কুবিতে পদোন্নতি নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে শিক্ষকমহল-উপাচার্য
শিক্ষকদের বিভিন্ন পদে পদোন্নতি নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে আছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষকমহল ও উপাচার্য। শিক্ষকদের অভিযোগ নীতিমালার বাইরে গিয়েও অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করে বেকায়দায় ফেলা হচ্ছে তাদের। তবে উপাচার্য বলছেন এসবে তার হাতে নেই, সবই নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে এবং শিক্ষকদের মান বাড়ানোর জন্য নীতিমালার বাইরে অতিরিক্ত গবেষণার শর্ত আরোপ করা হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালার শর্তের পাশাপাশি এককভাবে কিউ-ওয়ান মানের জার্নালে প্রকাশের অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করা হচ্ছে৷ কখনও দেখা যায় সিনিয়র শিক্ষকদের আগে জুনিয়র শিক্ষকরা প্রমোশন পেয়ে যাচ্ছে এতে বিভাগগুলোতে সিনিয়র-জুনিয়র অবস্থান বজায় থাকছেনা। তাছাড়া আগে পদন্নোতির ক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত শর্তগুলো ছিলো না। এখন এই অতিরিক্ত শর্তগুলো দেয়া হচ্ছে।
এ ব্যাপারে উপাচার্য বলেন, 'এটা আসলে নির্ভর করে সে সিনিয়র থাকতে চায় কী-না। একজন শিক্ষক যদি প্রিডেটরি জার্নালে গবেষণা প্রকাশ করে বা গবেষণা না করে তাহলে তার পদন্নোতি হবে না। একজন জুনিয়র শিক্ষকের যদি তার থেকে ভালো গবেষণা থাকে তাহলে তাকে অবশ্যই পদন্নোতি দেয়া হবে। যে আগে পাবলিশ করতে পারছে তার আগে পদন্নোতি হচ্ছে, আর এটাই নিয়ম। শুধু কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় না সবজায়গায় একই নিয়ম।'
পদন্নোতির ক্ষেত্রে আগের নিয়ম না মেনে নতুন শর্ত আরোপের ব্যাপারে বলেন, 'আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে চাই। আগে আমাদের এমন ভিশন ছিলো না; এখন আমাদের একটা ভিশন আছে। সে ধারাবাহিকতায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে এবং শিক্ষকদের মান বাড়াতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
কুবি শিক্ষকদের পদোন্নতির নীতিমালায় দেখা গেছে, সহকারী হতে সহযোগী অধ্যাপকে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সহকারী অধ্যাপক পদে থাকাকালীন কমপক্ষে তিনটি গবেষণা প্রকাশনা থাকার শর্ত রয়েছে৷ অন্যদিকে সহযোগী থেকে অধ্যাপকে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সহযোগী অধ্যাপক পদে থাকাকালীন কমপক্ষে পাঁচটি গবেষণা প্রকাশনা থাকার শর্ত রয়েছে৷ যদিও এই নীতিমালায় প্রকাশনার কোনো মানের উল্লেখ না করে বলা আছে ‘স্বীকৃত জার্নাল' এ প্রকাশিত বা প্রকাশনার জন্য গৃহীত গবেষণা প্রবন্ধই পদোন্নতির ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হবে।
নীতিমালার বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত শর্ত আরোপের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, 'শুধু নীতিমালা দেখেই যদি আমরা প্রমোশন দেই তাহলে তো আমাদের বোর্ড বসাতে হয় না। বোর্ডের কাজ হচ্ছে যাচাই বাছাই করা। একজন শিক্ষক অধ্যাপক হিসেবে যোগ্য কী-না বা সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ্য কী-না তা যাচাই বাছাই করা।'
পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, 'আগে ছিল স্বীকৃত জার্নালে একটা পেপার পাবলিশের নিয়ম। উনি ইউজিসির নিয়মে ভালো ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালের কথা বলতে পারেন। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কী এমন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন যে উনি কিউ-ওয়ান, কিউ-টু মানের জার্নালে পাবলিকেশন চান? গবেষণার পরিবেশ তৈরি না করেই এভাবে পুশ করলে তো হবে না।'
তিনি আরো বলেন, 'গবেষণা কিন্তু সিঙ্গেল অথরে সহজে হয় না। এখানে সিঙ্গেল অথোর, ফাস্ট অথোর এগুলো কেন? একজন শিক্ষক ক্লাস-পরীক্ষা কিছু না নিয়ে শুধু গবেষণা নিয়ে থাকবে নাকি।'
অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, 'স্থায়ীকরণের বিষয়টি নির্ভর করে কোনো শিক্ষকের নিয়োগপত্রের মধ্যে কী লেখা আছে তার উপর। এ উপাচার্য আসার আগ পর্যন্ত ক্রাইটেরিয়া ফিলাপ হয়েছে কিন্তু স্থায়ীকরণ হয় নাই এমন হয়নি। আমার ক্রাইটেরিয়া ফিলাপ হওয়ার পর তিনবার আবেদন করার পরেও আমার সাথে শত্রুতা করে স্থায়ী করেনি। স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে কখনো কোনো শিক্ষককে বোর্ডে ডাকানো হয়না। অথচ একমাত্র আমাকে ডেকে অপমান করা হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'একজন স্বাধীন শিক্ষক হিসেবে আমি কোনো সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দিতেই পারি। এ বিষয়টাও তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সিন্ডিকেটে উপস্থাপন করেছেন। শিক্ষকদের তিনি এক বছরে দুই তিনটা গবেষণা কিউ-ওয়ান জার্নালে প্রকাশের কথা বলছেন। একটা গবেষণাই তো কিউ-ওয়ান মানে তৈরি করতে এক বছরের বেশি লাগে৷ তার উপর তো এর জন্য পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্টও নেই। যোগদানের পর থেকে তিনি কোনো আইন তো মানছেনই না, নিজের মন মতো কাজ করে যাচ্ছেন।'
এ বক্তব্যের বিপরীতে উপাচার্য বলেন, 'যাদের আগে থেকে ভালো গবেষণা আছে তাদের অতিরিক্ত কোন গবেষণা করতে বলা হয়নি, যাদের নেই তাদের বলা হয়েছে। একটা পদে যাওয়ার জন্য নূন্যতম কোয়ালিটি থাকা প্রয়োজন। যদি কিছুই না থাকে তাহলে কিভাবে প্রমোশন দেয়া হবে?'
ব্যাবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, 'একটা বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মূল ভিত্তি হলো গবেষণা এই জায়গাটাতে মাননীয় উপাচার্য স্যার গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু কাকে কী শর্ত দিচ্ছে সেটা বোর্ডের বিষয় এই বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না।'
সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন বলেন, 'পদোন্নতির বেলায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য একটা কাঠামো আছে। তাদের আপগ্রেডেশন বোর্ড ও নীতিমালা আছে। সেখানে দেশসেরা অধ্যাপকরা থাকেন। তাদের দুইজন আমাদের সিন্ডিকেট থেকে এবং তিনজন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মনোনীত সদস্য থাকে এবং আমি পদাধিকারবলে চেয়ারম্যান। এখানে ঐ সদস্যরাই সব করেন, আমার কোনো প্রভাবই নেই। বিভাগভিত্তিক বোর্ডের সদস্যরাই সব নির্ধারণ করেন, সেখানে ঐ শিক্ষকের বাইরের কোনো ঘটনা প্রভাব পড়েনা।'