সায়েম খান, লেখক ও কলামিস্ট
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

পৃথিবীর শুরুতে শ্রম ছিল একটি গুরুত্বহীন বিষয়। প্রাচীন মিশরীয় যুগে যে দাসপ্রথার উদ্ভব হয়, সেখানে দেখা যায় মানুষকে দাস হিসেবে বন্দী রাখা হতো ও তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করানো হত। সেটা পাহাড় কেটে প্রাসাদ বানানো কিংবা পাথরের উপর পাথর বসিয়ে পিরামিড বানানো। ক্ষমতার কাছে শ্রম ছিল কুক্ষিগত। এক হিসেবে ধরা যা্য় পর্যবেক্ষণিক অর্থে “দাস” শব্দটি ছিল শ্রমের আদিশব্দ। সময় ও কালের গতিধারায় মানবজীবন পরিবর্তনশীল ও পরিবর্ধনশীল। সভ্যতার ক্রমবিকাশে প্রয়োজনের তাগিদে সৃষ্টি হয় কাজ। আর সেই কাজের জন্য শ্রমের আবিস্কার। গোটা পৃথিবী হয়ে পড়ে শ্রম-নির্ভর। মালিক-শ্রমিক নামক দুটি গোত্রের আবির্ভাব হয় এই শ্রমকে কেন্দ্র করে।

এক দলের কাজের প্রয়োজন, আরেক দলের কাজ করানোর প্রয়োজন। আর সেই থেকে শ্রম বিক্রির ধারণার উদ্ভব হয়। পৃথিবীতে শিল্প-বিপ্লবেরও বহু আগে মানুষের শ্রমের মুল্যায়ন ছিল সস্তা। ইউরোপে কল-কারখানা স্থাপনার পর থেকে ব্যাপকভাবে পুরো সমাজ-ব্যবস্থা হয়ে পড়ে শ্রমিক নির্ভর। কিন্তু শুরুতে আজকের এই আধুনিক সমাজ-ব্যবস্থার মত এতটা শ্রমিক বান্ধব ছিলনা। বেশি সময় কাজ করানো, মজুরি কম দেওয়া, কর্মঘন্টায় মাত্রাতিরিক্ত উৎপাদন বৃদ্ধির তাগিদ, সব মিলিয়ে গোটা পৃথিবীতে শাষক ও শোষিত নামক দুটি গোষ্ঠী তৈরী হয়। শ্রমিকের মানেই মানবেতর জীবন। ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় গড়ে উঠে ঔপনিবেশিক তত্ত্ব। দরিদ্র হতে থাকে আরও দরিদ্র। ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, মহামারীতে আক্রান্ত হতে থাকে মানুষ। শাষকচক্র তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মেতে উঠে যুদ্ধ-বিগ্রহে। আর তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় এই শ্রমিক তথা দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধশ্রম নামে এক নতুন শ্রমের ধারণার উদ্ভব ঘটে। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশের শাষকশ্রেণী পুরুষদের জোর করে পাঠিয়ে দিত যুদ্ধক্ষেত্রে। এজন্য তাদের মোটা অংকের মজুরি প্রদান করা হত। যুদ্ধের পর গোটা পূর্ব ইউরোপে এক ভিন্ন চিত্র দেখা গেল। তা হল পূর্ব ইউরোপ অনেকটা পুরুষ শুন্য হয়ে গেল। যা আঘাত করল পুরো সমাজ ব্যবস্থায়। এক প্রকার নীরব দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। নারী, শিশু চলে যেতে থাকল ইউরোপের অন্য অংশ। নারীদের মধ্যে দেখা দিল বহুবিবাহ, বহুগামীতা ও পতিতাবৃত্তি। সমাজ-ব্যবস্থায় ছেয়ে গেল এক অশ্লীলতা ।

উনিশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপে শ্রমিক গোষ্ঠির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রম ইতিহাসের বিকাশ ঘটে। পুরো ইউরোপে তখন খন্ড খন্ড শ্রমিক আসন্তোষ, ধর্মঘট ও আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী শ্রম অধিকারের প্রভাব বিস্তার ঘটতে থাকে। আধুনিক যন্ত্রপাতি অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র করে পশমী বাণিজ্যের সাথে জড়িত শ্রমিকরা ব্রিটেনে লুডিইটস আন্দোলন শুরু করে, যা তৎকালীন সময়ে ব্রিটেনের আলোচিত ঘটনার একটি বলে ধরা হয়। আমেরিকার হেইমার্কেট দাঙ্গা, হোমস্টেড ধর্মঘট, পুলম্যান স্ট্রাইক ইত্যাদি শ্রম অধিকারের ধারাকে সমুন্নত করতে বিশেষ অবদান রেখেছিল। যার ফলে আজ আমরা উদযাপন করি মহান মে দিবস।

রুশ বিপ্লবের সময়কালে নাগরিকদের মানবেতর জীবন যাপন ও অভাব অভিযোগ ছিল সাধারণ ঘটনা। ১৯১৭ সালে শ্রমিক অস্থিরতা ও দাঙ্গার মাধ্যমে এই বিপ্লবে শামিল হয় শ্রমিকরা। সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে শ্রমিকদের একাত্বতা ঘোষণার মাধ্যমে রুশ বিপ্লবের সফলতা আসে এবং বলশেভিক (কম্যুনিজম) সরকার গঠিত হয়। কালে কালে, যুগে যুগে, পৌত্তলিক থেকে ঔপনিবেশিক, ঔপনিবেশিক থেকে আধুনিক, সব যুগে সব সময়ে শ্রমিকরা ছিল নিঃগৃহীত, নিস্পেশিত। আর তাই নিজেদের অধিকার আদায়ের ঝান্ডা উঁচিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে শ্রমিকদের ভাগ্যের উন্নতি হয়েছে কিঞ্চিত। তারা তাদের নির্দিষ্ট্ কর্মঘন্টায় মজুরী পায়। কর্মস্হলে পায় তাৃর প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা। কিন্তু এই সুবিধা ভোগকারী শ্রমিকরা হল প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর শ্রমিকরা আজও অবহেলিত। শ্রমিক অসন্তোস, কর্মস্থলে বিয়ভিন্ন ত্রুটির কারণে শ্রমিকের মৃত্যুঝুঁকি, শ্রমবাজারে মন্দাভাব ইত‌্যাদি বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর এক নিত্যকার ঘটনা। বাংলাদেশের শ্রমিকদের আজ বিদেশ গমণের প্রবণতা এইসব কারণে।

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সূচক উর্ধ্বমুখী হলেও শ্রমিক বান্ধব দেশ হিসেবে আজও আমরা নিজেদের দাবী করতে পারিনি। এটা আমাদেরই ব্যর্থতা। আর তাই আমরা প্রকারান্তরে শ্রমিকদের দাসই ভেবে থাকি। এজন্যই বাড়ীর কাজের লোক, রিকশা-চালক, দারোয়ান এইসব মেহনতি মানুুষগুলোর মহান মে দিবসে কোন ছুটি নেই।তারা জানেও না এই দিবসটি কি। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে তাদের ন্যায্য শ্রম অধিকার।

আগামী পৃথিবীর জন্য রয়েছে শ্রমিকদের জন্য রয়েছে এক ভয়ংকর বার্তা। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (ফোর আইআর)। ইংরেজীতে যাকে বলা হয়, The Fourth Industrial Revolution (4IR)। শারিরীক, ডিজিটাল ও জীবতাত্ত্বিক বলয়ের সংমিশ্রণ।তথ্য প্রযুক্তির উন্নতি সাধন, ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিকস, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স আর কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মত বিষয়গুলো এই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সূচনা করেছে বলে অনেকে মনে করেন। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে পৃথিবীতে এক অসাম্য ও চরম দারিদ্র্যের সূচনা হবে। রোবট ও যন্ত্রপাতি হবে কল-কারখানার শ্রমিক। স্বল্পদক্ষ শ্রমিকরা গণহারে হবে চাকুরীচ্যুত। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা চরম হতাশাব্যঞ্জক হবে। আমরা চাই শ্রমিকের অধিকার, শ্রমিকের স্বাধিকার। শ্রমিকের ঘাম ঝড়ে হয়েছে জংগল থেকে নগর পত্তন। সুউচ্চ অট্রালিকায় রয়েছে শ্রমিকের হাতের ছোঁয়া। তাবৎ পৃথিবীর উন্নতির অন্তরালে রয়েছে লক্ষ-কোটি শ্রমিকের দেহের ঘাম।

আর তাই মানব সভ্যতা গড়ে উঠার প্রকৃষ্ট হাতিয়ার হল এই দুনিয়ার মজদুর।সবাই বলি, “দুনিয়ার মজদুর এক হও!”

-সায়েম খান, লেখক ও কলামিস্ট

   

ইব্রাহিম রাইসি’র মৃত্যু-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়া



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

সৈয়দ ইব্রাহিম রাইসি আল সাদাতি (জন্ম ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৬০) সাধারণ মানুষের কাছে ইব্রাহিম রাইসি নামেই পরিচিত একজন রাজনীতিবিদ, বিচারক।

নির্বাচনে জয়ী হয়ে ৩ আগস্ট (২০২১) থেকে ১৯ মে (২০২৪) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ইরানে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার মৃত্যু ‘নিছকই দুর্ঘটনা’ না কি ‘সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড’, তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী চলছে তুমুল আলোচনা। কারণ, তিনি ছিলেন শক্ত মেজাজের নেতা। মধ্যপ্রাচ্যে তথা আরব বিশ্বে মার্কিন-ইসরায়েল আধিপত্যের বিরুদ্ধে খুবই সোচ্চার। পশ্চিমা আগ্রাসনবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও গ্রুপের সহযোগী।

মার্কিন-ইসরায়েল তাকে প্রধান শত্রু মনে করতো। ফলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তার মৃত্যু শুধুই ‘এক্সিডেন্ট’ নাকি ‘পলিটিক্যাল কিলিং’!

মার্কিন যুক্তরাষ্টের কাছে রাইসি ছিলেন ‘বিতর্কিত ও কট্টর মৌলবাদী’। তার শাসনকালকে ‘নারী অধিকার ও মানবাধিকারের পরিপন্থী‘মনে করতো ওয়াশিংটন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল অফিস তাকে নিষিদ্ধ করেছিল এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদকেরা তাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। তার রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি (JCPOA) নিয়ে আলোচনা আটকে যায়।

তারপরেও রাইসিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি পশ্চিমা শক্তি। তার শাসনামলে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিদর্শনে বাধা দিয়েছে এবং রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণে সমর্থন দিয়েছে। ইরান গাজার সংঘাতে ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় এবং হিজবুল্লাহ ও হুথি আন্দোলনের মতো গোষ্ঠীগুলিকে অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে।

অতএব, কপ্টার দুর্ঘটনায় রাইসির আকস্মিক মৃত্যুর পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো সমবেদনার পথে না হেঁটে সরাসরিই বলেছে, ‘এই মানুষটির হাতে যে অনেক রক্ত লেগে রয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ কোনো নেই’।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের প্রতিবাদে রাইসির সমর্থকেরা প্রশ্ন করেছেন, ‘গাজ়ার মানুষের রক্ত তা হলে কার হাতে লেগে আছে! ইসরায়েল, না তাদের অস্ত্র জোগানো অন্ধ সাপোর্টার যুক্তরাষ্ট্রের! রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, দু’জনেই রাইসির মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে তাকে ‘প্রকৃত বন্ধু’ বলেছেন।

প্রথাগত রাজনীতির পথে ইব্রাহিম রাইসি ইরানের ক্ষমতার শীর্ষে আসীন হননি। তিনি ছিলেন ইরানের বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত উপপ্রধান বিচারপতি। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি ছিলেন।

১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে তিনি তেহরানের প্রসিকিউটর এবং উপ-প্রসিকিউটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি আস্থান কুদস রাযভী নামক একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক এবং চেয়ারম্যান ছিলেন। রাইসি ২০০৬ সালে দক্ষিণ খোরাসান প্রদেশ থেকে প্রথমবারের মতো বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি মাশহাদের জুমা নামাজের ইমাম এবং ইমাম রেজা মাজারের প্রধান ইমাম আহমদ আলা মোলহোদার জামাতা।

রাইসি ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, কিন্তু মধ্যপন্থী রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানির কাছে পরাজিত হন। তিনি ২০২১ সালে ফের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ৬২.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে হাসান রুহানিকে পরাজিত করেন।

অনেকেই মনে করেন, এই নির্বাচন রাইসির পক্ষে প্রভাবিত করা হয়েছিল। কারণ, তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ মিত্র। রাইসিকে খামেনির পরবর্তী উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

সন্দেহ নেই, ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার পর ইরাসের ইতিহাসে রাইসির শাসনকাল ছিল অত্যন্ত সংকটময়। ভেতরের নানা আন্দোলন থামানোর পাশাপাশি ইরানকে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় সদা নিয়োজিত থাকতে হয়েছে তাকে।

অন্যান্য মুসলিম দেশ যেখানে মার্কিন-ইসরায়েল আধিপত্য ও গণহত্যা মেনে নিয়েছে, ইরান তা করেনি। ইরানি রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব সর্বদা সচেষ্ট থেকেছে, মার্কিন-ইসরায়েল আগ্রাসন মোকাবিলায়। সে কারণে ইরানি জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রাইসিকেও হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। কেননা, রাইসির কপ্টার নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছিল, তারা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেও সব জানানো হয়েছে।

হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মুখপাত্র জন কার্বি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলিকে মদত দিচ্ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। গোটা অঞ্চলকে অস্থির করে রাখার অভিযোগ ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতেও তুলবে।’

রাইসির শাসনকালে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মারাত্মক কিছু ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘হামাস’কে সাহায্য করেছে। হিজ়বুল্লাহ গোষ্ঠীকে শক্তিশালী করেছে। সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে বোমা ফেলায় ইসরায়েলকে নিশানা করে ইরান পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। যদিও এরপর ইস্পাহানের কাছে ইরানের এয়ারবেসে বোমা ফেলে আসে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান।

হরমুজ় প্রণালীতে ইসরায়েলি মালিকের একটি জাহাজকে পণবন্দিও করে ইরানের বাহিনী। মোটের ওপর, মার্কিন-ইসরায়েলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়ে যাচ্ছিল রাইসির ইরান। এমনকী, মার্কিন নিষেধাজ্ঞাতে পরোয়া না করে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে মৈত্রী গঠন করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিকল্প পরিসর তৈরি করে নেয় রাইসির নেতৃত্বাধীন ইরান।

১৯ মে (২০২৪) রোববার ইব্রাহিম রাইসি পূর্ব আজারবাইজানের প্রদেশে জলপাই এলাকায় প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলীর সঙ্গে জলাধার প্রকল্প উদ্বোধন শেষে ফেরার পথে রাইসিকে বহনকারী একটি হেলিকপ্টার ইরানের উত্তর-পশ্চিমে ভারজাকান এলাকার একটি দুর্গম পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয়।

ওই দুর্ঘটনায় ইব্রাহিম রাইসি, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির-আব্দুল্লাহিয়ানসহ হেলিকপ্টারে থাকা সবাই অর্থাৎ ৯ জন নিহত হন। কপ্টার ভেঙে রাইসির মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলা হলেও নানা ঘটনাপ্রবাহ সন্দেহের আঙুল তুলছে ইরানের প্রতিপক্ষের দিকে।

কৌশলী ইরান হয়ত গোটা পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কায় সমঝে চলছে। তার সামনে নেতৃত্বের শূন্যতা পূর্ণ করা এবং রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখাই আপাতত বড় চ্যালেঞ্জ।

রাইসির মৃত্যুশোক পালনের মধ্যেই ইরান আগামী ২৮ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছে। ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর পর অন্তর্বর্তীকালীনভাবে ওই ভূমিকায় থাকার কথা ভাইস প্রেসিডেন্টের। ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মোখবর সাময়িকভাবে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব সামলাবেন। তাকে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া মেনে কাজ করতে হবে। ইরানের সংবিধানে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্টের আচমকা মৃত্যু হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট সাময়িকভাবে ওই দায়িত্ব সামলাবেন। তিনি সরকারের তিন সদস্যের কাউন্সিলের একজন সদস্য হিসেবেই ওই দায়িত্ব পাবেন। কাউন্সিলে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছাড়াও রয়েছেন ইরানের পার্লামেন্টের স্পিকার এবং বিচার বিভাগের প্রধান।

প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর ৫০ দিনের মধ্যে এই কাউন্সিল দেশে নতুন করে নির্বাচনের আয়োজন করবে। তার মাধ্যমেই স্থির হবে ইরানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন।

২৮ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নতুন প্রেসিডেন্ট যিনিই হবেন, তাকে রাইসির মৃত্যুতে পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে সৃষ্টি হওয়া একরাশ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবতে হবে। মার্কিন-ইসরায়েলি প্ররোচনায় যাতে পশ্চিম এশিয়ায় উত্তেজনা না বাড়ে এবং ইরানের স্বার্থ রক্ষিত হয়, সেসব বিষয় নিয়েও সতর্ক থাকতে হবে নতুন নেতাকে।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে কড়া দর-কষাকষিরই পক্ষপাতী ছিলেন রাইসি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিলেন মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রের ‘বন্ধু’ যে পাকিস্তানের সঙ্গে গত জানুয়ারিতে ইরানের যুদ্ধ বাধার উপক্রম হয়েছিল, শেহবাজ় শরিফের সরকার গঠনের পরে তিনদিন ধরে সে দেশেই সস্ত্রীক সফর করে দ্বিপাক্ষিক, একাধিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার অঙ্গীকার করে এসেছিলেন রাইসি। স্পষ্টতই, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে শত্রুতা ভুলে বন্ধুতার প্রয়োজন বুঝেছিলেন বৈদেশিক রাজনীতিতে পটু ও কৌশলী রাইসি। নতুন ইরানি নেতা রাইসির পথে চলেন না কি নতুন রাস্তা বের করেন, সেটাই দেখার বিষয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য রাইসির পিছু ছাড়েনি। ইরানের সঙ্গে সখ্যতার ‘অপরাধে’ পাকিস্তানকে নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছিল। সেই হুঁশিয়ারির সুর আবার শোনা গিয়েছিল চাবাহার বন্দর নিয়ে ভারতের সঙ্গে ইরানের চুক্তির পরে।

মনে করা হয়, ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গেও চুক্তির পথে হাঁটছিলেন রাইসি। মার্কিন অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা ও নানা প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে দেশের ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কমিউনিস্ট রাশিয়া, চীন ও অপরাপর দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা বুঝেছিলেন রাইসি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের নীতি একা প্রেসিডেন্ট তৈরি করেন না। স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনেকগুলো সংস্থা ও ফোরাম মিলিতভাবে দেশের জন্য নানান রকমের নীতি প্রণয়ন করে। প্রেসিডেন্ট তার মন্ত্রীদের নিয়ে সেসব বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন। ফলে, রাইসির মৃত্যুতেও ইরানের জাতীয় নীতির খুব একটা বদল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে, এটাও ঠিক যে, রাইসির মৃত্যুর প্রভাব পড়তে চলেছে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় ভূ-রাজনীতিতে ও আঞ্চলিক ক্ষমতার মেরুকরণে। সংঘাত, যুদ্ধ, আগ্রাসন, গণহত্যায় জর্জরিত ওই অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান শক্তির লড়াইয়ে রাইসির ইরান যেভাবে নেতৃত্বের আসনে চলে এসেছিল এবং সমমনাদের নিয়ে বড় মাপের মেরুকরণ করে মার্কিন-ইসরায়েল জোটের বিরুদ্ধে লড়ে চলছিল, তার প্রভাব সহজে মুছে যাবে না।

ড. মাহফুজ পারভেজ: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’

;

গরীবি চেহারার গাড়িগুলোর গর্বিত মালিক কারা?



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবিঃ বার্তা২৪.কম

ছবিঃ বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমাদের রাজধানী ও সারাদেশে একই রাস্তায় চলন্ত গাড়ির ধরণ বিভিন্ন তবে এদের মালিক মূলত: দুই শ্রেণির। ধনী আর গরিব মালিক। গরিব মালিকরা কখনো কখনো মাত্র একটি পুরনো গাড়ির মালিক। তাদের গড়িগুলো হতে পারে একটি বাস বা মাইক্রোবাস, একটি সিএনজি, একটি বা কয়েকটি অটোরিক্সা। তারা সেটাকে ভাড়ায় খাটান অথবা নিজেরাই সেটা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। গত বছর রাজপথ থেকে পুরনো গাড়ি সরানো হবে খবর প্রচারিত হলে তাদের অনেকেই ভেবেছেন উপার্জনের একমাত্র সম্বল একটিমাত্র গাড়ি। সেটাকে পথে চালাতে না দিলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে মারা যাবেন।

এসব পুরনো গাড়ির ব্যক্তিমালিকরা কখনো কোন নীতিনির্ধারণী সভায় আমন্ত্রিত হন না, তাদের কোন প্রতিষ্ঠান নেই। অন্যদিকে পুরনো গাড়ির ধনী মালিকদের এককজনের বহু গাড়ি, নিজস্ব পরিবহন প্রতিষ্ঠান, লোকবল, সমিতি, নেটওয়ার্ক সবকিছুই আছে। তারা নতুন গাড়ি কিনে দূরপাল্লায় দেন ও অতিপুরনোগুলো ঢাকা-চট্টগ্রামে চালান। তারা সরকারের নীতিনির্ধারণী সভায় আমন্ত্রিত হন, মতামত প্রদান করেন।

এসব বাস মালিকদের উদ্দেশ্য করে এক সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, ‘রাজধানী ঢাকায় অনেক উন্নয়ন হলেও লক্করঝক্কর বাস চলাচল বন্ধ হয়নি। এ জন্য ১২ বছর মন্ত্রী পদে থেকে কথা শুনতে হয়। আপনাদের কি লজ্জা করে না?... আমাকে জিজ্ঞেস করল, এত বছর মন্ত্রী আছেন, গাড়িগুলোর এই অবস্থা? এই গাড়িগুলো চলে চোখের সামনে। কেন এই বাস বন্ধ করা যায়নি? এটি সত্যিই লজ্জার বিষয়। আপনাদের কি লজ্জা করে না?’ প্রশ্ন হলো- গরীব গরীব চেহারা কি শুধু রাজপথে চলাচলকারী গাড়িগুলোর? জড় পদার্থ ছাড়া গরীব চেহারার জীবগুলোর কথা আগে ভাবা উচিত। জীবগুলোর গরীবি চেহারা দেখানো বন্ধ হলে তাদের বাহনগুলোর গরীবি চেহারা হয়তো আর দেখা যাবে না।

রাজপথে ক্ষুধার তাড়নায় রাজকীয় গাড়ির বন্ধ জানালায় টোকা দিয়ে এক টাকা দাবী করা ভিক্ষুক, ভবঘুরে, অভাবী মানুষ তাদের চেহারাও বেশ মলিণ ও গরীবি। তাদের মোট সংখ্যা কত? তারা নিশ্চয়ই মাফিয়াদের কালো কাঁচ লাগানো গোপন পরিবহন দ্বারা পরিবাহিত হন অথবা রিক্সাভ্যান, অথবা গরীবি চেহারার বাসে চলাচল করেন। এসব তথ্য নীতিনির্ধারকের কাছে মোটেও অজানা নয়।

তিলোত্তমা ঢাকার রাস্তায় হাল ফ্যাশনের গাড়ির পাশে রঙ চটা, কালো ধোঁয়া ছড়ানো, লক্কর-ঝক্কর মার্কা গাড়ি, বাস চলাচল করা নিতান্ত বেমানান। এসব গাড়ির কোনটির বয়স তেতাল্লিশ বছর পার হয়েছে। এরে চেয়ে আরো কত বৃদ্ধ গাড়ি রাজপথে ও দেশের আনাচে কানাচে চলাচল করছে তার কোন পরিসংখ্যান কেউ দিতে পারবে বলে মনে হয় না। এসব গাড়ির গর্বিত মালিক কারা?

গত বছর পুরনো গাড়ি ডাম্পিং করার কথা উঠলে এক শ্রেণির মালিকরা না খেয়ে মারা যাচ্ছেন বলে সংবাদ হয়েছিল। এখন তো অতি বৃদ্ধ গাড়ি ধরে ধরে স্ক্রাপিং করার কথা ভাবা হচ্ছে। তাহলে তাদের এবার কি হবে? অতি বৃদ্ধ গাড়ি স্ক্রাপিং করার পদ্ধতি সব উন্নত দেশে প্রচলিত। সেখানে অতি বৃদ্ধ গাড়ি ধরে ধরে আনতে হয় না। কোন
গাড়ি সরকার নির্দেশিত বয়সসীমা পার হয়ে গেলে তার লাইসেন্স নবায়ন করা হয় না। উন্নত দেশে লাইসেন্স নবায়ন করা হয় স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে। এতে কোন নতুন গাড়িও যদি ফেল করে তাহলে সেটা রাস্তায় চলাচলের অনুমতি পায় না। তিনি বাধ্য হন সেই গাড়িকে ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসতে। মজার ব্যাপার হলো, উন্নত বিশ্বে ফিটনেস পেতে ব্যর্থ গাড়িকে ডাম্পিং ও স্ক্রাপিং করতে হলে নির্দিষ্ট ফি জমা দিয়ে সরকারী ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসতে হয়। সেসব ভাগাড় ভর্তি হলে সরকারী লোকেরা নষ্ট গাড়িগুলোকে স্ক্রাপিং করে মন্ড বানিয়ে লৌহজাত দ্রব্য তৈরীর কারখানায় পাঠিয়ে দেয়। স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে ফিটনেস পেতে ব্যার্থ গাড়িকে রিসাইকেল করার নিয়ম নেই। পরিবেশ সচেতনতা আইনের কঠোরতা থাকায় তারা নিজেদের দেশে সেসব পুরনো গাড়ি চালাতে পারে না। জাপান ও কিছু দেশ পাঁচ বছরের পুরনো কিন্তু সচল গাড়িকে বিদেশে রপ্তানী করে থাকে।

আমাদের দেশে অবৈধভাবে আমদানী, বেনামী, ফিটনেসবিহীন, দুর্ঘটনা কবলিত ইত্যাদি গাড়িকে মামলা দিয়ে ধরে এনে থানার পাশে ডাম্পিং করা হয়। বহু থানায় জায়গা না থাকায় রাস্তায় সারিবদ্ধ করে ফেলে রাখা হয়। অনেক সময় ঘুষের ভয়ে মালিকরা গাড়ি ফেরত নিতে আসে না। সেখান থেকে বছরের পর বছর জং ধরে এসব গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে ধোলাই খালে বিক্রি হয়।

কারণ, এসব গাড়ির মালিক ও এর তদারকিতে অফিসে ও রাস্তায় দায়িত্বরত কোন কোন মানুষের মন খুব গরীব। তাদের জৌলুষ ও চেহারা কিন্তু গরীব নয়। তাই কে শোনে কার কথা? ফিটনেসবিহীন, দুর্ঘটনা কবলিত গাড়িগুলো স্ক্রাপ না হয়ে গোপনে পুনরায় রাজপথে ফিরে আসার অনুমতি পায়। রাজধানীর একই রাস্তায় রোলসরয়েস, মার্সিডিজ, পাগানি, বিএমডব্লিউ, টেসলা, টয়োটা, ফেরারী ইত্যাদি বিলাসবহুল কারের সাথে ৪৩ বছরের পুরনো লক্কর-ঝক্কর বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, মুড়ির টিন, রিক্সা, ভ্যান, ঘোড়ার গাড়ি চলতে দেখা যায়। দানব মোটর বাইক ফাঁক-ফোকর দিয়ে পিড় পিড় করে হর্ণ বাজিয়ে পথচারীর গা ঘেঁষে চলে যাবার জন্য তাড়াহুড়ো
করে। এটাই তো আমাদের পথ চলাচলের চিরায়ত কৃষ্টি!

এর জন্য কোন মোটিভেশন আজ পর্যন্ত কাজে লাগানো যায়নি। দেশের গ্রামাঞ্চলে এমনকি হাইওয়েতে চলে নসিমন, করিমন, পঙ্খীরাজ নামক অটোরিক্সা, ভুটভুটি, চান্দের গাড়ি আরো কত কি ! নতুন রাস্তায় আধুনিক মোটর বাইক অন্যান্য গড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে চলার কৃষ্টি চালু করেছে সাড়ম্বরে। এসবের গতি নিবারণের জন্য সিসি ক্যামেরা বসালেও অদ্যাবধি দক্ষ ও সৎ জনবল তৈরী করা যায়নি। মুখের কথা ও দেশের বাস্তব অবস্থার মধ্যে এখানেও দুস্তর ব্যবধান তৈরী হয়ে আছে। গরীবি চেহারার এসব গাড়ি ছাড়াও একইসংগে অনেক বিলাসবহুল গাড়ির মালিক অনেক আমলা ও রাজনৈতিক নেতারাও। এজন্য নেপথ্যে থাকা মালিকদেরকে চিহ্নিত করতে হবে।

এতদিন পরে ‘সাবওয়ে আমাদের করতেই হবে’ আমাদের যোগাযোগমন্ত্রীর এমন বোধদয় হওয়ায় তাঁকে অনেক ধন্যবাদ। তবে পুঙ্খানুভাবে পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ না করে বন্যাপ্রবণ ঢাকায় সাবওয়ে মতো বড় কোন প্রকল্প তৈরীর আগাম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে সাবওয়ে থেকে তেমন কোন উপকার পাওয়া কঠিন। কল্পিত পাতাল পথের সাথে উপরের প্রচলিত পথের কানেক্টটিভিটির বিষয়টি বেশী গুরুত্ব দেয়া উচিত। এতে মানুষ নিকটস্থ জেলাশহরগুলো থেকে প্রতিদিন ৩০-৪০মিনিটে ঢাকায় এসে অফিস করে বাড়িতে ফিরতে পারবে। তাহলে জাপানের টোকিওর সাথে সাইতামা, চিবা, তোচিগি ইত্যাদি নিকটস্থ জেলার মতো আমাদের জনগণ ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সিপঞ্জ থেকে ডেইলী প্যাসেঞ্জারী করে ঢাকায় চাকুরী করতে পারলে ঢাকার উপর মানুষ ও বসতির চাপ কমবে এবং গরীবি চেহারার পুরনো যানবাহনগুলো এমনিতেই বিলীন হতে পারে।

*লেখকঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’

;

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা ও আরাকান আর্মি



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির (এ এ) সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘাত চলমান রয়েছে। মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ এই সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তোরনের কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। রাখাইনে প্রায় ছয় লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছে এবং সেখানে ভয়াবহ মানবিক সংকট চলছে। চলমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে এবং রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে ১২ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে। তারা সেখানে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া জোরদারকরণে করণীয় সম্পর্কে এবং শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় বলে জানায় রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কবে নাগাদ মিয়ানমার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাই এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের সহায়তা নিশ্চিতে পাশাপাশি রাখাইনে তাদের ফিরে যাবার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতে কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসীরা সক্রিয় রয়েছে, তারা সেখানে হত্যা, মারামারি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো কিছু এন জি ও’র সহায়তায় ক্যাম্পে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রত্যাবাসন বিরোধী প্রচারণার দায়ে দুটি এনজিওকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং এর পরপরই এনজিওগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত এনজিওগুলো যাতে প্রত্যাবাসন বিরোধী কার্যক্রমে জড়িত না থাকে তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আধিপত্য বিস্তার কোন্দলসহ খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা ও পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নাশকতার সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে ধরার জন্য উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ে তাদের আস্তানায় অভিযান চালায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন কারণে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক ২০২৩ সালে ৬৪ জন এবং ২০২৪ সালে এ পর্যন্ত ১৬ জন নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ত্রাণ সহায়তা কমে যাওয়ার কারণে রোহিঙ্গারা জীবিকার তাগিদে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে কাজ করছে। যারা এই অবৈধ কাজে জড়িত এবং যারা রোহিঙ্গাদেরকে নিয়োগ দিচ্ছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তাদের সদস্য সংগ্রহ করছে এবং এর ফলে বাংলাদেশে সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি আশপাশের দেশেও সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক বিস্তারজনিত সমস্যা তৈরি হচ্ছে। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন দল ও উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং তারা অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত রয়েছে। আইওএম মহাপরিচালক কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে ৭ মে প্রধানমন্ত্রীর কাছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরে। বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের নিরাপদ অবস্থান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত সংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ করেছে এবং ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে।

রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় প্রতি বছর আন্তর্জাতিক সহায়তা কমেছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে রোহিঙ্গাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে বলে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, নরওয়ে, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ডের প্রতিনিধিরা তাদের মত ব্যক্ত করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা বাড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য আরো মানবিক ও টেকসই সহায়তা অব্যাহত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ২০২৪ সালের জয়েন্ট রেসপন্স প্লানকে (জে আর পি) সমর্থন জানাতে হবে। এতে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানরত রোহিঙ্গা ও স্থানীয় মিলে সাড়ে ১৩ লাখ মানুষের জন্য ৮৫২.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চাহিদা উপস্থাপন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৭.৬ মিলিয়ন, জাপান ২.৬ মিলিয়ন ডলার এবং নরওয়েও ৬.৫ মিলিয়ন ক্রোনার দেয়ার প্রতিশ্রতি দিয়েছে। সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ড জে আর পি’কে সমর্থন জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য তহবিল কমে যাওয়ার ফলে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তা থেকে উত্তোরন এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য নতুন উৎস থেকে আরও তহবিল সংগ্রহের জন্য এবং ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করতে আইওএমকে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বর্তমানে রাখাইনের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল ও সংঘাতপূর্ণ। এ এ জাতিগত রাখাইন জনগোষ্ঠীর জন্য স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এ এ রাখাইনের ১৯ টা টাউন শিপের মধ্যে ১৭ টাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। রাখাইনে এ এ ৬ মে বুথিডাং শহরের কাছে মিলিটারি অপারেশন কমান্ড ১৫ দখলের জন্য আক্রমণ চালালে প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর জান্তা সৈন্যরা এ এ’র কাছে আত্মসমর্পণ করে। রোহিঙ্গা ও রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করা সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ, কম্বোডিয়ার তথ্য সংগ্রহকারীদের সঙ্গে সম্প্রতিকালে ২০১৬ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধনে অংশগ্রহণকারী অনেক রাখাইনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তারা জানায় যে, সে সময়ের ঘটনার জন্য তারা অনুতপ্ত এবং তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। সে সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যপক প্রচারণার মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানো কারনে তারা এই কাজ করেছিল এবং তা ঠিক করেনি বলে জানায়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখনও আরাকানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে রাখাইনদের মধ্যে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। এর বিপরীতে কোনো মহলে তেমন কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায় না। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালালেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভামারদের অনেকে তা গ্রহণযোগ্য মনে করছে না। সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাদেরকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে জাতিগত সংঘাত উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে, তবে এবার তাদের এই প্রচেষ্টা তেমন কার্যকরী হচ্ছে না। এ এ তাদের দখলকৃত এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কোনো বৈষম্য মূলক আচরণ করছে না বলে জানা যায়। তারা মিয়ানমার সেনা ক্যাম্প দখল করার পর সৈন্যদের পরিবারগুলোকে ও নিরাপদে হস্তান্তর করছে। এ ধরনের আচরণ তাদের সহনশীলতা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দেয়।

এ এ’কে তাদের সুদূর প্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক গবেষক এই সহস্রাব্দের সশস্ত্র দল হিসেবে আখ্যায়িত করে। এন এল ডি’র শাসনামলে এ একে সন্ত্রাসী দল হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। ২০২১ সালে সেনাঅভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরেই সেনাসরকার সংগঠনটিকে কালো তালিকা থেকে বাদ দিয়ে তাদের সঙ্গে একটি অঘোষিত যুদ্ধবিরতির আয়োজন করে। আরাকান আর্মি এই সুযোগটি পুরোপুরি কাজে লাগায়। প্রায় দুই বছর তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সঙ্ঘাত এড়িয়ে পুরোপুরি রাজনীতিতে মনোনিবেশ করে ও রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক গণসংযোগ চালায়। প্রতিটি এলাকায় তারা তাদের রাজনৈতিক এবং বিচারিক নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেয়। উত্তর এবং দক্ষিণ রাখাইনের মধ্যে যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান দূরত্ব কমিয়ে এনে ধীরে ধীরে তারা রাখাইনবাসীদের একমাত্র আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে। এ এ’র সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে রাখাইনবাসীদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মীয় সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অঙ্গীকার। মিয়ানমারের সেনা-সরকার এবং এনএলডি রোহিঙ্গাদের প্রতি বরাবরই বিদ্বেষমূলক আচরণ দেখিয়ে আসলেও এ এ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে চায় বলে জানিয়েছে। অতীতে বিভিন্ন সময় জান্তা সরকার অত্যন্ত কৌশলে রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে রেখেছিল। বর্তমানে এ এ নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে রাখাইনদের এক ধরনের স্বস্তিমূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে জানা যায়।

২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) এর সামরিক শাখা এএ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের অন্যতম স্টেকহোল্ডার হিসেবে রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানায়। রাখাইনরা আরাকানে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইনদের সমর্থন ছাড়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে টেকসই প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে না। মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিলেও রাখাইনে শান্তিতে বসবাস করতে হলে রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেই হবে। তাই বাংলাদেশ থেকে আরাকানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে মিয়ানমার সরকারের মতো আরাকানের রাজনৈতিক দল এবং জনগণের মতও গুরুত্বপূর্ণ। এ এ’র কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল তোয়াং ম্রা নায়েঙ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক নিয়ে জানায় যে, এ এ বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চায় এবং এটা তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় আছে।

এ এ জাতিগত রাখাইনদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে ও তাদের দূরদর্শী নেতৃত্ব মিয়ানমারের ফেডারেল কাঠামোর আওতায় একটা স্বশাসিত আরাকান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে এ এ’র সঙ্গে তাদের যোগাযোগ স্থাপন করেছে। সামনের দিনগুলোতে রাখাইনে তাদের প্রভাবের কারনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে তাদের সহযোগিতা দরকার হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জড়িত আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশকে এ এ’র সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ এ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে আন্তরিক হলে তারা রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা রাখাইন জনগণের মধ্যে প্রচার করতে পারে। রাখাইন সমাজের ওপর তাদের প্রভাব থাকায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের পক্ষে রাখাইন সমাজে জনসচেতনতা তৈরিতে এ এ’র প্রচারণাই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হবে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সঙ্গেও নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে রোহিঙ্গাদেরকে পূর্ণ নাগরিক অধিকারসহ ফেরত নেয়ার বিষয়ে তারা মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদেরকেও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে কোনো দ্বিমত বা বিভক্তি থাকতে পারবে না। নিজেদের ভিতরের বিভক্তি দূর করে তাদেকেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সফল করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’

;

দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ



ড. মাহফুজ পারভেজ
দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ/ছবি: সংগৃহীত

দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ/ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

তীব্র গরমে ফের জারি করা হয়েছে হিট অ্যালার্টের সতর্কতা। এপ্রিলের শেষ দিকে লাগাতার তাপপ্রবাহের জেরে অস্থির হয়েছিল স্বাভাবিক জনজীবন। মাঝে বৃষ্টির ছোঁয়ায় এসেছিল স্বস্তি। মে মাসের মাঝামাঝি পুনরায় শুরু হয়েছে দহনজ্বালা। আবার জনজীবনে নেমে এসেছে অস্বস্তি। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচণ্ড তাপদাহের দাপটে হিট অ্যালার্টের সতর্কতা ঘোষণা করতে হয়েছে।

এপ্রিলে স্মরণকালের তীব্র গরমে মানুষের প্রাণ ছিল ওষ্ঠfগত। স্কুল-কলেজসহ অন্যান্য স্বাভাবিক কাজকর্মেও নেমে এসেছিল স্থবিরতা। তারপর বহু প্রতীক্ষিত বৃষ্টির দেখা পেয়ে একটানা অগ্নিবাণে দগ্ধ ও ক্লান্ত জনজীবনে এসেছিল স্বস্থির পরশ। তবে, সে সময় অস্বস্তি বাড়িয়েছিল বৈশাখী বৃষ্টির দোসর বজ্রপাতের আধিক্য। যদিও গ্রীষ্মের তপ্ত পরিবেশে ঝোড়ো হাওয়া, বৃষ্টি, বজ্রপাত বাংলাদেশের চিরচেনা ছবি, তথাপি গত কয়েক বছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তার কারণ। সামান্য বৃষ্টি ও উতাল হাওয়ার মধ্যেই বিকট শব্দে সিরিজ বজ্রপাতের ঘটনা আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে এবং বাড়িয়েছে প্রাণহানি। এমনকি, ফাঁকা জায়গায় বজ্রপাতে মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি মর্মে প্রচলিত ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে শহরেও বাজ পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

এই যে তাপদাহের ফিরে আসা এবং বৃষ্টির সঙ্গে লাগাতার বজ্রপাতের ঘটনা, তা অবশ্যই বিরূপ প্রকৃতির প্রকাশ। প্রকৃতির বিরূপতা অতি উষ্ণায়ন, তীব্র শীত, বায়ু ও জলের দুষণ ইত্যাদি নানা বিপদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রকাশ পাচ্ছে। যদিও আমরা এবং বিশ্ববাসী এসব বিপদের ব্যাপারে এখনও যথেষ্ট পূর্ব-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারছি না। ফলে বিপদের প্রকোপ ও পরিধি ক্রমান্বয়েই বাড়ছে প্রকৃতির নানামুখী বিরূপ আচরণের মাধ্যমে।

এসব বিপদের বিষয়ে বিজ্ঞানীরা বার বার সতর্কতা জানিয়েছেন। পরিবেশবাদী ও সিভিল সোসাইটির পক্ষেও অবিরাম বলা হচ্ছে এসব বিষয়ে। ফলে সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন প্রতিটি মানুষই জানেন যে, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবেই তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হচ্ছে এবং পরিণামে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসছে। সর্বশেষ গবেষণা বলছে, জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন যদি ঠেকানো না যায় এবং ইতিবাচক দিকে না নেওয়া যায়, তাহলে বিশ্বে তাপপ্রবাহের আশঙ্কা বাড়বে ৪৫ গুণ। জলবায়ুর চোখরাঙানির জেরে বিশ্ব জুড়ে গড় তাপমাত্রা বাড়তে পারে ১.২ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমনই আশঙ্কার ছবি উঠে এসেছে নানা গবেষণায়। বিশেষত ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন (ডব্লিউডব্লিউএ)-এর সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে বিস্তর আলোকপাত করা হয়েছে।

গবেষণার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিপদ যে জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করবে, তা চিহ্নিতকরণ। বলা হচ্ছে, এসব কারণ সামগ্রিক জনজীবনে বিপদ বাড়াবে। তবে বিশেষত যাঁরা দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছেন, তাদের দুর্ভোগ বাড়বে সবচেয়ে বেশি। এর ফলে বিশ্বের দেশে দেশে বসবাসকারী দরিদ্র্য জনগোষ্ঠী, যারা আগে থেকেই ক্ষুধা, অপুষ্টি, বঞ্চনার শিকার, তারা আরো মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবেন প্রাকৃতিক বিরূপতার কারণে।

ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন (ডব্লিউডব্লিউএ)-এর গবেষণা রিপোর্টটি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রণীত। মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, সুইডেন, নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন আবহাওয়া সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৩ জন বিজ্ঞানী রিপোর্টটি তৈরি করেছেন। গত দু’বছরের রিপোর্টেও এ বারের মতোই ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির কার্যকারণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আবহাওয়ার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখেছেন শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় বর্তমানে তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।

নতুন রিপোর্টে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল বিশ্লেষণের জন্য পৃথক মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছিল। পশ্চিম এশিয়ায় (যেমন সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, প্যালেস্টাইন) মার্চ-এপ্রিলের তিন দিনের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা খতিয়ে দেখা হয়। ফিলিপিন্সে দৈনিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ১৫ দিনের গড় পর্যালোচনা করা হয়েছে। তবে ভারত, মিয়ানমার, লাওস-সহ দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে এপ্রিলের গড় তাপমাত্রাকে বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা গিয়েছে, গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি। চলতি বছরের গ্রীষ্মেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে একই চিত্র ধরা পড়েছে।

রিপোর্ট যেমন বলছে, বাস্তবেও তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের জোরালো ইঙ্গিত মিলেছে বিশ্বের দেশে দেশে। প্রায় সব দেশেই তাপমাত্রা বেড়েছে। তাপপ্রবাহের বিপদও বেড়েছে। তবে আগে থেকেই উষ্ণ অঞ্চল, যেমন পশ্চিম এশিয়ায় তাপমাত্রা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করেছেন বিজ্ঞানীদের। তাদের ধারণা, ২০৪০ বা ২০৫০ সালে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি ছুঁতে পারে।

গবেষকরা বলছেন, ভৌগোলিক কারণেই সাধারণ ভাবে এপ্রিল মাসে এশিয়ায় তাপমাত্রা এমনিতে বেশি থাকে। তারপরেও এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলকে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের অংশ রূপেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সেই বাস্তবতা ক্রমেই বিলীন হওয়ার পথে। গবেষকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক কালে নানা কারণে তাপমাত্রা যে বিপুল হারে বাড়ছে (বিশেষত কিছু শহরে), তা নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। অত্যধিক তাপে যে সমস্ত প্রজাতির বিলুপ্তির আশঙ্কা রয়েছে, তাদের সুরক্ষার বন্দোবস্তেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তা না হলে ব্যাহত হতে পারে জীববৈচিত্র। যার পরিণতিতে সবুজ ও নাতিশীতোষ্ণ এশিয়ার দেশগুলোর ভাগ্যেও চরম বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করতে ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কথা শুধু বলতেই শোনা যায়। কখনো কোনো প্রকল্প গৃহীত হলেও তা কার্যকর হয় কমই। উপরন্তু, শহরের দুষণ কমানো যাচ্ছেই না। নদী দখল থামছেই না। বৃক্ষ নিধন কমছেই না। তা হলে নতুন পরিকল্পনা কাজ করবে কেমন করে? বাংলাদেশে যখন এমনই শোচনীয় পরিস্থিতি, তখন বিশ্বের অবস্থাটাও বিশেষ ভালো নয়। অনেক অগ্রসর দেশই প্রকৃতি বিনাশের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাদের কারণে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। বিনষ্ট হচ্ছে জলবায়ুর ভারসাম্য। এবং নেমে আসছে নানা বিপদ।

অতএব, বিশ্ব জুড়ে যদি অবিলম্বে তাপ নিঃসরণের হার নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, সে ক্ষেত্রে তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বিশ্ববাসীকে। আগামী দিনে এই বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রিও ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর তাপপ্রবাহের ক্ষেত্রে তা হতে পারে ৭ ডিগ্রি। বিশেষ করে, যেসব দেশ দারিদ্র্য ও যুদ্ধ বা সংঘাতের কারণে তছনছ হয়ে পড়েছে, সেখানে বিপদ আরো ভয়াবহ রূপ নেবে। একটি গবেষণা পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে, ইসরায়েলি আক্রমণে বিধ্বস্ত গাজ়ায় ভিটেহারা ১৭ লক্ষ মানুষের জীবন আরো দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে অত্যধিক গরমে। এমন চিত্র বিশ্বের অন্যান্য শরণার্থী শিবিরেও দৃশ্যমান।

নগর ও উদ্বাস্তু জীবনের পাশাপাশি জলবাযু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের প্রভাব পড়ছে গ্রামীণ জনজীবনেও। অত্যধিক গরমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাষাবাদ। ফলে খাদ্যশস্যের জোগানে ঘাটতির আশঙ্কাও দেখা দেবে সামনের দিনগুলোতে। জলসঙ্কটের কারণ ঘটবে অত্যাধিক গরমের ফলে। শিক্ষা ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও ছেদ পড়বে বিরূপ পরিস্থিতির প্রভাবে। মৃত্যু হবে অসংখ্য গবাদি পশুর। মারা যাবে মানুষও। যেমন চলতি তাপদহনের কারণে গত এপ্রিলে মৃত্যুর সংখ্যা (সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী) বাংলাদেশে ২৮, ভারতে ৫ এবং গাজ়ায় ৩। থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্সেও দহনজ্বালায় মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে একজন করে। এমনকি, নির্বাচনের মতো গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় আয়োজনও থমকে যাবে বা স্থিমিত হবে তীব্র গরমের কারণে। যেমন, ভারতে চলমান লোকসভা নির্বাচনে ভোটদানের হারও বহু জায়গায় কমেছে তাপপ্রবাহের কারণে।

তাপমাত্রা জনিত কারণে যতগুলো বিপদ আপতিত হয়েছে, তার পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রয়েছে মানুষের অপরাধ। বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনে খলনায়ক মানুষই। বিশেষত সেইসব মানুষ, যারা রয়েছেন ক্ষমতায়, নেতৃত্বে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়। তাদের ভুলের কারণেই অত্যধিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে। অরণ্যবিনাশের মতো অপরাধ হতে পারছে। যার মাসুল গুনছেন বিশ্বের সাধারণ মানুষ।

বাংলাদেশের মতো বৃষ্টির আধিক্য রয়েছে যেসব দেশে, সেখানে উষ্ণায়নের কুপ্রভাব হিসাবে যে সকল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হয়, বজ্রপাতও তার অন্তর্ভুক্ত। ফলে বন্যা, খরা, অতি গরম বা অতি ঠাণ্ডার মতোই বজ্রপাত নিয়েও মনোযোগী হওয়া দরকার। যে হারে বজ্রপাতের আধিক্য দেখা যাচ্ছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে বিষয়টি মোটেও উপেক্ষা করার মতো নয়। বরং এক্ষেত্রে আগাম সতর্কতা হিসাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পথে অগ্রসর হওয়াই কর্তব্য। তবে, নিঃসন্দেহে জনসচেতনতা বৃদ্ধি বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকানোর পক্ষে অত্যাবশ্যক। বারংবার সতর্ক করা সত্ত্বেও বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে খেলা, উঁচু ছাদে মোবাইলে কথা বলা আটকানো যায়নি। শহরে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়েছে এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতা।

অন্য দিকে, প্রকৃত জ্ঞানের অভাবও বজ্রপাতে আহতদের চিকিৎসা সময়ে শুরু করতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বজ্রপাতে আহতদের স্পর্শ করলে নিজেরাও বিদ্যুৎপৃষ্ট হতে পারেন ভেবে প্রত্যক্ষদর্শীরা তাঁদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন না। এই ভ্রান্ত ধারণাও দূর করা আবশ্যক। কালবৈশাখীর সময় পেরিয়ে যায়নি, বর্ষা শুরুর বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির দিনও সমাগতপ্রায়। বজ্রাঘাতে মৃত্যু ঠেকাতে এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন সরকার থেকে সাধারণ মানুষ— উভয় পক্ষেরই। বিশেষ করে, বার বার দহনজ্বালার ফিরে আসা এবং প্রকৃতির বিরূপতায় ধেয়ে আসা বিপদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বহুমুখী বিপদ যেন আরো বৃদ্ধি না পায়, সে ব্যবস্থা করার কথাও নীতিপ্রণেতাদের জরুরি ভিত্তিতে ভাবতে হবে। নইলে প্রাকৃতিক বিপদের পথ ধরে যে সামাজিক বিপদ ও অস্থিতিশীলতা নেমে আসবে, তা সামাল দেওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসেোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’

;