জনগণ নির্বাচনের জন্য গণঅভ্যূত্থান করেনি দাবি করে কবি, চিন্তাবিদ ও গবেষক ফরহাদ মজহার বলেছেন, জনগণের অভ্যুত্থান ছিল রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রের জন্য। বর্তমান অন্তবর্তী সরকারকে এজন্য জনগণের কাছে যেতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সরকার কোনো অধ্যাদেশ জারি করে আজ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারেনি যে তারা বৈধ সরকার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দুই মাসেও জনগণের কোনো অভিপ্রায়ই বাস্তবায়িত হয়নি বলেও মনে করেন তিনি।
দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপিকে বাদ দিয়ে যেমন কিছু করতে পারবেন না, তেমনি শেষাবধি আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়েও কিছু করতে পারবেন না৷
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের গেল দুই মাসের পরিস্থিতি সম্পর্কে দৈনিক ইত্তেফাক ও কালের কণ্ঠকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন ফরহাদ মজহার। বার্তা২৪.কম এর পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকার দু’টির কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে প্রকাশ করা হল:
আজ ৫ অক্টোবর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দুই মাস পূর্ণ হলো। এই দুই মাসে জনগণের অভিপ্রায় কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
ফরহাদ মজহার : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দুই মাসেও জনগণের কোনো অভিপ্রায়ই বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা এখন পর্যন্ত নতুন করে গঠন করার কোনো প্রক্রিয়াই দেখছি না। উল্টো শেখ হাসিনার তথাকথিত সংবিধানের মধ্যে এই সরকার শপথ নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের ইতিবাচক যত সম্ভাবনা ছিল, তা শুরুতেই নস্যাৎ করে দিয়েছে। প্রথমত, এই সংবিধানের মধ্যে এ রকম কোনো সরকারের বৈধতা নেই। দ্বিতীয়ত, এই সরকার কোনো অধ্যাদেশ জারি করে আজ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারেনি যে তারা বৈধ সরকার।
আপনি সংবিধান পরিবর্তনের আলোচনা করছেন। অনেকেই আবার সংবিধান সংস্কারের কথা বলছে। সংবিধান সংস্কার নাকি পরিবর্তন, কোনটি প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
ফরহাদ মজহার : আপনার একটা ভাঙা ঘর থাকলে আপনি সেটা সংস্কার করবেন। কিন্তু আপনার তো ঘরই নেই, কিসের সংস্কার করবেন? ১৯৭২ সালে ছিল পাকিস্তানের সংবিধান। যারা সে সময় সংবিধান প্রণয়ন করেছেন, তাঁরা পাকিস্তানি সংবিধান প্রণয়নের জন্য নির্বাচিত ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তো আমরা তাঁদের নির্বাচিত করিনি। সে জন্য ১৯৭২ সালের সংবিধান কোনোভাবেই বাংলাদেশের সংবিধান হতে পারে না। এ ছাড়া ’৭২ সালের সংবিধান কাটাছেঁড়া করতে করতে শেখ হাসিনার ষোড়শ সংশোধনীর পর এটা একটা ছেঁড়া তেনা হয়ে গেছে। এটাকে কিভাবে সংস্কার করবেন? এই সরকারের উচিত ছিল নতুন করে গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দেওয়া। এ জন্য সরকারকে জনগণের কাছে যেতে হবে।
এই সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েও কি এই সরকার সংবিধান পুরোপুরি পরিবর্তন করে নতুন সংবিধান তৈরি করতে পারবে?
ফরহাদ মজহার : হ্যাঁ, পারবে। তারা বলবে যে, আমরা যখন এসেছিলাম তখন বাংলাদেশের একটা রাজনৈতিক সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। তখন মনে হয়েছিল আমাদের সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এই সাংবিধানিক সংস্কার করার জন্য আমরা সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছি। পরে আমরা বিবেচনা করে দেখেছি, এটা সঠিক পথ নয়। এর ফলে আমরা নিজেদের অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছি। এখন থেকে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে একটা নতুন গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের জনগণকে উপহার দেওয়া। এটা এখনই করতে হবে।
আপনি নতুন গঠনতন্ত্রের প্রক্রিয়ায় যেতে বলছেন। এই প্রক্রিয়ায় যেতে সরকারকে কী ভূমিকা পালন করতে হবে?
ফরহাদ মজহার : নতুন গঠনতন্ত্রের প্রক্রিয়ায় যেতে সরকারকে জনগণের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এটার কোনো বিকল্প নেই। জনগণের সঙ্গে কথা বললে তারা সঠিক কথাটা বলবে। জনগণের অনেক ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। চিন্তার মধ্যে অনেক ঘাটতি থাকতে পারে। কিন্তু জনগণের সঙ্গে কথা বলা শুরু করতে হবে। তখন এই চিন্তার ঘাটতি দূর হয়ে যাবে। জনগণকে বাদ দিয়ে কখনোই কোনো গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হতে পারে না।
বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আলোচনা করছে। তারা দ্রুত নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সরকারকে যেতে বলছে। আপনি কি এর সঙ্গে একমত?
ফরহাদ মজহার : আমি মনে করি না বাংলাদেশের জনগণ আরেকটি নির্বাচনের জন্য গণ-অভ্যুত্থান করেছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের জনগণ নতুন গঠনতন্ত্রের জন্য গণ-অভ্যুত্থান করেছে। এখন যারা নির্বাচনের কথা বলছে, তারা ক্ষমতায় এসে লুটপাট করবে বলেই নির্বাচনের কথা বলছে। এখন এই সরকারের উচিত রাজনৈতিক দলগুলোকে গঠনতন্ত্র তৈরি করার কাজে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে অংশগ্রহণ করানো। তাহলে এই সরকার একটি টেকসই সরকার হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে বোঝাতে হবে, দেশটাকে গঠন করার দায়িত্ব শুধু যারা ক্ষমতায় আছে তাদের নয়। এর ভেতর রাজনৈতিক দলগুলোর স্টেক রয়েছে। তাদের বাইরে রেখে এই গঠনতন্ত্র নির্মাণের কাজ তো এই সরকার করতে পারবে না।
অনেক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছে। আপনি কি এই দাবির সঙ্গে একমত?
ফরহাদ মজহার : আমি মনে করি, আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা উচিত। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, আইন করে যত ফ্যাসিস্ট দল রয়েছে, সব দলকে নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ আমরা তো ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। তাই সব ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের আইন লাগবে। এই আইন দ্বারা হয় আমরা তাদের চিন্তার পরিবর্তন ঘটাব, নয় তাদের দমন করব।
এবারের গণ-অভ্যুত্থান কতটা কঠিন ছিল?
ফরহাদ মজহার : অনেক বেশি কঠিন ছিল। প্রায় অসম্ভব ছিল বলা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের ১৫ বছরের যে লড়াই, তাদের মনেই এসে গেছে যে এভাবে চলতে পারে না। ফলে একটা বারুদ জমে গিয়েছিল। ছাত্ররা সেখানে দিয়াশলাইয়ের মতো বারুদটা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। এটা যেকোনো আন্দোলন থেকেই ঘটতে পারত। তবে এখানে ছাত্ররা একসঙ্গে থাকার কারণে তাদের মধ্যে সংঘবদ্ধ হওয়ার সুবিধা ছিল।
গণ-অভ্যুত্থানের পর এখন বিভিন্ন জায়গায় যে ধরনের ঘটনা ঘটছে, এগুলোর দায় কি সরকারের রয়েছে?
ফরহাদ মজহার : প্রথমত, সরকার মাজার ভাঙার বিরুদ্ধে কঠোর কোনো অবস্থান নেয়নি। এ জন্য তাদের দায় রয়েছে। আর সেনাবাহিনীকে দুই মাসের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি দেওয়াও তো তর্কের বিষয়। কেন দিচ্ছেন, কারণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারছেন না। এখন এই যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারছেন না, তারই ফসল আমরা শ্রমিক হত্যার মধ্যে দেখলাম। এই সরকার তৈরির জন্য তো গণ-অভ্যুত্থান হয়নি। তার দায় তো সরকারকে নিতে হবে।
প্রতিবিপ্লব বা বিপ্লব ছিনতাই হওয়ার মতো ঘটনা কি ঘটেছে?
ফরহাদ মজহার : এখানে সাংবিধানিক প্রতিবিল্পব হয়েছে। অর্থাৎ সংবিধানের অজুহাত দেখিয়ে, আইনের অজুহাত দেখিয়ে গণ-অভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। জনগণের অভিপ্রায় ছিল এমন এক অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা, যে সরকার হবে জনগণের প্রতিনিধি। সেটা না করে করা হলো শেখ হাসিনার অধীন একটা উপদেষ্টা পরিষদ। আর সংবিধানের নামেই সেটি বানানো হলো। এ জন্য এটাকে বলা হয় সাংবিধানিক প্রতিবিল্পব।
আপনি বিএনপিকে কেন সমর্থন করছেন?
ফরহাদ মজহার : আমি করছি; কারণ বাংলাদেশে এখন কিচ্ছু করা যাবে না। কেবল হাওয়াই কথাবার্তা বলে লাভ নাই। মনে রাখতে হবে, বিএনপি বাংলাদেশের একটা শক্তি। ফলে বিএনপিকে সমালোচনা করতে হবে অবশ্যই, কিন্তু সেটা করতে হবে যেন বিএনপি আওয়ামী লীগ হয়ে না যায়। আওয়ামী লীগও বাংলাদেশের একটা শক্তি। কিন্তু সমালোচনা শোনেনি বলে ফ্যাসিস্ট হয়ে গিয়েছে।
বিএননির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা, দখলদারিত্বসহ নানা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে বিএনপিকে ভালোভাবে নিতে চাইছে না। বিএনপির শাসনকাল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে..
ফরহাদ মজহার: আপনি আমাকে সুনির্দিষ্ট করে বলেন, কোন আমল আসলে ভালো ছিল? আমরা কখনোই জনগণের রাষ্ট্র কায়েম করতে পারিনি। এবারও পারলাম না। তাহলে এই দায় তো একা বিএনপির উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। বিএনপির রাজনৈতিক চিন্তায় বহু দুর্বলতা আছে; তবে তাদের অবদান অস্বীকার করবেন কিভাবে? খালেদ জিয়ার অবদানটা- যে তিনি এই ফ্যাসিস্ট সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে রাজি হননি। অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট সরকারকে বৈধতা দেননি। জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের অবদানও কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে? যদি আগামী দিনে বিএনপি বাংলাদেশ গড়তে চায়, তাহলে অবশ্যই সাধারণ জনতার সঙ্গে তার মৈত্রী গড়ে তুলতে হবে।
বিএনপিকে নিয়ে আমাদের চিন্তাকেও ঠিক করতে হবে। নিজেরা বদলাবার অঙ্গীকার করলে আমাদের মধ্যে তৈরি হওয়া নানা ক্ষত ও উপদংশ আমরা দ্রুত সারিয়ে তুলতে পারব, তত দ্রুত আমরা শক্তিশালী রাজনৈতিক জনগণ হিসেবে নিজেদের গঠন করতে পারব, রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত হবো। আপনি বিএনপিকে বাদ দিয়ে যেমন কিছু করতে পারবেন না, তেমনি শেষাবধি আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়েও কিছু করতে পারবেন না৷
যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন নিয়ে নিতে চায়। অনেকের এ বিষয়ে কৌতুহল আছে। আপনি কী বলবেন?
ফরহাদ মজহার : শেখ হাসিনা একটু বিকৃত মস্তিষ্কের ছিলেন, অনেকে বলেন। তার এই বক্তব্যের পক্ষে কোনো তথ্য বা প্রমাণ নাই। সহজ কথা হলো যুক্তরাষ্ট্র যদি আসলেই সেন্টমার্টিন চাইত, শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমতা ছিল না না-দেওয়ার। তাছাড়া দীর্ঘকাল ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সামরিক ঘাঁটি গড়বার কৌশল থেকে সরে এসেছে। কারণ যুদ্ধের কৃৎকৌশলের ক্ষেত্রে বিপুল বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটেছে। সেন্টমার্টিনে যুক্তরাষ্ট্র কেন ঘাঁটি করবে হাসিনা কোনো স্পষ্ট যুক্তি দেননি। তবে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ভুরাজনৈতিক এবং স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ রয়েছে। সাম্প্রতিক কালে তা বোড়েছে সামুদ্রিক যাত্রাপথ, সামুদ্রিক সম্পদ, বিশেষত গ্যাস ও জ্বালানির মজুত থাকার সম্ভাবনা এবং সামরিক গুরুত্বের কারণে ।
দৈনিক ইত্তেফাক ও কালের কণ্ঠ’র সৌজন্যে