কমিউটার ট্রেন যেন 'গরুর গোয়াল'
গফরগাঁও থেকে ফিরে: শুক্রবার ভোর ৪টায় কমলাপুর রেল স্টেশনে লাইনে দাঁড়িয়ে এক ঘণ্টা ২০ মিনিট পর টিকিট পেলেন আব্দুর রাজ্জাক। ঢাকার একটি কওমি মাদরাসার এই শিক্ষকের গন্তব্য গফরগাঁও। গফরগাঁওয়ের সিট পাওয়া যায় না বলে ৪০ টাকা দিয়ে তার আগের স্টেশন মশাখালীর টিকিট কেটেছেন।
এক ঘণ্টা ২০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর টিকিট হাতে পেয়ে একটু হাসি দিয়ে বলেন, 'ভাগ্য ভালো, আজ একটি টিকিট কেটে সিট পেলাম (অন্যদিন তিনটি টিকিট কাটলে বসার সিট পাওয়া যায় একটি) একটু আরামে যেতে পারব।'
তিনি ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে জামালপুর দেওয়ানগঞ্জগামী কমিউটারের যাত্রী। ট্রেনটি প্রতিদিন ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে কমলাপুর থেকে দেয়াগনঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
'ঙ-৪২' নম্বর টিকিট হাতে নিয়ে বগিতে উঠতেই 'থ' হয়ে গেলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে হাসি মুখখানা মলিন হয়ে গেল। কারণ ট্রেনের পুরো বগিটাই ধান ক্ষেত্রের মতো কাদাযুক্ত, কাগজ-পলিথিনসহ বিভিন্ন ধরনের ময়লায় ভরপুর।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর দুয়েকজনের দিকে তাকিয়ে অন্যদের মতোই নিজের ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে সিটের উপরের পানি ও ময়লা পরিষ্কার করলেন। তারপর ফ্যান ছেড়ে শুকানোর পর বসলেন। মনের মধ্যে থাকা ক্ষোভ কমানোর জন্য বললেন, 'কী আর করা, মালিকানাধীন ট্রেন'।
একইভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে ট্রেনটির 'ঙ' বগির ৪১তম সিটে বসে দেখা গেছে, বর্ষার দিনে গোয়াল ঘরে গরু যেমন হাঁটতে হাঁটতে কাদা বানিয়ে ফেলে। কমিউটারের ভেতরের অবস্থাও ঠিক তেমনই। বসার সিটের উপর-নিচে ময়লাযুক্ত পানি, আর কাদা। বসার কোনো সুযোগ নেই। ঠিক যেনো গরু রাখার গোয়াল।
৩২ নম্বর সিটের যাত্রী সুমাইয়া আক্তার হেপিতো চিৎকার চেচামেচি করে বলছেন, 'এটা ট্রেন না গোয়াল ঘর। গরুর গোয়াল ঘরও এর চেয়ে ভালো'।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'একেতো অন্ধকার, বেশি কিছু দেখা যায় না। তারপরও সিটে ময়লা পানি, নিচে ময়লা আবর্জনাগুলো যুক্ত হয়ে কাদার সৃষ্টি হয়েছে। হাঁটা চলা যাচ্ছে না।'
বগিটির দায়িত্বে থাকা টিটি (ট্রেনের ভেতরে টিকিট চেক করেন যিনি) দেবাশীষকে সিটগুলো পরিষ্কার করে দিতে বললে তিনি বলেন, 'এটা আমার দায়িত্ব নয়'। তাহলে একটি ন্যাকড়া দেন আমরাই মুছে নেই। তার উত্তরে তিনি বলেন, 'এগুলো আমাদের কাছে নেই'।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-এর পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, 'এটা আমার দায়িত্ব না, গতকাল যে ডিউটি করেছেন তিনি যাওয়ার সময় দরজা জানালাগুলো বন্ধ করে যায়নি। তাই ট্রেনের ভেতরের অবস্থা খারাপ। আমরাইতো চিন্তা করছি এই বগিতে ডিউটি কেমনে করুম।'
ট্রেনটির ছ, ঝ, ঞ, ট,ঠ বগিতে গিয়েও একই দৃশ্য দেখা গেছে।
কমলাপুরে যাত্রীদের উপস্থিতি কম থাকলেও, তেজগাঁও বিমানবন্দর স্টেশনে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিটগুলো ফিল-আপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পাশাপাশি বানরের মতোই ঝুলতে শুরু করে। টঙ্গী স্টেশনে যাওয়ার পর ঈদের মতোই আর তিল ধারণের ঠাঁই নেই। তারপরেও হকারদের আশা যাওয়া, ট্রেনের কাদাতে যাত্রীদের কাপড়গুলো নষ্ট হতে দেখা গেছে। এর পাশাপাশি প্রতিটি স্টেশনে বিলম্ব করা যেন নিয়ম।
আর এসব যন্ত্রণা সইতে না পেরে আব্দুর রাজ্জাক শ্রীপুর স্টেশনে যাওয়ার পর ট্রেন থেকেই নেমে গেলেন। তার মতোই কাওরাইদ ও মশাখালী এবং গফরগাঁওয়ের অনেক যাত্রী ট্রেন থেকে নেমে চেলে গেছেন। তারা বাস, অটোরিকশা করে নিজের গন্তব্যে পৌঁছেছেন হয়তো।
শুক্রবারের মতোই শনিবারও কমিউটার ট্রেনের একই অবস্থা ছিল বলে বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে জানিয়েছেন যাত্রীরা। টিটিরাও স্বীকার করেছেন।