মাটিতে বসে ২০ হাজার কেজির ক্রেন টেনে বিশ্ব রেকর্ড!
ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
জর্ডান স্টিফেনসন। ছবি: সংগৃহীত
ফিচার
২০ হাজার ৩০০ কেজির (২০.৩ টন) হাইড্রোলিক ক্রেন ধরি ধরে পাঁচ মিটার দূরত্ব টেনে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক জর্ডান স্টিফেনসন (৩৩) আগের বিশ্ব রেকর্ডটি ভেঙে দিয়েছেন। আগের রেকর্ডটি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক কেভিন ফাস্টের দখলে ছিল। ২০২১ সালে তিনি ১৩ হাজার ৮৬ কেজির একটি পাবলিক বাস টেনেছিল। জর্ডান শরীরের ওপর অংশ দিয়ে ভারী বাহন টানা ক্যাটাগরিতে এ রেকর্ড গড়েছেন। গত বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
জর্ডান জানান, আমি একজন বডিবিল্ডার পাশাপাশি এর কোচ হিসেবে কাজ করছি। ছয় মাস ধরে এই রেকর্ড করার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এর জন্য আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু, এই রেকর্ড করার পর এখন নিজের কাছে খুবই ভালো লাগছে।
রেকর্ড ভাঙার কয়েক সপ্তাহ পরে আবার একই ধরনের সক্ষমতা দেখান। তিনি অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ‘রয়্যাল অ্যাডিলেড শোতে’ ওই সক্ষমতা দেখিয়ে প্রায় ৪০ হাজার অস্ট্রেলীয় ডলার তহবিল সংগ্রহ করেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় এই অর্থের পরিমাণ ২৮ লাখ টাকার বেশি। এই তহবিল তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশুদের সহায়তাদানকারী স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান স্টারলাইট চিলড্রেনস ফাউন্ডেশনকে দান করেন।
এই রেকর্ডের জন্য প্রতিযোগীকে বসার অবস্থানেই থাকতে হবে। কোমর থেকে শরীরের ওপর অংশের শক্তি দিয়ে বাহন টানতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগী তাঁর পা দিয়ে কোনো ধরনের শক্তি উৎপাদন করতে পারবেন না। এই ক্যাটাগরিতে প্রতিযোগীকে তাঁর পিঠ ও দুই হাতের মাংসপেশির ওপর প্রধানত নির্ভর করতে হয়।
অবশ্য জর্ডানের এই কাজ এবারই প্রথম নয়। ২০২১ সালে তিনি ১৮৪ টন ওজনের একটি ট্রেন টেনে বিশ্ব রেকর্ড করেছিলেন। তবে সেটা এক বছর পরই মিশরের আশরাফ মোহাম্মদ সুলিমানের কাছে হারাতে হয়েছে।
আগামী মাসে আরও বেশি রেকর্ড ভাঙার বড় পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান জর্ডান। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আরও অবিশ্বাস্য শক্তিশালী স্টান্টগুলো করে দাতব্যে সংস্থার জন্য অর্থ সংগ্রহ করার ইচ্ছে রয়েছে তাঁর।
‘অ-এ অজগর আসছে তেড়ে!’ সত্যি সত্যিই এবার অজগর তেড়ে এসে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি ভারতের উত্তর প্রদেশে ১৪ ফুট লম্বা এক অজগর উদ্ধার করা হয়েছে। বিশাল আকারের এই অজগর সাপ একটি কাপড়ের দোকনে পাওয়া গেছে। সাপটি দোকানের ভেতরে কুন্ডলি পাকিয়ে বসে ছিল। ঘটনাটি ঘটেছে মেরুটের লালকুর্তি পীঠ এলাকায়। ইতিমধ্যে সাধারণ জনগণের মধ্যে অনেক আতঙ্ক তৈরি করে ফেলেছে এই অজগর কাহিনী।
দোকানের মালিক রবি কুমার বলেছেন, 'তারা অতিসত্তর দোকান থেকে বাইরে বের হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি এবং তার কর্মচারীরা ক্রেতাদেরসহ দ্রুত বাইরে চলে আসেন এবং মেরুট বনবিভাগের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন।'
তিনি আরও জানান তখন দোকানে অনেক ক্রেতার ভিড় ছিল। হঠাৎ একজন ক্রেতা সাপটিকে দেখতে পান। কাপড়ের একটি র্যাকের উপর সাপটি পেচিয়ে বসে ছিল। দেখতে পেয়ে তিনি ভয়ে চিৎকার করে ওঠেন। এতে পুরো দোকানের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে যায়। সেখানে উপস্থিত এক কর্মচারী সাপটির অবস্থান খুঁজে বের করে এবং দোকানের মালিককে গিয়ে সাথে সাথে খবর দেয়। এই সম্পূর্ণ ঘটনায় রবির দোকানসহ আশেপাশের সবা্ই অনেক ভয় পেয়েছে।
কেউ জানেনা সাপটি এখানে কিভাবে এলো। সবাই দোকানের কাছাকাছি যেতেও ভয় পাচ্ছিল। এর প্রায় দেড় ঘণ্টা পর বনবিভাগ থেকে একটি টিম সেখানে উপস্থিত হয়। তারা সফলভাবে সাপটিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার হচ্ছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, বিশাল অজগরটি দোকানে কাপড়ের তাকের উপর নড়াচড়া করছে। মেরুট বনবিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন তারা সাপটিকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছেন। এরপর সাপটিকে বনের অভয়ারণ্যে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই অজগর সাপ এখন বিপদমুক্ত রয়েছে।
পৃথিবীতে খাওয়ার জন্য কত হাজারও রকমের সুস্বাদু খাবারই না রয়েছে, কিন্তু এসব বাদে কাউকে বেবি পাওডার খেতে দেখেছেন? কিংবা শুনেছেন? আশ্চর্য মনে হলেও এই ঘটনাই ঘটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
ড্রেকা মার্টিন নামে এক মার্কিন নারী প্রতিদিন জনসনের বেবি পাউডার খেতে পছন্দ করেন বলে স্বীকার করেছেন। সংবাদমাধ্যম মিররের বরাতে ড্রেকার এই বেবি পাউডার খাওয়ার খবর প্রকাশ করেছে এনডিটিভি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৭ বছর বয়সী ড্রেকা মার্টিন যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের নিউ অর্লিন্সের বাসিন্দা। দিনে ৬২৩ গ্রামের গোটা এক বোতল জনসন অ্যালোভেরা এন্ড ভিটামিন ই বেবি পাউডার খাওয়ার অভ্যাস তার। এ বছর এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ডলারের বেবি পাউডার খেয়েছেন তিনি।
ড্রেকা মার্টিন বলেছেন, ‘প্রথমে তিনি তার বাচ্চাদের গোসল করার পরে পাউডারের স্বাদ কেমন তা বোঝার জন্য কৌতুহলবশত একটু চেখে দেখেছেন। কিন্তু তারপরে তিনি এই পাউডার স্বাদের লোভে পরে যান।। পরবর্তীতে এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়’।
এই অদ্ভুত রকমের খাবারের অভ্যাস ত্যাগ করার বিষয়ে জানতে চাইলে ড্রেকা বলেন, তিনি বরং "স্বাভাবিক খাবার" ছেড়ে দিবেন কিন্তু এই পাউডার খাওয়ার অভ্যাস ছাড়তে পারবেন না। জনসনের এই সাদা পাউডারের স্বাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘এটি মুখে দিতেই গলে যায়’।
শিশুদের ত্বকের জন্য জনসনের বেবি পাউডার তৈরি করা হলেও এতদিন ধরে পাউডার খেয়ে হজমের কোন সমস্যা হয়নি বলে জানিয়েছেন ড্রেকা। বেবি পাউডার খাওয়া এক ধরনের আসক্তিতে পরিণত হয়েছে।
ড্রেকা নিজের পাউডার আসক্তি নিয়ে বলেন, ’আমি বেবি পাউডার খেতে খুবই ভালবাসি। এর যেমন গন্ধ, তেমন স্বাদ। খেতে খুব ভাল লাগে আমার। তবে আমি পাউডার খাওয়া ছাড়তে চাই, কিন্তু আমি পারছিই না’।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে পরিবারের কেউ এ বিষয়টা জানতো না। কিন্তু ২ মাস ব্যবহার করা পাউডারের বোতল যখন ১ সপ্তাহেই শেষ হয়ে যাওয়া শুরু করল তখন আমার মা বিষয়টি ধরে ফেলে। এরপর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুরা আমাকে বোঝায়, পাউডার খেলে আমি অসুস্থ হয়ে যাবো। আমিও তাদের কথায় চেষ্টা করেছি পাউডার না খেতে। কিন্তু এটা এতো সহজ না, আমি এখনো গন্ধ শুঁকি, এরপর আর নিজেকে আটকাতে পারি না। এমনকি যদি আমি ভ্রমণ করি তখনও আমার সবসময় বেবি পাউডার দরকার হয়। আমি অন্তত তিনটি বোতল প্যাক করে নিয়ে যায় যাতে আমার ফুরিয়ে না যায়’।
পেশায় একজন মেকআপ আর্টিস্ট ড্রেকা অবশ্য নিজের অভ্যাস নিয়ে চিন্তিত না হলেও তার ছোট্ট শিশুকে নিয়ে শঙ্কিত। ছেলে যদি তাকে অনুকরণ করে এই নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে এই উদ্বেগ থাকলেও আপাতত ড্রেকা বেবি পাউডার খাওয়া ছাড়বেন, এমন কোনো পরিকল্পনা তার নেই বলে জানান।
পথের পাঁচালীর সেই ‘অপু-দুর্গা’র দেখা মিলছে কক্সবাজারেও!
তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
পথের পাঁচালীর সেই ‘অপু-দুর্গা’র দেখা মিলছে কক্সবাজারেও!
ফিচার
অপু: দিদি রেলের গাড়ি দেখেছিস?
দুর্গা: হ্যাঁ
অপু: রেলের রাস্তা কোথায় জানিস, কোথায় রে?
দুর্গা: ওই তো, সোনাডাঙার মাঠ, তারপর ধানখেত, তারপর রেলের রাস্তা।
অপু: একদিন যাবি?
তারপর একদিন, শরৎকালের বিকেলবেলা। দিগন্ত বিস্তৃত সাদা কাশফুলের আড়াল থেকে ভেসে আসছে ট্রেনের-‘কু ঝিক ঝিক’। কোথা হতে আসছে সেই সুমধুর ডাক, কান পেতে প্রাণপণে সেদিকে ছুঁটছে অপু-দুর্গা, দুই ভাইবোন। একটু পরেই ধরা দিল সেই অনন্য মুহূর্ত, কালো ধোঁয়া উড়িয়ে সাপের মতো এগিয়ে আসছে রেলগাড়ি। দু চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে ট্রেনের চলে যাওয়া দেখছিল অপু-দুর্গা। কিংবদন্তী চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীর সেই অমর ফ্রেম, যা বাঙালির নস্টালজিয়ায় চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছে। দৃশ্যটা সাদা কালো বটে। কিন্তু ৭০ বছরের পুরনো সেই ফ্রেমটা আজও যেন রঙিন হয়ে গেঁথে আছে ট্রেনপ্রেমী প্রতিটি মানুষের মনে, একেবারে টাটকা হয়ে!
অপু-দুর্গার সেই ছবিটা যেন এবার বাস্তব কক্সবাজারেও। পাহাড় জঙ্গল আর সমুদ্রের প্রতিবেশি পর্যটননগরীতে ১ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো ছোঁটে বাণিজ্যিক ট্রেন। গ্রামের পর গ্রামের প্রত্যন্ত পথ ধরে সেই ট্রেন যাত্রার ‘মধূচন্দ্রিমা’ চলছে এখনো। একইদিনে দুইবার ঢাকা-কক্সবাজার, কক্সবাজার-ঢাকায় আসা যাওয়ার মাঝে ৬৯২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া কক্সবাজার এক্সপ্রেস ‘ঘুম ঘুম চোখ’ আর ‘ক্লান্ত পায়ে’ এগিয়ে গেলেও যেন বিরতি নেই শিশুদের আগ্রহের। প্রতিদিন তাই রেললাইন থেকে দূর নয় এমন পথে দাঁড়িয়ে সেই ট্রেনের দেখতে অপু-দুর্গার মতো জমছে অবাক শিশু-কিশোরের জটলা। তাঁদের কেউ প্রথমবার ট্রেন দেখছে, কেউবা বারাবার দেখছে-কিন্তু কৌতূহল যে ফুরায় না।
সময়টা ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, ব্রিটিশ শাসনামলের স্বর্ণযুগ। ক্যালেন্ডারের হিসেবে দিনটি ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর। সেইদিন প্রথমবারের মতো রেলগাড়ির পা পড়ে বর্তমান বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির তৈরি ব্রডগেজ রেলপথ ধরে পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাট থেকে একটি ট্রেন এসে থামে কুষ্টিয়ার এক রেলস্টেশনে। যে স্টেশনের কাগুজে নাম ‘জগতি’।
এরপর ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে রেলপথের শরীর। সেই ধারাবাহিকতায় অবিভক্ত আসাম রেলওয়ে ১৯২৯-৩১ সালে চট্টগ্রাম শহর থেকে দোহাজারী পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৭ কিলোমিটারের রেলপথ নির্মাণ করে। এরপর কেটে যায় কত মাস, বছর, দীর্ঘ সময়। কিন্তু দক্ষিণে আর এগোয়নি রেলপথের দৈর্ঘ্য। দোহাজারি এসে ট্রেন থেমে যেত বলে অনেকেই এর নাম দেন-আখেরি স্টেশন। যে স্টেশন ঘিরে গত শতাব্দির ষাটের দশকে তখনকার জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী রহমান-শবনমকে নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল ‘আখেরি স্টেশন’ নামের সিনেমাও। মানুষের আবেগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা স্টেশনটি ঘিরে মুগ্ধতা তাই থাকত বারোমাস। তবে ধীরে ধীরে ট্রেনের অভাবে সেই স্টেশনটি হয়ে পড়ে বড্ড নিঃসঙ্গ, মুখর অপেক্ষাকক্ষ হয়ে যায় প্রায় পরিত্যক্ত। সেই ভাটায় পানি আসে রেলপথ ঘুমধুম পর্যন্ত প্রসারের উদ্যোগ নেওয়ার পর। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার লাইন অবশ্য এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। কক্সবাজারবাসীর শত বছরের অপেক্ষাও তাই ফুরিয়ে গেছে এক লহমায়।
এই ট্রেনকে ঘিরে আবেগের বিস্ফোরণ তাই দেখা যাচ্ছে একটু বেশিই। কেননা ট্রেনে চড়া তো দূরের কথা, লাইন দিয়ে ছুটে যেতেও দেখেনি এই জেলার অনেক মানুষ। সেই ট্রেন এখন হাতের কাছেই। তাই তো ট্রেন দেখার জন্য পড়া ফেলে ছুটে আসছে ছেলেমেয়েরা। হুইসেল বাজলে কাজের ফাঁকে এসে বড়রাও দু চোখ ভরে ট্রেন দেখার সাধ মেটাচ্ছেন। এ যে অধরাকে দেখার আনন্দ, অচেনাকে চেনার আনন্দ!
ফসলের মাঠ, নদী আর বনভূমি পেরিয়ে চকরিয়া স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে মনে হবে এই তো পথের পাঁচালীর সেই এক টুকরো নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম। শরৎ অতীত হয়েছে বলে সেই কাঁশফুল নেই বটে, কিন্তু রেললাইনের দু ধারে মাথা দোলানো ধান-সবজি গাছেরা মনে করিয়ে দেয় গ্রামের অপার সৌন্দর্য!
সেই পথ ধরে ট্রেন রাজকীয় চালে হেলেদুলে ভেঁপু বাজিয়ে এগিয়ে গেলেই ধান খেতের বুক চিরে গড়ে উঠা আইল ধরে দৌড়ে দৌড়ে আসে ‘অপু-দুর্গার’ দল। বাণিজ্যিক ট্রেন চলার প্রথমদিন সেই দলে ছিল স্কুলশিক্ষার্থী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। ১০ বছরের আবদুল্লাহ একরাশ বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে বলল, ‘বইয়ের পাতায় দেখেছি ট্রেনের ছবি, বাস্তবে কোনদিন দেখিনি। তাই ভেপু বাজতেই দৌড়ে আসি। সাপের মতো লম্বা শরীর, একেবেকে এগিয়ে আসছে। আবার দেখছি বড় বড় শিসও দিচ্ছে। শুরুতে তাই ভয় পাই। কিন্তু একটু পর সেই ভয় কেটে যায়। উপভোগ করি ট্রেনের এগিয়ে যাওয়ার সৌন্দর্য।’ এ যেন ভয় থেকে ভক্তির গল্প!
আর যারা প্রথমবারের মতো ট্রেনে চড়ে ঢাকায় গেল তাঁদের উচ্ছ্বাসও তো আরও বেশি। সেই দলে ছিল বেসরকারি কর্মকর্তা আবদুর রশিদের শিশুকন্যা নাদিয়া সোলতানাও। বাবার ফোনে নাদিয়া বলল, ‘সাঁ সাঁ করে ট্রেন ছুটছে। জানলার বাইরে দ্রুতই পেছনে চলে যাচ্ছে গাছপালা, সবুজ মাঠ। এলোমেলো হাওয়া উড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের চুল। প্রথমবার ট্রেনে চড়ার এই স্মরণীয় অভিজ্ঞতা বড় হলেও মনে থাকবে।’
কোনো কাজ ছিল না, তবুও প্রথম ট্রেনে চড়ে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় গিয়েছিলেন আসিফ আসহাব। পরদিন আবার ফিরিও এসেছেন ট্রেনে। এই তরুণ বললেন, ‘সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি পথের পাঁচালীতে ট্রেন ঘিরে দুই ভাই-বোনের আবেগ দেখে ভেবেছিলাম, আসলেই কি এমন হয়? একটা বাহন নিয়েই এত উচ্ছ্বাসের ঢেউ? আমার সেই ভুল ভেঙে গেছে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ট্রেনে একবার চড়ে। কক্সবাজার থেকে যতই ট্রেন চট্টগ্রামের দিকে এগিয়েছে ততই দেখেছি দুই ধারে মানুষের ঢল। কেউ কাজ ফেলে বিলের মাঝ খান দৌড়ে আসছেন, কেউবা বেরিয়ে আসছেন ঘর থেকে। সত্যিই প্রথম দেখার আনন্দের সঙ্গে কিছুর তুলনা হয় না।’
দিন ফুরোলে নাকি উৎসব গত হয়ে যায়, উদযাপন হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ! কিন্তু কক্সবাজার এক্সপ্রেসকে ঘিরে আবেগের ফল্গুধারা যেন বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের মতো বইতে থাকবে আরও বহুদিন। তাই তো ট্রেনের গায়ে ছুঁড়ে মারা ভালোবাসার ফুল শুকিয়ে যাওয়ার আগেই আবার পড়ছে ফুলের আঁচড়। শত বছরের অপেক্ষার পর পাওয়া বহু আরধ্যের এই ট্রেন যে নয় শুধু কোনো বাহন, এ তো এই অঞ্চলের মানুষের আবেগের উৎপত্তিস্থল!
নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল পৌর এলাকার একটি গ্রামের নাম আটিয়াগাঁও। এই গ্রামেই এক স্থানে রয়েছে ১৮ জন মানুষের গণকবর। বর্তমানে সেখানে রয়েছে বাঁশের ঝাড়। অথচ সরকারিভাবে সেই গণকবরগুলো চিহ্নিত করে স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত করে রাখার কথা। তা না করে দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫২ বছর পরও বাঁশঝাড়্টি এখন স্মৃতি। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। আটিয়াগাঁও গ্রামের অরক্ষিত বাঁশঝাড়ের স্থানটিতে পাকবাহিনী ৭১ সালে প্রায় ৩০ জন নিরীহ বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করে এবং তাদেরকে গণকবর দেয়া হয়।
৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালের এই দিনে ঘোড়াশাল আটিয়াগাঁও গ্রামে একই বাড়িতে শিশুসহ ১৮ জন নর-নারীকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাক বাহিনী। পুড়িয়ে দেওয়া হয় গ্রামের বেশকিছু ঘর-বাড়ি। নির্মম হত্যাযজ্ঞে গ্রামের শিশুসহ প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন নারী পুরুষকে গুলি করে হত্যা করে পাক বাহিনী। এরপর থেকে ৬ ডিসেম্বর দিনটি আসলে আজও সেই স্মৃতি মনে করে চোখে পানি এসে যায়। মাঝেমাঝে সেই স্মৃতি মনে হলে আজও মন আঁৎকে উঠে। অথচ দিবসটিকে সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
স্থানীয়রা জানায়, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র ৯ দিন আগে দেশজুড়ে যখন কোণঠাসা পশ্চিমা পাক হানাদার বাহিনী। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘোড়াশাল এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিকামী বাঙালির সাথে কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধ সংগঠিত হয়। বিজয়ের কাছাকাছি সময়ে এসে পাক বাহিনীর সদস্যরা ফিরে যাওয়ার সময় ৬ ডিসেম্বর ঘোড়াশালের আটিয়াগাঁও গ্রামে প্রবেশ করে। গ্রামে প্রবেশ করেই আবুল কাসেম নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে হত্যাকাণ্ড চালায়। এসময় বাড়িতে থাকা ৪ মাসের এক শিশু আয়শাসহ হত্যা করা হয় মোকছেদ আলী, মালাবক্স, শাহাজাহান, রহম আলী, আঃ হেকিম, হযরত আলী, আম্বিয়া খাতুন, মজিদা, শাহাজউদ্দিন, নেহাজউদ্দিন ও নেজুসহ প্রায় ১৮ জন নর-নারীকে। জ্বালিয়ে দেয়া তাদের বাড়িঘর। এভাবে শুধু আটিয়াগাঁও গ্রামেই ২৫ থেকে ৩০ নারী-পুরুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলিতে আহত হয় আরো প্রায় ১০ থেকে ১৫ জন। হত্যাযজ্ঞের পরের দিন মৃতদের মধ্যে অনেককেই গণকবর হিসেবে মাটি দেয়া হয়। সেই গণকবরগুলো আজও অরক্ষিত, ঝোপঝাড়ে পরিণত, সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নেই কোনো উদ্যোগ। আর শহিদ পরিবারের খাতায়ও তাদের নাম আছে কিনা কেউ জানেন না। যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সহায়তায় শহিদের প্রত্যেক পরিবারের জন্য দেয়া দুই হাজার করে টাকা। এছাড়া তাদের ভাগ্যে আর কিছুই সুযোগ সুবিধা ভাগ্যে জোটেনি। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে শহিদদের পরিবারের খোঁজখবর একটিবারের জন্যও কেউ নেয়নি বলে পরিবারগুলোর অভিযোগ।
আটিয়াগাঁও এলাকার শহিদ হযরত আলীর ছেলে মোঃ হাবিবুল্লাহ জানান, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীরা আমার বাবা, দাদি ও ফফুকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। পাক বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে মা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে আমাদের নিঃস্ব করে দেয়া হয়। সেদিন আমাদের চলার মতো তেমন কিছুই ছিল না। আশপাশের গ্রামের লোকজন আমাদের চলার পথে সহায়তা করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার আজ ৫২টি বছর পার হলেও সাংবাদিক ছাড়া কেউ আমাদের কোনো খবর নেয়নি। এছাড়া শহিদ পরিবারের তালিকায় তাদের নাম আছে কিনা তার উত্তরও কেউ দিতে পারেননি। একই এলাকার প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্তার বাবুল এ প্রতিনিধিকে জানান, পাক বাহিনীরা এই এলাকায় প্রবেশ করেই প্রথমে আমাদের ঘরে আগুন দিয়েছিল। তখন বাড়িতে যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করেছে। পাক বাহিনীর সদস্যরা ৪ মাসের শিশুকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। তবে কয়েকজন বাড়ির পাশে একটি গর্ত করে তাতে লুকিয়ে থেকে কোনোক্রমে নিজেকে রক্ষা করেন।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী নারী রাহাতুন বেগম বলেন, তখন অগ্রহায়ণ মাস, বাড়ির পাশেই ধানের কাজ করছিলেন তিনি। এমন সময় পাক বাহিনীর সদস্যরা এসে বাড়িঘরে আগুন দেয়। আর গুলি করে হত্যা করেছে যাকে পেয়েছে তাকেই। পরে নিহতদের গণকবর দেওয়া হয়েছিল। আর এই গণকবরের স্থানে এখন বাঁশের ঝাড়।
এলাকার শহিদদের কবরস্থানে বধ্যভূমি নির্মাণের পাশাপাশি পরিবারগুলোর সহায়তায় সরকারকে পাশে দাঁড়ানোর দাবি জানিয়েছেন, ঘোড়াশাল পৌরসভা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও ঘোড়াশাল পৌর সভার সাবেক কাউন্সিলর বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক ভূইয়া।
এ অঞ্চলের ট্র্যাজেডির কথা উল্লেখ করে শহিদ পরিবারেরগুলোর স্মৃতি রক্ষায় একটি বধ্যভূমি নির্মাণের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন পলাশ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ জাবেদ হোসেন।
বিজয়ের ৫২ টি বছর পেরিয়ে আজ এলাকাবাসীর দাবি হত্যাযজ্ঞে নিহত শহিদদের তালিকা প্রণয়ন, গণকবর তৈরি করে তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদা দানের। এতে বীরমুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশা স্থানীয়দের।