এমপির নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টের জোর



কবির য়াহমদ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সবুজ, নীল ও লাল; বাংলাদেশে এই তিন রঙের পাসপোর্ট রয়েছে। সরকারি চাকরিজীবী ও সর্বসাধারণের জন্যে সবুজ পাসপোর্ট, সরকারি কাজে কর্মকর্তারা বিদেশ সফরে গেলে নীল পাসপোর্টের ব্যবহার হয় এবং অন্য পাসপোর্টটির রঙ লাল।

এই লাল রঙের পাসপোর্ট ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য ও তাদের স্পাউস (স্বামী-স্ত্রী) এই পাসপোর্ট পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন।

লাল রঙের পাসপোর্ট পেয়ে থাকেন উচ্চতর আদালতের বিচারপতি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রধান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বিদেশে বাংলাদেশি মিশনের কর্মকর্তারা। লাল রঙের এই পাসপোর্টধারীরা দেশে-দেশে অন-অ্যারাইভাল ভিসা পান। এর অন্য বিশেষত্ব হচ্ছে, ডিপ্লোম্যাটিক বা কূটনৈতিক পাসপোর্ট সব দেশেই লাল রঙয়ের হয়ে থাকে।

পাসপোর্টের রঙয়ের প্রসঙ্গের অবতারণা মূলত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ভ্রমণে গিয়ে বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্যের হত্যাকাণ্ড। ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার চিকিৎসা ও বন্ধুর মেয়ের বিয়ের জন্যে ভারতে গিয়ে খুন হয়েছেন। গত ১২ মে তিনি সড়কপথে ভারতে যান। গিয়ে ওঠেন তার পরিচিত এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে। আগেও যখনই কলকাতা গেছেন তখনও ওই বাড়িতে উঠতেন তিনি বলে জানা গেছে।

১৩ মে চিকিৎসার কথা বলে ওই বাড়ি ত্যাগ করেন বলে পশ্চিমবঙ্গের থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিতে (জিডি) উল্লেখ করেন স্বর্ণ-কারবারি গোপাল বিশ্বাস আর ১৬ মে তারিখ আনোয়ারুল আজীম আনারের ব্যক্তিগত সহকারীর মোবাইল ফোনে সবশেষ কল আসে বলে জানা গেছে।

ভারতে যাওয়ার এক সপ্তাহ এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার তিনদিন পর আনোয়ারুল আজীম আনারের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভারতে গিয়ে তিনি ‘নিখোঁজ’। হয়ত তাৎক্ষণিক বিভিন্ন মাধ্যম ও দপ্তরে এই সংবাদ গেছে, তবে সংবাদমাধ্যমে এই খবর এসেছে ১৯ মে।

ওইদিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ‘আনোয়ারুল আজীম আনারকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই’ মন্তব্য করে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘আমাদের এনএসআই কাজ করছে। ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো হয়েছে। উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নাই’।

মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘তিনি (আনোয়ারুল আজীম) পুরানা মানুষ, একজন সংসদ সদস্য বুঝেশুনেই তো চলেন। পাশের দেশ ভারতে গেছেন। এমন তো না মিয়ানমার গেছেন, যে মারামারি লেগেছে। আমার মনে হয় এসে পড়বেন।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে আশ্বস্ত করার বার্তা ছিল। ছিল প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে প্রবল বিশ্বাস। ‘এমন তো না মিয়ানমার গেছেন’ এই মন্তব্যে ভারত সম্পর্কে যে প্রবল আস্থার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তিনি, দেখা গেল তার উল্টো ফল! নিখোঁজের পর এখন জানা গেছে, ভারতে গিয়েই খুন হয়ে গেছেন আনোয়ারুল আজীম আনার এবং খুনের ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভারতে এমপি আনারকে খুন করেছে বাংলাদেশিরাই। এই ঘটনায় কোনো ভারতীয় সম্পৃক্ত নাই বলে তার দাবি।

ভারতের কেউ হয়ত এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত নয়, তবে ঘটনাস্থল যখন ওখানে তখন কি সত্যিই দায় এড়ানো যায়!

প্রথমে খবর এসেছিল সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের একটি ভবন থেকে। পরে জানা গেছে, তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। মরদেহের সন্ধান চলছে। এরই মধ্যে দেশে-বিদেশে অন্তত পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভারতীয়দের কেউ নয়, বাংলাদেশিদের দ্বারা খুন হয়েছেন আনোয়ারুল আজীম আনার। বিষয়টির তদন্ত চলছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভাষায় বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে তদন্ত শেষ! অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই আবার নিখোঁজের সংবাদ প্রকাশের পর পরই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘তিনি পুরানা মানুষ, একজন সংসদ সদস্য বুঝে শুনেই তো চলেন। আমার মনে হয় এসে পড়বেন।’ বাস্তবতা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত তার ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। মন্ত্রীও বলছেন, খুন হয়েছেন।

সংবাদমাধ্যমে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের অতীত বের হয়ে আসছে ক্রমশ। জানা যাচ্ছে, তিনি আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ওয়ারেন্টভুক্ত ছিলেন। হুণ্ডি কারবার, চোরাচালান ও পাচারের অভিযোগে ইন্টারপোল তার বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি করেছিল। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে, এমপি হয়ে তিনি সেই নোটিস প্রত্যাহার করিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বিভিন্ন সূত্র বলছে, স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে তিনি ওই এলাকায় শুরু করেছিলেন, বিকশিত হয়েছিলেন বিএনপির আমলে আর জনপ্রতিনিধি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের আমলে। পেয়েছিলেন সব জায়গা থেকে ‘দায়মুক্তি’। এখন তাই অতীতকে ভুলে আমরা ব্যস্ত শোকপ্রকাশে। মানবিক শোকের প্রকাশ যদিও দোষের নয়, তবু সত্য অপরাধ তামাদি হয় না কখনো।

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের এমন মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত। বিদেশে বিশেষ করে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্রে বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্যের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উদ্বেগজনক। যদিও এটা তার সরকারি সফর নয়। তিনি একাই গিয়েছিলেন ভারতে। চিকিৎসা, ব্যবসা কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া, যে কারণেই হোক এই সফরটা ব্যক্তিগত হলেও তার পরিচিতি এখানে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য। তিনি দেশের লাল রঙের পাসপোর্ট ব্যবহার করে থাকেন। পৃথিবীর প্রতি দেশের ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টের রঙ লাল। এই হিসেবে তার এই বিদেশ সফরও দুই দেশের কারো অজানা থাকার কথা নয়।

ভারতে বাংলাদেশের সংসদ সদস্যের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একাধিক মন্ত্রী বিষয়টির মধ্যে প্রতিবেশী দেশকে আমলে নিতে চাইছেন না। বিএনপি মহাসচিব খোঁচা দিয়েছেন, ‘বন্ধুরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব’ নিয়ে। এখানে ভারতকে আড়াল করার চেষ্টা, সামনে আনার চেষ্টার মধ্যে রাজনীতি এবং ভারতপ্রেম ও বিদ্বেষ আছে তাদের তবে এখানে তাদের দায় নেই কোনো এটা বলার সময় কিন্তু আসেনি এখনো। আগবাড়িয়ে তাদেরকে দায় দেওয়া ও দায়মুক্ত করার এই প্রচেষ্টা অপ্রয়োজনীয়। এটা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের যোগাযোগ, সম্পর্ক ও তদন্তের বিষয়।

ভারতের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক। বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের অগ্রগতি সবখানে দেশটির সহায়তা ও অংশগ্রহণ আছে। এই সত্যিকে স্বীকার করেও প্রশ্ন রাখা যায়, সীমান্তে নাগরিক মরে গুলিতে, আর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের এমপি কেন মরবেন আততাতীয় হাতে! এখানে কি ওই দেশের কোনো দায় নেই! সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তিনি যখন ভারত প্রবেশ করলেন তখন তার পাসপোর্ট সূত্রেই ভারত জানতে পেরেছে দেশটিতে একজন সংসদ সদস্য প্রবেশ করেছেন। এগুলো অতি-স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে যখন কোনো বিদেশি ভিআইপি প্রবেশ করেন, তখন কি নানা সংস্থা, কর্তৃপক্ষ অপ্রকাশ্য হলেও সক্রিয় হয় না! নজরদারি, নিরাপত্তাসহ বিবিধ দিক দেখার বিষয় এখানে প্রাসঙ্গিক। ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টের জোর তো এখানে!

প্রাথমিক তথ্যের সূত্র ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, বাংলাদেশিদের দ্বারা কলকাতায় হত্যাকাণ্ডের শিকার সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। এই মন্তব্য কি আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরুর আগে তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে দেওয়ার মতো মন্তব্য হয় না! চূড়ান্ত তদন্তেও যদি এটা প্রমাণ হয়, তবু প্রশ্ন রাখাই যায়, বাংলাদেশিরা ভিন দেশে গিয়ে এত বড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার সময়ে কি টের পাবে না দেশটির নানা বাহিনী, সংস্থা! এখানে কি সত্যি দায় থাকছে না তাদের!

ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টধারী বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মরদেহ এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি। অথচ প্রথমে জানা গিয়েছিল মরদেহ উদ্ধারের কথা। দেশটির একটা অভিজাত এলাকায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া একদল আততায়ী খুন করেছে, মরদেহ সরিয়ে নিয়েছে, খুনের ঘটনা নিশ্চিতের আগে সন্দেহভাজনরা গ্রেফতার হয়ে গেছে, প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রের ‘দায় আছে দায় নেই’ আলোচনাও শুরু হয়ে গেছে—এত সব ঘটনা ঘটেছে, দ্রুততম সময়ে। এগুলো রহস্যজনক!

হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে ঘটে যাওয়া এত সব ঘটনার রহস্য উন্মোচনও জরুরি।

কবির য়াহমদ: অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর,বার্তা২৪.কম

   

কালো টাকা সাদা বলা- পাপকে ঘৃণা করছি না কেন?



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

নসর পেয়াদা গল্পে ভুলে মাছ রান্নার তেল কেনা হয়েছিল মদের বোতলে। সেজন্য সেই রান্না করা লোভনীয় মাছ কোন মুসলিম সে রাতে খাননি। স্কুলে পড়েছিলাম সেই গল্প। কারণ, মাদকদ্রব্য সেবন করাই মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ বা হারাম। এ গল্পে ধর্মীয় নৈতিকতার একটা মহান শিক্ষা মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। তখনকার দিনে মানুষ এতটা ধর্মপরায়ণতার চিন্তা করতো না-কিন্তু, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দের তফাৎ করাকে কায়মনোবাক্যে পালন করতো। যে যার ধর্মের বিধি-নিষেধগুলোকে শ্রদ্ধাভরে পালন করতো। এখন দিন পাল্টে গেছে। মানুষ দিন দিন বড্ড বেশি অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে।

আজকাল ব্যস্ত মানুষের সময় কেড়ে নিচ্ছে মোবাইল ফোন আর সংযুক্ত এন্তারজাল। যে মায়াজালে মানুষের চোখ-মন সব সময় আটকে থাকে। তাইতো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, অভিভাবক বা কারো সঙ্গে কোন কিছুর ভাল-মন্দ শেয়ার করার কোন সময় না পেয়ে ভুল করে বসে। এভাবে গায়ের চামড়ার রং আরও ফর্সা করার জন্য বিষাক্ত ক্রিমের ব্যবহার করতে গিয়ে দেহকে বিকৃত করেতে দ্বিধা করছে না!

এবারের জাতীয় বাজেটে কালো টাকা সাদা করার ঘোষণা নিয়ে একটি বিতর্কের কলামে চোখ আটকিয়ে গেল। টিআইবি মন্তব্য করেছেন-কালো টাকা সাদা করা অসাংবিধানিক, বৈষম্যমূলক, দুর্নীতিবান্ধব এবং প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণার পরিপন্থি।

দেশে একশ্রেণির মানুষ অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। এদের প্ররোচণায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্বরত নীতিবান মানুষগুলোর সৎ ও জনকল্যাণকর নীতিগুলো বার বার ভূলুন্ঠিত হয়ে পড়ে। বাধাগ্রস্থ হয় সততা। জিইয়ে থাকে মাদক ব্যবসা, অনৈতিক লেন-দেনের সিস্টেমগুলো। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অন্যায়-অবিচার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষিত জিরো টলারেন্স বা সহ্যের শূন্য সীমা- তাহলে কি তারা ভাঁওতাবজিতে পরিণত করতে চায়?

কালো টাকার জন্ম অন্ধকারের ঘুপচি গলিতে। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, জালিয়াতি, মিথ্যা, প্রতারণা, কর ফাঁকি, চুরি-ডাকাতি, প্রতারণা, চোরাচালানি, অবৈধ মাদক ব্যবসা, ব্যাংক লুন্ঠন, মানি লন্ডারিং, জমি জবরদখল, নদীদখল, ভেজালদ্রব্য তৈরি ও বিক্রি সর্বোপরি ধর্মীয় প্রতারণা, মাজার ব্যবসা, যাকাত ফাঁকি-ইত্যাকার নানা বাজে পন্থা হলো কালো টাকার আঁতুড় ঘর। এসব কালো টাকার মালিকরা সমাজের হোমড়-চোমড়া। নৈতিকার বালাই নেই এদের কাজে কর্মে ও নীতিতে। দেশের কর প্রদান করতে গেলে ধরা পড়তে পারে তাই এরা একদিকে সঠিক পরিমাণ কর দেয় না অন্যদিকে ধর্মীয় ও নৈতিকতাবোধ না থাকায় যাকাত প্রদানেও বিরত থাকে। তাই এদের দ্বারা রাষ্ট্রের আর্থিক কোন মর্যাদা বাড়ে না, দরিদ্র মানুষের কল্যাণও সাধিত হয় না।

রাসায়নিকভাবে কালো রংয়ের মধ্যে সাদা রং মেশালে তা সাদা থাকে না। ছাই বা এ ধরণের ভিন্ন রং ধারণ করে। যা অনেক সময় ছাই বা উৎকট পরিবেশ তৈরি করে বিশ্রি রূপ নেয়! কালো টাকা সাদা করতে গিয়ে যদি সমাজে কিছু ছাই জন্ম নেয় তাহলে মানুষের স্বাভাবিক মানসিক পরিস্থিতি খিঁচড়ে গিয়ে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

বাংলাদেশ মুসলিম রাষ্ট্র। এদেশের কর্ণধারগণ মোটামুটি সবাই হজ করে থকেন। কেউ কেউ কিছুদিন পর পর পবিত্র ওমরাহ পালন করতে মক্কা-মদিনায় গমণ করে থাকেন। সেখানে গিয়ে তারা পবিত্র দেহ-মন নিয়ে ফিরে আসেন, দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তারা নিশ্চই চাইবেন না- দেশে এখনও কালো টাকা থাকুক অথবা কালো টাকা জন্ম নিক। আমাদের ৯০ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশে সিংহভাগ মানুষই ন্যায়নীতির সাথে জীবন যাপন করতে ভালবাসে। তারা সেই পরিবেশ আরু ভালো হোক্ সেটাই কামনা করে। তবে কেন মাত্র ১০% কর দিয়ে মিথ্যার বেসাতী ? যারা কালো টাকা সাদা করার পক্ষে তার কি পর্যবেক্ষণ করেন না যে এর চেয়ে কত বেশি অর্থ প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে হারাতে হয়?

কালো টাকা সাদা করার সংবাদ দুর্নীতিকে বহু গুণে উস্কে দিবে। জাতি আর জেনেশুনে পাপী হতে চায় না। আমাদের লাখ-কোটি টাকার বাজেটে কালো টাকা সাদা করার অবদান যতই থাকুক না কেন তা অবৈধ, নাপাক! একজন হাজি সৎ রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে এই অবৈধ অর্থের পৃষ্ঠপোষকতা না করে বরং ঘৃণা প্রদর্শন করা উচিত। তা না হলে আমাদের উন্নয়নের বরকত কেন উধাও হয়ে যায়? আমাদের সোনার দেশের সোনার ছেলেরা বর্তমানে গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ছেড়ে কোন অশান্তিতে পিষ্ট হয়ে ভূ-মধ্যসাগরে রিফিউজি হয়ে বার বার সাগরডুবিতে মারা যায়?

সেজন্য লাগামহীন দুর্নীতি কমানোর জন্য জিরো টলারেন্স বা সহ্যের শূন্য সীমা নামক যে জোর প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে সেটাই থাক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন পিছু না আসে সেজন্য সবাই নিজ নিজ ধর্মমতে প্রার্থনা করুন। আশা করা যায়, কালো টাকা সাদা করার প্রচেষ্টা থেকে সরে এলে শান্তি আসতে পারে। আমাদের হতাশা ও অস্থিরতা বেড়েছে, শান্তি কমে যাচ্ছে দিন দিন। এদিকে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইপির প্রতিবছরের মত এবারের রিপোর্টে প্রকাশ- ২০১৮ সালে বিশ্ব শান্তি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯২ থাকলেও ২০১৯ সালের জুনে এসে তা ৯ ধাপ পিছিয়ে ১০১তম হয়েছে। বিশ্ব শান্তি সূচকে এক বছরে নয়ধাপ অবনমন আমাদের দেশের জন্য ভয়ংকর অশনিসংকেত।

কালো টাকা প্রতিবছর সাদা করার ঘোষণা দেওয়াটা আমাদের দেশের মানুষের ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা দেশে হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদেরকে আরও বেশি উৎসাহ দিচ্ছে এবং দুর্বৃত্তপরায়ণাতাকে শক্তিশালী করে তুলছে। তার প্রমাণ ২০২৪ সালে শুরুতে কেতাদুরস্ত সরকারি -বেসরকারি কুম্ভীলকদের ভয়ংকর রকম চুরি-ডাকাতির ঘটনা ফাঁস হওয়া ও তাদেরকে ক্ষমতাধর মহারথীদের যাদুমন্ত্রের কারসাজিতে দেশ থেকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেওয়া। এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনা আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধকে চপেটাঘাত করেছে, চরম আয়বৈষম্য, দ্রব্যমূল্যসন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে এবং গণদারিদ্র্যকে আরও বেশি ঘনীভূত করার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। এটা কোন কোন ভণ্ড মুসলিম নামধারীদের নীতি হলেও দেশের আপামর প্রকৃত মুমিন-মুসলিমদের আর্থিক নীতি হতে পারে না।

এবারের বাজেটে ডিভিএস বা ডাটা ভেরিফিকেশন সিস্টেম চালু করে অপ্রদর্শিত আয় বা দুর্নীতির কালো টাকা দিয়ে ফ্লাট, অ্যাপার্টমেন্ট, জমি কেনা ইত্যাদি বৈধ করার ঢালাও সুযোগ সত্যিই হতাশাজনক। এটা সুনাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের সরকারি নির্দেশনা যা সংবিধানের (২০) অনুচ্ছেদকে লঙ্ঘন করে। তাই এ বাজেট জনবান্ধবব না হয়ে দুর্বৃত্তবান্ধব বটে। এটা সুশিক্ষা, নৈতিকতা ও মানব উন্নয়নেরও পরিপন্থি। তাই আমাদের আগামীর চরিত্রবান প্রজন্মের তাগিদে এই ভিনদেশী অর্থনৈতিক সংস্কৃতির ধারক অশুদ্ধ-পাপী নীতি এখনই পরিহার করা প্রয়োজন।

কালো টাকা মানুষ ও রাষ্ট্রের অশান্তির মূল কারণ-সেটা ঘরে হোক বা বাইরে হোক। অর্থনীতির ভাষায় যিনি যতই জোর গলায় কালো টাকা সাদা করার সাফাই গেয়ে যুক্তি দিন না কেন- গোয়ালা গাভির দুধ দোহনের সময় এক বালতি দুধে এক ফোঁটা প্রস্রাব যদি অসাবধানতাবশত: ছিটকে পড়ে তাহলে একজন পবিত্র মানুষ কি জেনেশুনে সেটা পান করতে চাইবেন?

এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার ঘোষণা দেশের বৈধ করদাতাকে আরও বেশি নিরুৎসাহিত করবে, সৎ মানুষের সাদা মনকে ভেঙে চুরমার করে দেবে ও সামাজিক ভাঙনকে আরও ত্বরান্বিত করে তুলবে। তাই অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে দেশের সব মানুষের শান্তি ও কল্যাণের জন্য আত্মিক ও নৈতিকতা জোরদার করণ কর্মসূচি নিয়ে আজকেই নতুন সৎ ভাবনা শুরু করা দরকার। সভ্যতার ডিজিটাল ও গতিশীল জাগরণের যুগে মানুষ আর জেনেশুনে পাপী হতে চায় না।

দেশে একশ্রেণির মানুষ অবৈধভাবে কর্মকানণ্ডের জোয়ারে জিইয়ে আছে ভয়ংকর মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, অনৈতিক লেন-দেনের সিস্টেমগুলো। তারা রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অন্যায়-অবিচার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষিত জিরো টলারেন্স কি তারা নিছক ভাঁওতাবজিতে পরিণত করে আরও বেশি পাপ করতে চায়? নাকি তারা বরেরও মাসি কনেরও পিসি? এসবের উত্তর দেবার সময় এখনই ।

ইসলাম ধর্মে কালো টাকা পাপের সঙ্গে তুলনীয় কারণ, এটা ইসলামের মৌলিক নীতির বিরুদ্ধে যায়। ইসলামে নৈতিকতা ও সততার গুরুত্ব অপরিসীম। কালো টাকার ব্যবহার ও উপার্জন অসততা ও নৈতিকতার অভাবের পরিচায়ক। কালো টাকার ব্যবহারে কোন জীবনেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত কর বৈধ উপায় নেই। এ টাকা দিয়ে দান ও যাকাত কার্যকর হয় না। ইহকাল বা পরকালে কালো টাকা ব্যবহারকারীদের জন্য তা শুধু ঘৃণা ও পাপ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।

যেমনটি আজকাল আমরা বিভিন্ন মেগা দুর্নীতিবাজদের কথা পত্রিকার শিরোনামে লক্ষ্য করে যাচ্ছি ও ঘৃণা করছি। কারণ, কালো টাকা হলো সেই অর্থ যা অবৈধভাবে উপার্জিত বা কর ফাঁকি দিয়ে জমা করা হয়েছে এবং সরকারি আর্থিক নীতিমালা লঙ্ঘন করে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সাধারণত বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম, যেমন দুর্নীতি, কর ফাঁকি, অবৈধ ব্যবসা, মাদক পাচার, সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং অন্যান্য অনৈতিক কাজের মাধ্যমে কালো টাকা অর্জিত হয়। কালো টাকা সব সমাজেই দুর্নীতির আঁতুড় ঘর।

কালো টাকা সাদা টাকা-তা বললেই মেনে নেওয়া উচিত নয়। আমরা সবাই পাপীকে ঘৃণা করছি, পাপকে ঘৃণা করছি না কেন? তাই একটি ন্যায়ানুগ সরকার ও দেশের সাদা মনের নিষ্পাপ মানুষদের উচিত কালো টাকা থেকে দূরে থাকা এবং এই টাকার ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। E-mail: [email protected]

;

বিদায় প্রজ্ঞা ও প্রগতির বরপুত্র



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
-প্রয়াত মেজর জেনারেল (অবঃ) আবদুর রশীদ

-প্রয়াত মেজর জেনারেল (অবঃ) আবদুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

৭০ বছরের এক বর্ণাঢ্য জীবন অতিবাহিত করে আজ ভোরে (১৪ জুন, ২০২৪) ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইহলোক ত্যাগ করে অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন বিশিষ্ট নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুর রশীদ। এই বহুল পরিচয়ের বাইরে ব্যক্তি মানুষ হিসাবে তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে মনে হয়েছে তিনি প্রজ্ঞা ও প্রগতির এক বরপুত্র। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন শেষে অধিকাংশ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের আর সেভাবে প্রকাশ্যে সমাজিক পরিমণ্ডলে দেখা যায় না। সেই বিচারে জেনারেল আবদুর রশীদ ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম এক ব্যক্তিত্ব। আমরা জানি পেশাগত জীবনে প্রশিক্ষণ ও কমাণ্ড পরিচালনাসহ সকল ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বড় হয়ে যে দিকটি ধরা দিয়েছে তা হচ্ছে পেশাগত জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতা সমাজ এবং রাষ্ট্রের কল্যাণে সার্থকভাবে সদ্ব্যবহার করতে পেরেছেন আবদুর রশীদ।   

সমরজ্ঞান ও সমাজ-রাষ্ট্র তথা বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিকে একজন আবদুর রশীদ এতটাই গভীরভাবে অনুসরণ করতেন যে বাংলাদেশের জাতীয় গণমাধ্যমসমূহ অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তাঁর বিশ্লেষণ শোনার জন্য উদগ্রিব থাকতো। মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের প্রশ্নে আপোষহীন সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তার বিশ্লেষণে যে অসাধারণ বাগ্মিতা প্রকাশ পেত তা সমকালীন বিশ্লেষকদের মাঝে বিরল। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর তুলনামুলক অধ্যয়ন এতটাই বিস্তৃত ও গভীর  ছিল যা তাকে বহু বক্তার মাঝে ভিন্ন পরিচয়ে দাড় করিয়ে দিত। সাত দশকের যাপিত জীবনে আবদুর রশীদ কেবল নিজেই সমুজ্জ্বল করেননি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবকেও বৃদ্ধি করেছেন।

পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে তাঁর পরিচয় বহু পূর্বেই পেয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবের মানুষটিকে জানার সুযোগ হয়েছে মাত্র ১ বছর ধরে। এই সময়কালে মাত্র ৩ বার জেনারেল আবদুর রশীদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ ঘটেছে। দু’বার তাঁর মিরপুর ডিওএইচএস এর বাসায় আর একবার আমার আমন্ত্রণে তিনি এসেছিলেন মৈত্রী দিবসের আলোচনায় বক্তা হয়ে। এছাড়াও অন্ততঃ ১০-১৫ বার তাঁর সঙ্গে ফোনালাম হয়েছে। এই সময়ে জেনারেল আবদুর রশীদের প্রতি যে গভীর সন্মোহন সৃষ্টি হয়েছে তাঁর নিঃসন্দেহে জীবনস্মৃতির এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।

‘মিয়ানমার বিষয়ে বাংলাদেশের দ্বিমুখী কূটনীতি গ্রহণ করা উচিত’

বিশেষ করে তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে আবদুর রশীদের  ব্যক্তিমানস সম্পর্কে যে মূল্যায়ন সৃষ্টি হয়েছে তা সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। যে দু’বার তাঁর বাসায় গিয়েছি-সেখানে পেশাগত আলোচনা ছাপিয়ে তা ক্রমেই দীর্ঘ আলাপচারিতায় পর্যবসিত হয়েছে। আধঘণ্টার নির্ধারিত সাক্ষাত সাড়ে ৩ ঘণ্টায় গড়িয়েছে। সেখানে আলোচনার মূল সুর ছিল মূখ্যত আদর্শিক সংহতির অনুরণন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতিশীলতা, বাংলাদেশ নিয়ে বহির্বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি-বার বার তাঁর আলোচনার কেন্দ্রে আবর্তিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন জেনারেল আবদুর রশীদ। পেন্টাগনের লব্ধ সেই অভিজ্ঞতা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাকর্তাদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি। সেকারণে আমরা দেখব, জেনারেল রশীদের আলোচনায় পরিমিতিবোধের কি চমৎকার পরিচয়!

সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি বর্বরতা, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ, রোহিঙ্গা সংকট, চীনের কৌশলগত অবস্থান, মিয়ানমারে ভারতের কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্ট কিংবা বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উত্থান নিয়ে তাঁর নির্মোহ মূল্যায়ন ছিল অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও তথ্যবহুল।  সংবাদকর্মীদের সঙ্গে প্রজ্ঞাবান এই মানুষটির ব্যক্তিগত আচরণে যে বিনয় ও আন্তরিকতা প্রকাশ পেত তা আমাদের আপ্লুত করতো। আজ যখন তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে বসেছি তখন বহু কথা স্মৃতিতে ভিড় করছে। সামরিক কর্মকর্তা হয়েও বাংলা ভাষার প্রমিত ব্যবহারে তাঁর অসাধারণত্ব সব সময়ই  মুগ্ধ করেছে। দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে গিয়ে সম্প্রতি তাঁকে শ্বাসকষ্টে ভুগতেও দেখেছি, চিকিৎসকেরও বারণ ছিল কিন্তু তবু তিনি বাকহীন হয়ে থাকতে পারতেন না। কথা বলা ও লেখাকে নিয়ে রাষ্ট্রের প্রতি তাঁর আমৃত্যু কর্তব্য হিসেবে মনে করতেন।  

বিদেশনির্ভরতা ও বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতি

আমাদের রাজনীতিবিদদের বিদেশমূখিতা নিয়ে সরব ছিলেন জেনারেল আবদুর রশীদ। তিনি মনে করতেন আমাদের রাজনীতিবিদদের দেশপ্রেম না থাকায় তাঁরা বিদেশিদের মুখাপেক্ষী হন কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক চক্রান্তে তাঁরা ঠিক ততোটাই পিছিয়ে। বার্তা২৪.কম-কে সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যা আছে, তাই আমাদের একটি দ্বিমুখি কূটনীতি গ্রহণ করা উচিত। একদিকে আরাকান আর্মির সঙ্গে প্রকাশ্যে বা গোপনে হোক সংযোগ তৈরি করা উচিত। আর স্বভাবতই মিয়ানমারের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে তো আমাদের কুটনীতি আছেই।’-রোহিঙ্গা সংকট যাদের কারণে তাদের কাছেই বাংলাদেশ সমাধান খুঁজছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন আবদুর রশীদ।  

সমকালীন ভূ-রাজনীতির বিস্তৃত প্রসঙ্গে আবদুর রশীদের যে গভীর বিশ্লেষণ তা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করতে দেখেছি আমরা। সমর-কুটনীতিতেও তিনি সাম্প্রতিক দশকে অনবদ্য অবদান রেখে গেছেন। বর্তমানে বিশ্বে যুদ্ধ-বিগ্রহের এই সময়ে তাঁর চলে যাওয়া রাষ্ট্রের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

আদর্শিক নৈকট্যের কারণে পেশাগত প্রয়োজনের বাইরেও জেনারেল আবদুর রশীদের অপত্য স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি। সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা ‍নিয়ে ফিরে আসার পর শেষবার যখন কথা হল তখনও বেশ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে আমাকে বলেছিলেন, তিনি আশা করছেন অচিরেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন। কথা দিয়েছিলেন আমার সাংগঠনিক অফিসে আসবেন, মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণও গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সেই ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে গেল।

পরিশেষে এটুকুই বলবার যে, একজন আবদুর রশীদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা রাষ্ট্রের সম্পদ ছিলেন। তাঁর প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম এবং প্রগতির প্রতি অন্তহীন নিষ্ঠা সত্যিই অতুলনীয়। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন ও আদর্শের জন্য বহুদিন তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। তাঁর পারলৌকিক জীবন শান্তির হোক, এই কামনা আমাদের।

;

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে দুই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা



এম. খালিদ মাহমুদ
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে দুই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে দুই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা

  • Font increase
  • Font Decrease

সরকার দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে অভূতপূর্ব ভূমিকা রেখে চলেছে। সড়ক নেটওয়ার্ক বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোডক্র্যাশ/ সড়ক দুর্ঘটনা। আর সেই সাথে বাড়ছে সড়কে হতাহতের সংখ্যা। দেশের সড়ক দুর্ঘটনার ৭০-৮০ শতাংশই ঘটে দ্রুত ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। অন্যদিকে মোটরসাইকেলের অনিয়ন্ত্রিত গতি প্রতিনিয়তই দেশের কর্মক্ষম তরুণসহ অনেকের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় কর্তৃক সম্প্রতি (৫ মে ২০২৪) জারি করা মোটরযানের ‘গতিসীমা নির্দেশিকা’ রোডক্র্যাশ ও প্রতিরোধযোগ্য অকালমৃত্যু কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। উল্লেখ্য, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ ও সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২-এ গতিসীমা মেনে গাড়ি চালানোর কথা বলা হলেও এই নির্দেশিকার মাধ্যমে দেশের জন্য প্রথমবারের মতো প্রতিটি সড়কে মোটরযানভিত্তিক সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারিত হলো।

একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, গত ৫ মে ২০২৪ সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ মোটরযানের ‘গতিসীমা নির্দেশিকা’ প্রণয়ণকালে গ্রামাঞ্চল ও শহরের জন ঘনত্বের মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েছে। রাস্তার ধরন ও প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন মোটরযানের গতি ভিন্ন ভিন্ন করা হয়েছে যা সড়ক নিরাপত্তার জন্য বৈশ্বিক মান অনুসরণে করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বিদেশের মতো বাংলাদেশের সড়কে পর্যাপ্ত লেন থাকলে গতিসীমা নির্দেশিকাটি বাস্তবায়ন করা সহজ হতো। আশার কথা, সরকার ধীরে ধীরে সকল মহাসড়ককে ছয় লেনে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তখন এ গতিসীমা নির্দেশিকাটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং রোডক্র্যাশ ও সড়কে অকাল মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। বিশেষত সড়কে নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ ঝুঁকিপূর্ণ পথচারীদের নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত হবে।

সাম্প্রতিককালে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, সড়কে ব্যাপক হারে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধি ও বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালনা, যাতে রোডক্র্যাশ/ সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদ্বেগের মাত্রাকে দ্বিগুণ করে দিচ্ছে অধিকাংশ মোটরসাইকেল আরোহীর মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার না করা। বিশেষত ঢাকার বাইরে মোটরসাইকেল আরোহীদের হেলমেট না পরার সংখ্যা আশংকাজনক। আশার কথা, গতিসীমা নির্দেশিকার পাশাপাশি সরকার ‘নো হেলমেট নো ফুয়েল’ নির্দেশিকাও জারি করেছে। এর ফলে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীগণ মানসম্মত হেলমেট পরার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত গতিতে মোটরসাইকেল চালাবেন বলে আশা করছি।

আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে সড়ক-মহাসড়কে গাড়ি ও মোটরসাইকেলের সংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধি পাবে। তাই এ সময়ে সড়কে দুর্ঘটনা/ রোডক্র্যাশ সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনতে জারিকৃত নির্দেশিকা দুটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত। এক্ষেত্রে বিআরটিএ ও পুলিশসহ সকল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান কঠোরভাবে ‘গতিসীমা নির্দেশিকা’ ও ‘নো হেলমেট নো ফুয়েল’ আদেশ দুটি বাস্তবায়ন করবে বলে আশা করছি।

নির্দেশিকা দুটি যথাযথ বাস্তবায়ন হলে সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি): ৩.৬ অর্জন তথা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে যাবে এবং বার্ষিক ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা (জিডিপি’র ২.০-২.৫%) অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারবে। পাশাপাশি সড়কে পূর্ণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সরকার অবিলম্বে বৈশ্বিক মান অনুযায়ী একটি ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করবে বলে আমরা আশাবাদী।

এম. খালিদ মাহমুদ, রোড সেফটি প্রোগ্রাম, ব্র্যাক।

;

কক্সবাজারে ট্রেন চলাচল নিয়ে সংশয় কাটবে কি?



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দুয়ারে কড়া নাড়ছে ঈদ। এখনকার ঈদ উৎসবে ধর্মীয় আচার পালনের চেয়ে ঈদের ছুটিতে ঘুরে বেড়ানোই বড় চাহিদা হয়ে ধরা দিয়েছে। আর্থ-সামাজিক অসমতা থাকলেও দেশের মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন যে হয়েছে তা উৎসবের দিনগুলিতে বেশ টের পাওয়া যায়। ঈদে শুধু ঘুরতে যাওয়াই নয়, ঈদ কেনাকাটা করতেও অনেকে এখন সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ড ঢু মারেন। নিদেনপক্ষে সীমান্তের উপারের শহর কলকাতার কথা তো বলাই বাহুল্য। তবে মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে নাগরিক জীবনের একঘেয়েমি দূর করতে দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণের প্রবণতাও বেড়েছে বহুলাংশে। 

গণমাধ্যমগুলো বরাবরই তুলে ধরছে বাংলাদেশে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনার কথা। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে দেশে রপ্তানি খাতের মতোই উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পর্যটন কেন্দ্রগুলোর। কিন্তু হতাশার কথা হচ্ছে, পর্যটনের বিদ্যমান এই সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে সহায়ক অবকাঠামোগুলো পুরোপুরি ব্যবহারের পূর্বেই মুখ থুবড়ে পড়ছে!  

গণমাধ্যমের খবরে জানতে পারছি, পর্যটননগরী কক্সবাজারে বহুল প্রতীক্ষিত ট্রেন চলাচল শুরু হলেও তা ব্যাহত করতে সক্রিয় একটি অশুভ চক্র। পর্যটননগরী কক্সবাজারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের গমনাগমন নির্বিঘ্ন করতে বহু অর্থ ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে আইকনিক স্টেশন। কক্সবাজারে ট্রেন চালু উপলক্ষে আড়ম্বরপূর্ণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আশাবাদের কথা শুনিয়েছিলেন তা ভ্রমণপিপাসু সবাইকে তা আশান্বিত করেছিল।

গত ৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেন চালুর পর বহু আবেগঘন খবর এসেছে সংবাদপত্রে। বাসে চড়তে না পারা মানুষদের জন্য কক্সবাজারে ট্রেন চালুর খবর আনন্দের বিশেষ মাত্রা যোগ করেছিল। ‘কক্সবাজার যেতে চাওয়া বৃদ্ধের স্বপ্ন পূরণ হবে এবার’-এমন খবরও পড়েছি আমরা। কিন্তু ‘ইঞ্জিন ও লোকোমাস্টার সংকট’ দেখিয়ে গত ৩০ মে (২০২৪) বন্ধ করে দেওয়া হয় ট্রেনটি। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মোজাম্মেল হক চৌধুরী তখন দাবি করেছিলেন, মূলতঃ ঢাকা-কক্সবাজার রুটের বাস মালিকদের আঁতাতেই ট্রেন বন্ধের সিদ্ধান্ত।

ভ্রমণপিপাসুদের অব্যাহত দাবির প্রেক্ষিত ১২ দিন বন্ধ থাকার পর স্পেশাল ট্রেনটি ১২ জুন (২০২৪) সকালে চট্টগ্রাম থেকে ফের কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এই খবর নতুন আশার সঞ্চার করলেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ‘আপাতত’ ট্রেনটি চলবে ২৪ জুন পর্যন্ত। কক্সবাজার রেলযাত্রা নিয়ে পর্যটকদের যেখানে এত আগ্রহ, সেখানে কর্তৃপক্ষ কেন প্রয়োজনীয় সংখ্যক ইঞ্জিন ও লোকোমাস্টার এতদিনেও ব্যবস্থা করতে পারল না? এত বিপুল অর্থ ব্যয়ে কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, আইকনিক স্টেশন-এই সবই যদি করা সম্ভব হলো; তবে ইঞ্জিন আর লোকোমাস্টারের সংকট দেখানো কি ঠুনকো অযুহাত নয়?

আকাশপথে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী উড়োজাহাড় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস কিংবা সরকারি টেলিফোন অপারেটর টেলিটক এর ক্ষেত্রে দেখেছি-কিভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিকল্পিতভাবে সেবা ও মুনাফা অর্জনে প্রতিযোগিতার দৌঁড়ে অন্যদের থেকে পিছিয়ে রাখা হয়। রাষ্ট্রের এমন বহু প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে, যেখানে এই অশুভ হাত ছায়া ফেলেছে।

কক্সবাজারের রেলপথ ও সেখানকার পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে যোগাযোগের এই অনায়াস মাধ্যমটিও যে এ ধরণের অশুভ চক্রের হাতে পড়বে তা পূর্বেই অনুমান করা হয়েছিল। প্রতীক্ষিত ট্রেনটি চালু করা নিয়ে বিদ্যমান দোলাচল তারই ইঙ্গিত বহন করছে বলে মনে করছেন অনেকে। পর্যটন নগরীর বিকাশে এত বিপুল ব্যয়ে নির্মিত রেলপথ স্বার্থান্বেষী বিশেষ চক্রের একচেটিয়া ব্যবসার আধিপত্যকে ভেদ করে ট্রেন চলাচল সচল থাকবে কিনা তা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়। আমরা প্রত্যাশা করব, সম্ভাবনার এই যোগাযোগ খাতটি মুখ থুবড়ে পড়ার আগেই সরকার এ বিষয়ে সচেষ্ট হবে। 

;