বহিরাগত-দর্শনার্থীমুক্ত জাবি, ক্যাম্পাস জুড়ে স্বস্তি
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত প্রায় ৭০০ একরের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। রাজধানী ঢাকার অদূরেই সবুজ গাছ-গাছালিতে ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে মাঝে ক্যাম্পাসটির অবস্থান।
শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোসহ প্রায় প্রতিদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষত ছুটির দিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিরিক্ত দর্শনার্থীর সমাগমের কারণে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা।
সাম্প্রতিক ধর্ষণকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হতে থাকলে গত ৫ ফেব্রুয়ারি (সোমবার) অনুষ্ঠিত এক জরুরি সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বহিরাগতদের প্রবেশ ও অস্থায়ী দোকানপাট নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ক্যাম্পাসে বহিরাগত প্রবেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেওয়া নিষেধাজ্ঞায় আজ শনিবার ছুটির দিনে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। দর্শনার্থী ও বহিরাগতদের আগমন অপেক্ষাকৃত কম ছিল। এতে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ কমাতে ও শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে ক্যাম্পাসের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা জরুরি বলে মনে করেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম দর্শনীয় স্থান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, বটতলা, টিএসসি, চৌরঙ্গী, সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ, মুরাদ চত্বর, মুন্নি সরণিসহ বেশ কিছু স্থানে অন্যান্য সময় বহিরাগতদের ঢল থাকলেও আজকে উপস্থিতি ছিল নগণ্য। যদিও দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে হতে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে কিছু বহিরাগত গ্রুপকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সম্প্রতি ধর্ষণকাণ্ডে ক্যাম্পাসে বহিরাগত প্রবেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেওয়া নিষেধাজ্ঞায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এতে কমে এসেছে বহিরাগতদের সংখ্যা। বহিরাগতদের প্রবেশে কর্তৃপক্ষের এমন ভূমিকায় স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে।
অনেকদিন পর বহিরাগতমুক্ত ক্যাম্পাস দেখে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বস্তি প্রকাশ করছেন। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী সজীব তালুকদার তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, 'শেষ কবে শুক্রবারে এমন ক্যাম্পাস দেখেছি মনে পড়ছে না। শুক্রবার বটতলায় গেলে মানুষের গমগমে আওয়াজ, শহীদ মিনারের সামনে গেলে চোখে পড়ে একদল কিশোর জুতা পায়ে শহীদ মিনারে উঠে নাচানাচি করতেছে, নতুন কলার ওয়াশরুমে গেলে দেখা যায় নির্দিষ্ট জায়গার বাইরে মল পড়ে আছে, ক্যাফের সামনে কলেজপড়ুয়া নিব্বা-নিব্বি ঝগড়া করতেছে বা প্রেম আরও কিছু ডাবল পার্ট প্রদর্শনী তো আছেই। ওয়াজেদ মিয়ার সামনে গেলে দেখা যায় সাপ পিটাইয়া মেরে ফেলতেছে, চৌরঙ্গীতে দেখা যায় পাখিকে ঢিল ছুঁড়তে, কিছু কাপল তো লেক থেকে শাপলা তোলে এনে ভালবাসার প্রমাণ দেয়।'
'এই শুক্রবার সেই ১ম বর্ষের দেখা জাবি ক্যাম্পাসের ভাইভ দিচ্ছে। হ্যাঁ এটাই আমার ক্যাম্পাস, এই ক্যাম্পাসই আমরা চাই যেখানে সপ্তাহে পাঁচ দিন ব্যস্ততার পর যখন ২টা দিন সময় পাওয়া যায় তখন যেন বিকেলে একটু বের হওয়া যায়। বহিরাগতদের অত্যাচারে এত বিরক্ত ছিলাম যে আজ বহিরাগত কম শুনে এই দুপুরে ক্যাম্পাস দেখতে বের হইছি। বিকেল পর্যন্ত এমন থাকলে ১ দিনের জন্য ধন্যবাদ দেব জাবি প্রশাসনকে'
সাভারের বাইপাইল থেকে ঘুরতে আসা এক নবদম্পতি জানান, বাসা থেকে কাছাকাছি হওয়ায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তাহের ছুটির দিনে প্রায়ই পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা হয়। এছাড়া পাশের গকুলনগরেই শ্বশুরবাড়ি, আর আমার শ্যালক এখানকার ছাত্র।
সম্প্রতি ধর্ষণের ঘটনায় বহিরাগত প্রবেশে প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে অবহিত করলে তিনি বলেন, প্রশাসনের এ সিদ্ধান্ত আমাদের সকলের মেনে চলা উচিত বলে মনে করি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী রবি ইসলাম প্রামাণিক বলেন, বহিরাগত প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়াতে বহিরাগতদের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষেই অনেক কমেছে। কিন্তু এর সাথে নিরাপত্তাজনিত অন্যান্য ব্যাপারগুলোতেও গুরুত্ব বাড়ানো উচিত। কারণ এটি কখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র সমস্যা ছিল না। এর পাশাপাশি আমাদের অন্য যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলোর উপর দৃষ্টিপাত করে আশু সুরাহা করা উচিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ওয়াজহাতুল ইসলাম বলেন, বিগত সময়ে বন্ধের দিনগুলোতে বহিরাগতদের কারণে ক্যাম্পাসে চলাফেরায় দায় হয়ে যেত। আজ ক্যাম্পাসে বের হয়েছি। অনেক দিন পর মনে হল ক্যাম্পাসটা তার স্বকীয়তা ফিরে পেয়েছে। বটতলায় যেখানে বন্ধের দিনগুলোতে মানুষের ভিড়ে যেতে পারতাম না আজকে সেখানেও বহিরাগতদের উপস্থিতি অনেকটাই নগণ্য বলা চলে। আশা করব প্রশাসন তাদের এ সিদ্ধান্তে অটল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার প্রধান সুদীপ্ত শাহীন বার্তা২৪.কমকে বলেন, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্যাম্পাসে কোনো বহিরাগত এবং অনিবন্ধিত অটোরিকশা চলাচল না করার ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত হয়। সেদিন থেকেই আমাদের সিকিউরিটি শাখার পুরো টিম নিয়ে মাঠে নেমেছি। সকলের সহযোগিতায় বহিরাগতদের প্রবেশ আমরা উল্লেখযোগ্য হারে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু সেনওয়ালিয়া, পুলিশ ফাঁড়িসহ কিছু জায়গায় পকেট গেইট আছে সেদিক দিয়ে দু-একজন আসতে পারে। আর সেখানে আমাদের নিরাপত্তা প্রহরীও থাকে না। তবে আমরা আশা করছি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলে নিজ নিজ জায়গায় সচেতন থেকে আমাদের সহযোগিতা করলে আমরা ক্যাম্পাসকে বহিরাগতমুক্ত রাখতে পারব, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রশাসনের নির্দেশনার সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটাতে পারব।
প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি) রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের সংলগ্ন জঙ্গলে বহিরাগত এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী/০৩) এর ৯(৩) ধারায় একটি মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী নারীর স্বামী। এই মামলার প্রেক্ষিতে মূল অভিযুক্তসহ ৬ জনকে আটক করেছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে তাদের রিমান্ড শেষে আদালতে পেশ করা হয়।