জবাফুলের দুনিয়া



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

এরকম হয়। খুব কম সময়। তবে হয়। সে তো জানা ছিল রফিকুলের। কিন্তু এবার যেরকম হলো সেটা অতীতের চেয়ে ব্যতিক্রম। সে যাচ্ছিল  নীলক্ষেত টু মিরপুর রোডের শুক্রাবাদের সিনজিয়ান রেস্তেরাঁর সামনে দিয়ে। সন্ধ্যা ৭টার একটু বেশি হবে। রাত বেশি নয়। কিন্তু শবে বরাতের রাত বলেই হয়তোবা ঠিক সেসময় মানুষজন রাস্তায় কম ছিল। যদি বেশি থাকত তবে হয়তো রফিকুল অতীতে এমন ঘটনার সময় যেরকম মানুষের হেল্প নিয়েছিল সেরকম নিত। কিন্তু  সেদিন সে নিরুপায়। সিনজিয়ান রেস্তেরাঁ বা’পাশে ফেলে দু’কদম এগুতেই সে পড়ে গেল।

এরপর ধানমন্ডি ইবনে সিনা ক্লিনিকে ১৪ ঘণ্টা পর যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন দেখল তার বাবা, মা ও ছোট ভাই আরিফ তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। চিকিৎসক জানালেন, রফিকুলের যে রোগটি হয়েছে এটিকে চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় বলে, ডিমেনশিয়া। এ রোগ সাধারণত বৃদ্ধকালে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যারা এলকোহলিক তারা এই রোগের ঝুঁকিতে থাকে।

কিন্তু রফিকুলের বয়স মাত্র আটাশ বছর কয়েক মাস। এবং সে নন-এলকোহলিক।

রফিকুল ক্লিনিক থেকে সুস্থভাবে বাসায় ফেরে ঠিকই কিন্তু বাইরে বেরুনোর ব্যাপারে ভয় গেড়ে বসে তার মনে। যদি সে আর তার বাসা না চিনতে পারে। আবার যদি এমন হয়!

কিন্তু তাকে ক্লাস নাইনে পড়ুয়া যে মেয়েটি ভালোবাসে, মানে মিল্কি, তার তো আর এসব বোঝার কথা নয়। সে মোবাইলে ফোন দিতেই থাকে প্রতিদিন। বলে, ‘স্যার আমাকে বাসায় এসে পড়ানো ছেড়ে দিলেন, ঠিকাছে। কিন্তু আসবেন না বেড়াতে?’ কোনোদিন বা বলে, ‘স্যার খুব মিস করছি। জবাফুলের গল্প না একদিন বলেছিলেন শোনাবেন, শোনালেন না তো!’ কখনো বলে, ‘স্যার পোস্টমাস্টারের রতনের কথা মনে পড়লে এখনো আমার চোখ ভিজে যায়। বলেছিলেন না, মফস্বলে এখনো অনেক রতন থাকে। তাদের কথা বলবেন। কই এলেন না তো! কবে আসবেন।’

রফিকুলের এসব কথা শুনতে আর ভালো লাগে না। আবার সারাদিন-রাত বাসায় কাটায় বলেই হয়তোবা রতনের ফোনকলের অপেক্ষাও করে। কিন্তু তাকে সারাক্ষণ তো তটস্থ রাখে সেই ভয়—যদি কোনোদিন সে তার বাবা, মা আর ছোটভাই আরিফকেও না চিনতে পারে। বাসার এ ঘর থেকে ওঘরে যাওয়া ভুলে যায়।

জীবন কিভাবে যে ধীরে ধীরে গুটিয়ে আসছে সে টের পায়।

একদিন দুপুরবেলা তার মাথায় প্রথম চিন্তা আসে যে, আত্মহত্যা করলে তো সে এই ক্রমাগত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারে। কিন্ত সমস্যা হলো আরিফ। আরিফের মুখ ভাসে। যেন সেই শৈশবে জামালপুরের রেললাইন ধরে রফিকুল ঘুড়ি নিয়ে দৌড়াচ্ছে। পেছনে আরিফ। আহা, এমন মায়াময় দৃশ্যের বাইরে চলে গেল রফিকুল। রাতে ঘুম হয় না বললেই চলে। তার পাশে ঘুমায় আরিফ। মাত্র ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। সেও জেগে থাকতে চেষ্টা করে। রফিকুল যখন আরিফ ঘুমিয়েছে ভেবে একটু উঠে বসে থাকতে চায়, অন্ধকার ঘরে দেখা গেল ঠিক তখনই আরিফ লাফিয়ে উঠে রফিকুলকে জড়িয়ে ধরে বলবে, ‘ভাইজান খারাপ লাগছে?’

রফিকুলের তখন ভীষণ কান্না পায় ছোট ভাইয়ের তার প্রতি মায়া দেখে। কিন্তু বুঝতে দেয় না। সচরাচর এমনই বলে, ‘তুই ঘুমাস না কেন? আমি ঠিক আছি।’

রফিকুল যদিও বলে ভালো আছে কিন্তু আজকাল তার মাঝেমাঝেই আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগে। সে আত্মহত্যা বিষয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা করে। বেশ রোমান্টিকতাও আছে এসব পরিকল্পনায়।

উদাহরণ দেওয়া যাক

এক. ছোট্ট তিনটা নীল ক্যাপসুল রফিকুলের হাতে। লাউয়াছড়ার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যে নিঃসঙ্গতম রেলপথটি চলে গেছে সে পথে আশ্বিনের জোছনা, রেললাইনের পাশ দিয়েই নেমে গেছে ঢালুপথ। ওই পথ দিয়ে নেমে যাচ্ছে রফিকুল। জিহ্বার নিচে রাখে  তিনটা নীল ক্যাপসুল। এই-ই শেষ। যে শেষটার জন্য সবাই অপেক্ষা করে। কেউ পায় দেরিতে, কেউ পেতে চায় না। কিন্তু রফিকুলের জীবনে আচমকা এসেছে, বুঝে ওঠার আগেই সে ছিনিয়ে নিয়ে যায় বোধ। হ্যাপিলি এভার আফটার। কেমিক্যাল নাম পটাশিয়াম সায়নাইড।

দুই. একটা বাথটাব, কানায় কানায় পরিপূর্ণ উষ্ণ পানি। গোসল করবা মিল্কি? তুমি আর আমি নেকেড হই চলো আপাতত। শরীর, শরীরই তো। নতুন কিছু নয়। চলে এসো। ঘ্রাণ নাও। নেবু নেবু গন্ধ পাইতেছো না? ওই যে দুইটা গেলাস। আগে আমি খাইনি। কসম আল্লার। আজই একদিন দুইজনে মিল্যা খেলতে খেলতে খাইতে খাইতে তোমারে রতনের গল্প করুম। জবাফুলের। ওই গেলাসে গোপীবাগ থিকা আনা স্পিরিট মিশানো বাংলা মদ।
না রফিকুল বলে না, একটা মদের গ্লাসে দুশোটা ঘুমের বড়ি মেশানো আছে।
মিল্কি পানির ভিত্রে আধডোবা হৈয়্যা আছি ফেস টু ফেস দু’জনে। নাও গেলাস। একশোবার গেলাস বদল করব। আর এক, দুই, তিন করে একশো গুনব। ঠিকাছে? রফিকুল বলে, মিল্কি রতনের মতন কাউরে ভালোবাসবা না। কানবা না। বুঝলা, জবাফুল আমি খুব ভালোবাসতাম। লাল দেইখ্যা। কিন্তু গন্ধ নাই বুঝলা। এরপর এতটুকু বলে রফিকুল গেলাসের হাত বদল করতে করতে গোপন সংকেত দেওয়া গেলাসটা নিজ হাতে নেয়। একশো গোনা শেষ। সে গেলাসের সবটুকু খায়। মিল্কি হয়তো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ওপরে শুয়ে পড়ে রফিকুল, অস্ফুস্ট স্বরে কী বলেছিল, তুমি জবাফুল হলা না আমার!
বাথটাব পানির নিচে এলোমেলো দুটি নগ্ন তরণ-তরুণীর শরীর জড়ানো। অয়েল পেইন্টিং।

তিন. কোনো পাহাড়ী হিমশহর। রফিকুল হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে অনেক কষ্টে এমন একটা জায়গায় উঠে সেখানে দেখে যীশুখ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার মতো লোহার ফ্রেমের একটা ক্রুশ। সেই ক্রুশে একটা সাপ ঝুলে আছে। রফিকুল তার মোবাইল থেকে সিম খোলে। তারপর সিমটিকে মুখে মুড়ে চিবিয়ে যতটা সম্ভব গুঁড়ো করে গেলে। মোবাইল ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে। এরপর এগিয়ে যায় ক্রুশে ঝুলে থাকা সাপের দিকে। তখন শীতের বিষণ্ণ বিকাল। সে জিহ্বা এগিয়ে দেয়, ব্যাস সাপটি সাহায্য করে। তার জিহ্বায় একটা সত্যি একটা মাত্র ছোবল দেয়। The road less travelled। রফিকুলকে দেখা যায় গড়িয়ে গড়িয়ে অনেক নিচে খাদ থেকে থাদে ঝরে পড়তে।

কিন্তু মুশকিল হলো রফিকুল এসব ভাবলে ভয় পায়। সে জানে আত্মহত্যা করবে না। সে ভীরু প্রকৃতির। তার সামনে জাকিরের মুখ ভাসে। ভাইজান ভাইজান ডাক শোনে। তার বাবার মুখ অতোটা ভাসে না। তবে মায়ের মুখ ভাসে। মাঝে মাঝে। ভাসবে আর কতদিন? সে তো স্মৃতিভ্রষ্টই হতে যাচ্ছে। অতএব বেঁচে থাকলেই বা কী মরে গেলেই বা কী? এমন চিন্তা রফিকুলকে তাজা করে।

একদিন দুপুরে ঘুম থেকে উঠে গোসল, নাস্তা সেরে তার কেন জানি বহুদিন পর খুব ফ্রেশ লাগে নিজেকে। আব্বা অফিসে। আম্মা রান্না নিয়ে ব্যস্ত। জাকির স্কুলে। সে গ্যাবার্ডিনের একটা প্যান্ট আর এ্যাশ কালারের টিশার্ট পরতে পরতে ফোনকল দেয় মিল্কিকে, ‘মিল্কি কোথায় তুমি?’
মিল্কি কল রিসিভ করে। কিন্তু এত কোলাহলপূর্ণ তার চারপাশ যে কথা স্পষ্ট শোনা যায় না। শুধু শোনা যায়, ‘স্কুলের গেইটে।’ আরো কীসব বলে শোনা যায় না।
রফিকুল বলে, ‘থাকো। আমি আসছি।’

বাসা থেকে বেরুনোর আগে রফিকুলের একটু ভয় জাগে, যদি না বাসা চিনে ফিরতে পারে, যদি চারপাশ অন্ধকার দেখে! তবু সে বেরিয়ে পড়ে। শ্যামলী সিনেমা হলের উল্টোপাড়ে গিয়ে একটু দাঁড়ানোর পরই বাস পায়। ঘিঞ্জি। উঠতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করায় পায়ের একজোড়া স্যান্ডেলের একটা খসে পড়ে।

রফিকুল ততোক্ষণে উঠে গেছে। বাসও ছেড়েছে। রফিকুলের একটা হাত উপরের হাতল ধরা অন্যটি একটি সিটের পেছনে ভর দেওয়া। সে ধীরে ধীরে বাম পায়ে থাকা অন্য স্যান্ডেল পা থেকে খুলে অগোচরে যেনবা, কেউ যেন না দেখে এমনভাবে ধাক্কা দিতে দিতে অনেকটা দূরে সরিয়ে দেয়। যেন ওই একখানা স্যান্ডেল তার না।

জ্যাম।  বাস ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। আসাদগেটের স্টপেজ পেরিয়ে ফের জ্যাম। রফিকুল মিল্কির বাসার কথা মনে পড়ে। আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারে। তার স্কুলও পাশেই। 

মিল্কিদের বাসার গেটভর্তি মাধবীলতা। উলোঝুলো হয়ে ঝুপ্পুস করে জড়িয়ে আছে গেটটা। সেই গেট ঠেলে এগুলে একটা উঠোনমতো। তারপর একটা টানা বারান্দা। প্রথম দরজাটা খুললে উপরে ওঠার সিঁড়ি। ওই উপরে থাকে বাকি বাড়িটা। আর দ্বিতীয় দরজা ঠেললে? হ্যাঁ, ওইটা মিল্কির ঘর। অনেকগুলো জানলা। সেই জানালা দিয়ে তাকালে জবাফুলের দুটো গাছ। মিল্কিকে যেদিন প্রথম টিউশনি পড়াতে যায় রফিকুল সেদিনের কথা মনে পড়ে। মিল্কিদের বাসার কাজের বুয়া প্রথমে এসে চা বিসকিট দেন। এর কিছুক্ষণ পর আসেন মিল্কির আম্মা। বোরকা পরিহিতা। বাসায়ও কি বোরকা পরেন? রফিকুল ভাবে। কে জানে? রফিকুলের পেছনে পেছনে ঢোকে মিল্কি। পরিচয়পর্ব শেষে রফিকুল মিল্কিকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই চলে যায় জবাফুলের দুটো গাছের দিকে। সে ওদিকে তাকিয়েই বলে, ‘বাহ, জবাফুল দেখতে দেখতে পড়ানো।’
মিল্কিও তাকায় জানালা গলিয়ে জবাফুলের দিকে।
রফিকুল আপনমনে বিড়বিড় করে বলে, ‘ফুলটা লাল। সুন্দর। কিন্তু কোনো স্মেল নাইকা। এই যে গন্ধ—এই ফুলটা পেল না এই নিয়া মজার গল্প আছে।’
মিল্কি মিশুক মেয়ে বোঝা গেল তার প্রশ্নে, ‘কী গল্প স্যার বলেন না?’
রফিকুল বলে, ‘ওইটা আরেকদিন বলুম। নাও ম্যাথ বইটা নাও।’

জ্যাম ছেড়েছে। প্রায় একঘণ্টা লেগে যায় মিল্কির স্কুলের গেটের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে। রফিকুল মোবাইলে কল করে, ‘মিল্কি আছো?’
কল রিসিভ করে মিল্কি বলে, ‘জ্বী। এই যে পাশেই আমিন কনফেকশনারির ভেতর।  জবাফুলের, রতনের গল্প শুনব বলে সেই থেকে বসে আছি। আপনি কই?’

দেখা হয় তাদের। একটা কমদামী হোটেলে ঢোকে। চা সিঙাড়া খায়। মুখোমুখি বসা। রফিকুলের মনে হয় সে তো আর কিছুদিন পরই মিল্কিকে চিনবে না। সে কিছু বলে না।   তার মুখ দেখে। ভাগ করে করে। ভ্রু। কপাল। চিবুক। ওষ্ঠ। কান। মিল্কি জানতে চায়, ‘কথা বলছেন না যে। কী দেখছেন?’
মানুষের এমন হয়। দেখছে এক জিনিস। ভাবছে অন্য জিনিস। আর ওই অন্য জিনিস নিয়ে ভাবনাই সে অসতর্কভাবে প্রকাশ করে ফেলে হঠাৎ। মন। তোর এত অলিগলি।   রফিকুল দৌড়াচ্ছে। এ গলি থেকে ও গলিতে। আর সামনে বসা মিল্কিকে বলে, ‘কী দেখছি? দেখছি জবাফুল।’

রফিকুলের মিল্কির হাত স্পর্শ করতে ইচ্ছা করে। বলতে ইচ্ছা করে সে আর বেশিদিন বাঁচবে না হয়তো। কিছুদিন পরই হয়তো আর কাউকে চিনতে পারবে না। স্মৃতিভ্রষ্ট হবে। বলতে ইচ্ছা, এই অল্প জীবনে সে কেন পড়াতে গিয়েছিল মিল্কিকে। মিল্কিকে কেন মনে পড়বে তার?

কিছুই বলে না।

বাসায় ফেরার পথে রফিকুল আটকা পড়ে নীলক্ষেত মোড়ে জ্যামে। একটা বাম ছাত্র সংগঠনের ছেলে মেয়েরা মিছিল বের করেছে। শ্লোগান দিচ্ছে ‘প্রহসনের নির্বাচন  চাই না। লুটপাটের ক্ষমতা চাই না। মুক্তি মুক্তি মুক্তি, মানুষের মুক্তি চাই।’

রফিকুলের শিরদাঁড়া বেয়ে ঘামের বিন্দু নামতে থাকে একের পর এক। তার মনে হলো ফের ঘটতে যাচ্ছে বিপর্যয়। একটা নেপথ্য। ব্যাকগ্রাউন্ড। আলো নেই। পিচ ডার্ক। শুধু সাউন্ড আসছে। কথা। আর অসংখ্য জবাফুল। ঝরে পড়ছে তার ওপর।

আপনারা কী ভাবছেন? চারপাশে যাদের দাঁত হাসছে তারা সেভেন্থ হেভেনে আছে আর রফিকুল দোজখের  টিকেট কেটেছে? জ্বী না... এটা দোজখই, টিকিট দরকারই নেই। এই যারা চাদ্দিকে রংচং মেখে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ টিপছে, মুচকি হাসছে, বলছে, ‘দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে...’ তারাও, ওই... দোজখেই। কিন্তু কাউকে সেটা বলছে না। অথবা, কেউ কেউ আবার জানেও না এখনো। কেউ কাউকে বলে না তো... তাই সবাই জানে যে তারা জানে না তারা দোজখে আছে, অথবা তারা সত্যিই জানে না অথবা ওই বামের মিছিলের মুখগুলোও জানে না বিশ্ব পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। নো মোর বিপ্লব।

ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়া দুপুর যাচ্ছে বিকেলের কাছে। রফিকুলকে আমরা পড়ে থাকতে দেখি। দেখি অনেক লালজবা ঝরে পড়ছে তার ওপর। সত্যি কথা কী, এসব গপসপ তো আর রফিকুলকে বানিয়ে লাভ নেই। ইলিউশ্যুন। সব। সব।

সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষই বা কেমন দায়িত্বজ্ঞানহীন। ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা। সেদিকে নজর নেই।

থাক ওসব কথা। আমরা এরপর দেখি রফিকুল একটু পাশ ফেরে। এরপর জবাফুলের ভিড় থেকে ম্যানহোলে পড়ে যায়। তেমন কিছু না, ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশন। এন্ড অব দ্যা হিস্ট্রি।

এগিয়ে আসুন, প্লিজ, না রফিকুলদের জন্য নয়। একটু ভাবতে থাকেন, রফিকুল গন্ধহীন জবাফুল কেন ভালোবাসত? আর তার পরিণতি কেনইবা হলো দুর্গন্ধযুক্ত ম্যানহোলে। সে ভেসে ভেসে এই রাজধানী ঢাকার নিচ দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে মিশবে। বাদ দেন। আমরা বরং উপরিকাঠামোতেই ব্যস্ত থাকি। লগ আউট।

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;