'এক চীন নীতি' ও স্পর্শকাতর তাইওয়ান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দক্ষিণপূর্ব চীনের উপকূল থেকে ১০০ মাইল দূরের দ্বীপ তাইওয়ান। ১৭ শতকে কিং রাজবংশের শাসনামলে দ্বীপটি প্রথমবারের মতো চীনের নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। ১৮৯৫ সালে জাপানের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে দ্বীপটি তাদের হাতে তুলে দেয় চীন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আবারো চীনের দখলে আসে তাইওয়ান।

চীনের জন্য তাইওয়ান অত্যন্ত স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ। কতটুকু স্পর্শকাতর, তার প্রমাণ পাওয়া যায়, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ভারতের একটি ঘটনায়। ঘটনা হলো, এই যে, তাইওয়ানের একজন মন্ত্রীর সাক্ষাৎকার প্রচার করে ভারতীয় একটি চ্যানেল। আর তাতেই ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় চীন। স্থানীয় চীনা দূতাবাসের তরফে একটি বিবৃতি দিয়ে সাক্ষাৎকারের বিরোধিতা করা হয় তৎক্ষণাৎ।

ভারতীয় মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার প্রদানকারী মন্ত্রীর নাম জোসেফ উ। তিনি তাইওয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশের জন্য ভারতীয় চ্যানেলের বিরুদ্ধে ক্ষোভপ্রকাশ করে চীন। দিল্লির চীনা দূতাবাসের তরফে একটি বিবৃতি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই সাক্ষাৎকারের বিরোধিতা করা হয়। চীনা তরফে এই মর্মে অভিযোগও করা হয় যে, প্রচারিত সাক্ষাৎকার তাইওয়ানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করছে এবং ‘ভুল তথ্য’ পরিবেশন করছে। জোসেফ ভারতীয় চ্যানেলটিকে তাইওয়ানের স্বাধীনতার প্রচারক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে বলেও দাবি চীনা দূতাবাসের।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চীনের বিবৃতির জবাব দিয়েছে তাইওয়ান। চীনা বিবৃতির জবাবে রাজধানী তাইপে থেকে জানানো হয়, ভারত এবং তাইওয়ান স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ। তাই তাদের যে কোনো সাক্ষাৎকার প্রকাশের অধিকার রয়েছে।

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ভারত ‘এক চীন নীতি’ অনুসরণ করে এবং তাইপেইয়ের সঙ্গে ভারতের কোনো সরকারি কূটনৈতিক বন্ধনও নেই।

ভারতে চীনের দূতাবাস যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ‘গত ২৯ ফেব্রুয়ারি একটি ভারতীয় টিভি চ্যানেলে তাইওয়ানের মন্ত্রীর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। এর ফলে তিনি তাইওয়ানের স্বাধীনতা প্রচার করা এবং ভুয় তথ্য দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এটি ‘এক চীন নীতি’কে লঙ্ঘন করে। এটি সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত।’

তাইওয়ানে গত বছর মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব ন্যান্সি পেলোসির সফরের পরও কঠোর মনোভার প্রকাশ করে চীন। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এমনকী কঠোর শক্তি প্রয়োগের কথাও বলেন। তবে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও পিছু হটেননি। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, তাইওয়ান আক্রান্ত হলে পাশে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র।

এইসব বিতণ্ডার মধ্যে নতুন করে 'এক চীন নীতি' ও স্পর্শকাতর তাইওয়ানের প্রসঙ্গ আবার সামনে চলে এসেছে। চীন অনুসৃত 'এক চীন নীতি’ অনুযায়ী, বিশ্বে একটি মাত্র ‘চীন’ রয়েছে। তাইওয়ান চীনেরই অঙ্গ। ‘পিপ্লস রিপাবলিক অব চীন’ চীনের একমাত্র বৈধ সরকার।

মজার ব্যাপার হলো, ভারত সরকারিভাবে এখনো এই নীতির বিরোধিতা করেনি। তবে তাইওয়ানের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক রয়েছে। আবার, মার্কিন নীতি অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র বেইজিংয়ের এই অবস্থান সমর্থন করে না। প্রকৃতপক্ষে, ওয়াশিংটনও তাইওয়ানের সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রাখে। এছাড়া, তাইওয়ান যাতে নিজেদের রক্ষা করতে পারে, সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান দ্বীপে অস্ত্র বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের নিরাপত্তার জন্য নিজেদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রেখেছে। তাইওয়ান ইস্যুতে এজন্য চীনের সঙ্গে মার্কিনিদের টানাপোড়ন রয়েছে।

উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো, স্বাধীন দেশ হিসেবে তাইওয়ানকে কোনো দেশই স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকী জাতিসংঘও নয়। চীন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ায়, ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। চীনের বিরোধিতায় তাইওয়ান জাতিসংঘের সদস্য হতে পারেনি। যদিও ১৯৭১ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে তারাই এগিয়েছিল। বৈশ্বিক করোনা মহামারি মোকাবিলায় সফল হলেও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার 'ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি'তে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকতে পারেনি তাইওয়ান। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কারণে অর্থনৈতিক জোট জি-৭ এ ক্ষেত্রে তাইওয়ানের পক্ষে ছিল।

১৯৭৯ সালে আমেরিকা মাওয়ের উত্তরসূরিদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও কুওমিনতাংয়ের প্রতি সমর্থন তুলে নেয়। আন্তর্জাতিক পরিসরে একা হতে থাকে তাইওয়ান। বর্তমানে ভাটিক্যানসহ মাত্র ১৪ দেশ তাইওয়ানের সার্বভৌম মানে। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৯ থেকে 'এক চীন' নীতি মেনে চললেও, সম্পর্ক এগিয়ে নেয় তাইওয়ানের সঙ্গেও। তাদের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও অস্ত্রের অন্যতম বড় বাজার তাইওয়ান। এটি মোটেও সহজভাবে নেয়নি বেইজিং।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের করা তাইওয়ান অ্যাক্ট অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে চীনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। একইসঙ্গে অস্ত্র বিক্রি, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগও রেখে চলছে। তাইওয়ানকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের চলছে 'কৌশলগত দ্বিচারিতা'।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে তাইওয়ানের কাছে ১৮ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে যুক্তরাষ্ট্র। তাইওয়ানে মার্কিন দূতাবাসের জন্য খরচ করা হয় ২৫০ মিলিয়ন ডলার। ১৯৭৯ সালের পর তাইওয়ানের এত ঘনিষ্ঠ আর কখনো হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। সেই সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করতে আগ্রহী বাইডেন।

অলিম্পিক গেমস এবং ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের মতো ইভেন্ট এবং প্রতিষ্ঠানগুলোতেও অংশ নেওয়ার জন্য এটি সাধারণ নামকরণের মধ্য দিয়ে যায়। কিন্তু এত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাইওয়ান একেবারেই সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে, তা কিন্তু নয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক বজায় রাখবে বলে আশা রাখে।

১৯৭৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে এক সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়। এই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ওপর যৌথ বিবৃতি ছিল এরকম:

'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকারকে চীনের একমাত্র আইনি সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই প্রেক্ষাপটে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ তাইওয়ানের জনগণের সঙ্গে সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রাখবে।'

'এক চীন নীতি' অনুযায়ী বিশ্বে কেবল একটি চীন আছে। তাইওয়ান চীনের ভূখণ্ডের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকার সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র আইনি সরকার। এটি চীনের অবস্থানগত কূটনৈতিক স্বীকৃতি, যার ফলে অন্যান্য দেশ এটা মেনে নেবে যে চীনে শুধুমাত্র একটি চীনা সরকার রয়েছে। চীনের জোর দাবি- তাইওয়ান চীনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা একদিন পুনরায় একত্রিত হবে।

এই নীতির পটভূমি সম্পর্কে জানতে ১৯৪৯ সালের চীনের গৃহযুদ্ধের সময়ের ইতিহাসে নজর দেওয়া আবশ্যক। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (People’s Republic of China – PRC) ও জাতীয়তাবাদী দল কুওমিনতাং (Republic of China – ROC)-এর মধ্যে চলা এই গৃহযুদ্ধে কুওমিনতাং পরাজিত হয় এবং তাইওয়ান দ্বীপে পালিয়ে যায়। বিজয়ী কমিউনিস্টরা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীন’ হিসেবে চীনের মূল ভূখণ্ড শাসন শুরু করে এবং সেখানে তাদের সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলে। যদিও কুওমিনতাং তাদের নিজেদের ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীন’ হিসেবে দাবি করে। তবে সমস্ত চীনের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে কমিউনিস্টরাই রাজত্ব করছে।

এই নীতি ১৯৭১ সালের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের রেজল্যুশন ২৭৫৮ দিয়ে স্পষ্টভাবে স্বীকৃত হয়েছে। ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৮১টি দেশ ‘এক চীন নীতি’র ভিত্তিতে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ‘এক চীন নীতি’ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সর্বজনীন ঐক্যমত এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি মৌলিক আদর্শ হিসেবে কাজ করছে।

শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কারণ, তারা চীনের কমিউনিস্ট সরকারকে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু ১৯৭০-এর দশক থেকে শুরু করে কূটনৈতিক সম্পর্ক পাল্টে যেতে থাকে, যখন চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ফলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ বেইজিংয়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে আর তাইপেইয়ের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক শিথিল করে। যদিও অনেক দেশই এখনো নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য বা সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাইওয়ানের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে।

'এক চীন’ নীতি বাস্তবায়ন করতে তাইওয়ানকে যেকোনো মূল্যে আয়ত্তাধীন করতে চায় বেইজিং। এই দ্বন্দ্ব অবশ্য নতুন নয়। চীন মনে করে, তাইওয়ান তাদেরই অংশ। তবে তাইওয়ান বিশ্বাসী নিজেদের স্বাধীনতায়। তাদের নিজস্ব সংবিধান আছে। তারা চীনের অংশ হতে চায় না। রক্ষা করতে চায়, নিজেদের সার্বভৌমত্ব। তাইওয়ানের নাগরিকদের মধ্যে অন্তত ৬১ ভাগই নিজেদেরকে 'তাইওয়ানিজ' পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। নিজেদের 'চীনা' মনে করেন ৩ শতাংশ মানুষ। ১৯৯৪ সালে এই হার ছিল প্রায় ২৬ শতাংশ। এ ছাড়া, সেখানকার ৩৩ শতাংশ বাসিন্দা নিজেদের চীনা ও তাইওয়ানিজ উভয়টিই মনে করেন। তাইওয়ানের স্বায়ত্তশাসন ও প্রাদেশিক সরকারের বিষয়ে চীনের আপত্তি নেই। কিন্তু, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে চায়।

চাপে রাখার কৌশল হিসেবে গত বছরের আগস্টের পর থেকে তাইওয়ানের উপকূলে বেশ কয়েকবার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে চীন। চালিয়েছে সামরিক মহড়াও। মহড়ার সময় তাইওয়ানের চারপাশ দিয়ে উড়েছে ৯১টি সামরিক উড়োজাহাজ।

বর্তমানে চীন সামরিক শক্তিতে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। সামরিক শক্তিতে চীনের তুলনায় অনেক পিছিয়ে তাইওয়ান। তবে সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে প্রতিরক্ষাখাতে তারা ব্যয় বাড়িয়ে চলেছে। এ খাতে এ বছর রেকর্ড ১৯ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে তাইওয়ান। যদিও চীনের ব্যয় এর ১২ গুণ বেশি।

তাইওয়ানকে চাপে রাখতে আরো অনেক কৌশল নিয়েছে চীন। ২০২০ সালে তাইওয়ানের ১০ সরকারি সংস্থার তথ্য ও ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে অন্তত ৬০০ ইমেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার অভিযোগ আছে চীনের বিরুদ্ধে। এমনকী, তাইওয়ানে পর্যটনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে চীন। সেখানে পর্যটকের সংখ্যা নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। চীনের চাপে তাইওয়ানের সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তিও করতে পারছে না অনেক দেশ। সিঙ্গাপুর ও নিউজিল্যান্ড ছাড়া খুব বেশি উন্নত দেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই।

তাইওয়ান ইস্যুতে চীনের আরেকটি বড় স্বার্থের জায়গা সেমিকন্ডাক্টর বা 'চিপ'। কম্পিউটার, মোবাইল, যানবাহন—কোথায় ব্যবহার হয় না এই চিপ! ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ৬০ ভাগ চিপ শুধুমাত্র তাইওয়ানেই তৈরি হয়। তাই চীন একে দখলে রাখতে পারলে এর ব্যবসা একচেটিয়াভাবে নিজেদের দখলে রাখতে পারবে৷

তবে তাইওয়ানেরও আছে নিজস্ব পরিকল্পনা। চীনের পরিচয়ে নয়, বরং সেমিকন্ডাক্টরের ব্যবসায় বিশ্বে নিজ পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় তারা। অ্যাপল ও অন্যান্য মার্কিন কোম্পানির প্রধান চিপ সরবরাহকারী তাইওয়ানের পাশে যুক্তরাষ্ট্রের দাঁড়াতে চাওয়ার পেছনে এটিও ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া, তাইওয়ানের সহায়তা নিয়ে নিজেদের দেশেও চিপের বাজার গড়ে তুলতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বস্তুতপক্ষে, তাইওয়ান কেবল চীনের জন্যই স্পর্শকাতর ইস্যু নয়, আঞ্চলিক রাজনীতি ও বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষেত্রেও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

 

   

শিল্প-সাহিত্যে সম্মাননা: ক্ষমতার আনুগত্যই ‘মানদণ্ড’ নয়



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বয়সে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের চেয়েও ৬ বছরের বড় ছিলেন ভাওয়ালের কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস। রাজ আনুকূল্য পরিত্যাগ করে রাজার বিরুদ্ধে কলম ধরার অপরাধে নির্বাসিত হয়েছিলেন কবি। ‘মগের মুলুক’ কাব্যগ্রন্থের জন্য নির্বাসিত গোবিন্দচন্দ্র দাসের জীবন কেটেছে নিদারুণ অর্থকষ্টে। বাংলা সাহিত্যকে ১০টি অমূল্য কাব্যগ্রন্থ উপহার দিলেও প্রতিভাধর এই কবির যাপিত জীবনের দুর্দশা ছিল প্রকট। শেষ জীবনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মতো মহৎপ্রাণ কিছু মানুষেরা অসুস্থ কবিকে অর্থসহায়তা দিয়ে উদাসীন সমাজের খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন। দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে ওষ্ঠাগত কবি তাঁর কবিতায় জীবদ্দশায় স্বীকৃতি না পাওয়ার আক্ষেপ ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সমাজ-রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করে কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আমি মরলে তোমরা আমার চিতায় দেবে মঠ?’

শিল্প-সাহিত্যের স্রষ্টাদের এই আক্ষেপ যুগে যুগে ধ্বনিত হয়ে আসছে। সবশেষ ঘটনাটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের গুণী শিল্পী সাদী মহম্মদের আত্মহনন। এসকল ঘটনা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে নীরবে চপেটাঘাত করে যায়। জীবদ্দশায় গুণীর কদর করতে বরাবরই ব্যর্থ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। বলা হয়ে থাকে যে সমাজে গুণীর কদর নেই, সেই সমাজে গুণীও জন্মায় না। সময়ের স্রোতে আমরা শ্রদ্ধায় নত হতে পারি, এমন গুণীজনদের ক্রমেই হারিয়ে ফেলছি। সেই শূন্যস্থান পূরণে আমাদের যোগ্য মানুষের অভাব প্রতিনিয়তই অনুভূত হচ্ছে।

ব্যক্তিত্ব ও মূল্যবোধের সঙ্গে আপস না করা মানুষের সংখ্যা দিনকে দিন কমে আসছে। বিপরীতে জায়গা করে নিচ্ছে স্তাবক ও অযোগ্য মানুষেরা। এতে করে সমাজে যে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে তা আমাদের ঐতিহ্যিক পরম্পরাকে বিপন্ন করে তুলছে। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ পদক ও পুরস্কার প্রদান নিয়ে মানুষের মনে যে নানা প্রশ্ন উঠতে দেখছি তা এই শূন্যতারই কার্যকারণ বলে মনে করেন বিজ্ঞজনরা। যেখানে নীরবে নিভৃতে বহু গুণীজন স্বীকৃতি না পাওয়ার বেদনা নিয়ে কাটান সেখানে পদক-পুরস্কার নিয়ে সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা গুণীদের হতাশাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

এমন বাস্তবতার মাঝেই গত ৩০ এপ্রিল বাংলা একাডেমি ঘোষণা করল রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার-২০২৪। যে তিন গুণীকে এবার এই পুরস্কারে ভূষিত করা হচ্ছে তাঁদের রবীন্দ্র ও নজরুল সাধনা প্রশ্নাতীত। বাঙালি জাতির আত্মঅহংকারের প্রতীক এই দুই মহান কবির নামে প্রবর্তিত এ পুরস্কার নিয়ে এবার একাডেমি সংশ্লিষ্টরা তাদের বিচার-বিবেচনাকে প্রশ্নের উর্ধ্বে নিয়ে যেতে পেরেছেন, এটা আশাবাদের সঞ্চার করেছে।

বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। বহু গবেষণাগ্রন্থের লেখক ভীষ্মদেব চৌধুরীর রবীন্দ্র গবেষণায় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে -দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫) ও প্রভাতসূর্য : রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা রবীন্দ্র অন্তঃপ্রাণ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকে তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতেও ভূমিকা রাখছেন।

বাঙালির হৃদয়স্পন্দন ও চেতনার বাতিঘর কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। নির্বাক কবিকে ঘিরে সেই সময়কার গবেষক ও সাহিত্যিকরা নানা দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং বিষয়-বৈচিত্রে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। কবির ঘনিষ্ঠজনরা তখনও জীবিত, রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে যা কিছু প্রয়োজন-তাও দুর্লভ ছিল না। তথ্যগত প্রাপ্যতার সঙ্গে গভীর নিষ্ঠা ও ভক্তি নিয়ে অনেক শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক কবিকে নানাভাবে মূল্যায়নের প্রয়াস পেয়েছেন।

বাংলা সাহিত্যের দুই যশস্বী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ও ড. রাজিয়া সুলতানা দম্পতি আত্মনিয়োগ করেন নজরুল গবেষণায়। নজরুল গবেষণায় এই গুণী দুই গবেষকের গ্রন্থসংখ্যা বিপুল না হলেও কবিকে নিয়ে যে কয়েকটি গবেষণাগ্রন্থ তাঁরা রচনা করেন তা এদেশে নজরুলচর্চায় বিশেষ ভাবে ভূমিকা রাখে। সে কারণে তাঁরা পথিকৃৎ গবেষক হিসেবেও নন্দিত হন।

মোহাম্মদ আবদুল কাইউম নজরুল গবেষণায় উপহার দেন ‘নানা প্রসঙ্গে নজরুল’ ও ‘নজরুল সংবর্ধনা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ। অন্যদিকে রাজিয়া সুলতানার গবেষণা গ্রন্থ ‘কথাশিল্পী নজরুল’ ও ‘নজরুল-অন্বেষা’। প্রকাশিত এসব গ্রন্থসম্ভারের বাইরে এই দুই নজরুল গবেষক তাদের দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে নিষ্ঠার সঙ্গে অসংখ্য নজরুল গবেষক ও অনুরাগী সৃষ্টি করেছেন; যাঁরা পরবর্তী জীবনে বাংলাদেশে নজরুল চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ও ড. রাজিয়া সুলতানা-দু’জনই কবি নজরুল ইনস্টিটিউট প্রবর্তিত ‘নজরুল পুরস্কার’ লাভ করেছেন। ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ১৯৯১ সালে লাভ করেছিলেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।

২০২০ সালের ১২ জুন প্রয়াত হন ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম। স্বামী মৃত্যুর পর ড. রাজিয়া সুলতানা প্রবাসেই কাটাচ্ছেন সন্তানদের সঙ্গে। গেল ৩০ এপ্রিল ২০২৪ বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র ও নজরুল গবেষণায় ৩ জনকে একাডেমি পুরস্কারের জন্য নাম ঘোষণা করে। নজরুল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন ড. রাজিয়া সুলতানা।

স্বজনদের থেকে জানা গেছে, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় আক্রান্ত ড. রাজিয়া সুলতানা। পুরস্কারপ্রাপ্তির খবর জেনেছেন দূরপ্রবাসে বসে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি নাকি এই খবরে ভীষণ আনন্দিত! তাঁর চোখেমুখে পরিতৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, জানিয়েছেন তাঁর মেয়েরা। এই খবর জেনে আমরা নিশ্চয়ই আনন্দিত এজন্য যে, একজন গুণী গবেষক জীবন-সায়াহ্নে হলেও তাঁর গবেষণার জন্য রাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কৃত হতে যাচ্ছেন। বাংলা একাডেমির সংশ্লিষ্টরা এজন্য অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন। কিন্তু আমরা এও প্রত্যাশা করি যে, একজন গুণী গবেষককে তাঁর গবেষণার স্বীকৃতি পেতে বার্ধক্য পর্যন্ত কেন অপেক্ষায় থাকতে হবে? একটি পুরস্কারকে উদযাপন করার মতো শারীরিক ও মানসিক স্ফূর্তি থাকতেই কেন আমরা তাদের পুরস্কৃত করতে ব্যর্থ হচ্ছি-সেই প্রশ্নও আজ বড় হয়ে ধরা দিচ্ছে।

আমরা জানি, কোন স্বীকৃতির আকাঙ্খা ব্যতিরেকেই এখনও বহু গুণীজন নিভৃতে তাদের জ্ঞান ও শিল্পসাধনায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। কিন্তু অযোগ্যদের সম্মানিত করে রাষ্ট্র যখন নিজেই অসম্মানিত হয় তখন অনেকের মতো সেইসব গুণীজনরাও নিশ্চয়ই ব্যথিত হন। এবং এই বেদনার ভার সইতে না পেরে সাদী মহম্মদের মতো প্রতিথযশা সাধকশিল্পীকেও নীরব অভিমানে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে যাঁরা চালনা করেন তাদের মনে রাখা উচিত, পুরস্কারের মনোনয়নে কেবলমাত্র ক্ষমতার আনুগত্যই একমাত্র মানদণ্ড নয়।

লেখনির মুখে সত্য উচ্চারণে যে লেখকগণ নিঃশঙ্কচিত্ত হতে পেরেছেন ইতিহাসে তাদেরই ঠাঁই হয়েছে। রাজ আনুকূল্যে ব্রিটিশ শাসনামলে পূর্ববর্তী শাসকদের যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তবাতবায়ী হাতে, সেই প্রামাণ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন’ পরবর্তী যুগে একটি ফরমায়েশি গ্রন্থরূপে সকলের কাছে প্রমাণিত হয়েছে। ইতিহাসের নির্মোহ মূল্যায়নে সেই তথাকথিত ঐতিহাসিক স্বীয় মর্যাদাকে ধরে রাখতে পারেননি। আমরা যদি এই ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে স্মরণ করে সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকে সমুন্নত রাখতে পারি, প্রকৃত গুণীদের যথাসময়ে মান দিতে পারি, তবেই দেশে অনেক জ্ঞানীর জন্ম হবে এবং আমরা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যেতে পারব। কবি গোবিন্দ দাসের মতো ‘মৃত্যুর পর চিতায় মঠ দেওয়া’ সমাজের চরিত্রকে বদলাতে পারব।

;

মে দিবস: শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য, অধিকার ও উন্নয়নের প্রতীক



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রতি বছর ১ মে বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য, অধিকার ও উন্নয়ন উদযাপন করা হয়। ২০২৪ সালে আমরা ১৩৮তম মহান মে দিবস উদযাপন করেছি। এই দিনটি শ্রমিক শ্রেণির দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের স্মরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের সময় শ্রমিকেরা অমানবিক পরিবেশে দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে বাধ্য হতেন। তাদের ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র এবং কাজের সময়সীমা দেওয়া হতো না। এই অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শ্রমিকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করেন।

১৮৮৬ সালের ১ মে, আমেরিকার শিকাগোতে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার দাবিতে শ্রমিকেরা ধর্মঘট শুরু করেন। এই ধর্মঘট পরবর্তীতে সহিংসতায় পরিণত হয়; যার ফলে অনেক শ্রমিক নিহত ও আহত হন। এই ঘটনার স্মরণে ১ মে বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে উদযাপন করা হয়।

বাংলাদেশেও মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার ও সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত, বাংলাদেশের শ্রমিকেরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য অসংখ্য আন্দোলন ও সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন।

বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। কিন্তু দেশটি চরম বৈষম্যের সম্মুখীন। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান, শ্রমিকদের শোষণ, কর্মসংস্থানের অভাব, ন্যূনতম মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব- এই সব সমস্যা শ্রমিক শ্রেণির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

এই বৈষম্যপূর্ণ পরিস্থিতিতে, মে দিবসের তাৎপর্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই দিনটি শ্রমিকদের দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের স্মরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লড়াইকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্য সুবিধা, ছুটির অধিকার- এই সব দাবি আদায়ের জন্য শ্রমিকেরা অনেকদিন ধরেই সংগ্রাম করে আসছেন।

চরম বৈষম্যযুক্ত সমাজে, শ্রমিকদের লড়াই এখনো চলমান। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, শ্রম আইন বাস্তবায়ন, শিশুশ্রম বন্ধ করা- এই সব দাবি আদায়ের জন্য শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কার্যকর শ্রম আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি- এই সব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে পারে।

শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও তাদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করার জন্য সমাজের সব স্তরের মানুষের ভূমিকা রয়েছে। শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতি ও শ্রদ্ধাশীল আচরণ, শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি। তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত এবং তাদের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করা উচিত।

শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা চালানো উচিত। এটি শ্রমিকদের তাদের অধিকার সম্পর্কে জানতে এবং তা আদায়ের জন্য পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে। শ্রমিকদের সংগঠনকে সমর্থন করা উচিত, যাতে তারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আরো শক্তিশালী হতে পারে।

‘মে দিবস’ শুধু একটি ছুটির দিন নয়, বরং এটি শ্রমিক শ্রেণির দীর্ঘদিনের লড়াই ও আত্মত্যাগের প্রতীক। চরম বৈষম্যযুক্ত সমাজে, মে দিবস শ্রমিকদের ঐক্য ও সংহতির বার্তা প্রচার করে।

এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও তাদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করার জন্য এখনো অনেক কিছু করার আছে। সরকার, নিয়োগকর্তা, শ্রমিক ও সমাজের সব স্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি ন্যায়সঙ্গত ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

মে দিবস শুধু অতীতের স্মরণ নয়, ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতিও বহন করে। এই দিন আমরা শ্রমিকদের অবদান ও সংগ্রামকে স্মরণ করি। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রত্যয় জানাই এবং আরো ন্যায়সঙ্গত ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাই।

বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব এখনো বিদ্যমান। শ্রমিকেরা তাদের চাকরি, মজুরি ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং কর্পোরেট লোভের ফলে শ্রমিক শ্রেণির ওপর নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে।

শ্রমিকদের ঐক্য হলো তাদের অধিকার আদায়ের মূলশক্তি। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন আন্দোলনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের দাবি আদায় করতে পারবে। শ্রমিকদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করার জন্য ন্যায্য মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা অপরিহার্য।

শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। কার্যকর শ্রম আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, পেনশন ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা উচিত।

শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন করা তাদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা উচিত। এছাড়াও শ্রমিকদের অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

জলবায়ু পরিবর্তন শ্রমিক শ্রেণির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পরিবেশবান্ধব শিল্প ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি শ্রমিকদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে। শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের এই নতুন সুযোগ গ্রহণে সহায়তা করা উচিত।

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও কর্পোরেট লোভ শ্রমিক শ্রেণির জন্য একটি বড় হুমকি। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও কর্পোরেট লোভের বিরুদ্ধে লড়াই করে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করা সম্ভব।

১৩৮তম মে দিবস শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য, অধিকার ও উন্নয়নের প্রতীক। এই দিনটি শ্রমিকদের দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের স্মরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায় এবং জীবন-যাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব।

মে দিবস শ্রমিকদের ঐক্য ও সংগ্রামের দিন। এই দিন আমরা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তাদের অবদানকে স্মরণ করি। শ্রমিকদের ন্যায্য কর্মপরিবেশ, মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যেতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করে আমরা একটি আরো উন্নত ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে পারবো।

এই মে দিবসকে সামনে রেখে আসুন, আমরা শ্রমিকদের ঐক্য ও সংগ্রামের মন্ত্র ধারণ করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি!

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

;

মহান মে দিবসের পরম্পরা ও বর্তমান বাংলাদেশ

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



ড. মিল্টন বিশ্বাস
ছবি: নূর এ আলম

ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

 

মহান মে দিবসের রক্তাক্ত ইতিহাস উনিশ শতকের অন্যতম ঐতিহাসিক ঘটনা। ঘটনাটি আমেরিকার শিকাগো শহরের কিন্তু পর্যায়ক্রমে তার প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বব্যাপী প্রসারিত। ইতিহাসের রেকর্ড থেকে দেখা যায়, ১৮৮৬ সালের মে মাসে শ্রমিক হত্যাকাণ্ড এবং তার প্রতিবাদে সমাবেশ ও সমাবেশে বোমা হামলা প্রভৃতি ঘটনার বিচার ও বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে সমগ্র পৃথিবীতে পরবর্তী কয়েক দশক নিন্দার তপ্ত হাওয়া বয়ে যায়। ফলে ১ মে দিনটিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। আন্দোলকারীরা হত্যা-নির্যাতনের পরও তাদের দাবি নিয়ে প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রেখেছিল। ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালের আন্তর্জাতিক দ্বিতীয় কংগ্রেস এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষিত হবার পর থেকে অনেক দেশে দিনটি শ্রমিক শ্রেণি কর্তৃক উদযাপিত হয়ে আসছে।

রাশিয়ায় এবং পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হবার পর মে দিবস এক বিশেষ তাৎপর্য অর্জন করে। জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শাখা হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের অধিকারসমূহ স্বীকৃতি লাভ করে। আইএলও কতগুলি নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠা করে এবং সকল দেশে শিল্পমালিক ও শ্রমিকদের তা মেনে চলার আহবান জানায় এবং এভাবে শ্রমিক ও মালিকদের অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। বাংলাদেশ আইএলও কর্তৃক প্রণীত নীতিমালায় স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। ১৯১৫ সালে প্রথম দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের নিয়ম জারি করা হয় উরুগুয়ে। পরে সারা বিশ্বে শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজের নিয়ম চালু হয়। মে দিবসের লড়াইয়ে আট ঘণ্টার শ্রমদিবস, মজুরি বৃদ্ধি, কাজের উন্নততর পরিবেশ ইত্যাদি দাবি ছিল- তা এখন উন্নত বিশ্বে পুরোপুরি অনুসরণ করা হচ্ছে।

২.
শ্রমিকের স্বাধীনতায় একদা বিশ্বাসী রাশিয়ার যুদ্ধংদেহি আচরণে বিশ্বের তাবৎ দেশ আজ আতঙ্ক ও দিশেহারা গ্রহের বাসিন্দা। পৃথিবীর যে শতাধিক রাষ্ট্র খুব গুরুত্বের সঙ্গে মহান মে দিবস পালন করে তারাও আজ শঙ্কিত। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই দিনটিকে লেবার ডে বা ওয়ার্কার্স ডে হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। অসংখ্য দেশে এই দিনটিতে ছুটি থাকে। মে দিবস শ্রমিকদের দাবি আদায় করার সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জনের স্মৃতিকে সম্মান দেখানোর দিন। এদিন একজন শ্রমিক উন্নততর জীবনের স্বপ্ন দেখে। কারণ মে দিবস সমগ্র বিশ্বকে বৈষম্য ও শোষণমুক্ত একটি সমাজ উপহার দিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা শ্রমজীবী মানুষের জন্য অভিশাপ বয়ে এনেছে। যুদ্ধের অভিঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য উন্নত দেশগুলোতে কল্যাণকর ব্যবস্থায় সহযোগিতা করা সম্ভব।

পক্ষান্তরে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সেই তুলনায় মেহনতি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যেমন, বাংলাদেশের ৫০ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক শহরকেন্দ্রিক (যদিও এদেশের শ্রমিকদের মাত্র ১৫ শতাংশ শহুরে-শ্রমিক হিসেবে কাজ করে), এছাড়া আছে দিন এনে দিন খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ এবং কৃষিখাতে জড়িত বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এসব স্বল্প আয়ের মানুষকে সংকট থেকে রক্ষা করা যেমন জরুরি তেমনি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য তাদের কাজে লাগানোও প্রয়োজন। তাছাড়া চিকিৎসা সেবাখাতে শ্রমজীবী নারী-পুরুষের চাহিদা করোনা সংকটে অনেক বেশি ছিল। চিকিৎসক-নার্সদের পাশাপাশি হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়, আয়া, ক্লিনার করোনা মোকাবেলায় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে। অর্থাৎ সংকটময় মুহূর্তে চিকিৎসাসেবায় শ্রমজীবী মানুষের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এদিক থেকে এবারের মে দিবস আলাদা তাৎপর্য বহন করছে। এজন্য ২০২২ সালেরও স্লোগান হওয়া দরকার- ‘বাঁচলে শ্রমিক বাঁচবে দেশ’।

৩.
বাংলাদেশের শ্রম আইনে আছে- সপ্তাহে ছয়দিন শ্রমিকরা কাজ করবে, প্রতিদিন আট ঘণ্টার বেশি নয়। দুই ঘণ্টা ওভারটাইম কাজ করানো যেতে পারে, কিন্তু কোনোক্রমেই তার বেশি নয়, অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই ১০ ঘণ্টার অতিরিক্ত একজন শ্রমিকের কর্মঘণ্টা হতে পারবে না। এই অতিরিক্ত দুই ঘণ্টার জন্য শ্রমিককে দ্বিগুণ মজুরি দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই মিল কর্তৃপক্ষ জোর করে অর্থাৎ শ্রমিকের সম্মতি ব্যতিরেকে ওভারটাইম কাজ করাতে পারবে না। শ্রমিককে জোর করে ১৬/১৮ ঘণ্টা কাজ করানো কিংবা ওভারটাইমে দ্বিগুণ মজুরি না দেওয়া অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। শ্রম আইনে আছে, কারখানার পরিবেশ স্বাস্থ্যকর ও মানবিক হতে হবে। দৈহিক নির্যাতন, গালিগালাজ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা যেন সেখানে না থাকে। শ্রম আইন লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধানও রয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা ২ কোটি ৩৩ লাখ, হোটেল রেস্তোরাঁ ও দোকানে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ৮২ লাখ, কারখানা শ্রমিকের সংখ্যা ৭৫ লাখ। এর মধ্যে ৫০ লাখ শ্রমিক পোশাক কারখানায় কাজ করে। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে বেশ কয়েকটি জেলায় শিশু শ্রমিকদেরও দেখা মেলে। এছাড়া সড়ক ও জনপথ, নির্মাণ, বস্ত্র (সূতা তৈরি ও বুনন), ট্যানারি, জাহাজ ভাঙা, পোল্ট্রি ও চিংড়ি (প্রক্রিয়াজাতকরণ), চাতাল (ধান কল), কৃষি ও মৎস্যখাতে শ্রমিক আছে। সেবা খাতে দোকান-শ্রমিক এবং যানবাহন মেরামত কারখানার শ্রমিকরাও গুরুত্বপূর্ণ। নির্মাণখাতের পাথর উত্তোলন ও পাথর ভাঙার এবং ইট ভাটার শ্রমিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এদেশে মানবেতর পরিবেশে বহু নারীশ্রমিক কাজ করে। মাটি কাটা ও ইট ভাঙার কাজে, চাতাল ও মাছ প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে এসব নারীদের দেখা যায়। আবার প্রবাসী নারী শ্রমিকদের এদেশের রেমিট্যান্সে অবদানও স্বীকৃত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি নারী শ্রমিক গেছে ১০টি দেশে; প্রায় ৯ লাখ নারী শ্রমিক আছে সেসব দেশে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটি তথ্য মতে ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া নারী শ্রমিকের সংখ্যা হলো- সৌদি আরব- তিন লাখ ৩২ হাজার ২০৪ জন, জর্ডান- এক লাখ ৫৫ হাজার ৪১১, সংযুক্ত আরব আমিরাত- এক লাখ ৩০ হাজার ৫৭১, লেবানন- এক লাখ ছয় হাজার ৮৪০, ওমান- ৮৬ হাজার ১৩২, কাতার- ৩২ হাজার ২৫৯, মরিশাস- ১৭ হাজার ৯২৩, কুয়েত- নয় হাজার ১৯, মালয়েশিয়া- ছয় হাজার ৬৩৮ এবং বাহরাইনে চার হাজার ২৯০ জন নারী শ্রমিক। বাংলাদেশে সব মিলে ৬ কোটি শ্রমিক আছে। এসব শ্রমিকদের প্রধান সমস্যা নিপীড়ন, নিখোঁজ ও দুর্ঘটনায় মৃত্যু। সমুদ্র মৎস্যখাতে শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি নিখোঁজ হয়। দুর্ঘটনার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, ভবন ধসের ঘটনা, উপর থেকে পড়ে যাওয়া, বজ্রপাত, অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু হয়ে থাকে প্রতিবছর। অন্যদিকে তৈরি পোশাক খাতে ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ১১ বছরে প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক নিহত হয়েছে। তবে ২০১৮ থেকে শ্রমিকদের অপমৃত্যু বহুলাংশে কমে এসেছে। লেখাবাহুল্য, মৃত শ্রমিকদের পরিবার ও সন্তানরা অসহায় হয়ে পড়ে, তাদের দেখার কেউ থাকে না। তারা বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে পারে না।

৪. গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি যে পর্যায়ে উত্তীর্ণ করা হয়েছে তাকে সন্তোষজনক না বললেও আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে । আওয়ামী লীগ সরকারের চেষ্টায় শিশুশ্রম নিষিদ্ধ ও শ্রম আইন বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে পোশাক শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি এবং কৃষি শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করার ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য কাজ। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ইতোমধ্যে জেনেছে যে, বাংলাদেশ শ্রম আইন ও ইপিজেড আইন সামঞ্জস্যপূর্ণ, এখানে সংগঠন করতে শ্রমিকদের বাধা দেওয়া হয় না, দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ছাঁটাই ও পুলিশি হয়রানি এখানে অনুপস্থিত। উপরন্তু শ্রমমান পরিদর্শনে (ইন্সপেকশন) যথার্থ বিধান রয়েছে। মূলত অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্সসহ অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতকল্পে বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ শ্রমমান এবং শ্রমিকদের সুরক্ষায় সচেতনতা বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় সংকটের সমাধান হচ্ছে ধীর গতিতে। এজন্য সব খাতের দিকে নজর দেওয়া দরকার।

অবশ্য ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর শেখ হাসিনা সরকারের উদ্যোগে পোশাক কারখানাগুলোর পরিবেশে যে পরিবর্তন এসেছে তা বেশ স্পষ্ট সেখানে কর্মরত শ্রমিকের কাছেও। আগে গার্মেন্টসগুলোতে দুর্যোগ মোকাবেলায় ট্রেনিং হতো না। এখন বেশ কিছু কারখানায় বছরে একাধিক ট্রেনিং হচ্ছে। আগুন লাগলে কী করতে হবে, কখনোবা অন্যান্য করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে মালিক পক্ষ। বেতন-বোনাস নিয়েও আগের মতো ‘টালবাহানা’নেই। শ্রমিকদের কোনো সমস্যা হলে এখন ম্যানেজমেন্টের কাছে অভিযোগও করা যায়। আসলে বিদেশি ক্রেতাদের দুটি জোট অ্যাকর্ড ও এলায়েন্সের চাহিদা মেনে ফায়ার সেফটি, ইলেক্ট্র্রিক্যাল সেফটি, বিল্ডিং সেফটি সবকিছু নতুন করে আধুনিক পদ্ধতি মেনে পোশাক-কারখানা সচল রাখতে হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং অন্যান্যদের রচনার সূত্রে দেখা যায়, ১৯৭১ এর আগে পাকিস্তান আমলে পাটকল, বস্ত্রকল ও চিনিকলে শ্রমিকদের পদচারণায় মুখরিত ছিল। এসব বড় বড় শিল্প কারখানা স্বাধীনতার পরে লাভের মুখ না দেখতে পারলেও এদেশে ছোট ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যাপকহারে। গার্মেন্টেসের পাশে এই নতুন কলকারখানার শ্রমিকরা শ্রমবাজারে নতুন। আর সব মিলে নারীশ্রমিকের সংখ্যা এখন অনেক। কিন্তু পোশাক কারখানাকে ঘিরে কোনো শ্রমিক কলোনি গড়ে উঠে নি। যেমন জুট মিল কিংবা টেক্সটাইল মিলকে ঘিরে অতীতে কলোনি থাকত। শ্রমিকরা এখন বাস করে শহরের বস্তিতে, কারখানা সংলগ্ন অনুন্নত জায়গায়। অথচ একসময় পাট ও বস্ত্র শিল্পের শ্রমিকদের জন্য থাকার কলোনি, চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদির ব্যবস্থা ছিল। তবে শ্রমিকের ঘর ভাড়া, ওষুধ ও চিকিৎসা খরচ, নূন্যপক্ষে চারজনের এক পরিবারের জন্য মাসিক ৮ হাজার টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে।
৫.
১ মে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে মেহনতি মানুষের জেগে ওঠার দিন। অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাবি আদায়ের লড়াইয়ের দিন। এটি ঐক্যের দিনও- সকল শ্রমজীবী মানুষ তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করার মাধ্যমে উন্নয়নমুখী কাজের জয়যাত্রাকে এগিয়ে নেবার শপথ ঘোষণার দিন এটি। ১ মে থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ভবিষ্যতে সকল ন্যায্য দাবি আদায়ের মাধ্যমে শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস। করোনাশূন্য-বিশ্বে শিল্প-কারখানার কর্মপরিবেশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা বজায় থাকলে কৃষি ও রপ্তানি খাতে শ্রমজীবী মানুষের অবদান হবে স্মরণীয়।

লেখক : অধ্যাপক,বাংলা বিভাগ; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল:[email protected]

;

শ্রমিক কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



ড. আতিউর রহমান
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

শ্রমিক কল্যাণ নিয়ে এই আলোচনাটি এমন একটি সময়ে তুলছি যখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি দানা বেধেছে। প্রথমে করোনাজনিত অর্থনৈতিক অচলাবস্থা এবং তার ওপর রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ও অন্যান্য ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি নিঃসন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষত বাইরের এই সঙ্কটগুলোর কারণে আমাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত সঙ্কটগুলোও নতুন করে প্রকট হয়ে ধরা দেয়ায় সম্ভবত বিগত ১০-১৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম এতো বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

বলা বাহুল্য যে এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও যে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি মোটামুটি ছয় শতাংশের আশেপাশেই প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে এর পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখে চলেছে আমাদের প্রবাসী আয়ের প্রবাহ, আমাদের কৃষি উৎপাদন এবং সর্বোপরি আমাদের রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো। এই প্রেক্ষাপটে তাই শ্রমিক কল্যাণ নিয়ে ভাবনা ও আলোচনা বিশেষ প্রাসঙ্গিক। কারণ আপতকালিন সময়ে শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ করা গেলেই সঙ্কট উত্তরণে আমাদের শ্রমঘন শিল্প খাত থেকে প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক সুফল পাওয়া সম্ভব। দিনশেষে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শিল্পেই। সেই পথেই বাংলাদেশ এখন হাঁটছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো-সহ মেগা প্রকল্পগুলো পুরোপুরি চালু হয়ে গেলে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি আরও গতিময় হবে। আর সেই সুবাদে শ্রমিকের কর্মসংস্থান ও সুযোগ-সুবিধেও বাড়বে।

স্বল্পমেয়াদে এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে তো বটেই এমন কি দীর্ঘতর মেয়াদে শ্রমিকবান্ধব অর্থনৈতিক বিকাশের পথ-নকশা তৈরির ক্ষেত্রেও শ্রমিক কল্যাণ বিষয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর এ বিষয়ক দর্শন ও চর্চাগুলো আমাদের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমরা সচরাচর যে সমস্ত দেশকে উন্নত হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি তাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে বাংলাদেশের মতো যে সমস্ত স্বল্পোন্নত দেশে দ্রুত সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিকাশের পথে এগিয়েছে তাদের বাস্তবতার বিশেষ ফারাক রয়েছে। এই পার্থক্যের বিষয়ে সচেতন না থাকলে শ্রমিক কল্যাণের নামে এমন নীতি প্রণিত হতে পারে যাতে করে স্বল্পোন্নত অর্থনীতিতে শিল্পের বিকাশই বাধাগ্রস্ত হবে। আর তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে শ্রমিকদেরই।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা লগ্নেই এ বিষয়ে নীতি-সংবেদনশীলতা দেখা যায়। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর মতে শ্রমিক স্বার্থ বিষয়ে উন্নত দেশগুলোর স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ না করে নিজস্ব বাস্তবতার বিষয়ে সচেতন থেকে বাংলাদেশের শ্রমনীতি প্রণিত হওয়ায় আমাদের শিল্প খাতের বিকাশ সহজতর হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতের ১৯৪৭ সালের ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্ট’-এ শ্রমিক নিয়োগ বিষয়ে ব্যাপক কড়াকড়ি ছিল। ভারত এই আইনটি নিয়েই স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। অন্যদিকে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে যখন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এ দেশে যাত্রা শুরু করে ঐ আইনটি ছাড়াই। ফলে বাংলাদেশের শিল্পোদ্যাক্তারা সহজেই বেশি সংখ্যক সস্তা শ্রমিককে নিয়োজিত করতে পেরেছিলেন। এতে একদিকে কম মূল্যে বিশ্ব বাজারে পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে বেশি সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগ দেয়ার ফলে কর্মসংস্থান বেড়েছে এবং অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সুফল বেশি বেশি বণ্টন করা সম্ভব হয়েছে।

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর শ্রম আইনের কড়াকড়ি সঙ্গত কারণেই বঙ্গবন্ধু অনুসরণ করেননি। কেননা সে সময় সদ্য-স্বাধীন দেশে ঐ অর্থে উদ্যোক্তা শ্রেণীই ছিল না। এমন কড়াকাড়ি আরোপ করলে নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণীর বিকাশই বন্ধ হয়ে যেতো। তবে স্বাধীন দেশের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু ঠিকই শ্রমিকের কল্যাণ ও স্বার্থের যথাযথ অগ্রাধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তির কথা বলা হয়েছে: “রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশ সমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা”। ১৫ (খ) অনুচ্ছেদে কর্ম ও মজুরির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে: “কর্মের অধিকার অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসংগত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার; যুক্তিসংগত বিশ্রাম বিনোদন ও অবকাশের অধিকার।” ৩৪ অনুচ্ছেদে জবরদস্তি- শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে: “সকল প্রকার জবরদস্তি শ্রম; এবং এই বিধান কোনোভাবে লংঘিত হইলে আইনত; দণ্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে।” বঙ্গবন্ধু নিখাদ আন্তরিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকারের বিষয় অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

সংবিধানে শ্রমিক অধিকারের এহেন স্বীকৃতি ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে ছিলো বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা সে সময় দেশীয় উদ্যোক্তা শ্রেণীর অনুপস্থিতির কারণে বড় শিল্পগুলো ছিলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন ঐ সব কারখানায় পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা নিঃসন্দেহে সংবিধানের নির্দেশনা মেনে চলার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানাধীন কারখানার পরিচালকদের চেয়ে বেশি তৎপর হবেন- এমনটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানার কারখানার প্রতি শ্রমিকদের দায়িত্বশীলতাও বেশি হবে, কেননা তারাও এক অর্থে এই কারখানার মালিক।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজেই ১৯৭২-এর ১৯ জুলাই আদমজীনগরে শ্রমিক সমাবেশে বলেছিলেন- “ ... ফ্যাক্টরি এখন আর আদমজী নাই, ফ্যাক্টরি এখন আর বাওয়ানীর নাই, ফ্যাক্টরি এখন আর দাউদের নাই, ফ্যাক্টরি এখন হয়েছে সাড়ে সাত কোটি লোকের সম্পত্তি। ... আপনারা প্রোডাকশন বাড়াবেন, আপনারাও খাবেন আর ঐ যে গরীব কৃষক, যাদের টাকায় এই কল-কারখানা গড়ে উঠে। তারাও এ টাকার ভাগ পাবে ...।”

শ্রমিক কল্যাণ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে আরও ভালোভাবে বুঝতে ফিরে যেতে হবে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের সময়ে। একেবারে যে সময় বঙ্গবন্ধু একজন তরুণ রাজনীতিকি সে সময়টায়। ঐ সময়ে শ্রমিক স্বার্থ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাগুলো সবেচেয়ে স্পষ্ট প্রতিফলন পাওয়া যায় তাঁর ১৯৫২ সালে চীন সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থটিতে। গণমুখী রাষ্ট্রে কৃষক আর শ্রমিকের স্বার্থই যে মূখ্যতম অগ্রাধিকারের বিষয় হওয়া উচিৎ ছিলো তরুণ বঙ্গবন্ধু সে বিষয়ে সদাসচেতন ছিলেন। তাই তরুণ বয়সে গণচীন সফরে গিয়ে নানকিংয়ের কৃষি ফার্মের মতোই আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করেছিলেন সাংহাইতে অবস্থিত বৃহৎ কাপড়ের কলের ব্যবস্থাপনা।

প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে তাঁরা এই কলটি পরিদর্শন করেছিলেন। কমিউনিস্ট দেশেও মিলটি একটি কোম্পানি হিসেবে পরিচালিত হচ্ছিল। একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক তা চালাচ্ছিলেন। তার মানে চীনে সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় নি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মিলেই মিলটি চালাচ্ছিলেন। মিলগুলো জাতীয়করণ না করেও এমন ব্যবস্থা করা হয়েছিল যে সকল পক্ষই লাভবান হতে পারেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন- “সরকারকে হিসাব দাখিল করতে হয়। যে টাকা আয় হবে তা শ্রমিকদের বেতন, তাদের বাসস্থানের বন্দোবস্ত, চিকিৎসার জন্য ব্যয় করতে হবে। আর যা বাঁচবে তা দিয়ে মিলের উন্নতি করতে হবে। আর যারা মালিক তাদের লভ্যাংশের কিছু অংশ দেয়া হয়।” তিনি আরও সন্তুষ্ট হয়েছিলেন এই দেশে যে মেয়ে শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্য শিশু যত্ন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। যুবক শ্রমিকরা কয়েকজনে মিলে বাড়িতে বাস করার সুযোগ পেয়েছেন। শ্রমিকদের জন্য আলাদা হাসপাতালের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা স্কুলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সফর শেষে শ্রমিক ও মালিকদের পক্ষ থেকে তাদের সংবর্ধনা দেয়া হয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি উভয়ে বলেন, “আমরা শ্রমিক ও মালিক পাশাপাশি দেশের কাজ করছি। মিলটা শুধু মালিকের নয়, শ্রমিকের ও জনসাধারণেরও। আজ আর আমাদের মধ্যে কোনো গোলমাল নাই। আমরা উভয়েই লভ্যাংশ ভাগ করে নেই। শ্রমিকের স্বার্থও আজ রক্ষা হয়েছে, মালিকের স্বার্থও রক্ষা হয়েছে।” (আমার দেখা নয়াচীন, পৃষ্ঠা ৭০)।
তরুণ বয়সে বিপ্লবোত্তর চীনে শ্রমিকদের ক্ষমতায়িত করার কৌশলগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভবিষ্যতে নিজে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলে শ্রমিক কল্যাণে কি করবেন তার পথ-নকশাই হয়তো সে সময় তিনি দাঁড় করাচ্ছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তি কালে বৃহৎ শিল্প যখন রাষ্ট্রীয়করণ করেছিলেন তখন কারখানা ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তাঁর নেয়া উদ্যোগগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে এমনটিই মনে হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই ১৯৭৩-এ আদমজীনগরের ভাষণে (আগে উল্লিখিত) বক্তৃতায় বলেছিলেন- “প্রত্যেকটা কল-কারখানা আপনাদেরই (শ্রমিকদেরই) করতে হবে। সেভাবেই ম্যানেজমেন্ট বোর্ড হবে।

সরকারের থাকবে, কর্পোরেশনের থাকবে আর শ্রমিকদের প্রতিনিধি থাকবে ... আপনারা শ্রমিকরা ভোট দিয়ে পাশ করে দিবেন, দুইজন আপনার, একজন ব্যাংকের, একজন গভর্নমেন্টের, একজন হলো আপনার জুট কর্পোরেশনের। পাঁচজনে বসে কল-কারখানা চালাবেন। ... আপনাদের কলে যা আয় হবে, তার একটা অংশ আপনাদের শ্রমিকদের জন্য ব্যয় হবে, আরেক অংশ জনগণের জন্য ব্যয় হবে। সরকারের কাছে যাবে।” শ্রমিকদের কল্যাণের ভার এভাবেই তিনি শ্রমিক প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। রাষ্ট্রের হাতে রেখেছিলেন শ্রমিকদের ক্ষমতায়িত হওয়ার পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব। বাংলাদেশের তখনকার বাস্তবতায় এই পদ্ধতিটি সত্যিই সময়োপযোগি ছিল।

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিতেও এই ধারাবাহিকতা তিনি রক্ষা করেছিলেন। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কার্যক্রমকে বেগবান এবং অংশগ্রহণমূলক করতে সে সময় সকল মহকুমাকে ডিস্ট্রিক্ট-এ রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর প্রতিটি থানার সার্বিক তদারকির জন্য একটি করে ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাবনা ছিল তাঁর। আর সেই কাউন্সিলে আলাদা করে শ্রমিকদের প্রতিনিধি রাখার পরিকল্পনা দিয়েছিলেন তিনি, যাতে করে থানাভিত্তিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াতেও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হতো।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) কমিটিতে তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- “এক বছরের মধ্যে থানা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল করতে হবে। সেখানে বাকশালের রিপ্রেজেন্টেটিভ থাকবে, কৃষকদের রিপ্রেজেন্টেটিভ থাকবে, শ্রমিকদের থাকবে, যুবকদের থাকবে, মহিলাদের থাকবে।” অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনায় আলাদাভাবে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার এই প্রচেষ্ট থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পরিক্রমায় অংশীজন হিসেবে শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যে একান্ত জরুরি সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশেষ সংবেদনশীল।

নীতি-নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ ও তাদের বৃহত্তর কল্যাণ নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণগুলো বিষয়েও বঙ্গবন্ধু বিশেষ সচেতন ছিলেন। কখনো ধর্ম, কখনো জাতীয়তা, কখনো কে কোন জেলা থেকে আগত- ইত্যাদি ইস্যু তুলে শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার মাধ্যমে শ্রমিক কল্যাণ প্রায়শই ব্যাহত হয়েছে পাকিস্তান শাসনামলে। আর শ্রমিকদের মধ্যে এই বিভেদ বিরাজ করলে জাতীয় রাজনীতিতে বিশেষ শক্তি হিসেবে শ্রমিকদের অংশগ্রহণও বাধাগ্রস্ত হয়। পূর্ব বাংলার শ্রমিকরা যেন জাতীয় রাজনৈতিক অধিকারের আন্দোলনে কার্যকর শক্তি হিসেবে সামনে আসতে না পারে সে জন্য পাকিস্তানী অপশাসকরা প্রায়শই এ দেশের শ্রমিকদের মধ্যে এ ধরনের বিভেদ তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।

১৯৫৪-তে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ঐক্যজোট যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক নির্বাচনে জয়ী হয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করার পরপরই তাই আদমজীতে শ্রমিকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির পায়তারা দেখা গিয়েছিলো। সে সময় বঙ্গবন্ধু কনিষ্ঠতম মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। নির্বাচনে জয় কিংবা মন্ত্রীত্ব পাওয়া উদযাপনের পরিবর্তে শপথ নিয়েই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন ঐ দাঙ্গা নিরসন করতে। স্বাধীনতা উত্তর কালেও এহেন বিভেদ বৃহত্তর শ্রমিক কল্যাণ ও জাতীয় অগ্রগতির পথে হুমকি তৈরি করতে পারে- এমন আশঙ্কা বঙ্গবন্ধুর ছিলো। তাই বার বার শ্রমিকদের বিভেদের রাজনীতি থেকে বিরত থাকার উদাত্ত আহ্বান তিনি জানিয়েছেন।

আগেই আদমজীনগরে শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে তাঁর দেয়া যে ঐতিহাসিক ভাষণের কথা উল্লেখ করেছি সেখানেও এ বিষয়টি তিনি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন- “আদমীজতে রক্ত আমি দেখেছি, ১৯৫৪ সালের রক্ত আমি দেখেছি। মন্ত্রী হয়েছিলাম, শপথ নিয়েছিলাম, মন্ত্রীর দ্বার থেকে সোজা আমি ’৫৪ সালে এই পথে দৌড়াইয়া আদমজীতে আসার চেষ্ট করি। তখন তোমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। ... মন্ত্রী হয়ে আদমজীতে এসেছিলাম, সে জন্য মন্ত্রিত্ব ডিসমিস করে সমস্ত মন্ত্রী থেকে বাদ দিয়ে আমাকে জেলে নিয়েছিল। ... যদি আমার শ্রমিক ভাইদের মধ্যে আজকে (স্বাধীন বাংলাদেশে) এই কথা হয়- ওমুক নোয়াখালীরে, ওমক ঢাকার, ওমক কুমিল্লার, ওমক ফরিদপুরের- এর আগে কি আমার মৃত্যু ভালো ছিল না? বলেন আপনারা ওয়াদা করতে হবে যে, আমরা এক, আমরা বাঙালী ...।”

বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আজও শ্রমিকদেরকে ঐক্যবদ্ধ রাখা একই রকম জরুরি। এখনও দেশ-বিরোধী চক্র শ্রমিকদের বিপথগামী করে তথাকথিত শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষূণ্ন করতে তৎপর হতে পারে। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ অনুসরণ করা একান্ত জরুরি। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির ভিত্তিকে মজবুত করতে শ্রমিকরা যে ভূমিকা রাখছেন তার স্বীকৃতি বার বার দিতে হবে। একই সঙ্গে কোন স্বার্থান্বেষী মহল যেন শ্রমিকদের ব্যবহার করে আমাদের অর্জনগুলো ধুলিস্মাত করতে না পারে তার জন্য শ্রমিকদের সচেতন করে তুলতে হবে।

আশার কথা ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হারানোর পর বহু ত্যাগের বিনিময়ে হলেও দেশ আবার বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই ফিরেছে। এই নতুন অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শ্রমিক কল্যাণকে তিনিও একই রকম অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছেন। চ্যালেঞ্জিং সময়েও তাই জাতীয় মজুরি কমিশনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো হচ্ছে (সর্বশেষ বেড়েছে গত বছর)।

বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে শ্রমিক স্বার্থের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অর্জন অবশ্য এসেছে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে। ইতোমধ্যে বিশ্বের শীর্ষ পরিবেশবান্ধব আরএমজি কারখানাগুলোর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক (২০৯টি) বাংলাদেশি হওয়ায় এক্ষেত্রে যে বাংলাদেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে তা বলাই যায়। আরও বিপুল সংখ্যক কারখানা এখন সবুজ হওয়ার পথে । বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সবুজ অর্থায়নের কৌশল গ্রহণ করে এই সবুজ রূপান্তরকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। শোভন কর্মসংস্থানের বিষয়টি এখন গুরুত্ব পাচ্ছে।

আশার কথা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে সবুজ কারখানার সংখ্যা বাড়ছে বলেই শোভন কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়ছে। রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর আমাদের আরএমজি খাত নিয়ে অনেকেই শঙ্কায় পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সকল অংশীজনে মিলে কমপ্লায়েন্ট কারখানার পরিবেশ উন্নয়নে মনোযোগ দেয়ায় সেই আশঙ্কা সত্য হয়নি। বরং কাজের পরিবেশ উন্নত করার সুবাদে আমাদের সুনাম বেড়েছে।

বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়িত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কারখানার লভ্যাংশ শ্রমিক কল্যাণে ব্যয়ের পরিকল্পনা সে সময়কার শ্রমিক প্রতিনিধিরা করতে পারছিলেন। আজ রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা হাতে গোণা। শিল্প মূলত ব্যক্তি খাত নির্ভর। তবে ব্যক্তি খাতের দেয়া কর থেকে সরকারের যে আয় হয় তার একটি অংশ শ্রমিক পরিবারগুলোর কল্যাণে বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নিশ্চয় ব্যয় করা যায়। ফলে আজকের পরিবর্তিত বাস্তবতাতেও বঙ্গবন্ধুর দর্শন বাস্তবায়িত করা খুবই সম্ভব। শ্রমিকদের ক্ষমতায়িত করতে কেবল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি-কেন্দ্রিক ভাবনাই ভাবতে হবে এমন নয়।

আজও আমাদের দেশের অধিকাংশ শ্রমিকই অদক্ষ। শিল্প খাতের আধুনিকায়ন (অটোমেশন), আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তি প্রতিযোগিতা, এবং সর্বোপরি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে অদক্ষ শ্রমিকেরা বাড়তি ঝুঁকিতে রয়েছেন। তাদেরকে দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ করে দেয়ার মাধ্যমেও তাদের ক্ষমতায়ন করা সম্ভব। এভাবে বঙ্গবন্ধুর শ্রমিক কল্যাণের দর্শনের মূল সুরটি ঠিক রেখে পরিবর্তিত বাস্তবতার উপযোগি করে নতুন করে শ্রমিক কল্যাণের পথ-নকশাই আমাদের দাঁড় করাতে হবে।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

;