রাজা ত্রিশঙ্কু অবস্থার দোলাচলে মোদি সরকার!

  • মযহারুল ইসলাম বাবলা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

নরেন্দ্র মোদি। ছবি: সংগৃহীত

নরেন্দ্র মোদি। ছবি: সংগৃহীত

একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া বিজেপি’র শরিক দুটি দল তেলেগু দেশম পার্টি এবং জেডি (ইউনাইটেড)-এর কাঁধে ভর রেখে আজ জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি মোটি তৃতীয়বারের মতো শপথ গ্রহণ করবেন। কে কোন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব পাচ্ছেন সেটা কৌশলগত কারণে উহ্য রেখে ৭ জন পূর্ণ মন্ত্রী শপথ নিবেন। তাদের মধ্যে মাত্র ২ জন মাত্র বিজেপি সাংসদ। বাকিরা শরিক দলের। টিডিপি’র ২ জন, জেডি(ইউ) ২ জন এবং শিব সেনা’র একজন পূর্ণ মন্ত্রী শপথ নেবেন। শপথ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল, মরিশাস ও ভুটানের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানেরা উপস্থিত থাকবেন। গতকাল পর্যন্ত জানা গেছে শপথ অনুষ্ঠানে প্রধান বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের কাউকে শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এ প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ প্রশ্ন তুলেছেন, “মোদি বলেছেন বিরোধীদের নিয়ে এগোবেন, অথচ এটাই কি তার সঙ্গে নিয়ে এগোনোর নমুনা”?

আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এনডিএ জোট ক্ষমতায় পৌঁছে গেছে এবং প্রবল প্রতিপক্ষের মুখে দেশ শাসন করবে। বাস্তবে মোদির জন্য বিরোধীরা নয়, চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে জোট মিত্র দল দু’টি। যাদের সমর্থনের ওপরই মোদি সরকার গঠিত হচ্ছে। নীতিশ কুমার রেলমন্ত্রী চেয়েছেন। চন্দ্রবাবু নাইডু চেয়েছেন স্পিকারের পদ। মোদি-অমিত শাহ যদিও সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না। আর ওই পদ দুটি না পেলে তারা দু’জন কি সিদ্ধান্ত নেন, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

বিজেপি’র কৌশলটি হচ্ছে কোনোক্রমে সরকার গঠন করে নিই। তারপর দেখা যাবে। আর এই দেখা যাবেটা হচ্ছে তেলেগু দেশম পার্টি এবং জনতা দল (ইউনাইটেড) এর সাংসদদের অঢেল অর্থ ও হরেক সুযোগ সুবিধা দিয়ে দল ভাঙিয়ে বিজেপি দলভুক্ত করা। দলছুট সাংসদদের সংসদে বসার অনুমোদনের এখতিয়ার স্পিকারের। স্পিকার ইচ্ছে করলে তাদের সংসদে প্রবেশাধিকার রোখার ক্ষমতা রাখেন। চন্দ্রবাবু নাইডু  এবং নীতিশ কুমার রাজনীতিতে মোদির চেয়েও প্রবীণ ও পরিণত। তাই তারা বিজেপি জোটে শামিল হয়ে মোদিকে সরকার গঠনে সমর্থন দিলেও নিকট ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যথার্থ সচেতন এবং ওয়াকিবহাল।

চন্দ্রবাবু এবং নীতিশ কুমারের ডানা ছেটে দেবার কৌশল তারা উপলব্ধি করেই স্পিকার পদের দাবি করেছেন। স্পিকার পদে ভোট হলে সঙ্গত কারণে ইন্ডিয়া জোট চন্দ্রবাবুকে যে সমর্থন করবে এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। গত দশ বছর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে একক কর্তৃত্বে মোদি দেশ চালিয়েছিলেন। এবার তেমনটি হচ্ছে না। প্রচুর টানাপোড়েনের মুখে তাকে শরিকদের আজ্ঞাবহ হয়ে তাদের দাবি পূরণে তটস্থ থাকতে হবে। যদি শরিকদের কোনো দাবি উপেক্ষিত হয়, তবে দুই শরিক সমর্থন প্রত্যাহার করলেই মোদি সরকারের পতন ঘটবে। ভারতের ইতিহাসে এযাবৎ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না-পাওয়া একটি সরকারও মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। ইন্দিরা গান্ধীকে পরাজিত করে মোরারজি দেশাইর জোট সরকার শরিকদের সমর্থন প্রত্যাহারের ফলশ্রুতিতে পড়ে গিয়েছিল। একই ধরাবাহিকতায় ভিপি সিং, দেবগৌড়ার জোট সরকারেরও মেয়াদের পূর্বেই পতন হয়েছিল। সঙ্গত কারণেই অনুমান করা যায় নরেন্দ্র মোদি’র জোট সরকারের পতনেও বিস্ময়ের কারণ হবে না।

এবারের সংসদে শক্তিশালী বিরোধী জোটের পাশাপাশি পাঞ্জাবের স্বাধীন খালিস্তান আন্দোলনের সমর্থক অমৃতপাল সিং, শারাবজিৎ সিং এবং কাশ্মিরের সেপারেটিস্ট আন্দোলনের প্রধান রশীদ শেখকে নিয়ে সংসদে মোদিকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে। ওই তিনজন স্বতন্ত্র সাংসদদের দু’জন রাষ্ট্র-বিরোধী অভিযোগে কারাগারে বন্দি আছেন। তবে নিশ্চয় নির্বাচনে বিজয়ী হিসেবে সংসদ কার্যক্রমে অংশ নেবেন। সংসদে মোদি সরকারকে চতুর্দিকে চরম বৈরী পরিস্থিতিতে মোকাবিলা করতে হবে।

নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ’র প্রতি আরএসএস-এর নিরঙ্কুশ সমর্থনে ভাটির টান লক্ষ্য করা গেছে। এবারের নির্বাচনে বিজেপি’র পক্ষে আরএসএস-এর তুলনামূলক নিষ্ক্রিয় ভূমিকাও অপ্রত্যক্ষে থাকেনি। বিজেপি’র আদর্শিক সংগঠন আরএসএস (সাবেক ভারতীয় জনসংঘ)। আরএসএস-এর বিশ্বস্ত কর্মী নন এমন কেউ বিজেপি’র নেতৃত্বে আসতে পারে না। বাজপেয়ী, মোদি দুজনেই সুদীর্ঘকাল আরএসএস-এর কর্মী হিসেবে সক্রিয়তার প্রমাণ দিয়েছিলেন।

নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল আরএসএস-এর কর্মী হিসেবে। আনুগত্যের প্রমাণ স্বরূপ গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন আরএসএস-এর আশীর্বাদে। বাজপেয়ী সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং বাবরি মসজিদ ভাঙার নেতৃত্বদানকারী এল. কে আদবানি বিজেপি’র দ্বিতীয় নেতা। তারই ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়া প্রায় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু কে প্রধানমন্ত্রী হবে, না হবে সেটা নির্ধারণের এখতিয়ার একমাত্র আরএসএস’র। আদবানির চেয়ে মোদিকে, অধিক বিশ্বস্ত, অনুগত, নির্ভরযোগ্য বিবেচনা করেই আদবানির পরিবর্তে নরেন্দ্র মোদিকে সামনে এনেছিল। মোদিকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং তার দ্বারা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে অগ্রসর করা যাবে বিবেচনায় অন্যদের পেছনে ঠেলে আরএসএস মোদিকেই গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করেছে।

প্রথম মেয়াদে মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়ে আরএসএস-এর আনুগত্য স্বীকার করলেও দ্বিতীয় মেয়াদে মোদির অতিমাত্রার আত্মবিশ্বাস আরএসএস প্রধান মোহন ভগত-এর সঙ্গে দূরত্বের সৃষ্টি করে। অমিত শাহ এবং বিজেপি দলীয় কতিপয়ের পরামর্শ মোতাবেক মোদি সকল সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে এমন কি সর্বশেষে নিজেকে ঈশ্বরের অবদার হিসেবে দাবি করায় আরএসএস-এর অস্তিত্ব হুমকির কবলে পড়ে। তাই এবারের নির্বাচনে আরএসএস মোদি এবং অমিত শাহদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে অতীতের ন্যায় অনেক রাজ্যে বিশেষ করে উত্তর প্রদেশে আরএসএস কিছুটা নিষ্ক্রিয় থেকেছে। তবে তার মানে এই নয় বিজেপি’র পরাজয় আরএসএস চেয়েছে। আগামী বছর আরএসএস-এর শতবর্ষ পালিত হবে। সঙ্গত কারণেই আএসএস চেয়েছে বিজেপি ক্ষমতাসীন হলে তাদের আয়োজনে ব্যাপকতা ভারত জুড়ে বিস্তার লাভ করবে। মোদির জোট সরকারের ভবিষ্যৎ আরএসএসকেও শঙ্কার মুখে ফেলেছে।

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মতো নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছেন। গত দশ বছরে মোদি সরকার দেশের এবং দেশবাসীকে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও প্রতিশ্রুতি পালন না করলেও, তার দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও সর্বাধিক আসন পেয়েছে। বাংলায় প্রবচন আছে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ধর্মকে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হিসেবে বলা হয়েছে। মোদির ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটছে। ভারতীয়দের ইহজাগতিক সমস্যা, অনাহার, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনা ওই ধর্মের কলে ভুলিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপিকেই রক্ষাকর্তা রূপে বিবেচনা করেছে। ইহজাগতিক সমস্যা থেকে তারা পারলৌকিক সুখ-সুবিধা পাবার মোহে মোদিকেই পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে, তবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারা পায়নি। বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে নির্ভর করতে হচ্ছে জেডি ইউনাইটেডের নীতিশকুমার এবং তেলেগু দেশম পার্টির চন্দ্রবাবু নাইডুর ওপর। এবং তাদের সমর্থনে সরকার টিকে থাকবে। সমর্থন হারালে সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে পড়বে।

আমাদের উপমহাদেশ খণ্ডিত হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের খড়গে। যদিও সেটা জাতিতত্বের ভুল ব্যাখ্যা ছিল। ছিল দুই প্রধান সম্প্রদায়ের বিভাজন। কংগ্রেস যদি এক জাতির আওয়াজ না তুলতো তাহলে মুসলমানেরা দ্বিজাতিতত্ত্ব হাজির করার সুযোগ পেত না। ওই তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্ব সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে স্থায়ী আসন নিয়ে বসেছে।

বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। এটা বিগত দশ বছরব্যাপী মোদি শাসনের ওপর জনগণের চপেটাঘাত নিশ্চয়। মোদি সরকার আগামী পাঁচ বছর একক আধিপত্য অতীতের ন্যায় ফলাতে পারবে না। বিজেপিকে সমর্থন চাইতে হয়েছে নীতিশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নাইডুর কাছে। তাদের কাক্সিক্ষত চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে তারা সমর্থন প্রত্যাহার করবে এবং অতীতের সকল জোট সরকারের ন্যায় বিজেপি সরকারেরও পতন ঘটবে। ভারতে ইতিপূর্বে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া কোনো জোট সরকার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। জওহরলাল নেহেরুর পর টানা তৃতীয়বারের ন্যায় প্রধারমন্ত্রী হবার গৌরব নরেন্দ্র মোদি অর্জন করলেও; তার ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং না থাকার দোলাচলে কখন যে হুট করে পড়ে যাবে তার নিশ্চয়তা নেই। রাজা ত্রিশঙ্কুর অবস্থায় ঝুলে থাকতে হবে মোদি সরকারকে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত