মিউনিখ ট্র্যাজেডির ৪৭ বছর



শেহজাদ আমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
ভয়াবহ সেই মিউনিখ ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারানো ১১ ইসরায়েলি অ্যাথলেট

ভয়াবহ সেই মিউনিখ ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারানো ১১ ইসরায়েলি অ্যাথলেট

  • Font increase
  • Font Decrease

‘খেলাধুলার সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই’—এমনটাই মনে করে থাকেন সাধারণ মানুষেরা। খেলাধুলার ব্যাপারটা রাজনৈতিক ও ভূখণ্ডের সীমারেখার বাইরের এক জিনিস। তাই তো দেখা যায় রাজনৈতিকভাবে বিরোধীভাবাপন্ন দেশের গুণী অ্যাথলেটদেরও ভক্ত বনে যান কোনো কোনো দেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিক। কিন্তু কিছু হীন চরিত্রের, স্বার্থবাদী মানুষের কাছে খেলাধুলাও হয়তো হয়ে ওঠে রাজনৈতিক উপকরণ। খেলোয়াড়রাও তখন হয়ে ওঠে দাবার গুটি বা স্রেফ রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উপকরণ মাত্র। এরকম চিন্তাধারারই চরমপন্থার শিকার ১৯৭২-এর মিউনিখ অলিম্পিক গেমস। প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতাকামী এবং বিপথে যাওয়া কিছু লোকের কারণে গেমস চলাকালীনই ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর প্রাণ হারায় ইসরায়েলের ১১ জন অ্যাথলেট।

কী ঘটেছিল সেদিন

৩৬ বছরের বিরতি দিয়ে সেবার জার্মানিতে ফিরেছিল অলিম্পিক গেমস। এর আগে ১৯৩৬-এ জার্মানিতে অনুষ্ঠিত হওয়া সবশেষ অলিম্পিক গেমসে অনেকটাই কালিমা লেপে দিয়েছিল সেসময়ে দেশটিতে ক্ষমতাসীন হিটলারের নাৎসি বাহিনীর আদব-কেতা ও কিছু কাজকর্ম। তাই স্বাভাবিকভাবে মিউনিখ অলিম্পিকে আয়োজকদের মধ্যে সেই কালো দাগ দূর করে সম্ভাব্য সকল উপায়ে সেরা এক অলিম্পিক আয়োজনের চেষ্টা ছিল। কিন্তু, মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। এবারের অলিম্পিকে পড়ল আরো বেশি কালো দাগ।

মিউনিখের অধ্যায়টা শুধু অলিম্পিক নয়, বরং পুরো মানবজাতির জন্যেই কালো ইতিহাস। প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী সংগঠন ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’-এর উগ্রবাদীরা গেমস ভিলেজে এসে এগারজন ইসরায়েলিকে জিম্মি করে ফেলে। জার্মানির অভ্যন্তর থেকে তাদের সহায়তা দেয় নব্য নাৎসি দল ‘ফ্যাকশন রেড আর্মি’। ইসরায়েলিদের ছেড়ে দিতে শর্ত ছিল ইসরায়েলের কারাগারে আটক থাকা ২৩৪ ফিলিস্তিনি এবং জার্মান কারাগারে আটক থাকা দুই নব্য নাৎসি নেতার মুক্তি। জার্মান মধ্যস্থতাকারীরা অনেকটা রাজি হয়ে গিয়েছিল ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের দাবি মেনে নেওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু, ইসরায়েলি সরকার আপোষ করতে চায়নি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য ছিল, সন্ত্রাসীদের দাবির কাছে হার মেনে নিলে দুনিয়ার কোথাও ইসরায়েলি নাগরিকেরা নিজেদের নিরাপদ মনে করতে পারবে না। তাই শেষমেশ দাবি মেনে নিতে রাজি হয়নি দুই দেশের সরকারই। বদলে শুরু করে অন্য পরিকল্পনা।

গেমস ভিলেজের ছাদে চক্কররত জার্মান পুলিশের সদস্যরা


এই ভয়াবহ ঘটনার শুরু হয়েছিল ৫ সেপ্টেম্বর। ৫ সেপ্টেম্বর ভোর সাড়ে চারটায় শুরু হওয়া এই নাটকের পদে পদে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। হাই কমান্ড থেকে নির্দেশ পেয়ে জার্মান পুলিশ পরিকল্পনা করে অ্যামবুশের। জিম্মিকারীদের চাহিদা মতো হেলিকপ্টার জোগান দেওয়া হয়। এবং করা হয় হেলিকপ্টারে ওঠার সময় স্নাইপার দিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা।

গেমস ভিলেজের ছাদে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের এক সদস্য


কিন্তু নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয় জার্মান পরিকল্পনা। হেলিকপ্টারে ওঠার পথে আক্রমণের শিকার হয়ে জিম্মিকারীরা ওখানেই চারজনকে মেরে ফেলে। পালানো অসম্ভব, বুঝতে পারে জিম্মিকারীরা। গ্রেনেড বিস্ফোরণে পুরো হেলিকপ্টারই উড়িয়ে দেয়। ইসরায়েলি কাউকেই তাই জীবিত উদ্ধার করা যায় না।

মিউনিখ পুলিশের তৎকালীন প্রধান ম্যানফ্রেড শাইবা জানিয়েছিলেন, এই ব্যাপারটা মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি ছিল যথেষ্ট কম। কিন্তু তার দাবি সত্য নয় বলে অনেকের দাবি। কেননা, পুলিশ চাইলেই এই হামলা আগে থেকেই যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে পারত। বার্লিনের ইতিহাসবেত্তা ম্যাথিয়াস ডালকে জানান, এধরনের হামলা তখন ছিল বেশ নিয়মিত ঘটনা। আয়ারল্যান্ড, স্পেন ও মধ্যপ্রাচ্যে বিচ্ছিন্নতাকামীদের উৎপাত ছিল ভালোরকম। নিয়মিত বিমান হাইজ্যাকের ঘটনা তো ছিলই। হামলা সম্পর্কে আগাম আশঙ্কাও করেছিল স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। পুলিশের মনস্তত্ত্ববিদ জর্জ সিবার সম্ভাব্য ২৬টি হামলার কথা উল্লেখ করেছিলেন, যার মধ্যে ১১ নম্বরটির সাথে মিল ছিল এই হামলার। কিন্তু, পুলিশ প্রধান শাইবারকে হামলার ব্যাপারে সতর্ক করা হলে তার অভিমত ছিল, এরকম হামলার হুমকি তো আমরা ভুরিভুরি পাই। সেগুলোকে আমলে নিলে তো অলিম্পিক বন্ধ রাখতে হবে ২০ বছরের জন্য।

সেই মুহূর্তে অলিম্পিকজ্বরে আক্রান্ত মিউনিখ সামাল দিতে পারছিল না আকস্মিক এই হামলার ব্যাপারটিকে। বিভ্রান্তিকর তথ্য ও সঠিক নির্দেশনার অভাবের কারণে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছিল না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কতজন ‘সন্ত্রাসী’ আছে, কতটুকু সক্ষমতা তাদের, এসব না জানার কারণে সক্রিয় হতে পারছিল না স্নাইপাররাও।

সেসময় জার্মানির অঙ্গরাজ্যগুলো নিজেরাই ছিল নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্বে। রাজ্য ও ফেডারেল সরকারের মধ্যে কারা অপারেশন চালাবে, সে নিয়েও ছিল বিভ্রান্তি। এর ওপর সন্ত্রাসীদের দখলকৃত বিল্ডিংয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করায় বাইরের দুনিয়ার সব খবরাখবরও পেয়ে যাচ্ছিল তারা। প্রথম অবস্থায় ওই এলাকার আশপাশ থেকে সাংবাদিকদেরও সরাতে ব্যর্থ হয় প্রশাসন। ফলে, স্নাইপারদের অবস্থান টের পেয়ে সতর্ক অবস্থায় থাকতে পেরেছিল ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সদস্যরা। এজন্য বাতিল করতে হয় জার্মান পুলিশের বেশ কয়েকটি অভিযান।

একটা সময় মনে হচ্ছিল, জার্মান প্রশাসন জিম্মিদেরসহ সন্ত্রাসীদের কায়রো পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাবে রাজি। জিম্মিকারী ও জিম্মিদের বহনকারী হেলিকপ্টার দুটো আক্রমণস্থল থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ফুস্টেনফ্রেডবুক বিমানঘাঁটিতে নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানে আগে থেকেই ঘাপটি মেরে ছিল পুলিশ। জার্মান সেনাবাহিনীর অনেক আধুনিক সরঞ্জাম ও শক্তি থাকলেও দেশটির সংবিধান অনুযায়ী বেসামরিক বাহিনীকে সাহায্য করতে পারত না তারা। সেখানে থাকা স্নাইপারদের হাতিয়ার ও দক্ষতায়ও ছিল বেশ ঘাটতি।

বিমান ঘাঁটিতে যে বিমানটি জিম্মি ও জিম্মিকারীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল, সেখানে বিমানের ক্রুদের ছদ্মবেশে আগে থেকে মওজুদ করে রাখা হয়েছিল ১৭ জন দক্ষ পুলিশ অপারেশন কর্মকর্তাকে। বলা হয়েছিল, জিম্মিকারীরা বিমানে ওঠামাত্রই হামলা করতে। কিন্তু সর্বসম্মতিক্রমে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়ায় পুলিশরা।

এদিকে, রাত সাড়ে ১০টার দিকে দুজন ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর সদস্য হেলিকপ্টার থেকে নেমে বিমান দুটো পরীক্ষা করে দেখতে যায়। সেখানে সবকিছু ফাঁকা দেখে সঙ্গীদের ব্যাপারটা জানায় তারা। ওই মুহূর্তেই অবশ্য পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালানো শুরু করে। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলে এই গুলি-পাল্টা গুলির বৃষ্টি। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় বেশিরভাগ ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর সদস্য, একজন পুলিশ ও কিছু অ্যাথলেট।

ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর সদস্যদের ছোঁড়া গ্রেনেডে বিধ্বস্ত হেলিকপ্টার


ইসরায়েলি অ্যাথলেটদের উদ্ধার করার জন্য যে গাড়িগুলোর সেখানে চলে আসার কথা ছিল, সেগুলো সেখানে আসতে পারেনি সময়মতো। আটকে গিয়েছিল যানজটে। যতক্ষণে ওই গাড়িগুলো এসে পৌঁছায়, ততক্ষণে সন্ত্রাসীরা জিম্মিদের রাখা হেলিকপ্টারটি লক্ষ্য করে ছুড়ে মারে গ্রেনেড। এতে গুঁড়িয়ে যায় হেলিকপ্টার এবং মারা যায় সব অ্যাথলেট।

এই অপারেশনে বেঁচে যায় তিনজন ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর সদস্য। পরে জার্মান বিমান লুফথানসা হাইজ্যাক করার ঘটনায় পণ হিসেবে তাদেরকে মুক্ত করে নেয় তাদেরই উগ্রবাদী সহযোগীরা।

কারা এই ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর?

প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিনভিত্তিক এক আধা-সামরিক সংগঠন এই ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর। ১৯৭০-এ উৎপত্তি হওয়া এই সংগঠনটি আরবিতে পরিচিত ‘মুয়াজ্জামাত আইয়ুল আল-আসওয়াদ’ নামে। তারা এখন নিষ্ক্রিয়। তবে, বিশ্বজুড়ে খ্যাতি বা কুখ্যাতি পেয়েছিল জর্ডানের প্রধানমন্ত্রী ওয়াসফি তালকে হত্যা এবং ১৯৭২-এর মিউনিখ অলিম্পিকের এই হত্যাকাণ্ডের কারণে। তাদের এই ভয়ানক হামলার পরই নড়েচড়ে বসে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ; গঠন করতে থাকে বিশেষ ও স্থায়ী কাউন্টার-টেরোরিজম বাহিনী।

এই সংগঠনের নামটি নেওয়া হয়েছে ১৯৭০-এর সেপ্টেম্বরের সংঘর্ষ থেকে। তখন ফেদায়েনদের হাত থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য দেশে সামরিক আইন জারি করেন জর্ডানের রাজা হোসেন। এই কারণে জর্ডান থেকে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে বহিষ্কার করা হয়। মৃত্যু হয় তাদের অনেকের। প্যালেস্টাইনি ফাতাহ আন্দোলনের ছোট একটি সেল হিসেবে যাত্রা শুরু করে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর, যারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল বাদশাহ হোসেন ও জর্ডানের সামরিক বাহিনীর ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার ব্যাপারে।

ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের বেশিরভাগ সদস্য ছিল ফাতাহ আন্দোলনের কর্মী


প্রাথমিকভাবে এর বেশিরভাগ সদস্যই ছিল ফাতাহ আন্দোলনের কর্মী। মিউনিখ হামলার আগে ১৯৭২ সালের ৮ মে তারা হাইজ্যাক করেছিল একটি বেলজিয়ান বিমান। পরে, ১৯৭৩ সালে সুদানের খার্তুমে সৌদি দূতাবাসেও হামলা চালায় তারা। একই বছর নিউ ইয়র্কে বোমা হামলার পরিকল্পনাও করেছিল।

ইসরায়েলের পাল্টা আঘাত

এগারজন অ্যাথলেটের মৃত্যু ও তিনজন ‘সন্ত্রাসী’র মুফতে মুক্তি ক্ষুব্ধ করে তোলে ইসরায়েলের জনগণ ও সরকারকে। মিউনিখ হামলার দুদিন পরেই প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর দশটি ঘাঁটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয় ইসরাইল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, মিউনিখ ম্যাসাকারে জড়িতদের যারা সাহায্য করেছে বা তাদের সাথে সংযুক্ত আছে, তাদের সবাইকে এমন শিক্ষা দেওয়া, যাতে করে কেউই ইসরায়েলিদের হত্যা করার সাহস না পায় ভবিষ্যতে। এই উদ্দেশ্যে গঠন করা হয় একটি কমিটি। সেই কমিটির কাজ ছিল গুপ্তহত্যার জন্য বেছে বেছে শিকারদের তালিকা তৈরি করা। ২০-২৫ জনের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। তালিকা তৈরির পর মোসাদ বাহিনীকে গুপ্তহত্যার মিশন শুরু করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। জন্ম নেয় ‘অপারেশন র‌্যাথ অব গড’ বা ‘অপারেশন ঈশ্বরের ক্রোধ’-এর।

এই অপারেশনের প্রথম গণহত্যাটি সংঘটিত হয় ১৯৭২ সালের ১৬ অক্টোবর। শিকার ফিলিস্তিনি ওয়ারিল রোমে। রাতের খাবার খেয়ে ফেরার পথে তাকে হত্যা করে চলে যায় আততায়ীরা। ওয়ারিল ছিল সেই সময়ে পিএলও’র একজন সক্রিয় কর্মী।

দ্বিতীয় শিকার ছিল মাহমুদ হামশারি নামে এক পিএলও কর্মী। হোটেল রুমে পেতে রাখা বিস্ফোরণে মারা যায় সে, যার পেছনে ছিল মোসাদের লোকেরাই।

এরপর এই ধারা চলতেই থাকে। ফিলিস্তিনি অনেক নেতা, পিএলও কর্মী ও ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নেতাদের হত্যা করা হয় সত্তর ও আশির দশকজুড়ে।

বিশ্বনেতাদের ক্ষমতার লোভ আর কপটতার ফাঁদে পড়ে নিরীহ অ্যাথলেটদের খেলতে এসে জীবন দিয়ে দেওয়ার কাহিনী নিতান্তই মর্মান্তিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত। মিউনিখ অলিম্পিকে হয়তো ঘটেছিল অনেক অবিস্মরণীয় ক্রীড়ানৈপূণ্য। মার্ক স্পিটজের রেকর্ড (২০০৮ অলিম্পিক পর্যন্ত) ৭টি সোনা জেতার মতো ঘটনাও রয়েছে। তবুও মিউনিখ অলিম্পিক মনে থাকবে ওই এগারজনের জন্যেই। গুগল সার্চে মিউনিখ লেখার সাথে সাথে আসা ‘ম্যাসাকার’ শব্দটি অলিম্পিকের ‘ভ্রাতৃত্ববোধ’ স্লোগানের ওপর আবহমান কাল ধরেই তাই চপেটাঘাত করতেই থাকবে।

   

ফেনী শহরে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে কৃষ্ণচূড়া



মোস্তাফিজ মুরাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ফেনী
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

'কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে-আমি ভুবন ভুলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে' জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই মনোমুগ্ধকর গানে ফুটে উঠেছে কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য। কৃষ্ণচূড়া যেন প্রকৃতিকে দান করেছে লাল আভার অপরূপ সৌন্দর্যের মহিমা। সাথে গ্রীষ্মের উত্তাপে শহরে সৌরভ ছড়াচ্ছে নানা জাতের ফুল। তীব্র তাপদাহের পর কালবৈশাখী, এরপর মাঝারি বৃষ্টির মধ্যে ফুলের আগমন। এতে রঙের উল্লাসে মেতে উঠেছে ফেনী শহরবাসী।

ফেনী শহরের কোর্ট বিল্ডিং, এলজিইডি, পুলিশ লাইন, নবীন চন্দ্র সেন কালচারাল সেন্টার, ফেনী সরকারি কলেজ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া। এটি একদিকে প্রকৃতিকে যেমন সাজিয়েছে অপরূপ সৌন্দর্যে, অন্যদিকে এর সৌন্দর্য মুগ্ধ করছে তরুণ-তরুণী, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষসহ ফুলপ্রিয় পথচারীদের। শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে, সরকারি দফতরসহ স্কুল-কলেজে কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল ও উজ্জ্বল সবুজ পাতার সংমিশ্রণ দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে চারপাশ।


কৃষ্ণচূড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ফুলের ঘ্রাণে মুখরিত হয়ে আছে পুরো শহর। শহরের মূল সড়কের ডিভাইডারে পৌরসভার উদ্যোগে লাগানো হাসনাহেনা, রজনিগন্ধা, গন্ধরাজসহ নানা জাতের ফুল গাছে ফুল ফুটেছে। এটি একদিকে বাড়িয়েছে সৌন্দর্য অন্যদিকে হেঁটে কিংবা রিকশায় চলাচল করলে পাওয়া যায় এসব ফুলের সুঘ্রাণ।

ফেনী শহরের কৃষ্ণচূড়ার অপরূপ সৌন্দর্য দেখে ফুলপ্রিয় পথিকরা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া ফুল প্রকৃতিকে অনন্য সাজে সাজিয়েছে। এই ফুলের সৌন্দর্যের কারণে পথচারীরা একবার হলেও এই ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এর গাছের উপর নজর দিবে। পাশাপাশি তীব্র গরমে অন্যান্য ফুলের সুঘ্রাণে চারপাশ মুখরিত হওয়াতে ক্লান্তিতা কিছুটা হলেও কমছে।


তারা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া ফুলের এই নান্দনিক দৃশ্য দেখতে এর গাছ রোপণ করা জরুরি। রাস্তা প্রশস্তকরণ, ঘর-বাড়ি নির্মাণসহ নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে ফেলা হয়। অন্যান্য গাছ রোপণ করার পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া রোপণ করলে একদিকে যেমন সৌন্দর্য বাড়াবে অন্যদিকে পরিবেশ বান্ধব হবে।

সাজিদ হাসান নামের এক পথচারী বলেন, কৃষ্ণচূড়া একদিকে যেমন প্রকৃতিতে অপরুপ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে, আরেকদিকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমাবে। সারাদেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে, আমার মতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে এই গাছটিও যুক্ত করা উচিত। তীব্র গরমের পর বৃষ্টি হলো, এরপর শহরে নানা রঙের ফুলের দেখা মিলছে, ফুলের ঘ্রাণে চলাচল করতেই ভালো লাগছে।

ফারজানা ইয়াসমিন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ফুলের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। অন্যান্য ফুলের পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া ফুল আমার অনেক ভালো লাগে। আমাদের কলেজে বকুল তলা আছে, ক্যান্টিনের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। সুযোগ পেলেই ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করি।

অনিক মোহন নামে একজন বলেন, রিকশায় করে যখন বাসায় ফিরি, শহরের রাস্তার মাঝে ভিডাইভারে লাগানো নানা জাতের ফুলের ঘ্রাণ মনকে আনন্দিত করে। রাতের বেলা শহর যখন নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তখন এ ফুলের সৌন্দর্য কয়েকশ’ গুণ বেড়ে যায়।

সড়কের পাশে কৃষ্ণচূড়া লাগানো হলে সৌন্দর্য বাড়বে বলে মনে করেন পথচারী মিনহাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাস্তা প্রশস্তকরণের জন্য যে গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে, ওই গাছগুলোর জায়গা কৃষ্ণচূড়ার গাছ লাগালে রাস্তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে।

একই কথা বলেন শহরের ব্যবসায়ী নাদিম আহমেদ। তিনি বলেন, সৌন্দর্য ও পরিবেশের কথা বিবেচনা করে এই গাছ রোপণ করা উচিত আমাদের। তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে অন্যন্যা গাছ রোপণ করার পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া গাছ রোপণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। যেগুলো শহরে আছে তাতেই সৌন্দর্য বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ, আরও যদি লাগানো যায় ফুলে ফুলে ভরে উঠবে আমাদের শহর।

কৃষ্ণচূড়া মাদাগাস্কারের শুষ্ক পত্রঝরা বৃক্ষের জঙ্গলে পাওয়া যায়। যদিও জঙ্গলে এটি বিলুপ্ত প্রায়, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এটি জন্মানো সম্ভব হয়েছে। সৌন্দর্যবর্ধন গুণ ছাড়াও, এই গাছ উষ্ণ আবহাওয়ায় ছায়া দিতে বিশেষভাবে উপযুক্ত। কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদ উচ্চতায় কম (সর্বোচ্চ ১২ মিটার) হলেও শাখা-পল্লবে এটি বেশি অঞ্চল ব্যাপী ছড়ায়।

শুষ্ক অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে কৃষ্ণচূড়ার পাতা ঝরে গেলেও, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এটি চিরসবুজ থাকে। কৃষ্ণচূড়া ফুলের রং উজ্জ্বল লাল। পত্র ঝরা বৃক্ষ, শীতে গাছের সব পাতা ঝরে যায়। বাংলাদেশে বসন্ত কালে এ ফুল ফোটে। ফুলগুলো বড় চারটি পাপড়ি যুক্ত। পাপড়িগুলো প্রায় ৮ সেন্টিমিটারের মত লম্বা হতে পারে। কৃষ্ণচূড়া জটিল পত্র বিশিষ্ট এবং উজ্জ্বল সবুজ। প্রতিটি পাতা ৩০-৫০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ২০-৪০ টি উপপত্র বিশিষ্ট। কৃষ্ণচূড়ার জন্মানোর জন্য উষ্ণ বা প্রায়-উষ্ণ আবহাওয়ার দরকার। এই বৃক্ষ শুষ্ক ও লবণাক্ত অবস্থা সহ্য করতে পারে।

জানা যায়, অপরূপ সৌন্দর্য ছড়ানোর পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর পাতা, মূলের বাকল ও ফুল ভেষজ গুণাগুণ সম্পূর্ণ, যা জ্বর ও খুশকি নিরাময়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ভেষজটি হেমিপ্লেজিয়া, আর্থরাইটিস এবং কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। কৃষ্ণচূড়া গাছের শিকড়, বাকল এবং ফুল সবই পরজীবী সংক্রমণ নিরাময়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।

;

হলুদ আভায় মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে সূর্যমুখী 



শহিদুল ইসলাম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নওগাঁ
ছবি: প্রাণের উচ্ছ্বাসে সূর্যমুখী

ছবি: প্রাণের উচ্ছ্বাসে সূর্যমুখী

  • Font increase
  • Font Decrease

মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে সূর্যমুখী। বাস্তব জীবনের নিস্তব্ধতা ভাঙছে তার হলুদ আভায়। মৌমাছির আলিঙ্গন পেতে ছড়াচ্ছে উষ্ণ মুগ্ধতা। হলুদের কারুকার্যে বিমোহিত হচ্ছে পথিকের মন। লুকায়িত সৌন্দর্য প্রকৃতির মাঝে তুলে ধরে প্রবল আকর্ষণে টানছে দর্শনার্থীদের। সবুজ পাতা ভেদ করা সেই অনিন্দ্য হাসি যেন কৃষকের মুখেরই প্রতিচ্ছবি। সূর্যমুখী ফুল চাষে জনপ্রিয়তা বাড়ছে কৃষকদের মাঝে।

সূর্যমুখী এক ধরনের একবর্ষী ফুলগাছ। সূর্যমুখী গাছ লম্বায় ৩ মিটার (৯ দশমিক ৮ ফুট) হয়ে থাকে। ফুলের ব্যাস ৩০ সেন্টিমিটার (১২ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়। এই ফুল দেখতে কিছুটা সূর্যের মতো এবং সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে বলে এর এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। ফুলের বীজ হাঁস-মুরগির খাদ্যরূপে ও তেলের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

জানা যায়, বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের উৎস হিসেবে ১৯৭৫ সাল থেকে এ ফুলের চাষ শুরু হলেও কৃষকের মাঝে জনপ্রিয়তা পায় নি বহুদিন। পরে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। বর্তমানে রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, নাটোর জেলা, পাবনা, নওগাঁ, দিনাজপুর, গাজীপুর, টাঙ্গাইল প্রভৃতি জেলাতে এর ব্যাপক চাষ হচ্ছে।

সূর্যমুখীর বাঁধভাঙা হাসি আর প্রাণের উচ্ছ্বাস

সোমবার (১২ মে) সকালে সরেজমিনে নওগাঁ সদর উপজেলার মুক্তির মোড় কেন্দ্র শহীদ মিনারের পাশে দেখা যায়, সূর্যমুখী বাতাসে; দুলছে আলোর প্রতিফলনে পাপড়িগুলো যেন চকচকে হলুদ আভা ছড়াচ্ছে। মৌমাছি এক ফুল থেকে অন্যফুলে মধু আহরণে ছুটাছুটি করছে আর এসব দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে পথচারীরা। এছাড়াও নওগাঁর বেশ কিছু অঞ্চলে চাষ হচ্ছে সূর্যমুখী। একদিকে যেমন ফুলগুলো সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে তেমনি বীজ থেকে ভোজ্য তেল উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে সূর্যমুখীর বীজ। সূর্যমুখী গাছ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। 

প্রতিদিন ভোরে সূর্যমুখী বাগানের সকল গাছ অনেকটা পূর্বদিকে মুখ করে থাকে। যেদিকে সূর্য দেখা দেয় এবং ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে থাকে। সূর্যের সাথে সাথে সূর্যমুখীগুলোও ধীরে ধীরে নিজেদের দিক পাল্টাতে থাকে। সূর্য যেদিকে যায় তারাও সেদিকে যায়। সবসময়ই এগুলো সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। সূর্য যখন পশ্চিম দিকে অস্ত যায় তারাও তখন পশ্চিম দিক বরাবর থাকে। অস্ত যাওয়ার পরে তারা রাতব্যাপী আবার উল্টো দিকে ঘুরে পূর্বমুখী হয়। এভাবে শুকিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের এই চক্র চলতেই থাকে।

সূর্যের সাথে সাথে নিজেদের দিকও পাল্টাতে থাকে সূর্যমুখী

তবে সবার মাঝে একটি প্রশ্ন অনেক সময় ঘুরপাক খায় যে সূর্যমুখী ফুল কেন সূর্যে দিক হয়ে থাকে! সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের একটি দল সূর্যমুখীর এই দিক পরিবর্তন সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যের রহস্য উন্মোচন করেছেন। তাদের গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসে সূর্যমুখীরা তাদের নিজস্ব সার্কাডিয়ান চক্রে আবদ্ধ। এই চক্র সচল থাকার কারণে সূর্যমুখীরা সব সময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। গবেষকরা সায়েন্স জার্নালে তাদের গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশ করেছেন। সার্কাডিয়ান চক্র বা সার্কাডিয়ান ঘড়িকে অনেক সময় ‘দেহঘড়ি’ নামেও ডাকা হয়। মানুষের মাঝেও এই চক্র বিদ্যমান। যেমন প্রত্যেক মানুষেরই দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম চলে আসে।

পথচারী রায়হান বলেন, ফুল শুভ্রতার প্রতীক ও পবিত্র। ফুলকে যারা ভালোবাসে তাদের মনটাও সুন্দর। সূর্যমুখী ফুল সব ফুলের চেয়ে আলাদা কারন সূর্যের দিক মুখ করে বেশিরভাগ থাকে এ ফুল। বিশেষ করে দুপুর শুরু হলে সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে এ ফুল যা দেখতেও খুব সুন্দর লাগে তাছাড়া এ ফুলের বীজ থেকে তেল হয় যা অনেক স্বাস্থ্যকর।

ক্ষুদে শিক্ষার্থী আফরিন (১০) জানায়, আমি ফুল খুবই ভালোবাসি আর সূর্যমুখী ফুলগুলো হলুদ হবার কারনে আরো বেশি ভালো লাগে। নামটা যেমন সুন্দর তেমনি মুগ্ধতাও ছড়ায়। ফুলগুলো থেকে তেল হয় তাই কোনোভাবেই নষ্ট করা যাবে না। আমরা দূর থেকে দেখেই শান্তি পাই।

সূর্যের সাথেই একাত্মতা সূর্যমুখীর

স্থানীয় বাসিন্দা আরেফিন তুহিন বলেন, স্বল্প পরিসরে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য যারা সূর্যমুখী ফুলের গাছ লাগিয়েছে তারা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। ফুল মানেই সুন্দর সূর্যমুখীও এটিএ ব্যাতিক্রম নয়। মাঝে মাঝে যখন ফুলের দিকে চোখ যায় খুব ভালোলাগা কাজ করে। এ ফুল দেখতে যেমন সুন্দর এটির তেল ও খুব পুষ্টিকর।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে চলতি অর্থবছরে সূর্যমুখী চাষের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ হেক্টর ও অর্জন হয়েছে ৬৫ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন হয়েছে ১০০ মেট্রিক টন। 

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বার্তা২৪.কমকে বলেন- সূর্যমুখী একদিকে যেমন শুভ্রতার প্রতীক আবার অন্যদিকে বীজ থেকে তেল উৎপাদন হয় আবার মধুও পাওয়া যায়। বাজারে যে ভৈজ্যতেল গুলো রয়েছে যেমন, সয়াবিন,সরিষা, পাম-ওয়েল ইত্যাদি এগুলোর চেয়েও অনেক বেশি পুষ্টিগুণ আছে সূর্যমুখীর তেলে যা স্বাস্থ্যকর এবং স্বাস্থ্যর জন্য খুবই উপকারী। আমরা বেশি বেশি উৎপাদনে কৃষকদের সব রকম পরামর্শ দিয়ে থাকি।

;

ওই আকাশে লুকিয়ে আছে মা



সহিদুল আলম স্বপন, লেখক জেনেভা সুইজারল্যান্ড
ওই আকাশে লুকিয়ে আছে মা

ওই আকাশে লুকিয়ে আছে মা

  • Font increase
  • Font Decrease

তো ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকের কথা, তখন সুইস কোম্পনী ফাদসা এস এ তে চাকরী করি। হঠাৎ একদিন কোম্পানীর মালিক মশিউয়্যু মিশেল লাসের (বাংলায় জনাব মিশেল ল্যাসার) তার অফিসে ডেকে পাঠালেন।আমিতো ভয়ে দিশেহারা, ভাবলাম ফ্রেন্স ভাষা না জানার কারণে আমার মনে হয় এবার চাকরীটাই গেল। বলে রাখা ভালো, সুইজারল্যান্ডের চারটি সরকারী ভাষার(ফরাসী, সুইস জার্মান, ইতালীয়ান এবং রোমন্স - রোমান নয়)মাঝে জেনেভা ফরাসী ভাষাভাষী।নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটা ভ্যানিশিং ক্রিমের পাবলিসিটি ছিল-ম্যানোলা সিবোঁ ভ্যানিশিং ক্রিম নিয়ে এলো ফরাসী সৌরভ। পরে জেনেছি সিবোঁ ফরাসী শব্দ যার অর্থ খুব ভালো (হয়তো বাংলায় বুঝাতে চেয়েছেন সুগন্ধময়)-আর এটাই শুধু আমার ফরাসী ভাষার ভান্ডার।

যাই হোক, ভয়ে ভয়ে তাঁর খাস কামরায় হাজির হলাম।দেখি কামরায় সোফার এককোনে প্যাট্রিক(আমার সুইস সহকর্মী আমার চেয়ে বছর দুয়েক এর ছোট হবে)আর লরেতা মার্টিনি এইচ আর হেড বসে আছে। বুঝতে আর দেরী হলোনা, এখনি বস বলবেন ইউ আর ফায়ার এবং প্যাট্রিককে তোমার সব কাজগুলো বুঝিয়ে দাও।

কোথায় ফায়ার তা না বলে মশিউয়্যু লাসের বললেন মাই ডিয়ার, আগামী সপ্তাহে প্যাট্রিক আর আলম (আমি) তোমরা দুজনে রটারডাম যাচ্ছো ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং এর জন্য। আলম তুমি কাল ভোরে বার্ণ(সুইজারল্যান্ডের রাজধানী)যাবে নেদারল্যান্ডের ভিসা করাতে। লরেতা তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবে। বলে রাখা ভালো তখনো আমি সুইস নাগরিক হয়ে উঠিনি, আর মশিউয়্যু মিশেল লাসের ই আমাকে সুইজারল্যান্ডে স্হায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

রটারডাম উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্র নেদারল্যান্ডসের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর( আমস্টারডামের পরেই)।এটি ইউরোপের বৃহত্তম ও বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর।নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণ হল্যান্ড প্রদেশে, উত্তর সাগরের তীরে, রাইন নদীর মোহনায় অবস্থিত এই বন্দর শহরকে প্রায়শই "ইউরোপের প্রবেশদ্বার" নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

তো যেই কথা সেই কাজ, সমস্ত আনুষ্ঠিকতা শেষে সপ্তাহান্তে কেএলএম রয়্যাল ডাচ এয়ারলাইন্সে চেপে জেনেভা থেকে আমস্টারডামের শিফল বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলাম। আমস্টারডাম শিফল বিমানবন্দর থেকে ট্রেনে রটারডাম সেন্ট্রাল ট্রেন ষ্টেশনে এসে নামলাম। সেখান থেকে টেক্সীকরে সরাসরি রটারডাম ম্যারিয়ট হোটেলে।রটারডাম স্কুল অফ ম্যানেজমেন্ট, ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি (আরএসএম) ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় বিসনেস স্কুলগুলির মধ্যে একটি, এখানেই আমাদের কোর্স। বাংলাদেশ আর নেদারল্যান্ডসের মাঝে চার পাঁচ ঘন্টার পার্থক্য। প্রতিদিন বাবা -মা সাথে কথা হয়। বাবা আমার জ্ঞানের পাগল। ৬০ বছর বয়সে উনি তাঁর মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। কিন্তু বাবা মা দুজনের কেউ মানতে পারছিলেন না আমি বিদেশে থাকি। দেশে থাকতে মা এর আহাজারীতে বাবা বিভিন্ন কায়দায় বাংলাদেশ মিলিাটারী একাডেমী থেকে আমায় ছাড়িয়ে এনেছিলেন। রাতে ঘুমাতে যাবার আগের মা কে ফোন করে ঘুমাই। বরাবরের মতে ১৮ ই ফেব্রুয়ারি রাতে মার সাথে কথা বলছি, মা আমার প্রাইমেরীর গন্ডি পেরুনো কিন্তু শিক্ষার প্রতি তাঁর পরম শ্রদ্ধা। গান-নাটক সংস্কৃতির পাগল আমি। মা আমার প্রতিদিন ই জিজ্ঞেস করেন কেমন চলছে গান-বাজনা। অনেক গুলো নূতন গানের ক্যাসেট কিনে রেখেছেন তিনি, সুইজারল্যান্ডে ফিরলেই ডাকযোগে পাঠিয়ে দিবেন, আমার প্রিয় কুমিল্লার খদ্দরের হাউয়াই শার্টসহ। আরো কত কথা, শেষ হয়েও হয়না শেষ। মায়ের প্রতিটি কথায় সেকি এক অনুপ্রেরণা। আজ বাংলাদেশে শেষ রোজা। পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার রোজার ঈদ।

পরদিন ক্লাস নেই, ভেবে রেখেছি সকালে ব্রেকফাস্ট না করে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে ফ্রেস হয়ে তারপর সারাদিন ঘুরে বেড়াবো, দেখবো বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভাবনী বন্দর, রটারডাম চিড়িয়াখানা, রিমাস্টারড" ডিজিটাল আর্ট অডিওভিজ্যুয়াল, ইউরোমাস্ট টাওয়ার, কিউব হাউস ইত্যাদি আর রাতে যাবে বাইয়্যাবীচ ক্লাবে নাচতে।

হোটেল রুমের সাইড টেবিলে রাখা ফোনটা সাত সকালেই আজ চিৎকার করে কান্না করে চলেছে, ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং……। ফোনটা যেন পাগল হয়ে গেছে। বিরক্ত হয়েই মিনিট খানেক পর আঁধো বোজা চোখে ফোনটা কানের কাছে নিয়ে বললাম, হোয়াট দ্যা হেল প্যাট্রিক, লেট মি গেট সাম স্লিপ । ফোনের ঐ প্রান্ত থেকে ভেসে এলো ভাইয়া আমি ফরিদ(আমার ছোট বোন পান্নার বর), এক নি:শ্বাসে বলে চলছেন, ভাইয়া আমরা এই মাত্র কবরস্তান থেকে আসলাম, সব কিছুই ঠিক ছিল, দাফন- কাফন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে, কেঁদে আর কি করবেন, আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, এইযে আব্বার সাথে কথা বলেন, আম্মাতো কাউকে কষ্ট দেননি, আল্লাহর কাছে আম্মার রুহের মাগফিরাত কামনা করে নামাজ পড়ুন যেন উনাকে আল্লাহ জান্নাতে স্হান করে দেন।চোখের জলে বালিশ ভিজেঁ যাচ্ছে আমি আজো প্রতিনিয়ত গেয়ে চলছি - " সবাই বলে, "ওই আকাশে লুকিয়ে আছে" "খুঁজে দেখ, পাবে দূর নক্ষত্রমাঝে"রাতের তারা, আমায় কি তুই বলতে পারিস কোথায় আছে, কেমন আছে মা? ভোরের তারা, রাতের তারা, মা-কে জানিয়ে দিস অনেক কেঁদেছি আর কাঁদতে পারি না।

;

১২ মে: আন্তর্জাতিক মা দিবস, মায়েদের ত্যাগের স্বীকৃতির দিন



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

মা পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াবী শব্দ। এটি কেবল একটি ডাক নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারও আবেগ, সুখ-দুঃখ, ব্যথা, আনন্দ, আকাঙ্ক্ষা, অভিযোগ- না জানি আরো কত কত অনুভূতি!

হাদিসে বলা আছে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। সনাতন ধর্মের পুরাণে লিখিত রয়েছে- জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী অর্থাৎ মা এবং জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এমনকী অন্যান্য ধর্মগ্রন্থেও জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি অশেষ ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷

অশেষ কষ্ট সহ্য করে আমাদের লালন-পালন করেন জন্মদাত্রী মা। তাদের কষ্ট উপলব্ধি করতে উদযাপন করা হয়, আন্তর্জাতিক মা দিবস। এই বিশেষ দিনে মা এবং মাতৃসমতুল্যদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। সারাবিশ্বের অনেক দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রোববার উদযাপিত হয়, আন্তর্জাতিক মা দিবস। এই দিনটি ‘মাদারিং সানডে’ নামেও পরিচিত। এ বছর ১২ মে পড়েছে মা দিবস।

মা দিবসের আদি ইতিহাস
আন্তর্জাতিক মা দিবসের ইতিহাস বিষয়ে উইকিপিডিয়ায় লেখা হয়েছে, মা দিবস বা মাতৃ দিবস হলো একটি সম্মান প্রদর্শনের অনুষ্ঠান যা, মায়ের সম্মানে এবং মাতৃত্ব, মায়ের প্রতি ঋণ হিসেবে এবং সমাজে মায়েদের ভূমিকার জন্য উদযাপন করা হয়। বিশ্বের অনেক অঞ্চলে বিভিন্ন দিনে, সাধারণত মার্চ, এপ্রিল বা মে মাসে উদ্‌যাপন করা হয়।

বিশ্বের সবখানে মায়ের এবং মাতৃত্বের অনুষ্ঠান উদযাপন করতে দেখা যায়। এগুলির অনেকই প্রাচীন উৎসবের সাক্ষ্য। যেমন- সিবেল গ্রিক ধর্মানুষ্ঠান, হিলারিয়ার রোমান উৎসব, যা গ্রিকের সিবেল থেকে আসে অথবা সিবেল এবং হিলারিয়া থেকে আসা খ্রিস্টান ‘মাদারিং সানডে’ অনুষ্ঠানের মতোই।

একটি গোষ্ঠীর মতে, এই দিনটির সূত্রপাত প্রাচীন গ্রিসের মাতৃ আরাধনার প্রথা থেকে, যেখানে গ্রিক দেবতাদের মধ্যে এক বিশিষ্ট দেবী সিবেল-এর উদ্দেশে পালন করা হতো। এশিয়া মাইনরে মহাবিষুবের সময়ে এবং তারপর রোমে আইডিস অব মার্চ (১৫ মার্চ) থেকে ১৮ মার্চের মধ্যে এই উৎসবটি উদযাপন করা হতো।

প্রাচীন রোমানদের ম্যাত্রোনালিয়া নামে দেবী জুনোর প্রতি উৎসর্গিত আরো একটি ছুটির দিন ছিল। সেদিন মায়েদের উপহার দেওয়া হতো। মাদারিং সানডে-তে ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে অনেক দিন আগে থেকেই বহু আচারানুষ্ঠান ছিল, যেখানে মায়েদের এবং মাতৃত্বকে সম্মান জানানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট রোববারকে আলাদা করে রাখা হতো।

মাদারিং সানডের অনুষ্ঠান খ্রিস্টানদের অ্যাংগ্লিকানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পঞ্জিকার অঙ্গ। ক্যাথলিক পঞ্জিকা অনুযায়ী, এটিকে বলা হয়, ‘লেতারে সানডে’ যা লেন্টের সময়ে চতুর্থ রোববার পালন করা হতো ভার্জিন মেরি বা কুমারী মাতার ও প্রধান গির্জার সম্মানে।

প্রতি বছরের মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পৃথিবীর সব মায়ের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি জানানোর দিন, গ্রাফিকস- সংগৃহীত

প্রথানুযায়ী, দিনটিতে প্রতীকী উপহার দেওয়া এবং কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রান্না আর ধোয়ামোছার মতো মেয়েদের কাজগুলো বাড়ির অন্য কেউ করার মাধ্যমে উদযাপন করা হতো।

জুলিয়া ওয়ার্ড হোই রচিত ‘মাদার্স ডে প্রোক্লেমেশন’ বা ‘মা দিবসের ঘোষণাপত্র’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবস উদযাপনের গোড়ার দিকের চেষ্টাগুলির মধ্যে অন্যতম।

আমেরিকান গৃহযুদ্ধ ও ফ্রাঙ্কো-প্রুশীয় যুদ্ধের নৃশংসতার বিরুদ্ধে ১৮৭০ সালে রচিত ‘হোই’-এর মা দিবসের ঘোষণাপত্রটি ছিল একটি শান্তিকামী উদ্যোগ। রাজনৈতিক স্তরে সমাজকে গঠন করার ক্ষেত্রে নারীর একটি দায়িত্ব ও ভূমিকা আছে, হোই-এর এই নারীবাদী বিশ্বাস ঘোষণাপত্রটির মধ্যে নিহিত ছিল।

ঘোষণা
১৯১২ সালে আনা জার্ভিস ‘মাদার'স ডে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোশিয়েশন (আন্তর্জাতিক মা দিবস সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেন।

জানা যায়, ভার্জিনিয়ায় অ্যান নামে একজন শান্তিবাদী সমাজকর্মী ছিলেন। অ্যান ছিলেন খুবই ধর্মপ্রাণ এবং নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। তিনি ‘মাদারস ডে ওয়ার্ক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছোট ছোট ওয়ার্ক ক্লাব বানিয়ে সমাজের পিছিয়েপড়া নারীদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য চেষ্টা চালাতেন। নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য তিনি উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিতেন।
অ্যানের একটি মেয়ে ছিল। তার নাম ছিল- আনা মারিয়া রিভস জার্ভিস।

একদিন ছোট মেয়ের সামনেই অ্যান হাত জোড় করে বলেছিলেন, আমি প্রার্থনা করি, একদিন কেউ না কেউ, কোনো মায়েদের জন্য একটা দিন উৎসর্গ করুক। কারণ, মায়েরা রোজ মনুষ্যত্বের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন। একটি দিন উৎসর্গ করা তাদের অধিকার।

মায়ের সেই প্রার্থনা হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায় আনার। অ্যানের মৃত্যুর দিনটিকে সারাবিশ্বের প্রতিটি মায়ের উদ্দেশে উৎসর্গ করেন তিনি। তার পর থেকে মায়েদের প্রতি সম্মানে উদযাপিত হয়ে আসছে, আন্তর্জাতিক মা দিবস হিসেবে।

১৯১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ‘মা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকে প্রতিবছরের মে মাসের দ্বিতীয় রোববার আন্তর্জাতিক মা দিবস উদযাপন করা হয়ে থাকে।

;