দানব হয়েছে মূল্য সন্ত্রাস
খুব অল্পদিনের মধ্যে দানব হয়ে উঠেছে দ্রব্যমূল্য। এ দানব ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের আলোচিত ভয়ংকর দানবকে হার মানিয়েছে। মেরী শেলীর উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউস’- এর এক বিখ্যাত চরিত্র বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। যিনি নিজের গবেষণায় বিশেষ ধরনের বিজ্ঞান আয়ত্ত্ব করেন। যার মাধ্যমে মৃত আত্মাকে জীবনদান করা সম্ভব হয়। এই পরীক্ষাটি এজন মৃত ব্যক্তির উপর করলে মৃত ব্যক্তিটি বেচেঁ উঠে কিন্তু পরিণত হয় এক ভয়ংকর দানবে। এই দানব দেখতে ছিল কুৎসিত। তাকে দেখে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ভয় পেয়ে দুর্ব্যবহার করলে সে প্রতিশোধ নেয়া শুরু করে। দানবটি ক্রমান্বয়ে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লে, তার পরিবার, আত্মীয স্বজনদেরকে হত্যা করতে থাকে। একদিন ফ্রাঙ্কেনস্টাই কে হত্যার জন্য ধাওয়া করলে তিনি দৌড়ে বনের মধ্যে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। কিন্তু নির্জনে বনে মারা যান। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মৃত্যু সংবাদ জানার পর দানব আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং একদিন চিরতরে হারিয়ে যায়। তাকে আর কোনদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বলা হচ্ছে, করোনার প্রভাব, ইউক্রেন যুদ্ধ, দাবানল, বন্যা, মাঙ্কিপক্স, তেল-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদির কারণে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে বিশ^বাণিজ্য ও আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা। লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে নিত্যপণ্যের বাজার দরে আগুন লেগেছে। সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ায় ধ্বস নেমেছে চারদিকে। দর-দামের দুর্যোগ নেমে সুযোগসন্ধানী মূল্য সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে সৃষ্ট দানব চরিত্রের মৃত আত্মা পুনর্জীবন লাভ করে ক্রমান্বয়ে শক্তি সঞ্চারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে নিয়েছে বাজারের সবকিছু। দখল করে ফেলে গোগ্রাসে চারদিকের সবকিছুকে খেয়ে সাবাড় করে দিচ্ছে যেন।
এবার শুধু লোভী ব্যবসায়ী নয়- নেমে পড়েছে সুযোগসন্ধানী মূল্য সন্ত্রাসী দানবরা। তারা কাউকে ভয় করে না। বাজারে কত নামে, কত আবরনে, কত আভরণে কতশত নিয়ন্ত্রক টিম নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। নিত্যপণ্য মূল্যের মনিটরিং চলছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ছেড়ে দেয়া পাগলা ঘোড়াকে কোনভাবে বেঁড়ি পরানো যাচ্ছে না। সবাই যেন এক প্রকার হাল ছেড়ে দিয়ে কাল্পনিক দানবকে দোষারোপ করে পার পাবার চেষ্টা কর যাচ্ছে। তবে কেউ সহসা পার পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। এই নাজুক অবস্থা আর কতদূর, কোথায় গিয়ে থামবে তার কোন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছেন না। আক্ষেপ করছেন প্রতিদিনের খাবারের বাজেটে কাঁটছাট করতে থাকা স্বল্প আয়ের নিরীহ মানুষগুলো।
তেমনি একজন আমাদের পাশে থাকেন। তাঁর নাম বলা হলো না। তবে তিনি কাজ পাগল। সবার আগে অফিসে আসা এবং সবাই অফিস শেষে চলে যাবার পর তাকে বাসায় ফিরতে হয়। তাঁর পরিবারে অনেকে আছেন। তারা নিজেরা অতিব্যস্ত থাকেন। তাই তার খোঁজ-খবর ঠিকমতো নিতে পারেন না আপনজনেরা। খুব সকালে এসে অফিসের তালা খুলে সবুকিছু গুছিয়ে রেখে তিনি সকালের নাশতা সারেন ২টি রুটি ও সব্জিভাজি দিয়ে। কোন কোন দিন ডাল পরোটা খেয়ে থাকেন। বছর দুয়েক আগে সেখানে পরোটার দাম ছিল পাঁচ টাকা। কুড়ি টাকায় নাশতা হয়ে যেত। এখন পঞ্চাশ টাকাতেও টানাটানি হয়।
দুপুরের খাবারে তাঁর পছন্দ খিঁচুড়ি ও একটি ডিমভাজা। একপ্লেট খিঁচুড়ি ও একটি মুরগীর ডিম এক বছর আগেও ত্রিশ টাকায় পাওয়া যেত। সেটা অফিসের কাছাকাছি আমতলার সামনে অস্থায়ী খোলা দোকানে। এরপর ছয়মাস আগে হঠাৎ একদিন পঞ্চাশ টাকা হয়ে গেল। কারণ, পেঁয়াজ ও ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছিল তখন। গত ছয়দিন একই খাবারের মূল্য ষাট টাকা নেয়া হচ্ছে। একটি ডিমভাজার দাম বেড়ে নাকি বিশ টাকা হয়েছে! এজন্য তিনি খুব নাখোশ।
তাঁর কথা হলো- ডিম, দুধের সাদা বিপ্লব কি শেষ হয়ে গেল? তার বয়স অনেক হয়েছে। আগের মতো ভারী কাজ করতে পারেন না। দীর্ঘ সময় কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তিনি ডাক্তার দেখিয়েছিলেন। ডাক্তার তাকে শরীরে বাড়তি শক্তির জন্য প্রতিদিন একটি করে ডিম খেতে বলেছেন। তাই তার নিয়মিত ডিম খাওয়া দরকার। কিন্তু ডিমের হালি পঞ্চাশ টাকা হয়ে গেল এটা কেমন কথা? এটা তিনি কোনভাবেই মানতে পারছেন না। তার কথা হলো- কারো খারাপ অবস্থা থেকে আরো খারাপ হলে মেনে নেয়া সহজ। কিন্তু একবার একটু ভাল অবস্থা হলে সেখান থেকে আবার খারাপের দিকে যাওয়া খুব কষ্টের। ডিমের মতো প্রিয় খাবারের দাম হঠাৎ এত বেশী হয়ে যাবে সেটা তার কোনদিন মাথায় আসেনি।
দোকানদারকে খাবারের দাম বাড়ানোর কারণ জিজ্ঞেস করে তিনি জানতে পেরেছেন- ফার্মে বিদ্দুৎ ছাড়া মুরগীর বাচ্চা ফুটানো যায় না। লোড শেডিং চলতে থাকায় বাচ্চা ফুটানো যাচ্ছে না। যেগুলো কোনভাবে ফুটানো হয়েছিল সেগুলো গরমে মরে গেছে। বিদ্দুৎ-এর অভাবে এখন বাচ্চা উৎপাদন বন্ধ। জেনারেটর দিয়ে তেল খরচ অনেক বেশী। তাই ৮-১০ টাকার বাচ্চার দাম ১৭-১৮ টাকা হয়েছে। এরপরও বাচ্চা মরে যায়। তাই অনেকে মুরগীর ফার্ম বন্ধ করে দিয়েছে।
এছাড়া মুরগীর খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্রয়লার বা মাংসের জন্য লেয়ার, সোনালী প্রভৃতি মুরগীর উৎপাদনও কমে গেছে। জ¦ালানী তেলের দাম বেড়ে যাওযায় পরিবহন খরচ বেড়ে গছে অনেক। পাইকাররা গ্রামে আসতে চাচ্ছে না। ফলে দুরবর্তী গ্রাম এলাকার ফার্মের মুরগী উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে অনেক ব্যবসায়ী।
একইভাবে মাছ, শাক-সব্জি, ফলমূল সবকিছুতেই বাড়তি খরচের প্রভাব পড়েছ্ েগার্মেন্টস্ প্রেটিন নামে খ্যাত পাঙ্গাস, কৈ, সিরভার কার্প, তেলাপিয়া প্রভৃতি মাছের ফিডের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং পরিবহন খরচ দ্বিগুন হয়ে যাওয়ার উৎপাদন ও সরবরাহে এসেছে ব্যাপক সমস্যা। শাকসব্জি পরিবহনের ট্রাক পাম্পে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে তেল কিনতে পারছে না। রাজধানীর পাম্পে অপেক্ষারত একজন দরিদ্র ড্রাইভার বলেছেন, “এই অবস্থা চলতে থাকলে আমার মালিক ব্যবসা বন্ধ করে দেবে। আমি হয়তো শীগগীর রাস্তায় ভিক্ষা করতে নামব”।
এভাবে বাড়তে থাকা দ্রব্যমূল্যের কারণে ভয়াবহ আর্থিক সংকটের কবলে পড়ে গেছে বাংলাদেশ। এমনকি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকে বাইসাইকেল কেনার প্রত্যাশা করেছেন। সাইকেল চালিয়ে গাড়িভাড়া বাঁিচয়ে সেই অর্থ সংসারের কাজে লাগাবেন বলে। কিন্তু বাজারে বাইসাইকেলের দামও হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। সুযোগসন্ধানী মূল্যসন্ত্রাসীরা কোথাও বসে নেই।
মানুষ সবাই রাক্ষস নয়। কিন্তু অভাবে কেউ কেউ রাক্ষস হয়ে যায়। তবে অভাব না থাকলেও রাক্ষসের বংশবদরা কখনই হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ করতে ক্ষান্ত দেয় না। তারা সামনে যা পায় তাই গিলতে চায়। তাৎক্ষণিক গিলতে না পারলে অপচয় করে, নষ্ট করে। এবাবে আরো বেশী সংকট তৈরী করে সবার দুর্ভোগ বাড়ায়।
ভূতের জন্য ওঁঝা থাকে। ওঁঝা দেখলে ভূতেরা শান্ত হয় অথবা পালিয়ে যায়। কিন্তু দানবরা ওঁঝা দেখলে ভয় পায় না। কারণ, দানবের মাঝে ওঁঝা বিরাজ করে অথবা ওঁঝার মনের মধ্যে দানবরা তৈরী হয়। অন্তত: আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে রক্ষকরা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পড়ায় এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
এভাবে ক্রমান্বয়ে দানব হয়ে উঠেছে দ্রব্যমূল্য। শুরু হয়েছে মূল্যসন্ত্রাস। আর মূল্য সন্ত্রাসীরা লাগামহীনভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে আস্ফালন করে চলেছে। বাজার নিয়ন্ত্রককরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পিছুটান দেয়ায় বাজারে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। এত ব্যর্থতার মধ্যেও বাজার দর নিয়ে তাচ্ছিল্য করে মানুষের কষ্টকে আরো বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। অথচ, জ¦ালানী তেলের দাম বিশ^বাজারের বর্তমান কমতি দামের সাথে সমন্বয় করে অচিরেই দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্দ্ধগতিকে স্বল্প চেষ্টাতে টেনে ধরা যায়। দ্রব্যমূল্যের এই কুৎসিত দানবকে ভয় পেয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে থাকলে সামনে সমূহ বিপদ সামাল দেয়া আরো কঠিন হতে পারে।
*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]