কাদের স্বার্থে, মদতে শান্তি ও সম্প্রীতির পাহাড়ে চলছে সন্ত্রাসবাদ?



আবুল খায়ের মোহাম্মদ
কাদের স্বার্থে, মদতে শান্তি ও সম্প্রীতির পাহাড়ে চলছে সন্ত্রাসবাদ?

কাদের স্বার্থে, মদতে শান্তি ও সম্প্রীতির পাহাড়ে চলছে সন্ত্রাসবাদ?

  • Font increase
  • Font Decrease

দুই যুগ আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাহানির অন্ধকার অধ্যায়ের অবসান হয়ে এসেছিল শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের নতুন ভোর। তারপর আলোকোজ্জ্বল হয়েছে পশ্চাৎপদ পার্বত্যাঞ্চল। নবজীবনের স্বাদ পেয়েছে পাহাড়ে বসবাসকারী উপজাতি ও বাঙালি জনগোষ্ঠী।

কিন্তু অকস্মাৎ বান্দরবানের গহীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাদের স্বার্থে, কাদের মদদে শুরু হলো সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নাশকতা? অভিজ্ঞরা বলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম হলো লাভজনক সন্ত্রাসবাদের ‘দোকান’। সেখানে সন্ত্রাসের নতুন সংজ্ঞার নাম 'পাহাড় দখল'। তারপর আন্তর্জাতিক মাফিয়া গোষ্ঠীর মদতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আফিম ও গাঁজার চাষ। দেশের হেরোইন রাজধানী হয়ে উঠেছে ভারত ও মায়ানমারের সীমান্তরেখা।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিক তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের অপর পার্শ্বের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো মাদক তৈরির কারখানা, মানুষ ফসলের চাষবাস বন্ধ করে আফিম চাষ করছেন। মায়ানমার-চট্টগ্রাম সীমান্ত জুড়ে মাদক তৈরি সংগঠিত ‘শিল্প’, যা কুকিদের ব্যবহার করে তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মায়ানমার ও মিজ়োরাম থেকে কুকিরা নাগাড়ে ঢুকছেন মাদক আর অস্ত্র নিয়ে। আফিম চাষের পাশাপাশি উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েও মদত দিচ্ছে,সীমান্তের ও-পারের এজেন্টরা। যার ফলে নিরাপত্তার ক্ষতি হচ্ছে শান্ত পাহাড়ের এবং বিশেষভাবে বান্দরবানের।

সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক চিত্র পেতে তাকানো দরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে। বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় এক দশমাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। এই এলাকাটি বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি, ভাষাগত বৈচিত্র, তাদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, প্রথাগত রীতিনীতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত সাজেক পর্যটন এলাকা, আলুটিলা, রাঙামাটি ঝুলন্ত ব্রীজ, বান্দরবান এর নীলগিরি, বগালেক ও তাজিংডং পাহাড় এর মত উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান এই অঞ্চলেই অবস্থিত বিধায় এই এলাকাটি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত।

আরও পড়ুন: বান্দরবানে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের উত্থান নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ

শান্তিচুক্তির পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থিতিশীলতা রক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা এই অঞ্চলের আপামর জনসাধারণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, খাদ্য সমস্যা, মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত স্থানীয় ব্যক্তিবর্গদের চিকিৎসা সেবা, দরিদ্র ব্যক্তিবর্গদের আর্থিক অনুদান প্রদান করে স্বাবলম্বী হতে সহযোগিতা করা, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা, দুর্গম এলাকায় পানির সমস্যায় জর্জরিত স্থানীয়দের কষ্ট লাঘবে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা এবং বেকার ব্যক্তিবর্গের কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র কারখানা স্থাপন করে আসছে।

এছাড়া তিন পার্বত্য জেলার অরক্ষিত সীমান্ত এলাকাকে নজরদারির আওতায় আনতে বাংলাদেশ সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল ও উপজাতি সন্ত্রাসীদের প্রতিকূল অবস্থান মোকাবেলা করে সীমান্ত সড়ক নির্মাণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিবেদিতপ্রাণ হয়ে দায়িত্বপালন করছে।

দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের আত্মত্যাগের বিষয়টি আজ দেশে-বিদেশে প্রশংসিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের আত্মত্যাগ ও কল্যাণকর কাজে ফলে পাহাড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য। এজন্য সেনাবাহিনী কঠোর ত্যাগ স্বীকার করে চলছে। উদাহরণ স্বরূপ দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল খাগড়াছড়ি জেলার আলুটিলা পুনর্বাসন এলাকায় ১৬০টি পরিবারের ৪০০ জন ব্যক্তিবর্গ দীর্ঘদিন যাবৎ পানির সমস্যায় ভূগছিল। সেখানে ছিলনা কোন সুপেয় পানির উৎস। এই খবর জানার পরপরই ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে খাগড়াছড়ি রিজিয়নের উদ্যোগে সেনাবাহিনী কর্তৃক ১০ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি পানির ট্যাংক স্থাপন করা হয়। যা ৫০০ মিটার গভীর হতে মোটর এর মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করতঃ উক্ত পানির ট্যাংকে সংরক্ষিত হয় এবং সেখান থেকে স্থানীয়রা সুপেয় পানি সংগ্রহ করে। সেখানে এই প্রকল্প চালুর পর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পানির সমস্যা সমাধান হওয়ায় সেনাবাহিনীর অনন্য ভূমিকায় আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।

অতি সম্প্রতি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার গোলাবাড়ী ইউনিয়নের জংলীটিলা এলাকায় স্থানীয় পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের পানির সমস্যা সমাধানে মহালছড়ি সেনা জোনের মাধ্যমে একটি সুপেয় পানির হাউজ নির্মাণ করা হয়। এতে ঐ এলাকার স্থানীয় জনগণ সেনাবাহিনীর মানবিক দায়িত্ব পালনে অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্ববোধ করছে।

পাহাড়ের অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে দ্রুত পৌঁছে দেন তারা। যে কোনো দুর্যোগে পাহাড়ি মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় তাদের। না এখানেই শেষ নয়, বেকার যুবকদের জন্য ব্যবস্থা করছেন কর্মসংস্থানের। রাত হলে উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কারণে ঘুমাতে পারেন না পাহাড়ি-বাঙালিরা। তাদের শান্তিতে ঘুমোনোর ব্যবস্থাও করছেন এই বাহিনীর প্রতিটি সদস্য।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পাহাড়ি অঞ্চল- খাগড়াছড়ি, বান্দরবন এবং রাঙামাটিতে সেনাবাহিনীর মানুষের পাশে থাকার কথা সর্বজনবিদিত। সামাজিক উন্নয়নে এই বাহিনীর ভূমিকা যেমন এখন দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত, তেমনি আস্থা অর্জন এবং সম্প্রীতি বজায়ে তিন পাহাড়ের সব ধর্মের মানুষের কাছে সেনাবাহিনী একটি নির্ভরতার প্রতীক। পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি এখন একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।

খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার হাজাপাড়া নামক দূর্গম পাহাড়ী এলাকায় মহামারি আকারে ডায়রিয়া আর অন্যান্য পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিলো কিছু দিন আগে। ঐ সময়ে বেশ কিছু পাহাড়ী যুবক, বৃদ্ধা ও শিশু গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর পাওয়ার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অতি দ্রুত সেখানে ছুটে গিয়ে দূর্গম পাহাড়ী পথে কয়েক ঘন্টা হেটে হাতিরমাথা অতিক্রম করে হাজাপাড়া এলাকায় পৌছায়, সেখানে অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প নির্মাণ করে ১৫০-১৬০ জন মহামারী আক্রান্ত রোগীদের পরম যত্নের সাথে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলে। প্রখর রৌদ্র উপেক্ষা করে দূর্গম ঐ এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশমাতৃকার সেবায় নিজেদের কষ্ট বিসর্জন দিয়ে বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসা সেবা এবং জনস্বার্থমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল।

করোনায় যখন সারাদেশের মানুষ নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই খাগড়াছড়ি, বান্দরবন এবং রাঙামাটির দুর্গম অঞ্চলের মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সেনাবাহিনী। কেবল তাই নয়, করোনা ছাড়াও রাত-বিরাতে অনেক মানুষ হাসপাতালে যেতে পারেন না। তাদেরকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এই বাহিনীর প্রতিটি চৌকষ সদস্য।

এই বাহিনীর আরও রয়েছে নানান ভূমিকা। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি তারা সেখানকার বসবাসরত লোকজনের জীবনমানোন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে উন্নয়নমূলক প্রকল্প পরিচালনা করে আসছে।

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ৩ বছরে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের আওতাধীন তিন পার্বত্য জেলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৫০ হাজারের বেশি মানুষের ভেতর শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে। এছাড়াও অন্তত এক লাখ মানুষের মাঝে বিভিন্ন প্রকার ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও ২০ হাজার জনকে বিভিন্ন আর্থিক অনুদান প্রদান করেছে। নিয়মিতভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে বিনামূল্যে চক্ষুশিবির।

এসব চক্ষুশিবিরে দুর্গম পার্বত্য এলাকার সুবিধাবঞ্চিত বয়োবৃদ্ধ পাহাড়ী ও বাঙালির চোখের ছানি অপারেশনসহ বিভিন্ন ধরনের চক্ষু সেবা প্রদান করা হয়।

ইতিপূর্বে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা, রাঙামাটির সাজেক ও বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় হাম আক্রান্ত হয়ে বহু পাহাড়ী শিশু নিহত হবার ঘটেছে। এসব আক্রান্ত এলাকাগুলোতে নিজেদের জীবন বাজি রেখে সুপেয় পানি সরবরাহ, খাবার ব্যবস্থা, অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প করে অসুস্থদের চিকিৎসাসেবা পরিচালনা করে পাহাড়ে হাম আক্রান্ত পাহাড়ীদের জীবন বাঁচানোর মতো মানবিক কাজে সেনাবাহিনীর অবদানও কম নয়।

পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাস দমন, শান্তি রক্ষায় সেনাবাহিনী রয়েছে বদ্ধপরিকর। বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ের দূর্গম স্থানগুলোতে গর্ভবতী মুমূর্ষ নারীদের পাহাড়ী রাস্তায় কাঁঢ়ে করে এনে হেলিকপ্টার যোগে সিএমএইচ এ নিয়ে সন্তান প্রসবসহ সুস্থ করে তোলার নজিরও রয়েছে অহরহ।

দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় ২০২০ সালে ভাল্লুকের আক্রমণে গুরুতর আহত মঙ্গলিয় মুরং (০৬) ও তার দাদা ইয়াংসাই (৪৮) কে আশংকাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম সিএমএইচ এ নিয়ে চিকিৎসা সেবা ও এরপর ভাল্লুকের আক্রমনে আহত ত্রইল মুরং (৬৬) নামের আরো এক পাহাড়ীকে উদ্ধার করে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম সিএমএইচ এ নিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলার একমাত্র প্রসংশার দাবীদার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীই।

শিক্ষাবিস্তারে সেনাবাহিনী এর তত্ত্বাবধানে সর্বশেষ গত ৩ বছরে ২৫০টির বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাহাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে। যেখান থেকে প্রচুর স্কুল শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায়ও এগিয়ে আছে সেনাবাহিনী। গত ৩ বছরে ২২০টির বেশি ধর্মীয় উপসনালয় গড়ে দিয়েছে তিন পাহাড়ি জেলায়। অবেহেলিত শিশুদের মানসিক বিকাশে তাদের রয়েছে সময়োপযুগী পদক্ষেপ। অনেক স্কুলে পড়ালেখার বই নেই। নেই উপকরণ। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিভিন্ন প্রকার শিক্ষা উপকরণ, ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ড্রেস ও খেলাধুলার সামগ্রী বিতরণ করে তারা মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

পার্বত্য অঞ্চলের অবহেলিত মানুষদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে সেনাবাহিনী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে কম্পিউটার ও সেলাই মেশিন বিতরণসহ ঐ বিষয়ে প্রশিক্ষণও প্রদান করছে তারা। এতে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ী-বাঙালি নারীরা স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।

দুর্গম পার্বত্য এলাকার জনগণের সুষ্ঠু বিনোদনের জন্য সেনাবাহিনী প্রতিবছর নানা দিবসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। তাদের এসব কার্যক্রম মুক্তবুদ্ধি ও সাংস্কৃতিক চর্চাকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পথে পরিচালিত করছে। যা ইতিবাচক বলে মত দিয়েছেন দেশের আপামর জনগণ।

একসময় ভীষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। ছিলনা শিক্ষার আলো। রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের বা গুরুত্বর অসুস্থ ও আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছিলনা। এছাড়া তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ী সন্ত্রাসী দলগুলোর পাল্টা-পাল্টি হামলা ও খুনোখুনির কারণে ভয় নেমে আসতো সেখানকার বসবাসরত সাধারণ মানুয়ের ভেতর। সময় গড়িয়ে এখন বদলে গেছে এই পাহাড়ী জনপদ। বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পাহাড়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে হাতে নিয়েছেন নানান পরিকল্পনা।

আর সেই পরিকল্পনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাত ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে খাগড়াছড়ি, বান্দরবন ও রাঙামাটি জেলায়। যার ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে গুইমারা সেনা রিজিয়নের উদ্যোগে গুইমারা রিজিয়নের পুরাতন কমান্ডার বাংলোতে একটি কম্বল ও ব্যাগ ফ্যাক্টরি উদ্বোধন করা হয়। এতে ঐ এলাকার স্থানীয় জনগণের ক্ষুদ্র কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ায় বেশ কিছু বাঙালি ও পাহাড়ী ব্যক্তিবর্গ শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ লাভ করায় তাদের পারিবারিক ভরণপোষণ ক্ষমতা ও স্বচ্ছলতা বৃদ্দি পেয়েছে। অনেকেই ভাবেননি এসব অঞ্চলে পানি আসবে, থাকবেনা বিদ্যুৎ সমস্যা। দুর্গম পাহাড়ী পথে ঘটবে উন্নয়ন, প্রান্তিক চাষিগণ প্রত্যন্ত এলাকা হতে বিভিন্ন উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও ফলফলাদি পরিবহণে সুবিধা প্রাপ্তি হয়ে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নে অবদান রাখবে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দুর্গম পাহাড়ে এখন জ্বলছে বিদ্যুতের আলো। রাস্তা করা হয়েছে প্রশস্ত। কোথাও পাকা সড়ক। বেড়েছে কৃষিকাজ। বেড়েছে চাষাবাদ। পর্যটন খাতেও উন্নতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সেখানে বাড়ছে বিনিয়োগ। তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এখন চলছে উন্নয়নযজ্ঞ।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য তিন জেলাতে যোগাযোগের উপযোগী রাস্তা ছিল ২ হাজার ৮০৩ কিলোমিটার, বর্তমানে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের তত্ত্বাবধানে নির্মিত সড়ক যোগাযোগের পরিধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯৪৯ কিলোমিটার।

শান্তিচুক্তির পূর্বে তিন জেলায় হাসপাতাল-ক্লিনিক ছিল মাত্র ২৪টি, এখন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি পর্যায়ে ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে ২৭০টির বেশি। যাত্রী ছাউনি ও ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে ২০টি। সীমান্তসড়ক নির্মাণেও ভূমিকা রয়েছে তাদের। এর সবই সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এবং বাঙালিদের মাঝে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সেনাবাহিনী নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকাগুলো ছিলো একসময় অরক্ষিত। বলা যায়, সন্ত্রাসী আর উগ্রবাদীদের অভয়ারণ্য। গোষ্ঠীগুলোর পরস্পরবিরোধী কার্যকলাপে প্রায়ই ঘটতো মৃত্যুর ঘটনা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসে।

এরপরই সেখানে শান্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে কয়েক দফা সংলাপের পর অনুষ্ঠিত হয় পার্বত্য শান্তিচুক্তি। যা ইতিহাসে ঠাঁই করে নেয় সফলতার সঙ্গে।

এই চুক্তির পরপরই কমে আসে পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। স্থানীয় সূত্র মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশের বসবাস তিন পার্বত্য জেলায়। সেনাবাহিনী দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই যেন এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটেছে। তবে শান্তিচুক্তির পরও এখনও পাহাড়ে উগ্র উপজাতি গোষ্ঠী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে তৎপর রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি চার ভাগ হয়ে এখন প্রতিদিনই ঘটাচ্ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। তবে সেনাবাহিনীর কারণে সেখানে অনেক কমে আসছে এই ধরণের ঘটনা।

পাহাড়ে অনেক স্থান ছিলো অনুন্নত। পায়ে হেঁটে যাওয়ার কথা তো ভাবাই যায় না। অথচ সেনাবাহিনীর সদস্যরা পার্বত্যাঞ্চলে দিনরাত পরিশ্রম করে রাতারাতি সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটিয়েছেন।

পাহাড়ে শান্তিকামী মানুষকে প্রায়শই বিচলিত দেখা যায়। উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। লুটপাট করে। পর্যটক অপহরণ করে নিয়ে যায়। চাঁদাবাজি তো আছেই। এসব অপকর্ম থেকে পাহাড়ের মানুষকে শান্তিতে রাখতে দিনরাত অতন্দ্র প্রহরী হয়ে কাজ করছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

স্থানীয় সূত্রমতে, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এবং বান্দরবানে একাধিক উপজাতি সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে। যাদের হাতে জিম্মি রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক লাখ মানুষ।

শান্তিচুক্তির পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং ওয়ান এলিভেন সরকারের পর এ দুইটি সংগঠন থেকে আরও দুইটি উপজাতি সশস্ত্র সংগঠন সৃষ্টি হয়ে তারা বিভিন্ন নাশকতা ও সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে চাঁদাবাজি, অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায়, হামলা ও পাল্টা হামলার মাধ্যমে নিজেদের এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অথচ এসব উপজাতিগোষ্ঠী সেখানে উন্নয়ন কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট নামক উপজাতি সংগঠন মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা যখনই কোন ঘটনা ঘটার খবর পাচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ছুটে যাচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে নানা অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছে রকেট লঞ্চার, ১৪-এমএম, এম-১৬, এসকে-৩২, সেনেভা-৮১, এম-৪ এবং এম-১ এর মতো ভয়াবহ অস্ত্র।

পার্বত্য এলাকা থেকে সেনাক্যাম্প অপসারণ না করার দাবি সেখানকার লাখো বাঙালির। এই দাবিতে একমত স্বয়ং পাহাড়িরাও। তারা বলেছেন, সেনাবাহিনীর তৎপরতার কারণে পাহাড়ের মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সুখী। কেননা পাহাড়ী-বাঙালি সবার জন্যই এই বাহিনীর সদস্যরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে।

একটি সূত্র জানায়, বিভিন্ন খাত থেকে বছরে এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের আয় ৫০০ কোটি টাকার বেশি। খাগড়াছড়িতে গত ২০ বছরে এমন সংঘাতে ৭শ’র বেশি খুন হয়েছে। এছাড়া রাঙামাটিতে গত ৫ বছরে মারা গেছে অন্তত ৪৫ জন।

২০১৭ সালের জুন মাসের ১২ তারিখ সোমবার রাত ১৩ তারিখ মঙ্গলবার ভোরে অতিবৃষ্টির ফলে রাঙামাটির বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে, সেখানে ব্যাপক প্রানহানি ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এদিন জেলার মানিকছড়িতে পাহাড় ধসে মাটি ও গাছ পড়ে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে রাঙ্গামাটি জোন সদরের নির্দেশে মানিকছড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর ১৬ জনের একটি দল ওই সড়কে চলাচল স্বাভাবিক করতে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে।

উদ্ধার কার্যক্রম চলাকালীন আনুমানিক বেলা ১১টায় পাশেই পাহাড়ের একটি বড় অংশ উদ্ধারকারীদলের সদস্যদের ওপর ধসে পড়ে। পাহাড় ধসের ফলে সেনবাহিনী সদস্যরা প্রায় ৩০ ফুট নিচে পড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মেজর মোহাম্মদ মাহফুজুল হক ও ক্যাপ্টেন মো. তানভীর সালাম শান্ত নিহত হয়েছেন। পরে এ ঘটনায় আরো ৩ সেনা সদস্যের লাশ উদ্ধার করা হয় এবং ১০ সেনা সদস্য গুরুতর আহত হন।

বাকি নিহতরা হলেন কর্পোরাল মোহাম্মদ আজিজুল হক ও সৈনিক মো. শাহিন আলম ও সৈনিক মোঃ আজিজুর রহমান। পাহাড় ধসে উদ্ধারের বিষয়ে হয়তো তাদের কোন প্রশিক্ষণ ছিল না, কিন্তু দেশের মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোকে নিজেদের কর্তব্য মনে করেই ওরা সেদিন এগিয়ে গিয়েছিল।

এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফেরাতে এসে আজ অবধি বহু সেনা সদস্য মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হয়ে, সাপের কামড়ে কিংবা বন্য জন্তুর আক্রমনে নিহত হয়েছেন। কেউ কেউ আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।

দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীর বেশকিছু সদস্য পাহাড়ের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে সশস্ত্র আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। বহু সেনা সদস্য আহত হয়েছেন।

সর্বোপরি, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে এ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত সবসময়ে বাংলাদেশের মানুষ তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের আপদে/বিপদে সেনাবাহিনীর সদস্যদেরকে কোন না কোনভাবে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে যেতে দেখা গেছে, এমন ঘটনা অসংখ্যবার ঘটেছে।

তারপরেও কাদের স্বার্থে, কাদের মদতে পাহাড়ে সন্ত্রাসবাদ চলছে? এই প্রশ্নে সঠিক উত্তর পাহাড়ে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষকে জানতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে পাহাড়ে সন্ত্রাসবাদের নেপথ্য কারণ। এবং সম্মিলিতভাবে সন্ত্রাসের মূলোৎপাটন করে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের পথে পার্বত্য চট্টগ্রামের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে আর সুদৃঢ় করতে হবে জাতীয় নিরাপত্তা।

আবুল খায়ের মোহাম্মদ, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম

ভাসানচর- এক টুকরো পরিকল্পিত বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ সাময়িক আশ্রয়



ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও দমন অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ শুরু থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।এই প্রক্রিয়া এখনও শুরু না হওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতিতে সামিয়কভাবে রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে থাকতে পারে, সে কারণে ভাসানচরে তাদের জন্য নতুন ঘরবাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে।

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ বিপর্যয় এবং কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরগুলো থেকে চাপ কমাতে বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে যা একটি দূরদর্শী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ।

জাতিসংঘ শুরুতে এর বিরোধিতা করেছিল এবং ২০১৯ সালের মার্চ মাসে, জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক তদন্তকারী কর্মকর্তা জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া ২৩ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার পরকিল্পনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছিল যে, এই দ্বীপ মানুষের বসবাসের উপযোগী হতে পারে না। রোহিঙ্গাদের সেখানে সরিয়ে নেওয়া হলে তা নতুন সঙ্কট তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের ১৮ সদস্যের একটি দলকে ভাসানচরে চার দিনের সফরে নিয়ে যায়। সেখানকার উন্নয়ন কার্যক্রম সরেজমিনে দেখার পর জাতিসংঘ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের ‘মানবিক সহায়তা ও সুরক্ষার চাহিদার’ স্বীকৃতি দেয় এবং ভবিষ্যতের অপারেশনাল কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করতে সম্মত হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালের ১৮ মে, ইউএনএইচসিআর এবংআন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শন করে সেখানকার পরিস্থিতি, সুযোগ-সুবিধা এবংসার্বিক অবস্থাস ম্পর্কে অবগত হয়।

পরিদর্শন শেষে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে ইউএনএইচসিআর ৯ অক্টোবর ২০২১, একটি সমঝোতা স্মারকে সই করে। চুক্তি অনুযায়ী, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও পুষ্টি, সুপেয় পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, চিকিৎসা, মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম ও ভাষায় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং জীবিকা সংস্থানের ব্যবস্থা করতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘ যৌথভাবে কাজ করতে সম্মত হয়। জাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তির পর ভাসানচরে বিদেশি অর্থায়ন শুরু হয়েছে।বর্তমানে ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের জীবন ও জীবিকা স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের সঙ্গে ইউএনএইচসিআর, ডব্লিউ এফ পি ও অন্যান্য এন জি ও সেখানে তাদের কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনা করছে।

কক্সবাজার থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ সরকার আশ্রয়ণ-৩ নামের এই প্রকল্প হাতে নেয় এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। নৌ বাহিনী সফলতার সাথে এই প্রকল্প সম্পন্ন করে। প্রকল্পে রোহিঙ্গাদের জন্য বসবাসের জন্য ১২০টি ক্লাস্টার এবং ১২০টি শেলটার স্টেশন রয়েছে। ভাসানচরের ক্লাস্টার হাউজ ও শেল্টার স্টেশনগুলো ভূমি থেকে চার ফুট উঁচু করে কংক্রিটের ব্লক দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে আছে ১২টি হাউজ। এখানে সব মিলিয়ে ১,৪৪০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ঘরে ১৬টি কক্ষ রয়েছে এবংপ্রতিটি কক্ষে দুটো ডাবল বাঙ্কার বা দোতলা খাট আছে যাতে একটি পরিবারের চারজন থাকতে পারে। পরিবারে সদস্য সংখ্যা চারজনের বেশি হলে তাদের জন্য দুটো কক্ষ বরাদ্দ করার ব্যবস্থা রয়েছে। জাতিসংঘের আদর্শ মান অনুযায়ী আবাসনের ক্ষেত্রে মাথাপিছু ৩৭ বর্গফুট জায়গা দরকার, এসব কক্ষে তার চেয়ে বেশি জায়গা রাখা হয়েছে। প্রতি ৮টি কক্ষের জন্য তিনটি টয়লেট এবং দু'টি গোসলখানা রয়েছে, নারী-পুরুষদের জন্য রয়েছে আলাদা গোসলখানা ও টয়লেট। রান্নার জন্য প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি করে চুলার জায়গা বরাদ্দ করা আছে।সেখানে সিলিন্ডারে এল পি জি গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।রান্নায় গ্যাস সাশ্রয়ের জন্য একটা এন জি ও বিশেষ বাক্সের ব্যবস্থা করছে। রান্নাঘর, গোসলখানা এবং টয়লেটে পানির সরবরাহ রয়েছে। প্রতিটি হাউজের ওপরে রয়েছে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল।

প্রতিটি ক্লাস্টারের জন্য আছে একটি করে শেল্টার স্টেশন। ভাসানচরে বড় ধরনের ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা মোকাবিলায় গত ১৭১ বছরের ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ভাসানচরে পাঁচ তলা বিশিষ্ট ১২০টি শেল্টার স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার গতিবেগের ঘূর্ণিঝড় হলেও টিকে থাকতে সক্ষম এই শেলটার স্টেশন। ভাসানচরে কর্মরত ইউএনএইচসিআর ও আরআরআরসি’র প্রতিনিধি জানায় যে, কিছুদিন আগে সাইক্লোন মোখার সময় দুই ঘণ্টার মধ্যে ভাসানচরের সবাইকে সাইক্লোন শেল্টারে নেওয়া হয়েছিল, এবং তারা সবাই নিরাপদ ছিল, এটা ভাসানচরের জন্য একটা বড় অর্জন।

ভাসানচরে শিশুদের জন্য দুটি খেলার মাঠ, এতিমখানা, ডে-কেয়ার, সুপারশপ, সেলুন, মসজিদ ও বাজার আছে। সেসব বাজারে নোয়াখালী হাতিয়া ও অন্যান্য জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে ব্যবসা করছে এবং প্রায় সব প্রয়োজনীয় জিনিস সেখানে পাওয়া যায়। প্রকল্প এলাকায় পুকুর এবং লেক কাটা হয়েছে। রোহিঙ্গারা এখানে মাছ ধরে এবং এখানে মাছের চাষ হচ্ছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে ও ১০ ফুট গভীর একটি পুকুর আছে। এসব পুকুরের পানি গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিটি ক্লাস্টার একই আকৃতিতে বানানো হয়েছে, এখানকার সব ঘর দেখতে একই রকম। ঘরের পাশের অল্প ফাঁকা জায়গায় মহিলারা শাক সবজি চাষ করছে। প্রতিটি ঘরের সামনে ২০ থেকে ২৫ ফুট চওড়া পাকা রাস্তা রয়েছে। বাংলাদেশের সব গ্রামে এত সুন্দর মজবুত ও পরিচ্ছন্ন রাস্তা দেখা যায় না। প্রকল্পের ভেতরে পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় সংরক্ষণাগার আছে। এনজিওদের তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গারা সমস্ত আবর্জনা সেখানে এনে জমা করছে। এর ফলে এলাকা পরিচ্ছন্ন থাকছে এবং এই আবর্জনা থেকে জৈব সার তৈরি করে তা কৃষি জমিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাসান চরে ৪৩২ একর জমিতেরোহিঙ্গাদের আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনানির্মিতহয়েছে।ভবিষ্যতে প্রকল্পের সম্প্রসারণ ও বনায়নের জন্য বাঁধের ভেতর ৯১৮ একর এলাকা খালি রাখা হয়েছে।

ভাসানচরে দুটি ২০ শয্যার হাসপাতাল এবং চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। প্রকল্প এলাকায় সরকারি কর্মকর্তা, জাতিসংঘ প্রতিনিধি, আরআরআরসি প্রতিনিধি, রেডক্রস, আন্তর্জাতিক এনজিও প্রতিনিধি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্যও আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য যেসব ঘর নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর তুলনায় অনেক টেকসই ও উন্নতমানের। কক্সবাজারের ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ঘরগুলোতে বিদ্যুতের সরবরাহ না থাকলেও ভাসানচরে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে আলোর ব্যবস্থা রয়েছে।

ভাসানচরে জোয়ার ও জলোচ্ছাসের ঝুঁকি থেকে নিরাপদ করতে ১৭০২ একর জমির চারপাশে ৯ ফুট উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই বাঁধ ১৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু করা হবে। ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে তীর রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সমুদ্রের যে পাশ থেকে ঢেউ চরে আঘাত করে, সেই পাশেই শোর প্রোটেকশন দেওয়া হয়েছে। শোর প্রোটেকশন থেকে ৫০০ মিটার ভেতরে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। অনেক শক্তিশালী ঝড় এই চরের উপর দিয়ে গেলে ও মানুষের জীবন বিপন্ন হবে না।

১৩,০০০ একরের এই দ্বীপে সারাবছর সুপেয় পানি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, কৃষি জমি, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, দুটি হাসপাতাল, চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদ, গুদামঘর, টেলিযোগাযোগ পরিষেবা, একটি পুলিশ স্টেশন, বিনোদন ও শিক্ষা কেন্দ্র, খেলার মাঠ এবং আরও অনেক কিছু রয়েছে।ভাসানচরে ডব্লিউএফপি খাদ্য সহযোগিতা দিচ্ছে, পাইলট প্রকল্প আকারে ই ভাউচারের মাধ্যমে এখন ৫০০০ রোহিঙ্গা কে খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতে সবাইকে এই সুবিধার আওতায় আনা হবে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলি থেকে রোহিঙ্গাদেরকে ভাসানচরে স্থানান্তরিত করা শুরু হয়। ভাসানচরে আসা রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের চেয়ে ভাসানচরে নিরাপদ আর স্বস্তিতে আছে। স্বাস্থ্যসেবাসহ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আধুনিক সুযোগ-সুবিধাগুলি রয়েছে যা বাংলাদেশের সব জায়গায় পাওয়া যাবে না।

রোহিঙ্গারা বর্তমানে ভাসানচরের জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও কক্সবাজারের নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্তির সুবাতাস হিসেবে দেখছে। ভোর থেকেই ভাসানচরে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়ে যায়। রোহিঙ্গাদের কেউ সাগরে কিংবা চরের ভেতরের পুকুর বা লেকে মাছ ধরতে যায়। কেউ ভ্যান কিংবা রিকশা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। কেউ তাদের জন্য বরাদ্দ কৃষি জমিতে চাষ করতে চলে আসে। কিছু রোহিঙ্গা তাদের পশুদের চড়াতে বের হয়। এক সময়ে জাতিসংঘ ও অন্যান্য দাতা সংস্থা যে ভাসানচরের উপর তাদের আস্থা রাখতে পারেনি আজ সেখানেই নিরাপদে উন্নত পরিবেশে বসবাস করছে রোহিঙ্গারা যা বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।

ভাসানচরে রোহিঙ্গারা এখন গবাদিপশু লালন পালন, মাছধরা ও চাষাবাদের মত জীবিকা নির্বাহের সুযোগ আছে। ভাসানচরে কাজ করা এনজিওগুলো সেলাই, পাটজাত পণ্য তৈরি, ব্লকের কাজ, স্কিন প্রিন্ট, সূচিকর্ম এবং আরও অন্যান্য ভোকেশনাল ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছে। এখানে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জীবিকার নিশ্চয়তা, মৌলিক অধিকার নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা হচ্ছে। ভাসানচরের স্কুলগুলো এখন কলরব মুখর, শিশুরা সকাল বেলা সেখানে যাচ্ছে এবং সামনে তাদের কেন্দ্রিয়ভাবে পরীক্ষা নেওয়া হবে পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য। ভাসানচরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের ভাষায় পাঠ্যক্রম অনুসরণ, দক্ষতা বৃদ্ধি কার্যক্রম ও জীবিকা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে।

সবশেষে বলা যায় যে, পরিকল্পিতভাবে নির্মিত এক টুকরো বাংলাদেশ এই ভাসানচর যা এখন রোহিঙ্গাদের নিরাপদ সাময়িক আশ্রয়।

;

সোনায় অযৌক্তিক ভ্যাটে বিদেশমুখী ক্রেতা



রিপুনুল হাসান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

পুত্র-সন্তানের বিয়ের সময় উপহার দেওয়ার জন্য ডায়মন্ড ও গোল্ডের অর্নামেন্ট কেনার জন্য প্রতি বছর বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক বিত্তবান ও সম্পদশালী ভারতে যান। সেখান থেকে নতুন নতুন ডিজাইনের পাশাপাশি সাশ্রয়ী দামে সব গহনা কিনে আনেন। শুধু ভারতেই যান না। বাংলাদেশিরা সোনার গহনা কিনতে দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া যান। আর প্রবাসীরা যে দেশে থাকেন সেখান থেকে দেশে ফেরার সময় সোনার সোনার গহনা নিয়ে আসেন। প্রতি বছর সোনার গহনা রফতানি করে বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে ভারত। তারপরও তারা দেশের ভোক্তার প্রতি বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কোন ভাবেই ভারতীয় ক্রেতারা সোনার গহনা ও ডায়মন্ড কিনতে বিদেশ না যায়। জুয়েলারী ব্যবসার ক্ষেত্রে সোনা, সোনার অলংকার, রূপা বা রূপার অলংকার বিক্রির ক্ষেত্রে আরোপিত ভ্যাট হার ৩ শতাংশ। ভারতের সোনার বাজার এবং অর্থনীতির তুলনায় আমাদের দেশে বিক্রি ও ক্রেতার পরিমাণ বেশি না। তারপরও আমাদের ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ। ক্রেতারা বলছেন, ৫ শতাংশ ভ্যাট অযৌক্তিক। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তুলনা করলে এটা আমাদের জন্য বেশি।

ভোক্তাদের বিদেশমুখী বন্ধ করতে হলে প্রতিযোগীতামুলক ভ্যাটের হার নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিবেশি দেশটির এত বড় বাজার হওয়ার পর ক্রেতাদের জন্য ভ্যাট মাত্র ৩ শতাংশ। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করতে জুয়েলারি খাতে আরোপিত শুল্ককর ও ভ্যাট হার কমানো এবং আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করতে হবে। এতে যেমন সরকারের বৈদেশিক আয় আসবে। তেমনি বাড়বে রাজস্ব আয়। বিপুল পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি খাত তৈরি হবে। বর্তমানে জুয়েলারী ব্যবসার ক্ষেত্রে সোনা, সোনার অলংকার, রূপা বা রূপার অলংকার বিক্রির ক্ষেত্রে আরোপিত ভ্যাট হার ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হোক। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি এবং ডলারের বিনিময় মূল্যের কারণে ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম বা প্রতি এক ভরি ২২ ক্যারেট সোনার মূল্য ৯৯ হাজার ১৪৪ টাকা। এরসঙ্গে নূন্যতম মজুরি ৩ হাজার ৪৯৯ টাকা। তারসঙ্গে নির্ধারিত ৫ শতাংশ হারে বা ৫ হাজার ১৩২ টাকা ভ্যাট যুক্ত হলে, মোট মূল্য হয় ১ লাখ ৭ হাজার ৭৭৫ টাকা। বাংলাদেশে প্রতি ভরিতে ভ্যাট দিতে হয় ৫ হাজার ১৩২ টাকা। অন্যদিকে ভারতে সমপরিমান সোনার অলঙ্কার কিনতে ৩ শতাংশ হারে বা ২ হাজার ৭৯১ টাকা ভ্যাট দিতে হয়। যার প্রভাব স্বর্ণালংকার ক্রয় ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সু¯পষ্ট বিদ্যমান। অথচ বাংলাদেশের অলংকার শিল্পের অপার সম্ভাবনা আছে। ভ্যাট আহরণে আগামী দিনে সরকারের একটি বড় খাত হতে পারে জুয়েলারী শিল্প। এক্ষেত্রে ক্রেতাদের কাছে সহনীয় আকারে ভ্যাট নির্ধারণ করা জরুরি। বাজুস মনে করে সোনা একটি মূল্যবান ও ¯পর্শকাতর ধাতু হওয়ায় মোট বিক্রয়ের উপর ভ্যাট হার ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা দরকার। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিমান আরও বাড়বে।

ভ্যাট হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে- বাংলাদেশের ক্রেতারা যেন বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে অলংকার ক্রয়ে নিরুৎসাহিত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন সময়ে উচ্চবিত্তদের একটা বড় অংশই বিদেশে গিয়ে অলংকার ক্রয় করে থাকেন। যার অন্যতম কারণ আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে আমাদের স্থানীয় বাজারের সাথে দামের পার্থক্য। যার কারণে যাদের সামর্থ্য থাকে একসাথে বেশী পরিমাণে সোনা ক্রয় করার, তারা বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে বা আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে ব্যাগেজ রুলের অপব্যবহার করে দেশে সোনা আনছেন। এতে একদিকে যেমন দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে সরকার প্রত্যাশিত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার দেশে যারা কেনাকাটা করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ করহারের কারণে ভ্যাট প্রদানে অনীহা প্রকাশ করে থাকেন। এতে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েন। আবার জুয়েলারি পণ্য রফতানি সম্ভব হচ্ছে না।

সরকারের প্রাথমিক হিসাবে বাংলাদেশের সোনার বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৪০ টন। তবে প্রকৃত চাহিদা নিরুপণে সরকারের সমীক্ষা প্রয়োজন। বৈধভাবে সোনার চাহিদা পূরণ করার ক্ষেত্রে বড় বাঁধা কাঁচামালের উচ্চ মূল্য, অতিরিক্ত উৎপাদন ব্যয়, শিল্প সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির উচ্চ আমদানি শুল্ক। বর্তমানে জুয়েলারি শিল্পের প্রায় সকল ধরণের পণ্য ও যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ। যা স্থানীয় অন্যান্য শিল্পে আরোপিত শুল্কের চেয়ে অনেক বেশি। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। পাশাপাশি ৫ শতাংশ হারে উচ্চ ভ্যাট হার ও অতিরিক্ত উৎপাদন খরচের কারণে ভোক্তা পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দামের পার্থক্য হচ্ছে। এতে ক্রেতা হারাচ্ছেন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন ছোট ছোট জুয়েলারী ব্যবসায়ী।

বাংলাদেশের মহান স্থাপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণে ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ভিশন ২০৪১ সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাজুসের প্রেসিডেন্ট জনাব সায়েম সোবহান আনভীরের নেতৃত্বে আমরা বদ্ধ পরিকর। আগামী দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জাগরণ তুলবে চায় জুয়েলারি শিল্প। বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ্যভাবে জুয়েলারি শিল্পে আনুমানিক ৪৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। আগামীতে এই শিল্পে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে জুয়েলারি শিল্পে ভ্যালু এডিশন করে সোনার অলঙ্কার রফতানি সম্ভব। দুবাই যেমন সোনার ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও এই সম্ভাবনা রয়েছে। সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন ছিলো জাতির পিতার। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে জুয়েলারি শিল্পে ৩ শতাংশ ভ্যাট ও করমুক্ত সুবিধা চাই। সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ গড়তে জুয়েলারি শিল্পে সকল সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।

লেখক: রিপুনুল হাসান, ভাইস-প্রেসিডেন্ট-বাজুস

;

কেবিন ক্রু দিবস: কেবিন ক্রু পেশায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশিরাও



মো. কামরুল ইসলাম
ছবি; বার্তা২৪.কম

ছবি; বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

কেবিন সার্ভিস যেকোনো এয়ারলাইন্সের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ডিপার্টমেন্ট। যারা প্রতিদিন বিমান যাত্রীদেরকে সরাসরি সেবা দেয়ার সুযোগ পেয়ে থাকে। একটি এয়ারলাইন্স কোম্পানী যে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান তার পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে সহায়তা করে কেবিন ক্রুরা। প্রতিদিন একটি হাসপাতাল কিংবা অন্যান্য সেবামূলক যেকোনো প্রতিষ্ঠান থেকেও সংখ্যার হিসেবে এয়ারলাইন্স ক্রুরা বেশী যাত্রীদের সেবা দিয়ে থাকে। তাদের মনোভাবটাই থাকে এয়ারলাইন্সের যাত্রীসংখ্যা বৃদ্ধির পিছনে তাদের সেবাই প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে।

দেশ-বিদেশ ভ্রমণ, আজন্ম লালিত স্বপ্নের জাল বুনে থাকে অনেক স্মার্ট-শিক্ষিত নারীরা। যাঁরা আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেন, পাখির মতো আকাশে উড়ে বেড়াতে চান, সারা বিশ্বকে খুব কাছ থেকে দেখতে চান, তাঁদের জন্য কেবিন ক্রুর চাকরি অনেকটা সোনার হরিণের মতো। সারা বিশ্বের প্রত্যেকটি এয়ারলাইন্সের কেবিন ক্রু বা এয়ার হোস্টেজ পদটির অধিকাংশই বরাদ্দ আছে উপরোক্ত গুনাবলীর নারীদের জন্য।

বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি এয়ারলাইন্সের কেবিন ক্রু পদে সবাই বাংলাদেশি এবং অনেক বিদেশি এয়ারলাইন্সও বাংলাদেশি কেবিন ক্রু নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছে। এর পিছনে রয়েছে বিশেষ কারণ বাঙালিরা জাতি হিসেবে খুবই অতিথি পরায়ন। এর পিছনে নারীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কেবিন ক্রুদের এয়ারলাইন্সে চুক্তিবদ্ধ হতে হয়। পরবর্তী সময়ে তা পুন:চুক্তি করার সুযোগ আছে।

প্রত্যেক এয়ারলাইন্সের গন্তব্য বিশ্বের সব বড় বড় শহরে। আকাশ কন্যার চাকরির সুবাদে সব বড় বড় শহর, চিত্তাকর্ষক সব আধুনিক বিমান বন্দর দেখা হয়ে যায়। স্বল্প সময়ের জন্য শহর দেখারও সুযোগ থাকে অনেক সময়। শুধু চোখের কিংবা মনের তৃপ্তি নয়, এখানে আর্থিক স্বচ্ছলতাও একটা বড় ব্যাপার। নির্দিষ্ট বেতনের বাহিরে যত বেশী আকাশ ভ্রমণ তত বেশী উপার্জন। সত্যিই বিচিত্র। প্রতিটি ফ্লাইটে শতাধিক যাত্রীকে সেবা প্রদান আর কোন প্রফেশনে আদৌ সম্ভব নয়। সংখ্যার বিচারে প্রতিমাসে হাজার হাজার যাত্রীকে সেবা দেয়া কোন হাসপাতালেও সম্ভব নয়। প্রতি ফ্লাইটে কত বিচিত্র রকম মানুষের সাথে পরিচয় হয়। যা তার জ্ঞান ভান্ডারকেও করে সমৃদ্ধি।


সাবলীল বাচনভঙ্গী। নজরকাড়া সৌন্দর্য্য। স্বাভাবিক গড় উচ্চতার চেয়ে একটু বেশী। কেবিন ক্রু হওয়ার জন্য যোগ্যতা হিসেবে ন্যূনতম এইচএসসি বা এ লেভেল কিংবা সমমানের হতে হয়। সাধারনত বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছর এর মধ্যে হতে হবে। মেয়েদের জন্য কমপক্ষে ৫ ফুট ২ ইঞ্চি এবং ছেলেদের জন্য ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতা থাকতে হয়, আর ওজন উচ্চতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। চোখের মাপ-৬/৬ (চশমা বা কন্টাক্ট লেন্স গ্রহণযোগ্য নয়)। হাতে কোনো কাটা দাগ কিংবা শরীরে কোনো ট্যাট্টু থাকতে পারবে না, যা সহজে দেখা যায়। সাঁতার জানা আবশ্যক। কোনও কারণে বিমান যদি পানিতে অবতরণ করতে হয় সেজন্য বিমানবালাদের কমপক্ষে ২০ মিটার সাঁতার কাটার সক্ষমতা থাকতে হয়। ইংরেজি ও বাংলায় কথা বলা ও লেখায় দক্ষ হতে হবে, অন্য ভাষা জানা অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে দেখা হয়। সাধারণত বিভিন্ন এয়ারলাইন্স কেবিন ক্রুর জন্য অবিবাহিতদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।

বর্তমানে এয়ার হোস্টেজ বা কেবিন ক্রু পেশা স্মার্ট ও সম্মানজনক হওয়ায় প্রতিনিয়ত প্রবল ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস ও ঝুঁকি গ্রহণের দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে এয়ারলাইন্সগুলোতে ভিড় করছে তরুণ-তরুণীরা। তা ছাড়া এ পেশায় আছে অ্যাডভেঞ্চার, গ্ল্যামার ও উচ্চ আয়ের পন্থা। তাই দিন দিন ক্যারিয়ার হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এ পেশা। সঙ্গে সঙ্গে তরুণদের মাঝে পেশাটি হয়ে উঠেছে প্রতিযোগিতামূলক।

দীর্ঘ প্রস্তুতি না থাকলেও কিছু প্রশিক্ষণ কোর্স করে দেশী ও বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোতে চাকরির সুযোগ নেওয়া যায়। সাফল্যের সঙ্গে এ ক্যারিয়ারে যুক্ত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা। বর্তমানে কেবিন ক্রু প্রশিক্ষণের জন্য কিছু একাডেমী আছে যেখানে প্রাথমিক ধারনা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে এভিয়েশন কলেজ অব ইউনাইটেড, বাংলাদেশ বিমান ট্রেনিং ইন্সটিটিউট, জবস এ-ওয়ান উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে উল্লেখযোগ্য পরিমান কেবিন ক্রু নিয়োগ প্রদান করতে হয়। কারন একটাই বেসরকারি এয়ারলাইন্সের অগ্রগতি।

স্মার্টনেস ও ভালো ইংরেজি বলার দক্ষতা আপনাকে এগিয়ে রাখবে এয়ার হোস্টেজ বা কেবিন ক্রু হওয়ার প্রতিযোগিতায়। কেবিন ক্রু বা এয়ার হোস্টেজ হতে চাইলে অধিক সুন্দর বা সুন্দরী হতে হবে- এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যোগ্যতাই হল আসল কথা। যেকোন ধর্মের ছেলে মেয়েরা আবেদন করতে পারবে। প্রার্থীকে পরিচ্ছন্ন রুচি, মিষ্টি হাসি, অনেকক্ষণ এককভাবে কাজ করার ক্ষমতা, বিরক্তিকর পরিস্থিতে স্বাভাবিক থাকা, উপস্থিত বুদ্ধিজ্ঞান, ধৈর্য্য ও সহনশীলতা, বিপদে সাবলিল মানসিকতা ও সবার সাথে আন্তরিকতার সাথে মিশতে পারার ক্ষমতা এ চাকরিতে সফলতা এনে দেবে। আমাদের দেশের শত শত ছেলেমেয়ে প্রতিদিন উড়ে চলেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।

আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সগুলো কেবিন ক্রুদের বিভিন্ন দেশের বিলাসবহুল হোটেলগুলোয় থাকার ব্যবস্থা করে থাকে, যেখানে থাকা এবং খাওয়া সম্পূর্ণ ফ্রি। শুধু একজন ক্রু'র নিজের জন্যই নয়, তার পরিবারের সদস্যদের জন্যও আছে নানা ধরনের সুবিধা। পরিবারসহ বিভিন্ন দেশে ট্যুর করার সুযোগ হরহামেশাই পাওয়া যায় এই পেশায়।

বিশ্বের বেশিরভাগ এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রু সদস্যদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। যাত্রীদের খাবার পরিবেশন ছাড়াও তাদের নির্দিষ্ট আসন খুঁজে পেতে সহায়তা করা, ওভারহেডে মালপত্র ওঠানামায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, যাত্রীদের কেউ অসুস্থ হলে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করার মতো অনেক দায়িত্ব পালন করেন তারা। সব মিলিয়ে ফ্লাইটের অভ্যন্তরে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় যাত্রীদের নিরাপদে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে তাদের।

কেবিন ক্রুদের মাথার চুল অবশ্যই কাঁধের ওপর পর্যন্ত ছোট রাখা আবশ্যক। চুল লম্বা হলেও সেভাবে সাজিয়ে রাখতে হবে। আর চুলের রঙ হতে হবে স্বাভাবিক। প্রত্যেক ক্রুর হাত ও পায়ের নখ ছোট রাখা বাধ্যতামূলক। অনেক বিদেশি এয়ারলাইন্সে কেবিন ক্রুদের সুন্দর পা থাকাও বাধ্যতামূলক।

আপনার পরিচিত কিংবা আপনার বন্ধুই হয়তো কোন না কোন এয়ারলাইন্সের কেবিন ক্রু তার কাছ থেকেও বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেন, জেনে নিতে পারেন অনেক কিছু। উপরোক্ত গুনাবলী আর অদম্য ইচ্ছা থাকলেই সুদূর পরাহত নয়, আপনিও হয়ে যেতে পারেন কোন এয়ারলাইন্সের আকাশ কন্যা।

আজ ৩১ মে আন্তর্জাতিক কেবিন ক্রু দিবস। কানাডা ইউনিয়নের উদ্যোগে ২০১৫ সালে বিশ্বে প্রথম কেবিন ক্রু দিবস পালন করা হয়। প্রথম ৪৮০ জন কেবিন ক্রু নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটি উদযাপন করা হয়।

কেবিন ক্রু দিবসে বিশ্বের সকল কেবিন ক্রুদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। আপনাদের সেবায় হয়ে উঠুক বিশ্বের আকাশ পরিবহন অনন্য, যেখানে প্রতি পরতে পরতে বিছিয়ে থাকুক শান্তির পরশ।

লেখক: মোঃ কামরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স।

;

বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যাওয়ার কারণ ও পুনরুদ্ধারের উপায়



মো. বজলুর রশিদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন একটি নির্দিষ্ট সমাজের সাংস্কৃতিক প্রতীক এবং সামাজিক নিয়ম দ্বারা বোঝা যায়। বিভিন্ন সমাজ প্রায়শই বয়স্ক ব্যক্তিদের তাদের বয়স এবং জীবনের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে আচরণ সংক্রান্ত নিয়ম এবং প্রত্যাশা স্থাপন করে।

অনেক সমাজের বয়স-ভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে যা ব্যক্তিদের বয়সের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ভূমিকা, অধিকার এবং দায়িত্ব প্রদান করে। বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রায়ই বিশেষ মর্যাদা এবং কর্তৃত্ব দেওয়া হয়, কারণ তারা সময়ের সাথে সাথে জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে বলে দেখা হয়।

প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধাকে আন্তঃপ্রজন্মীয় সংহতির প্রকাশ হিসেবেও দেখা যেতে পারে, যেখানে তরুণ প্রজন্ম বয়স্ক ব্যক্তিদের অবদানকে স্বীকার করে এবং মূল্য দেয়। এই সংহতির অনুভূতি সামাজিক সংহতিকে শক্তিশালী করে এবং একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ধারাবাহিকতা এবং স্থিতিশীলতার ধারণা জাগায়।

প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধার ধারণা বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং সমাজে পরিবর্তিত হতে পারে। কিছু সংস্কৃতি ধার্মিকতা, পিতামাতা এবং গুরুজনদের প্রতি দৃঢ় শ্রদ্ধা এবং আনুগত্যের ওপর জোর দেয়। অন্যান্য সংস্কৃতিতে বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছ থেকে পরামর্শ এবং নির্দেশনা চাওয়ার মাধ্যমে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের জড়িত করে সম্মান প্রকাশ করে থাকে।

এটি লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। শিল্পায়ন, নগরায়ন, বিশ্বায়ন এবং পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন, আন্তঃপ্রজন্মীয় সম্পর্কের গতিশীলতা, ইত্যাদি প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশকে প্রভাবিত করতে পারে।

যদিও প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা সাধারণত একটি ইতিবাচক সামাজিক মূল্য হিসেবে বিবেচিত হয়, তবে এটি স্বীকার করা অপরিহার্য যে ক্ষমতার গতিশীলতা, আর্থিক অসমতা এবং সাংস্কৃতিক পক্ষপাতগুলি এই দৃষ্টিকোণকে প্রভাবিত করতে পারে। সমাজবিজ্ঞানীরা এই বিষয়গুলি অধ্যয়ন করেন এবং নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা কীভাবে প্রকাশ পায় তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন।

বিভিন্ন সময় বলা হয়ে থাকে যে আমাদের দেশে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ কমে যাওয়ার পেছনে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক কারণকে দায়ী করা যেতে পারে। অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক দশকে দ্রুত আধুনিকায়ন ও পশ্চিমাকরণ হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলি প্রবীণদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিসহ প্রথাগত মূল্যবোধ এবং নিয়মের পরিবর্তন ঘটাতে সহায়ক হয়েছে। পশ্চিমা সাংস্কৃতিক প্রভাব, যা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ এবং যুব-কেন্দ্রিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেয় তা প্রবীণদের সম্মান করার অনুভূত গুরুত্ব হ্রাসে অবদান রাখতে পারে।

ঐতিহ্যবাহী বর্ধিত পারিবারিক কাঠামো যেখানে বেশ কয়েকটি প্রজন্ম একসাথে বসবাস করে এবং যেখানে প্রবীণরা অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল- এই ধরনের পরিবারের বিলুপ্তি তাদের মধ্যে দৈনন্দিন মিথস্ক্রিয়া হ্রাস করতে পারে, সম্ভাব্য আন্তঃপ্রজন্মের বন্ধন এবং সম্মানের সুযোগগুলি হ্রাস করতে পারে। একক পরিবারে বাবা-মা ছাড়া শিশুরা আর কোনো সদসস্যের সংস্পর্শে আসতে পারেনা। এ কারণে তাদের মধ্যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ বৃদ্ধি পায় এবং সমাজের অন্যান্য প্রবীণ সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ শেখার জায়গা সংকুচিত হয়।

দ্রুত নগরায়ন এবং বিশ্বায়ন জীবনধারা এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। শহুরে এলাকায় প্রায়ই একটি দ্রুতগতির, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ থাকে যা প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধার ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের চেয়ে ব্যক্তিগত সাফল্য এবং অর্জনকে অগ্রাধিকার দিতে পারে।

অর্থনৈতিক চাপ এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতাও আন্তঃপ্রজন্মের সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, পরিবারের অল্পবয়সী সদস্যরা বড়দের যত্ন এবং সমর্থনের চেয়ে তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিতে পারে, যার ফলে প্রবীণদের সম্মান করার অনুভূত গুরুত্ব হ্রাস পায়।

শিক্ষার বর্ধিত প্রবেশাধিকার এবং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঐতিহ্যগত বিশ্বাস এবং মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। প্রযুক্তির কল্যাণে বিভিন্ন ধারণা এবং দর্শনের সংস্পর্শে আসা তরুণ প্রজন্ম প্রবীণদের সম্মান করাসহ প্রচলিত নিয়মগুলিকে প্রশ্ন বা চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে যদিও কিছু দিক থেকে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা হ্রাস পেতে পারে, বাংলাদেশে অনেক ব্যক্তি এবং সম্প্রদায় এখনও তাদের প্রবীণদের সম্মান করার গুরুত্বকে মূল্য দেয় এবং অগ্রাধিকার দেয়। সামাজিক পরিবর্তনগুলি জটিল এবং বহুমুখী এবং এই ঘটনাটি ব্যাপকভাবে বোঝার জন্য বাংলাদেশি সমাজের মধ্যে নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বিবেচনা করা অপরিহার্য।

বাংলাদেশে বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রর্দশনের বিষয়টি পুনরুদ্ধারের জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন যাতে ব্যক্তি, পরিবার, সম্প্রদায় এবং সরকারসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার জড়িত থাকবে। এখানে কিছু কৌশল রয়েছে যা প্রবীণদের প্রতি সম্মান বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে।

প্রবীণদের সম্মান করার মূল্য এবং গুরুত্ব তুলে ধরে শিক্ষা এবং সচেতনতামূলক প্রচারনা চালানো। এটি সরকারি ঘোষণা, স্কুল পাঠ্যক্রম, কমিউনিটি প্রোগ্রাম এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে করা যেতে পারে। লক্ষ্য হল বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি সন্মানবোধ জানানোর উপলব্ধির অনুভূতি জাগানো।

আন্তঃপ্রজন্মমূলক প্রোগ্রাম এবং ক্রিয়াকলাপগুলিকে উৎসাহিত করা যা তরুণ এবং বয়স্ক প্রজন্মকে একত্রিত করে। যেখানে মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম, সম্প্রদায় পরিষেবা উদ্যোগ, বা সাংস্কৃতিক বিনিময় অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এই প্রোগ্রামগুলি তরুণ প্রজন্মের প্রবীণদের কাছ থেকে শিখতে এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়া বিকাশের অনুমতি দেয়।

পরিবার এবং সম্প্রদায়কে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে উৎসাহিত করা। এটি আন্তঃপ্রজন্মগত সম্পর্কের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে, প্রজন্মের মধ্যে যোগাযোগের প্রচার এবং সক্রিয় শ্রবণ এবং পরিবার ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সহায়তা ব্যবস্থা প্রদান করে অর্জন করা যেতে পারে।

বয়স্ক ব্যক্তিদের অধিকার এবং কল্যাণ রক্ষা করে এমন নীতি এবং আইন তৈরি করা। এতে বয়স্কদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যসেবা বিধান এবং আন্তঃপ্রজন্মমূলক কর্মসূচির জন্য সমর্থন অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। একটি ব্যাপক আইনি কাঠামো এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে যা বয়স্ক ব্যক্তিদের মূল্যায়ন করে এবং সম্মান করে।

প্রবীণদের অবদান এবং জ্ঞানকে তুলে ধরে সাংস্কৃতিক উদযাপন এবং ঐতিহ্যের প্রচার করা। এতে উৎসব, গল্প বলার সেশন এবং স্বীকৃতি অনুষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তিদের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য প্রদর্শন করা তাদের মূল্যবোধকে শক্তিশালী করে এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ায়।

বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য পর্যাপ্ত সামাজিক পরিষেবা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সহায়তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এতে স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা, প্রবীণ-বান্ধব অবকাঠামো, এবং তাদের প্রয়োজনগুলিকে সমাধান করার জন্য সামাজিক কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। বয়স্ক ব্যক্তিদের ব্যবহারিক চাহিদা পূরণ করা ও তাদের প্রতি যত্ন ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার জন্য সকলকে উৎসাহিত করা।

গণমাধ্যমে বয়স্ক ব্যক্তিদের ইতিবাচক এবং সম্মানজনক প্রতিনিধিত্বকে উৎসাহিত করা। গণমাধ্যম সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং উপলব্ধি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণমাধ্যমে এমন সব বিষয় প্রচার করা যা বয়স্ক ব্যক্তিদের সমাজে মূল্যবান অবদানকারী হিসাবে চিত্রিত করে এবং নেতিবাচক ধারণাগুলিকে চ্যালেঞ্জ করে।

এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান পুনরুদ্ধার করা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া যার জন্য সমাজের সকল সদস্যের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বয়স্ক ব্যক্তিদের জ্ঞান এবং অবদানকে মূল্যায়ন করে এবং সম্মান করে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করার জন্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, সাংস্কৃতিক অনুশীলন এবং নীতির পরিবর্তন প্রয়োজন।

মো. বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

;