আবাসন খাতের উদ্যোক্তাদের দিকে নজর দেওয়া হোক
ক্রমবর্ধমান শহরায়ন ও নাগরিক জীবনে বসবাসের উপযোগী মানসম্পন্ন বাসস্থান নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে দেশের আবাসন শিল্প। স্বল্প জায়গায় কীভাবে বেশি মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যায় সেই ভাবনা থেকে নানা সংকট ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও অনেক দুর এগিয়ে গেছে আবাসন খাত।
তবে দিন দিন যেভাবে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ছে তাতে একটা সময় আসবে যখন আবাসন ক্রয় ক্ষমতা সাধারণ মানুষের আর্থিক সক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। নতুন করে দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে নির্মাণসামগ্রীর উচ্চমূল্য। এতে ফ্ল্যাটের দাম আরও বেড়ে দ্বিগুন হয়ে যাবে। দেশের হাজার হাজার প্রকৌশলী, স্থাপত্য, সিমেন্ট শিল্প, রি-রোলিং মিলস, ইট ভাটা, বালু, টাইলস-সিরামিক, পাথর, পরিবহন, পাইপ, ফিটিংস, ক্যাবলস, কাঁচ, অ্যালুমিনিয়াম ফিটিংসসহ বিভিন্ন সেক্টরের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে স্থবিরতা চলে আসবে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ এখাতের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানসহ কোটি মানুষের আবাসন চাহিদা পূরণে সরকারের সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনার বিকল্প নেই। যদিও দেশের অন্যতম উদীয়মানখাত হিসেবে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু নীতিগত সিদ্ধান্ত দিলেই হবে না, বিনিয়োগকারী বা ক্রেতা-বিক্রেতাদের হয়রানি, ঝুঁকি ও আস্থা ফিরিয়ে আনার বাস্তব উদ্যোগও নিতে হবে সরকারকে।
দিনদিন যেভাবে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আবাসন নির্মাণখাতের একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আমি শঙ্কিত। কারণ তিনমাসের ব্যবধানে চলতি বছরের মার্চে আবাসনখাতে ব্যবহৃত প্রধান প্রধান কাঁচামালের দাম বেড়েছে গড়ে ২৫ শতাংশ। প্রধান উপকরণ রডের দাম প্রতিটনে ২০ শতাংশ বেড়ে দাড়িয়েছে প্রায় ৮৩ হাজার টাকা। এক বছর আগে ছিল ৬৮ হাজার ৫শ টাকা। ৫০ কেজির বস্তা সিমেন্টের দাম ১০ শতাংশ বেড়ে দাড়িয়েছে ৪০৪ টাকায়। গেলো বছরের মার্চে ছিল ৩৬৮ টাকা। পাথরের দাম ২৯ শতাংশ বেড়ে প্রতি স্কয়ার ফুটের দাম হয়েছে ২১৩ টাকা। ২০২১ সালের মার্চে দাম ছিল ১৬৫ টাকা। ফ্লোর টাইলসের দাম প্রতি স্কয়ার ফুটের দাম ২৪ শতাংশ বেড়ে দাড়িয়েছে ১৪০ টাকা। আগের বছরের একই সময়ে দাম ছিল ১১৩ টাকা। স্যানিটারি আইটেমের দাম ২১ শতাংশ বেড়ে দাড়িয়েছে ৯০ টাকায়। গেলো বছরের মার্চে দাম ছিল ৭০ টাকা। বৈদ্যুতিক তারের দাম ১৮শতাংশ বেড়ে দাড়িয়েছে ৯০ টাকায়। আগের বছরের একই সময় দাম ছিল ৭৬ টাকা। তিনমাস আগে থাই অ্যালুমিনিয়ামের দাম বেড়েছে প্রতি স্কয়ার ফুটে ২৮ শতাংশ। বর্তমানে প্রতি স্কয়ার ফুট থাই অ্যালুমিনিয়াম বিক্রি হচ্ছে ৫০৫ টাকায়। ২০২১ সালের মার্চে দাম ছিল ৩৯৬ টাকা।
২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে সরকারি কর্মচারীদের ৫ শতাংশ সুদে গৃহঋণ দেওয়ার ঘোষণা আসার পর ধীরে ধীরে আবাসন ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। করোনার ধাক্কায় ২০২০সালের শুরুর দিকে আবার সংকটে পড়ে আবাসন খাত। পরবর্তীতে করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে ব্যবসা বাড়তে শুরু করে। তবে নতুন করে আবাসন ব্যবসায় সংকট তৈরি করেছে নির্মাণ সামগ্রীর অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি পাওয়ায়। বিশেষ করে রড ও সিমেন্টের দাম বেড়ে দ্বিগুন হয়েছে। আগে প্রতিটন রডের দাম ছিল ৫৫ থেকে ৫৬ হাজার টাকা। এখন সেই রডের দাম হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার টাকা। একই ভাবে বেড়েছে সিমেন্টের দাম। ৫০ কেজির প্রতিবস্তা সিমেন্টের দাম ছিল ৩৭০ টাকা। দাম বেড়ে দাড়িয়েছে ৪০০ টাকা উপরে। স্থবির হয়ে গেছে নির্মারণ কাজ। দাম বাড়ার আগে ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুট জায়গা বিক্রি হতো ৭ হাজার টাকায়। নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ায় নির্মাণ ব্যয় বেড়ে এখন দ্বিগুন হয়েছে। আগে নির্মাণাধীন হাউজিং প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগের ভবিষ্যত নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ার আগে যেদামে ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে, এখন দাম বাড়ায় তাতে মুনাফা দুরে থাক, উল্টো লোকসানে পড়তে হবে।
আবাসনখাতে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ রাখার কথা বলা হলেও দুর্নীতি দমন কমিশন, আয়কর বিভাগসহ সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকায় হয়রানি ও বিড়ম্বনার ভয়ে বিনিয়োগকারীরা আস্থা রাখতে পারছে না বলে অভিযোগ আছে। আবাসন খাতে ব্যাংক ঋণে জটিলতা, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগে অনিশ্চয়তা, সময়ক্ষেপণ ও নানাবিধ ভোগান্তির ঘটনাও ঘটছে।
সরকার বিভিন্নখাতের উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকিসহ অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তবে আবাসন খাতের সংকট নিরসনে কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। একযুগেও সরকারের উল্লেখযোগ্য কোন পরিকল্পনা নেই, যাতে আবাসন খাতের উদ্যোক্তা ও গ্রাহকরা কিছুটা আশার আলো দেখতে পাবে। আমরা নির্মাণ সামগ্রীর দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। যাতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব বিভাগীয় শহরগুলোর আবাসান সমস্যা সমাধান কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারি।
লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জেসিএক্স ডেভেলপমেন্টস লিমিটেড