গণপরিবহনে যৌন হয়রানি বন্ধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে
উন্নয়ন ও নগরায়নের কারণে নারীদের গণপরিবহন ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা আজ অনস্বীকার্য। নারীর ক্ষমতায়নের ফলে তাদের ঘর ছাড়ার প্রয়োজনও বেড়েছে। বর্তমানে নারীরা কর্মক্ষেত্রে, স্কুলে, কলেজে, শিশুদের স্কুলে পাঠাতে ও আনতে, অসুস্থ হলে হাসপাতালে যেতে ও বিভিন্ন কারণে অনত্র যাতায়াত করতে গণপরিবহন ব্যবহার করে কিন্তু গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে পড়েছে। গণপরিবহনে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হননি এমন একজন নারীকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। দেশের গণপরিবহনে চলাচলকারী কতজন নারী যৌন হয়রানী ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিভিন্ন সময়ে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় তা থেকে দেশের গণপরিহনে নারীদের যৌন হয়রানীর বিক্ষিপ্ত কিছু চিত্র পাওয়া যায়।
গণপরিবহনে নারীদেরকে শুধু যৌন হয়রানী নয় এমন ঘটনাও ঘটে যে গণপরিহনে নারী যাত্রীকে ধর্ষণ, ও ধর্ষণের পর হত্যা করে নির্জন স্থানে ফেলে যাওয়ার মতো সংবাদও আমরা জানি।
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, বিভিন্ন গণপরিবহন যেমন, বাস, লঞ্চ, ট্রেন, অন্যান্য যানবাহন এবং টার্মিনাল সহ গণপরিবহনে ৩৬ শতাংশ নারী নিয়মিত যৌন হয়রানির শিকার হন।
এছাড়াও, ৮৭ শতাংশ নারী তাদের জীবনে অন্তত একবার যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। আর ৬৬ শতাংশ নারী কয়েকবার এবং ৭ শতাংশ নারী বারবার যৌন হয়রানিসহ নানা হয়রানির শিকার হন। তবে হয়রানির শিকার ৩৬ শতাংশ নারী প্রতিবাদ করেছেন বলে অনলাইনে পরিচালিত ওই জরিপে উঠে এসেছে।
ইউএনডিপি বাংলাদেশ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) এর যৌথ উদ্যোগে ২৪ টি জেলার ৫,১৮৭ জন নারীর অংশগ্রহণে বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে যেমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টেক্সট মেসেজ এবং ই-মেইল এর মাধ্যমে যোগাযোগ করে এই ফলাফল পাওয়া গেছে।
সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী, ২৩ শতাংশ মহিলা রাস্তায় এবং ১১ শতাংশ মার্কেট ও শপিং মলে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং ১১ শতাংশ মহিলা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সাইবার বুলিং এর শিকার হয়েছেন।
এর মধ্যে ৪২ শতাংশ নারী উত্ত্যক্তের, ১২ শতাংশ অপ্রত্যাশিত স্পর্শ ও ১১ শতাংশ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হন। এছাড়া ৪২ ভাগ নারী ইভটিজিংয়ের শিকার হন। ১৭ ভাগ নারী পাবলিক প্লেসে অশোভন আচরণের এবং ১২ শতাংশ অপ্রত্যাশিত স্পর্শের শিকার হন।
সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৩৬ শতাংশ নারী হয়রানির প্রতিবাদ করেছেন, এবং ৩৪ শতাংশ নারী কিছুই করেননি। ৭ শতাংশ নারী তাদের পরিবারকে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেছেন এবং মাত্র ৫ শতাংশ নারী এবিষয়ে তাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছিলেন। হয়রানির শিকার মাত্র ১ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চেয়েছেন, ১ শতাংশ ৯৯৯ এ ফোন করেছেন এবং ১ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন ও সহযোগিতা চেয়েছেন।
জরিপ অনুযায়ী, ৫৭ শতাংশ নারী গণপরিবহনকে সবচেয়ে অনিরাপদ বলে মনে করেন। অন্যদিকে, ৪৪ শতাংশ নারী প্রকাশ্যে হয়রানির শিকার হয়েও কোনো সাহায্য পাননি।
অন্য একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণপরিবহনে যাতায়াতকারী ৬৩ শতাংশ নারী, যুবতী এবং মহিলা হয়রানির শিকার হন। তাদের মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন - এই মহিলাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক যারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন তারা পরে মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন।
যৌন হয়রানির মধ্যে রয়েছে গণপরিবহনে ওঠা ও নামার সময় চালকের সহকারীর অযাচিত স্পর্শ, বাসে আসন থাকা সত্ত্বেও যাত্রীদের পাশে দাঁড়ানো, অনাকাঙ্খিত স্পর্শ, ধাক্কাধাক্কি এবং অশালীন মন্তব্য। জরিপে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ নারী ঝামেলা এড়াতে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেননি।
যৌন নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে যাত্রীর সংখ্যাই বেশি। গণপরিবহনের চালক ও চালকের সহকারীর হাতেও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন অনেকে। নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা বেশি।
আঁচল ফাউন্ডেশন ৫ মার্চ, ২০২২-এ 'তরুণীদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের মোট তরুণীর ৬৫.৫৮ শতাংশই যৌন হয়রানির শিকার। এছাড়াও, ৪৫.২৭ শতাংশ তরুণী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হন। ৮৪.১০ শতাংশ তরুণী বাসে বা বাস স্ট্যান্ডে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন, যা গণপরিবহনের সর্বাধিক ব্যবহৃত রূপ। গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হওয়া এসব নারীর ৬৫ শতাংশই বিভিন্ন কটূক্তির শিকার হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা গণপরিবহনে যৌন হয়রানির বিভিন্ন কারণউল্লেখ করেন। এগুলো হলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়; মহিলাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাবের অভাব; নারীকে পণ্য ও ভোগের বস্তু হিসেবে বিবেচনা করা; পর্নোগ্রাফির অবাধ প্রবাহ; ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার; ভাল আচরণের অভাব; মাদকাসক্তি এবং সুশিক্ষার অভাব ইত্যাদি।
তারা গণপরিবহনে যৌন হয়রানির প্রতিকারে আইনের কঠোর প্রয়োগের পরামর্শ দেন। এছাড়াও সামাজিক আন্দোলন ও প্রতিরোধ জোরদার করা; সামাজিক বয়কট এবং যৌন হয়রানির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি; কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা এবং মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট এবং উন্মুক্ত সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিশ্চিত করা;নারীদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব বিকাশের পরিবেশ তৈরি করা; বিনোদনমূলক এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলন বৃদ্ধি; পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ; আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির সক্রিয় ভূমিকা পালন করা; গণপরিহনে নারীদের সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা এবং তাদের নিজেদের নিরাপত্তার সক্ষমতার প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
সর্বোপরি, গণপরিবহনের মালিকদের সচেতন হওয়া এবং কোনো গণপরিবহনকর্মী যাতে নারীদেরকে যৌন হয়রানীসহ অন্য কোনোভাবে হয়রানী না করে সেসম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করা। কোনো গণপরিবহনকর্মী এমন আচরণ করলে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।
যেখানে ঘর ও কর্মস্থলের বাইরে গণপরিবহনে নারীদের নিরাপদ থাকার কথা, সেখানে গণপরিবহনে নারীদের যৌন হয়রানির ঘটনা দিন দিন বাড়লে নারীর নিরাপত্তা সম্পূর্ণভাবে হুমকির মুখে পড়বে, যা একটি দেশের সুশাসনের মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই গণপরিবহনে নারী নির্যাতনের এ ধরনের বিপজ্জনক পরিসংখ্যানকে কমিয়ে আনতে দেশের দায়িত্বশীল সকলের এগিয়ে আসা সময়ের দাবি।
ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।