মণিপুরে জাতিগত সংঘাত, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

১. বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিবেশী রাজ্য ভারতের মণিপুরের সংঘাতময় পরিস্থিতি কমার লক্ষণ নেই। মণিপুরে কুকি এবং মেইতেইদের ভয়ঙ্কর জাতি দাঙ্গার ৬০তম দিনে (২ জুলাই) এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে চারজনের। আহত হয়েছে পাঁচ জন। নিহতদের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বুলেট বিদ্ধ হয়ে। চতুর্থ জনের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানী ইমফল এর সত্তর কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে কুমবিতে। রাতভর গুলির লড়াইয়ে পাঁচজন গুরুতর আহত হয়েছে। তাদের আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বিদ্রোহীরা মণিপুরের সাপ্লাই লাইন দু নম্বর জাতীয় সড়কের অবরোধও চালিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। যুজুধান ইউনিয়ন পিপলস ফ্রন্ট ও কুকি ন্যাশনাল এজেন্সি নিজস্ব কর্তৃত্ব বজায় রাখতে রাজনৈতিক ও সামরিক ফ্রন্টে তৎপর রয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত মণিপুর সংক্রান্ত খবরগুলোর ভিত্তিতে আঁচ করা যাচ্ছে।

২. প্রায় দু’মাসের বেশি সময় ধরে উত্তেজনা অব্যাহত ভারতের মণিপুরে। মণিপুর উত্তরপূর্ব ভারতের সাতটি পার্বত্য রাজ্যের একটি, যাদেরকে একত্রে 'সেভেন সিস্টার্স' বলা হয়। অতীতে নাগা, মিজো, বড়ো জাতির সশস্ত্র বিদ্রোহের কারণে উত্তরপূর্ব ভারতকে বলা হতো জাতিগত সংঘাতে অস্থির, রক্তাক্ত ও উতপ্ত অঞ্চল। মণিপুরের চলমান সন্ত্রাস, রক্তপাত ও অসন্তোষ সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতির পুনরুত্থান ঘটাচ্ছে এবং উত্তরপূর্ব ভারতে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে, যা থেকে আশেপাশের অঞ্চলও মুক্ত থাকতে পারবে কিনা, এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ, সংঘাতের কেন্দ্রস্থল বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সন্নিহিত হওয়ায় এবং বিদ্রোহী জাতিগুলো তিন দেশেই বসবাস ও অবাধে চলাচল করায় তা আঞ্চলিক নিরাপত্তা সমস্যায় রূপান্তরিত হওয়ার বিপদ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বিশেষত, পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে কুকি সন্ত্রাসীদের একাধিক ঘাঁটির অস্তিত্ব থাকার ফলে নিরাপত্তা বাহিনি অভিযান পরিচালনা করেছে এবং গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার ও কিছু সন্ত্রাসী আটক হয়েছে। তদুপরি, পাহাড়ের চলমান অস্থিতিশীল পরিবেশ এবং বান্দরবানের তিন উপজেলায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকায় পর্যটক আসছে না। এবারের ঈদের ছুটিতে পর্যটক বরণে বিভিন্ন প্রস্তুতি নিয়েছিল বান্দরবানের পর্যটন সংশ্লিষ্টরা, পর্যটকদের আকর্ষণে দেওয়া হয়েছিল নানা রকম ছাড়ের অফার। তবে জেলার তিনটি উপজেলায় নিষেধাজ্ঞা বলবত থাকায় ঈদুল আজহার বন্ধে বান্দরবানে পর্যটকদের অগ্রিম বুকিং ছিলনা বেশিরভাগ হোটেল মোটেল রিসোর্টে। এতে হতাশ জেলার পর্যটন ব্যবসায়ীরা। এর ফলে পর্যটন খাতে দৈনিক কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।

এইসব তথ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যার পাশাপাশি আর্থিক সঙ্কটেরও স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষেত্রে। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর উন্নয়ন ও সম্প্রীতির পথে চলমান পার্বত্য চট্টগ্রামে এসব বিষয় সুপ্ত হুমকি স্বরূপ এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য আগাম অশনিসংকেতের বার্তাবাহী।

৩. প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতের মণিপুর রাজ্যে জাতিগোষ্ঠী সংঘর্ষে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেমে সেনাও বিক্ষোভের মুখে পড়েছে। দু’মাসের চলমান উত্তেজনা অব্যাহত থাকায় মণিপুরে সফর করেছেন শাসক দল বিজেপি নেতা ও ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ এবং অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা রাহুল গান্ধী। নেতারা বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে গিয়েছেন এবং মেইতেই, কুকি ও নাগাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মণিপুর পেট্রিয়টিক পার্টি মনে করে, কংগ্রেসের আমলেই মণিপুরের এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। কংগ্রেস সরকারই ১৯৪৯ সালে স্বাধীন মণিপুরকে জোর করে ভারতে অঙ্গীভূত করেছিল। মণিপুরবাসী কখনও সেই একত্রীকরণ মানতে পারেনি বলেই রাজ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসের সূচনা হয়।

মণিপুরের কিছু রাজনৈতিক সংগঠন আরও দাবি করেছে যে, কংগ্রেসই বরাবর কুকিদের ভোট ব্যাঙ্কের স্বার্থে ব্যবহার করেছে এবং পৃথক কুকিল্যান্ডের স্বপ্ন দেখিয়েছে। তার জেরেই বর্তমানে পাহাড় থেকে মেইতেইদের বহিষ্কার করে পৃথক রাজ্যের দাবি তুলছে কুকিরা। তাদের আরও অভিযোগ, কুকি জঙ্গিদের দমন না করে সংঘর্ষবিরতি চুক্তি করার আড়ালে কংগ্রেস সরকার আসলে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নাগা ও মেইতেই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়েছিল।

৪. এদিকে, মণিপুরে কুকিরা পৃথক রাজ্য বা পৃথক প্রশাসনের জন্য যখন সরব, তখনই সেই দাবিতে ইন্ধন জুগিয়ে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা বলছেন, ১৯৬১ সাল থেকেই তাঁর দল সব জো গোষ্ঠীকে এক ছাতার তলায় আনার জন্য লড়ছে। সরাসরি সব জো-কুকি জনগোষ্ঠীকে একজোট করার কথা বলে জোরাম শাসকদল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএ)-এর সভায় বলেন, আমি প্রতিবেশী মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহকেও জানিয়েছি, এমএনএফের প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল সব জো-কুকিদের একত্রীকরণের উদ্দেশ্যে। উল্লেখ্য, মণিপুরের প্রায় ১২ হাজার জো-কুকি এখন মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছেন। মণিপুরের কুকি এলাকায় বৃহত্তর মিজোরামের দাবি লেখা দেওয়াল লিখন, পোস্টার চোখে পড়ছে। সেখানকার ১০ জন বিধায়ক একজোট হয়ে পৃথক প্রশাসন দাবি করেছেন। ভারতের কেন্দ্রের তৈরি শান্তি কমিটিকে ইতিমধ্যেই বয়কট করেছে কুকি সংগঠনগুলো। তারা স্পষ্ট জানিয়েছে, পৃথক কুকি এলাকা তথা পৃথক প্রশাসন বাদে তাদের আলোচনার আর কোনও জায়গাই নেই। এই পরিস্থিতিতে জোরাম আগেও কুকিদের একত্রীকরণের কথা বলেছিলেন। প্রতিবাদে আসামের মেইতেইরা মিজোরামের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের ডাক দিয়েছিল। তখনকার মতো চুপ করে গেলেও দেখা যাচ্ছে জোরাম কুকিদের একত্রীকরণের স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি। যদিও তিনি বলেন, “মণিপুরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমার হস্তক্ষেপ করার কোনও জায়গা নেই। কিন্তু প্রতিবেশী রাজ্যের সমগোষ্ঠীয় ভাইবোনেরা তা চাইতেই পারেন।”

ফলে মণিপুরের সমস্যা যে শুধুমাত্র মণিপুর রাজ্যেই সীমাবদ্ধ নেই তা বুঝতে অসুবিধা হয়না। আশেপাশের রাজ্যে বসবাসকারী কুকি ও সমগোত্রীয় উপজাতিগুলোর মধ্যেও বিস্তৃতি লাভ করেছে। এমতাবস্থায়, মণিপুর ও ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী মায়ানমার ও বাংলাদেশে বসবাসীকারী কুকি সম্প্রদায়ের অবস্থান নিঃসন্দেহে অনুমেয়। জাতিগত ও ধর্মীয় অভিন্নতা তথা নব্য-দীক্ষিত খ্রিস্টান পরিচিতি তাদেরকে উগ্র জাতীয়তাবাদী 'কুকিল্যান্ড' আন্দোলনের সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে একাত্ম করতেই পারে এবং ভারত, মায়ানমান ও বাংলাদেশে বসবাসীকারী জনগোষ্ঠীকে বৃহত্তর কুকি জাতীয়তাবাদের উন্মাদনায়-সৃষ্ট উগ্রপন্থার মাধ্যমে 'বৃহত্তর কুকিল্যান্ড' আন্দোলনের দিকে সশস্ত্রভাবে ঠেলে দিতে পারে। ফলে বাংলাদেশে কুকিদের সামরিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা এবং প্রশিক্ষণ শিবির ও ঘাঁটি সংক্রান্ত তথ্যগুলোকে সামগ্রিক আঞ্চলিক পরিস্থিতির বাইরে এসে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার অবকাশ কম।

৫. গণমাধ্যমের আরেক খবরে জানা যায়, মণিপুরে বিদ্রোহীদের দ্বারা পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে লুঠ হওয়া অস্ত্র বিক্রির চেষ্টার সময় সেনা ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের কাছে ৭টি অস্ত্র ও ২১৮ রাউন্ড গুলি মেলে। এখন পর্যন্ত লুট হওয়া ৪ হাজারের বেশি অস্ত্রের মধ্যে ১১১০টি অস্ত্র, প্রায় ১৪ হাজার গুলি এবং ২৫০টি বোমা উদ্ধার হয়েছে।

সূত্র বলছে, মণিপুরের গ্রামের দিক থেকে বিনা উস্কানিতে সেনাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ভারতীয় সেনার টুইটার হ্যান্ডল ‘স্পিয়ার কর্পস’-এর তরফে জানানো হয়, মণিপুরের হারাওথেল গ্রামে টহল দেওয়ার সময়ে হঠাৎই ভোরের দিকে সেনা আধিকারিকদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করে অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীরা। সেনার তরফে জানানো হয়েছে, ‘পারিপার্শ্বিক ক্ষয়ক্ষতি’ এড়াতে পাল্টা গুলি চালায় তারাও। সেনার তরফে এ-ও জানানো হয়, সামরিক তৎপরতার সমান্তরালে বিপুল সংখ্যক উন্মত্ত জনতা ওই এলাকায় জড়ো হয়েছিল। পরে সন্ধ্যার দিকে উন্মত্ত জনতার ভিড় নিয়ন্ত্রণে আনে সেনা।

প্রসঙ্গত, গত ৩ মে মণিপুরের জনজাতি ছাত্র সংগঠন ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অফ মণিপুর’ (এটিএসইউএম)-এর বিক্ষোভ-মিছিল ঘিরে উত্তরপূর্বের ওই রাজ্যে অশান্তির সূত্রপাত। মণিপুর হাই কোর্ট মেইতেইদের তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি রাজ্য সরকারকে বিবেচনা করার নির্দেশ দিয়েছিল। এর পরেই জনজাতি সংগঠনগুলো তার বিরোধিতায় পথে নামে। আর সেই থেকেই মণিপুরে সংঘাতের সূত্রপাত, যার নেতৃত্ব দিচ্ছে কুকি এবং সমগোত্রীয় উপজাতি গোষ্ঠীগুলো। পরবর্তীতে রাজনৈতিক আন্দোলন সশস্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে। সরকারি অস্ত্রভাণ্ডার লুট করা ছাড়াও ভারত-মায়ানমার-বাংলাদেশের সংযোগ ত্রিভুজে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও সহজে অস্ত্রের জোগান পাওয়ার কারণে পরিস্থিতি সশস্ত্র রূপ পেতে বিলম্ব হয়নি।

৬. ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মণিপুরের জ্বলন্ত পরিস্থিতি ও সন্ত্রাসের দায় আপাতদৃষ্টিতে কুকি জাতিগোষ্ঠীর দিকেই আঙুল তুলেছে। মণিপুরের এই বিশেষ সহিংস পরিস্থিতির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা এবং দুটি জাতিগোষ্ঠীর সংঘর্ষের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিক্রিয়া কিরূপ হতে পারে, তা নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন ভারতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞগণ।

অভিযোগ করা হচ্ছে, যখন সহিংসতা শুরু হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন কর্ণাটকে বিজেপির পক্ষে প্রচার করছিলেন (সেখানে ১০ মে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে শাসক দল হেরে যায়)। পরেও তাঁর নীরবতা অব্যাহতই ছিল এবং তিনি জাপান, পাপুয়া নিউগিনি ও অস্ট্রেলিয়া সফরে ব্যস্ত ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার যাওয়ার কথা ছিল; তাঁরা তাঁদের পরিকল্পনা বাতিল করার পরেও মোদি অস্ট্রেলিয়া যান। সেখানে তিনি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে হিন্দু মন্দির ধ্বংসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন। অথচ মোদি মণিপুরে মৃত্যু নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেননি বা রাজ্যে খ্রিষ্টানদের গির্জা ধ্বংসের কথাও উল্লেখ করেননি।

মোদির মন্ত্রিসভার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সদস্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সহিংসতা শুরু হওয়ার ২৭ দিন পরে মণিপুর সফর করেন ও ত্রাণের প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর আগে সেখানে দুই দিনের সফরে যান ভারতের সেনাপ্রধান। সহিংসতা তখন আরও ছড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সালে চীনা সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভয়াবহ এক সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে মণিপুরে বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের সেখান থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। এখন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার জন্য মণিপুরে আবার সৈন্য পাঠানো হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী সম্ভবত রাজ্যে স্বাভাবিক অবস্থার দ্রুত প্রত্যাবর্তনের আশা করছে, কিন্তু মোদি সরকারের কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া তা অসম্ভব বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞগণ।

৭. সামগ্রিকভাবে ও প্রধানত মণিপুরের সাম্প্রতিক সহিংসতাকে একটি নিরাপত্তা সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এর ঐতিহাসিক পটভূমি ও রাজনৈতিক দিকটিকে এবং ভূরাজনৈতিক গুরুত্বকে মোটেও অবজ্ঞা করা সমুচিত নয়। বিশেষত, রাজনীতি যদি বিবদমান জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সেতু নির্মাণের বদলে বিভাজনকে আরও উস্কে দেয়, তাহলে পরিস্থিতির অবনতি ও সহিংসতার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। এই অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র জাতিগত সংঘাতের কারণ হয়েছে। মণিপুরের ক্ষেত্রে কুকিরা রাজনীতিবিদ ও পুলিশকে অবিশ্বাস করে। অস্ত্রাগার লুট করে। সহিংসতা পথে যেতে চায়। তেমন নাজুক ও ভঙ্গুর পরিস্থিতে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হলেও সহজে শান্তি আসেনা। সেনা ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করতেই থাকে, যা আগেভাগে রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। ফলে শুধু মণিপুরই নয়, আশেপাশের ভারতীয় রাজ্যগুলোতেও জাতিগত অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব নিরসনে আলাপ-আলোচনা ও শক্তিশালী রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয়। একইভাবে, ভারতের পার্শ্ববর্তী মায়ানমান ও বাংলাদেশের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা অটুট রাখার জন্য প্রথমেই সামরিক প্রস্তুতির পাশাপাশি রাজনৈতিক শক্তিকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।

বিশেষত, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল বলে বেশ স্পর্শকাতর ও বিপদজনক। কারণ, উপজাতিগুলোর অনেক সদস্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে বসবাস করায় তাদের স্বজাতীয় সন্ত্রাসীদের দ্বারা ভুলভাবে প্রভাবিত হতে পারেন। যদিও বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিগণ শান্তিচুক্তির কাঠামোর মধ্যে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে অধিকার অর্জন করে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি পথে চলেছেন, তথাপি তাদেরকে উস্কানি দিয়ে বিপথগামী করার সুযোগ নেওয়া স্বার্থবাদী গ্রুপের পক্ষে অসম্ভব নয়। এসব বিষয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিরসন হতে পারে। বিশেষত, নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকেই এগিয়ে আসতে হবে সন্ত্রাসবাদী অপশক্তিকে প্রতিহত করার কাজে।

৮. মণিপুরের জাতিগত সন্ত্রাসের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বও অনেক। আশেপাশের বিস্তৃত অঞ্চলে এ অশান্তি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও রয়েছে। মিয়ানমারের চিন জনগোষ্ঠী ও বাংলাদেশের কুকি/বোম এবং ভারতের মিজোরাম রাজ্যের মিজো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কুকিদের নৃতাত্ত্বিক মিল আছে। সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে শত শত কুকি মায়ানমারে পালিয়ে গেছে। তারা বাংলাদেশেও প্রবেশ করতে পারে।

কুকিদের প্রতি অন্যায় আচরণে প্রতিবেশী রাজ্য মিজোরামেও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। এ রাজ্যটি ১৯৮৬ সালে মিজো-নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। নাগাল্যান্ড রাজ্যে নাগাদের বিদ্রোহেও তাদের জাতিগত কুকি ভাইদের সহানুভূতি আছে। এটা বিশ্বের চলমান দীর্ঘতম বিদ্রোহগুলোর মধ্যে একটি। সেখানে নাগা জনগণ তাদের নিজস্ব পতাকা ও সংবিধান দাবি করেছে।

গবেষকরা মনে করেন, যদি মণিপুরে পূর্ণাঙ্গ বিদ্রোহ ফিরে আসে এবং এর প্রভাব যদি প্রতিবেশী রাজ্য মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং আসামে পড়ে, তাহলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সেখানে পর্যাপ্ত সেনা মোতায়েন করতে হবে। তা হলে সেটা অরুণাচল সীমান্তে চীনের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অবস্থানকে কমজোরি করে দেবে। ওদিকে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি ২০২১ সাল থেকে সেখানে শক্ত অবস্থান নিয়ে আছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী মণিপুরকে শান্ত করতে যত বেশি সময় নেবে, তারা ভারত সীমান্তে তত বেশি দুর্বল থাকবে। ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত অবকাঠামোগত ব্যাপক ফারাক রয়েছে। এমন পরিস্থিতির বহুমাত্রিক প্রভাব মায়ানমার ও বাংলাদেশে অনুভূত হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।

৯. বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে স্থানীয় বা আঞ্চলিক বিষয় অতিদ্রুত আন্তর্জাতিক মাত্রা লাভ করে। ভারতের মণিপুর এবং তৎসংশ্লিষ্ট মায়ানমার ও বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের তটরেখায় অবস্থিত হওয়ায় বৃহত্তর ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের প্রান্তিক অংশ। আর ইন্দোপ্যাসিফিকে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো নানা মাত্রায় তৎপর। ফলে উত্তরপূর্ব ভারত ও সন্নিকটবর্তী দেশগুলোর ঘটনাপ্রবাহ বিশ্বশক্তিসমূহের নজর ও আগ্রহের বাইরে নেই। অতএব, এসব অঞ্চলে নিরাপত্তা ঝুঁকি যতই বাড়বে, তারাও ততই নড়েচড়ে উঠবে।

সম্ভবত আঞ্চলিক গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে ২০১৫ সালে ভারত ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ তথা পূর্বদিকে সক্রিয় হওয়ার নীতি ঘোষণা করেছিল। এটা বাণিজ্য, সংস্কৃতি, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ এবং ভৌত অবকাঠামোর মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে কাছের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করার ওপর জোর দেয়। কিন্তু অবকাঠামোগত অগ্রগতি সে অনুসারে হয়নি বললেই চলে; বিলম্বিত কিছু প্রকল্প শুধু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সচল হয়েছে। যদি মণিপুরের সহিংসতা রাজ্যের সীমানার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে, তবে এটি 'অ্যাক্ট ইস্ট' নীতিকে আরও ব্যাহত করবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। তাদের মতে, পরোক্ষভাবে নীতিটি মার্কিন ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলের সঙ্গে জড়িত– যা 'কোয়াড' নামক চতুর্ভুজ নিরাপত্তা সংলাপের আদলে কার্যকর হচ্ছে। ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতির অবনতি হল ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ এমন পরিবর্তন আসতে পারে, যা আঞ্চলিক ক্ষেত্রে পরাশক্তিগুলোর পদচারণা বাড়িয়ে নানামুখী ঝুঁকিও সৃষ্টি করতে পারে।

১০. ভারতের উত্তরপূর্বের নাজুক পরিস্থিতি বারুদভর্তি বাক্সের সমতুল্য। মণিপুরের সহিংসতা এতে ভয়ংকর স্ফুলিঙ্গ জোগাতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। অতএব ইস্যুটি ভারতীয় রাজনীতির সরাসরি অংশগ্রহণ ও হস্তক্ষেপ দাবি করে। নয়াদিল্লির উচিত, শুধু সামরিক পন্থানুসরণ না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রুটিন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সঙ্কটের নিরসন ও শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। ভারত যদি দ্রুত মণিপুরে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে না পারেন, তাহলে সীমান্তে চীনের কাছ থেকে চ্যালেঞ্জের ঝুঁকি আরও বাড়বে এবং কোয়াডের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলব। মণিপুরের মতো প্রত্যন্ত রাজ্যে সহিংসতা ও সংঘর্ষ কোনো সাধারণ নিরাপত্তা সমস্যা নয়। এই ঘটনাবলি দক্ষিণ এশিয়া এবং বিস্তৃত ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের ভূরাজনীতিতেও ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।

এমনই পটভূমিতে পার্শ্ববর্তী মণিপুরের ঘটনাপ্রবাহকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে বাংলাদেশকে। ঘটনার কোনও ধরণের প্রভাব মণিপুর-সংলগ্ন পার্বত্য চট্টগ্রামে যেন বিস্তার করতে না পারে, সেজন্য রাজনৈতিক, সামরিক ও কৌশলগত দিক থেকে পূর্ণ সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশকে। যখন বাংলাদেশের সামনে রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন, তখন শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অধিকতর জরুরি ও অগ্রাধিকারের বিষয়।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ (সিসিআরএস)।

   

ফেনী শহরে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে কৃষ্ণচূড়া



মোস্তাফিজ মুরাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ফেনী
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

'কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে-আমি ভুবন ভুলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে' জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই মনোমুগ্ধকর গানে ফুটে উঠেছে কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য। কৃষ্ণচূড়া যেন প্রকৃতিকে দান করেছে লাল আভার অপরূপ সৌন্দর্যের মহিমা। সাথে গ্রীষ্মের উত্তাপে শহরে সৌরভ ছড়াচ্ছে নানা জাতের ফুল। তীব্র তাপদাহের পর কালবৈশাখী, এরপর মাঝারি বৃষ্টির মধ্যে ফুলের আগমন। এতে রঙের উল্লাসে মেতে উঠেছে ফেনী শহরবাসী।

ফেনী শহরের কোর্ট বিল্ডিং, এলজিইডি, পুলিশ লাইন, নবীন চন্দ্র সেন কালচারাল সেন্টার, ফেনী সরকারি কলেজ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া। এটি একদিকে প্রকৃতিকে যেমন সাজিয়েছে অপরূপ সৌন্দর্যে, অন্যদিকে এর সৌন্দর্য মুগ্ধ করছে তরুণ-তরুণী, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষসহ ফুলপ্রিয় পথচারীদের। শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে, সরকারি দফতরসহ স্কুল-কলেজে কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল ও উজ্জ্বল সবুজ পাতার সংমিশ্রণ দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে চারপাশ।


কৃষ্ণচূড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ফুলের ঘ্রাণে মুখরিত হয়ে আছে পুরো শহর। শহরের মূল সড়কের ডিভাইডারে পৌরসভার উদ্যোগে লাগানো হাসনাহেনা, রজনিগন্ধা, গন্ধরাজসহ নানা জাতের ফুল গাছে ফুল ফুটেছে। এটি একদিকে বাড়িয়েছে সৌন্দর্য অন্যদিকে হেঁটে কিংবা রিকশায় চলাচল করলে পাওয়া যায় এসব ফুলের সুঘ্রাণ।

ফেনী শহরের কৃষ্ণচূড়ার অপরূপ সৌন্দর্য দেখে ফুলপ্রিয় পথিকরা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া ফুল প্রকৃতিকে অনন্য সাজে সাজিয়েছে। এই ফুলের সৌন্দর্যের কারণে পথচারীরা একবার হলেও এই ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এর গাছের উপর নজর দিবে। পাশাপাশি তীব্র গরমে অন্যান্য ফুলের সুঘ্রাণে চারপাশ মুখরিত হওয়াতে ক্লান্তিতা কিছুটা হলেও কমছে।


তারা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া ফুলের এই নান্দনিক দৃশ্য দেখতে এর গাছ রোপণ করা জরুরি। রাস্তা প্রশস্তকরণ, ঘর-বাড়ি নির্মাণসহ নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে ফেলা হয়। অন্যান্য গাছ রোপণ করার পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া রোপণ করলে একদিকে যেমন সৌন্দর্য বাড়াবে অন্যদিকে পরিবেশ বান্ধব হবে।

সাজিদ হাসান নামের এক পথচারী বলেন, কৃষ্ণচূড়া একদিকে যেমন প্রকৃতিতে অপরুপ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে, আরেকদিকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমাবে। সারাদেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে, আমার মতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে এই গাছটিও যুক্ত করা উচিত। তীব্র গরমের পর বৃষ্টি হলো, এরপর শহরে নানা রঙের ফুলের দেখা মিলছে, ফুলের ঘ্রাণে চলাচল করতেই ভালো লাগছে।

ফারজানা ইয়াসমিন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ফুলের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। অন্যান্য ফুলের পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া ফুল আমার অনেক ভালো লাগে। আমাদের কলেজে বকুল তলা আছে, ক্যান্টিনের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। সুযোগ পেলেই ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করি।

অনিক মোহন নামে একজন বলেন, রিকশায় করে যখন বাসায় ফিরি, শহরের রাস্তার মাঝে ভিডাইভারে লাগানো নানা জাতের ফুলের ঘ্রাণ মনকে আনন্দিত করে। রাতের বেলা শহর যখন নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তখন এ ফুলের সৌন্দর্য কয়েকশ’ গুণ বেড়ে যায়।

সড়কের পাশে কৃষ্ণচূড়া লাগানো হলে সৌন্দর্য বাড়বে বলে মনে করেন পথচারী মিনহাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাস্তা প্রশস্তকরণের জন্য যে গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে, ওই গাছগুলোর জায়গা কৃষ্ণচূড়ার গাছ লাগালে রাস্তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে।

একই কথা বলেন শহরের ব্যবসায়ী নাদিম আহমেদ। তিনি বলেন, সৌন্দর্য ও পরিবেশের কথা বিবেচনা করে এই গাছ রোপণ করা উচিত আমাদের। তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে অন্যন্যা গাছ রোপণ করার পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া গাছ রোপণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। যেগুলো শহরে আছে তাতেই সৌন্দর্য বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ, আরও যদি লাগানো যায় ফুলে ফুলে ভরে উঠবে আমাদের শহর।

কৃষ্ণচূড়া মাদাগাস্কারের শুষ্ক পত্রঝরা বৃক্ষের জঙ্গলে পাওয়া যায়। যদিও জঙ্গলে এটি বিলুপ্ত প্রায়, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এটি জন্মানো সম্ভব হয়েছে। সৌন্দর্যবর্ধন গুণ ছাড়াও, এই গাছ উষ্ণ আবহাওয়ায় ছায়া দিতে বিশেষভাবে উপযুক্ত। কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদ উচ্চতায় কম (সর্বোচ্চ ১২ মিটার) হলেও শাখা-পল্লবে এটি বেশি অঞ্চল ব্যাপী ছড়ায়।

শুষ্ক অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে কৃষ্ণচূড়ার পাতা ঝরে গেলেও, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এটি চিরসবুজ থাকে। কৃষ্ণচূড়া ফুলের রং উজ্জ্বল লাল। পত্র ঝরা বৃক্ষ, শীতে গাছের সব পাতা ঝরে যায়। বাংলাদেশে বসন্ত কালে এ ফুল ফোটে। ফুলগুলো বড় চারটি পাপড়ি যুক্ত। পাপড়িগুলো প্রায় ৮ সেন্টিমিটারের মত লম্বা হতে পারে। কৃষ্ণচূড়া জটিল পত্র বিশিষ্ট এবং উজ্জ্বল সবুজ। প্রতিটি পাতা ৩০-৫০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ২০-৪০ টি উপপত্র বিশিষ্ট। কৃষ্ণচূড়ার জন্মানোর জন্য উষ্ণ বা প্রায়-উষ্ণ আবহাওয়ার দরকার। এই বৃক্ষ শুষ্ক ও লবণাক্ত অবস্থা সহ্য করতে পারে।

জানা যায়, অপরূপ সৌন্দর্য ছড়ানোর পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর পাতা, মূলের বাকল ও ফুল ভেষজ গুণাগুণ সম্পূর্ণ, যা জ্বর ও খুশকি নিরাময়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ভেষজটি হেমিপ্লেজিয়া, আর্থরাইটিস এবং কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। কৃষ্ণচূড়া গাছের শিকড়, বাকল এবং ফুল সবই পরজীবী সংক্রমণ নিরাময়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।

;

হলুদ আভায় মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে সূর্যমুখী 



শহিদুল ইসলাম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নওগাঁ
ছবি: প্রাণের উচ্ছ্বাসে সূর্যমুখী

ছবি: প্রাণের উচ্ছ্বাসে সূর্যমুখী

  • Font increase
  • Font Decrease

মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে সূর্যমুখী। বাস্তব জীবনের নিস্তব্ধতা ভাঙছে তার হলুদ আভায়। মৌমাছির আলিঙ্গন পেতে ছড়াচ্ছে উষ্ণ মুগ্ধতা। হলুদের কারুকার্যে বিমোহিত হচ্ছে পথিকের মন। লুকায়িত সৌন্দর্য প্রকৃতির মাঝে তুলে ধরে প্রবল আকর্ষণে টানছে দর্শনার্থীদের। সবুজ পাতা ভেদ করা সেই অনিন্দ্য হাসি যেন কৃষকের মুখেরই প্রতিচ্ছবি। সূর্যমুখী ফুল চাষে জনপ্রিয়তা বাড়ছে কৃষকদের মাঝে।

সূর্যমুখী এক ধরনের একবর্ষী ফুলগাছ। সূর্যমুখী গাছ লম্বায় ৩ মিটার (৯ দশমিক ৮ ফুট) হয়ে থাকে। ফুলের ব্যাস ৩০ সেন্টিমিটার (১২ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়। এই ফুল দেখতে কিছুটা সূর্যের মতো এবং সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে বলে এর এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। ফুলের বীজ হাঁস-মুরগির খাদ্যরূপে ও তেলের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

জানা যায়, বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের উৎস হিসেবে ১৯৭৫ সাল থেকে এ ফুলের চাষ শুরু হলেও কৃষকের মাঝে জনপ্রিয়তা পায় নি বহুদিন। পরে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। বর্তমানে রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, নাটোর জেলা, পাবনা, নওগাঁ, দিনাজপুর, গাজীপুর, টাঙ্গাইল প্রভৃতি জেলাতে এর ব্যাপক চাষ হচ্ছে।

সূর্যমুখীর বাঁধভাঙা হাসি আর প্রাণের উচ্ছ্বাস

সোমবার (১২ মে) সকালে সরেজমিনে নওগাঁ সদর উপজেলার মুক্তির মোড় কেন্দ্র শহীদ মিনারের পাশে দেখা যায়, সূর্যমুখী বাতাসে; দুলছে আলোর প্রতিফলনে পাপড়িগুলো যেন চকচকে হলুদ আভা ছড়াচ্ছে। মৌমাছি এক ফুল থেকে অন্যফুলে মধু আহরণে ছুটাছুটি করছে আর এসব দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে পথচারীরা। এছাড়াও নওগাঁর বেশ কিছু অঞ্চলে চাষ হচ্ছে সূর্যমুখী। একদিকে যেমন ফুলগুলো সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে তেমনি বীজ থেকে ভোজ্য তেল উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে সূর্যমুখীর বীজ। সূর্যমুখী গাছ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। 

প্রতিদিন ভোরে সূর্যমুখী বাগানের সকল গাছ অনেকটা পূর্বদিকে মুখ করে থাকে। যেদিকে সূর্য দেখা দেয় এবং ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে থাকে। সূর্যের সাথে সাথে সূর্যমুখীগুলোও ধীরে ধীরে নিজেদের দিক পাল্টাতে থাকে। সূর্য যেদিকে যায় তারাও সেদিকে যায়। সবসময়ই এগুলো সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। সূর্য যখন পশ্চিম দিকে অস্ত যায় তারাও তখন পশ্চিম দিক বরাবর থাকে। অস্ত যাওয়ার পরে তারা রাতব্যাপী আবার উল্টো দিকে ঘুরে পূর্বমুখী হয়। এভাবে শুকিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের এই চক্র চলতেই থাকে।

সূর্যের সাথে সাথে নিজেদের দিকও পাল্টাতে থাকে সূর্যমুখী

তবে সবার মাঝে একটি প্রশ্ন অনেক সময় ঘুরপাক খায় যে সূর্যমুখী ফুল কেন সূর্যে দিক হয়ে থাকে! সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের একটি দল সূর্যমুখীর এই দিক পরিবর্তন সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যের রহস্য উন্মোচন করেছেন। তাদের গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসে সূর্যমুখীরা তাদের নিজস্ব সার্কাডিয়ান চক্রে আবদ্ধ। এই চক্র সচল থাকার কারণে সূর্যমুখীরা সব সময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। গবেষকরা সায়েন্স জার্নালে তাদের গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশ করেছেন। সার্কাডিয়ান চক্র বা সার্কাডিয়ান ঘড়িকে অনেক সময় ‘দেহঘড়ি’ নামেও ডাকা হয়। মানুষের মাঝেও এই চক্র বিদ্যমান। যেমন প্রত্যেক মানুষেরই দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম চলে আসে।

পথচারী রায়হান বলেন, ফুল শুভ্রতার প্রতীক ও পবিত্র। ফুলকে যারা ভালোবাসে তাদের মনটাও সুন্দর। সূর্যমুখী ফুল সব ফুলের চেয়ে আলাদা কারন সূর্যের দিক মুখ করে বেশিরভাগ থাকে এ ফুল। বিশেষ করে দুপুর শুরু হলে সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে এ ফুল যা দেখতেও খুব সুন্দর লাগে তাছাড়া এ ফুলের বীজ থেকে তেল হয় যা অনেক স্বাস্থ্যকর।

ক্ষুদে শিক্ষার্থী আফরিন (১০) জানায়, আমি ফুল খুবই ভালোবাসি আর সূর্যমুখী ফুলগুলো হলুদ হবার কারনে আরো বেশি ভালো লাগে। নামটা যেমন সুন্দর তেমনি মুগ্ধতাও ছড়ায়। ফুলগুলো থেকে তেল হয় তাই কোনোভাবেই নষ্ট করা যাবে না। আমরা দূর থেকে দেখেই শান্তি পাই।

সূর্যের সাথেই একাত্মতা সূর্যমুখীর

স্থানীয় বাসিন্দা আরেফিন তুহিন বলেন, স্বল্প পরিসরে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য যারা সূর্যমুখী ফুলের গাছ লাগিয়েছে তারা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। ফুল মানেই সুন্দর সূর্যমুখীও এটিএ ব্যাতিক্রম নয়। মাঝে মাঝে যখন ফুলের দিকে চোখ যায় খুব ভালোলাগা কাজ করে। এ ফুল দেখতে যেমন সুন্দর এটির তেল ও খুব পুষ্টিকর।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে চলতি অর্থবছরে সূর্যমুখী চাষের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ হেক্টর ও অর্জন হয়েছে ৬৫ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন হয়েছে ১০০ মেট্রিক টন। 

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বার্তা২৪.কমকে বলেন- সূর্যমুখী একদিকে যেমন শুভ্রতার প্রতীক আবার অন্যদিকে বীজ থেকে তেল উৎপাদন হয় আবার মধুও পাওয়া যায়। বাজারে যে ভৈজ্যতেল গুলো রয়েছে যেমন, সয়াবিন,সরিষা, পাম-ওয়েল ইত্যাদি এগুলোর চেয়েও অনেক বেশি পুষ্টিগুণ আছে সূর্যমুখীর তেলে যা স্বাস্থ্যকর এবং স্বাস্থ্যর জন্য খুবই উপকারী। আমরা বেশি বেশি উৎপাদনে কৃষকদের সব রকম পরামর্শ দিয়ে থাকি।

;

ওই আকাশে লুকিয়ে আছে মা



সহিদুল আলম স্বপন, লেখক জেনেভা সুইজারল্যান্ড
ওই আকাশে লুকিয়ে আছে মা

ওই আকাশে লুকিয়ে আছে মা

  • Font increase
  • Font Decrease

তো ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকের কথা, তখন সুইস কোম্পনী ফাদসা এস এ তে চাকরী করি। হঠাৎ একদিন কোম্পানীর মালিক মশিউয়্যু মিশেল লাসের (বাংলায় জনাব মিশেল ল্যাসার) তার অফিসে ডেকে পাঠালেন।আমিতো ভয়ে দিশেহারা, ভাবলাম ফ্রেন্স ভাষা না জানার কারণে আমার মনে হয় এবার চাকরীটাই গেল। বলে রাখা ভালো, সুইজারল্যান্ডের চারটি সরকারী ভাষার(ফরাসী, সুইস জার্মান, ইতালীয়ান এবং রোমন্স - রোমান নয়)মাঝে জেনেভা ফরাসী ভাষাভাষী।নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটা ভ্যানিশিং ক্রিমের পাবলিসিটি ছিল-ম্যানোলা সিবোঁ ভ্যানিশিং ক্রিম নিয়ে এলো ফরাসী সৌরভ। পরে জেনেছি সিবোঁ ফরাসী শব্দ যার অর্থ খুব ভালো (হয়তো বাংলায় বুঝাতে চেয়েছেন সুগন্ধময়)-আর এটাই শুধু আমার ফরাসী ভাষার ভান্ডার।

যাই হোক, ভয়ে ভয়ে তাঁর খাস কামরায় হাজির হলাম।দেখি কামরায় সোফার এককোনে প্যাট্রিক(আমার সুইস সহকর্মী আমার চেয়ে বছর দুয়েক এর ছোট হবে)আর লরেতা মার্টিনি এইচ আর হেড বসে আছে। বুঝতে আর দেরী হলোনা, এখনি বস বলবেন ইউ আর ফায়ার এবং প্যাট্রিককে তোমার সব কাজগুলো বুঝিয়ে দাও।

কোথায় ফায়ার তা না বলে মশিউয়্যু লাসের বললেন মাই ডিয়ার, আগামী সপ্তাহে প্যাট্রিক আর আলম (আমি) তোমরা দুজনে রটারডাম যাচ্ছো ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং এর জন্য। আলম তুমি কাল ভোরে বার্ণ(সুইজারল্যান্ডের রাজধানী)যাবে নেদারল্যান্ডের ভিসা করাতে। লরেতা তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবে। বলে রাখা ভালো তখনো আমি সুইস নাগরিক হয়ে উঠিনি, আর মশিউয়্যু মিশেল লাসের ই আমাকে সুইজারল্যান্ডে স্হায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

রটারডাম উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্র নেদারল্যান্ডসের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর( আমস্টারডামের পরেই)।এটি ইউরোপের বৃহত্তম ও বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর।নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণ হল্যান্ড প্রদেশে, উত্তর সাগরের তীরে, রাইন নদীর মোহনায় অবস্থিত এই বন্দর শহরকে প্রায়শই "ইউরোপের প্রবেশদ্বার" নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

তো যেই কথা সেই কাজ, সমস্ত আনুষ্ঠিকতা শেষে সপ্তাহান্তে কেএলএম রয়্যাল ডাচ এয়ারলাইন্সে চেপে জেনেভা থেকে আমস্টারডামের শিফল বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলাম। আমস্টারডাম শিফল বিমানবন্দর থেকে ট্রেনে রটারডাম সেন্ট্রাল ট্রেন ষ্টেশনে এসে নামলাম। সেখান থেকে টেক্সীকরে সরাসরি রটারডাম ম্যারিয়ট হোটেলে।রটারডাম স্কুল অফ ম্যানেজমেন্ট, ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি (আরএসএম) ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় বিসনেস স্কুলগুলির মধ্যে একটি, এখানেই আমাদের কোর্স। বাংলাদেশ আর নেদারল্যান্ডসের মাঝে চার পাঁচ ঘন্টার পার্থক্য। প্রতিদিন বাবা -মা সাথে কথা হয়। বাবা আমার জ্ঞানের পাগল। ৬০ বছর বয়সে উনি তাঁর মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। কিন্তু বাবা মা দুজনের কেউ মানতে পারছিলেন না আমি বিদেশে থাকি। দেশে থাকতে মা এর আহাজারীতে বাবা বিভিন্ন কায়দায় বাংলাদেশ মিলিাটারী একাডেমী থেকে আমায় ছাড়িয়ে এনেছিলেন। রাতে ঘুমাতে যাবার আগের মা কে ফোন করে ঘুমাই। বরাবরের মতে ১৮ ই ফেব্রুয়ারি রাতে মার সাথে কথা বলছি, মা আমার প্রাইমেরীর গন্ডি পেরুনো কিন্তু শিক্ষার প্রতি তাঁর পরম শ্রদ্ধা। গান-নাটক সংস্কৃতির পাগল আমি। মা আমার প্রতিদিন ই জিজ্ঞেস করেন কেমন চলছে গান-বাজনা। অনেক গুলো নূতন গানের ক্যাসেট কিনে রেখেছেন তিনি, সুইজারল্যান্ডে ফিরলেই ডাকযোগে পাঠিয়ে দিবেন, আমার প্রিয় কুমিল্লার খদ্দরের হাউয়াই শার্টসহ। আরো কত কথা, শেষ হয়েও হয়না শেষ। মায়ের প্রতিটি কথায় সেকি এক অনুপ্রেরণা। আজ বাংলাদেশে শেষ রোজা। পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার রোজার ঈদ।

পরদিন ক্লাস নেই, ভেবে রেখেছি সকালে ব্রেকফাস্ট না করে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে ফ্রেস হয়ে তারপর সারাদিন ঘুরে বেড়াবো, দেখবো বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভাবনী বন্দর, রটারডাম চিড়িয়াখানা, রিমাস্টারড" ডিজিটাল আর্ট অডিওভিজ্যুয়াল, ইউরোমাস্ট টাওয়ার, কিউব হাউস ইত্যাদি আর রাতে যাবে বাইয়্যাবীচ ক্লাবে নাচতে।

হোটেল রুমের সাইড টেবিলে রাখা ফোনটা সাত সকালেই আজ চিৎকার করে কান্না করে চলেছে, ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং……। ফোনটা যেন পাগল হয়ে গেছে। বিরক্ত হয়েই মিনিট খানেক পর আঁধো বোজা চোখে ফোনটা কানের কাছে নিয়ে বললাম, হোয়াট দ্যা হেল প্যাট্রিক, লেট মি গেট সাম স্লিপ । ফোনের ঐ প্রান্ত থেকে ভেসে এলো ভাইয়া আমি ফরিদ(আমার ছোট বোন পান্নার বর), এক নি:শ্বাসে বলে চলছেন, ভাইয়া আমরা এই মাত্র কবরস্তান থেকে আসলাম, সব কিছুই ঠিক ছিল, দাফন- কাফন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে, কেঁদে আর কি করবেন, আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, এইযে আব্বার সাথে কথা বলেন, আম্মাতো কাউকে কষ্ট দেননি, আল্লাহর কাছে আম্মার রুহের মাগফিরাত কামনা করে নামাজ পড়ুন যেন উনাকে আল্লাহ জান্নাতে স্হান করে দেন।চোখের জলে বালিশ ভিজেঁ যাচ্ছে আমি আজো প্রতিনিয়ত গেয়ে চলছি - " সবাই বলে, "ওই আকাশে লুকিয়ে আছে" "খুঁজে দেখ, পাবে দূর নক্ষত্রমাঝে"রাতের তারা, আমায় কি তুই বলতে পারিস কোথায় আছে, কেমন আছে মা? ভোরের তারা, রাতের তারা, মা-কে জানিয়ে দিস অনেক কেঁদেছি আর কাঁদতে পারি না।

;

১২ মে: আন্তর্জাতিক মা দিবস, মায়েদের ত্যাগের স্বীকৃতির দিন



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

মা পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াবী শব্দ। এটি কেবল একটি ডাক নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারও আবেগ, সুখ-দুঃখ, ব্যথা, আনন্দ, আকাঙ্ক্ষা, অভিযোগ- না জানি আরো কত কত অনুভূতি!

হাদিসে বলা আছে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। সনাতন ধর্মের পুরাণে লিখিত রয়েছে- জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী অর্থাৎ মা এবং জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এমনকী অন্যান্য ধর্মগ্রন্থেও জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি অশেষ ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷

অশেষ কষ্ট সহ্য করে আমাদের লালন-পালন করেন জন্মদাত্রী মা। তাদের কষ্ট উপলব্ধি করতে উদযাপন করা হয়, আন্তর্জাতিক মা দিবস। এই বিশেষ দিনে মা এবং মাতৃসমতুল্যদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। সারাবিশ্বের অনেক দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রোববার উদযাপিত হয়, আন্তর্জাতিক মা দিবস। এই দিনটি ‘মাদারিং সানডে’ নামেও পরিচিত। এ বছর ১২ মে পড়েছে মা দিবস।

মা দিবসের আদি ইতিহাস
আন্তর্জাতিক মা দিবসের ইতিহাস বিষয়ে উইকিপিডিয়ায় লেখা হয়েছে, মা দিবস বা মাতৃ দিবস হলো একটি সম্মান প্রদর্শনের অনুষ্ঠান যা, মায়ের সম্মানে এবং মাতৃত্ব, মায়ের প্রতি ঋণ হিসেবে এবং সমাজে মায়েদের ভূমিকার জন্য উদযাপন করা হয়। বিশ্বের অনেক অঞ্চলে বিভিন্ন দিনে, সাধারণত মার্চ, এপ্রিল বা মে মাসে উদ্‌যাপন করা হয়।

বিশ্বের সবখানে মায়ের এবং মাতৃত্বের অনুষ্ঠান উদযাপন করতে দেখা যায়। এগুলির অনেকই প্রাচীন উৎসবের সাক্ষ্য। যেমন- সিবেল গ্রিক ধর্মানুষ্ঠান, হিলারিয়ার রোমান উৎসব, যা গ্রিকের সিবেল থেকে আসে অথবা সিবেল এবং হিলারিয়া থেকে আসা খ্রিস্টান ‘মাদারিং সানডে’ অনুষ্ঠানের মতোই।

একটি গোষ্ঠীর মতে, এই দিনটির সূত্রপাত প্রাচীন গ্রিসের মাতৃ আরাধনার প্রথা থেকে, যেখানে গ্রিক দেবতাদের মধ্যে এক বিশিষ্ট দেবী সিবেল-এর উদ্দেশে পালন করা হতো। এশিয়া মাইনরে মহাবিষুবের সময়ে এবং তারপর রোমে আইডিস অব মার্চ (১৫ মার্চ) থেকে ১৮ মার্চের মধ্যে এই উৎসবটি উদযাপন করা হতো।

প্রাচীন রোমানদের ম্যাত্রোনালিয়া নামে দেবী জুনোর প্রতি উৎসর্গিত আরো একটি ছুটির দিন ছিল। সেদিন মায়েদের উপহার দেওয়া হতো। মাদারিং সানডে-তে ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে অনেক দিন আগে থেকেই বহু আচারানুষ্ঠান ছিল, যেখানে মায়েদের এবং মাতৃত্বকে সম্মান জানানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট রোববারকে আলাদা করে রাখা হতো।

মাদারিং সানডের অনুষ্ঠান খ্রিস্টানদের অ্যাংগ্লিকানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পঞ্জিকার অঙ্গ। ক্যাথলিক পঞ্জিকা অনুযায়ী, এটিকে বলা হয়, ‘লেতারে সানডে’ যা লেন্টের সময়ে চতুর্থ রোববার পালন করা হতো ভার্জিন মেরি বা কুমারী মাতার ও প্রধান গির্জার সম্মানে।

প্রতি বছরের মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পৃথিবীর সব মায়ের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি জানানোর দিন, গ্রাফিকস- সংগৃহীত

প্রথানুযায়ী, দিনটিতে প্রতীকী উপহার দেওয়া এবং কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রান্না আর ধোয়ামোছার মতো মেয়েদের কাজগুলো বাড়ির অন্য কেউ করার মাধ্যমে উদযাপন করা হতো।

জুলিয়া ওয়ার্ড হোই রচিত ‘মাদার্স ডে প্রোক্লেমেশন’ বা ‘মা দিবসের ঘোষণাপত্র’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবস উদযাপনের গোড়ার দিকের চেষ্টাগুলির মধ্যে অন্যতম।

আমেরিকান গৃহযুদ্ধ ও ফ্রাঙ্কো-প্রুশীয় যুদ্ধের নৃশংসতার বিরুদ্ধে ১৮৭০ সালে রচিত ‘হোই’-এর মা দিবসের ঘোষণাপত্রটি ছিল একটি শান্তিকামী উদ্যোগ। রাজনৈতিক স্তরে সমাজকে গঠন করার ক্ষেত্রে নারীর একটি দায়িত্ব ও ভূমিকা আছে, হোই-এর এই নারীবাদী বিশ্বাস ঘোষণাপত্রটির মধ্যে নিহিত ছিল।

ঘোষণা
১৯১২ সালে আনা জার্ভিস ‘মাদার'স ডে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোশিয়েশন (আন্তর্জাতিক মা দিবস সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেন।

জানা যায়, ভার্জিনিয়ায় অ্যান নামে একজন শান্তিবাদী সমাজকর্মী ছিলেন। অ্যান ছিলেন খুবই ধর্মপ্রাণ এবং নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। তিনি ‘মাদারস ডে ওয়ার্ক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছোট ছোট ওয়ার্ক ক্লাব বানিয়ে সমাজের পিছিয়েপড়া নারীদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য চেষ্টা চালাতেন। নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য তিনি উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিতেন।
অ্যানের একটি মেয়ে ছিল। তার নাম ছিল- আনা মারিয়া রিভস জার্ভিস।

একদিন ছোট মেয়ের সামনেই অ্যান হাত জোড় করে বলেছিলেন, আমি প্রার্থনা করি, একদিন কেউ না কেউ, কোনো মায়েদের জন্য একটা দিন উৎসর্গ করুক। কারণ, মায়েরা রোজ মনুষ্যত্বের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন। একটি দিন উৎসর্গ করা তাদের অধিকার।

মায়ের সেই প্রার্থনা হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায় আনার। অ্যানের মৃত্যুর দিনটিকে সারাবিশ্বের প্রতিটি মায়ের উদ্দেশে উৎসর্গ করেন তিনি। তার পর থেকে মায়েদের প্রতি সম্মানে উদযাপিত হয়ে আসছে, আন্তর্জাতিক মা দিবস হিসেবে।

১৯১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ‘মা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকে প্রতিবছরের মে মাসের দ্বিতীয় রোববার আন্তর্জাতিক মা দিবস উদযাপন করা হয়ে থাকে।

;