বাংলাদেশে আঘাত হানা প্রলয়ংকারী যত ঘূর্ণিঝড়
ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’। এটি ভারতের ওড়িশা, কলকাতা হয়ে বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে। তবে বাংলাদেশে আসতে আসতে এর শক্তি ক্রমশই কমে যাচ্ছে।
ফণীর মত বহু ঘূর্ণিঝড় ইতিহাসের বহু সময় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে। আবহাওয়া বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ৬০ বছরে ছোট বড় অন্তত ৩৩টি ঘূর্ণিঝড় এদেশে আঘাত হেনেছে।
২০০৪ সালের আগে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো নাম ছিল না। তখন তাদের বলা হতো ‘স্যাভেয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম’। এসব ঘূর্ণিঝড় যেসব স্থানে আঘাত হানতো সে স্থানের নামানুসারে পরবর্তীতে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হতো।
প্রলয়ংকারী এমন কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ের সময়কাল ও ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ তুলে ধরা হলো:
১৯৬০ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়:
১৯৬০ সালের ৩০-৩১ অক্টোবর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, পটুয়াখালী এবং মেঘনা মোহনার পূর্ব পাড়ে আঘাত হানে ঘুর্ণিঝড়টি। এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৯৩ কিলোমিটার। এর প্রভাবে ৪.৫-৬.১ মিটার জলোচ্ছাস হয়। প্রায় ১০ হাজার মানুষ, ২৭ হাজার ৭৯৩ গবাদি পশু, পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার ১৬১ বাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এর শতকরা ৭০ ভাগই হাতিয়ায়। দুইটা বড় সমুদ্রগামী জাহাজ তীরের উপরে উঠে আসে।
১৯৬৩ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়:
১৯৬৩ সালের ২৮-২৯ মে তীব্র ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত করে দেয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার এবং সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া এবং মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২০৩ কিলোমিটার। এ অঞ্চলের ১১ হাজার ৫২০ অধিবাসী, ৩২ হাজার ৬১৭ গবাদিপশু ও তিন লাখ ছয় হাজার ৩৩২টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৯৬৫ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়:
১৯৬৫ সালের ১৪-১৫ ডিসেম্বর তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে কক্সবাজার ও পটুয়াখালীর নিকটবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার। ঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানির উচ্চতা ৪.৭-৬.১ মিটার বৃদ্ধি পায়। ৮৭৩ জন অধিবাসী মারা যায় ও ৪০ হাজার লবণ খামার নষ্ট হয়।
১৯৭০ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় বা ভোলা ঘূর্ণিঝড়:
১৯৭০ সালের ৭-১৩ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ইতিহাসে ভোলা ঘূর্ণিঝড় নামে পরিচিত। চটগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, চর বোরহানুদ্দিনের উত্তর পাশ, চর তাজুমুদ্দিন এবং মাইজদি ও হরিণঘাটার দক্ষিণ পাশ সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৪ কিলোমিটার। সরকারি হিসাব অনুসারে মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচ লাখ বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা ছিল আরও বেশি। ১০ লাখ গবাদিপশু মারা যায়। চার লাখ বাড়িঘর এবং তিন হাজার ৫০০ শিক্ষাকেন্দ্র বিধ্বস্ত হয়।
১৯৯১ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়:
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল শেষ রাতের দিকে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়টি। এর ব্যাস ছিল প্রায় ৬০০ কিলোমিটার। আর বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার। ঝড়ের প্রভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের উত্তর উপকূলে ভূমিধ্বস হয়। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ৫-৮ মিটারে পৌঁছায়। প্রায় দেড় লাখ লোক ও ৭০ হাজার গবাদি পশু মারা যায়। ঘূর্ণিঝড়টিতে সম্পদের ক্ষতি হয় প্রায় ৬০ বিলিয়ন টাকা।
১৯৯৪ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়:
১৯৯৪ সালের ঘূর্ণিঝড়টি ২৯ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তীব্র ঘূর্ণিঝড়টি কক্সবাজারের নিকটবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার। ৪০০ লোক ও আট হাজার গবাদি পশু মারা যায়।
১৯৯৭ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়:
১৯৯৭ সালের ১৯ মে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী এবং ভোলার নিকটবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহে আঘাত হানে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার। ১২৬ জন লোক মারা যায়।
ঘূর্ণিঝড় সিডর:
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর ঘণ্টায় ২২৩ কিলোমিটার বেগে বাংলাদেশের খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে। এলাকায় ১৫-২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাস হয়। রেডক্রসের হিসাবে ১০ হাজার লোক মারা গেছে বলা হলেও সরকারিভাবে ছয় হাজার লোক মারা যাওয়ার কথা বলা হয়।
ঘূর্ণিঝড় আইলা:
২০০৯ সালের ২৯ মে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আইলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগের ১৫ জেলার উপর দিয়ে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যায়। প্রায় ১৫০ জন অধিবাসী মারা যায়, ২ লাখ বসতবাড়ি ও ৩ লাখ একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়।
এছাড়া বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড় বিজলি, ভিয়ারু, রোয়ানু, ডিয়ামু আঘাত হানে। তবে এসবের তীব্রতা কম থাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়।