ধুসাইলা



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

এক.
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে আলিসারকুল গ্রামে যেতে লোকাল বাসে সময় লাগে মাত্র বিশ-পচিশ মিনিট। বশিরকে শহর চৌমোহনা থেকে তার স্কুল-শিক্ষক স্ত্রী আলতাবানু বাসে তুলে দেন সন্ধ্যা সাতটা দশে। শহর চৌমোহনা থেকে তার বাসায় ফেরার দূরত্ব মাত্র পাঁচ মিনিটের। বাসা কলেজ রোডে, থানার পাশেই। বাসায় ফিরে আলতাবানু পরীক্ষার খাতা দেখার জন্যে মেঝেতে সব বিছিয়ে নিয়ে বসে টিভি ছাড়েন সারেগামা গানের অনুষ্ঠান দেখার জন্য। নোবেল গাইবে। তো, ওই ভারতীয় চ্যানেল খুঁজতে গিয়ে একটি চ্যানেলে গিয়ে দৃষ্টি আটকে গেল। ‘আল্লাগো’ বলে হাহাকার করে উঠলেন। এই চিৎকারকে হাহাকার বলা যায় না। হাহাকার সেটি যেখানে হারানোর ব্যথা থাকে। এই চিৎকারকে নিরুপায় বিলাপ হয়তো বলা যায়। কারণ ‘আল্লাগো’ বলার মধ্যেও ভরসা যেন নেই। যেন সব শেষ। যেন আর কোনো অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। কিন্তু আলতাবানু ঘুম থেকে জেগে ওঠেন যখন কালিঘাট রোডের ৫০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাদা চাদর বিছানো বিছানায় তখন রাত্রি অনেক। বর্ষাকাল। হাসপাতালের পাশেই ধানি পরিত্যক্ত ডোবা মতন জায়গা। ব্যাঙের কান্না। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে বোঝেন তার হাতের কোথাও স্যালাইনের সিরিঞ্জ ঢোকানো। টান পড়ে। তাই ধীরে ধীরে চোখ বুজে খোলেন। কেউ নেই আশপাশে। করিডরে। দোতলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তিনি রুম থেকে বেরিয়ে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ান। আলিসারকুল ইউনিয়ন অফিসের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটি ধলামন্দিরের দিকে গেছে ওই পথ ভেসে ওঠে আলতাবানুর সামনে। ঠিক এভাবে বলা মনে হয় ঠিক না। আলিসারকুল, পুরো গ্রামটিই যেন দুলছিল। ছোপ ছোপ সবুজ ঘাসের দলার মতো। এ গ্রামটিতে অদ্ভুত এক রহস্যময়তা বিরাজ করে। কারণ ওই একটাই গ্রামের মানুষদের মধ্যে রয়েছে আত্মহত্যা করার চরম প্রবণতা। প্রায় ১৫ দিন পরপর না হলেও একমাসের মধ্যে তো অন্তত একটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটবেই এই আলিসারকুলে। কেন এই ধরনের ঘটনা ঘটে? এজন্য দেশি ও বিদেশি দুটো এনজিও কাজ করছে। আলিসারকুল গ্রামটি সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানার একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। উপজেলা সদর দফতর থেকে ২৮ কিলোমিটার এবং মৌলভীবাজার জেলা সদর দফতরের ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গ্রামের মোট ভৌগোলিক এলাকা ৫৭৩.৫ হেক্টর। ২০০৯ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, গ্রামটিতে ১,৫২২টি পরিবার বাস করত, আর তখন জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১২,৬৪৪ জন। বর্তমানে গ্রামটিতে ৩২০টি পরিবারের বাস এবং মোট লোকসংখ্যার পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২,৫০০।

আত্মহত্যাকারী গ্রাম হিসেবে এর একটা বদনাম আছে। গত বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ের রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায়, ১১০ দিনে প্রায় ১২০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে এই গ্রামে। সাম্প্রতিক অতীতে এত বড় আত্মহত্যার ঘটনা খুব একটা শোনা যায়নি। কিন্তু গ্রামবাসীদের এক অন্ধ ধারণা হচ্ছে কোনো দুষ্ট আত্মাই এর জন্য দায়ী। সেই দুষ্ট আত্মাই নাকি একের পর এক গ্রামবাসীকে আত্মহত্যার জন্য প্ররোচিত করছে। চলতি বছরের গত জুন পর্যন্ত ১৯টির মতো আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এমন তথ্য দিয়েছে দেশি এনজিও ‘মানুষের পাশে আমরা’ (মাপাআ)। মাপাআ’র কো-অডিনেটর সুশান্ত ভৌমিক বিষণ্ণতার কারণ হিসেবে মারাত্মক পরিমাণে কীটনাশক দেওয়া ছাড়াও কৃষকদের মধ্যকার আর্থিক দৈন্যতার কথা বলেন। দেখা যায় চাষাবাদের জন্য বা মেয়ের বিয়ের জন্য লোন করেছেন, কিন্তু সময়মতো সে অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় তাদের মধ্যে এক ধরনের ভয় কাজ করে এবং পরবর্তীতে যা বিষণ্ণতায় রূপ নেয়।

উদাহরণ হিসেবে তিনি চীনের কথা উল্লেখ বলেন, একসময় চীনের একটি গ্রামেও এধরনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। পরে বিভিন্ন গবেষণার মধ্য দিয়ে জানা যায়, একটি বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে যেটি বিষণ্ণতার কারণ। চীনের বড় একটি গ্রাম যার নাম—‘ঝেঝাং’, সেটি দুভাগে বিভক্ত ছিল ‘সিয়ান’ নদীর কারণে। যাতায়াতে ঝামেলা ছিল। ফলে ঝেঝাং গ্রামে সরকার-সরবরাহকৃত ভালো মানের কীটনাশক পৌঁছাতে দেরি হতো বলে ঝেঝাংবাসীরা নিম্নমানের কীটনাশক ‘খিটাসান’ বানাত এবং এটি ব্যবহারে ফসলের ফলন ভালো হলেও এরমধ্যে থাকা একধরণের সীসা বাতাসে মিশে থাকত যেটি মানবমনের ওপর বিষণ্ণতার ছাপ ফেলত। পরে এ থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষা পেতে একটা সেতু নির্মাণ করা হয় এবং সেই সেতু নির্মাণের আগে কাজ শুরুর দিন সাতজন মানুষের কাটামুণ্ডু দেওয়ার কথা চালু থাকলেও সেটি সত্য নয় বলে জানান সুশান্ত ভৌমিক।

দুই.
আলতাবানু জানেন না কতক্ষণ স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ব্যাঙের কান্না শুনছিলেন! তবে এটুকু মনে আছে তিনি বারান্দার মেঝেতে পড়ে যাওয়ার সময় পাশের কেবিনের রোগীর দুজন স্বজন তাকে ধরেন। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙে বেশ দেরিতে। ততক্ষণে দেখেন তার কেবিনের সামনে বেশ ভিড়। বাইরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। এক ডাক্তার তার পালস, রক্তচাপ এসব মাপার পর এক সাংবাদিক ঢোকেন। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে। তাকে ঘিরে বেশ কিছু মানুষ পেছনে। সাংবাদিক আলতাবানুকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার স্বামী বশিরের খবর জানেন তো?’ আলতাবানু কী ভাবেন সেটি আমাদের জানার কথা নয়। আমরা শুধু এখন পর্যন্ত জানি যে তিনি গতরাতে পরীক্ষার খাতা দেখার জন্য মেঝেতে বসে টিভি অন করেছিলেন। আলতাবানু বলেন, ‘অয়, জানি। কাইল রাইত আমার জামাই ধুসাইলাতে(গণপিটুনি) মরছইন আলিসারকুলের ইউনিয়ন অফিসোর রাস্তাত।’ সাংবাদিক জানতে চান, ‘তার ব্যাগে একটা শিশুর গলা কাটা লাশ পাওয়া গেছে। শিশুটি ওই গ্রামের নেজামত মাস্টারের সাত বছরের নাতির। নেজামত মাস্টারের সাথে কি আপনার স্বামীর বিরোধ ছিল?’ ডাক্তার এগিয়ে এসে তখন বলেন, ‘রোগিনী অসুস্থ।’ সাংবাদিক কী ভাবেন কে জানে এরপর আর কোনো প্রশ্ন না করে বেরিয়ে যান কেবিন থেকে। এর একটু পরই পুলিশ আসে একদল। দুপুরে নার্স খাবার দেওয়ার আগে। আলতাবানু তখন গোসল করছিলেন। বেরুতেই নার্স বলেন, ‘ভয় পাইহৈন না। পুলিশ আইছে। আগে খাবার খাইলান। মরল জামাই আফনার, দিগদারিও শুরু হৈল আফনার।’

আলতাবানু কারো সাথে কিছু না বলে খাবার খেলেন। ওষুধ খেলেন। ঘুমিয়ে পড়লেন। ‘ইলাকান অয় না আলতা, ইলাকান মরাত গেছলায় কেরলাগি’—কেউ যেন ফিসফিসিয়ে আলতাবানুর কানে বলে। আলিসারকুলের ধলামন্দিরের পুবদিকে নিকুঞ্জ গ্রামের সীমানা ঘেঁষে যে রাণীদিঘি, সেই দিঘির সিঁড়ির ওপরই তো পড়ে ছিল আলতাবানু সেই বিকালে। আশ্বিনের শেষ বিকাল। ‘ওরাসন’ নামের কীটনাশক খেয়েছিল। ওরাসন ধানের ক্ষেতে দেওয়া হয় যাতে কীটপতঙ্গের উৎপাত না হয়। বাপজান কিনে রেখেছিল। লাল গুড়ের মতন। খেতে তিতা। বুক জ্বলছিল ঢোক গেলার পর। তখন আলতাবানু সিঁড়ির ওপর পড়ে গিয়েছিল। তার তখন বড় সাধ ছিল দিঘির পানিতে পড়ে মরবে। মরার পর তার লাশ ভেসে থাকবে। সবাই তার লাশ দেখার জন্য ভিড় করবে দিঘির পাড় ঘেঁষে। কিন্তু দিঘির পানিতে সেদিন ঠাঁই পায়নি আলতাবানু। ঠাঁই পেয়েছিল নকুলের কোলে। নকুল দ্বিজদাস। কীর্তন করে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে বেড়ায়। শীতকালে দুর্গাপুজার সময় বিভিন্ন এলাকায় যাত্রাপালা শুরু হলে যাত্রাদলে ‘বিবেক’-এর ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে গ্রামছাড়া হয়। নকুলের সত্যিকার অর্থেই কেউ নেই। ধলামন্দিরে ঘুমায়।

বাবা-মা দুজনই একরাতে নিরুদ্দেশ হন যখন নকুলের বয়স মাত্র বছর আটেক। নকুলের বাবা-মায়ের নিরুদ্দেশের কারণ গ্রামবাসীর অজানা। এরপর কিছুদিন সতীশ মণ্ডলের বাড়িতে থাকে। সেখান থেকে কোনো অজানা কারণে তার ঠাঁই হয় ধলা মন্দিরে। সেই প্রথম আলতাবানু নকুলকে দেখে। কত নাম শুনেছে তার। সীতার বনবাস, গলি থেকে রাজপথ, আনারকলি, বাঁদী থেকে বেগম—নামের কত কত যাত্রাপালায় সে অভিনয় করে বেড়ায় এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে। কত নামডাক তার। সেই নকুলদার কোলে তার মাথা! নকুল তার হাতের দুটো আঙুল কায়দা করে কিঞ্চিত আলতার মুখে ঢুকিয়ে বমি করায়। দিঘির পানি নিয়ে চোখে মুখে কপালে ঝাপটা দেয় সেই বেঁচে ওঠে আলতাবানু, দিঘির পাড় বেয়ে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে যেন চারিদিকে সুনশান নীরবতা। সেই প্রেম শুরু হয় নকুলের সাথে আলতাবানুর। খুব ভোরে মন্দিরের জন্যে নকুল ফুলের সন্ধানে গেলে আলতাবানু ফজরের নামাজ পড়ে অপেক্ষায় থাকত জানালা ফাঁক করে, কখন নকুল এসে দাঁড়াবে। শুরুটা এভাবে। শেষও তো থাকে। নকুল মনে হয় এভাবে শেষ হবে জানত না। শেষ হলো এক শুক্কুরবার। নেজামত মাস্টারের উঠান বাড়িতে। মৌলভী ডেকে নকুলকে মুসলমান বানানো হলো। কলেমা পড়ল। নতুন নাম হলো বশির। এরপর বিয়ে হলো আলতাবানুর সাথে। তখন আলতাবানু শ্রীমঙ্গলে একটি প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। নকুল অষ্টম শ্রেণী-পাস বেকার। এরপর থেকে তাদের বসবাস শ্রীমঙ্গলের কলেজ রোডে থানা সংলগ্ন ভাড়া বাড়িতেই। এসব পুরনো কথা মনে পড়ে না কখনোই আলতাবানুর। স্বপ্নেও না। কিন্তু বশির খুন করতে পারে নেয়ামত মাস্টারের নাতিকে এটি ভাবতেও পারছেন না। ঘুম অনেক আগেই ভেঙেছিল। কিন্তু নিরুপায় মানুষের জীবনে এ সময়টাও মূল্যবান যে সে যখন চোখ বুজে অনেক কিছু তার স্মৃতিপটে ভাসায়। এই স্মৃতিপটে নিরুপায় মানুষ ঘটনাসমূহ ভাসিয়ে থাকে দুটো কারণে হয়তো-বা। যখন তার করার কিছু থাকে না। যখন সে আশপাশ থেকে পালাতে চায়।

তিন.
নির্বিরোধী মানুষের বিপদ কম হয় সেটিই সবাই জানেন। কিন্তু আমরা যারা আলিসারকুল গ্রামের ঘটনাবলির দিকে নজর রাখছিলাম, তারা অনেক অনেক কাল পর জানতে পারি বশির ‘ধুসাইলা’তে (গণপিটুনি) মারা গিয়েছিলেন। তার কাছে একটা বড়ো চটের ব্যাগে যদিও নেজামত মাস্টারের নাতির গলা কাটা মুণ্ডু পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু এর রহস্য আমরা আজও জানি না। কারণ বশির নির্বিরোধী মানুষ ছিলেন এবং তিনি মারা যাওয়ায় তাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে শিশুর গলা কাটা মুণ্ডুর বিষয়ে কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি। তখন আমরা ভাবি, শিশুটিকে কে খুন করতে পারে! কেউ কেউ ভাবি নিছক নেজামত মাস্টারের কোনো শক্রপক্ষের কাজ এটি। এটি করে কোনো চটের ব্যাগে কাটা মুণ্ডু ঢুকিয়ে দিয়ে নির্বিরোধী বশিরকে ‘ছেলেধরা-ছেলেধরা’ বলে মারতে থাকলে আরো জনতা এসে যোগ দেয় এবং তারাও মারতে শুরু করে বশিরকে, হয়তো সে সুযোগে নেজামত মাস্টারের প্রকৃত খুনী ও সহযোগীরা পালিয়ে যায়। কেউ কেউ ভাবেন, পদ্মাসেতু হচ্ছে। একলাখ শিশুর গলাকাটা মুণ্ডু লাগবে। সে কারণে বশির এমন করতে পারে। যদিও সরকার পক্ষ বারবার বলেছে এসব নিছক গুজব। আবার অনেকের ধারণা, নকুল ‘বশির’ হলেও নওমুসলিম হিসেবে তাকে ওই গ্রামের অনেক ধর্মান্ধ মানুষই সুযোগ খুঁজছিল শায়েস্তা করার। কিন্তু এ যুক্তি মেনে নেওয়া যায় না, কারণ অল্প শায়েস্তা করার জন্য গলা কাটা মুণ্ডু লাগবে কেন? মাপাআ’র কো-অডিনেটর সুশান্ত ভৌমিক কথাপ্রসঙ্গে আমাদের বলেন, ‘ধুসাইলা একটি মাস-সুইসাইডাল সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার। আলিসারকুলের মানুষকে কাউন্সিলিংয়ের পাশাপাশি পলিটিক্যালি কনসাসও হতে হবে। নাহলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’

সন্ধ্যা নামে। আমরা মাঝে মাঝে আলিসারকুলের ইউনিয়ন অফিসের সড়কের নিমগাছটার নিচে যেখানে ক্যারাম খেলা হয় সেখানে যাই, রাস্তার ধারের শালগাছগুলির বড় বড় পাতা হাতির কানের মতো দোলে। বিধবা সুন্দরীর মায়ের চা দোকানের কাঠের বেঞ্চিতে বসি, চা খেতে গেলে মুতের গন্ধ। কিরে মাইনকা, মুতের গন্ধ কেরলাগি? কোনো জবাব নাই, দেখি নিমগাছের একটু দূরে পাকুড়গাছের নিচে বস্তা বিছিয়ে আলতাবানু বসে থাকে। বসে থাকে নাকি আমরাই গল্প বানাই কে জানে? আলতাবানু বসে বসে মুতে। বস্তা ভিজে। নিউজপেপার ভিজে। সে মুত বহে আসে আমাদের দিকে। আমরা যাতে না ভাসি সেই ভয়ে আলগা আলগা থাকি।

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;