সিদ্ধান্তহীনতার চেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত ভালো



প্রভাষ আমিন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মানুষ যখন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারে, তখন টস করে, লটারি করে, র‌্যাফল ড্র করে। মানে হলো নিজেকে ভাগ্যের হাতে সপে দেয়। ছেলেবেলায় স্কুলে পড়ার সময় বিতর্ক করতাম। তখন এটা ছিল উপস্থিত বক্তৃতার মত। মানে তাৎক্ষণিকভাবে টস করে বিষয়ের পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণ করা হতো। ধরুন, বিষয়: বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ? টস করে ঠিক করা হলো, কোন দল পক্ষে বলবে, কোন দল বিপক্ষে। হতে পারে আজ আপনি বিষয়ের পক্ষে বলছেন, কালই হয়তো একই বিষয়ে টসে আপনি বিপক্ষে বলার সুযোগ পেলেন। ভালো বিতর্কের মজাটা হলো, যুক্তি-তর্কের লড়াইয়ে দুই পক্ষকেই সঠিক মনে হয়। এই যে দুই পক্ষকেই সঠিক মনে হওয়ার বিভ্রম, এটা তো বাস্তবে সম্ভব নয়। ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-বেঠিক বেছে নিতে পারাটাই মানুষের বিবেক, বিবেচনা।

টিভি টক শো’তেও মাঝে মধ্যে সেই ছেলেবেলার উপস্থিত বক্তৃতার মত অবস্থা হয়। পছন্দমত আলোচক না পেলে বিপাকে পড়েন উপস্থাপক। তখন ব্যক্তিগত সম্পর্কের দোহাই দিয়ে কখনো কখনো অতিথিদের কাউকে কাউকে বলতে হয়, বিএনপির ভালো গেস্ট পাইনি, আজ একটু বিএনপির পক্ষে বলে দিয়েন। অনেকে সে অনুরোধ রাখেনও।

খেলায় যেমন টস হয়, উপস্থিত বক্তৃতায় যেমন টস হয়; তেমনি ব্যক্তিগত জীবনেও আমরা টস করি। এর একটি মজার খেলা আছে। ছড়ায় ছড়ায় আমরা টস করি- অবু দশ, বিশ…। যেখানে গিয়ে আঙ্গুল একশ’তে পড়বে, সেটাই সিদ্ধান্ত। আবার এমনও বলা হয়, রং ডিসিশন ইজ বেটার দ্যান ইনডিসিশন- সিদ্ধান্তহীনতার চেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত ভালো।

সিদ্ধান্ত আর সিদ্ধান্তহীনতা নিয়ে এত কথা বিএনপির সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে। র্সবশেষটি নিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক। কারাবন্দী বিএনপি চেয়াপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির উদ্যোগ নিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে ফোন করেছেন। তিনি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করতেও অনুরোধ করেছেন। ওবায়দুল কাদের তার অনুরোধ রেখেছেনও। দুর্নীতির দু’টি মামলায় ১৭ বছরের দণ্ড নিয়ে দুই বছরেরও বেশি সময় কারাগারে আছেন খালেদা জিয়া। দলের চেয়ারপারসনকে কারামুক্ত করতে যেমন ডেসপারেট চেষ্টা থাকার কথা, বিএনপির মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। খালেদা জিয়াকে আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত করা সম্ভব নয়, সেটি অনেক আগেই বুঝে গিয়েছেন এবং স্বীকারও করেছেন বিএনপির আইনজীবীরা।

রাজপথে তাকে মুক্ত করার মত আন্দোলন করার সক্ষমতা বিএনপির নেই, সেটাও তারা বারবার প্রমাণ করেছেন। বাকি ছিল রাষ্ট্রপতির কাছে মার্জনা ভিক্ষা বা স্বাস্থ্যগত কারণে প্যারোল। এ দু’টির জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সমঝোতা। কারণ রাষ্ট্রপতির কাছে মার্জনা চাইতে হলে অপরাধ স্বীকার করে নিতে হবে। আর রাজনৈতিক সমঝোতা হলেই কেবল এই মার্জনা পাওয়া সম্ভব। আর প্যারোল চাইলেও সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। কিন্তু বিএনপি এতদিন সমঝোতার কোনো চেষ্টাই করেনি। পারবেন না জেনেও তারা বারবার বলেছেন, আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়াকে মুক্ত করবেন, নইলে রাজপথে তীব্র আন্দোলন করে।

এতদিন তারা বলে আসছিলেন, আপসহীন নেত্রী কখনোই আপস করবেন না। কিন্তু দুই বছর পর এসে তারা বুঝলেন, রাজনৈতিক সমঝোতাতেই সমাধান। মির্জা ফখরুলের এই সিদ্ধান্তকে আমি স্বাগত জানাই। কারণ আমি মনে করি, যে কোনো মূল্যে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করাটাই বিএনপির রাজনীতির এক নম্বর এজেন্ডা হওয়া উচিত ছিল। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান যখন সাজা মাথায় নিয়ে লন্ডনে পালিয়ে আছেন, তখন খালেদা জিয়ার মুক্ত থাকাটা বিএনপির জন্য অতি জরুরি। কিন্তু অতি জরুরি বিষয়টা বুঝতে বিএনপির দুই বছর লাগলো কেন, এটাই বিস্ময়ের। অথচ সুযোগ ছিল নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা সংসদে যোগদানের বিনিময়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি নিয়ে দর কষাকষি করা। তখন তাদের হাতে খেলার কার্ড ছিল। আর এখন তাদের খেলতে হবে ব্লাইন্ডে। এখন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সরকারের বিশেষ করে সরকার প্রধানের সদয় দৃষ্টির ওপর নির্ভর করছে। তবে ফোনে বা মুখে অনুরোধ করলে হবে না; সেটার জন্য আবেদন করতে হবে, প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। সেটা যত তাড়াতাড়ি করবেন, ততই মঙ্গল।

মজাটা হলো, বিতর্কের মত মনে হচ্ছে, বিএনপির দু’টি সিদ্ধান্তই সঠিক। আপসহীন নেত্রী কেন সরকারের করুণায় মুক্তি পাবেন? আবার ৭৫ বছর বয়সী অসুস্থ খালেদা জিয়ার মুক্তির চেয়ে বড় যুক্তি আর কী হতে পারে।

গত সপ্তাহে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপি আগামী সব নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সামনেই গাইবান্ধা-৩, বাগেরহাট-৪, ঢাকা-১০, যশোর-৬, বগুড়া-১ আসনের উপনির্বাচন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই ছয়টি নির্বাচনকে সামনে রেখেই বিএনপির এ সিদ্ধান্ত। তবে সিদ্ধান্তটি শুধু এ ছয়টি নির্বাচনের জন্য নয়, এরপর থেকে সব নির্বাচনেই বিএনপি অংশ নেবে। আমি এ সিদ্ধান্তকেও স্বাগত জানাই। কারণ আমি বরাবরই বলে এসেছি, হারজিত যাই হোক, বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত। কারণ বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়। বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল। বিএনপি নেতারা এখন বলছেন, ভোট বর্জন করে ঘরে বসে থাকার মধ্যে কোনো ফায়দা নেই। বরং ভোটের মাঠে থাকলেই তাদের লাভ। বিএনপি এখন বুঝতে পারছে, ভোটের মাঠে থাকলে ক্ষমতাসীনদের ভোট কারচুপির বিষয়টি আরো উন্মোচিত হবে। তারা আর কোনো নির্বাচনই বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমার ধারণা, ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে হারলেও মাঠে থাকার সুবিধাটা তারা বুঝতে পেরেছেন। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুবাদে অনেকদিন পর বিএনপির নেতাকর্মীরা নির্বিঘ্নে মাঠে থাকতে পেরেছেন, মিছিল-সমাবেশ-প্রচারণায় অংশ নিতে পেরেছেন। এই দুই নির্বাচন ঢাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে দারুণ উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। বিলম্বে হলেও সেই লাভটা তারা বুঝতে পেরেছেন, এটাই মঙ্গল।

অথচ এই ভালোটা তারা ২০১৪ সালের নির্বাচনে বুঝতে পারেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আগে পাঁচ সিটি নির্বাচনে বিপুল জয় পেলেও সেই ধারাবাহিকতা তারা জাতীয় নির্বাচনে টেনে নিতে পারেননি। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে বিএনপির দোদুল্যমানতা স্পষ্ট ছিল। কখনো তারা স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেন, কখনো নেন না। একবার বলেন, এই সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারের বৈধতা দেওয়া অর্থহীন। কিন্তু নির্বাচন ঠেকানোর সামর্থ্যও তারা হারিয়েছেন অরেক আগেই। তাই বিএনপি অংশ না নিলেও সরকারের বৈধতার প্রশ্নটি তারা জোরেশোরে তুলতে পারেননি। বরং নির্বাচন বর্জন করে তারা রাজনীতিতে আরো অপাংক্তেয় করে তোলেন নিজেদের।

২০১৪ সালের পরিস্থিতি আর ২০১৮ সালের পরিস্থিতি একই ছিল। একই সরকার, সেই সরকারের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন; তারপরও তারা ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যতটা পিছিয়েছে, ২০১৮ সালে অংশ নিয়েও তা পুনরুদ্ধার করতে পারেনি।

বিএনপির মত দলকে মাত্র ছয়টি আসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। এখন যদি বিএনপির কোনো কর্মী প্রশ্ন করেন, পরিস্থিতি না বদলালেও কেন আগে আপনারা নির্বাচনে যাননি, কেন এখন যাচ্ছেন; কী জবাব দেবেন স্থায়ী কমিটির নেতারা?

বরং ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে এবং পরের বছর নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে আন্দোলনের নামে তারা যে জ্বালাও পোড়াও করেছেন, তা একটি নিয়তমান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির ভাবমূর্তিকে আরো প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। দেরিতে হলেও তারা নিজেদের ভালোটা বুঝতে পেরেছেন, এটা সবার জন্যই মঙ্গল।

সিদ্ধান্তহীনতা শুধু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নে নয়, সংসদে যোগ দেওয়ার প্রশ্নেও দেখা গেছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসন পাওয়ার পর তারা সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন বলা হচ্ছিল, সংসদে যোগ দিয়ে এই অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে মুখে অনেক কথা বললেও কার্যত তারা মাঠে বা আদালতে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিবাদ করেতে পারেননি। তখন সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, বিএনপি সংসদে যাচ্ছে না। এমনকি একজন সদস্য দলের সিদ্ধান্ত অসম্মান করে সংসদে যোগ দেওয়ায় তাকে অনেক গঞ্জনা সইতে হয়েছে। দলে তাকে সবাই বেঈমান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু সংসদে যোগ দেওয়ার শেষ দিনে নেতাকর্মীদের অন্ধকারে রেখে বিএনপির এমপিরা সুরসুর করে সংসদে চলে গেলেন। এতদিন যারা বলছিলেন, সংসদে যোগ দিয়ে এই সরকারকে বৈধতা দেওয়ার কোনো মানে হয় না; তারাই বলতে থাকলেন আন্দোলনের অংশ হিসেবেই সংসদে যোগ দিচ্ছেন তারা। এখন সংসদের ভেতরে-বাইরে সরকারে বিরুদ্ধে আন্দোলন হবে। সরকারকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছাড়া হবে না। খুব ভালো সিদ্ধান্ত। আমরাও চাইছিলাম বিএনপি সংসদে যাক। কিন্তু সেটা এত দেরিতে এবং এমন লুকোচরি করে কেন? তারওপর সবাই সংসদে গেলেন, মহাসচিব মির্জা ফখরুল গেলেন না। সংসদের ভেতরে-বাইরে আন্দোলন গড়াটাই যদি সঠিক সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে মির্জা ফখরুল গেলেন না কেন? এই প্রশ্নের কোনো যৌক্তিক উত্তর আজও মেলেনি। বিএনপির এই সিদ্ধান্তহীনতায় বিপাকে পড়েন দলের নেতাকর্মীরা। সকালেও বিএনপির যেসব নেতাকর্মী সংসদে না যাওয়ার পক্ষে তুমুল তর্ক করেছেন, বিকেলেই তাদের যাওয়ার পক্ষে যুক্তি দিতে হয়। সেই ছেলেবেলার উপস্থিত বক্তৃতার মত।

রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে, কৌশল বদলাতে পারে। তবে পরিস্থিতি না বদলালেও বিএনপির নেতারা যখন একবার এই পক্ষে যুক্তি দেন, আরেকবার ওই পক্ষে; তখন মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বিভ্রান্ত হন। রাজনীতিতে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে অনেক সময় রাজনৈতিক দল কোণঠাসা হয়ে যায়। এটা ঠিক, সরকারি দল প্রবল চাপ সৃষ্টি করে বিএনপিকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। তবে নিজেদের ভুল সিদ্ধান্ত তাদের সেই দুর্দশাকে আরো প্রকট এবং প্রলম্বিত করেছে। আশা করি, সব নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তে বিএনপি অনড় থাকবে এবং নেতাকর্মীদের মাঠে ব্যস্ত রাখবে। আর কোনো ভুল সিদ্ধান্ত যেন তাদের আরো বেশি বিপদে না ফেলে। মাঠে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকাটা সরকারের জন্য, দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, এমনকি সরকারি দলের জন্যও বিপদজনক।

প্রভাষ আমিন: হেড অফ নিউজ, এটিএন নিউজ

   

তাপমাত্রা, পাপমাত্রা ও এসি-ফ্যান হাতপাখা



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

গোটা এশিয়া জুড়ে এবার উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশের উচ্চতাপমাত্রা যেমন নজর কেড়েছে তেমনি প্রাণ ওষ্ঠাগত করে বিপদে ফেলেছে মানুষকে। কেউ কেউ মজা বা উপহাস করে বলে বেড়াচ্ছে, মানুষের পাপ কাজের মাত্রা বেড়েছে। পাপ কাজকে কেউ এখন আর তেমন ঘৃণা করেনা, ভয়ও পায় না। কারণ এদেশের মানুষ সিংহভাগই ধর্মপ্রাণ। এদেশের মতো এত বেশি মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। মানুষ পাপ কাজ করে আর ধর্মীয় উপাসনা করে প্লাস-মাইনাস থিওরিতে মনের ভারসাম্যতা এনে আত্মতৃপ্তি লাভ করে।

কিন্তু সেই আত্মতৃপ্তি সবার ক্ষেত্রে টেকসই হয় না। কারণ, মানুষ বার বার তওবা করে আবার বার বার পাপ কাজ করতে উদ্যত হয়ে ওঠে। ফলে সীমা লঙ্ঘণ করার অপরাধেপ্লাস-মাইনাস থিওরিতে মনের পাপ বিদূরিত হয় না। বরং আরো বেশি কালিমা লেপন হয়ে যায়। ফলত: পাপের বোঝা ক্রমাগত ভারী হয়ে উঠায় বর্তমানে পাপমাত্রা বেশি ভারী হয়ে অসহনীয় হয়ে উঠেছে!

এছাড়া শুধু প্রার্থনা না করলেই পাপ হয় অথবা প্রার্থনা না করলেই মার্জনা হয় এমন ধারণা সব ধর্মের সবাই মানতে নারাজ। ইসলামে ধর্মীয়ভাবে হয়তো সীমা লঙ্ঘণকারীদের জন্য এই ধারণা সঠিক কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে সীমালঙ্ঘণকারীদের বেলায় কি হবে?

মানুষ নিজেদের আরাম আয়েশের জন্য প্রকৃতির ওপর নির্বিচারে নিষ্ঠুরতা চালিয়ে উল্লাসে মেতে উঠেছে। উন্নয়নের নামে প্রকৃতির সবুজ গায়ের চামড়া তুলে কালো পশমি চাদর ও জামা পরিয়ে দিয়েছে। গরমের মৌসুমে মানুষ বা কোনো প্রাণী কি কালো পশমী কোট পায়ে দিয়ে থাকতে পারে?

আধুনিকতার নামে শহরের ব্যাপ্তি ঘটছে প্রতিটি দেশে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির নামে গোটা পৃথিবীর বুক জুড়ে কংক্রিট ও কালো পিচের ঢালাই এঁকে দেয়া হয়েছে। ক্ষমতার লোভে যুদ্ধের দামামা চালিয়ে সাইরেন বাজিয়ে বোমা বারুদ ফাটিয়ে পৃথিবীর শান্ত সুন্দর পরিবেশকে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। আরাম আয়েশের জন্য এসি, কুলিংফ্যান, ফ্রিজ নামক কীট মানুষের গাড়ি, বাড়ি, অফিস, আদালত, রিসোর্ট প্রভৃতিতে খামচে বসে অনর্গল উচ্চ তাপমাত্রা ও বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে দিয়ে উপহাস করছে। কার্বন কমানোর নামে সেমিনার, কনফারেন্স, কনভেনশন করতে গিয়ে বেটো দিয়ে ওয়াক আউট করে চলে যাচ্ছে স্বার্থের সংঘাতের কারণে। মারণাস্ত্র বিক্রি করে যাদের জাতীয় ও বার্ষিক আর্থিক বাজেট নিরুপণ করা হয় তারা এ ব্যাপারে শুধু ভণিতা ছাড়া আর কি করতে পারে? তাই পাপমাত্রা শুধু ধর্মপ্রাণ মানুষকে কেন্দ্র করে প্রার্থণার উপর নির্ণীত করাটা বড় ভুল হবে। পাপের মাত্রাটা নির্ভর করছে বড়বড় অর্থনীতির বড় বড় মেগা কর্মকান্ডের ফলে প্রকৃতির উপর ব্যাপক হারে নিষ্ঠুরতা চালানোর মধ্যে।

আসলে যুদ্ধের উন্মাদনায় পড়ে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে কেউই তেমন পাত্তা দিচ্ছেন না। কিছুদিন আগে বলা হতো- পৃথিবী আর দেড় বছরের মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ হারাবে। হঠাৎ করে এখন বলা হচ্ছে, দেড় বছর নয় আর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে পৃথিবীর ভাগ্য জানা যাবে (বিবিসি)। কারণ, আর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে যে বিশ^ পরিবেশ সম্মেলন হতে যাচ্ছে সেখানে বড় বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর ভূমিকা কি হবে তা দেখার মতো বিষয়। সেখানে নির্ধারিত হবে কার্বন নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন নীতিমালা।

রাশিয়া গ্যাস সরবরাহে ইউরোপের উপর থেকে অবরোধ তুলে না নেয়ায় গোটা ইউরোপে কাঠ ও কয়লার ব্যবহার বেড়ে গেছে। তাই ইউরোপে অতি বেশি কার্বণ নির্গমণ হতেই আছে। এটা আরো কতদিন বা বছর কলবৎ থাকবে তা বোঝা মুষ্কিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাবস্থায় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ চলছে। ইরান, লেবাননসহ গোট মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি। সবার সামরিক উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এবং দ্রব্যমূল্য আরো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে।

বিশ্ববাণিজ্য ও জরুরি খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ আরো বেশি সংঙ্কুচিত হয়ে পড়লে বিশ্বমন্দা নিয়ে মানুষ আরো বেশি হতাশ হয়ে যাবে। তখন ধনী দেশগুলো কার্বন নিঃসরণের জন্য কোনরুপ অর্থ ব্যয় করতে মোটেও রাজি হবে না। ফলে গোটা বিশ্ব অচিরেই একটি চরম ক্রান্তিকালের মুখোমুখি এসে উপনীত হয়েছে। সেখান থেকে অচিরেই কোন মুক্তির পাবার আশা করা বৃথা।

এতো গেল ইউরোপের ধনী দেশগুলোর কথা। করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট,বন্যা, দাবানল, ডেঙ্গু, মরুর দেশ আমীরাত ও ওমানে আকস্মিক অতিবৃষ্টি ও ফ্লাশফ্লাড, ইত্যাদি নিয়ে গোটা পৃথিবীতে কঠিন অর্থনৈতিক আঘাত লেগে গেছে। বড় আঘাতে ইতোমধ্যে আফিকা ও এশিয়ার ছোট ছোট ১৬টি দেশ নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে। দেশে দেশে জ্বালানী সংকট ও উচ্চদ্রব্যমূল্য চোখে পড়ার মতো অবস্থায় জানান দিচ্ছে সামনের ভয়াবহ আশঙ্কার কথা।

আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ষোল হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার মাত্রা সফলভাবে প্রচারিত হলেও সাম্প্রতিক ভয়াবহ তাপপ্রবাহ ও জরুরি এলার্টের ফলে মানুষ ঘরে বসে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে। এসময় বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার ঘন ঘন লোড শেডিং মানুষকে জানান দিচ্ছে- এটাই যথেষ্ট নয়। এখন ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার সংখ্যা কত কোটি হয় তা কারো জানা নেই। অটোর চার্জ, সেচ মেশিনের অতি ব্যবহার ও অতি গরমে গ্রামের মানুষও দেশীয় তৈরি সস্তা এসি কিনে ঘরে ঘরে লাগাচ্ছে। তাই বিদ্যুতের সংকট আরো বেশি ঘণীভূত হচ্ছে।

আমি একজন আশাবাদী মানুষ। চিরকাল আশা ও ভরসার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর সকল হতাশাকে জয় করে মানুষ বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাক সেই চেষ্টা করি। এখনো করছি এবং ভবিষ্যতে সেটা করেই যাব। কিন্তু মানুষের কাজের গতি বন্ধ হয়ে গেলেই তো সম্ভাব্য বিপদের হাতছানি চলে আসে।মানুষের দেহে যেমন রক্তপ্রবাহ সঠিক থাকা জরুরি ঠিক তেমনি একটি দেশের সারাদেহে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্দুৎপ্রবাহ থাকাটা খুব জরুরি।

সমস্যাটা এখানেই অনুভব করছি। পড়াশুনা ও গবেষণার জন্য দীর্ঘদিন জাপানে ছিলাম। প্রথমদিকে দেশ থেকে জাপানে গিয়ে মনে হতো সেখানে কি রাত হয় না? রাতের রাস্তায় কারো ঘুম নেই। সেটা গাড়ি, ট্রেন বা মানুষের। কোনো শব্দ নেই শুধু আলো আর আলো। সবাই শিফট বদল করে নিজের কাজ করেই যাচ্ছে। ওর মধ্যেই বিরাম, বিশ্রাম চলছে। কেউ কাউকে কোনভাবেই বিরক্ত করছে না। ওরা তো গ্যাস, তেল সবই কিনে আনে। নিজের কিছুই নেই। তবুও ওদের অভাব নেই। ও হ্যাঁ, এখনো ঢাকার চেয়ে টোকিও বা পাশের শহরতলির নির্মাণ খরচ ও জমির দাম অনেক কম। ওদের তো বিদ্দুৎ রেশনিং করতে হয় না। ওখানে এক মিনিট কেন, এক সেকেন্ডের জন্য বিদ্দুৎ কোথাও চলে যায় যায় না। কারণ ওরা খুব সৎ ও কর্মঠ। ওরা মুখে প্যাঁচ প্যাঁচ করে বাহুল্য কথা বলে না। কথায় ও কাজে সততাকে প্রমাণ করে দেখায়। আমরা চোরের খনিতে বাস করি। এটা নতুন কথা নয়। রেন্টাল বিদ্দুৎ-এর প্রভাবে টাইকুনরা এই চরম বিপদের সময় চুপ করে আছেন কেন?

এপ্রিল শেষ হলো কোনা বরিষণের দেখা নেই। আবাদী জমি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্চে। সেচ দেবার উপায় নেই। কারণ, পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। সাথে চরম অভাব লেগেছে বিদ্যুৎ সরবরাহে।

গতবছর প্রথম দেশে জানা গেছে লোডশেডিং-এর প্রাতিষ্ঠানিকিীকরণ করার কথা। সেটা সরকারিভাবে রাখঢাক না করে সময়সূচি ধরে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ঘোষণা অনুযায়ী লোডশেডিং-এর ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে না বলে সারা দেশের জনগণ অভিযোগ করে চলেছেন।চাহিদা অনুযায়ী দুরে থাক্, এমনিতেই তো বিদ্দুৎ থাকে না। চাহিদা মতো ভোক্তাকে বিদ্দুৎ দিতে না পারলে তো ক্ষমা চাইতে হয়। এটা আমাদের কৃষ্টিতে নেই অথচ, ক্ষমা চাওয়াটাই ভাল উপায়। তা না করে লোডশেডিং-এর অনিয়ম কথাটা শুনতে ও বুঝতে গিয়ে অনেকে আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছেন, হতাশ হয়ে পড়ছেন।

এবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রাইমারি স্কুল খোলা। দেশে এসি সম্বলিত ক্লাসরুম কয়টি বিদ্যালয়ে আছে? এই ভয়াবহ গরমে সবার আগে কোমলমতি শিশুদের জন্য স্কুল বন্ধ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও তা বলবৎ করা হচ্ছে না। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবাই হলে থাকে না। ফলে অনলাইনের খরচে কারণে শিক্ষার্থীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে সংকটে পড়ে অনুপুস্থিত থাকছে।

এগুলোই আমাদের দেশের সেবাদানকারীদের সাথে উন্নত কোন দেশের সেবাদানকারীদের তফাৎ। কেউ কি সেটা বুকে হাত দিয়ে অস্বীকার করতে পারবেন? জোড়াতালি দেয়া জীবনে আমাদের সবাইকে কেন বিদ্যুৎ কষ্টে থাকতে হবে? অভিজাত এলাকা ও বস্তি বা দুর্গম গ্রামীণ এলাকায় বাস করা সবাই তো রক্তমাংসের মানুষ। তাদের কারো শরীরে কি ঠান্ডা ও গরমের মধ্যে অনুভূতির কি কোন পার্থক্য আছে?

লোডশেডিং-এর জন্য যাদের চারতলার চৌবাচ্চায় কৃত্রিম পানি তুলে শিং-মাগুর মাছের প্রজেক্ট আর চলছে না, যাদের ছাদবাগানের গাছগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে তাদের কথা আলাদা করে ভাবার অবকাশ নেই। রাজধানীর কোনো কোনো রাস্তায় সিটি কর্পোরেশনের কতটি গাড়ি পানি ছিটাচ্ছে বস্তি এলাকার কলসি কাঁখে খাবার পনি সংগ্রহ করতে যাওয়া দরিদ্র মানুষগুলোর নিকট সেটাও খুব বাহুল্য বা কৌতুক মনে হচ্ছে। যাদের প্রিয় ছেলের কিনে দেয়া এসিটাও চালানো যাচ্ছে না,আইপিএসে চার্জ না হওয়ায় সিলিং ফ্যানও ঘুরছে না তাদের জন্য সবকিছু হতাশার মধ্যে নিপতিত হলেও তালের হাতপাখা দু’টো কিন্তু চালানো যাবে। কারণ, আমি আশাবাদী মানুষ। মরুশহর দুবাইয়ে হঠাৎ তীব্র বন্যার মাত্রা ওদের অধিবাসীদের পাপমাত্রার কারণে ঘটেছে তা বলা মুষ্কিল। কারণ সেখানে শত শত ভিন্নধর্মাবলম্বী লোকের বাস। কিন্তু আমাদের দেশের ওপর কি হলো? বিপদ বার বার আসে এজন্য বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতেই হবে। আর এজন্য আগাম বড় পরিকল্পনা এখনই গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। 

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

 

;

রক্তচক্ষু উপেক্ষার সাহস না থাকলে সাংবাদিকতা নয়



আশরাফুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের বরপুত্র নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ঘুমন্ত জনগণকে জাগাতে বহু যুগ আগে উচ্চারণ করেছিলেন এক চরম সত্য। তিনি বলেছিলেন, ‘Freedom is not given, it is taken’. ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক, স্থানিক বা বৈশ্বিক সব স্তরেই এটি আজ চরম সত্য হিসেবে বিশ্বের পরাধীন কোটি মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়।

৩ মে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস (World press freedom day) ঘিরে নানা আয়োজন চলে বিশ্বজুড়েই। প্রকাশিত হয়েছে অগণিত সম্পাদকীয় নিবন্ধ। মুক্ত সাংবাদিকতার পথ প্রশস্ত করার দাবি নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিমের দেশে দেশে পথেও নামেন সাংবাদিকরা। যদিও সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, হত্যা-নির্যাতন, হুমকি-অপহরণের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি থেমে নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতি বছরই চলে এমন আয়োজন ও কর্মসূচি।

বলতে দ্বিধা নেই- ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতাহীন কেউই সাংবাদিক নিপীড়নে পিছিয়ে নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোর দিকে যদি আমরা দৃষ্টি দিই, তবে এমন ঘটনার দৃষ্টান্ত বহু দেওয়া যাবে। ক্ষমতাসীনদের হাতে সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনাকে যদি বাধ্য হয়ে ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা হিসবে মেনেও নিতে হয়, কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলের যারা সরকারকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে মুখে ফেনা তুলেন তাদের হাতেও যখন সাংবাদিকরা নিগৃহীত হন তখন তার কোন সদুত্তর মেলে না!

২০২৩ সালে ২৮ অক্টোবর বিএনপি নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোটের সমাবেশে দায়িত্বরত সাংবাদিকদের ওপর বর্বর হামলার ঘটনা ঘটে। কিছু দিন চলে হইচই। সময়ের সঙ্গে সেইসব ঘটনা চাপা পড়ে যায় নতুন ঘটনার ঘনঘটায়। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলির যে কোন দায়বোধ নেই তা প্রমাণিত, তাই কোন তদন্তও হয় না-শাস্তি তো বহু দূরের ব্যাপার।

সংবাদকর্মীদের গায়ে আঘাতের ক্ষত না শুকাতেই ঘটনায় জড়িত রাজনৈতিক নেতারা প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে চা-আড্ডায় মেতে উঠেন। প্রহৃত সাংবাদিকদের কেউ কেউ হয়ত উঁকি দিয়ে সেই আড্ডা দেখে ফেলেন, কিন্তু প্রভাবশালীদের কাছে হার মেনে নীরব অভিমানে সরে আসেন তারা।

সবশেষ, এফডিসিতে চলচ্চিত্রের খল অভিনেতাদের নেতৃত্বে বিনোদন সাংবাদিকদের ওপর যে নারকীয় হামলার ঘটনা ঘটলো তার কি বিচার হলো? এক অভিনেতার বাসায় কতক সাংবাদিক নেতার গোপন মিটিংয়ে ঘটনার আপসরফার খবর শোনা গিয়েছিল। একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে। বেশ কিছু দিন পেরিয়ে গেলেও কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না।

এবারের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের পরদিন শনিবার যখন এই দিবস নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আলোচনা সভা হয় সেখানে ‘বিষয়’ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল ‘পরিবেশ ও উন্নয়ন সাংবাদিকতাকে’; সাংবাদিক নিপীড়নের প্রসঙ্গ ছিল সেখানে গৌণ। শীর্ষ গণমাধ্যমের সম্পাদক থেকে শুরু করে স্বয়ং তথ্য প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের অতিথি। নির্যাতিত কমিউনিটির মাঝেই যদি এমন আপস করার প্রবৃত্তি আর ক্ষমতার আশীর্বাদ পাওয়ার ব্যাকুলতা থাকে তবে সাংবাদিক নিগ্রহের প্রতিকার দাবি করাই তো একটা ‘অপরাধ’!

শুরুতেই স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষের প্রসঙ্গ এসেছে। তিনি যে কেবল মুক্তিকামী মানুষদের ‘স্বাধীনতা’ ছিনিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিলেন তাই নয়, জাতীয় কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি সুভাষচন্দ্র বসু এক ভাষণে আমাদের মজ্জাগত দাসত্বের প্রবৃত্তিকেও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে, ‘বন্ধুগণ, আমরা দাস হয়ে জন্মেছি। আসুন সংকল্প করি, আমরা মরবার পূর্বে স্বাধীন হব।’

সত্যিকথা বলতে চারপাশে কেবল দাসত্ব আর তোষামোদি দেখে দেখে আমরা নির্বিকার হয়ে পড়েছি। সাংবাদিকতায় আমরা যাদের পরম্পরা বহন করছি, সেই গৌরবের ইতিহাস আমাদের সামান্যই প্রভাবিত করছে।

১৯২২ সালের ১১ আগস্ট। প্রাণভরে সত্য উচ্চারণের আকাঙ্খা নিয়ে বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতার ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিট থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করছিলেন অর্ধ-সাপ্তাহিক ধুমকেতু। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা কতটা প্রাতঃস্মরণীয় আখ্যান সৃষ্টি করতে পারে ধুমকেতু তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সমকালীন সাংবাদিক ও সম্পাদকদের সেই ঘটনা স্মরণ করা এই জন্য জরুরি যে, মহান এ পেশার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আমাদের আরও কতটা সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন তারই খানিকটা ধারণা পাওয়া যাবে সেই ঘটনার আখ্যানে।

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের মালিকানাধীন সান্ধ্য-দৈনিক নবযুগের সম্পাদনায় নিজের চিন্তা ও স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা অনুভব করে তরুণ কবি নজরুল নিজেই ‘ধুমকেতু’ নামে নিজেই একটি সংবাদপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কাছে চেয়ে পাঠান আশীর্বাদ বাণী। কবিগুরুও তাকে ফেরান না। রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদবাণীসহ প্রকাশিত ধুমকেতু একটি ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলতে কি অনন্য ভূমিকাই না রাখে! সাহিত্যিক ও কবিবন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘‘জাতির অচলায়তন মনকে অহির্নিশি এমন করে ধাক্কা মেরে চলে ‘ধুমকেতু’ যে রাজশক্তি প্রমাদ গণে।’’

পরাধীন দেশে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ ধুমকেতুর যে কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল তা যেন অঙ্গিস্ফূলিঙ্গ হয়ে রাজশক্তির সিংহাসনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। কালজয়ী সব কবিতা আর জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় নিবন্ধে নজরুল স্বাধীনতার কথাকেই প্রবল পরাক্রমে বলতে পেরেছিলেন ধুমকেতুতে।

ধুমকেতুর একটি সংখ্যার সম্পাদকীয় নিবন্ধে নজরুল লেখেন, ‘..সর্বপ্রথম, ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়..ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসন-ভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশান-ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদেরে পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা পুঁটুলি বেঁধে সাগর-পাড়ে পাড়ি দিতে হবে…’-কি দুঃসাহসিক উচ্চারণ!

‘ধুমকেতুর কবি নজরুল’ শীর্ষক স্মৃতিচারণমূলক এক লেখায় পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় এক ঘটনার বয়ান লিপিবদ্ধ করেন। তিনি যা তুলে ধরেন তার সারমর্ম হচ্ছে, একদিন ধুমকেতুর কার্যালয়ে গোপীনাথ নামে এক যুবক স্বভাবসুলভ উৎফুল্ল কবি নজরুলকে প্রশ্ন করে বসেন, ‘দেশ পরাধীন, সাহেবদের অত্যাচার-জুলুম দিন দিন বেড়ে উঠছে। সেই জ্বালার মধ্যে আনন্দ জাগে কি করে?’

দেখা গেল কয়েক দিনের মধ্যে ওই যুবকটি কলকাতা চৌরঙ্গীর মোড়ে পিস্তল সহ হাতেনাতে ধরা পড়ল। যুবকটির নাম গোপীনাথ, অমর বিপ্লবী। অবশ্য ধরা পড়ার পূর্বে পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট মনে করে ডে সাহেব নামে আরেক ইংরেজকে গুলি করে হত্যা করেন ওই বিপ্লবী। সেই ঘটনার ডামাঢোলের মধ্যেই নজরুল লিখে ফেললেন, ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক এক জ্বালাময়ী কবিতা। ধুমকেতুতে তা প্রকাশিত হলে নড়েচড়ে বসে ব্রিটিশ পুলিশ। যে কবিতায় কবি লিখেছিলেন, ‘‘আর কত কাল থাকবি বেটী/মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে/অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল/দেবশিশুদের মারছে চাবুক/বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি/ভূ-ভারত আজ কসাইখানা আসবি কবে সর্বানাশী’’

ফল যা হবার তাই হল, ধুমকেতু অফিসে হানা দিল পুলিশ। কুমিল্লা থেকে আটক হলেন নজরুল। আদালতে অকুতোভয় নজরুল যে জবানবন্দী দেন তা কেবল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেই নয়, মুক্ত সাংবাদিকতার ইতিহাসেও এক দৃষ্টান্ত। কবি দৃপ্তকণ্ঠে আদালতে উচ্চারণ করেন, ‘সত্য স্বয়ংপ্রকাশ তাকে কোন রক্ত আঁখি রাজদণ্ড নিরোধ করতে পারে না..’।

১৯২৩ সালের জানুয়ারিতে কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মি. সুইনহো ধুমকেতু সম্পাদক কবি নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। কারা অন্তরীণ নজরুল আলিপুর সেন্ট্রাল জেল হয়ে হুগলী কারাগারে স্থানান্তরিত হন। সেখানে বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে দীর্ঘ ৩৯ দিন অনশন করে পরাধীন জাতিকে তিনি এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন। এই সময়ে কবিগুরু তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করলেন তরুণ কবি নজরুলকে । কাজী নজরুল ইসলামের বীরোচিত এই আখ্যান যেমন বাংলা সাহিত্যের পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা, তেমনি মুক্ত সাংবাদিকতার ঐতিহ্যিক পরম্পরাতেও এক চির অনুপ্রেরণা।

সমকালীন সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার অন্দরে প্রবেশ করে যদি আমরা আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে স্মরণ করি তবে লজ্জায় নত হতে হয়। সাংবাদিকতার মানস-মূল্যবোধ আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! একটি স্বাধীন দেশে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমরা স্বাধীনতার জন্য রীতিমতো ‘কান্নাকাটি’ করছি। অথচ সত্য উচ্চারণে চিরকালই বাধা আসবে, গ্লানি থাকবে-তবু সত্যকে আলিঙ্গন করতে হবে-সাংবাদিকতায় এটিই বাস্তবতা। সেখানে সত্য উচ্চারণের পথ এতটা নিষ্কণ্টক হবে তা আমরা আশা করি কি করে? অতীত যেন আমাদের ভৎর্সনা করে বলছে, ‘বাধাকে, রক্তচক্ষুকে ডিঙিয়ে যাওয়ার সাহস যদি না-ই থাকবে তবে এ পথ তোমার নয়’।

সমকালীন বাস্তবতাকে যদি বিবেচনায় আনি তবে যা স্পষ্ট হয়ে উঠছে তা হল-ঔপনিবেশিক ও নব্য ঔপনিবেশিক দুঃশাসন থেকে মুক্ত হয়ে আমরা যে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পেয়েছি সেখানেও আমাদের চ্যালেঞ্জ কম নয়। বলতে গেলে বর্তমানে রাজনীতি, প্রশাসন আর বণিকশ্রেণীর মাঝেও এক প্রবল ঔপনিবেশিক চরিত্র ধরা দিয়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক তথা বৈশ্বিক ক্ষমতার সমীকরণও। এই সময়ের সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রকে একসঙ্গে এই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কতটা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে প্রস্তুত?

যা দৃশ্যমান হচ্ছে, দ্ব্যর্থহীনভাবে আত্মসমালোচনা করলে বলতেই হবে, বহুলাংশেই আপস করছি আমরা। সত্য উচ্চারণে কিছু কণ্ঠস্বর কখনো জ্বলে উঠে আবার স্থিমিত হয়ে যাচ্ছে কিংবা থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জ্বলে উঠা এই কণ্ঠস্বরগুলো যদি সংঘবদ্ধ করা যায় তবে অচলায়তন ভেঙে দেওয়া অসম্ভব নয়। আসুন আমরা সেই অভিপ্রায়কে বাস্তব করতে উদ্যত হই।

লেখক: বার্তা২৪.কম এর পরিকল্পনা সম্পাদক ও ইতিহাস গবেষক

;

বন্যা আসছে, প্রস্তুতি নিন!



কবির য়াহমদ
বন্যা আসছে, প্রস্তুতি নিন!

বন্যা আসছে, প্রস্তুতি নিন!

  • Font increase
  • Font Decrease

তীব্র তাপদাহ শেষে স্বস্তির বৃষ্টির দেখা পেয়েছে দেশ। দেশের অন্য এলাকাগুলোর অনেকগুলোতে এখনো তাপের তীব্র দহন থাকলেও সিলেট অঞ্চলের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। এখানে প্রায়ই যেন নিয়ম করে বৃষ্টি নামছে, তাপমাত্রা পরিস্থিতিও মোটামুটি সহনীয়। দেশ যখন পুড়ছে তাপে, তখন দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা বিশেষ করে সিলেটে দেখা দিয়েছে বন্যার আশঙ্কা।

বন্যার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় যে খেতের ধানের, এটা এবার কৃষকেরা ঘরে তুলতে শুরু করেছেন। অনেক এলাকার ধান কাটা শেষের পর্যায়ে। এখন চলছে ধান শুকানো আর গোলায় তোলার পালা। কেবল ধানই নয়, খড়ও শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে শুরু করেছেন তারা, কারণ এই খড় গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বোরো ধান দেশের খাদ্যচাহিদার অন্তত ৫৫ শতাংশ মিটিয়ে থাকে। দেশের হাওরভুক্ত ৭টি জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওরে এই বোরোর চাষ বেশি হয়ে থাকে। এই ধান অতিবৃষ্টি, বন্যা ও ভারতের পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে দেশের খাদ্যচাহিদায় ঘাটতি পড়ে না। তাই এই ধান চাষ থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত অনুকূল আবহাওয়া, বিশেষ করে রোদের উপস্থিতি অতি জরুরি। ভালোয়-ভালোয় শেষ পর্যায় এটা শেষের পথে। তবে এখন উঁকি দিচ্ছে বন্যার শঙ্কা।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর পরিচালিত বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোর নদীগুলোতে পানির স্তর দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা বেশ কয়েকটি অঞ্চলে আকস্মিক বন্যার ঝুঁকি তৈরি করছে। প্রতিষ্ঠানটি পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে। এফএফডব্লিউসি বলছে, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে প্রাক-বর্ষার পানিপ্রবাহ অতিক্রম করতে পারে।

পূর্বাভাসে যখন আকস্মিক বন্যার তথ্য, তখন ঠিক ঠিক সিলেট অঞ্চলের নদ-নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধির তথ্য মিলছে। এরইমধ্যে সিলেটের দুটি নদ-নদীর পানি শুষ্ক মৌসুমের বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ভারতে কয়েক দিন ধরে বৃষ্টির ফলে সিলেটের নদ-নদীগুলোয় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃহস্পতিবারই দুটি পয়েন্টে নদীর পানি শুষ্ক মৌসুমের বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। পাউবোর তথ্যমতে, সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে শুষ্ক মৌসুমের বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৮০ মিটার। বর্ষা মৌসুমে বিপৎসীমা ১৩ দশমিক ৭৫ মিটার। শুক্রবার সকাল ৯ টা থেকে সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে ১১. ০৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একইভাবে সারি নদের জৈন্তাপুরের সারিঘাট পয়েন্ট শুষ্ক মৌসুমে বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৭০ মিটার। বর্ষা মৌসুমে বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৩৫ মিটার। নদের ওই পয়েন্ট পানি ১১ দশমিক ৮৭ মিটারে অবস্থান করছিল, যা শুষ্ক মৌসুমের বিপৎসীমার ওপরে। এ ছাড়া সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্ট এবং কুশিয়ারা নদীর শেওলা পয়েন্টেও পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। তবে ভারতের বৃষ্টিসৃষ্ট ঢল নামতে থাকলে অন্য পয়েন্টগুলোতে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।

২০১৭ সালের মতো এবার দেশের বেরো খেত বন্যায় তলিয়ে যায়নি। কৃষকেরা আনন্দ লুট হয়নি বন্যায়। তবে ঘরে ফসল তোলার পর পরই বন্যার যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে সেটা ভাবনার। এমনিতেই ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার স্মৃতি বিস্মৃত হতে পারেনি সিলেট অঞ্চলের মানুষ। অবর্ণনীয় দুর্ভোগের পাশাপাশি জানমাল, আর্থিক ও অবকাঠামোগত যে ক্ষতি সেটা পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এখনো সিলেটের অনেক অঞ্চলে দুই বছর আগের সেই বন্যার ক্ষতচিহ্ন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

২০২২ সালের বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল সিলেট নগরসহ জেলার প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা। দীর্ঘমেয়াদি ওই বন্যায় মাসখানেক সময় দুর্ভোগ পোহাতে হয় মানুষকে। বন্যার পর দাবি ওঠেছিল সুরমা নদী খননের। এনিয়ে কিছু কাজ শুরু হলেও সেটা সমাপ্ত হয়নি। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সিলেট নগরের কুশিঘাট থেকে বিশ্বনাথের দশগ্রাম পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার খনন কাজ শুরু হয়েছিল। এই ১৫ কিলোমিটারের খনন কাজ ১৫ মাসেও শেষ হয়নি। অথচ এই প্রকল্প চার মাসে সম্পন্ন করার কথা ছিল। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যের কারণে খননকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য নির্ধারিত সময়ে খননকাজ শেষ করা যায়নি। প্লাস্টিক ও পলিথিনের কারণে মেশিনারি যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যায় বলে তাদের দাবি। শতভাগ সম্পন্ন করতে না পারলেও ৮০ ভাগ কাজ আগামী জুনের মধ্যে তারা সম্পন্ন করতে পারবেন বলেও তারা আশাবাদী।

গত বন্যার পর সুরমা নদীর নাব্যতা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, দাবি ওঠেছে নদী খননের। কেবল বন্যার ওই সময়ই নয়, সামান্য বৃষ্টিতেও সিলেট নগর ডুবে যাচ্ছে। খাল-ছড়াগুলো দখলে-দূষণে সংকীর্ণ, এবং অনেকগুলো ‘নাই’ হয়ে গেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টি নগরে সৃষ্টি করছে জলাবদ্ধতা। তার ওপর আছে সিটি করপোরেশনের নানা উন্নয়নমূলক কাজ, যেগুলো পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহকে কোথাও কোথাও সৃষ্টি করছে বাধার। শুষ্ক মৌসুমের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পানির গতিপ্রবাহ নিয়ে ভাবা হয় সামান্যই, ফলে গ্রীষ্মের প্রকল্প বর্ষা পর্যন্ত দীর্ঘায়ত হয়ে যাওয়ার কারণে পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে দেখা দিয়েছে প্রতিবন্ধকতা। আর শেষ পর্যন্ত তাই ভোগান্তির গন্তব্য মানুষ। এছাড়াও আছে হাওর এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও ভৌত অবকাঠামো, যেগুলো হাওরের বিশাল জলরাশির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত ‘তিস্তা নদী অববাহিকা: সংকট উত্তরণ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সপ্তম আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলনের ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও এনভায়রনমেন্ট গভার্নড ইন্টিগ্রেটেড অর্গানাইজেশনের পরিচালক জয়ন্ত বসু ‘জিওপলিটিকস অফ রিভার তিস্তা অ্যান্ড নিড টু পারসু নেচারবেইজড নেগোশিয়েটেড অ্যাপ্রোচ (এনবিএনএ)’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার আন্তদেশীয় নদীর সমস্যা আঞ্চলিক ভূরাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, এই অঞ্চলের সব দেশ প্রধানত কৃষি, জলবিদ্যুৎ এবং অন্যান্য কারণে নদীর ওপর প্রবলভাবে নির্ভরশীল। আর তাই এ অঞ্চলের অসম রাজনৈতিক ক্ষমতার উপস্থিতি; আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও স্থানীয় রাজনৈতিক সম্পর্কের প্রভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তন আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। আন্তদেশীয় নদীর পানি ব্যবহারে সমন্বিত মডেল বাস্তবায়নে আন্তদেশীয় স্টেকহোল্ডার পর্যায়ে আলোচনার আহ্বান জানিয়ে জয়ন্ত বসু বলেছিলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনো সামগ্রিক অববাহিকাভিত্তিক পদ্ধতি নেই। যদিও উভয় দেশের মধ্য দিয়ে ৫৪টি আন্তসীমান্ত নদী বয়ে গেছে। এ জন্য একটি সামগ্রিক অববাহিকাভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।’ গবেষকদের এই সব গবেষণাপত্র নিয়ে আলোচনাই হয় কেবল, এসব নিয়ে কাজ হয় কমই। ফলে সমস্যা যেখানে ছিল সেখানেই থেকে যাচ্ছে। এখানে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে ভূ-রাজনীতি, মনে করা হচ্ছে এখানে আমরা পিছিয়ে আছি অনেকটাই।

এখন যেখানে আমরা সেখানে একটা বন্যার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এটা নিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সতর্কতা দিয়েছে। এই সতর্কতা শুরুতে কৃষক পর্যায়ে ছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল, বেরো ধান ৮০ শতাংশ পরিপক্ব হলেই যেন কাটা শুরু হয়। কৃষকেরা সে কাজটিই করেছেন। কৃষকের নিয়মিত কাজ শেষে এখন সরকার-প্রশাসনের দরকার বন্যা মোকাবেলা বিষয়ক প্রস্তুতি গ্রহণ করা। ভারতে বৃষ্টি কমলে দেশে বন্যা হবে না—স্রেফ প্রকৃতির ওপর নির্ভর না করে বন্যা হলে কী প্রক্রিয়ায় মানুষকে বাঁচানো যায় সে দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। হাতে আছে সময়, এই সময়টুকুর সঠিক ব্যবহার করাই হবে সময়ের কাজ।

;

শিল্প-সাহিত্যে সম্মাননা: ক্ষমতার আনুগত্যই ‘মানদণ্ড’ নয়



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বয়সে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের চেয়েও ৬ বছরের বড় ছিলেন ভাওয়ালের কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস। রাজ আনুকূল্য পরিত্যাগ করে রাজার বিরুদ্ধে কলম ধরার অপরাধে নির্বাসিত হয়েছিলেন কবি। ‘মগের মুলুক’ কাব্যগ্রন্থের জন্য নির্বাসিত গোবিন্দচন্দ্র দাসের জীবন কেটেছে নিদারুণ অর্থকষ্টে। বাংলা সাহিত্যকে ১০টি অমূল্য কাব্যগ্রন্থ উপহার দিলেও প্রতিভাধর এই কবির যাপিত জীবনের দুর্দশা ছিল প্রকট। শেষ জীবনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মতো মহৎপ্রাণ কিছু মানুষেরা অসুস্থ কবিকে অর্থসহায়তা দিয়ে উদাসীন সমাজের খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন। দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে ওষ্ঠাগত কবি তাঁর কবিতায় জীবদ্দশায় স্বীকৃতি না পাওয়ার আক্ষেপ ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সমাজ-রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করে কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আমি মরলে তোমরা আমার চিতায় দেবে মঠ?’

শিল্প-সাহিত্যের স্রষ্টাদের এই আক্ষেপ যুগে যুগে ধ্বনিত হয়ে আসছে। সবশেষ ঘটনাটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের গুণী শিল্পী সাদী মহম্মদের আত্মহনন। এসকল ঘটনা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে নীরবে চপেটাঘাত করে যায়। জীবদ্দশায় গুণীর কদর করতে বরাবরই ব্যর্থ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। বলা হয়ে থাকে যে সমাজে গুণীর কদর নেই, সেই সমাজে গুণীও জন্মায় না। সময়ের স্রোতে আমরা শ্রদ্ধায় নত হতে পারি, এমন গুণীজনদের ক্রমেই হারিয়ে ফেলছি। সেই শূন্যস্থান পূরণে আমাদের যোগ্য মানুষের অভাব প্রতিনিয়তই অনুভূত হচ্ছে।

ব্যক্তিত্ব ও মূল্যবোধের সঙ্গে আপস না করা মানুষের সংখ্যা দিনকে দিন কমে আসছে। বিপরীতে জায়গা করে নিচ্ছে স্তাবক ও অযোগ্য মানুষেরা। এতে করে সমাজে যে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে তা আমাদের ঐতিহ্যিক পরম্পরাকে বিপন্ন করে তুলছে। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ পদক ও পুরস্কার প্রদান নিয়ে মানুষের মনে যে নানা প্রশ্ন উঠতে দেখছি তা এই শূন্যতারই কার্যকারণ বলে মনে করেন বিজ্ঞজনরা। যেখানে নীরবে নিভৃতে বহু গুণীজন স্বীকৃতি না পাওয়ার বেদনা নিয়ে কাটান সেখানে পদক-পুরস্কার নিয়ে সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা গুণীদের হতাশাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

এমন বাস্তবতার মাঝেই গত ৩০ এপ্রিল বাংলা একাডেমি ঘোষণা করল রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার-২০২৪। যে তিন গুণীকে এবার এই পুরস্কারে ভূষিত করা হচ্ছে তাঁদের রবীন্দ্র ও নজরুল সাধনা প্রশ্নাতীত। বাঙালি জাতির আত্মঅহংকারের প্রতীক এই দুই মহান কবির নামে প্রবর্তিত এ পুরস্কার নিয়ে এবার একাডেমি সংশ্লিষ্টরা তাদের বিচার-বিবেচনাকে প্রশ্নের উর্ধ্বে নিয়ে যেতে পেরেছেন, এটা আশাবাদের সঞ্চার করেছে।

বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। বহু গবেষণাগ্রন্থের লেখক ভীষ্মদেব চৌধুরীর রবীন্দ্র গবেষণায় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে -দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫) ও প্রভাতসূর্য : রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা রবীন্দ্র অন্তঃপ্রাণ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকে তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতেও ভূমিকা রাখছেন।

বাঙালির হৃদয়স্পন্দন ও চেতনার বাতিঘর কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। নির্বাক কবিকে ঘিরে সেই সময়কার গবেষক ও সাহিত্যিকরা নানা দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং বিষয়-বৈচিত্রে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। কবির ঘনিষ্ঠজনরা তখনও জীবিত, রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে যা কিছু প্রয়োজন-তাও দুর্লভ ছিল না। তথ্যগত প্রাপ্যতার সঙ্গে গভীর নিষ্ঠা ও ভক্তি নিয়ে অনেক শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক কবিকে নানাভাবে মূল্যায়নের প্রয়াস পেয়েছেন।

বাংলা সাহিত্যের দুই যশস্বী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ও ড. রাজিয়া সুলতানা দম্পতি আত্মনিয়োগ করেন নজরুল গবেষণায়। নজরুল গবেষণায় এই গুণী দুই গবেষকের গ্রন্থসংখ্যা বিপুল না হলেও কবিকে নিয়ে যে কয়েকটি গবেষণাগ্রন্থ তাঁরা রচনা করেন তা এদেশে নজরুলচর্চায় বিশেষ ভাবে ভূমিকা রাখে। সে কারণে তাঁরা পথিকৃৎ গবেষক হিসেবেও নন্দিত হন।

মোহাম্মদ আবদুল কাইউম নজরুল গবেষণায় উপহার দেন ‘নানা প্রসঙ্গে নজরুল’ ও ‘নজরুল সংবর্ধনা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ। অন্যদিকে রাজিয়া সুলতানার গবেষণা গ্রন্থ ‘কথাশিল্পী নজরুল’ ও ‘নজরুল-অন্বেষা’। প্রকাশিত এসব গ্রন্থসম্ভারের বাইরে এই দুই নজরুল গবেষক তাদের দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে নিষ্ঠার সঙ্গে অসংখ্য নজরুল গবেষক ও অনুরাগী সৃষ্টি করেছেন; যাঁরা পরবর্তী জীবনে বাংলাদেশে নজরুল চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ও ড. রাজিয়া সুলতানা-দু’জনই কবি নজরুল ইনস্টিটিউট প্রবর্তিত ‘নজরুল পুরস্কার’ লাভ করেছেন। ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ১৯৯১ সালে লাভ করেছিলেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।

২০২০ সালের ১২ জুন প্রয়াত হন ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম। স্বামী মৃত্যুর পর ড. রাজিয়া সুলতানা প্রবাসেই কাটাচ্ছেন সন্তানদের সঙ্গে। গেল ৩০ এপ্রিল ২০২৪ বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র ও নজরুল গবেষণায় ৩ জনকে একাডেমি পুরস্কারের জন্য নাম ঘোষণা করে। নজরুল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন ড. রাজিয়া সুলতানা।

স্বজনদের থেকে জানা গেছে, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় আক্রান্ত ড. রাজিয়া সুলতানা। পুরস্কারপ্রাপ্তির খবর জেনেছেন দূরপ্রবাসে বসে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি নাকি এই খবরে ভীষণ আনন্দিত! তাঁর চোখেমুখে পরিতৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, জানিয়েছেন তাঁর মেয়েরা। এই খবর জেনে আমরা নিশ্চয়ই আনন্দিত এজন্য যে, একজন গুণী গবেষক জীবন-সায়াহ্নে হলেও তাঁর গবেষণার জন্য রাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কৃত হতে যাচ্ছেন। বাংলা একাডেমির সংশ্লিষ্টরা এজন্য অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন। কিন্তু আমরা এও প্রত্যাশা করি যে, একজন গুণী গবেষককে তাঁর গবেষণার স্বীকৃতি পেতে বার্ধক্য পর্যন্ত কেন অপেক্ষায় থাকতে হবে? একটি পুরস্কারকে উদযাপন করার মতো শারীরিক ও মানসিক স্ফূর্তি থাকতেই কেন আমরা তাদের পুরস্কৃত করতে ব্যর্থ হচ্ছি-সেই প্রশ্নও আজ বড় হয়ে ধরা দিচ্ছে।

আমরা জানি, কোন স্বীকৃতির আকাঙ্খা ব্যতিরেকেই এখনও বহু গুণীজন নিভৃতে তাদের জ্ঞান ও শিল্পসাধনায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। কিন্তু অযোগ্যদের সম্মানিত করে রাষ্ট্র যখন নিজেই অসম্মানিত হয় তখন অনেকের মতো সেইসব গুণীজনরাও নিশ্চয়ই ব্যথিত হন। এবং এই বেদনার ভার সইতে না পেরে সাদী মহম্মদের মতো প্রতিথযশা সাধকশিল্পীকেও নীরব অভিমানে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে যাঁরা চালনা করেন তাদের মনে রাখা উচিত, পুরস্কারের মনোনয়নে কেবলমাত্র ক্ষমতার আনুগত্যই একমাত্র মানদণ্ড নয়।

লেখনির মুখে সত্য উচ্চারণে যে লেখকগণ নিঃশঙ্কচিত্ত হতে পেরেছেন ইতিহাসে তাদেরই ঠাঁই হয়েছে। রাজ আনুকূল্যে ব্রিটিশ শাসনামলে পূর্ববর্তী শাসকদের যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তবাতবায়ী হাতে, সেই প্রামাণ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন’ পরবর্তী যুগে একটি ফরমায়েশি গ্রন্থরূপে সকলের কাছে প্রমাণিত হয়েছে। ইতিহাসের নির্মোহ মূল্যায়নে সেই তথাকথিত ঐতিহাসিক স্বীয় মর্যাদাকে ধরে রাখতে পারেননি। আমরা যদি এই ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে স্মরণ করে সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকে সমুন্নত রাখতে পারি, প্রকৃত গুণীদের যথাসময়ে মান দিতে পারি, তবেই দেশে অনেক জ্ঞানীর জন্ম হবে এবং আমরা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যেতে পারব। কবি গোবিন্দ দাসের মতো ‘মৃত্যুর পর চিতায় মঠ দেওয়া’ সমাজের চরিত্রকে বদলাতে পারব।

;