যাত্রী স্বল্পতায় বাংলাদেশ থেকে ভারতের বিভিন্ন গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা ব্যাহত
যুক্তিতর্ক
আন্তর্জাতিক কিংবা আঞ্চলিক যেকোনো বিবেচনায় বাংলাদেশ থেকে ভারতের বিভিন্ন গন্তব্যে ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশি যাত্রীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় মাধ্যম আকাশপথ। অথচ জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে আজ অবধি বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যাত্রী সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ৫ আগস্টের পর ভারতের ভিসা ইস্যূ সংক্রান্ত জটিলতার জন্য বাংলাদেশ থেকে জনপ্রিয় গন্তব্য ভারতের কলকাতা, চেন্নাই, দিল্লীসহ বিভিন্ন রুটে যাত্রীসংখ্যা স্মরণকালের মধ্যে নিম্নগতি দেখা যাচ্ছে।
ভ্রমণপিপাসু বাংলাদেশীরা পর্যটন ভিসার মাধ্যমে কলকাতা, দিল্লী ভ্রমণ, চিকিৎসা সেবা নেয়ার জন্য মেডিকেল ভিসার মাধ্যমে চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ ভ্রমণ করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন কারন বিশেষ করে, ব্যবসায় সংক্রান্ত, শিক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে অনেকে ভারতের বিভিন্ন গন্তব্যে ভ্রমণ করে থাকে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ থেকে দেশীয় এয়ারলাইন্স জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, অন্যতম বৃহৎ বেসরকারী বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, ঢাকা-কলকাতা রুটে পরিচালনাকারী এয়ারলাইন্স নভো এয়ার অস্বাভাবিক যাত্রী স্বল্পতার জন্য আগস্টের শুরু থেকেই প্রতিটি বিমান সংস্থা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফ্লাইট বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ঢাকা থেকে কলকাতা প্রতিদিন ২টি করে ফ্লাইট পরিচালনা করতো, যা সপ্তাহে ১৪টি ফ্লাইট। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমানে সপ্তাহে মাত্র ছয়টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন একটি ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছিলো কিন্তু যাত্রী স্বল্পতার কারনে বর্তমানে চট্টগ্রাম-কলকাতা রুটে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ রাখতে হয়েছে। চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশ থেকে রেকর্ডসংখ্যক যাত্রী চেন্নাই ভ্রমণ করে থাকে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স সপ্তাহে ১১টি ফ্লাইট পরিচালনা করছিলো কিন্তু বর্তমানে ঢাকা-চেন্নাই রুটে সপ্তাহে মাত্র ৬টি ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে।
বিজ্ঞাপন
কলকাতা রুটে চলাচলকারী নভোএয়ার যাত্রী স্বল্পতার জন্য সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে ।বেসরকারী এয়ারলাইন্সের পাশাপাশি জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ঢাকা-কলকাতা রুটে সপ্তাহে ১৪টি ফ্লাইটের পরিবর্তে বর্তমানে ৭টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। অন্যদিকে ঢাকা-চেন্নাই রুটে সপ্তাহে ৭টির পরিবর্তে ৩টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
একই চিত্র ভারতের বিমান সংস্থাগুলোর বাংলাদেশে চলাচালকারী বিভিন্ন রুটে যাত্রী সংখ্যা নিম্নমূখী, যা দৃশ্যমান।
বাংলাদেশ থেকে ভারতের বিভিন্ন গন্তব্যে ভ্রমণকারী যাত্রীরা ভিসা ইস্যূর প্রক্রিয়া স্বাভাবিক না হওয়ায় চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে সময় অতিবাহিত করছে। অনেকে জরুরী প্রয়োজনে ভারত ভ্রমণ করতে পারছে না। পার্শ্ববর্তী দু’দেশের আর্থ-সামাজিকসহ নাগরিকদের সকল ধরনের সম্পর্কের স্বাভাবিকতা বজায় রাখার জন্য দু’দেশের নীতি-নির্ধারকদের দ্রুতলয়ে এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছে ভারত ভ্রমণে ইচ্ছুক নাগরিকরা। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ভিসা জটিলতার কারনে নাগরিকদের যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেলে দু’দেশের আকাশপথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে যাবে, যা কোনোভাবে কাম্য নয়। ফলে বিমান চলাচল ও পর্যটন খাত হুমকির মুখে পরবে।
নির্বাচনের বছর বলা হয়েছিল ২০২৪ সালকে। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ এবার ভোট দিয়েছেন। কিন্তু বছর শেষে বাংলাদেশ, দক্ষিণ কোরিয়া, সিরিয়া এবং আরও অনেক দেশে গণআন্দোলন, সংঘাত ও ক্ষমতার পালাবদলের জন্য ২০২৪ নামক বছরটিকে দেখা যাচ্ছে রক্তাক্ত রাজনৈতিক পর্বান্তরের পটভূমিতে।
বছর শেষের প্রাক্কালে যে প্রশ্নটি বিশ্বব্যাপী আলোচনার ঝড় তুলেছে, তা হলো, কেন সিরিয়ায় আসাদের নাটকীয় পতন হয়েছে? দ্রুততম ও অভাবনীয় এই পতনের নেপথ্য কার্যকারণগুলো কি ছিল? যদিও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের সাথে সুপরিচিত এবং বিশ্বাসযোগ্য ভাষ্যের বন্যা বইছে। অনেকেই ব্যাখ্যা করেছেন, কিভাবে এবং কেন তার শাসন এত দ্রুত পতন হল। তথাপি সিরিয়া নিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায় নি।
বিশেষত, প্রবীণ সিরিয়ান সাংবাদিক এবং বিশ্লেষক হাসান হাসানের এক্স-এর একটি পোস্টে উত্থাপিত অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর এখনও বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট নয়। তিনি বলেছেন যে, "সিরিয়া বিষয়ে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত উত্তর নেই। এখনও অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা বাকি।" তার মতে, "আসাদের অনুগত বাহিনী ছিল অন্তত কিছু সময়ের জন্য দামেস্ককে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্ত তারা কেন হাল ছেড়ে দিল, তার কোন সদুত্তর নেই।
তিনি মনে করেন, "দামেস্কের কাছে এটি পরিষ্কার ছিল যে পুরো দেশের বেশিরভাগ অংশে যুদ্ধ করতে অক্ষম ছিল আসাদের শাসন ও সৈন্যদল। কিন্তু এটা স্পষ্ট নয়, কেন তারা রাজধানী রক্ষার যে সিদ্ধান্ত ছিল, তা কোনও ঘোষণা ছাড়াই পরিত্যাগ করেছিল? এটি কখন ও কেমন করে হলো, তা এখনও প্রকাশ করা হয়নি কোনও সূত্রের পক্ষেই।"
হাসান আরও বলেন, "আসাদের কাছে লড়াই করার জন্য সবচেয়ে প্রশিক্ষিত এবং অনুগত বাহিনী ছিল, কিন্তু তারা রাজধানী ছেড়ে পালালো কেন? যদিও সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে আসাদের অনেকগুলো শক্তিশালী ঘাঁটিতে অনুগত ইউনিটগুলে লড়াই করতে ইচ্ছুক ছিল। রাজধানীর আকস্মিক পতন ঘটায় তারাও হতাশ আর নেতৃত্বহীন হয়ে রণাঙ্গন পরিত্যাগ করে।"
হাসানের মতো আরও অনেকেই প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, "তাহলে কেন সেনাবাহিনী আসাদকে সম্পূর্ণরূপে এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে পরিত্যাগ করল অপেশাগত পদ্ধতিতে?" পশ্চিমা গ্রেগরি ওয়াটার্স এবং সিরিয়ার মুহসেন মুস্তাফার মতো বিশ্লেষকরা একাধিক কারণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন যা গত কয়েক বছরে সামরিক সংহতি এবং প্রস্তুতিকে ক্ষুণ্ন করেছে, যার মধ্যে কয়েক হাজার অফিসার এবং সৈন্যকে রিজার্ভে স্থানান্তর করার ঘটনা রয়েছে। এতে, সক্রিয় এবং রিজার্ভ উভয় ধরনের সৈন্যদের পেশাগত জীবনযাত্রার মান মারাত্মক ক্ষয় হয়েছে। তাছাড়া, সংরক্ষিত কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও দুর্নীতির ফলে বেতন আত্মসাৎ এবং খাদ্য সরবরাহের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় আসাদের সামরিক শক্তি ভঙ্গুর হয়েছে। সর্বোপরি, রাশিয়া, ইরান এবং হিজবুল্লাহর কাছ থেকে যে ধরনের সামরিক সহায়তা আসাদ-শাসনের টিকে থাকার চাবিকাঠি ছিল, শেষ দিকে পর্যাপ্ত ছিল না।
আসাদের পতনের ঘটনা থেকে কর্তৃত্ববাদী আরব রাষ্ট্রগুলো এই সামরিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা পেতে পারে যে, বাইরের সাহায্যে ভেতরের সমস্যার সমাধান দীর্ঘমেয়াদে সম্ভব নয়। আসাদ পতনের ঘটনাবলি এই দরকারী অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে যে, জনবিচ্ছিন হলে ক্ষমতা ধরে রাখা অসম্ভব। তদুপরি, জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে রাজনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, যা শাসনের অবক্ষয় নিয়ে আসে। সিরিয়ার অভিজ্ঞতায় আরব বিশ্বের দেশগুলোতে আগামী দিনে শাসন ব্যবস্থা ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার সম্পর্ককে আরও জনমুখী করার প্রয়োজনীয়তা প্রকট হচ্ছে।
উত্তাল আরব বিশ্বে অভ্যুত্থান ও গণবিক্ষোভ তীব্র হয়ে ক্ষমতার পালাবদল ঘটালেও সিরিয়া এসব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তবে, ২০১১ সালে মিশর এবং লিবিয়ায় এবং ২০১৯ সালে আলজেরিয়া এবং সুদানে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাধারণ কারণের মধ্যে অন্তত একটি সিরিয়ার আসাদ সরকারের শেষ দিনগুলোতে দৃশ্যমান হয়েছিল। অন্যান্য আরব দেশের মতো সিরিয়ায় যখন জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায় শুরু হয়েছিল, তখন সামরিক বাহিনী বুঝতে পেরেছিল যে বর্তমান রাষ্ট্রপতি জনগণের সঙ্গে বোঝাপড়ায় পর্যুদস্ত হয়েছেন, আর তখনই কর্তৃত্ববাদী শক্তির প্রধান নোঙ্গর এবং শাসনের স্থায়িত্বের গ্যারান্টার হিসাবে সামরিক বাহিনী তার ভূমিকা স্থগিত করেছে।
২০২৪ সালে সিরিয়ায় যা হয়েছে, তা ২০১১-২০১২ সালে হয় নি। তখনকার জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের হুমকির কারণে আসাদ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়নি। তবে শাসনের প্রতিটি সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষয় শুরু হয়েছিল অল্প অল্প করে। এর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধকালীন বাস্তুচ্যুতি এবং রাষ্ট্রীয় ঋণের ক্ষতির কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি বৃহৎ চাষি শ্রেণি, এবং একটি ব্যবসায়িক খাত যা বারবার ঝাঁকুনি এবং পতনের মুখোমুখি হয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে, আসাদ একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের সাথে একটি অন্তর্নিহিত চুক্তি ভঙ্গ করেছেন বলে মনে হচ্ছে যেটি তার প্রতিরক্ষায় হাজার হাজার লোককে হারিয়েছে। ক্রমাগত অবনতিশীল জীবনযাত্রার মান এবং সরকারী খাতে আয়ের অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে। সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে আস্থায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং মুদ্রাস্ফীতির অন্তহীন চক্রের পতন ঠেকাতে পারে নি।
সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কমান্ডের মধ্যে এই ধারণা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতি একটি সংকটময় মুহূর্তে বিদেশি সামরিক বা আর্থিক সহায়তার সুবিধা নিতে পারছেন না। এর আনুমানিক কারণগুলো ছিল, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ, ইরানের অবক্ষয়, কৌশলগত প্রতিরোধ এবং লেবাননে হিজবুল্লাহর সামরিক ক্ষয়ক্ষতি, যা ছিল সম্পূর্ণরূপে আসাদের হাতের বাইরে। অন্য চারটি আরব দেশে অতীত দৃষ্টান্তে দেখা যায় যে, একজন প্রেসিডেন্টের বিদেশি সমর্থন বা সামরিক নিষেধাজ্ঞা থেকে রক্ষা করার ক্ষমতার প্রকৃত বা সম্ভাব্য ক্ষতি তাকে রক্ষা করতে বা পরিত্যাগ করার জন্য সামরিক প্রস্তুতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
সিরিয়ার একদিকে, সমাজ ও রাজনীতির সামরিকীকরণ এবং কয়েক দশক ধরে শাসনের স্তম্ভ হিসাবে সেনাবাহিনীর দ্ব্যর্থহীন ভূমিকা সত্ত্বেও, সিরিয়ার সেনাবাহিনীর আরব প্রতিপক্ষদের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের অভাব ছিল। হাস্যকরভাবে, আসাদের অনানুষ্ঠানিক কন্ট্রোল নেটওয়ার্কের সাথে এর আনুষ্ঠানিক কমান্ড স্ট্রাকচারের আন্তঃসংযোগের অর্থ হল যে তিনি এর সংহতি রক্ষা করতে এবং গৃহযুদ্ধের সময় এটির টিকে থাকা নিশ্চিত করার চেয়ে বেশি করেছিলেন তার ক্ষমতা রক্ষা করার জন্য। অতি সম্প্রতি, একটি সঙ্কুচিত অর্থনীতি থেকে আয় কমানোর বিষয়ে তার বিভ্রান্তির মধ্যে এই ফাংশনটির প্রতি তার অবহেলা, সেনাবাহিনীর সংহতিকে আরও দুর্বল করেছে। অন্যদিকে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর সামাজিক স্বায়ত্তশাসনের অভাব ছিল। সেনাবাহিনীতে আসাদপন্থী আলাভি সম্প্রদায়ের নিয়োগের উপর অত্যধিক নির্ভর করে শাসনের টিকে থাকার প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সেনা প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যর্থ করেছে। যদিও সামরিক বাহিনী দীর্ঘকাল ধরে এবং নিজের মধ্যে একটি প্রধান পাবলিক সেক্টর নির্বাচনী প্রতিনিধিত্ব করেছে ও এটিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার একটি হাতিয়ার হিসাবে অপরিহার্য করে তুলেছে, তথাপি আসাদের রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের বাকি অংশের দরিদ্রতা থেকে রক্ষা করতে আসাদের অক্ষমতা তার উপর সেনা আস্থা হ্রাস করেছে।
সিরিয়ার বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কের এই পাঠ থেকে একটি চূড়ান্ত, আশাব্যঞ্জক প্রভাব হল যে দামেস্কে যা ঘটেছিল তা ২০১১ সালে মিশরে যা ঘটেছিল তার পুনরাবৃত্তি নয়, যখন সশস্ত্র বাহিনী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হোসনি মুবারককে রক্ষা করার জন্য ক্ষমতা থেকে সরে গিয়েছিল। তাদের অবস্থান এবং মূল শাসন সংরক্ষণ, অথবা যখন আলজেরিয়ান এবং সুদানী সেনাবাহিনী ২০১৯ সালে একই কাজ করেছিল। সিরিয়ার কয়েক ডজন সিনিয়র সেনা কমান্ডার যারা আসাদের শাসনের শেষ দিনে দামেস্কে থেকে যাওয়া হয়তো তাকে বলেছিল যে তারা তার পক্ষে লড়াই করবে না এবং তাকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছে। যাইহোক, তাদের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের অভ্যাসের অভাব ছিল এবং সিরিয়ার রাজনৈতিক রূপান্তর বাতিল করতে এবং তাদের নিজের হাতে ক্ষমতা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক স্বায়ত্তশাসনের অভাব ছিল। ফলে সিরিয়ার ক্ষমতা আসাদের কাছ থেকে কোনও সামরিক জেনারেলের হাতে যায় নি। জেনারলগণ নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে পুরো সেনাবাহিনী সমেত রণাঙ্গন থেকে সরে গিয়ে ক্ষমতা দখলের জন্য বিদ্রোহীদের সামনে মসৃণ পথ তৈরি করে দিয়েছেন। সেই পথে, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে আরেক দিক থেকে ইসরায়েল আক্রমণ ও আগ্রাসন চালিয়েছে সিরিয়ায়।
সিরিয়ায় আসাদের সুদীর্ঘ স্বৈরশাসন ও কর্তৃত্ববাদ দেশটির ইতিহাস, ঐতিহ্য, শক্তি ও সামর্থ্যের যে চরম ক্ষতি করেছে, তার দায়ভার সিরিয়াকে ভোগ করতে হচ্ছে চারদিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার মাধ্যমে।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।
সামরিক জান্তার অধীনে বসবাস করে মিয়ানমারের জনগণ তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার মতো সুসংবাদের জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন অপরাধী সামরিক শাসন ব্যবস্থা ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়তে যাচ্ছে-এমন পরিবর্তনের জন্য জনগণ মুখিয়ে আছে। গত রোববার এমনই কিছু প্রাপ্তির সম্ভাবনাকেই অনুভব করতে পেরেছেন তারা।
সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অত্যাশ্চর্য বিজয়ে বাশার আল-আসাদের কয়েক দশকের শাসনের অবসানে বিরোধী বিদ্রোহী বাহিনীর রাজধানী দখল এবং রাষ্ট্রপতিকে রাশিয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য করা, দামেস্কের রাস্তায় সিরিয়ানদের স্বাধীনতা উদযাপন করার খবর এবং ছবি মিয়ানমারের জনগণ ব্যাপকভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছেন। মিয়ানমারে বিরোধী বাহিনী এবং বেসামরিকদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন বিমান হামলা চালানোর নির্দেশদাতা জেনারেলদের প্রতি এটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা। যা কোন ডিজাইনকৃত ভুল প্রচারণা ছিল না, জনগণের স্বতোস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল এ প্রচারণায়।
মিয়ানমারেও কি সিরিয়ার মতো একই রকম পরিস্থিতি হতে পারে? এখন আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার ঝড় দেখতে পাচ্ছি—আসাদ সরকারের মত পতন মিয়ানমারে ঘটতে পারে কিনা তা নিয়ে সীমাহীন চর্চা চলছে। মিন অং হ্লাইং যদি একই পরিণতির মুখোমুখি হয়, তবে রাশিয়া বা চীন কি তাকে এবং তার স্ত্রীকে নিয়ে যাবে? যদিও এই মুহুর্তে এটি কিছুটা দূরবর্তী বিষয়, তবে মিয়ানমারের বিপ্লবের অনেক কট্টর সমর্থক এমন একটি ফলাফলেরই আশা করছেন।
সিরিয়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সেখানে আরও বিশৃঙ্খলা, এমনকি দেশটি নতুন যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে; তা সত্ত্বেও মিয়ানমারের মানুষ সাগ্রহে দামেস্কে খুনি শাসনের পতনের খবর শেয়ার করেছেন। সরকার-নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রগুলি আসাদের পরাজয়ের বা রাশিয়ায় তার ফ্লাইটের কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি, যখন আসাদ সরকারও অব্যাহতভাবে মিয়ানমার জান্তার শক্তিশালী মিত্র ছিল।
আকস্মিক পতন প্রতিটি স্বৈরাচারী শাসনের জন্যই দুঃস্বপ্নের, তবে এটি যে কোনও জায়গায় ঘটতে পারে এবং মিয়ানমারও এর ব্যতিক্রম নয়। সিরিয়ার জনগণকে এতে আনন্দিত হতে দেখে মিয়ানমারের জনগণও অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন। মিয়ানমারের জনগণ এবং বিরোধী দলগুলো নিজেদের সেই দিনের স্বপ্ন দেখছেন, যেদিন নেপিদোতে মিন অং হ্লাইং সরকার একই পরিণতির মুখোমুখি হবে।
আসাদের মতো, মিন অং হ্লাইং গত চার বছরে তার নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধে সীমাহীন অপরাধ করেছে এবং জনগণ সেই নৃশংসতা জনগণ সহজে ভুলবে না। আসাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমারের জনগণও দেশটির জাতিগত বিদ্রোহী বাহিনীর রাখাইন এবং চিন রাজ্যে আরও কৌশলগত শহর দখলের খবর জেনেছে। আরাকান আর্মির কাছে রাখাইনে মংডুর পতন এবং জান্তা বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরেইন তুনকে বন্দী হতে দেখেছে। এখন মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত আরাকান আর্মির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এই বিজয়ের আবহেই চীন প্রদেশে প্রতিরোধ বাহিনী রাজ্যের রাজধানী হাখা এবং থানলাংয়ের মধ্যবর্তী কৌশলগত সমভূমিতে শেষ নিরাপত্তা ফাঁড়িটি দখল করে নিয়েছে। দেশটির উত্তরে কাচিন রাজ্যে, চীনের চাপকে উপেক্ষা করে, কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ) ভামো এবং মানসি শহরে সরকারী চৌকিতে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।
অন্যান্য স্বৈরশাসকদের মতোই তবে কি মিন অং হ্লাইং একটি বিভ্রান্তিকর স্বপ্নের জগতে বাস করছেন? এমনকি তার সৈন্যরা যখন বিরোধী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করছে এবং তার নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলগুলি সারা দেশে ক্রমাগত সঙ্কুচিতত হয়ে আসছে তবুও তিনি বিশ্বাস করেন যে মিয়ানমার ‘সোনার ভূমি’ ‘স্থিতিশীল’ ও ‘শান্তিপূর্ণ’!
প্রকৃতপক্ষে ২০২১ সাল থেকে তার শাসনকালে মিয়ানমারের বেশিরভাগ অংশ ছাই হয়ে গেছে, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা চরমে পৌছেছে। তার সেনাবাহিনী প্রতিরোধ শক্তির অভূতপূর্ব চাপ এবং এখন বিস্ফোরণের সম্মুখীন। কিন্তু মিন অং হ্লাইং এখনও বিশ্বাস করেন যে তিনি চীন এবং রাশিয়ার মতো তার প্রধান বিদেশী মিত্রদের সহায়তায় দেশে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে পারবেন।
কিন্তু সিরিয়ার বিদ্রোহীরা যখন দামেস্কের পথে ছিল তখন আসাদের মিত্র ইরান এবং রাশিয়ার কাছ থেকে কোনো সহায়তা আসছিল না, আসাদ এবং তার পরিবারকে তাদের জীবনের জন্য দৌঁড়াতে বাধ্য করেছিল, এই সত্যটি তার মনে রাখা ভাল।
এমন অবস্থাকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভয় পান। আজ দেশব্যাপী প্রতিরোধ প্রচেষ্টাগুলো চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসক আসাদের মতো একই পরিণতির মুখোমুখি হবেন না এমন সম্ভাবনা কেউ উড়িয়ে দিতে পারছে না। আজ নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে আসাদ সরকারের পতন ৬০০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরের মিয়ানমারের জনগণের জন্য আনন্দের উৎস এবং অবশ্যই নেপিদোর নেতৃত্বকে এটি নাড়া দেবেই।
মিয়ানমারের জনগণের কাছে ইতিহাসের সান্ত্বনাদায়ক স্মৃতি হিসাবে কাজ করছে যে সমস্ত স্বৈরশাসকেরই শেষ পর্যন্ত পতন ঘটে, তাদের যতই শক্তিশালী মনে হোক না কেন। মিয়ানমারের মানুষ তাদের নিজ দেশে দমনমূলক শাসনের উত্থান-পতন দেখেছে। তারা কষ্ট পেয়েছিল এবং অবশেষে তারা তা কাটিয়ে উঠবেই। মিন অং হ্লাইং এর ক্ষমতায় আরোহণ ও তার বিরোধিতায় অটল প্রতিরোধ আন্দোলনে মিয়ানমারের জনগণ বর্তমানে আরেকটি বিশৃঙ্খল সময় সহ্য করছে। নিঃসন্দেহে যখন কাঙ্খিত পরিবর্তন আসবে জনগণ পরবর্তী অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানাবেই। মিন অং হ্লাইং-এর জন্য এটি ভয়ের কারণ।
দ্য ইরাবতী’র সম্পাদকীয় নিবন্ধ থেকে ভাষান্তার: আশরাফুল ইসলাম
একটি চৌবাচ্চায় যতই পানি ভরা হোক, সেখানে ছিদ্র থাকলে পানি ধরে রাখা সম্ভব হবে না। একদিক দিয়ে পানি ঢালা হলেও ছিদ্রের কারণে অন্য দিক দিকে সব পানি বের হয়ে যাবে। চৌবাচ্চা পরিণত হবে শুষ্ক ও পানিশূন্য ভাণ্ডে। ফলে পানি সংরক্ষণ করতে হলে সবচেয়ে আগে চৌবচ্চার ছিদ্র সারাতে হবে।
দুর্নীতি হলো চৌবাচ্চার ছিদ্রের মতো। যতই আয় হোক, উৎপাদন হোক, দুর্নীতি থাকলে সঞ্চয় ও সমৃদ্ধি বলতে কিছুই হবে না। অভাব ও হাহাকার লেগেই থাকবে। তাই সমাজকে উন্নত, দারিদ্র্য মুক্ত ও আর্থিকভাবে মজবুত করতে হলে অবশ্যই দুর্নীতি দূর করতে হবে।
জুলাই বিপ্লবের পর যে সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতায় এসেছে, তা অতীতের গতানুগতিক সরকারের মতো নয়। এই সরকারের শরীরে লেগে রয়েছে মানুষের রক্ত-মিশ্রিত অঙ্গীকার পালনের দায়বদ্ধতা। যার মধ্যে রয়েছে বৈষম্য রোধ করা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজের উপর অর্পিত দায়িত্বসমূহ পালনের পথে বেশ কিছু কাজ করেছে। যার ভিত্তিতে কিছু সংস্কার ও পরিবর্তন সম্ভব হবে এবং দুর্নীতি, অনিয়ম ও বৈষম্য রোধ করা সহজ হবে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের লক্ষ্যে শ্বেতপত্র প্রকাশ। যাতে এসব সেক্টরে অনিয়ম, বৈষম্য ও দুর্নীতির প্রকৃত কার্যকারণ স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। দেশের নেতৃস্থানীয় বিশেষজ্ঞদের দিয়ে প্রণীত এইসব শ্বেতপত্র বস্তুনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত দলিল স্বরূপ, যার সুপারিশের ভিত্তিতে দুর্নীতি, বৈষম্য ও অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে এবং প্রতিরোধের পথ প্রশস্ত হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্নহলো, এইসব শ্বেতপত্র প্রকাশই শেষ কথা? নাকি এগুলোর বাস্তবায়ন করাই জরুরি বিষয়? অবশ্যই এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। নচেৎ অতীতের মতো বস্তাবন্দী হয়ে এগুলো পোকার পেটে যাবে। যদি পোকা খাদ্য হয়, তাহলে এতো আয়োজন করে এগুলো প্রণয়ন ও প্রকাশ করা হলো কেন? এই প্রশ্ন জনমতে সৃষ্টি হবেই।
অতএব, জরুরি ভিত্তিতে এসবের বাস্তাবয়ন করতে হবে। কিন্তু কে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে? যে সরকার এগুলো প্রণয়ন করিয়েছে, বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদের উপরই বর্তায়। ভবিষ্যতের সরকার এসব কাজের দায় দিতেও পারে কিংবা না-ও নিতে পারে। তাছাড়া ভবিষ্যতের সরকারগুলো জুলাই বিপ্লবের রক্তরঞ্জিত চেতনা বাস্তবায়নে কতটুকু তাগিদ অনুভব করবে, সেটাও এখনই বলা সম্ভব নয়। ফলে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই এইসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।
তবে এক্ষেত্রে একটি সংশয় রয়েছে। তাহলো, বর্তমান সরকারের পক্ষে শ্বেতপত্রের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা কতটুকু সম্ভব হবে? নাকি মতলববাজ মহল এসব বাস্তবায়নে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে? এই সংশয় অমূলক নয়। কারণ, বাংলাদেশের মতো দুর্নীতি ও অনিয়মের দেশে সমস্যা চিহ্নিত করার পর সমস্যার প্রতিরোধ বা সমাধান করতে গেলে পদে পদে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হয়। এদেশে ভালো ভালো কথা ও ভালো পরিকল্পনা করা যত সহজ, সেগুলো বাস্তবায়ন করা ততই কঠিন। অতীতে বহু ভালো ও মহৎ উদ্যোগ নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানেও এমনটি হয় কিনা, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে ভীতি, সন্দেহ ও সংশয় রয়েছে।
কারণ, বাংলাদেশ বছরের পর বছর অনিয়ম, বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতকে পুষ্টি জুগিয়েছে। সমাজ ও রাজনীতিতে স্বার্থ গোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে। এইসব স্বার্থবাদী গোষ্ঠী দু্র্নীতি ও বৈষম্য প্রতিরোধের পথে কালাপাহাড়ের মতো অবরোধ সৃষ্টি করবেই। বাস্তবায়নের কাজগুলো সম্পন্ন হলে এইসব অপশক্তির স্বার্থ নষ্ট হবে। বিধায় তারা রাজনৈতিক দিক থেকে, প্রশাসনিক দিক থেকে, সামাজিক দিক থেকে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে শ্বেতপত্রের সুপারিশ বাস্তবায়ন হতে দেবে না। তারা চাইবে দুর্নীতি ও অনিয়ম থাকুক। এতে জনগণকে ঠকিয়ে তাদের পক্ষে ফায়দা হাসিল করা সহজ হবে।
কিন্তু বর্তমান সরকারকে স্বার্থগোষ্ঠীর বিরোধিতা, প্রতিবন্ধকতা ও চাপের কাছে নতি স্বীকার করলে মারাত্মক ভুল হবে। সকল বিঘ্ন ঠেলে সংস্কার বিষয়ক প্রস্তাব ও সুপারিশ তাদেরকেই বাস্তবায়ন করে যেতে হবে কিংবা বাস্তবায়নের ধারার সূচনা করে যেতে হবে। এতে দুর্নীতি ও বৈষম্যের অতীত মুছে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে। কিংবা তাদেরকে এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে হবে, যাতে শ্বেতপত্র, সংস্কার প্রতিবেদন, সুপারিশ প্রকাশই শেষ কথা না হয়, সেগুলোর বাস্তবায়নও নিশ্চিত হয়। সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশের শাসন কাঠামোতে এমন একটি পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া থাকা দরকার, যেখানে ছিদ্র-রূপী দুর্নীতি চিরতরে বন্ধ হয় এবং দেশ ও জনগণের সম্পদ বেহাত ও লুটপাট হতে না পারে।
প্রসঙ্গত, শ্বেতপত্র নিশ্চয় কোনও ঐশ্বরিক দলিল নয়। এর ভুলভ্রান্তি থাকলে সেগুলোকে সংশোধনের এবং সময় সময় আপটুডেট করার রাস্তাও খোলা রাখতে হবে। একটি চলমান পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও সুশাসনের পক্ষে শাসন ব্যবস্থার অব্যাহত গতিই হওয়া উচিত যেকোনও সংস্কার ও পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি, এই সত্যটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সরকার পরিচালনায় সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই মনে রাখতে ও পালন করতে হবে। আর এটা বর্তমান সরকারের মতো ভবিষ্যতের সরকারগুলোকেও বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হবে দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনের প্রয়োজনেই।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।
থ্রি ব্রাদারহুড এলায়েন্স ২০২৩ সালে গঠনের পর শুরু হওয়া ‘অপারেশন ১০২৭’র মাধ্যমে সমন্বিত আক্রমণ শুরুর পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ও চীন–মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চলে বেশ কিছু শহর ও সামরিক অবস্থানের পতন ঘটে। চীনের সীমান্ত অঞ্চলে চলা এই সংঘর্ষের কারণে সীমান্ত বাণিজ্যের ওপর প্রভাব পড়ে ও চীন সীমান্ত অঞ্চলে সংঘাত বন্ধের জন্য চাপ সৃষ্টি করে। মিয়ানমারের সংঘাত চীন সীমান্ত থেকে দূরে রাখাই চীনের মূল লক্ষ্য, যদিও চীন প্রাথমিকভাবে ‘অপারেশন ১০২৭’ সমর্থন করেছে বলে অনেকে মনে করে। সেসময় কোকাং অঞ্চলে মিয়ানমারের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী সাইবার কেলেঙ্কারির মাধ্যমে চীনা নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল এবং এমএনডিএএ তাদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে সংঘাত বাড়তে থাকায় চীনের মধ্যস্থতায় সহিংসতা বন্ধে থ্রি ব্রাদারহুড এলায়েন্স এবং মিয়ানমার সরকারের মধ্যে ১০ জানুয়ারি থেকে উত্তর-পূর্ব শান রাজ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী এই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে বোমাবর্ষণ করার পর ব্রাদারহুড জোটের সদস্য তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি ২৫ জুন থেকে পুনরায় সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। চলমান আক্রমনের মুখে চীন-মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সেপ্টেম্বর মাসে মিয়ানমারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল টিন অং সান চীন সফর করে ড্রোন ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে চীনের সহায়তা চায় এবং আন্তঃসীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে। এর আগে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়ার পায়ে’র চীন সফরের সময় চীন মিয়ানমারকে ৭ লাখ ডলারের সামরিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি চীন ও মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়।
চীন, মিয়ানমার সামরিক জান্তার প্রধান মিত্র এবং অস্ত্র সরবরাহকারী। চীন তার বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কাঠামোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণকারী জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির সঙ্গেও সুসম্পর্ক রাখে। জুন মাসে চীন মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চলে পুনরায় সংঘর্ষ শুরু হলে চীন যুদ্ধ বিরতির জন্য সশস্ত্র দলগুলোকে চাপে রাখে। অক্টোবরে মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি জান্তার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধের আলোচনায় রাজি হয়। ব্রাদারহুড এলায়েন্সের আরেকটি প্রধান দল তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি চীন-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে এক বছর ধরে লড়াই চালিয়ে যাবার পর চীনের সমর্থনে বিমান হামলা বন্ধের শর্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ বিরতির আলোচনার জন্য প্রস্তুত বলে জানায়।
২০২১ সাল থেকে চলমান সাড়ে তিন বছরের তীব্র সংঘাতের পর মিয়ানমার সরকার সেপ্টেম্বরে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সংঘাত বন্ধ ও শান্তি আলোচনা শুরুর আহ্বান জানায়। সশস্ত্র সংগ্রাম বাদ দিয়ে টেকসই শান্তি ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠা করাই এ সংলাপের লক্ষ্য। মিয়ানমার সরকার ২০২৫ সালে নির্বাচনের পরিকল্পনা করছে। চীন মিয়ানমারের এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জান্তার প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে। জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর প্রথমবারের মতো চীন সফরের সময় চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে এই দুই গোষ্ঠীর বিষয়ে শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে। মিয়ানমারের স্থিতিশীল অবস্থা চীনের স্বার্থরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং চীন মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন অব্যাহত রাখবে বলে জানায়। চীন মিয়ানমারে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের জন্য সহায়ক নয়।
মিয়ানমার চীনের ১ ট্রিলিয়ন ডলারের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। চীন রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিতওয়ে থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে চকপিউ গভীর সমুদ্র বন্দর এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণে এই বিনিয়োগ করছে। ১৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ চিন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের চকপিউ বন্দরকে চিনের কুনমিং শহরের সঙ্গে যুক্ত করে। অর্থনৈতিক করিডোরটি চীনকে কৌশলগতভাবে মালাক্কা প্রণালীকে এড়িয়ে ভারত মহাসাগরে সরাসরি প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। মিয়ানমারের অস্থিতিশীল সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলির ওপর দিয়ে এই প্রকল্প চলে গেছে। মিয়ানমারে চীনের কৌশলগত স্বার্থের পাশাপাশি প্রায় ২১ বিলিয়ন ইউরো সমপরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে। চীন ভারত মহাসাগরে তার কৌশলগত প্রবেশাধিকার এলাকা যুক্তরাষ্ট্র বা বাহিরের যে কোন প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে এই অঞ্চলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চায়।
ব্রাদারহুড এলায়েন্সের তৃতীয় দল আরাকান আর্মি এখনও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। রাখাইন অঞ্চলে চীনের অর্থনীতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে চীনের তেল ও গ্যাস পাইপ লাইন গিয়েছে ও চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠছে। এছাড়াও এই অঞ্চল চীনের বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে প্রবেশ পথ। চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিসিয়েটিভ বাস্তবায়নেও রাখাইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী এ পর্যন্ত চীনের কোন স্থাপনায় আঘাত করেনি। চীন তার অর্থনৈতিক বিনিয়গের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে। মিয়ানমারের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে চীনের স্বার্থ নিশ্চিতে নভেম্বর মাসে চীন ও মিয়ানমার সরকার একটি 'যৌথ নিরাপত্তা কোম্পানি' গঠনে সহযোগিতার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা যায়। চীনা মালিকানাধীন ব্যবসা এবং অবকাঠামো রক্ষার জন্য এই নিরাপত্তা কোম্পানির কর্মীরা কাজ করবে।
ভারত সরকার রাখাইনে ২০০৯ সালে শুরু হওয়া কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সিতওয়ে বন্দর, পালেতওয়া অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন টার্মিনাল, এবং পালেতওয়া-মিজোরাম মহাসড়ক এই প্রকল্পের অন্তর্গত। ভারত এই প্রকল্পে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ভারত আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত করতে আগ্রহী। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারত আরাকানে চীনের উপস্থিতি ঠেকাতে এবং ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণে চকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে আগ্রহী। নভেম্বরের শুরুতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে জাতীয় ঐক্য সরকার, আরাকান আর্মি, চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং চীন ব্রাদারহুডের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। আরাকান আর্মির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন থাকলেও তাদের এই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে বলে জানা যায়। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স এই উদ্যোগ নেয়। ভারত প্রথমবারের মত মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে শান্তি স্থাপনের বিষয়ে আলোচনা করল, যা চীন সবসময় তার স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য করে আসছিল।
রাখাইন অঞ্চলে চীনের স্বার্থ নিশ্চিত করতে এই অঞ্চলে শান্তি স্থাপন জরুরি এবং এই রাজ্যের আর্থসামাজিক উন্নয়ন দরকার। রাখাইন মিয়ানমারের অনুন্নত প্রদেশগুলোর মধ্যে একটি। এখানে উন্নয়নের দরকার এবং প্রচুর সুযোগ আছে, অথচ বছরের পর বছর ধরে এখানে সংঘাত ও জাতিগত বিদ্বেষের বিষ ছড়ানো হয়েছে। রোহিঙ্গারা এই অঞ্চল থেকে বিতাড়িত এবং এখন পর্যন্ত তাদের প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। চীনের উদ্যোগে নেয়া পাইলট প্রকল্পও সফলতার মুখ দেখছে না। রাখাইনের জনগণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্প্রীতি বাড়বে ও বিদ্বেষ কমবে। এর ফলে এই অঞ্চলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সামরিক জান্তা ও আরাকান আর্মির মধ্যে সহিংসতা বৃদ্ধির কারণে রোহিঙ্গারা রাখাইনে উভয়পক্ষের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। রাখাইনের চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে এবং বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের চলমান ত্রাণ সহায়তা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর চাপ ফেলছে। বাংলাদেশের সঙ্গে আরাকান আর্মির কোনো সমস্যা নাই। বাংলাদেশ রাখাইন পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করতে পারে। আরাকান আর্মি বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে দ্রুত সময়ে তাদের প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য সহায়তাও পেতে পারে। রাখাইনের উন্নয়নের চাকা ত্বরান্বিত করতে হলে রোহিঙ্গা রাখাইন সংঘাত বন্ধ করে সম্প্রীতি এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাড়াতে হবে। দীর্ঘ সাত বছরেও রাখাইন রোহিঙ্গা সম্পর্কে উল্লেখ করার মত অগ্রগতি হয়নি। রাখাইনের ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য আরাকান আর্মির উচিত রোহিঙ্গাদের অধিকার পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে রাখাইনের স্থানীয় নাগরিক হিসেবে তাদেরকে বৃহত্তর রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া।
আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার জান্তা উভয়ের কাছে চীনের গ্রহণযোগ্যতা সুবিদিত। তাই চীন তার নিজস্ব অর্থনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় মিয়ানমারে শান্তি স্থাপনে অগ্রণী ভুমিকা রাখতে পারে। রাখাইন মিয়ানমারের অর্থনৈতিক ভাবে অনুন্নত রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি। এই অঞ্চলে চীন ও ভারতের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। রাখাইনের জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন না হলে এই অঞ্চলে সংঘাত বন্ধ হবে না। রাখাইন অঞ্চলে চীনের পাশাপাশি বর্তমানে ভারতও তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই দুই আঞ্চলিক শক্তির পাশাপাশি এই অঞ্চলের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিও রয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে রাখাইন অঞ্চলে শক্তিধর দেশগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চেষ্টা চালিয়ে যাবে এবং এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর এর প্রভাব পড়বে। রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর চাপ পড়ছে।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সুসম্পর্ক রয়েছে। চীনের উদ্যোগে মিয়ানমার রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করলেও চলমান সংঘাতের কারণে এই উদ্যোগ থেমে যায়। রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য চীন বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারে রাখাইনদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুললে তারা রাখাইনের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে। একটা বিশেষ বিনিয়োগ পরিকল্পনার মাধ্যমে চীন বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদেরকে আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষিত করতে পারে এবং পাশাপাশি রাখাইনের জনগণকেও এই প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে পারে। এর ফলে উভয় জনগোষ্ঠী সংঘাত থেকে সরে আসবে ও জাতিগত বিদ্বেষ প্রশমিত হবে। এই প্রশিক্ষিত জনবল চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলেও কাজ করতে পারবে এবং এই উদ্যোগ থেকে চীন দীর্ঘ মেয়াদে লাভবান হবে। রাখাইনে চলমান সংঘাত ও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হলে পুরো অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এবং চীনের অর্থনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত স্বার্থ নিশ্চিত হবে।
ব্রিঃ জেঃ হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এন ডি সি, এ এফ ডব্লিউ সি, পি এস সি, এম ফিল (অবঃ) মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক