বন্ধ হোক কালো হাতের হাতছানি



নিনি ওয়াহেদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, ততই দেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। চারিধারে লু হাওয়া বইছে। প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়েই চলছে রাজনীতির মাঠের উত্তাপ। কোনদিকে উত্তাপ বেশি, আর কোনদিকে কম, তা নির্ণয়ে কোন পরিমাপক যন্ত্র নেই বলে নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, তবে তা যে অনুভূত হচ্ছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে একদিকে বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে এবং শক্তি জোরদারে ব্যস্ত। তবে গোল বেঁধেছে দেশে প্রধান বিরোধীদলের বিএনপি’র এক দফা দাবিকে কেন্দ্র করে।

বিএনপি’র একদফা দাবি সরকারের পদত্যাগ, বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। বিএনপি’র এই একদফা দাবি যেমন সাম্প্রতিক, অন্যদিকে পশ্চিমা দুনিয়ার বৃহৎ শক্তিধরদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের ইঙ্গিতবাহী প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে সেতুবন্ধনের প্রভাবে তা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে একই সময়ে।

বিদেশিদের ক্রমাগত দৌড়ঝাঁপ সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। (এ বিষয়ে আমি বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রাখি)। আজ যে বিষয়টি নিয়ে আমার এ লেখা তাহলো দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, নির্বাচন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ করা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। আর তা সকলের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা। এ প্রসঙ্গে বিএনপির অতীত ও বর্তমান ভূমিকা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।

এ ক্ষেত্রে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলগুলোর যে বিভাজন তা বাংলাদেশে গত ’৫২ বছর ধরে বিরাজমান, বলা চলে গোটা দেশই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং বিপক্ষে বিভক্ত যা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও শংকার জন্ম দিয়ে চলেছে।

সবচাইতে কঠিন ও দুঃখজনক সত্য হচ্ছে দেশের প্রধান বিরোধীদল হিসেবে পরিচিত বিএনপিই দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান এবং ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদানের ইতিহাসকেই আমলে নেয় না, বিশ্বাস করে না। উল্টো ইতিহাস বিকৃতির এক অপসংস্কৃতিকে সুকৌশলে জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত। একথা বলা চলে সরাসরি।

তারই ধারাবাহিকতায়, বিএনপি, স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার, স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার মধ্যে দিয়ে বাঙালির জাতিসত্তা, ইতিহাস, ভাষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য বাঙালি ২৩ বছরের রক্তক্ষয়ী লড়াই, সংগ্রাম ও মুক্তির সনদকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলে নতুন এক অসত্য ইতিহাস রচনার লক্ষ্যে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার জন্য দায়ী আলবদর, আলশামস ও রাজাকারদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেন।

এই জিয়াউর রহমানই পাক বাহিনীর দোসর জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দেন। ৭২ সালে বঙ্গবন্ধু তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, গণহত্যার নির্দেশক ও জামায়াতের প্রধান গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে সসম্মানে বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনেন।

যে দলের প্রতিষ্ঠাতা ক্ষমতায় আসেন ক্যু’র মাধ্যমে, যিনি সেনা ছাউনি থেকে দল গঠন করেন, যিনি হ্যাঁ এবং না সূচক ভোট করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যিনি রাজাকারদের পুনর্বাসন করেন, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি বিল পাশ করান- সেই দলের নেতাদের মুখেই গণতন্ত্রের জন্য মায়া কান্না। হায় সেলুকাস এ পৃথিবী।

পরবর্তীতে বিএনপির হাল ধরেন খালেদা জিয়া, তিনিও স্বামীর অনুসৃত পথে হাঁটেন। তবে আরও এক ধাপ এগিয়ে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভোট চুরি, ২০০৪ সালে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে বোমা তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে বোমা মেরে হত্যা চেষ্টার ঘৃণ্য নজির সৃষ্টি, ২০০৭ সালে ভূয়া ভোটার তালিকা তৈরি ও বিচারপতিদের বয়সে হেরফের ঘটিয়ে ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হওয়ার নির্বাচন করার প্রস্তুতি, খুনিকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত করা, মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার তালিকা প্রণয়নকারীদের দুই শীর্ষ নেতা যুদ্ধাপরাধী আল মুজাহিদী ও মতিউর রহমান নিজামীকে মন্ত্রীসভার সদস্য করা, বাংলাদেশের পবিত্র জাতীয় পতাকা তাদের গাড়িতে তুলে দেয়ার মত বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করেছেন খালেদা জিয়া দেশ ও জাতির সঙ্গে। তিনি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন।

অথচ তার দলের নেতারাই আজ গণতন্ত্র, মানবাধিকার আর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু করেছে। এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কী হতে পারে? আর সেই সঙ্গে নেতারা বিশ্ব দরবারে ঘুরপাক খাচ্ছেন ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার নেশায়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়া তাদের ওই অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের এই সুযোগে বিএনপিকে নিয়ে শুরু করেছে ষড়যন্ত্রের বিশাল কর্মযজ্ঞ।

ইদানিং অনেক বিশিষ্টজনের লেখা পড়ছি পত্রপত্রিকায় যার শিরোনামগুলোই সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। শিরোনাম পড়লেই মনে হয় বাংলাদেশ রসাতলে যাচ্ছে বা চলে গেছে, সর্বকালের অনিরাপদ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, বাংলাদেশ কার?, কার হাতে আছে এবং কার হাতে যাওয়া দরকার, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

অন্যদিকে কিছু কিছু পত্রিকা আছে তা পড়লে যে কোন মানুষের মনে হতে বাধ্য, যে এই সরকারের আমলে একটিও ভালো কাজ হয়নি। হওয়া সম্ভবই না।

ভালো তো দূরের কথা, কোন একটি কাজ বা ঘটনা শুরু হতে না হতেই তার ভবিষ্যৎ নিয়ে নেতিবাচক গবেষণার কাজ তারা সম্পন্ন করে ফেলেন অতি দ্রুত গতিতে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ২০২০ সালে যখন বিশ্ব জুড়ে ভয়াবহ করোনা আঘাত হানে তখন তাদের গবেষণার ফলাফল এমন দাঁড়িয়েছিল যে বাংলাদেশের পথে ঘাটে শুধু লাশ আর লাশ পড়ে থাকবে। এই সরকারের মন্দ যত কিছু আছে তুলে এনে জনসম্মুখে প্রকাশ করা এবং সুকৌশলে শিরোনাম ও সংবাদটি পরিবেশন করাই যেন তাদের সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্য। অবশ্য এই বিষয়ে তারা অধিক বুদ্ধিদীপ্ত ও গুণীজন। নির্বাচন এলেই তাই তাদের দৌড়ঝাঁপও বেড়ে যায় অতিমাত্রায়।

এসব দেখে শুনে সহজেই যে প্রশ্ন মনে উদয় হয় তাহলো যে বা যারা মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান ও ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদানে বিশ্বাসী নয় তারা কীভাবে বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারে? আর রাজনীতি করার অধিকার লাভ করতে পারে। যে কোন দেশের নাগরিকত্ব লাভ করতে হলে সে দেশের সংবিধানের প্রতি সম্মান রেখেই শপথ গ্রহণ করতে হয়। এটাই তো বিধান।

গত কিছুদিন থেকে চোখে পড়ার মত আরো একটি বিষয় হচ্ছে, এই সেদিন পর্যন্ত বিএনপির সভা, সমাবেশ, মিটিং মিছিলে জনসমাগমের বিষয়টি ছিল হাসি ঠাট্টার পর্যায়ে। এখন তার ব্যতিক্রম বিশেষভাবে লক্ষণীয়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এই জনমানুষ কারা? কী তাদের পরিচয়? তারা কি বিএনপির সমর্থক, কর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী? নাকি জামায়াত শিবিরের ক্যাডার?

সব শেষে বলতে চাই, ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, বিদেশে অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ সকল অন্যায় অবিচার বন্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার এখনই সময়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই পারে সরকারকে এসব বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য করতে।

এই সরকার উৎখাত করে আলবদর রাজাকারদের ক্ষমতার মসনদে বসাবার জন্য নয় (আফগানিস্তানে গণতন্ত্রের বর্তমান রূপ দেখার জন্য এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ার কোন মাথা ব্যথা নেই) বরং সত্যিকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ধর্ম নিরপেক্ষ ও কল্যানমুখী রাষ্ট্র গঠনে চাপ সৃষ্টি করা, প্রয়োজনে বাধ্য করা। এটাই হোক আজকের শপথ।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক

   

এমপির নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টের জোর



কবির য়াহমদ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সবুজ, নীল ও লাল; বাংলাদেশে এই তিন রঙের পাসপোর্ট রয়েছে। সরকারি চাকরিজীবী ও সর্বসাধারণের জন্যে সবুজ পাসপোর্ট, সরকারি কাজে কর্মকর্তারা বিদেশ সফরে গেলে নীল পাসপোর্টের ব্যবহার হয় এবং অন্য পাসপোর্টটির রঙ লাল।

এই লাল রঙের পাসপোর্ট ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য ও তাদের স্পাউস (স্বামী-স্ত্রী) এই পাসপোর্ট পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন।

লাল রঙের পাসপোর্ট পেয়ে থাকেন উচ্চতর আদালতের বিচারপতি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রধান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বিদেশে বাংলাদেশি মিশনের কর্মকর্তারা। লাল রঙের এই পাসপোর্টধারীরা দেশে-দেশে অন-অ্যারাইভাল ভিসা পান। এর অন্য বিশেষত্ব হচ্ছে, ডিপ্লোম্যাটিক বা কূটনৈতিক পাসপোর্ট সব দেশেই লাল রঙয়ের হয়ে থাকে।

পাসপোর্টের রঙয়ের প্রসঙ্গের অবতারণা মূলত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ভ্রমণে গিয়ে বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্যের হত্যাকাণ্ড। ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার চিকিৎসা ও বন্ধুর মেয়ের বিয়ের জন্যে ভারতে গিয়ে খুন হয়েছেন। গত ১২ মে তিনি সড়কপথে ভারতে যান। গিয়ে ওঠেন তার পরিচিত এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে। আগেও যখনই কলকাতা গেছেন তখনও ওই বাড়িতে উঠতেন তিনি বলে জানা গেছে।

১৩ মে চিকিৎসার কথা বলে ওই বাড়ি ত্যাগ করেন বলে পশ্চিমবঙ্গের থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিতে (জিডি) উল্লেখ করেন স্বর্ণ-কারবারি গোপাল বিশ্বাস আর ১৬ মে তারিখ আনোয়ারুল আজীম আনারের ব্যক্তিগত সহকারীর মোবাইল ফোনে সবশেষ কল আসে বলে জানা গেছে।

ভারতে যাওয়ার এক সপ্তাহ এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার তিনদিন পর আনোয়ারুল আজীম আনারের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভারতে গিয়ে তিনি ‘নিখোঁজ’। হয়ত তাৎক্ষণিক বিভিন্ন মাধ্যম ও দপ্তরে এই সংবাদ গেছে, তবে সংবাদমাধ্যমে এই খবর এসেছে ১৯ মে।

ওইদিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ‘আনোয়ারুল আজীম আনারকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই’ মন্তব্য করে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘আমাদের এনএসআই কাজ করছে। ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো হয়েছে। উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নাই’।

মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘তিনি (আনোয়ারুল আজীম) পুরানা মানুষ, একজন সংসদ সদস্য বুঝেশুনেই তো চলেন। পাশের দেশ ভারতে গেছেন। এমন তো না মিয়ানমার গেছেন, যে মারামারি লেগেছে। আমার মনে হয় এসে পড়বেন।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে আশ্বস্ত করার বার্তা ছিল। ছিল প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে প্রবল বিশ্বাস। ‘এমন তো না মিয়ানমার গেছেন’ এই মন্তব্যে ভারত সম্পর্কে যে প্রবল আস্থার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তিনি, দেখা গেল তার উল্টো ফল! নিখোঁজের পর এখন জানা গেছে, ভারতে গিয়েই খুন হয়ে গেছেন আনোয়ারুল আজীম আনার এবং খুনের ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভারতে এমপি আনারকে খুন করেছে বাংলাদেশিরাই। এই ঘটনায় কোনো ভারতীয় সম্পৃক্ত নাই বলে তার দাবি।

ভারতের কেউ হয়ত এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত নয়, তবে ঘটনাস্থল যখন ওখানে তখন কি সত্যিই দায় এড়ানো যায়!

প্রথমে খবর এসেছিল সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের একটি ভবন থেকে। পরে জানা গেছে, তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। মরদেহের সন্ধান চলছে। এরই মধ্যে দেশে-বিদেশে অন্তত পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভারতীয়দের কেউ নয়, বাংলাদেশিদের দ্বারা খুন হয়েছেন আনোয়ারুল আজীম আনার। বিষয়টির তদন্ত চলছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভাষায় বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে তদন্ত শেষ! অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই আবার নিখোঁজের সংবাদ প্রকাশের পর পরই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘তিনি পুরানা মানুষ, একজন সংসদ সদস্য বুঝে শুনেই তো চলেন। আমার মনে হয় এসে পড়বেন।’ বাস্তবতা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত তার ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। মন্ত্রীও বলছেন, খুন হয়েছেন।

সংবাদমাধ্যমে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের অতীত বের হয়ে আসছে ক্রমশ। জানা যাচ্ছে, তিনি আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ওয়ারেন্টভুক্ত ছিলেন। হুণ্ডি কারবার, চোরাচালান ও পাচারের অভিযোগে ইন্টারপোল তার বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি করেছিল। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে, এমপি হয়ে তিনি সেই নোটিস প্রত্যাহার করিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বিভিন্ন সূত্র বলছে, স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে তিনি ওই এলাকায় শুরু করেছিলেন, বিকশিত হয়েছিলেন বিএনপির আমলে আর জনপ্রতিনিধি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের আমলে। পেয়েছিলেন সব জায়গা থেকে ‘দায়মুক্তি’। এখন তাই অতীতকে ভুলে আমরা ব্যস্ত শোকপ্রকাশে। মানবিক শোকের প্রকাশ যদিও দোষের নয়, তবু সত্য অপরাধ তামাদি হয় না কখনো।

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের এমন মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত। বিদেশে বিশেষ করে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্রে বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্যের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উদ্বেগজনক। যদিও এটা তার সরকারি সফর নয়। তিনি একাই গিয়েছিলেন ভারতে। চিকিৎসা, ব্যবসা কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া, যে কারণেই হোক এই সফরটা ব্যক্তিগত হলেও তার পরিচিতি এখানে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য। তিনি দেশের লাল রঙের পাসপোর্ট ব্যবহার করে থাকেন। পৃথিবীর প্রতি দেশের ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টের রঙ লাল। এই হিসেবে তার এই বিদেশ সফরও দুই দেশের কারো অজানা থাকার কথা নয়।

ভারতে বাংলাদেশের সংসদ সদস্যের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একাধিক মন্ত্রী বিষয়টির মধ্যে প্রতিবেশী দেশকে আমলে নিতে চাইছেন না। বিএনপি মহাসচিব খোঁচা দিয়েছেন, ‘বন্ধুরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব’ নিয়ে। এখানে ভারতকে আড়াল করার চেষ্টা, সামনে আনার চেষ্টার মধ্যে রাজনীতি এবং ভারতপ্রেম ও বিদ্বেষ আছে তাদের তবে এখানে তাদের দায় নেই কোনো এটা বলার সময় কিন্তু আসেনি এখনো। আগবাড়িয়ে তাদেরকে দায় দেওয়া ও দায়মুক্ত করার এই প্রচেষ্টা অপ্রয়োজনীয়। এটা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের যোগাযোগ, সম্পর্ক ও তদন্তের বিষয়।

ভারতের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক। বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের অগ্রগতি সবখানে দেশটির সহায়তা ও অংশগ্রহণ আছে। এই সত্যিকে স্বীকার করেও প্রশ্ন রাখা যায়, সীমান্তে নাগরিক মরে গুলিতে, আর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের এমপি কেন মরবেন আততাতীয় হাতে! এখানে কি ওই দেশের কোনো দায় নেই! সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তিনি যখন ভারত প্রবেশ করলেন তখন তার পাসপোর্ট সূত্রেই ভারত জানতে পেরেছে দেশটিতে একজন সংসদ সদস্য প্রবেশ করেছেন। এগুলো অতি-স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে যখন কোনো বিদেশি ভিআইপি প্রবেশ করেন, তখন কি নানা সংস্থা, কর্তৃপক্ষ অপ্রকাশ্য হলেও সক্রিয় হয় না! নজরদারি, নিরাপত্তাসহ বিবিধ দিক দেখার বিষয় এখানে প্রাসঙ্গিক। ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টের জোর তো এখানে!

প্রাথমিক তথ্যের সূত্র ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, বাংলাদেশিদের দ্বারা কলকাতায় হত্যাকাণ্ডের শিকার সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। এই মন্তব্য কি আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরুর আগে তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে দেওয়ার মতো মন্তব্য হয় না! চূড়ান্ত তদন্তেও যদি এটা প্রমাণ হয়, তবু প্রশ্ন রাখাই যায়, বাংলাদেশিরা ভিন দেশে গিয়ে এত বড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার সময়ে কি টের পাবে না দেশটির নানা বাহিনী, সংস্থা! এখানে কি সত্যি দায় থাকছে না তাদের!

ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টধারী বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মরদেহ এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি। অথচ প্রথমে জানা গিয়েছিল মরদেহ উদ্ধারের কথা। দেশটির একটা অভিজাত এলাকায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া একদল আততায়ী খুন করেছে, মরদেহ সরিয়ে নিয়েছে, খুনের ঘটনা নিশ্চিতের আগে সন্দেহভাজনরা গ্রেফতার হয়ে গেছে, প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রের ‘দায় আছে দায় নেই’ আলোচনাও শুরু হয়ে গেছে—এত সব ঘটনা ঘটেছে, দ্রুততম সময়ে। এগুলো রহস্যজনক!

হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে ঘটে যাওয়া এত সব ঘটনার রহস্য উন্মোচনও জরুরি।

কবির য়াহমদ: অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর,বার্তা২৪.কম

;

কার হাতে গাজাবাসীর রক্তের দাগ!



ড. মাহফুজ পারভেজ
কার হাতে গাজাবাসীর রক্তের দাগ!

কার হাতে গাজাবাসীর রক্তের দাগ!

  • Font increase
  • Font Decrease

একতরফা ইসরায়েলি হামলায় গত অক্টোবর (২০২৩) থেকে প্রায় ৩৭ হাজার মৃত্যু ঘটেছে গাজায়। হামলা এখনো অব্যাহত। নিহতদের বেশির ভাগই নারী, শিশু, বৃদ্ধ, সাধারণ নাগরিক। নিহত হয়েছেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অসুস্থ মানুষ, ত্রাণকর্মী, আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বেচ্ছাসেবী, চিকিৎসক, নিরীহ ও নিরপেক্ষ মানুষজন।

ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজায় মৃত্যুর মহোৎসবের দায় কার! কার হাতে লেপ্টে আছে সহস্র গাজাবাসীর রক্তের দাগ! কোনো ভণিতা ও কৌশলে এড়ানো সম্ভব হবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়বদ্ধতার! শাঠ্য-ষড়যন্ত্রে আড়াল করা যাবে, হত্যাকারীর রক্তলোলুপ-কুৎসিত চেহারা!

গাজায় নিজেদের হামলা, গণহত্যা ও দখলদারিত্বকে যতই হামাসবিরোধী আন্দোলন বলে দেখানো চাক ইসরায়েল, আসলে তা চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ ও সাফ গণহত্যা। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এই বার্তা দিয়ে সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার আবেদন জানিয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)-র চিফ প্রসিকিউটর করিম খান। আন্দোলন হচ্ছে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শত শত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।

কিন্তু সেই দাবির বিরোধিতা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, 'গাজায় যা হচ্ছে, তা কিছুতেই গণহত্যা নয়'। যদিও বাইডেন বিরোধীদের দাবি, গাজার ব্যাপারটিতে কার্যত চোখ বুজে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট। 'গণহত্যাকারী জো’ তকমাও জুটেছে তার। গণহত্যাকারী নেতানিয়াহুকে নির্লজ্জভাবে সমর্থন করে বাইডেন নিজের হাতে গাজাবাসীর রক্তের দাগ লাগাতেও পিছপা হননি।

গণহত্যাকারী নেতানিয়াহুকে নির্লজ্জভাবে সমর্থনকারী বাইডেনের সুরে কথা বলেছেন, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকও। আইসিসি-র দাবির বিরোধিতা করে তিনি বলেছেন, 'করিমের এই আবেদন মধ্য এশিয়ায় শান্তি আনতে পারবে না।' তাহলে শান্তি আনবে আরো মৃত্যু ও গণহত্যা! মনে মনে নেতানিয়াহু, বাইডেন, ঋষি সুনক আরো যুদ্ধ, আরো গণহত্যা, আরো রক্ত, আরো মৃত্যুই চাইছেন! গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের মুখোশের আড়ালে তারা আসলে গণহত্যাকারীর দোসর।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)-র চিফ প্রসিকিউটর করিম খানের দাবি, ২০২৩-এর ৭ অক্টোবর থেকে হামাস ও গাজার সংঘর্ষে মানবতা বিপন্ন। নির্বিচারে প্রাণ হারাচ্ছেন গাজার নারী-পুরুষ-শিশু। ত্রাণটুকুও পৌঁছচ্ছে না। তাই, প্রয়োজন আগ্রাসীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার।

নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে মূলত গণহত্যা, মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য অপরাধ, যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সেখানে মামলা করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, মামলা করেন গাজায় আক্রান্তদের আইনজীবীরাও। মামলায় গণহত্যা প্রমাণিত হয়েছে। নেতানিয়াহু অপরাধী হয়ে গ্রেফতারের মুখোমুখি।

গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন অপরাধীদ্বয়: নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট। তাদের পক্ষে সুর মেলান ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগও। ছুটে এসে আপত্তি জানিয়েছে আমেরিকা ও ব্রিটেন। তবে হঠাৎ করে সুর বদলে আইসিসিকে সমর্থন করে ফ্রান্স ও বেলজিয়াম। গাজার সরকারি সংবাদমাধ্যম দফতর ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনও করিমের আবেদনকে স্বাগত জানিয়েছে।

গণহত্যা থেকে চোখ সরিয়ে দিতে নেতানিয়াহুর দাবি, আসলে করিম ফের ইহুদি-বিদ্বেষ জাগিয়ে তুলতে চাইছেন। তিনি ‘আধুনিক যুগের অন্যতম প্রধান ইহুদি-বিদ্বেষী’। তিনি বলেন, 'দ্য হেগের আইনজীবী কীভাবে গণতান্ত্রিক ইসরায়েলের সঙ্গে রক্তপিপাসু হামাসের তুলনা করছেন! ইসরায়েলি বাহিনী স্রেফ আত্মরক্ষার খাতিরে লড়াই করছে। আর হামাস নির্বিচারে অপহরণ করে খুন ও ধর্ষণ করেছে আমার ইসরায়েলি ভাই-বোনেদের।' প্রায় একই সুরে গ্যালান্টের দাবি, ইসরায়েলের হকের লড়াইকে অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করতে চাইছেন করিম। এদেরই অভিন্ন সুর শোনা যাচ্ছে, বাইডেন ও ঋষি সুনকের কণ্ঠে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)-র চিফ প্রসিকিউটর করিম খান যেদিন এই গ্রেফতারি পরোয়ানার দাবি জানান, সেদিনই হোয়াইট হাউসে ‘ইহুদি ঐতিহ্য মাস’ সংক্রান্ত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, ‘আমি স্পষ্টভাবে একটা কথাই বলতে চাই। ইসরায়েল রাষ্ট্র আর হামাসের মধ্যে কোনো তুলনাই হয় না। আমরা আইসিসি-র প্রস্তাব সম্পূর্ণ খারিজ করে দিচ্ছি।’ ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচও বলেন যে, ইহুদিদের প্রতি এই ধরনের তীব্র বিদ্বেষ দেখা গিয়েছে, একমাত্র নাৎসি জার্মানিতেই।

হামাসের পাল্টা দাবি, 'নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়টিতে বেশ দেরি করে ফেললো আন্তর্জাতিক আদালত। আর তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। বরং ইসরায়েলি অপরাধের তুলনায় হামাস কিছুই করেনি।'

একদা ইসরায়েলসমর্থক ফ্রান্স ও বেলজিয়াম ৩৭ হাজার গাজাবাসীর মৃত্যু পর অবশ্য এক বিবৃতি প্রকাশ করে করিমকে সমর্থন জানিয়েছে। ফ্রান্সের মতে, ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষা’র খাতিরে বহু নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর বিচার প্রয়োজন। একই সুর বেলজিয়ামের। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলোও।

করিম ও তার সহযোগীদের দাবি, হামাস মৌলিক মানবাধিকারকে খর্ব করেছে। ইসরায়েলও আত্মরক্ষার নামে আন্তর্জাতিক মানবতার আইন না মেনে নির্বিচারে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই কারণেই গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রয়োজন। গণহত্যা থামানো ও গণহত্যাকারীকে আইনের আওতায় আনা দরকার।

এত কিছুর পরেও থেমে নেই ইসরায়েলি গণহত্যা। থেমে নেই গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত নেতানিয়াহুর প্রতি বাইডেন ও ঋষি সুনকের উলঙ্গ সমর্থন। এমনকী, গণহত্যার তাণ্ডবে মদমত্ত ইহুদি নেতা নেতানিয়াহু গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়েও দর্পিত চিৎকারে ঘোষণা করেছেন, 'তার জীবদ্দশায় আলাদা রাষ্ট্র হবে না প্যালেস্টাইন।' কিন্তু তার এই দম্ভোক্তি ব্যর্থ হওয়ার পথে।

বরং আশার কথা হলো, কতিপয় যুদ্ধোন্মাদ ছাড়া মানবিক বিশ্বনেতৃত্ব একবিংশ শতকের নব্য-হিটলার, হন্তারক নেতানিয়াহুর বন্য-হুঙ্কারে কান দেয়নি। আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও স্পেন ঘোষণা করেছে, 'আমরা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছি। আমরা এখন সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য জাতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করব। আমরা নিশ্চিত যে, আগামী সপ্তাহে আরো অনেক দেশ এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণে আমাদের সাথে যোগ দেবে।' গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শান্তির আশা ব্যক্ত করেছেন দেশ তিনটির শীর্ষ নেতারা।

আজকে না হলেও ভবিষ্যতে কোনো একদিন বিশ্ব ঠিকই চিহ্নিত করবে কার হাতে ছিল গাজাবাসীর রক্তের দাগ। কারা ছিলেন গণহত্যাকারীর দোসর-সমর্থক, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী। আর কারা ছিলেন শান্তির পক্ষে ও গাজা গণহত্যাকাণ্ডের বিপক্ষে।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

সব নিষেধাজ্ঞা ভিসানীতির অধীন নয়



কবির য়াহমদ
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে অভিযোগ, সেটা দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ এবং দুর্নীতির সহায়তা।

যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তিনি তার ভাইকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি এড়াতে সহযোগিতা করেছেন। অন্যায়ভাবে সামরিক খাতে চুক্তি বা ঠিকাদারি পাওয়া নিশ্চিত করতে তিনি তার ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। নিজের স্বার্থের জন্য সরকারি নিয়োগের বিনিময়ে ঘুষ নিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে সোমবার (২০ মে) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞার কথা জানানো হয়।

দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের বিবৃতিতে বলা হয়, উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার কারণে আজিজ আহমেদকে ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট, ফরেন অপারেশন অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্টের ৭০৩১ (সি) ধারার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে পররাষ্ট্র দপ্তর। এর ফলে আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য হবেন।

নিষেধাজ্ঞার পর প্রতিক্রিয়ায় সমস্ত অভিযোগকে অস্বীকার করে আজিজ আহমেদ বলেছেন, ‘নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি যদিও ব্যক্তিগত, তবে বর্তমান সরকারের সময়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই ঘটনাটি সরকারকেও কিছুটা হেয় করে।’

এদিকে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, এই নিষেধাজ্ঞা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন ভিসানীতির অধীন নয়, দেশটির অন্য আইনে। দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘এটা সেনাবাহিনীর বিষয়।’

এটা সত্যি যে, জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেটা নির্বাচনকেন্দ্রিক ভিসানীতির অধীন নয়। মার্কিন ভিসানীতি ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের অধীন। কিন্তু জেনারেল আজিজকে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা ফরেন অপারেশন অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্টের অধীন।

ম্যাথিউ মিলার তার বিবৃতিতে আইনের বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। নির্বাচনকে প্রভাবিত কিংবা বাধা প্রদান বিষয়ে মার্কিনিরা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে যে ভিসানীতি দিয়েছিল, এর অধীনে এখন পর্যন্ত কাউকে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। আজিজ আহমেদকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের বিশ্বাসকে ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে।

নিষেধাজ্ঞা মানে ভিসানীতির নিষেধাজ্ঞা নয়। এটা দুর্নীতির অভিযোগে। এই ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ঘোষণা আছে বাংলাদেশের।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখানে যথার্থই বলেছেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দুর্নীতি দমন, সন্ত্রাস দমনসহ অন্যান্য বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করছি। আমরা দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রেও একসঙ্গে কাজ করবো। সরকার-দলের অনেকেই দুর্নীতিতে জেলে গেছেন, যাচ্ছেন সেটাও নিষেধাজ্ঞা-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় উল্লেখ করেছেন হাছান মাহমুদ এবং এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অবগত করেছিল বলেও দাবি তার।

জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদকে দেওয়া নিষেধাজ্ঞায় তার ভাইকে শাস্তির থেকে পরিত্রাণের যে উল্লেখ সেটা দেশবাসীর অবিদিত নয়। এনিয়ে আগে প্রতিবেদন হয়েছে দেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমে। প্রতিবেদন হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায়।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ নামে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করে, যেখানে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ এবং তার ভাইদের কর্মকাণ্ডের উল্লেখ ছিল।

যদিও সরকার এর প্রতিবাদ করেছিল। প্রতিবাদ করেছিল সেনা সদর দপ্তর। ওই প্রতিবেদনের অন্যতম কুশীলব ছিলেন ডেভিড বার্গম্যান, তাসনিম খলিল, জুলকারনাইন সায়ের খান নামের ব্যক্তিরা।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) প্রতিবাদলিপিতে তাদের পরিচয় হিসেবে উল্লেখ করা হয় যথাক্রমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দণ্ডিত, অখ্যাত নেত্র নিউজ-এর প্রধান সম্পাদক ও মাদকাসক্তির অপরাধে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি হতে বহিষ্কৃত একজন ক্যাডেট হিসেবে। অর্থাৎ সেনা সদর দপ্তরের ছিল কড়া প্রতিক্রিয়া।

জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ যে সব দায়িত্বে ছিলেন, সেগুলো ছিল রাষ্ট্রের অতি-গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তার সাবেক পদ-পদবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও রাষ্ট্রের সম্মানের প্রশ্ন জড়িত। তাই, এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিজিবি-সেনাবাহিনী তাদের সাবেক প্রধানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আনীত অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য দেবে নিশ্চয়ই।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলছেন, ‘এটা সেনাবাহিনীর বিষয়’, তখন এই মুহূর্তে আমাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এছাড়া অভিযুক্ত ভাইকে বাঁচাতে সত্যি কি কোনো অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল, ওই ঘটনায় কি আইনের কোনো ব্যত্যয় হয়েছিল, এনিয়েও ব্যাখ্যা আমরা আশা করি আইন মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে।

অসত্য তথ্য দিয়ে ভাইদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করার যে অভিযোগ উঠেছে, সেটারও ব্যাখ্যা আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।

সাবেক সেনাপ্রধান যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষিদ্ধ হয়েছেন—এই সংবাদের কয়েকটা দিক রয়েছে। প্রথমত অভিযোগগুলো সত্যি কিনা, সত্যি হলে রাষ্ট্রের করণীয় কী, অসত্যি হলে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে! অভিযোগগুলো যদি সত্যি হয়, তবে আইনি প্রতিবিধান করা উচিত রাষ্ট্রের। অসত্যি হলে উচিত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রতিবাদ জানানো।

যদিও এখানে ব্যক্তি আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের শাস্তির কথা বলছে যুক্তরাষ্ট্র তবুও বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এই অপমান গিয়ে পড়ে রাষ্ট্রের ওপরও।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় দুর্নীতি দমনে রাষ্ট্রের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের একসঙ্গে কাজ করার যে প্রত্যয়, সেটা আমরা অনেকবারই শুনেছি, এবারও শুনলাম। তবে এই প্রত্যয় কেবল মুখের বুলি আর সাদা-কালো হরফের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাও উচিত নয় আমাদের।

বেঁচে থাকতে কাউকে যুক্তরাষ্ট্রে যেতেই হবে এমন না। পৃথিবীর সবার জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রের গমন নয়, এটা আরো অন্য অনেক কিছুর মতো ছোট্ট এক ঘটনা।

তবে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার মতো ফরমান জারি যে কারো জন্য অপমানের! হোক না সেটা ব্যক্তি পর্যায়ের। তবে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এবং দেশে স্পর্শকাতর একাধিক বাহিনীর সাবেক প্রধান হিসেবে এটা রাষ্ট্রের জন্যও অপমাননাকর।

সত্যি যদি দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে থাকেন জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ তবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিষেধাজ্ঞাতেই শাস্তি সীমিত থাকা উচিত হবে না। প্রচলিত আইনে তাকে বিচারের আওতায় আনার সুযোগ থাকলে সেটা গ্রহণ করতে হবে।

সাবেক সেনাপ্রধান যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন। এর আগে পুলিশের সাবেক নয় কর্মকর্তা যারা র‍্যাবে ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এসেছিল। এই তালিকাটা কেন দীর্ঘ হচ্ছে, এখানে কি অস্বীকার তত্ত্ব নেই! এই অস্বীকার তত্ত্ব-পদ্ধতি যখন কাজে আসেনি আগে, তখন এই পথে পা না বাড়ানোই উচিত হবে আমাদের। এখানে যেখানে থাকা দরকার বিভিন্ন বাহিনীর বিভাগীয় ভূমিকা, তেমনি দরকার রাষ্ট্রীয় ভূমিকাও। কারণ, ব্যক্তির নামে এসব নিষেধাজ্ঞা আসলেও নাগরিক হিসেবে তাদের সবাই বাংলাদেশের।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নিষেধাজ্ঞাবিষয়ক বিবৃতির পর একশ্রেণির মানুষের মধ্যে আনন্দ লক্ষণীয়। এই আনন্দের কারণ রাজনৈতিক। অনেকেই ভাবছেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক এই নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু সব নিষেধাজ্ঞা ভিসানীতির অধীন নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা দুর্নীতি সম্পৃক্ততায় বিচারিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত কিংবা প্রভাবিত এবং আর্থিকখাত সংশ্লিষ্ট। নির্বাচনকেন্দ্রিক ভিসানীতির অধীন হোক আর দুর্নীতির কারণে হোক ব্যক্তির নামের হলেও এখানে আদতে অপমানিত বাংলাদেশই।

দেশের এই অপমানে রাজনৈতিক-বিভক্তির আনন্দ অপ্রত্যাশিত, একইসঙ্গে ব্যক্তিগত শাস্তি এবং ‘স্বীকার করলে ভাবমূর্তি-সংকট’—এমন আশঙ্কায় এড়িয়ে যাওয়াও হবে অনাকাঙ্ক্ষিত!

কবির য়াহমদ: অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর,বার্তা২৪.কম

;

ইব্রাহিম রাইসি’র মৃত্যু-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়া



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

সৈয়দ ইব্রাহিম রাইসি আল সাদাতি (জন্ম ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৬০) সাধারণ মানুষের কাছে ইব্রাহিম রাইসি নামেই পরিচিত একজন রাজনীতিবিদ, বিচারক।

নির্বাচনে জয়ী হয়ে ৩ আগস্ট (২০২১) থেকে ১৯ মে (২০২৪) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ইরানে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার মৃত্যু ‘নিছকই দুর্ঘটনা’ না কি ‘সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড’, তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী চলছে তুমুল আলোচনা। কারণ, তিনি ছিলেন শক্ত মেজাজের নেতা। মধ্যপ্রাচ্যে তথা আরব বিশ্বে মার্কিন-ইসরায়েল আধিপত্যের বিরুদ্ধে খুবই সোচ্চার। পশ্চিমা আগ্রাসনবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও গ্রুপের সহযোগী।

মার্কিন-ইসরায়েল তাকে প্রধান শত্রু মনে করতো। ফলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তার মৃত্যু শুধুই ‘এক্সিডেন্ট’ নাকি ‘পলিটিক্যাল কিলিং’!

মার্কিন যুক্তরাষ্টের কাছে রাইসি ছিলেন ‘বিতর্কিত ও কট্টর মৌলবাদী’। তার শাসনকালকে ‘নারী অধিকার ও মানবাধিকারের পরিপন্থী‘মনে করতো ওয়াশিংটন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল অফিস তাকে নিষিদ্ধ করেছিল এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদকেরা তাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। তার রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি (JCPOA) নিয়ে আলোচনা আটকে যায়।

তারপরেও রাইসিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি পশ্চিমা শক্তি। তার শাসনামলে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিদর্শনে বাধা দিয়েছে এবং রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণে সমর্থন দিয়েছে। ইরান গাজার সংঘাতে ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় এবং হিজবুল্লাহ ও হুথি আন্দোলনের মতো গোষ্ঠীগুলিকে অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে।

অতএব, কপ্টার দুর্ঘটনায় রাইসির আকস্মিক মৃত্যুর পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো সমবেদনার পথে না হেঁটে সরাসরিই বলেছে, ‘এই মানুষটির হাতে যে অনেক রক্ত লেগে রয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ কোনো নেই’।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের প্রতিবাদে রাইসির সমর্থকেরা প্রশ্ন করেছেন, ‘গাজ়ার মানুষের রক্ত তা হলে কার হাতে লেগে আছে! ইসরায়েল, না তাদের অস্ত্র জোগানো অন্ধ সাপোর্টার যুক্তরাষ্ট্রের! রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, দু’জনেই রাইসির মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে তাকে ‘প্রকৃত বন্ধু’ বলেছেন।

প্রথাগত রাজনীতির পথে ইব্রাহিম রাইসি ইরানের ক্ষমতার শীর্ষে আসীন হননি। তিনি ছিলেন ইরানের বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত উপপ্রধান বিচারপতি। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি ছিলেন।

১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে তিনি তেহরানের প্রসিকিউটর এবং উপ-প্রসিকিউটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি আস্থান কুদস রাযভী নামক একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক এবং চেয়ারম্যান ছিলেন। রাইসি ২০০৬ সালে দক্ষিণ খোরাসান প্রদেশ থেকে প্রথমবারের মতো বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি মাশহাদের জুমা নামাজের ইমাম এবং ইমাম রেজা মাজারের প্রধান ইমাম আহমদ আলা মোলহোদার জামাতা।

রাইসি ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, কিন্তু মধ্যপন্থী রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানির কাছে পরাজিত হন। তিনি ২০২১ সালে ফের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ৬২.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে হাসান রুহানিকে পরাজিত করেন।

অনেকেই মনে করেন, এই নির্বাচন রাইসির পক্ষে প্রভাবিত করা হয়েছিল। কারণ, তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ মিত্র। রাইসিকে খামেনির পরবর্তী উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

সন্দেহ নেই, ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার পর ইরাসের ইতিহাসে রাইসির শাসনকাল ছিল অত্যন্ত সংকটময়। ভেতরের নানা আন্দোলন থামানোর পাশাপাশি ইরানকে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় সদা নিয়োজিত থাকতে হয়েছে তাকে।

অন্যান্য মুসলিম দেশ যেখানে মার্কিন-ইসরায়েল আধিপত্য ও গণহত্যা মেনে নিয়েছে, ইরান তা করেনি। ইরানি রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব সর্বদা সচেষ্ট থেকেছে, মার্কিন-ইসরায়েল আগ্রাসন মোকাবিলায়। সে কারণে ইরানি জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রাইসিকেও হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। কেননা, রাইসির কপ্টার নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছিল, তারা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেও সব জানানো হয়েছে।

হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মুখপাত্র জন কার্বি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলিকে মদত দিচ্ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। গোটা অঞ্চলকে অস্থির করে রাখার অভিযোগ ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতেও তুলবে।’

রাইসির শাসনকালে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মারাত্মক কিছু ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘হামাস’কে সাহায্য করেছে। হিজ়বুল্লাহ গোষ্ঠীকে শক্তিশালী করেছে। সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে বোমা ফেলায় ইসরায়েলকে নিশানা করে ইরান পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। যদিও এরপর ইস্পাহানের কাছে ইরানের এয়ারবেসে বোমা ফেলে আসে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান।

হরমুজ় প্রণালীতে ইসরায়েলি মালিকের একটি জাহাজকে পণবন্দিও করে ইরানের বাহিনী। মোটের ওপর, মার্কিন-ইসরায়েলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়ে যাচ্ছিল রাইসির ইরান। এমনকী, মার্কিন নিষেধাজ্ঞাতে পরোয়া না করে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে মৈত্রী গঠন করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিকল্প পরিসর তৈরি করে নেয় রাইসির নেতৃত্বাধীন ইরান।

১৯ মে (২০২৪) রোববার ইব্রাহিম রাইসি পূর্ব আজারবাইজানের প্রদেশে জলপাই এলাকায় প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলীর সঙ্গে জলাধার প্রকল্প উদ্বোধন শেষে ফেরার পথে রাইসিকে বহনকারী একটি হেলিকপ্টার ইরানের উত্তর-পশ্চিমে ভারজাকান এলাকার একটি দুর্গম পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয়।

ওই দুর্ঘটনায় ইব্রাহিম রাইসি, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির-আব্দুল্লাহিয়ানসহ হেলিকপ্টারে থাকা সবাই অর্থাৎ ৯ জন নিহত হন। কপ্টার ভেঙে রাইসির মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলা হলেও নানা ঘটনাপ্রবাহ সন্দেহের আঙুল তুলছে ইরানের প্রতিপক্ষের দিকে।

কৌশলী ইরান হয়ত গোটা পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কায় সমঝে চলছে। তার সামনে নেতৃত্বের শূন্যতা পূর্ণ করা এবং রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখাই আপাতত বড় চ্যালেঞ্জ।

রাইসির মৃত্যুশোক পালনের মধ্যেই ইরান আগামী ২৮ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছে। ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর পর অন্তর্বর্তীকালীনভাবে ওই ভূমিকায় থাকার কথা ভাইস প্রেসিডেন্টের। ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মোখবর সাময়িকভাবে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব সামলাবেন। তাকে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া মেনে কাজ করতে হবে। ইরানের সংবিধানে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্টের আচমকা মৃত্যু হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট সাময়িকভাবে ওই দায়িত্ব সামলাবেন। তিনি সরকারের তিন সদস্যের কাউন্সিলের একজন সদস্য হিসেবেই ওই দায়িত্ব পাবেন। কাউন্সিলে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছাড়াও রয়েছেন ইরানের পার্লামেন্টের স্পিকার এবং বিচার বিভাগের প্রধান।

প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর ৫০ দিনের মধ্যে এই কাউন্সিল দেশে নতুন করে নির্বাচনের আয়োজন করবে। তার মাধ্যমেই স্থির হবে ইরানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন।

২৮ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নতুন প্রেসিডেন্ট যিনিই হবেন, তাকে রাইসির মৃত্যুতে পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে সৃষ্টি হওয়া একরাশ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবতে হবে। মার্কিন-ইসরায়েলি প্ররোচনায় যাতে পশ্চিম এশিয়ায় উত্তেজনা না বাড়ে এবং ইরানের স্বার্থ রক্ষিত হয়, সেসব বিষয় নিয়েও সতর্ক থাকতে হবে নতুন নেতাকে।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে কড়া দর-কষাকষিরই পক্ষপাতী ছিলেন রাইসি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিলেন মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রের ‘বন্ধু’ যে পাকিস্তানের সঙ্গে গত জানুয়ারিতে ইরানের যুদ্ধ বাধার উপক্রম হয়েছিল, শেহবাজ় শরিফের সরকার গঠনের পরে তিনদিন ধরে সে দেশেই সস্ত্রীক সফর করে দ্বিপাক্ষিক, একাধিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার অঙ্গীকার করে এসেছিলেন রাইসি। স্পষ্টতই, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে শত্রুতা ভুলে বন্ধুতার প্রয়োজন বুঝেছিলেন বৈদেশিক রাজনীতিতে পটু ও কৌশলী রাইসি। নতুন ইরানি নেতা রাইসির পথে চলেন না কি নতুন রাস্তা বের করেন, সেটাই দেখার বিষয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য রাইসির পিছু ছাড়েনি। ইরানের সঙ্গে সখ্যতার ‘অপরাধে’ পাকিস্তানকে নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছিল। সেই হুঁশিয়ারির সুর আবার শোনা গিয়েছিল চাবাহার বন্দর নিয়ে ভারতের সঙ্গে ইরানের চুক্তির পরে।

মনে করা হয়, ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গেও চুক্তির পথে হাঁটছিলেন রাইসি। মার্কিন অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা ও নানা প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে দেশের ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কমিউনিস্ট রাশিয়া, চীন ও অপরাপর দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা বুঝেছিলেন রাইসি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের নীতি একা প্রেসিডেন্ট তৈরি করেন না। স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনেকগুলো সংস্থা ও ফোরাম মিলিতভাবে দেশের জন্য নানান রকমের নীতি প্রণয়ন করে। প্রেসিডেন্ট তার মন্ত্রীদের নিয়ে সেসব বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন। ফলে, রাইসির মৃত্যুতেও ইরানের জাতীয় নীতির খুব একটা বদল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে, এটাও ঠিক যে, রাইসির মৃত্যুর প্রভাব পড়তে চলেছে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় ভূ-রাজনীতিতে ও আঞ্চলিক ক্ষমতার মেরুকরণে। সংঘাত, যুদ্ধ, আগ্রাসন, গণহত্যায় জর্জরিত ওই অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান শক্তির লড়াইয়ে রাইসির ইরান যেভাবে নেতৃত্বের আসনে চলে এসেছিল এবং সমমনাদের নিয়ে বড় মাপের মেরুকরণ করে মার্কিন-ইসরায়েল জোটের বিরুদ্ধে লড়ে চলছিল, তার প্রভাব সহজে মুছে যাবে না।

ড. মাহফুজ পারভেজ: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;