বরিশালের কাশবনে প্রকৃতিপ্রেমীদের ঢল
ঋতুর রাণী শরতের সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ কাশফুল। আর কাশফুলের অপরূপ সৌন্দর্য পুলকিত করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। শরতের মেঘহীন নীল আকাশে গুচ্ছ সাদা মেঘের ভেলা কেড়ে নেয়, প্রকৃতিপ্রেমীদের মন। আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা আর তার নিচে কাশফুলেরীয় নাচানাচি-অজান্তেই মানুষের মনে নির্মল আনন্দ ছড়িয়ে দেয়।
তবে আকাশে ধবধবে সাদা মেঘের শতদল আর মাটিতে মৃদু বাতাসে দোল খাওয়া কাশফুল যে চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ছড়ায় তাতে থাকে শুধুই মুগ্ধতা। তবে কালের আবর্তে শরতকালের সেই চিরচেনা দৃশ্য এখন আর তেমনটি চোখে পড়ে না।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ কাশবন কেটে কৃষি জমি সম্প্রসারণসহ আবাসিক এলাকা গড়ে তুলছে। এতে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতিকে অপরূপ শোভাদানকারী কাশফুল। সাহিত্যে কাশফুলের কথা এসেছে নানাভাবে। রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন গ্রন্থ ‘কুশজাতক’ কাহিনী অবলম্বন করে ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্য রচনা করেছেন। কাশফুল মনের কালিমা দূর করে, শুভ্রতা অর্থে ভয় দূর করে শান্তির বার্তা বয়ে আনে। শুভকাজে কাশফুলের পাতা বা ফুল ব্যবহার করা হয়।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সুব্রত কুমার দাস বলেন, ‘কাশফুল এক ধরনের ঘাসজাতীয় জলজ উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Saccharum spontaneum. এরা উচ্চতায় তিন মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। নদীর তীরে জন্মানো শ্বেতশুভ্র কাশবন দেখতে খুবই সুন্দর। বাংলাদেশের ঋতুরীতি অনুযায়ী শরতের শোভা কাশফুল।’
তিনি বলেন, ‘এ ফুল ফুটতে দেখেই বোঝা যায় এটা শরতকাল। কাশফুল মূলত ছন গোত্রীয় এক ধরনের ঘাস। নদীর ধার, জলাভূমি, চরাঞ্চল, শুকনো রুক্ষ এলাকা, পাহাড় কিংবা গ্রামের কোনো উঁচু ঢিবিতে কাশের ঝাড় বেড়ে ওঠে। তবে নদীর তীরেই এদের বেশি জন্মাতে দেখা যায়। এর কারণ হল নদীর তীরে পলিমাটির আস্তর থাকে এবং এই মাটিতে কাশের মূল সহজে সম্প্রসারিত হতে পারে। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই কাশফুল দেখতে পাওয়া যায়। কাশফুল পালকের মতো নরম এবং ধবদবে সাদা। গাছটির চিরল পাতার দুই পাশ খুবই ধারালো।’
বরিশাল নগরীর শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত স্টেডিয়াম এর কাছে এবং ত্রিশ গোডাউন এবং দোয়ারিকা ও খয়রাবাদ সেতুর ঢালে ও সদর উপজেলা চরবাড়িয়ার ইউনিয়নের তালতলী ব্রিজ এর ঢালে দিগন্তজুড়ে ফুটে আছে সারি সারি শুভ্র কাশফুল। চোখে পড়বে এই দৃশ্য। করোনার প্রকোপ কাটিয়ে চিত্ত বিনোদনের জন্য কাশফুলের সাথে মিতালী করতে যান তারা। সেলফি আর পরিবার-স্বজন নিয়ে ছবি তুলে তারা মনের খোরাক যোগান। শরৎ কালে কাশফুল ঘিরে পর্যটকদের আনাগোনা হয়। এসব স্থানে শরতের এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে সেখানে ভিড় করেন বরিশাল ও এর নিকটবর্তী এলাকার অসংখ্য মানুষ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষের কাছে এ কাশবন যেন একরাশ আনন্দ আর সাময়িক মুক্তির বার্তা। এখানে তাকালেই দেখা যাবে নীল আকাশের নিচে বাতাসে দোল খায় সাদা কাশফুল। সেই কাশবন যেন হয়ে উঠেছে শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো ছবি! তাই তো অনেকেই ছুটছেন সেখানে বিনোদন পেতে। নতুন এ বিনোদন স্পটে দর্শনার্থীরা কাশফুলের সাথে মিলেমিশে একাকার হচ্ছেন। ক্যামেরা বা মুঠোফোনে ছবি তোলায় মেতে ওঠেন।
শরতের এ সময়টাতে সাদা আর সবুজের সাথে একাত্ম হয়ে ছুটে বেড়ায় কোমলমতি শিশু থেকে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী ও বৃদ্ধরা। শরতের বিকেলে রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরি উপেক্ষা করে যান্ত্রিক পরিবেশকে পেছনে ফেলে প্রকৃতির কাছ থেকে একটু প্রশান্তি পেতে প্রায়ই কাশবনে ছুটে আসেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এখানকার কাশবন যে কারো মনকে উদ্বেলিত করে।
বরিশাল সদর উপজেলা চরবাড়িয়ার ইউনিয়ন তালতলীর ব্রিজ এর কীর্তনখোলা নদীর তীর সংলগ্ন এ কাশবনের ভেতরে ঢুকলেই চারদিকে কাশফুল, নদীর ধারে শরীর-মন জুড়িয়ে দেওয়া বাতাস। তাই দুপুরের তীব্র রোদ উপেক্ষা করে কাশবনে বসে কেউ গল্প করছেন। আবার কেউ নিজের ছবি তুলছেন। আর পড়ন্ত বিকেলের কথা তো বলেই শেষ করা যায় না। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে দর্শনার্থীদের ভিড়। বরিশাল সদর উপজেলা চরবাড়িয়া তালতলী ব্রিজ এর কাছে কাশফুলের দর্শনার্থী মারিয়া ইসলাম মিম বলেন, বেশকিছু কারণে দীর্ঘদিন গৃহবন্দি ছিলাম। কাশফুলের বাগানে বেড়াতে এসে ভালোই লাগছে ।
বরিশালের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জাহিদুর ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘আগে পথে প্রান্তরে যেখানে সেখানে দেখা মিলত কাশফুলের। কিন্তু মানুষ বাড়ছে। বর্ধিত মানুষের খাদ্যের জোগান দিতে পতিত জমিও চলে যাচ্ছে চাষের আওতায়। পতিত জমি না থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে কাশবন আর কাশফুল। গ্রামাঞ্চলে অপরিকল্পিত দালানকোঠা, নদী ভাঙ্গন ও কৃষি চাহিদায় কাশফুল হারিয়ে যেতে বসছে। আবহাওয়াজনিত কারণে অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে শরৎকালে কাশফুলের তেমন দেখা মিলছে না ’
প্রকৃতিপ্রেমী জারাও স্বর্ণা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাশবনে ঘুরতে গিয়ে নিজের অনুভূতির থেকে জানান, সাদা আর সবুজের মিলনমেলার পাশ দিয়ে বয়ে চলা কীর্তনখোলা নদীর তীরে ঘুরে বেড়ানোর অনুভূতিই অন্যরকম। সাদা মেঘের সঙ্গে এ কাশফুলের সাদা রং মনকেও সাদা করে দেয়। শরৎ কাশবনকে অপরূপ সাজে সাজিয়েছে।
কাশবনকে উদ্দেশ্য করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জান্নাত ফেরদৌসী বলেন, আজকের এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে মানুষ খুব একা হয়ে পড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে তার সামাজিক ও মানসিক জীবনে। মানুষ কে প্রকৃতির কাছে যেতে হবে মনকে সজীব রাখতে হবে। তাহলেই আমরা সকল বাধা ভেদ করে এগিয়ে যেতে পারবো সুন্দর আগামীর পানে।
আপনি যদি প্রকৃতিপ্রেমী হয়ে থাকেন, বরিশাল আসলে একবার হলেও এই স্বর্গরাজ্যে আসার নিমন্ত্রণ রইলো।