রাতগভীরে অসুস্থ হবেন না প্লিজ!
রাতগভীরে ঢাকা শহরের কেউ অসুস্থ হবেন না প্লিজ। রাত ১২টা পর্যন্ত হালকা অসুস্থ হওয়া হয়তো যাবে, কিন্তু দুইটা এবং অথবা এর পর; না, কখনই না! হাস্যকর শোনাচ্ছে কথাগুলো? হাস্যকর হলেও এমন বাস্তবতার মুখে পড়তে যাচ্ছে ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের। আগামী পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার সব ওষুধের দোকান রাত ১২টায় বন্ধ করে ফেলতে হবে। হাসপাতাল সংলগ্ন ওষুধের দোকানগুলোকে আবার এখানে অতিরিক্ত ছাড় দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ তাদের জন্যে নির্ধারিত শেষ সময় রাত ২টা। এরপর তাদেরকেও অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধের দোকান বন্ধ করে ফেলতে হবে। ‘নগরে শৃঙ্খলা ফেরাতে’ এমন অভাবনীয় ‘ফরমান’ জারি করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
এটাকে বাস্তবতাবিবর্জিত সিদ্ধান্ত একবাক্যে বলা যায়। অসুস্থতা কি বলেকয়ে আসে? অসুস্থতা কি সময় ধরে আসে? কিন্তু সিটি করপোরেশনের এমন সিদ্ধান্তের পর বলা যায়, অন্তত ঢাকায় অসুস্থতা রুটিন মেনে চলে! মানুষের অসুস্থতা নিয়ে এমন সিদ্ধান্তকে কি অসুস্থ-চিন্তাপ্রসূত বলা ছাড়া উপায় আছে? অথবা বলা যায়, উঁচু তলায় বসা মানুষের সিদ্ধান্ত যেখানে মানুষের জীবনের মূল্য নাই কানাকড়িও!
সিটি করপোরেশনের এই সিদ্ধান্ত যে গণবিরোধী তা বলা অপেক্ষা রাখে না। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সিটি করপোরেশনের এই ভুল সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ওখানকার নগরপিতা বলে মনে করা সিটি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে। তিনি ‘নগরে শৃঙ্খলা ফেরাতে’ এমন সিদ্ধান্ত বলে দাবি করছেন। এটা কেমন শৃঙ্খলা যেখানে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয়। রাত দুইটার পর অতিপ্রয়োজনীয় কোন ওষুধের অভাবে যদি কোন রোগী মারা যায় তবে কি তার দায় নেবেন মেয়র? যদি সত্যি সত্যি এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয় তবে এককভাবে এর দায়িত্ব নিতে হবে মেয়রকে।
শেখ তাপস আওয়ামী-পরিবারের সন্তান। যদিও প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকবছর আগে তাঁর পুত্র-কন্যা ও শেখ রেহানা ও তাঁর পুত্র-কন্যার বাইরে আর কাউকে পরিবারের সদস্য দাবি দেখতে অনাগ্রহী। তবু শেখ তাপসের রাজনৈতিক ক্ষমতাপ্রাপ্তি, অবস্থান বঙ্গবন্ধু-পরিবারের সদস্যের বদৌলতে। শেখ তাপসের পিতা শেখ ফজলুল হক মণি পঁচাত্তরের বেদনাবিধুর রাতে ঘাতকদের গুলিতে শাহাদাতবরণ করেন। শেখ তাপস এক-এগারোর সময় কারান্তরীন শেখ হাসিনার পক্ষে মামলা লড়েছিলেন। নিজে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বঙ্গবন্ধু-পরিবারের সন্তান হিসেবে আগে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন, এরপর হয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র। জনপ্রতিনিধি হয়েছেন তিনি নির্বাচনে যদিও তবে এই জনপ্রতিনিধি হওয়ার দৌড়ে যে পারিবারিক প্রভাব ছিল তা বলাই বাহুল্য। কেবল শেখ ফজলে নূর তাপসই নয় তার বড়ভাই দেরিতে হলেও রাজনীতিতে এসেছেন। পেশায় শিক্ষক শেখ ফজলে শামস পরশকে কয়েকবছর আগে যুবলীগের কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এখানে পরিবারের প্রভাবকে অস্বীকার করা যাবে না।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনের ওষুধের দোকান নিয়ে এই আলোচনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রকে এত বিস্তৃতভাবে নিয়ে আসার কারণ হলো বঙ্গবন্ধু-পরিবারের একজন সদস্য কর্তৃক সিটি করপোরেশনের একটা সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমাণের অযৌক্তিক ধারা দেখে। বঙ্গবন্ধু-পরিবারের একজন সদস্য গণবিরোধী এবং মানুষের জীবনকে শঙ্কার মুখে ফেলে দেওয়ার একটা সিদ্ধান্তের পক্ষে এভাবে দাঁড়িয়ে যাবেন তা অনেকেই কল্পনা করতেই পারছেন না। এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে একটা কথাই বলতে হয় ক্ষমতা, স্রেফ ক্ষমতা অনেককেই অন্ধ করে দেয়। মানুষের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটির এই সিদ্ধান্ত ক্ষমতার প্রকাশ, যেখানে পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছে বাস্তবতা, মূল্য দেওয়া হয়নি মানুষের জীবনের।
হ্যাঁ, নগরে-বন্দরে-গ্রামে সবখানে শৃঙ্খলা দরকার। শৃঙ্খলা রক্ষায় জনপ্রতিনিধি ও প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করবে; প্রয়োজনে কঠোর সিদ্ধান্ত নেবে, তা বাস্তবায়নে কঠোর পদক্ষেপ নেবে। এটা ঠিক আছে। কিন্তু মানুষদের জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনীয় ওষুধের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া কোনোভাবেই শৃঙ্খলা নয়। বরং সেটা মানুষের জীবনকে অবজ্ঞা, অবমূল্যায়নের শামিল। এটা অমানবিকতা। কেউ কি বলতে পারে কে কখন অসুস্থ হবে, কেমন অসুস্থ হবে, কী ওষুধ লাগতে পারে তার? হাসপাতাল যেখানে জীবন রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান সেখানে ওষুধের দোকানগুলো জীবনরক্ষার উপকরণ সরবরাহক। এখানে হাসপাতাল খোলা রেখে ওষুধের দোকান বন্ধ করে দেওয়া আত্মহত্যার শামিল। এবং এটাকে প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের মধ্যে নিয়ে আসা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনির প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা।
হাসপাতাল সংলগ্ন ওষুধের দোকানগুলো একেকটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হলেও এগুলো কেবলই ব্যবসা করছে এমন না। ব্যবসার বিনিময়ে মানুষের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করছে। এগুলো বছরের সবকটা দিন চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা রাখা উচিত। হাসপাতালের মতো ওষুধের দোকানেরও ছুটি নেই। এখানে জ্বালানি-বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ব্যাপার নেই, এখানে শৃঙ্খলা আরোপের ফরমায়েশি ব্যাপার নেই; এগুলো মানুষের জীবন বাঁচানো পণ্যের একেকটা প্রতিষ্ঠান। হাসপাতাল যদি হয় কেপিআই স্থাপনা তবে জরুরি বিভাগের সামনের ওষুধের দোকানগুলোও গুরুত্বের দিক থেকে এর কোন অংশে কম নয়। এছাড়া আমাদের সরকারি হাসপাতাল এমন না যে যেখানে সব ওষুধ বিনামূল্যে হাসপাতাল থেকেই সরবরাহ করা হয়। হাসপাতাল চিকিৎসা দিচ্ছে, কিন্তু টাকার বিনিময়ে সেই চিকিৎসার প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করছে ব্যক্তিপর্যায়ে গড়ে ওঠা ওই ওষুধের দোকানগুলো। হাসপাতাল খোলা থাকল, আবার সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ওই সময়ের পর জরুরি কোন ওষুধ লাগলে সেটা পাওয়া গেল না, তখন কি চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব? মানুষের অসুস্থতা, মৃত্যুর শঙ্কা কি আটকে দেওয়া সম্ভব সিটি করপোরেশনের নোটিস দেখিয়ে? অসুস্থতা কি নোটিস চেনে, সময় চেনে, সিটি করপোরেশন চেনে, কোন মেয়র-মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীকে চেনে?
সরকারি হাসপাতালে কারা যায়? উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত ছাড়া অসুস্থতায় পড়া বেশিরভাগ মানুষেরই ঠিকানা হয় সরকারি হাসপাতাল। যারা উঁচুতলার তাদের হয়তো দরকার পড়ে না সরকারি হাসপাতালের, দেশের মধ্যকার বেসরকারি হাসপাতাল এবং এরপর তারা হয়তো বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারেন। কিন্তু আর্থিক দিক থেকে যারা উচ্চশ্রেণির নন তারা কি রাতগভীরে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাবে না? কেন তাদের চিকিৎসার পথ বন্ধ করে দেওয়ার এমন সিদ্ধান্ত? এটা কি মানুষের মৌলিক অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতির সুস্পষ্ট বিরোধিতা নয়?
ওষুধের দোকান নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন যে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে সেটা অবাস্তব, অবিবেচনাপ্রসূত, অমানবিক ও গণবিরোধী। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে মানুষের জীবনকে অবজ্ঞা করার প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে। সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীলরা ‘সরল বিশ্বাসে’ ভুল সিদ্ধান্তে নিতেই পারেন, কিন্তু সেই ভুল সিদ্ধান্তের জায়েজিকরণে মেয়রের ভূমিকা অপ্রত্যাশিত। আমরা আশা করি, তিনি মানুষের জীবনকে শঙ্কার মুখে ফেলে দেবেন না। তিনি জনপ্রতিনিধি, আর জনপ্রতিনিধির প্রত্যেক সিদ্ধান্ত, প্রত্যেক পদক্ষেপই হওয়া উচিত জনগণের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে।
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।