পান বেচে সংসার চালান মুক্তিযোদ্ধা লতিফ
বটতলায় পান বিক্রি করে সংসার চলে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফের। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। কোনো সম্পত্তি নেই, থাকেন ভাইয়ের বাড়িতে। অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে দিনযাপন করলেও কারো কাছে মাথানত করেননি এই বীর যোদ্ধা।
হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার চৌমুহনী ইউনিয়নের আলাবক্সপুর গ্রামের মৃত আলতাম উদ্দিনের ছেলে আব্দুল লতিফ (৬৬)। দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন শ্বাসকষ্ট রোগে। আব্দুল লতিফের গেজেট নং (১৩০৭), মুক্তি বার্তা লাল বই ০৫০৩২০১৫৬।
১৯৭১ সালে ছিলেন ২০ বছরের তরুণ। রণাঙ্গনে পাকবাহিনীর গুলিতে পায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়ে গেছে এখনও। কিন্তু যুদ্ধাহত ভাতা জুটেনি এখনো পর্যন্ত। কিন্তু দেশকে নিয়ে এখনো স্বপ্ন দেখেন তিনি।
৭১’র কথা মনে করতে গিয়ে লতিফ জানান, ১৪ আশ্বিন ধর্মঘর যুদ্ধটি ছিল ভয়াবহ। ভারতের মিত্র বাহিনী আর মুক্তিযোদ্ধারা মিলে পাক বাহিনীকে নাস্তানুবাদ করে দিয়েছিল। পাকবাহিনীর টেলিফোন লাইন আগেই কেটে দেওয়া হয়েছিল। রাত আড়াইটায় তাঁরা ঝাঁপিয়ে পরে পাকবাহিনীর ওপর। রাতভর চলা যুদ্ধ ভোরে শেষ হয়। বৃষ্টির মত গুলি আসছিল। এই যুদ্ধে তাঁর পায়ে গুলি লাগে। পরে আহত অবস্থায় ভারতের জিবি হাসপাতালে নিয়ে পায়ের চিকিৎসা করান সহযোদ্ধারা।
যুদ্ধের স্মৃতিচারণায় গিয়ে দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। হাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তিনি জানান, যুদ্ধ শুরু হলে ভাতিজা ফরিদ হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান ভারতের শনিতলায়। সেখানে স্বাক্ষাৎ পান তৎকালীন সংসদ সদস্য মাওলানা আসাদ আলীর। দেশের হয়ে যুদ্ধ করবেন শুনে আসাদ আলী তাঁদের পরিচয়পত্র দেন।
তখন তারা চাচা-ভাতিজা ৩নং সেক্টরে যান। সেক্টর কমান্ডার কেএম শফিউল্লাহ তাদের ভর্তি করে নিলেন মুক্তি বাহিনীতে। তারপর তাঁদের আবার পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের লেবুছড়া নামক স্থানে। সেখানে ২১ দিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তাঁরা। রাইফেল, গ্রেনেড, এলএমজি, এসএলআরসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা আবার দেশে ফিরে ৩নং সেক্টরে যোগ দেন।
আখাউড়া থেকে তেলিয়াপাড়া পর্যন্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন লতিফ। যুদ্ধ শেষে বাড়িতে এসে দেখেন কিছুই নেই। অনেকে স্থানীয় স্কুলে আশ্রয় নেন। তিনিও সেখানে আশ্রয় নেন। পরে তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে একটি ঘর নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। এখন পর্যন্ত তিনি সেখানেই আছেন।
মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিয়ে তাঁর সংসার চলে না। ছেলে আমির হামজা সুমন চৌমুহনী খুর্শিদ স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। মেয়ে নাদিরা খাতুন একই স্কুলে একাদশ শ্রেণিতে পড়াশুনা করে। ছোট ছেলে আলি আমজাদ নয়ন ৯ম শ্রেণির ছাত্র।
পান বিক্রি করে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে প্রতিদিনের বাজার খরচ চলে। আর ভাতার টাকা চলে যায় নিজের ঔষধ, ছেলে মেয়েদের লেখাপড়াসহ অন্যান্য কাজে।
লতিফের স্ত্রী জায়েদা খাতুন বলেন, ‘সরকার তো অনেককে অনেক কিছু দিচ্ছে শুনি। আমরা তো ছেলে মেয়ে নিয়ে খুব অসহায়। অন্যের জায়গায় বসবাস করি, নিজের কোনো জমিজমা নাই।’
স্থানীয় আরেক মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর নূর বলেন, ‘লতিফ আমার সহযোদ্ধা। সে খুব অসহায় ও অসুস্থ। তার নিজস্ব ঘর বাড়ি নাই। এই বটতলায় পান বিক্রয় কোনো রকম ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করাচ্ছে।’
২নং চৌমুহনী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আপন মিয়া বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সূর্য সন্তান। সরকারের কাছে যুদ্ধাহত অসহায় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ভাতা ও ঘরবাড়ি নির্মাণ করে পুনর্বাসনের দাবি জানাচ্ছি।’
মাধবপুর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার আব্দুল মালেক বলেন, ‘আব্দুল লতিফ অসুস্থ ও ভূমিহীন অসহায়। যাদের বাড়িঘর নেই তাদের তালিকা করে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আশা করি তাঁর ঘরের ব্যবস্থা হবে।’