শেক্সপিয়ারের জন্মভিটায় এক মোহনীয় সন্ধ্যা



সাঈদ চৌধুরী
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

শনিবার বিকেল সাতটা। আলো ঝলমল গোধূলি বেলায় সূর্যরশ্মি দিগন্ত বিস্তৃত। এভন নদীর তীরে সরিষার হলুদ হাসি আর স্নিগ্ধ হাওয়ায় সন্ধ্যাকে করেছে মোহনীয়। অনেকটা লাল বর্ণের স্ট্যাচু চোখে পড়তেই মনে হল ঠিক জায়গায় পা রেখেছি। পাশেই বিশ্বনন্দিত মহাকবি উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের জন্মভিটা। অনুভূতির রংটা অদ্ভুত ভাবে পালটে যায় সূর্যরশ্মির মত। মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।  

বৃটেনের ওয়ারউইকশায়ারের একটি ছোট শহর স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-এভন (STRATFORD-UPON-AVON)। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার (WILLIAM SHAKESPEARE) যে শহরে বড় হয়েছেন। হাজার হাজার মানুষ প্রতিবছর শেক্সপিয়ারের জন্মস্থান পরিদর্শন করেন। তার শৈশবের বাড়িটি আজো কাব্য ও নাট্য প্রেমিদের হৃদয়ে স্মৃতি হয়ে আছে।  


উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ছিলেন একজন বিখ্যাত ইংরেজ কবি, নাট্যকার এবং অভিনেতা। ট্র্যাজেডি, কমেডি ও ইতিহাস নির্ভর নাটকে তিনি ভুবন বিখ্যাত। পৃথিবীর আশিটি ভাষায় তা অনূদিত ও চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। পন্ডিতেরা তাকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার বলেই মনে করেন। 

শেক্সপিয়ার বিশ্ব সাহিত্যে অনন্য অবস্থান দখল করে আছেন। কবি হোমার ও দান্তে এবং উপন্যাসিক লিও টলস্টয় ও চার্লস ডিকেন্স সহ বহু বিশ্বমানের লেখকের সাথে তুলনা করা হয়। কিন্তু কোন লেখকের জীবন্ত খ্যাতি শেক্সপিয়ারের সাথে তুলনা হয়না। তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক দ্রুততা, উপলব্ধি এবং কাব্যশক্তি সম্পন্ন মহান লেখক। বিস্ময়কর ভাবে শব্দ এবং চিত্রের ব্যবহারে শেক্সপিয়ার অবিস্মরণীয়।


ব্রিটিশ থিয়েটারের এলিজাবেথান এবং জ্যাকোবিয়ান যুগে শেক্সপিয়ার ছিলেন একজন খ্যাতিমান লেখক। যে সময়কে ইংরেজ রেনেসাঁ বা প্রারম্ভিক আধুনিক যুগ বলা হয়। শেক্সপিয়ারের নাটক ও কবিতাগুলি আজও ব্যাপক জনপ্রিয়। হেমলেট (THE TRAGEDY OF HAMLET), ওথেলো (THE TRAGEDY OF OTHELLO), ম্যাকবেথ (THE TRAGEDY OF MACBETH), কিং লেয়ার (KING LEAR), রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট (ROMEO AND JULIET) ইত্যাদি তার সবচেয়ে জনপ্রিয় নাটক। ইংরেজি ভাষায় তিনি বহু নতুন শব্দ ও প্রবাদ বাক্য তৈরি করেছেন। ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’ (ALL'S WELL THAT ENDS WELL) প্রবাদবাক্য হিসেবে আজও বিভিন্ন ভাষায় ব্যবহৃত হয়। 

উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বাবা জন শেক্সপিয়ার 'স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-এভন' এলাকার হেনলি স্ট্রিটে বসবাস করতেন। এর একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এটি ইউনেস্কো মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারের মাধ্যমে স্বীকৃতি পেয়েছে। শেক্সপিয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্টের তত্বাবধানে রয়েছে শেক্সপিয়ারের জীবনের প্রত্যক্ষ প্রামাণ্য দলিল। ট্রিনিটি প্যারিশ রেজিস্টারে তার জন্ম এবং দাফন, তার সম্পূর্ণ রচনাগুলির প্রথম ফোলিওর অনুলিপি এখানে রয়েছে। একটি সিগনেট রিং আছে, যা শেক্সপিয়ারের ব্যবহৃত বলে বিশ্বাস করা হয়। শেক্সপিয়ারের প্রযোজনা সম্পর্কিত ছবি, প্রম্পট বই, রেকর্ডিং এবং মুদ্রিত সামগ্রীও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।  

শেক্সপিয়ারের জন্মস্থান হিসাবে এভন বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। জন শেক্সপিয়ার ১৫৫৭ সালে এখানেই মেরি আর্ডেনকে বিয়ে করেন এবং ১৫৬৪ সালে ২৩ এপ্রিল উইলিয়াম শেক্সপিয়ার জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আট ভাই ও বোনের মধ্যে তিনি হলেন তৃতীয়। ১৫৬৮ সালে জন শেক্সপিয়ার স্ট্র্যাটফোর্ডের মেয়র হন। শহরের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ‘মেয়র’ হিসেবে বাবার মর্যাদার কারণেই উইলিয়াম তার শিক্ষা লাভের জন্য গ্রামার স্কুলে যোগদানের সুবিধা পেয়েছিলেন।

১৫৮২ সালে ১৮ বছর বয়সে, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার অ্যান হ্যাথওয়েকে বিয়ে করেছিলেন। যিনি ছাব্বিশ বছর বয়সী ছিলেন। তরুণ দম্পতি জন্মস্থানে তার পিতামাতার সাথে বসবাস করতেন। এখানেই তাদের সন্তান সুসানা, জুডিথ এবং হ্যামনেটের (SUSANNA, JUDITH AND HAMNET) জন্ম হয়েছিল। জুডিথ এবং হ্যামনেট যমজ ছিলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে হ্যামনেট মারা যান। শেক্সপিয়ারের অনেক লেখায় পুত্র শোকের ছায়া লক্ষ্য করা যায়। 


জন শেক্সপিয়ার ১৬০১ সালে ইহত্যাগ করেন এবং জ্যেষ্ঠ জীবিত পুত্র হওয়ায় উইলিয়াম শেক্সপিয়ার বাড়ির উত্তরাধিকারি হন। উইলিয়াম তার বোন জোয়ান হার্টকে মূল বাড়ি সংলগ্ন ছোট দুই রুমে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। বাড়ির অবশিষ্ট অংশ ইজারা দেয়া হয়েছিল। যেটি সরাইখানা হয়ে উঠেছিল, যাকে মেডেনহেড বলা হয়। পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় ‘সোয়ান এন্ড মেডেনহেড ইন’। ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত এটি চালু ছিল। 

১৬১৬ সালে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার মৃত্যুকালে তার বড় মেয়ে সুসানার কাছে এই সম্পত্তি রেখে যান। আর  সুসানা যখন মারা যান, তিনি একমাত্র সন্তান এলিজাবেথের কাছে তা হস্তান্তর করেন। এলিজাবেথ দু'বার বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু কোনও সন্তান ছিল না। ১৬৭০ সালে যখন তিনি মারা যান তখন বাড়িটি জন হার্টের বংশধরদের কাছে চলে যায়। হার্ট পরিবার ১৮০৬ সাল পর্যন্ত সম্পত্তির মালিক ছিল। পরে তা থমাস কোর্টের জিম্মায় চলে যায়। ১৮৪৬ সালে এক কসাই কোর্টের কাছ থেকে তা ক্রয় করেছিল।

শেক্সপিয়ারের জন্মস্থান বিক্রির বিষয়টি জনমনে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তখন স্থানীয় উদ্যোগে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের স্মৃতি বিজড়িত ভবনটি অধিগ্রহণ ও সংরক্ষণের জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়। শুরু হয় সর্বজনীন প্রচারণা। চার্লস ডিকেন্স সমর্থিত প্রচারণা দ্রুত সফল হয়। ১৮৪৭ সালে ‘শেক্সপিয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্ট’ ৩০ হাজার পাউন্ডে এই সম্পত্তি ক্রয় করে। 


শেক্সপিয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্ট হল একটি স্বাধীন দাতব্য প্রতিষ্ঠান যা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যবাহী স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-এভনে শেক্সপিয়ার ব্যবহৃত দ্রব্য ও স্থানগুলির যত্ন নেয়। সারা বিশ্ব জুড়ে তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে প্রচার এবং আগ্রহীদের মধ্যে সে সময়ের আনন্দ উপভোগ করতে সহায়তা করে। এই  ট্রাস্টের মাধ্যমে শেক্সপিয়ারের জীবনের গল্প জানার ব্যবস্থা রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লেখক ও গবেষকেরা এসে আবিষ্কার করেন, কীভাবে অসাধারণ এই কবি ও নাট্যকার আমাদের জীবনকে নান্দনিক রূপ দিয়েছেন। ট্রাস্টের বিশ্বমানের সংগ্রহে রয়েছে শেক্সপিয়ারের লেখা সমূহ এবং তাকে নিয়ে লেখা অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ ও স্মৃতিচারণ। 

শেক্সপিয়ারের জন্মভূমির ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, রোমানরা স্ট্র্যাটফোর্ডের একটি রাস্তা তৈরি করেছিল, তবে প্রাচীন শহর হিসেবে তখনো প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। একটি জার্মান উপজাতি ‘অ্যাংলিয়ান ট্রাইব হুইক্কাস’ (THE HWICCAS) রোমানদের পরে বসতি স্থাপন করেছিল। তারা ছিল প্রথম স্ট্র্যাটফোর্ডিয়ান। তাদের বসতির মাধ্যমে ষষ্ঠ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে অ্যাঞ্জেলো-স্যাক্সন রাজ্য (ANGELO-SAXON KINGDOM) প্রতিষ্ঠিত হয়। 

শহরটির নামকরণ হয় 'এইট-স্ট্র্যাটফোর্ড দ্য আইলস অব দ্য ফোর্ড' (AET-STRATFORD THE ISLES OF THE FORD)। ৬৯৩ থেকে ৭১৭ সালের লিখিত রেফারেন্স সমূহে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। মাত্র ২০টি পরিবার তখন বসতি স্থাপন করেছিল। সেখানে একটি ট্রিনিটি চার্চ প্রতিষ্ঠার ফলে দূর অঞ্চলের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। গির্জা, মঠ  এবং ওয়াটারমিল সহ সামাজিক ও ব্যবসায়িক কর্মকান্ড ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হয়েছে।

১০১৫ সালে স্ট্র্যাটফোর্ডবাসীর জীবনে ভয়ঙ্কর দূর্ভাগ্য নেমে আসে। ড্যানিশ আক্রমণকারীরা ওয়ারউইকশায়ারের প্রতিটি বাড়িঘর ও গির্জা পুড়িয়ে দেয়। এতে প্রথম যুগের স্ট্র্যাটফোর্ডিয়ানদের সামান্যই বেঁচে ছিলেন। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের লেখায় ইংল্যান্ডে গৃহযুদ্ধের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন সময়ে স্ট্র্যাটফোর্ড লুটপাটের শিকার হয়েছিল। প্রতিবেশী প্যারিশগুলি থেকে সংঘর্ষ এবং স্থানীয় বিভাজন অতিক্রম করলেও বহু হিংসাত্মক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে। 


একাদশ শতাব্দীতে নরম্যান বিজয় (NORMAN CONQUEST) সত্ত্বেও শহরবাসীর জীবন তুলনামূলক ভাবে শান্তিপূর্ণ ছিল। গির্জাটি পাথরে পুনর্নির্মাণ করা হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যেরও বিকাশ ঘটে। দ্বাদশ, ত্রয়োদশ এবং চৌদ্দ শতক অবশ্য স্ট্র্যাটফোর্ডের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। তখনই জনবসতি বাড়তে থাকে। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি 'পরিকল্পিত শহর' হয়ে ওঠে।

১২৬৯ সালে গিল্ড অফ দ্য হলি ক্রস পৌরসভার দায়িত্ব গ্রহণ করে। বেশ যত্ন ও যোগ্যতার সাথে ১৫৪৭ সাল পর্যন্ত পরিচালনা করে। এই সময়ে সে এলাকার জন ডি স্ট্র্যাটফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৩১১ সালে স্নাতক ডিগ্রী  করেন। তিনি স্ট্র্যাটফোর্ডের উন্নয়নে একজন মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তারই প্রচেষ্টায় এলাকাটি আধুনিক শহরে পরিনত হয়। প্রশস্ত রাস্তার ধারে গাছপালা ও খেলার মাঠ সন্নিবেশ করা হয়।

১৪১৫ সালে রাজা হেনরি পঞ্চম (KING HENRY V) দ্বারা স্ট্র্যাটফোর্ডের আরো উন্নয়ন হয়েছে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে স্যার হিউ ক্লপটন (SIR HUGH CLOPTON) বেশ কয়েকটি ল্যান্ডমার্ক তৈরি করেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এভন জুড়ে বিশাল সেতু। এভনকে কটসওয়াল্ডস এবং ফেল্ডনের সাথে সেতুটি সংযুক্ত করে। ফলে বাণিজ্য সমৃদ্ধ শহরে পরিনত হয়। এতে ভেড়া শিল্পের উন্নয়নে সহায়ক হয়। পশম বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে।

জন শেক্সপিয়ার (JOHN SHAKESPEARE) সহ স্ট্র্যাটফোর্ডের মানুষের জীবনে ভেড়া পালন একটি ইতিবাচক ব্যবসা ছিল। কটসভোল্ডের কাছাকাছি অবস্থিত স্ট্র্যাটফোর্ড ছিল ভেড়া পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন এবং বিতরণের একটি প্রধান কেন্দ্র। ১৫৬৪ সালে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের (WILLIAM SHAKESPEARE) জন্মের সময় স্ট্র্যাটফোর্ড ছিল পশম বাণিজ্যে সফল একটি শহর। আস্তে আস্তে ক্লপটন ব্রিজ কারিগরি ও অন্যান্য ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করে এবং ক্রমবর্ধমান বাজার শহর হিসেবে খ্যাতি অর্জনে অবদান রাখে। 

ষোড়শ শতাব্দীতে ক্লপটন ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পুণরায় মেরামত করা হয়। তবে বৃহত্তম নতুন উন্নয়ন সাধিত হয়েছে জন পেটন (JOHN PAYTON) দ্বারা। পেটনের সময় পুরাতন শহরের উত্তর দিকে সম্প্রসারণ ও বেশ কয়েকটি নতুন রাস্তা তৈরি হয়। তবে স্ট্র্যাটফোর্ডের প্রায় হাজার বছরের পুরনো লেআউট আজো সংরক্ষিত আছে। 


লন্ডনে শেক্সপিয়ার

উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের কর্মজীবন লন্ডনে শুরু হয়েছিল। কিন্তু তিনি কখন লন্ডন এসেছিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শেক্সপিয়ারের যমজরা ১৫৮৫ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৫৯২ সালে লন্ডনে তার খ্যাতি বা পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফলে মধ্যবর্তী বছরগুলি রহস্যময় হিসেবে বিবেচিত হয়। পণ্ডিতেরা সাধারণত এই বছরগুলিকে 'দ্য লস্ট ইয়ারস' বলে উল্লেখ করেন।

লন্ডনের সময়কালে শেক্সপিয়ারের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। দুটি দীর্ঘ কবিতা 'ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডোনিস' (VENUS AND ADONIS, 1593) এবং 'দ্য রেপ অব লুক্রেস' (THE RAPE OF LUCRECE, 1594)। এসময়  শেক্সপিয়ার একটি কোম্পানির নিয়মিত নাট্যকার ছিলেন। প্রায় বিশ বছর ধরে বছরে গড়ে দুটি নাটক নির্মাণ করেছিলেন। এই কোম্পানিতে থাকাকালীন ১৬০৩ সালে জেমস প্রথম (KING JAMES I)  এর পৃষ্ঠপোষকতায় দ্য কিংস ম্যানে পরিণত হয়েছিলেন।

তখন শেক্সপিয়ার বিখ্যাত ট্র্যাজেডি বিষয়ক কিং লিয়ার এবং ম্যাকবেথের (KING LEAR AND MACBETH) পাশাপাশি দ্য উইন্টারস টেল এবং দ্য টেম্পেস্টের (WINTER’S TALE AND THE TEMPEST) মতো দুর্দান্ত রোম্যান্স লিখেছিলেন। সে সময়ে তিনি অভিনেতাদের সংস্থা দ্য লর্ড চেম্বারলাইনস মেন (THE LORD CHAMBERLAIN’S MEN) এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয়েছিলেন।

শেক্সপিয়ারের কাজ 

উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের রচনার মধ্যে রয়েছে ৩৮টি নাটক, ২টি বর্ণনামূলক কবিতা, ১৫৪টি সনেট এবং বিভিন্ন ধরনের কবিতা। শেক্সপিয়ারের নাটকের কোনো মূল পাণ্ডুলিপি আজও পাওয়া যায়নি। তার কোম্পানির অভিনেতাদের একটি গ্রুপকে ধন্যবাদ দেয়া হয়, যাদের মাধ্যমে অধিকাংশ নাটক সংরক্ষিত রয়েছে। শেক্সপিয়ারের মৃত্যুর পর তারা নাটকগুলো সংরক্ষণ ও প্রকাশের জন্য সংগ্রহ করেছিলেন। এই লেখাগুলি একত্রিত করা হয়েছিল যা প্রথম ফোলিও (FIRST FOLIO ) নামে পরিচিত। 'ফোলিও' ব্যবহৃত কাগজের আকারকে বোঝায়। এতে তার ৩৬টি নাটক ছিল।

শেক্সপিয়ারের লিগেসি বা উত্তরাধিকার খুবই সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময়। তার নাটকগুলি একাধিক ঘরানা এবং সংস্কৃতি জুড়ে অগণিত অভিযোজন তৈরি করেছে। তার নাটক মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে স্থায়ী উপস্থিতি পেয়েছে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের সম্পূর্ণ কাজ (THE COMPLETE WORKS OF WILLIAM SHAKESPEARE) বিভিন্ন ভাবে সংকলিত হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে তার সমস্ত নাটক, সনেট এবং অন্যান্য কবিতা।


এভনের নতুন বাড়ি

লন্ডন প্রেক্ষাগৃহে শেক্সপিয়ারের সাফল্য তাকে যথেষ্ট ধনী করে তোলে। ১৫৯৭ সালে তিনি 'স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-এভনের সবচেয়ে বড় বাড়ি কিনতে সক্ষম হন। যদিও তার পেশাগত কর্মজীবন লন্ডনে কাটিয়েছেন। তবুও তিনি জন্মস্থানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন।

শেক্সপিয়ার মারা যাওয়ার পর ১৭৫৯ সালে বাড়িটি ভেঙে সংস্কার করা হয়। সেখানে একটি বাগানও তৈরি করা হয়েছে। বিশাল সাইট জুড়ে নিযুক্ত শিল্পকর্মগুলি শেক্সপিয়ারের রচনাবলী ও পারিবারিক জীবনের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। যেখানে শেক্সপিয়ারের গুরুত্ব স্মরণ করতে এবং দর্শনার্থীদের ব্যক্তিগত সংযোগ তৈরির জন্য সাজানো হয়েছে। পাশেই রয়েছে কিং এডওয়ার্ড ষষ্ঠ স্কুল এবং গিল্ড চ্যাপেল। দুটোই তরুণ উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বেড়ে ওঠার সাথে সম্পৃক্ত।

শেক্সপিয়ারের সাইটে আবিষ্কৃত সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণে দেখায়, শেক্সপিয়ার লন্ডনে সাময়িক বাসিন্দা ছিলেন। তার সময় স্ট্র্যাটফোর্ড এবং লন্ডনের মধ্যে ভাগ করেছেন। তবে অধিক সময় তিনি জন্মস্থানে কাটিয়েছেন।

অ্যান হ্যাথওয়ের কটেজ

উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের স্ত্রী অ্যান হ্যাথওয়ের কটেজ একটি দর্শনীয় স্থান। এই কটেজ ছিল মূলত একটি খামারবাড়ি। এটি ১৪৬৩ সালে নির্মিত হয়েছিল। মাত্র তিনটি কক্ষ নিয়ে গঠিত। এরমধ্যে দুটি রান্নাঘর এবং পার্লার। কটেজে বসবাসকারী প্রথম হ্যাথওয়ে ছিলেন অ্যানের দাদা জন হ্যাথওয়ে। যিনি ছিলেন ভেড়া চাষি। শেক্সপিয়ারের স্ত্রী অ্যান ১৫৫৬ সালে এই কটেজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। খামার হিসেবে এটি 'হিউল্যান্ডস' নামে পরিচিত ছিল এবং হ্যাথওয়ে পরিবার ছিল সফল ভেড়া চাষি। যেখানে গবাদি পশু এবং শাক-সবজি চাষের জায়গা ছিল।

এখানেই অ্যানের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। যেখানে তরুণ শেক্সপিয়ার তাদের সম্পর্কের প্রথম অংশে তাকে দেখতে যেতেন। ১৩ প্রজন্ম ধরে যেখানে বসবাসকারী পরিবারের পাঁচ শতাব্দীর গল্প উন্মোচিত হয়। ৫০০ বছরেরও বেশি আগে নির্মিত এবং বছরের পর বছর ধরে প্রসারিত বাড়ির বেশিরভাগ অংশই টিকে আছে। হ্যাথওয়ে বিছানা সহ আসল আসবাবপত্র আজো সংরক্ষিত রয়েছে। কয়েক একর জায়গা জুড়ে সুন্দর ফুল এবং ফলের বাগানে ঘুরে মানুষ শেক্সপিয়ারের নাটক দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়।

অ্যান হ্যাথওয়ের কবর

স্থানীয় হলি ট্রিনিটি চার্চে স্বামীর বাম দিকে অ্যান হ্যাথওয়ের কবর। শেক্সপিয়ারের স্মৃতি স্তম্ভের মধ্যে তাকে সমাহিত করা হয়েছে। অ্যানের কবরটি ল্যাটিন ভাষায় একটি সুন্দর এপিটাফ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। সম্ভবত ১৬৩৪ সালে কন্যা সুসানার লেখা। অ্যানকে একজন ধার্মিক মহিলা এবং একজন ভাল মা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই এপিটাফ একটি পিতলের ফলকে সংরক্ষিত। 

স্ট্যাচু অব শেক্সপিয়ার

স্ট্যাচু অব শেক্সপিয়ার দাঁড়িয়ে আছে স্টার্টফোর্ড-আপন-এভনের রয়াল শেক্সপিয়ার থিয়েটারের সামনে। শেক্সপিয়ারের সাহিত্যের উপাদান তুলে ধরার জন্য এর স্তম্ভমূলে আরো চারটি ছোট মূর্তি রয়েছে। প্যারিসে বুলেভার্দ মন্টপানাসের স্টুডিওতে এটি ডিজাইন করেছেন ভাস্কর্য লর্ড রোনাল্ড গোয়ার।

রাশিয়ার প্রথম নাটক

১৭৮৬ সালে রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট দ্য মেরি ওয়াইভস অব উইন্ডসোর নামের শেক্সপিয়ারের একটি নাটক অনুবাদ করেন। তিনি নেভা নদীর পাশে হারমিটেজ থিয়েটার নির্মাণ করেন। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় তার অনুবাদকৃত নাটক। এটাই রাশিয়ার প্রথম নাটক যার অনুপ্রেরণা ছিলেন শেক্সপিয়ার।

দ্য কিংস মেন

১৬০৩ সালে রানি এলিজাবেথ মারা গেলে পরবর্তী রাজা জেইমস দ্য ফার্স্ট শেক্সপিয়ারের নাট্য দলকে রাজার একান্ত দল হিসেবে গ্রহণ করেন। তখনই দলটির নাম পরিবর্তিত হলো ‘দ্য কিংস মেন’ হিসেবে।

লেখক: লন্ডন প্রবাসী। কবি ও কথাশিল্পী। অতীত চিত্র ও তথ্য সূত্র: শেক্সপিয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্ট

   

ফেনী শহরে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে কৃষ্ণচূড়া



মোস্তাফিজ মুরাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ফেনী
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

'কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে-আমি ভুবন ভুলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে' জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই মনোমুগ্ধকর গানে ফুটে উঠেছে কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য। কৃষ্ণচূড়া যেন প্রকৃতিকে দান করেছে লাল আভার অপরূপ সৌন্দর্যের মহিমা। সাথে গ্রীষ্মের উত্তাপে শহরে সৌরভ ছড়াচ্ছে নানা জাতের ফুল। তীব্র তাপদাহের পর কালবৈশাখী, এরপর মাঝারি বৃষ্টির মধ্যে ফুলের আগমন। এতে রঙের উল্লাসে মেতে উঠেছে ফেনী শহরবাসী।

ফেনী শহরের কোর্ট বিল্ডিং, এলজিইডি, পুলিশ লাইন, নবীন চন্দ্র সেন কালচারাল সেন্টার, ফেনী সরকারি কলেজ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া। এটি একদিকে প্রকৃতিকে যেমন সাজিয়েছে অপরূপ সৌন্দর্যে, অন্যদিকে এর সৌন্দর্য মুগ্ধ করছে তরুণ-তরুণী, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষসহ ফুলপ্রিয় পথচারীদের। শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে, সরকারি দফতরসহ স্কুল-কলেজে কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল ও উজ্জ্বল সবুজ পাতার সংমিশ্রণ দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে চারপাশ।


কৃষ্ণচূড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ফুলের ঘ্রাণে মুখরিত হয়ে আছে পুরো শহর। শহরের মূল সড়কের ডিভাইডারে পৌরসভার উদ্যোগে লাগানো হাসনাহেনা, রজনিগন্ধা, গন্ধরাজসহ নানা জাতের ফুল গাছে ফুল ফুটেছে। এটি একদিকে বাড়িয়েছে সৌন্দর্য অন্যদিকে হেঁটে কিংবা রিকশায় চলাচল করলে পাওয়া যায় এসব ফুলের সুঘ্রাণ।

ফেনী শহরের কৃষ্ণচূড়ার অপরূপ সৌন্দর্য দেখে ফুলপ্রিয় পথিকরা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া ফুল প্রকৃতিকে অনন্য সাজে সাজিয়েছে। এই ফুলের সৌন্দর্যের কারণে পথচারীরা একবার হলেও এই ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এর গাছের উপর নজর দিবে। পাশাপাশি তীব্র গরমে অন্যান্য ফুলের সুঘ্রাণে চারপাশ মুখরিত হওয়াতে ক্লান্তিতা কিছুটা হলেও কমছে।


তারা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া ফুলের এই নান্দনিক দৃশ্য দেখতে এর গাছ রোপণ করা জরুরি। রাস্তা প্রশস্তকরণ, ঘর-বাড়ি নির্মাণসহ নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে ফেলা হয়। অন্যান্য গাছ রোপণ করার পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া রোপণ করলে একদিকে যেমন সৌন্দর্য বাড়াবে অন্যদিকে পরিবেশ বান্ধব হবে।

সাজিদ হাসান নামের এক পথচারী বলেন, কৃষ্ণচূড়া একদিকে যেমন প্রকৃতিতে অপরুপ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে, আরেকদিকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমাবে। সারাদেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে, আমার মতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে এই গাছটিও যুক্ত করা উচিত। তীব্র গরমের পর বৃষ্টি হলো, এরপর শহরে নানা রঙের ফুলের দেখা মিলছে, ফুলের ঘ্রাণে চলাচল করতেই ভালো লাগছে।

ফারজানা ইয়াসমিন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ফুলের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। অন্যান্য ফুলের পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া ফুল আমার অনেক ভালো লাগে। আমাদের কলেজে বকুল তলা আছে, ক্যান্টিনের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। সুযোগ পেলেই ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করি।

অনিক মোহন নামে একজন বলেন, রিকশায় করে যখন বাসায় ফিরি, শহরের রাস্তার মাঝে ভিডাইভারে লাগানো নানা জাতের ফুলের ঘ্রাণ মনকে আনন্দিত করে। রাতের বেলা শহর যখন নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তখন এ ফুলের সৌন্দর্য কয়েকশ’ গুণ বেড়ে যায়।

সড়কের পাশে কৃষ্ণচূড়া লাগানো হলে সৌন্দর্য বাড়বে বলে মনে করেন পথচারী মিনহাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাস্তা প্রশস্তকরণের জন্য যে গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে, ওই গাছগুলোর জায়গা কৃষ্ণচূড়ার গাছ লাগালে রাস্তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে।

একই কথা বলেন শহরের ব্যবসায়ী নাদিম আহমেদ। তিনি বলেন, সৌন্দর্য ও পরিবেশের কথা বিবেচনা করে এই গাছ রোপণ করা উচিত আমাদের। তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে অন্যন্যা গাছ রোপণ করার পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া গাছ রোপণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। যেগুলো শহরে আছে তাতেই সৌন্দর্য বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ, আরও যদি লাগানো যায় ফুলে ফুলে ভরে উঠবে আমাদের শহর।

কৃষ্ণচূড়া মাদাগাস্কারের শুষ্ক পত্রঝরা বৃক্ষের জঙ্গলে পাওয়া যায়। যদিও জঙ্গলে এটি বিলুপ্ত প্রায়, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এটি জন্মানো সম্ভব হয়েছে। সৌন্দর্যবর্ধন গুণ ছাড়াও, এই গাছ উষ্ণ আবহাওয়ায় ছায়া দিতে বিশেষভাবে উপযুক্ত। কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদ উচ্চতায় কম (সর্বোচ্চ ১২ মিটার) হলেও শাখা-পল্লবে এটি বেশি অঞ্চল ব্যাপী ছড়ায়।

শুষ্ক অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে কৃষ্ণচূড়ার পাতা ঝরে গেলেও, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এটি চিরসবুজ থাকে। কৃষ্ণচূড়া ফুলের রং উজ্জ্বল লাল। পত্র ঝরা বৃক্ষ, শীতে গাছের সব পাতা ঝরে যায়। বাংলাদেশে বসন্ত কালে এ ফুল ফোটে। ফুলগুলো বড় চারটি পাপড়ি যুক্ত। পাপড়িগুলো প্রায় ৮ সেন্টিমিটারের মত লম্বা হতে পারে। কৃষ্ণচূড়া জটিল পত্র বিশিষ্ট এবং উজ্জ্বল সবুজ। প্রতিটি পাতা ৩০-৫০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ২০-৪০ টি উপপত্র বিশিষ্ট। কৃষ্ণচূড়ার জন্মানোর জন্য উষ্ণ বা প্রায়-উষ্ণ আবহাওয়ার দরকার। এই বৃক্ষ শুষ্ক ও লবণাক্ত অবস্থা সহ্য করতে পারে।

জানা যায়, অপরূপ সৌন্দর্য ছড়ানোর পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর পাতা, মূলের বাকল ও ফুল ভেষজ গুণাগুণ সম্পূর্ণ, যা জ্বর ও খুশকি নিরাময়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ভেষজটি হেমিপ্লেজিয়া, আর্থরাইটিস এবং কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। কৃষ্ণচূড়া গাছের শিকড়, বাকল এবং ফুল সবই পরজীবী সংক্রমণ নিরাময়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।

;

হলুদ আভায় মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে সূর্যমুখী 



শহিদুল ইসলাম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নওগাঁ
ছবি: প্রাণের উচ্ছ্বাসে সূর্যমুখী

ছবি: প্রাণের উচ্ছ্বাসে সূর্যমুখী

  • Font increase
  • Font Decrease

মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে সূর্যমুখী। বাস্তব জীবনের নিস্তব্ধতা ভাঙছে তার হলুদ আভায়। মৌমাছির আলিঙ্গন পেতে ছড়াচ্ছে উষ্ণ মুগ্ধতা। হলুদের কারুকার্যে বিমোহিত হচ্ছে পথিকের মন। লুকায়িত সৌন্দর্য প্রকৃতির মাঝে তুলে ধরে প্রবল আকর্ষণে টানছে দর্শনার্থীদের। সবুজ পাতা ভেদ করা সেই অনিন্দ্য হাসি যেন কৃষকের মুখেরই প্রতিচ্ছবি। সূর্যমুখী ফুল চাষে জনপ্রিয়তা বাড়ছে কৃষকদের মাঝে।

সূর্যমুখী এক ধরনের একবর্ষী ফুলগাছ। সূর্যমুখী গাছ লম্বায় ৩ মিটার (৯ দশমিক ৮ ফুট) হয়ে থাকে। ফুলের ব্যাস ৩০ সেন্টিমিটার (১২ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়। এই ফুল দেখতে কিছুটা সূর্যের মতো এবং সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে বলে এর এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। ফুলের বীজ হাঁস-মুরগির খাদ্যরূপে ও তেলের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

জানা যায়, বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের উৎস হিসেবে ১৯৭৫ সাল থেকে এ ফুলের চাষ শুরু হলেও কৃষকের মাঝে জনপ্রিয়তা পায় নি বহুদিন। পরে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। বর্তমানে রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, নাটোর জেলা, পাবনা, নওগাঁ, দিনাজপুর, গাজীপুর, টাঙ্গাইল প্রভৃতি জেলাতে এর ব্যাপক চাষ হচ্ছে।

সূর্যমুখীর বাঁধভাঙা হাসি আর প্রাণের উচ্ছ্বাস

সোমবার (১২ মে) সকালে সরেজমিনে নওগাঁ সদর উপজেলার মুক্তির মোড় কেন্দ্র শহীদ মিনারের পাশে দেখা যায়, সূর্যমুখী বাতাসে; দুলছে আলোর প্রতিফলনে পাপড়িগুলো যেন চকচকে হলুদ আভা ছড়াচ্ছে। মৌমাছি এক ফুল থেকে অন্যফুলে মধু আহরণে ছুটাছুটি করছে আর এসব দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে পথচারীরা। এছাড়াও নওগাঁর বেশ কিছু অঞ্চলে চাষ হচ্ছে সূর্যমুখী। একদিকে যেমন ফুলগুলো সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে তেমনি বীজ থেকে ভোজ্য তেল উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে সূর্যমুখীর বীজ। সূর্যমুখী গাছ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। 

প্রতিদিন ভোরে সূর্যমুখী বাগানের সকল গাছ অনেকটা পূর্বদিকে মুখ করে থাকে। যেদিকে সূর্য দেখা দেয় এবং ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে থাকে। সূর্যের সাথে সাথে সূর্যমুখীগুলোও ধীরে ধীরে নিজেদের দিক পাল্টাতে থাকে। সূর্য যেদিকে যায় তারাও সেদিকে যায়। সবসময়ই এগুলো সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। সূর্য যখন পশ্চিম দিকে অস্ত যায় তারাও তখন পশ্চিম দিক বরাবর থাকে। অস্ত যাওয়ার পরে তারা রাতব্যাপী আবার উল্টো দিকে ঘুরে পূর্বমুখী হয়। এভাবে শুকিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের এই চক্র চলতেই থাকে।

সূর্যের সাথে সাথে নিজেদের দিকও পাল্টাতে থাকে সূর্যমুখী

তবে সবার মাঝে একটি প্রশ্ন অনেক সময় ঘুরপাক খায় যে সূর্যমুখী ফুল কেন সূর্যে দিক হয়ে থাকে! সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের একটি দল সূর্যমুখীর এই দিক পরিবর্তন সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যের রহস্য উন্মোচন করেছেন। তাদের গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসে সূর্যমুখীরা তাদের নিজস্ব সার্কাডিয়ান চক্রে আবদ্ধ। এই চক্র সচল থাকার কারণে সূর্যমুখীরা সব সময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। গবেষকরা সায়েন্স জার্নালে তাদের গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশ করেছেন। সার্কাডিয়ান চক্র বা সার্কাডিয়ান ঘড়িকে অনেক সময় ‘দেহঘড়ি’ নামেও ডাকা হয়। মানুষের মাঝেও এই চক্র বিদ্যমান। যেমন প্রত্যেক মানুষেরই দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম চলে আসে।

পথচারী রায়হান বলেন, ফুল শুভ্রতার প্রতীক ও পবিত্র। ফুলকে যারা ভালোবাসে তাদের মনটাও সুন্দর। সূর্যমুখী ফুল সব ফুলের চেয়ে আলাদা কারন সূর্যের দিক মুখ করে বেশিরভাগ থাকে এ ফুল। বিশেষ করে দুপুর শুরু হলে সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে এ ফুল যা দেখতেও খুব সুন্দর লাগে তাছাড়া এ ফুলের বীজ থেকে তেল হয় যা অনেক স্বাস্থ্যকর।

ক্ষুদে শিক্ষার্থী আফরিন (১০) জানায়, আমি ফুল খুবই ভালোবাসি আর সূর্যমুখী ফুলগুলো হলুদ হবার কারনে আরো বেশি ভালো লাগে। নামটা যেমন সুন্দর তেমনি মুগ্ধতাও ছড়ায়। ফুলগুলো থেকে তেল হয় তাই কোনোভাবেই নষ্ট করা যাবে না। আমরা দূর থেকে দেখেই শান্তি পাই।

সূর্যের সাথেই একাত্মতা সূর্যমুখীর

স্থানীয় বাসিন্দা আরেফিন তুহিন বলেন, স্বল্প পরিসরে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য যারা সূর্যমুখী ফুলের গাছ লাগিয়েছে তারা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। ফুল মানেই সুন্দর সূর্যমুখীও এটিএ ব্যাতিক্রম নয়। মাঝে মাঝে যখন ফুলের দিকে চোখ যায় খুব ভালোলাগা কাজ করে। এ ফুল দেখতে যেমন সুন্দর এটির তেল ও খুব পুষ্টিকর।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে চলতি অর্থবছরে সূর্যমুখী চাষের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ হেক্টর ও অর্জন হয়েছে ৬৫ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন হয়েছে ১০০ মেট্রিক টন। 

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বার্তা২৪.কমকে বলেন- সূর্যমুখী একদিকে যেমন শুভ্রতার প্রতীক আবার অন্যদিকে বীজ থেকে তেল উৎপাদন হয় আবার মধুও পাওয়া যায়। বাজারে যে ভৈজ্যতেল গুলো রয়েছে যেমন, সয়াবিন,সরিষা, পাম-ওয়েল ইত্যাদি এগুলোর চেয়েও অনেক বেশি পুষ্টিগুণ আছে সূর্যমুখীর তেলে যা স্বাস্থ্যকর এবং স্বাস্থ্যর জন্য খুবই উপকারী। আমরা বেশি বেশি উৎপাদনে কৃষকদের সব রকম পরামর্শ দিয়ে থাকি।

;

ওই আকাশে লুকিয়ে আছে মা



সহিদুল আলম স্বপন, লেখক জেনেভা সুইজারল্যান্ড
ওই আকাশে লুকিয়ে আছে মা

ওই আকাশে লুকিয়ে আছে মা

  • Font increase
  • Font Decrease

তো ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকের কথা, তখন সুইস কোম্পনী ফাদসা এস এ তে চাকরী করি। হঠাৎ একদিন কোম্পানীর মালিক মশিউয়্যু মিশেল লাসের (বাংলায় জনাব মিশেল ল্যাসার) তার অফিসে ডেকে পাঠালেন।আমিতো ভয়ে দিশেহারা, ভাবলাম ফ্রেন্স ভাষা না জানার কারণে আমার মনে হয় এবার চাকরীটাই গেল। বলে রাখা ভালো, সুইজারল্যান্ডের চারটি সরকারী ভাষার(ফরাসী, সুইস জার্মান, ইতালীয়ান এবং রোমন্স - রোমান নয়)মাঝে জেনেভা ফরাসী ভাষাভাষী।নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটা ভ্যানিশিং ক্রিমের পাবলিসিটি ছিল-ম্যানোলা সিবোঁ ভ্যানিশিং ক্রিম নিয়ে এলো ফরাসী সৌরভ। পরে জেনেছি সিবোঁ ফরাসী শব্দ যার অর্থ খুব ভালো (হয়তো বাংলায় বুঝাতে চেয়েছেন সুগন্ধময়)-আর এটাই শুধু আমার ফরাসী ভাষার ভান্ডার।

যাই হোক, ভয়ে ভয়ে তাঁর খাস কামরায় হাজির হলাম।দেখি কামরায় সোফার এককোনে প্যাট্রিক(আমার সুইস সহকর্মী আমার চেয়ে বছর দুয়েক এর ছোট হবে)আর লরেতা মার্টিনি এইচ আর হেড বসে আছে। বুঝতে আর দেরী হলোনা, এখনি বস বলবেন ইউ আর ফায়ার এবং প্যাট্রিককে তোমার সব কাজগুলো বুঝিয়ে দাও।

কোথায় ফায়ার তা না বলে মশিউয়্যু লাসের বললেন মাই ডিয়ার, আগামী সপ্তাহে প্যাট্রিক আর আলম (আমি) তোমরা দুজনে রটারডাম যাচ্ছো ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং এর জন্য। আলম তুমি কাল ভোরে বার্ণ(সুইজারল্যান্ডের রাজধানী)যাবে নেদারল্যান্ডের ভিসা করাতে। লরেতা তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবে। বলে রাখা ভালো তখনো আমি সুইস নাগরিক হয়ে উঠিনি, আর মশিউয়্যু মিশেল লাসের ই আমাকে সুইজারল্যান্ডে স্হায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

রটারডাম উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্র নেদারল্যান্ডসের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর( আমস্টারডামের পরেই)।এটি ইউরোপের বৃহত্তম ও বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর।নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণ হল্যান্ড প্রদেশে, উত্তর সাগরের তীরে, রাইন নদীর মোহনায় অবস্থিত এই বন্দর শহরকে প্রায়শই "ইউরোপের প্রবেশদ্বার" নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

তো যেই কথা সেই কাজ, সমস্ত আনুষ্ঠিকতা শেষে সপ্তাহান্তে কেএলএম রয়্যাল ডাচ এয়ারলাইন্সে চেপে জেনেভা থেকে আমস্টারডামের শিফল বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলাম। আমস্টারডাম শিফল বিমানবন্দর থেকে ট্রেনে রটারডাম সেন্ট্রাল ট্রেন ষ্টেশনে এসে নামলাম। সেখান থেকে টেক্সীকরে সরাসরি রটারডাম ম্যারিয়ট হোটেলে।রটারডাম স্কুল অফ ম্যানেজমেন্ট, ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি (আরএসএম) ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় বিসনেস স্কুলগুলির মধ্যে একটি, এখানেই আমাদের কোর্স। বাংলাদেশ আর নেদারল্যান্ডসের মাঝে চার পাঁচ ঘন্টার পার্থক্য। প্রতিদিন বাবা -মা সাথে কথা হয়। বাবা আমার জ্ঞানের পাগল। ৬০ বছর বয়সে উনি তাঁর মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। কিন্তু বাবা মা দুজনের কেউ মানতে পারছিলেন না আমি বিদেশে থাকি। দেশে থাকতে মা এর আহাজারীতে বাবা বিভিন্ন কায়দায় বাংলাদেশ মিলিাটারী একাডেমী থেকে আমায় ছাড়িয়ে এনেছিলেন। রাতে ঘুমাতে যাবার আগের মা কে ফোন করে ঘুমাই। বরাবরের মতে ১৮ ই ফেব্রুয়ারি রাতে মার সাথে কথা বলছি, মা আমার প্রাইমেরীর গন্ডি পেরুনো কিন্তু শিক্ষার প্রতি তাঁর পরম শ্রদ্ধা। গান-নাটক সংস্কৃতির পাগল আমি। মা আমার প্রতিদিন ই জিজ্ঞেস করেন কেমন চলছে গান-বাজনা। অনেক গুলো নূতন গানের ক্যাসেট কিনে রেখেছেন তিনি, সুইজারল্যান্ডে ফিরলেই ডাকযোগে পাঠিয়ে দিবেন, আমার প্রিয় কুমিল্লার খদ্দরের হাউয়াই শার্টসহ। আরো কত কথা, শেষ হয়েও হয়না শেষ। মায়ের প্রতিটি কথায় সেকি এক অনুপ্রেরণা। আজ বাংলাদেশে শেষ রোজা। পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার রোজার ঈদ।

পরদিন ক্লাস নেই, ভেবে রেখেছি সকালে ব্রেকফাস্ট না করে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে ফ্রেস হয়ে তারপর সারাদিন ঘুরে বেড়াবো, দেখবো বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভাবনী বন্দর, রটারডাম চিড়িয়াখানা, রিমাস্টারড" ডিজিটাল আর্ট অডিওভিজ্যুয়াল, ইউরোমাস্ট টাওয়ার, কিউব হাউস ইত্যাদি আর রাতে যাবে বাইয়্যাবীচ ক্লাবে নাচতে।

হোটেল রুমের সাইড টেবিলে রাখা ফোনটা সাত সকালেই আজ চিৎকার করে কান্না করে চলেছে, ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং……। ফোনটা যেন পাগল হয়ে গেছে। বিরক্ত হয়েই মিনিট খানেক পর আঁধো বোজা চোখে ফোনটা কানের কাছে নিয়ে বললাম, হোয়াট দ্যা হেল প্যাট্রিক, লেট মি গেট সাম স্লিপ । ফোনের ঐ প্রান্ত থেকে ভেসে এলো ভাইয়া আমি ফরিদ(আমার ছোট বোন পান্নার বর), এক নি:শ্বাসে বলে চলছেন, ভাইয়া আমরা এই মাত্র কবরস্তান থেকে আসলাম, সব কিছুই ঠিক ছিল, দাফন- কাফন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে, কেঁদে আর কি করবেন, আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, এইযে আব্বার সাথে কথা বলেন, আম্মাতো কাউকে কষ্ট দেননি, আল্লাহর কাছে আম্মার রুহের মাগফিরাত কামনা করে নামাজ পড়ুন যেন উনাকে আল্লাহ জান্নাতে স্হান করে দেন।চোখের জলে বালিশ ভিজেঁ যাচ্ছে আমি আজো প্রতিনিয়ত গেয়ে চলছি - " সবাই বলে, "ওই আকাশে লুকিয়ে আছে" "খুঁজে দেখ, পাবে দূর নক্ষত্রমাঝে"রাতের তারা, আমায় কি তুই বলতে পারিস কোথায় আছে, কেমন আছে মা? ভোরের তারা, রাতের তারা, মা-কে জানিয়ে দিস অনেক কেঁদেছি আর কাঁদতে পারি না।

;

১২ মে: আন্তর্জাতিক মা দিবস, মায়েদের ত্যাগের স্বীকৃতির দিন



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

মা পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াবী শব্দ। এটি কেবল একটি ডাক নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারও আবেগ, সুখ-দুঃখ, ব্যথা, আনন্দ, আকাঙ্ক্ষা, অভিযোগ- না জানি আরো কত কত অনুভূতি!

হাদিসে বলা আছে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। সনাতন ধর্মের পুরাণে লিখিত রয়েছে- জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী অর্থাৎ মা এবং জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এমনকী অন্যান্য ধর্মগ্রন্থেও জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি অশেষ ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷

অশেষ কষ্ট সহ্য করে আমাদের লালন-পালন করেন জন্মদাত্রী মা। তাদের কষ্ট উপলব্ধি করতে উদযাপন করা হয়, আন্তর্জাতিক মা দিবস। এই বিশেষ দিনে মা এবং মাতৃসমতুল্যদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। সারাবিশ্বের অনেক দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রোববার উদযাপিত হয়, আন্তর্জাতিক মা দিবস। এই দিনটি ‘মাদারিং সানডে’ নামেও পরিচিত। এ বছর ১২ মে পড়েছে মা দিবস।

মা দিবসের আদি ইতিহাস
আন্তর্জাতিক মা দিবসের ইতিহাস বিষয়ে উইকিপিডিয়ায় লেখা হয়েছে, মা দিবস বা মাতৃ দিবস হলো একটি সম্মান প্রদর্শনের অনুষ্ঠান যা, মায়ের সম্মানে এবং মাতৃত্ব, মায়ের প্রতি ঋণ হিসেবে এবং সমাজে মায়েদের ভূমিকার জন্য উদযাপন করা হয়। বিশ্বের অনেক অঞ্চলে বিভিন্ন দিনে, সাধারণত মার্চ, এপ্রিল বা মে মাসে উদ্‌যাপন করা হয়।

বিশ্বের সবখানে মায়ের এবং মাতৃত্বের অনুষ্ঠান উদযাপন করতে দেখা যায়। এগুলির অনেকই প্রাচীন উৎসবের সাক্ষ্য। যেমন- সিবেল গ্রিক ধর্মানুষ্ঠান, হিলারিয়ার রোমান উৎসব, যা গ্রিকের সিবেল থেকে আসে অথবা সিবেল এবং হিলারিয়া থেকে আসা খ্রিস্টান ‘মাদারিং সানডে’ অনুষ্ঠানের মতোই।

একটি গোষ্ঠীর মতে, এই দিনটির সূত্রপাত প্রাচীন গ্রিসের মাতৃ আরাধনার প্রথা থেকে, যেখানে গ্রিক দেবতাদের মধ্যে এক বিশিষ্ট দেবী সিবেল-এর উদ্দেশে পালন করা হতো। এশিয়া মাইনরে মহাবিষুবের সময়ে এবং তারপর রোমে আইডিস অব মার্চ (১৫ মার্চ) থেকে ১৮ মার্চের মধ্যে এই উৎসবটি উদযাপন করা হতো।

প্রাচীন রোমানদের ম্যাত্রোনালিয়া নামে দেবী জুনোর প্রতি উৎসর্গিত আরো একটি ছুটির দিন ছিল। সেদিন মায়েদের উপহার দেওয়া হতো। মাদারিং সানডে-তে ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে অনেক দিন আগে থেকেই বহু আচারানুষ্ঠান ছিল, যেখানে মায়েদের এবং মাতৃত্বকে সম্মান জানানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট রোববারকে আলাদা করে রাখা হতো।

মাদারিং সানডের অনুষ্ঠান খ্রিস্টানদের অ্যাংগ্লিকানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পঞ্জিকার অঙ্গ। ক্যাথলিক পঞ্জিকা অনুযায়ী, এটিকে বলা হয়, ‘লেতারে সানডে’ যা লেন্টের সময়ে চতুর্থ রোববার পালন করা হতো ভার্জিন মেরি বা কুমারী মাতার ও প্রধান গির্জার সম্মানে।

প্রতি বছরের মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পৃথিবীর সব মায়ের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি জানানোর দিন, গ্রাফিকস- সংগৃহীত

প্রথানুযায়ী, দিনটিতে প্রতীকী উপহার দেওয়া এবং কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রান্না আর ধোয়ামোছার মতো মেয়েদের কাজগুলো বাড়ির অন্য কেউ করার মাধ্যমে উদযাপন করা হতো।

জুলিয়া ওয়ার্ড হোই রচিত ‘মাদার্স ডে প্রোক্লেমেশন’ বা ‘মা দিবসের ঘোষণাপত্র’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবস উদযাপনের গোড়ার দিকের চেষ্টাগুলির মধ্যে অন্যতম।

আমেরিকান গৃহযুদ্ধ ও ফ্রাঙ্কো-প্রুশীয় যুদ্ধের নৃশংসতার বিরুদ্ধে ১৮৭০ সালে রচিত ‘হোই’-এর মা দিবসের ঘোষণাপত্রটি ছিল একটি শান্তিকামী উদ্যোগ। রাজনৈতিক স্তরে সমাজকে গঠন করার ক্ষেত্রে নারীর একটি দায়িত্ব ও ভূমিকা আছে, হোই-এর এই নারীবাদী বিশ্বাস ঘোষণাপত্রটির মধ্যে নিহিত ছিল।

ঘোষণা
১৯১২ সালে আনা জার্ভিস ‘মাদার'স ডে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোশিয়েশন (আন্তর্জাতিক মা দিবস সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেন।

জানা যায়, ভার্জিনিয়ায় অ্যান নামে একজন শান্তিবাদী সমাজকর্মী ছিলেন। অ্যান ছিলেন খুবই ধর্মপ্রাণ এবং নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। তিনি ‘মাদারস ডে ওয়ার্ক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছোট ছোট ওয়ার্ক ক্লাব বানিয়ে সমাজের পিছিয়েপড়া নারীদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য চেষ্টা চালাতেন। নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য তিনি উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিতেন।
অ্যানের একটি মেয়ে ছিল। তার নাম ছিল- আনা মারিয়া রিভস জার্ভিস।

একদিন ছোট মেয়ের সামনেই অ্যান হাত জোড় করে বলেছিলেন, আমি প্রার্থনা করি, একদিন কেউ না কেউ, কোনো মায়েদের জন্য একটা দিন উৎসর্গ করুক। কারণ, মায়েরা রোজ মনুষ্যত্বের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন। একটি দিন উৎসর্গ করা তাদের অধিকার।

মায়ের সেই প্রার্থনা হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায় আনার। অ্যানের মৃত্যুর দিনটিকে সারাবিশ্বের প্রতিটি মায়ের উদ্দেশে উৎসর্গ করেন তিনি। তার পর থেকে মায়েদের প্রতি সম্মানে উদযাপিত হয়ে আসছে, আন্তর্জাতিক মা দিবস হিসেবে।

১৯১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ‘মা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকে প্রতিবছরের মে মাসের দ্বিতীয় রোববার আন্তর্জাতিক মা দিবস উদযাপন করা হয়ে থাকে।

;