চা-শ্রমিক মা ও সন্তানের হার না মানা জীবনের গল্প!

, ক্যাম্পাস

আরিফ জাওয়াদ, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-09-01 01:14:47

 

মানুষ তাঁর স্বপ্নের বড়, স্বপ্ন মানুষকে লক্ষ্যের পানে ছুটতে যেমনটা তাড়না যোগায় তেমনি সবশেষ সেই স্বপ্ন পূরণের মাধ্যমে স্বপ্নিক মানুষটির গ্রহণযোগ্যতাও বেশ বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রতিকালে চা শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির একটি আন্দোলন হয়। সেই আন্দোলনের জের ধরে ধরে মা ও ছেলেকে নিয়ে এক করুণ গল্প গাঁথা স্ট্যাটাস নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়।

স্ট্যাটাস দেওয়া সেই যুবক সন্তোষ রবি দাস অঞ্জন। যার জীবনের একটি বড় অংশ চা বাগান নিয়ে গল্প ছিল, যে গল্প জুড়ে ছিল মজুরি ও নানা বঞ্চনার গল্প। কিন্তু চা শ্রমিক মায়ের সন্তান সন্তোষ নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে আজ ব্যাংকার।

তবে জীবন সংগ্রামের এ যাত্রা কখনোই মধুর ছিল না সন্তোষ রবি দাস অঞ্জনের। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের শমশেরনগর ফাঁড়ি কানিহাটি চা-বাগানে বাড়ি সন্তোষের। সালটি ১৯৯৬, ছয় মাস বয়সে বাবা সত্যনারায়ণ রবিদাসকে হারান সন্তোষ। স্বামী মারা যাবার পর, সন্তোষের মা কমলি রবিদাস কিভাবে কি করবেন, একদিকে ছোট ছয় মাসের সন্তোষ। নেমে পড়েন চা শ্রমিকের পেশায়।


 

দৈনিক ১৮ টাকা মজুরিতে চা বাগানে কাজ শুরু করেন কমলি। শুরু হয় এক সংগ্রামের জীবন যে গল্পের চরিত্র সন্তোষ ও কমলি। কিছু জীবনের গল্প রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। দুধের শিশু সন্তোষকে পটে করে দুধ খাইয়ে অন্যের কাছে রেখে শ্রমিকের কাজ করতেন কমলি। জীবন সংগ্রামী কমলি কষ্টের মধ্যে থেকেও একমাত্র সন্তানকে নিয়ে বুক ভরা স্বপ্নই বেঁধেছিলেন, হয়তো একদিন সুদিন আসবে সেদিনে এত কষ্ট থাকবে না।

সেই আশা থেকেই একমাত্র সম্বল ছেলে সন্তোষকে বাগানের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন কমলি। ২০০৭ সালে বাগানের প্রাথমিক বিদ্যালয় পঞ্চম শ্রেণির পাঠ চুকিয়ে ডানকান ব্রাদার্স ফাউন্ডেশনের লংলা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন কমলি রবিদাস। সপ্তাহে ৭০-৮০ টাকা সন্তোষকে পাঠাতেন মা কমলি। তা দিয়েই খাওয়া চালাতে হত সন্তোষকে। সেখান থেকে ২০১৩ সালে এসএসসি পাস করেন সন্তোষ।

মাধ্যমিকের পর যেই কলেজে ভর্তি হবেন, তখন কমলি রবি দাসের স্বপ্নগুলো যেন অধরা হয়ে যাচ্ছিল। কারণ ছেলেকে কলেজে ভর্তি করাতে অনেক অর্থের প্রয়োজন, চারদিকে পাচ্ছিলেন না কোন সাহায্য। তবু হাল ছাড়েন নি কমলি। চা–বাগানের কাজের ফাঁকে ফাঁকে মানুষের বাড়িতে কাজ করা শুরু করলেন। তাতেও যখন কুলাচ্ছিল না, তখন গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য হয়ে ঋণ নিয়ে বসলেন কমলি। ছেলে সন্তোষকে ভর্তি করান শমশেরনগরের বিএএফ শাহীন কলেজে, সেখানে নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে সন্তোষের। সন্তোষ বলেন, “সে সময় যখন টিফিন খাওয়ার জন্য বাহিরে যেত। আমি রুমের মধ্যে বসে থাকতাম। কারণ টিফিন খেতে গেলে অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হত।”

সেখান থেকে নানান ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে অভাবের মধ্য থেকে চলে আসল এইচএসসি রেজিস্ট্রেশন। কমলির হাতেও তখন টাকা ছিল না, সেই সময় মা কমলি পঞ্চাশ টাকার একটি নোট ধরে দিয়েছিলেন, বলে জানায় সন্তোষ। শেষ-মেশ এক শিক্ষকের সহায়তায় এইচএসসির রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়। ২০১৫ সালে শমশেরনগরের বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন সন্তোষ রবিদাস।


জীবন চলার পথে বাঁধা যেন মা কমলি ও সন্তান সন্তোষের পিছু কখনোই ছাড়ে নি। মেধাবী সন্তোষ যেই মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি ঝালিয়ে নিতে কোচিং-এ ভর্তি হবেন। তখনও আবার এক মোটা অঙ্কের টাকার বাঁধ সাধে। ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তুতি নিতে সন্তোষকে সিলেটে পাঠান মা কমলি রবি দাস। সঙ্গে কমলির আবার যুক্ত হল অতিরিক্ত পরিশ্রম। চা শ্রমিকের পাশাপাশি কাজ নিলেন মাটি কাঁটার। চা বাগানে কাজ করার মজুরি হিসেবে সেসময় ১০২ টাকা এবং অন্যান্য কাজের পারিশ্রমিক হিসেবেসব মিলিয়ে ৩০০ টাকা পেতেন দৈনিক কমলি রবি দাস।

মায়ের কষ্ট বৃথা যেতে দেয় নি সন্তোষ। শেষমেশ সকল প্রতিবন্ধকতাকে তুঙ্গে দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পান সন্তোষ। সেই গ্রামের মানুষ, এলাকার বিত্তশালী সকলে টাকা উঠিয়ে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা শিক্ষা অনুষদের মার্কেটিং বিভাগে। সাম্প্রতিককালে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন সন্তোষ।

বর্তমানে দেশের একটি বেসরকারি ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ পেয়েছেন সন্তোষ। জানা যায়, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির অংশ হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়। তবে নিয়ম অনুযায়ী লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরই সন্তোষের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেন সংশ্লিষ্টরা।

ব্যাংকে চাকরি পেলেও সন্তোষ নিজেকে দেশ ও জনগণের সেবাতে নিজেকে উৎসর্গ করতে চান। তিনি জানান, আজ এতদূর আসার পেছনে যেমনটা চা শ্রমিকের টাকা রয়েছে। তেমনি সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের টাকা রয়েছে এতদূর পর্যন্ত আসাতে। তাই জনগণের জন্য কাজ করে যেতে, বিপদে-আপদে পাশে থাকতে সিভিল সার্ভিসের মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারে যেতে চান সন্তোষ রবি দাস অঞ্জন।

পিছিয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের নিজ উদ্যেগে প্রতিষ্ঠা করেছেন “একটি বিদ্যার্থীর দৃষ্টি সংঘ” নামক একটি সামাজিক সংগঠন। ২০১৩ সাল থেকে চলা ওই সংগঠনটি শিক্ষা, সংস্কৃতি, বাল্যবিবাহ রোধ, ধর্মীয় রীতিনীতি শিক্ষাসহ নানা বিষয়ে সমাজ সচেতনতামূলক কাজ করছে। নিজ বাগানের প্রায় ৮৫ জন শিক্ষার্থীদের ওই সংগঠনের উদ্যোগে পড়াচ্ছেন। ভবিষ্যৎ বড় পরিসরে কিছু করার চিন্তা রয়েছে সন্তোষের, তার মত পিছিয়ে পড়া মেধাবীদের পাশে সব সময়ই থাকবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন জীবন যুদ্ধের এই লড়াকু সৈনিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর