সিলেটে ১৮ ইউনিটে বিএনপির আহবায়ক কমিটি গঠন



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
বিএনপি লোগো

বিএনপি লোগো

  • Font increase
  • Font Decrease

সিলেটে ১৩ উপজেলা ও ৫ পৌরসভায় কমিটি গঠন করেছে জেলা বিএনপি। সবগুলো ইউনিটে ২১ সদস্যের আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে।

শনিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে কমিটি গুলো অনুমোদন করেন সিলেট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কামরুল হুদা জায়গীরদার।

নবগঠিত আহবায়ক কমিটিতে যারা আছেন, সিলেট সদর উপজেলায় আহবায়ক তারেক কালাম, দক্ষিণ সুরমায় সিরাজুল ইসলাম, কানাইঘাট উপজেলায় আব্বাস উদ্দিন চেয়ারম্যান, কানাইঘাট পৌর শাখায় আবিদুর রহমান কাউন্সিলর, জকিগঞ্জ উপজেলায় অ্যাডভোকেট কাওছার রশিদ বাহার, জকিগঞ্জ পৌর শাখায় ইকবাল আহমদ, জৈন্তাপুর উপজেলায় এবিএম জাকারিয়া, গোয়াইনঘাট উপজেলায় লুৎফুর রহমান, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় আব্দুল মান্নান মনাফ, বিশ্বনাথ উপজেলায় মোহাম্মদ গৌছ খান, বিশ্বনাথ পৌর শাখায় তালেব আলী, ওসমানীনগর উপজেলায় জরিদ আহমদ, বালাগঞ্জ উপজেলায় আব্দুর রশিদ, গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ডা. আব্দুল গফুর, গোলাপগঞ্জ পৌর শাখায় হাসান ইমাদ, বিয়ানীবাজার উপজেলায় নজরুল ইসলাম খান, বিয়ানীবাজার পৌর শাখায় মো. নুরুল হুদা বাবুল ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় ইফতেখার উদ্দিন ফেদল।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২ অক্টোবর ২৫ সদস্যের সিলেট জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে সকল ইউনিটে কমিটি গঠন করে জেলা বিএনপির কাউন্সিল আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে নির্ধারত সময়ে কাউন্সিল করতে পারে নি জেলা বিএনপি।

বিএনপির এক নেতা জানান, দলীয় কোন্দলে কমিটি গঠনে দেরি হয়েছে। অনেক প্রার্থীকে বাদ দিয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের আহবায়ক করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক কেন্দ্রীয় নেতার সুপারিশও নেয়া হয়নি।    

সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ বলেন, ত্যাগী ও সাহসী নেতাদের আহবায়ক কমিটিতে মূল্যায়ন করা হয়েছে। আন্দোলন ও সংগ্রামে এই কমিটি ভূমিকা রাখবে।    

সিলেট জেলা বিএনপির আহবায়ক কামরুল হুদা জায়গীরদার বার্তা২৪.কমকে বলেন, সরকারের হামলা, মামলা ও দলীয় কর্মসূচিতে ব্যস্ত থাকার কারণে আমরা নির্ধারিত সময়ে ইউনিট কমিটিগুলো করতে পারিনি। এখন যেসব উপজেলা ও পৌরসভা কমিটি অনুমোদন করা হয়েছে তারা দ্রুত ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড সম্মেলন শেষ করবে। এরপর উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপির সম্মেলন শেষ করে জেলা বিএনপির সম্মেলন হবে।

তিনি বলেন, অনুমোদিত  কমিটিতে যোগ্যদেরই স্থান দেয়া হয়েছে। সবাই মিলে এই কমিটি নিয়ে কাজ করবে আশা করি।

   

বেনাপোলে বাস চাপায় শ্রমিক নিহত, আহত ১



সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বেনাপোল (যশোর)
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

যশোর-বেনাপোল মহাসড়কে দ্রুতগামী বাস চাপায় মোস্তাক ঢালি নামে এক শ্রমিক নিহত ও আনিসুর রহমান নামে একজন গুরুতর আহত হয়েছেন। নিহতের মরদেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে আর আহতকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যশোর সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। ঘাতক চালক পালিয়ে গেলেও জব্দ করা হয়েছে পরিবহন।

বুধবার (১ মে) ভোর ৬টায় মহাসড়কের দিঘিরপাড় নামক স্থানে এ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে।

জানা যায়, নিহত দিনমজুর মোস্তাক ঢালি শার্শা উপজেলার লাউতাড়া গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে এবং আহত দিনমজুর আনিসুর রহমান একই গ্রামের ছেলে রেজাউল ইসলামের ছেলে।

প্রতক্ষ্যদর্শীরা জানান, প্রতিদিনের মত শ্রম বিক্রী করতে শার্শার লাউতাড়া গ্রামের দুই দিনমজুর বেনাপোল শহরে আসছিল। এসময় বেনাপোলগামী গোল্ডেন পরিবহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পথচারী দিনমজুর দুই জনকে ঢাকা দিলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলে মারা যায় একজন। এসময় স্থানীয়দের খবরে অন্যজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে দুর্ঘটনায় নিহতের মরদেহ, একটি মৃত পাখি ও বাস জব্দ করে। এদিকে অভিযোগ রয়েছে চালকের অসাবধনতা ও সড়ক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভাল না থাকায় প্রায়ই সড়কটিতে দুর্ঘটনায় পথচারীরা জীবন হারাচ্ছে।

এদিকে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে স্বজনদের কান্নায় এলাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে ।

বেনাপোল পোর্ট থানার উপপরিদর্শক ঝন্টু কুমার বশাক জানান, নিহতের ঘটনায় ঘাতক চালক পালিয়েছে। তবে বাস জব্দ করা হয়েছে।

;

‘আমাগো মতো শ্রমিকদের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নাই’



মেহেদী হাছান মাহীম, বার্তা ২৪. কম, ঢাকা
ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘আমাগো মতো শ্রমিকদের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নাই’ এমন বুকভরা আক্ষেপ নিয়ে নিজের কষ্টের কথা প্রকাশ করেছেন ষাটোর্ধ্ব বয়সের তছিরন বেগম। স্বামী অনেক আগে মারা গেলেও ছেলেই ছিল তার একমাত্র ভরসা। এখন সেই ছেলেও অসুস্থ। পরিবারের সকল দায়িত্ব এখন তছিরন বেগমের উপর। পরিবারের দায়িত্ব মেটাতে তছিরন বেগম এখন কাজ করছেন রাজধানী ঢাকার গাবতলী এবং আমিন বাজারের মধ্যস্থল দিয়ে বয়ে যাওয়া তুরাগ নদী সংলগ্ন কয়লা ব্যবসা কেন্দ্রে। দিনে বারো ঘন্টা মাথায় করে বোঝাই করে কয়লা টানার কাজ করেও তেমন কোনো টাকা পায়না তিনি। এরকম ঝুকিপূর্ণ কাজে জীবনেরও নেই কোনও নিশ্চয়তা।

পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ১৮৮৬ সালে এদিনে শ্রমিকরা আমেরিকার শিকাগো শহরে তাদের কর্মক্ষেত্রে দৈনিক ১২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন করেছে। সেদিন আন্দোলনের একপর্যায়ে পুলিশ শ্রমিকদের উপর পুলিশ গুলি করতে শুরু করে। এতে করে প্রায় ১০-১২জন শ্রমিক নিহত হয় । পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা লড়াইকে স্বীকৃতি দিয়ে ওই ঘটনার স্মারক হিসেবে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অবশেষে শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। সেই থেকে পহেলা মে পালিত হয় হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস।

শ্রমিক দিবস কবে, কেন শ্রমিক দিবস পালিত হয় সে বিষয়ে কোনো কিছুই জানেনা তছিরন বেগম। তিনি বলেন, শ্রমিক দিবস কি এবং কেন পালিত হয় এ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।

তিনি আরও বলেন, কয়লা বোঝাই করা কাজ অনেকদিন ধরে করতেছি। আমাদেরকে খেটে খাওয়া লাগে। আমার একটা ছেলে সন্তান আছে। তার ঘরে দুটো মেয়ে আছে। আমার ছেলেও অসুস্থ। সে আগে মাছের ব্যবসা করতো। একদিনে আয় হয় দুই থেকে তিনশো টাকা। এই টাকা দিয়ে কিছুই হয়না। ৬০ বছর বয়সে এসে আমাদের এই কাজ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ঘরে ইনকাম করার মতো কেউ নেই। আমার কোনো বয়স্ক ভাতাও নেই।


তিনি আরও বলেন, আমি প্রায় ১২ ঘণ্টা কাজ করি। আমাগো মতো শ্রমিকদের জীবনের কোনও নিশ্চয়তা নাই। এখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মালিক পক্ষ কোনো ধরনের সাহায্য করে না।

হাফিজুর রহমান নামে আরেকজন কয়লা শ্রমিক বলেন, এখানে যে যতবেশি পরিশ্রম করে, সে ততবেশি টাকা পায়। কেউ কেউ ২০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত ইনকাম করে। অতিরিক্ত গরমের কারণে এখন কাজ করতে অনেক অসুবিধা হচ্ছে। যে টাকা ইনকাম করতেছি এটা দিয়ে পরিবার চলে না। মাঝে মাঝে ঋণ করে চলতে হয়। আমরা অসুস্থ হলে মালিক পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য আসে না।

মে দিবসের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি তছিরন বেগমের মতো একই কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি শ্রমিক দিবসের নাম জীবনেও শুনি নাই।

সয়েলি আক্তার নামে একজন মহিলা বালু শ্রমিক বলেন, আমি দৈনিক ১২ ঘণ্টা কাজ করি। সারাদিন পরিশ্রম করে ২০০-৩০০ টাকা পাই। পরিবারে আমার স্বামী এবং একটা ছোট মেয়ে আছে। এই রোদের ভিতরে কাজ করে চেহারা খারাপ হয়ে গেছে। আমরা গরীব মানুষ, আমাদেরকে কাজ করেই খেতে হবে। শ্রমিক দিবস সম্পর্কে তিনি বলেন, পহেলা মে শ্রমিক দিবস একথা আমরা লোকমুখে শুনছি। কিন্তু, এ সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না।

নাম বলতে অনিচ্ছুক একজন বালু শ্রমিক বলেন, ৪৫ টা টুকলি টানলে ১০০ টাকা পায়। গরমের কারণে ১০০ টাকাও ইনকাম করতে কষ্ট হয়। পরিবারে ঠিকমতো বাজারের খরচই হয়না। আমি ছাড়া সংসারে ইনকাম করার মতো কেউ নেই। আমার এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি অনেক আগে। আমার স্বামী মারা গেছে অনেক আগে। অভাবের তাড়নায় ১৩ বছরের ছেলেকে গার্মেন্টসে দিয়েছি। বেতন পায় মাত্র ৫ হাজার। কোনোমতে ডালভাত খেয়ে বেঁচে আছি। আমার ছেলে আমার একমাত্র ভরসা। আমার ছেলের নাম মো. ইয়াসিন। এই কাজ করতে গিয়ে যদি আমার কোনও সমস্যা হয় তাহলে আল্লাহ ছাড়া দেখার কেউ নেই। আমি টাকার জন্য বাজার করতে পারি না। জিনিসপত্রের দামের তুলনায় আমাদের পারিশ্রমিক বাড়ছে না। আমাদের এখন তেমন ইনকাম হয় না।

শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি শ্রমিক দিবস সম্পর্কে অল্প একটু জানি। এদিনে বিদেশে শ্রমিকরা আন্দোলন করেছে।

;

চা পাতায় বন্দী জীবন

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



সীরাত মঞ্জুর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম
ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘সুখ-দুঃখ সবই এই চা বাগানে। ছেলে বয়সে চা বাগানের গাড়িতে কাজ করেছি, চা চারার কলম গাছ কেটেছি। বাগানের লাকড়ি কাটি। এই বাগানে আমাদের বাপ-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠীর জন্ম। এখান থেকে বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এখানেই আমাদের জন্ম, এখানেই মৃত্যু!’

সোমবার (২৯ এপ্রিল) বিকেলে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির কর্ণফুলী চা বাগানে দাঁড়িয়ে এই প্রতিবেদককে নিজের জীবনের কথা এভাবেই তুলে ধরেন ৬৫ বছর বয়সী চা শ্রমিক পুলক রায়।

ছবি: চা শ্রমিক পুলক রায়।

জীবনের শেষ সময়ে এসেও পুলক রায়ের যেন নেই কোনো অবসর। জীবনের কঠিন সংগ্রাম এখনো চলছে। তরুণ বয়সে বাগানের চা চারার কলম কেটেছেন, গাড়িতে কাজ করেছেন । তবে বয়সের ভারে এখন আর এসব ভারি কাজ পারেন না। পরিবারে স্ত্রী পুত্র কেউ না থাকলেও পেটের দায়ে এখনো চা বাগানের লাকড়ি কাটার কাজ করে যেতে হচ্ছে তাকে। চা বাগানের বাইরে গিয়ে কিছু করবেন, সেটি ভাবনাতেও আসেনি কখনো। চা বাগানেই যে বন্দী পুলকের জীবন।

চা বাগানে জন্ম, কর্ম থেকে মৃত্যু। এমন জীবন চক্র শুধু পুলক রায়ের নয়, বাগানের প্রায় সব শ্রমিকেরই। চায়ের সবুজ পাতার প্রেমে পড়ে তাদের বেড়ে ওঠা। সেই চাকে ঘিরেই শুরু হয় জীবনের প্রথম কর্ম। নারীরা করেন পাতা তোলার কাজ। আর পুরুষেরা চা বাগান ও কারখানার বিভিন্ন শাখায় কাজ করেন।

গৌরি মালা পাতা তোলেন, স্বামী উজ্জ্বলও বাগানে কাজ করেন। দুই মেয়ে ও এক ছেলের সংসার তাদের। ছেলে ছোট্ট হওয়ায় স্কুলে পড়লেও টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে যায় মেয়েদের পড়ালেখা। বাগান থেকে পাতা তুলে ঘরে ফিরতে কথা হয় গৌরির সঙ্গে। তিনি বলেন, 'প্রতিদিন সকাল ৭টায় বের হই। বাগানে পৌঁছায় ৮টায়। কাজ শেষে ফিরি বিকেলে ৪টায়। যা টাকা পাই স্বামীসহ দুজনের ইনকাম দিয়ে ভগবানের দয়ায় চলি। আমাদের কর্ম ও জীবন এই চা বাগানেই সীমাবদ্ধ।' 

ছবি: কাজ শেষে দল বেঁধে ঘরে ফিরছেন তারা।

একদিন ছেলে-মেয়েরাও তাদের জায়গা নেবে বলে মনে করেন গৌরি। বলেন, ‘এখন আমরা বাগানে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের দেখাদেখি ছেলে-মেয়েরাও করবে। এখানে তাদের বিয়ে-সাদি করাব। এরপর তাদের ছেলে মেয়েরাও একদিন বাগানে কাজ করবে। দুঃখ লাগে না। কিসের দুঃখ! বাগানে যখন জন্ম, বাগানেই কাজ করে খাই।’

ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল পাঁচটা। পাতা তোলার কাজ শেষ করে এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাগানের পাশে বসে নিজের ছেঁড়া কাপড় সেলাচ্ছিলেন জোসনা বালা। ত্রিশ বছর ধরে বাগানে কাজ করছেন তিনি। জানতে চাইলে বলেন, 'আমার বয়স এখন ৪৫। ত্রিশ বছর ধরে পাতা তুলছি। কি আর করব, কষ্ট হলেও কর্ম করতে হয়। টাকা পয়সা নেই, জায়গা নেই। আমাদের বাপ দাদারা যেই কর্ম করে খেয়েছেন। আমরাও তাই করে চলছি।' 

নিজেদের আর্থিক দুর্দশার কথা জানাতে গিয়ে জোসনা বলেন, 'এমন না যে আমরা সরকার থেকে কোনো দামি কিছু পেলাম। দুমাস খেলাম। এসময়ে কাজ করা টাকাগুলো জমা রাখলাম, ছেলে মেয়ে শিক্ষা করলাম, নিজস্ব বাড়ি ভিটা বানালাম। এরকম সুযোগ আমরা পাই না। যতদিন কাজ করি ততদিন খাই। ১৭০ টাকা করে পাই। যদি ২৫ কেজি করে ৫০ কেজি পাতা তুলতে পারি তাহলে একদিনে ৩৪০ টাকার মতো পাওয়া যায়। আর যখন গাছে পাতা কম থাকে তখন তো আর বেশি তোলা যায় না। বৃষ্টি হচ্ছে না, গাছে পাতা নাই তেমন। যা পাতা তুলি, তাই পয়সা পাই। যখন পাতা ছিল তখন একশ’ কেজিও পাতা তুলছি। তখন ৭০০ টাকা মত পেয়েছি।' 

ছবি: পাতার পোটলা নিয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা।

কাজের কষ্টের কথা তুলে ধরতে গিয়ে জোসনা বলেন, 'পাতা তুলতে গিয়ে হাত ফেটে যায়। যারা নতুন তারা আরও হাতে আঘাত পায়। রোদের মধ্যে কাজ করতে হয়। ওপরে রোদ, নিচে গরম বালি। এর মধ্যে আমাদের কাজ করতে হয়। সপ্তাহে যে বেতন পাই তা দিয়ে চলে না, ঋণ হয়ে যায় অনেক টাকা। ১৭০ টাকায় আমাদের জীবন-মরণ।' 

জোসনা ও গৌরি মালাদের সঙ্গে টাকার অভাবে পাতা তোলার কাজ শুরু করেছেন আমেনা ও ফাল্গুনি রায় নামের দুই কিশোরী। আমেনা বলে, 'পাঁচ ক্লাস পড়েছি। দুই সপ্তাহ আগে পাতা তোলার কাজ শুরু করেছি। রোদে পাতা তুলতে আমার কষ্ট হয়। তারপরও কি আর করব, কাজ করতে হবে।' 

ফাল্গুনি রায় বলে, 'আমি একমাস ধরে পাতা তুলছি। পাঁচ ক্লাস পড়েছি। বড় কিছু হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও আমাদের অভাবে তা আর হয় না। তাই পাতা তুলার কাজ করছি।'

মা-বাবার সঙ্গে শহরে থাকলেও শ্বশুর বাড়ি এসে তিন মাস ধরে চা শ্রমিকের কাজ করছেন সুমি। তিনি বলেন, 'আমি মাত্র তিন মাস ধরে কাজ করছি। এটা আমার শ্বশুর বাড়ি। শহরে থাকা অবস্থায় কিছু করতাম না। এখন তো অভাবের জন্য কাজ করতে হচ্ছে। কেউ তো আর সুখে কাজ করে না।' 

ছবি:বাগানের মাঠে খেলছিল শ্রমিকের ছেলেরা।

বাগানের মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করছিল ১০ বছর বয়সী রাহুল দে। ফেনুয়া টি স্টেট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সে। মা-বাবা দুজন চা শ্রমিক হলেও সে হতে চায় চিকিৎসক। জানতে চাইলে বলে, 'আমি বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই। বাগানে কাজ করতে চাই না।' 

চা শ্রমিকেরা প্রতিদিন সকাল হলে দল বেঁধে ছুটে যান বাগানে। কাজ শেষে বিকেল হতেই ফিরে আসেন ঘরে। জীবন-মান উন্নয়নে সবসময় পিছিয়ে তারা। এমন কি তারা অন্য শ্রমিকদের তুলনায় পান সবচেয়ে কম পরিমাণের দৈনিক মজুরি। এভাবে চা বাগানকে ঘিরে বাঁধা পড়ে আছে তাদের জীবন। ছোট্ট শিশু জন্মের পর প্রথম যে দৃশ্য দেখে সেটিও চায়ের সবুজ পাতা। বেড়ে ওঠা থেকে মৃত্যুও এই চা বাগানে।

প্রসঙ্গত, চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে টানা তিন সপ্তাহ আন্দোলনের পর ২০২২ সালে ২৭ আগস্ট ৫০ টাকা দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমান চা শ্রমিকের নূন্যতম দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা।

;

দৃষ্টিহীন মায়ের আশার আলো শাহজাহান



রেদ্ওয়ান আহমদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম
ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

শাহজাহানের বয়স মাত্র ১২ বছর। এই বারো বছর বয়সেই সে যেন এক জীবনযোদ্ধা। ছয় বছর বয়সেই জন্মান্ধ মাকে ফেলে গেছেন রাঙামাটির লংগদুর বাসিন্দা বাবা আলতাফ হোসেন। বড় ভাইটাও মেপেছেন নিজের পথ। এরপর জীবিকার তাগিদে লংগদু ছেড়ে পাহাড়তলীতে এসে মা-সহ ঠাই নেয় সে। মা শুরু করেন ভিক্ষাবৃত্তি আর শাহজাহান জড়ায় শিশুশ্রমে। এভাবেই জন্মান্ধ মাকে নিয়ে গড়ে উঠে তার কষ্টের সংসার। যার কারণে দুয়েকবার স্কুলের বারান্দায় পা রাখলেও ভালো করে স্বরবর্ণের পাঠটাও নিতে পারলো না দারিদ্রের কারণে।

শাহজাহান এখন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী নতুন ব্রিজ এলাকার একটি দোকানে চার হাজার টাকা মাসে কাজ করে। তাই মাকে আর ভিক্ষাবৃত্তি করতে দেয় না। তবুও জীবনের প্রয়োজনে মাঝে মাঝেই মা সাজেদা খাতুনকে যেতে হয় ভিক্ষা করতে। কিন্তু শাহজাহান মায়ের এই ভিক্ষাবৃত্তি দেখতে চান না। কিন্তু নিয়তি যে তার সহায় নেই!

মায়ের প্রতিবন্ধিতার কারণে ছেড়ে যাওয়া বাবার প্রতি শাহজাহানের অভিমান বিশাল। তাইতো, জীবিত বাবাকে সে পরিচয় করিয়ে দেয় ’মৃত’ বলে। দিবেই বা না কেনো? যে বাবা স্ত্রী সন্তানকে ছেড়ে যেতে পারেন সে বাবা জীবিত থেকেও বা কী লাভ! পড়ালেখা করে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও এখনো পর্যন্ত শাহজাহানের সে স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে। তার যে ঘরে আয়-রোজগারের কেউ নাই!

’আব্বা মারা গেছে অনেক বছর আগে। আমার তখন ছয় বছর। এরপর থেকেই মাকে নিয়ে আমি এখানে থাকি। পড়ালেখা করার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু দুয়েকবার স্কুলে গেলেও আর যাওয়া হয় নাই। দোকানে কাজ করে চার হাজার টাকা মাসে পাই, এইটা দিয়ে মারে নিয়ে কোনরকম চলি।’ অন্ধ মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে মাত্র বারো বছরেই এ যেনো এক পঁচিশোর্ধ্ব যুবকের কণ্ঠস্বর।

তখনও মায়ের ভিক্ষাবৃত্তির কথা গোপন করে লাজুক শাহজাহান। মা সাজেদার নাম্বার চাইতেই দেয় সে। বলে, ’মা চোখে দেখে না। তবে, বাটন ফোন দিয়ে কল রিসিভ করতে জানে। আমার মুবাইল নাই। প্রয়োজনে মালিকের মুবাইল দিয়ে ফোন করি।’ অতঃপর জন্মান্ধ মা সাজেদাকে ফোনকল করলে রিসিভ করে তিনি মুঠোফোনটি তুলে দেন প্রতিবেশী রাশেদা বেগমের হাতে।

তার কাছ থেকে সকল তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া গেলেও শাহজাহানের বাবার মৃত্যুর বিষয়টা খোলাসা করে তিনি বলেন, ’ওর বাবা মারা যায়নি। ওর মা অন্ধ হওয়ায় একটা সময় পর ওর মা ওদেরকে ছেড়ে চলে যায়। ওদের আর কোন খোঁজ খবর রাখে না। যার কারণে, শাহজাহান বাবা মারা গেছে বলে পরিচয় দেয়। শাহজাহান দোকানে কাজ করলেও এই টাকা দিয়া তাদের সংসার চলে না। যার কারণে সাজেদা মাঝেমধ্যে ভিক্ষা করতে যায়।’

চট্টগ্রামের নতুন ব্রিজস্থ ’সফওয়ান ফুডস এন্ড বিরিয়ানি হাউজ’ এর মালিক নুরুল কবিরের সাথে আমাদের কথা হয়। তিনি বলেন, ’শাহজাহান পড়তে চাইলে পড়বে। বাঁধা নেই। তবে, তার জীবন পরিচালনার জন্য আর্থিক আয়-রোজগারও দরকার। তার পারিবারিক অবস্থা খুবই করুণ। তার মা আছে। তাকে তারই চালাতে হয়। তাই, লোক না লাগা সত্ত্বেও তাকে আমরা দোকানে নিয়েছি। মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা বেতনে। সে বাসা থেকে ভাত আনা-নেওয়া করে। দোকানের মালামাল এগিয়ে দেয়। তিন-চার মাস ধরে সে কাজ করছে। ছেলে হিসেবে এ পর্যন্ত তাকে বেশ ভালোই মনে হয়েছে আমাদের।’

শাহজাহানের জন্মান্ধ মা সাজেদা খাতুন কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আল্লাহর কাছে লাখো-কোটিগুণ শুকরিয়া। আমার জীবন এখন এই ছেলেকে নিয়েই। স্বামী গেলো, বড় ছেলে গেলো। এই ছেলে আমাকে আগলে রাখছে। আমাকে ভিক্ষা করতে দিতে চায় না। আমারও ভিক্ষা করতে মন চায় না। কিন্তু কী করবো বলেন, জীবন তো চালানো লাগবো! আমার ছেলেরে নিয়া আমার অনেক স্বপ্ন। সে অনেক বড় হবে একদিন ইনশাআল্লাহ।’

;