কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১১)



জিনি লকারবি ।। অনুবাদ: আলম খোরশেদ
বার্তার নিজস্ব অলঙ্করণ

বার্তার নিজস্ব অলঙ্করণ

  • Font increase
  • Font Decrease

এখানে আপনাদের বেতারকেন্দ্র স্থাপন করা যাবে না

[পূর্ব প্রকাশের পর] আমাদের প্রথম দলের মিশনারিরা নিরাপদে দেশ ছেড়ে বেরিয়ে গেলে, আমরা বাকিদের জরুরি নির্গমন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে বসি, যদি তার প্রয়োজন পড়ে কখনো। আমাদের একাধিক সভার শেষে নিচের চারটি সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করা হয়।
• যারা যেতে চায় তাদেরকে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়া হবে, এই প্রত্যাশায় যে, সামনের দিনগুলোতে সমুদ্র কিংবা আকাশপথে দেশত্যাগের আরো কোনো সুযোগ আসবে।
• একটা ট্রাক ভাড়া করা হবে নব্বই মাইল দূরে পাকিস্তান-বার্মার সীমান্ত শহর টেকনাফে যাওয়ার জন্য। সেখান থেকে আমরা নৌকায় নাফ নদী অতিক্রম করে বাসে চড়ে আকিয়াব যাব।
• যদি সড়কপথে চলাচল একবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে, তাহলে আমরা হাসপাতাল থেকেই সরাসরি নৌকা করে আকিয়াব রওনা হব।
• নৌকা বা সাম্পানে করে আমরা চট্টগ্রাম বা আশেপাশে অপেক্ষমাণ কোনো উদ্ধারকারী জাহাজে গিয়ে উঠব।

প্রত্যেকটি পরিকল্পনারই সীমাবদ্ধতা ছিল। আমরা শত হলেও বাইশজন প্রাপ্তবয়স্ক ও পঁচিশটি বাচ্চা নিয়ে কাজ করছি। ট্রাকযাত্রার ব্যাপারটা মোটামুটি বিবেচনা করা গেলেও, এই পঁচিশটি বাচ্চাকে সাম্পানের অমসৃণ তলদেশে গাদাগাদি করে বসিয়ে পাঁচদিনের সমুদ্রযাত্রার ভাবনাটি দুঃস্বপ্নের মতোই ছিল, যদি তা কেউ কল্পনা করতে চান আদৌ।

বিভিন্ন সম্ভাব্য পরিকল্পনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করার জন্য আমরা একটি কমিটি গঠন করি। আমরা এর নাম দিই ‘আতঙ্ক কমিটি’। তারা ব্যাগ, জলপাত্র, টিনের খাদ্য, বাসনপত্র ইত্যাদি যোগাড়ে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেয়। সাত বছর আগে, আমাদের হাসপাতাল নির্মাণের সময় এর কন্ট্রাক্টরদ্বয়, পল গুড্‌ম্যান ও টম ম্যাক্‌ডোনাল্ড, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুই যোদ্ধা, সামরিক কে-রেশনের শুকনো খাদ্যের টিন এনেছিল কিছু। এগুলোকেও আমাদের জরুরি রসদের তালিকায় যোগ করা হয়।

আমাদের পুরো দলটাকে তিনভাগে ভাগ করে প্রতি দলে সমানভাবে ছোটবাচ্চা, বড় বাচ্চা, স্বাস্থ্যকর্মী, নতুন ও পুরনো মিশনারিদের বণ্টন করে দেওয়া হয়। দলগুলোকে লাল, নীল আর হলুদ রঙের রিবন দিয়ে আলাদা করা হয়। (হলুদ দল অভিযোগ করে যে, দলগঠনের আগেই নাকি তাদের বিরুদ্ধে একটা আঘাত আসে।)

আমাদের নিজেদের প্রস্তুতির ব্যাপারে আমরা আমাদের দেশি কর্মীবৃন্দ ও চট্টগ্রামের শরণার্থীদেরকেও একটা সুচিন্তিত পলায়ন-পরিকল্পনা ভেবে রাখতে বলি। তারা ভুলভাবে বিশ্বাস করেছিল যে, যতক্ষণ আমরা আছি ততক্ষণ তাদের কোনো বিপদ হবে না।

“তা আপনারা কী করবেন যদি মিলিটারি এসে আপনাদেরকে গুলি করা শুরু করে?” আমরা জিজ্ঞাসা করি।

“আমরা দৌড়ে আপনাদের বাসায় চলে আসব,” তারা সরলভাবে জবাব দেয়।

গুড ফ্রাইডের রাত তিনটার দিকে, লিন ও বেকি তাদের বাসার পাশ দিয়ে একটা গাড়ি যাওয়ার শব্দে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। তারা খুব সাবধানে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আবাসিক এলাকায় ঘুরতে থাকা গাড়ির শব্দটাকে অনুসরণ করতে চেষ্টা করে। কয়েক মিনিটের মধ্যে জে ওয়াল্শ তাঁর সাইকেলে চেপে আসেন, বন্দুকহাতে। রাতের বাতাস তাঁর কণ্ঠকে দূরে দাঁড়ানো মেয়ে দুজনের কাছে বয়ে নিয়ে আসে।

“এটা হাসপাতাল; আর আমরা ডাক্তার,” তিনি বলছিলেন।

পরদিন সকালে এই রহস্যের সমাধান হয়। গাড়িতে ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা, যারা আসলে হসপাতাল অঙ্গনে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের নতুন অফিস স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখেছেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নার্সদের আবাসন ভবনটাই হচ্ছে সবচেয়ে অবাধ স্থাপনা। তাঁরা এর একটি অংশ নিয়ে নেবেন, এই বলে ধন্যবাদও জ্ঞাপন করেন।

চারজন মিশনারি পুরুষ আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদেরকে এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাঁরা অটল। জে নিশ্চিত ছিলেন যে, তাঁরা আবার ফিরে আসবে, তাই আমরা এই সমস্যাটা নিয়ে আলাপ করছিলাম। আমরা সবাই অনুভব করছিলাম, তাঁদেরকে জোর গলায় বলে দিতে হবে, এই হাসপাতালের মাঝখানে তাঁরা রেডিও স্টেশন বসাতে পারেন না, যদি না তাঁরা সেটা গায়ের জোরে করতে চান। আমরা একটা আপোস প্রস্তাব দিই যে, তাঁদেরকে আমরা একটা ছোট্ট, বহনযোগ্য জেনারেটর দেব, যেটাকে তাঁরা গাড়ির মধ্যে বসিয়ে জঙ্গলের ভেতর থেকেই তাঁদের গোপন বেতারকেন্দ্র পরিচালনা করতে পারবেন।

জে ঠিকই ভেবেছিলেন। তাঁরা ফেরত আসেন আবার। প্রথমে একবার সন্ধ্যা নাগাদ আসেন একজন বন্দী ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারকে সঙ্গে নিয়ে। তাঁরা এসে আমাদেরকে তাদের অনুকূলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলে চলে যান। রাত সাড়ে নয়টায় তাঁরা আবার আসেন। ডা. ওল্সেন এবং জে ওয়াল্শ যখন তাঁদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, আমরা তখন প্রার্থনা করছিলাম ও প্রার্থনাসংগীত গাইছিলাম। ঈশ্বর কি প্রার্থনার জবাব দেন? জে এবং ভিক ওল্সেন চকচকে মুখে ফেরত আসেন। তাঁরা হাসপাতালকে তাঁদের বেতারকেন্দ্র বানানোর ভাবনা থেকে সরে এসেছেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, এখান থেকে রেডিও’র বেতার-তরঙ্গ শনাক্ত করা সহজ হবে এবং পাকিস্তানিরা তখন বোমা মেরে তা উড়িয়ে দেবে। বেতারেকেন্দ্র প্রকল্প বিষয়ে সেবারই শেষ শুনি আমরা তাঁদের কাছ থেকে।

ইস্টার সানডে ১৯৭১

দিনটা শুরু হয় সকাল ছয়টার প্রার্থনা দিয়ে। দিনভর ক্লাস ও প্রার্থনাসভার ভেতর দিয়ে খ্রিস্টবিশ্বাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিককে আমরা স্মরণ করছিলাম। বিকেলে মেয়েদের বাইবেল ক্লাসের পরে এক গাড়ি আওয়ামী লীগের নেতা হাসপাতালে এসে হাজির হন। গাড়ি থেকে নেমেই তাঁরা তাঁদের কাহিনী শুরু করেন। ক্যাপ্টেন হারুন, মুক্তিবাহিনীর একজন উঁচু অফিসার চিটাগাংয়ের উপকণ্ঠে কালুরঘাট সেতুর কাছে যুদ্ধে ভীষণভাবে আহত হয়েছেন। তাঁরা তাঁকে পটিয়ায় তাঁদের ফিল্ড হাসপাতালে নিয়ে যান, যেখানে ডাক্তাররা তাঁর পেটে অপারেশন করেছে। অজ্ঞান না করে স্রেফ একটি ডেমেরল দিয়েই অপারেশন করে তাঁরা তাঁর পেটের দুই ফুটের মতো বুলেটজর্জর অন্ত্র বার করে ফেলে দেন। তারপর তাঁরা ঘোষণা দেন, “অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে তিনি এখন খুবই দুর্বল।”

সঙ্গে সঙ্গে ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান বব আডল্‌ফ গাড়িতে-বসা একজনের শরীর থেকে কিছু রক্ত নিয়ে তাঁদেরকে দিলে তাঁরা তা নিয়ে দ্রুতবেগে যেপথে এসেছিলেন সেপথে ফিরে যান। ডা. ডন কেচাম তাঁদেরকে বলে দেন, ক্যাপ্টেনকে সেই সাময়িক আশ্রয় থেকে বার করে এনে এই হাসপাতালে নিয়ে আসতে। কয়েকদিন পরে তাঁরা সেই অসম্ভব দুর্বল রোগীটিকে আমাদের কাছে নিয়ে আসেন। তাঁর শরীরে আবারও মেরামতি অপারেশন করা হয়, এবং তিনি চট্টগাম থেকে আসা একজন ব্যাংক ম্যানেজার হিসাবে সেরে উঠতে থাকেন। তাঁর সন্ধানে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাদের আমাদের হাসপাতালে আগমনের আগেই ডা. কেচাম তাঁকে নিরাপদে অন্যত্র সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সেই দিনগুলোতে আমি ও লিন আমাদের চট্টগ্রামের শরণার্থীদের জন্য একধরনের বিশেষ দায়িত্ব বোধ করছিলাম। আমরা মিশনারিদের বাগান তন্ন তন্ন করে, শাকটা, শিমটা কুড়িয়ে আনছিলাম তাদের জন্য। (আপনারা কি জানতেন যে পুরনো, তেতো লেটুস পাতার রান্নাও বেশ স্বাদের হয়?) আমরা প্রত্যেকদিন সকালে এইসব শাকসব্জি বহন করে ওদের বাড়ি যেতাম এবং সবাইকে সেসব ভাগ করে দিতাম। আমরা বাচ্চাদের ব্যাপারেও খেয়াল রাখছিলাম। এতখানি খোলা মাঠ দৌড়ঝাঁপ করার জন্য! আর সেইসব সাইকেল! এটা শহরের বাচ্চাদের জন্য অনেক বড় লোভনীয় বিষয়, বিশেষ করে যারা অস্থির সময়টায় পুরোপুরি ঘরবন্দী ছিল।

সেখানে অধিকাংশ সময়ই লিন মিশনারিদের ভাষা শেখানোর এবং হাসপাতালে কাজ করছিল। আমার কাজ ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর বাচ্চাদের পড়ানো, যারা তাদের শিক্ষকদের ও আমাদের বার্ষিক শিশুশিবিরের জন্য সংগৃহীত লেখার সরঞ্জামাদি হারিয়ে ফেলেছিল।

আমরা সময় কাটানোর জন্য সবাই মিলে ডায়রিও লিখছিলাম, যদি কখনো কিছু মনে করতে হয়, কিংবা কাউকে এই দিনগুলোর গল্প করতে হয়, একথা ভেবে। এই রইল ডায়রির কয়েকটি পাতা।

শুক্রবার, এপ্রিল ১৬, দুপুর ২.২০

সবাই দিবানিদ্রা উপভোগ করছিলেন, এমন সময় শোর উঠল, “মিলিটারি এসেছে।” হাসপাতালের ভেতরে অবস্থানরত পরিবারসমূহ, ঘরের কাজের লোকেরা, এবং অন্যান্যরা তাড়াতাড়ি যার যার ঘরে ঢুকে যেতে শুরু করে। আমরা জানতে পারি যে, পটিয়া ও আমিরাবাদে (মালুমঘাট থেকে যথাক্রমে ৪৫ ও ২৫ মাইল দূরে) বোমা পড়েছে। তখন পর্যন্ত অবশ্য রাস্তা দিয়ে কোনো সৈন্য আসেনি।

মালুমঘাটে বোমা বর্ষণ করলে কী করব সে-নিয়ে কথা বলার জন্য মিলিত হই আমরা। সিদ্ধান্ত হয়: জঙ্গলের দিকে চলে যেতে হবে এবং সেখানে তখনও বিদ্যমান দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন ট্রেঞ্চগুলোতে ঢুকে পড়তে হবে। মলি বিল্সকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ট্রেঞ্চগুলোকে খুঁজে বার করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখার। লিন আর আমার দায়িত্ব ছিল নার্সদের হোস্টেলের ছাদ থেকে প্লেন আসছে কিনা সেটা দেখা। কোনো প্লেন দেখা যাওয়ামাত্র সেখানকার বিশাল ঘণ্টাটি বাজিয়ে দিতে হবে।

আমরা রাতের খাবার শেষ করামাত্র রিড মিনিখ তিনজন আমেরিকানকে নিয়ে হাজির হন।

রাত সোয়া আটটায় আরেকটা সভা বসে।

সেই তিনজন হলেন: যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং ঢাকা থেকে আসা ইউ এস এইডের দুজন প্রতিনিধি। চারজনই চট্টগাম থেকে এসেছেন গুর্‌গানসের স্টেশন ওয়াগনে করে, আমাদের দুটো বিশাল আমেরিকান পতাকা লাগিয়ে।

তাঁরা এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে বেসামরিক নাগরিকদের জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে কড়া সাবধানবাণীটি জানাতে, যেন আমরা অবশ্যই দেশত্যাগ করি। তারা বলেন, এর আগের দিন সন্ধ্যায় ভয়েস অভ আমেরিকায় নাকি বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম জেলায় অবস্থানরত আমেরিকানদের বার্মার ভেতর দিয়ে দেশ ছাড়তে। আমরা কেউই অবশ্য সেই ঘোষণা শুনিনি। (আমরা একটা মিটিংয়ে ছিলাম।)

আমরা তাঁদেরকে অনেক প্রশ্ন করি। তাঁদের অধিকাংশ তথ্যই আশাব্যঞ্জক ছিল। তাঁরাও মনে করেন না যে, আমরা সত্যিকার যুদ্ধের ডামাডোলে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছি, যদি না অওয়ামী লীগের নেতারা হাসপাতাল দখল করে প্রতিরোধ শুরু করেন। তাঁরা এও ভাবেন, আমরা যতদিন এখানে আছি ততদিন দেশি নাগরিকেরাও নিরাপদ। শুধু হিন্দুরাই সত্যিকারের বিপদের মধ্যে ছিল। তাঁরা আমাদের ওপরই চরম সিদ্ধান্ত নেবার ভার দিয়ে যান, কারা থাকবে আর কারা চলে যাবে সেটা ঠিক করতে। পরদিন সকাল দশটার মধ্যে তাঁদের চট্টগ্রাম ফিরে যাবার কথা। তাঁরা চাচ্ছিলেন মিলিটারির সঙ্গে দেখা করে তাদেরকে দুদিনের জন্য বোমা ও গুলি বর্ষণ থেকে বিরত রাখতে, যাতে করে আমরা নিরাপদে এই পথটুকু পেরিয়ে যেতে পারি। পরিকল্পনাটা ছিল, আমেরিকান গাড়ির একটা বাহিনী আমাদেরকে নিয়ে চট্টগাম যাবে এবং সেখান থেকে আমরা একটা বড় বিমানে করে ঢাকায় চলে যাব।

দেশত্যাগের বিষয়ে আলোচনা শেষ হওয়ার পর সবাই প্রার্থনা, ও যার যার মতো বোঝাপড়া করতে চলে গেলে আমি ও লিন রিডকে বলি, শহরত্যাগের পর সেখানে কী কী ঘটেছে আমাদেরকে তা জানাতে? তিনি যে-বর্ণনা দিয়েছিলেন তা মোটেও আশাজাগানিয়া ছিল না। [চলবে]


কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১০)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৯)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৮)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৭)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৬)

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;