সারাদেশে আলোচিত ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একরামকে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে হত্যার দশ বছর পূর্ণ হল সোমবার (২০ মে)। এ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১৭ আসামিকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ছাড়া রায় ঘোষণার ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও উচ্চ আদালতে শুরু হয়নি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিলের শুনানি।
২০১৪ সালের ২০ মে ফেনী শহরের একাডেমি এলাকায় একরামুল হককে প্রকাশ্যে পিটিয়ে, কুপিয়ে, গুলি করে ও গাড়িতে আগুন দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ওই দিন এ ঘটনায় ফেনী সদর মডেল থানায় মামলা করেন একরামের বড় ভাই জসিম উদ্দিন। মামলায় ফুলগাজীর বিএনপি নেতা ও উপজেলা নির্বাচনে একরামের প্রতিদ্বন্দ্বী মাহতাব উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে আসামি করা হয়।
শুনানি শুরু না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে আসামি পক্ষের আইনজীবী আহসান কবীর বেঙ্গল জানান, জেলা জজ আদালতে রায় ঘোষণার পর উচ্চ আদালতে আপিল করেন দণ্ডপ্রাপ্তরা। সেই আপিলের শুনানি উচ্চ আদালতের কার্যতালিকায় রয়েছে।
ফেনী আদালতের আইনজীবী শাহজাহান সাজু জানান, এ মামলায় দুটি আসামি এবং রাষ্ট্রপক্ষ দুটি পৃথক আপিল করেছে। উচ্চ আদালতে মামলাটি এখন ডেথ রেফারেন্স শুনানীর জন্য অপেক্ষমাণ।
ডেথ রেফারেন্স শুনানি সম্পর্কে ফেনী আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) হাফেজ আহম্মদ বলেন, এটি উচ্চ আদালতের বিষয়। উচ্চ আদালতে বিচার আটকে যাওয়ায় অসন্তুষ্ট একরামের ছোট ভাই মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, রায় কার্যকরে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রায় যাতে দ্রুত কার্যকর হয়, সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।
একরাম হত্যার ১০ দশ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও বিভীষিকা মোছেনি নিহতের স্ত্রী তাসনিম আক্তার ও একরামের পরিবারে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তাসনিম বলেন, মামলা সম্পর্কে আপনারা সবাই ভালো জানেন। আমার কিছু বলার নেই।
এদিকে ১০ বছর পার হলেও এখনও পলাতক একরাম হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৭ আসামি।
আদালত ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, একরাম হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ড পাওয়া ৩৯ জনের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির, ফেনী পৌরসভার তৎকালীন কাউন্সিলর আবদুল্লাহ হিল মাহমুদসহ ২২ আসামি কারাগারে রয়েছেন, পলাতক রয়েছেন ১৭ জন। এদের মধ্যে আটজন বিচার চলাকালীন জামিনে মুক্ত হয়ে পালিয়ে যান, বাকিরা শুরু থেকে পলাতক ছিলেন।
পলাতক আসামিরা হলেন জাহিদ হোসেন, আবিদুল ইসলাম, চৌধুরী মো. নাফিজ উদ্দিন, আরমান হোসেন, জাহেদুল হাসেম, জিয়াউর রহমান, জসিম উদ্দিন, এমরান হোসেন, রাহাত মো. এরফান, একরাম হোসেন ওরফে আকরাম, শফিকুর রহমান, কফিল উদ্দিন মাহমুদ, মোসলে উদ্দিন, ইসমাইল হোসেন, মহিউদ্দিন আনিছ, মো. বাবলু ও টিটু। এর মধ্যে চারজন জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর পালিয়ে যান। পলাতক ও কারাগারে থাকা দণ্ডপ্রাপ্ত সব আসামিই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী।
মামলাটির তদন্ত শেষে ৫৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ। এর মধ্যে এক আসামি র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ মামলার রায়ে ৩৯ জনকে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়। রায়ে খালাস পান বিএনপির নেতা মাহতাব উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীসহ ১৬ জন।
রায়ে বলা হয়, স্থানীয় নির্বাচন থেকে আসামিদের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধের কারণে একরামকে হত্যা করা হয়েছে। একরামের বড় ভাই জসিম উদ্দিন ৩৩ জনকে আসামি করে মামলা করলে চার বছর পর ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ ৩৯ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন ফেনীর জেলা ও দায়রা জজ। এই মামলার আসামি ফুলগাজীর বিএনপি নেতা ও উপজেলা নির্বাচনে একরামের প্রতিদ্বন্দ্বী মাহতাব উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী মিনারসহ খালাস পান ১৬ জন। মামলা চলাকালে এক আসামি র্যাবের সঙ্গে 'কথিত বন্দুকযুদ্ধে' মারা যান। স্থানীয় নির্বাচন থেকে আসামিদের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধের কারণে একরামকে হত্যা করা হয়েছে বলে বিচারক রায়ে উল্লেখ করেছেন।
ফাঁসির দণ্ড পাওয়া আসামিদের মধ্যে আছেন- জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির, ফেনী পৌরসভার তৎকালীন কাউন্সিলর আবদুল্লাহ হিল মাহমুদ। বাকিরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী।
মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে কনডেম সেলে বন্দিদের মধ্যে আছেন- জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির আদেল, যাকে রায়ে হত্যার পরিকল্পনাকারী বলা হয়েছে। ফেনী পৌরসভার কাউন্সিলর আবদুল্লাহিল মাহমুদ শিবলু, সাজ্জাদুল ইসলাম পাটোয়ারী ওরফে সিফাত, আবু বক্কার সিদ্দিক ওরফে বক্কর, আজমির হোসেন রায়হান, শাহজালাল উদ্দিন শিপন, জাহিদুল ইসলাম জাহিদ ওরফে আজাদ, কাজী শানান মাহমুদ, মীর হোসেন আরিফ, আরিফ ওরফে পাচ্চু আরিফ, রাশেদুল ইসলাম রাজুও বন্দি। অন্যরা হলেন সোহান চৌধুরী, জসিম উদ্দিন নয়ন, নিজাম উদ্দিন আবু আবদুল কাইউম, নুর উদ্দিন মিয়া, তোতা মানিক, জিয়াউর রহমান বাপ্পি, মো. সজিব, মামুন, রুবেল, হুমায়ুন ও টিপু। এদের মধ্যে জিয়াউর রহমান বাপ্পিকে ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর গ্রেফতার করে পুলিশ।
এ ব্যাপারে ফেনী মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের মধ্যে সদর থানা এলাকার ১৩ জনের গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। তাদের গ্রেফতারে পুলিশের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। পলাতক অন্য আসামিদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে।