ভূমি দখল, অস্ত্র, হত্যা মামলা সবই হাওয়া

ঢাকা, জাতীয়

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-10 16:50:45

ভালুকা (ময়মনসিংহ) থেকে ফিরে: উত্তরা থেকে গ্রেফতার হন। তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক বাড়ি থেকে গ্রামের বাড়ি থেকে দু’টি পাইপগান উদ্ধার করে পুলিশ। সেই মামলায় নির্দোষ খালাস হয়ে যান বুঝেন তাহলে তার কেরামতির জোর!

তার নামে হত্যাসহ অনেক মামলা হয়েছে, বেশিরভাগই সাক্ষীর অভাবে ছাড়া পেয়েছেন। আর কিভাবে এই সাক্ষী ম্যানেজ করতে হয় ভালো জানা তার। প্রথমে টাকা সাধবে, কাজ না হলে হুমকি এতেই কেল্লাফতে। অস্ত্র মামলা থেকে ভূমি দখল ও হত্যা মামলা সবগুলো থেকেই মুক্তি পেয়েছেন।

লিখে কি হবে তার কিছুই করতে পারবেন না। তিনি বিএনপির নেতা হলেও প্রশাসন তার পকেটে। ২০০১ সালে ভালুকা থানায় শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় তার নাম উঠেছিলো। কিন্তু থানা পুলিশকে যদি তার কথা জিজ্ঞেস করেন, তারাও হয়তো তার পক্ষেই সাফাই গাইবেন। বলবেন, আগে খারাপ ছিলো এখন ভালো হয়ে গেছে।

বাস্তবতা কিন্তু এমন নয়। এখনও বনের জমি দখলের প্রসঙ্গ এলে তার নামেই ডাক পড়ে আগে। ২০১৮ সালেও বীকন গ্রুপের হয়ে বনের জমি দখল করেছেন। তার নিজের দখলেতো আছেই।

ভালুকার বিএনপি নেতা শহীদুল ইসলাম শহীদের (বাউন্ডারি শহীদ) সম্পর্কে গলা নিচু করে এমন খেদোক্তি প্রকাশ করেন তারই এক প্রতিবেশী। প্রথমেই বলেন, যদি নাম না প্রকাশ করেন তবে কিছু বলতে পারি। নাম প্রকাশ করলে দেখা যাবে আমি গায়েব হয়ে গেছি। না হলে এলাকা ছাড়া হতে হবে।

তার বিরুদ্ধে যারাই কথা বলেছেন, তাদেরকে হয় এলাকা ছাড়া হতে হয়েছে। আর সরকারি কর্মকর্তা হলে বদলি হতে হয়েছে। এক সময়ে বনের নার্সারিতে দিন হাজিরার ভিত্তিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো। এখন শত কোটি টাকার মালিক। গাড়ি-বাড়ি, বিত্ত-বৈভব সবই এখন তার হাতের মুঠোয়।

বন বিভাগের ভালুকা রেঞ্জ সংলগ্ন এলাকায় আলিশান বাড়ি তৈরি করেছেন। রয়েছে একাধিক খামার ও শিল্প কারখানা। সিডস্টোর বাজারের পূর্বদিকে ২০ বিঘা জমির ওপর রয়েছে সুপ্তি সোয়েটার ও সুপ্তি প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং, দক্ষিণ দিকে ১০ বিঘা জমির ওপর রয়েছে সুপ্তি ওয়েল লিমিটেড।

কোকাকোলার পশ্চিমে সাত বিঘা জমির ওপর রয়েছে তার হাজী এন্টারপ্রাইজ নামে আরসিসি পিলারের কারখানা। জনশ্রুতি আছে ঢাকাতেও তার রয়েছে একাধিক বাড়ি। হাঁকান কোটি টাকা দামের গাড়ি।

বন বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, আগে ছিলেন চুনোপুটি, নব্বই সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে সেই যে বনের জমি দখল শুরু করেছেন, তা এখনও চলছে। নিত্য-নতুন ফন্দিতে বনের জায়গা দখল করে চলেছেন তিনি। তার এক ডাকে কয়েকশ লোক লাঠি নিয়ে নেমে আসে রাস্তায়।

কিভাবে শহীদের উত্থান?
বিএনপি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টুর মাল্ট্রি মুড গ্রুপের নামে জমি দখলের মাধ্যমে বড় আকারে সামনে চলে আসেন। এরপর বাংলাদেশ-কোরিয়া যৌথ বিনিয়োগে দাইয়ু, ১৯৯৯ সালে স্কয়ার গ্রুপের স্কয়ার ফ্যাশন লিমিটেড।

এরপর যথাক্রমে বীকন ফার্মা, লাভেলো আইসক্রীম, ওরিয়ন গ্রুপ, বাদশা টেক্সটাইলসসহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের বাউন্ডারি নির্মাণে সামনে থেকে লিড দেন। যে সব জায়গা দখল করা হয়েছে তাতে বন বিভাগের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। প্রায় সবার বিরুদ্ধেই একাধিক মামলা ঝুলছে। তাদের কাজ কিন্তু থেমে নেই। বন বিভাগও মামলা দিয়ে দায় সেরেছে।

বনের জায়গা দখল করে বাউন্ডারি শহীদের বাড়ি

২০০১ সালে ভালুকা থানার শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় উঠেছিলো বাউন্ডারি শহীদের নাম। কিন্তু কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে সব কিছু। শহীদের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেছে। বনের জমি দখলের পেছনে প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি যুক্ত থাকলেও সংশ্লিষ্টরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে এড়িয়ে গেছেন।

কোনো মামলায় তার নাম ভুল, কোনো মামলায় তার পিতার নাম ভুল, আবার কোনো মামলায় তার ঠিকানা ভুল দেওয়া হয়েছে। কখনও জমির দাগ নম্বরে ভুল করে তাকে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক ঘটনায় তাকে খলনায়ক মনে করা হয়। কিন্তু তিনি থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

তার নামে প্রথম মামলা হয় ১৯৯৩-৯৪ সালে (১৯হবি/৪০ ভালু)। ওই সময়ে আরও গোটা তিনেক মামলা হয়। এরপর ধীরে ধীরে দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেন শহীদ। বদলে যেতে থাকে বনের লোকদের ভূমিকা। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিট অফিসার মুস্তাফিজুল হক (ফরেস্টার) নিজের পিঠ বাঁচাতে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করেন। সবগুলো মামলায় তার নামের ক্ষেত্রে নানান রকম ক্রটি রেখে দেন।

এসব মামলার মধ্যে ২২হবি/৩১ ভালু মামলায় শহীদুল ইসলামের বদলে কৌশলে এস. ইসলাম এবং পিতার নাম আলাউদ্দিনের বদলে আঃ উদ্দিন লেখা হয়। এরপর মামলা নম্বর ২৩হবি/৩২ ভালু একই ভুল করা হয়।

২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৮হবি/৮ভালু মামলায় শহীদের নাম ঠিক লিখলেও পিতার নাম অফিমুদ্দিন লেখা হয়। অনেক মামলায় নানা রকম ভুল করে তাকে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বন বিভাগ।

১৯৯৮ সালে কোরবানি ঈদের দিনে নিজের ঘরে খুন হন ভালুকার আকবর মেম্বার। সেই মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাউন্ডারি শহীদকে। ওই মামলায় বেশ কিছুদিন হাজত খাটতে হয় তাকে। পরে বিএনপি ক্ষমতায় এলে মামলা থেকে ছাড় পেয়ে যান। আরও কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের জন্য তাকে সন্দেহ করে ভালুকাবাসী।

তার সঙ্গে কথা বলার জন্য অনেকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি এসএমএস দিলেও সাড়া দেননি। বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান মামুন বার্তা২৪.কমকে বলেন, মামলাগুলো থেকে নির্দোষ হওয়া প্রমাণিত হয় তিনি এসবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা হয়েছিলো। আমার বাবা কখনই বনের জমি দখলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।

ময়মনসিংহ বন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বার্তা২৪.কমকে বলেন, বাউন্ডারি শহীদ ও যুবলীগ নেতা মুনীরকে ঠেকানো গেলে তবেই বনকে রক্ষা করা সম্ভব। না হলে মল্লিকবাড়ি বিটের মতো অন্যান বিটও হারিয়ে যাবে।

ময়মনসিংহ বন বিভাগের ভালুকা রেঞ্জ অফিসার মোজাম্মেল হক বার্তা২৪,কমকে বলেন, পুরোনো কাগজপত্র অনুযায়ী বাউন্ডারি শহীদ বন বিভাগের ৫টি স্পটে প্রায় ৮-১০ একর জমি দখলে রেখেছে। এর মধ্যে তার একটি বাড়িও রয়েছে।

স্থানীয়রা মনে করেন, তার সম্পদের হিসেব ধরে টান দিলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। না হলে ধুরন্ধর বাউন্ডারি শহীদকে আটকানো কঠিন হবে। বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য কেউ সাক্ষী দিতে আসবে না।

আরও পড়ুন

** ভালুকায় বনের মাটি কেটেই দখল হচ্ছে বনের জমি

** বন বিভাগের আতঙ্ক কে এই মনির!

** ১৫৯৯ একর জমির মালিক মল্লিকবাড়ি বন বিট নিজেই ভূমিহীন

** বনের জমি দখলের খেলার নাম ‘ডিমার্কেশন’

** কে এই বাউন্ডারি শহীদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর