককীট, ছোট মাছ, ক্ষুদে কাঁকড়া, পাতলা খোসার ঝিনুক, শ্যাওলা ইত্যাদি খায়। এদের কোনো চোয়াল বা দাঁত না থাকায় পিছনের পায়ের মাধ্যমে খাবার ভেঙে সামনের পা দু’টি দিয়ে মুখে পুরে।

বসন্তের শেষ থেকে গ্রীষ্মের শুরু এদের প্রজননকাল। এরা পূর্ণিমার রাতে ভরা জোয়ারের সময় প্রজনন করে। এ সময় এরা নিজেদেরকে জড়িয়ে ধরে সমুদ্র সৈকতে আসে। স্ত্রী নরম বালি খুড়ে বাসা তৈরি করে তাতে ডিম পাড়ে। আর পুরুষ সেই ডিমের উপর শুক্রাণু ছড়িয়ে দিয়ে সেগুলো নিষিক্ত করে। এভাবে স্ত্রীটি কয়েকবারে প্রায় ১০ হাজার ডিম পাড়ে। এদের ডিম সরীসৃপ, পাখি ও মাছের প্রিয় খাবার হওয়ায় শেষ পর্যন্ত খুব কম ডিমই ফোটার সুযোগ পায়। যাহোক, ডিমগুলো এসব শিকারি প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পেলে ডিম ফুটে শূককীট বের হতে প্রায় দু’সপ্তাহ সময় লাগে।

দ্বিতীয় রাজকাঁকড়াটির দেহের নিচের অংশ

শূককীটগুলো দেখতে হুবহু বয়স্ক রাজকাঁকড়ার মতো, শুধু আকারেই ছোট এবং এদের লেজ থাকে না। এরপর এই শূককীটগুলো সমুদ্রে চলে যায় ও সমুদ্রের বালুময় তলায় টাইডালে ফ্ল্যাটে অবস্থান করে এবং এভাবে প্রায় বছরখানেক থাকে। এরপর খোলস পাল্টিয়ে রূপান্তরের মাধ্যমে আকারে বড় হয় ও সমুদ্রের আরও গভীরে চলে যায়। প্রায় দশ বছরে ১৬ থেকে ১৭ বার খোলস পাল্টে এরা প্রাপ্তবয়স্ক প্রাণীতে পরিণত হয়। এদের আয়ুষ্কাল প্রায় ২০ বছর।

যদিও এদেশে রাজকাঁকড়ার সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই, তথাপি বিজ্ঞানীর মনে করেন নানা কারণে, যেমন- অতিরিক্ত শিকার, পরিবেশ দুষণ, আবাস ধ্বংস ইত্যাদি কারণে গত ২৫ বছরে দেশের ৩০% রাজকাঁকড়া বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে। আর একারণেই এরা বর্তমানে সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। কাজেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের এই জীবিত জীবাশ্মটিকে রক্ষায় আমাদের সকলের এগিয়ে আসা উচিত।

;

মোংলা-ঘোষিয়াখালী ক্যানেলের তীরভূমি দখলের মহোৎসব: নাব্যতা হারানোর শঙ্কা



মনিরুল ইসলাম দুলু, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বাগেরহাট
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

মোংলা-ঘোষিয়াখালী ক্যানেলের তীর ও প্লাবনভূমির হাজার একর সরকারি চরভরাটি জমি দখল করে মাছ চাষের মহোৎসব চলছে।

এসব জমি দখলে নিয়ে বড় বড় খামার করে মাছচাষ করাসহ বাড়িঘর নির্মাণ করে বসবাস করতে শুরু করেছেন অনেকেই। এতে সরকারের হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি বেহাত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

চ্যানেলের তীর ও প্লাবনভূমির পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় নতুন করে হুমকিতে পড়েছে চ্যনেলটি। এতে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ও মোংলা বন্দরও হুমকিতে পড়ার ফের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাগেরহাট জেলা কালেক্টর, বাগেরহাটের পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিআইডব্লিউটিএসহ সংশ্লিষ্টদের উদাসিতা ও নজরদারির অভাবে এত বিপুল পরিমাণ মূল্যবান জমি বা তীরভূমি বেহাত হতে চলেছে বলে পরিবেশবাদী সংগঠন ও সচেতন মহল অভিযোগের আঙুল তুলেছে।

মোংলা-ঘোষিয়াখালী চ্যানেল

জানা গেছে, মোংলা-ঘোষিয়াখালী চ্যানেলটি ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। জলবায়ু পরিবর্তন ও মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার কারণে এটি নাব্যতা হারায়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে প্রায় ৫ শত কোটি টাকা ব্যয়ে চ্যানেলটি খনন করে উম্মুক্ত করা হয়।

চ্যানেলটির নাব্যতা রক্ষায় মূল চ্যানেলটির ৫ কিলোমিটার এলাকা বাদ দিয়ে রোমজাইপুর পয়েন্টে লুফ কাট দিয়ে আলাদা করা হয়। ৫ কিলোমিটার এলাকা লম্বা ও প্রায় ৩শ মিটার চওড়া নদীর মূল অংশ খনন না করায় এটি এখন শীর্ণকায় খালে পরিণত হয়েছে, যা মুজিবনগর ও রোমজাইপুর পয়েন্টের বড়দিয়া, ছোটদিয়া, কুমারখালী মৌজার কালিগঞ্জ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।

পাঁচ কিলোমিটার চ্যানেলের অংশে ৬০-এর দশক থেকে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে নদী ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এতে প্রায় হাজার একর জমি সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

এটি রক্ষণাবেক্ষণেও সরকারের ভূমি ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্টদের নানান অসামঞ্জস্যতা রয়েছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। নদী ভাঙনের পর চরভরাটি জমি এক শ্রেণির কথিত ভূমিহীন ও ভূমিদস্যুরা রামপালের সেটেলমেন্ট অফিস ও রামপালের সহকারী কমিশনারের অফিসের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে তঞ্চকি কাগজপত্র তৈরি করে রেকর্ড করে নেন। এমনকী তারা কেউ কেউ আদালতে ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে জমি হাতিয়ে নিয়েছেন। ব্যক্তি মালিকানার জমি ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে অপর পাড়ে চর পড়লে সেটিও ভূমিদস্যুরা কাগজপত্র তৈরি করে মালিকানায় নিয়ে নেয়, যা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে বলে সচেতন মহল মনে করেন।

নতুন করে মুজিবনগর পয়েন্টে ভূমিদস্যুরা আবারও নদীর তীরভূমি ও প্লাবনভূমি দখল করে বেড়িবাঁধ দেওয়া শুরু করেছে।

গিলাতলার মিজান মল্লিকের নেতৃত্বে মুজিবনগর গ্রামের শেখ ইলিয়াসের ছেলে শেখ বেলাল, রুস্তুম শেখের ছেলে শেখ মুকুল, শেখ শরিফুল, শেখ সাইফুল ও শেখ সোলাইমানের ছেলে শেখ আরিফ এবং মৃত শেখ মাহাতাবের ছেলে মোজাফফর হোসেন বেড়িবাঁধ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ের মল্লিক মিজানুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।

শেখ বেলাল, মুকুল, আরিফ ও শরিফুল বলেন, সবাই সরকারি খাস জমি দখল করে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন। আমরা বাঁধ দিতে গেলে মিজান মাস্টারের লোকজন বাধা দিচ্ছে। সবাই জমি ঘিরেছে। আমরা ঘিরলে দোষ হচ্ছে!

মোংলা-ঘোষিয়াখালী ক্যানেল

এ ব্যাপারে ‘মোংলা-ঘোষিয়াখালী চ্যানেল রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’র সদস্য সচিব মোল্লা আব্দুস সবুর রানা অভিযোগ করে বলেন, বাগেরহাট জেলা কালেক্টর, সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিআইডব্লিউটিএ’র নজরদারির অভাবে হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি বেহাত হয়েছে। নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে এবং হুমকির মুখে পড়েছে চ্যানেলটি।

এ বিষয়ে রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রহিমা সুলতানা বুশরা বলেন, মোংলা-ঘোষিয়াখালী চ্যানেলের নাব্যতা রক্ষায় সব কিছু করা হবে। সরকারি জমি অবৈধভাবে দখলকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জনবল সংকটের কারণে ভূমি ব্যবস্থাপনায় বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে বলে দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি।

;