বাংলায় একাডেমিক চৌর্যবৃত্তি রোধে সফটওয়্যার চাই



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ইংরেজি বা অন্যান্য বহুল ব্যবহৃত ভাষায় একাডেমিক নকল বা চৌর্যবৃত্তি যাচাই করার কম্পিউটার প্রযুক্তি তৈরি হয়েছে এবং সেগুলা ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় এ্যন্টি-প্লেজারিজম সফটওয়্যার বা বাংলায় লেখা পান্ডুলিপির আসল-নকল যাচাই করার জন্য কোনরূপ কম্পিউটার প্রযুক্তি অথবা সফটওয়্যার এখনও চালু হয়নি।

বাংলাভাষার জন্য আত্মত্যাগের বিরল ঘটনা স্মরণে রাখতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করায় আমরা বিশ্ব দরবারে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছি। এজন্য আমরা এখন গর্বিত। কিন্তু কোথায় যেন বাংলাভাষার প্রতি চরম অবহেলার পাখা গজাতে সাহায্য করা হচ্ছে। যার জন্য দিন দিন আমরা দ্রুতলয়ে সামনে চলতে গিয়ে বার বার হোঁচট খাচ্ছি এবং ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছি। আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চ্চা এখনও বিদেশি ভাষা নির্ভর। তাই অনেক কিছুই অব্যক্ত ও অজানা থেকে যাচ্ছে। বিদেশী ভাষা নির্ভরতার কারণে আমাদের জ্ঞান ক্রমশ বিশ্ব সমাজে মূল্য হারাচ্ছে।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় হযবরল অবস্থা এই দুর্বল দিকে প্রতি সহজেই তর্জনী নির্দেশ করে। পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট একটি দেশের অধিকারী আমরা। কিন্তু জনসংখ্যায় বিরাট বড় দেশের দাবি রাখি। এখানে অনেক মানুষ, ছত্রিশটি উপজাতিসহ বহুভাষাভাষি মানুষজনের বাস। কিন্তু শতকরা ৯৮% মানুষের মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা বাংলা। তবে আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট হলেও এদেশের প্রায় সকল মানুষই সবার মুখের বাংলা বলাটা বোঝে ও বাংলায় লিখতে-পড়তে জানে, টিভি দেখে। পাবলিক পরীক্ষায় দেশের সকল শিক্ষার্থীকে একটি আবশ্যিক বাংলাকোর্সের বই পড়ে পরীক্ষা দিতে হয়। তবে এদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় এখনও অনেক বৈসাদৃশ্য থাকায় সর্বস্তরে বাংলাভাষা শেখা ও এর ব্যবহার করা দিন দিন বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে। এই বৈসাদৃশ্যের প্রধান অন্তরায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। একটি ছোট দেশে একসংগে ১১ ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকাটা এই সমস্যাকে জিইয়ে রেখেছে।

আমরা এমন একটি পর্যায়ে চলে গিয়েছি যে, মঞ্চে উঠে কেউ হিন্দি, আরবী বা ইংরেজিতে গান গাইলে বা কথা বললে তাকে বেশী বাহবা দিই। চাকরির ভাইভা বোর্ডে ইংরেজিতে প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে তাকে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। এই বৈপরিত্য আজকাল ঘরে-বাইরে সব জায়গায় লক্ষ্যণীয়। মনে করা হয় ইংরেজিতে কথা বলতে না পারলে তার লেখাপড়াই বৃথা। তা হবে কেন? তাহলে জাপান, ফ্রান্স, চীন, জার্মানি, কোরীয়া, স্পেন, ইতালি এর কীভাবে উন্নত হলো? এসব দেশে শিশুশ্রেণি থেকে পিএইডি গবেষণা পর্যন্ত নিজ নিজ মাতৃভাষায় করানো হয়ে থাকে। সেসব দেশে বিদেশি কেউ স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গেলে সর্বাগ্রে ওদের মাতৃভাষা শিখিয়ে দেয়া হয়। তারপর এন্ট্রান্স বা ভর্তি পরীক্ষায় ওদের নিজ মাতৃভাষা বিষয়ে উত্তীর্ণ হতে না পারলে সেখানে পড়া বা গবেষণার সুযোগ দেয়া হয় না। সে যতবড় ইংরেজি ভাষার বিদ্বান হোক না কেন তাকে এন্ট্রান্সে ওদের মাতৃভাষায় পাশ করতেই হবে। এটাই নিয়ম। তাদের ভাষা শিখে তাদের কৃষ্টি ও জীবন প্রণালীর সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য এই আবশ্যিক ব্যবস্থা তারা চালু রেখেছে। এজন্য বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়তি অর্থ ব্যয় করে তারা এবং এক থেকে দুবছরের বেশি সময় বরাদ্দ দেয়া হয়। এভাবে তারা নিজেদের মাতৃভাষাকে বিশ্বদরবারে আরো বেশি পরিমাণে বিকাশ লাভের সুযোগ করে দেয়ায় সেগুলোর ব্যাপ্তি ঘটছে।

আর আমরা বাংলাকে বাদ দিয়ে শিশুকাল থেকে কিন্ডারগার্টেনের নামে প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজি শেখার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছি। সেখানে অধিকাংশ শিক্ষকরাই তো ঠিকমতো ইংরেজি জানে না। বাচ্চাদের শেখাবে কী? এছাড়া প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনার নামে যেসব পাঠদান করানো হয় বাংলায় স্কুল-কলেজ ডিঙ্গিয়ে আসা শিক্ষার্থীদের দ্বারা তার  যথার্থ পাঠোদ্ধার  করে পরীক্ষা দেয়াটাই তো বেশ কঠিন। এরা অনেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পেয়ে সেখানে ভর্তি হয়। তাদের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ণ যদি কেউ করে থাকেন তাহলে আমার চেয়ে ভাল বলতে পারবেন যে তারা চার চার পাওযার যোগ্য কি-না। অথচ তাদের সনদ ও ট্রান্সক্রিপ্ট ক্রেডিটে বেশ ভারী হয়ে উঠে। মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা ও অনাদরে এরা একটা বিশেষ শ্রেণিতে পরিণত হয়ে যায়। যাদের ইনডিজিনাস জ্ঞানের গভীরতা জন্মায় না ফলে দেশজ মায়া-মমতার প্রতি তাদের আকর্ষণ থাকে না। তারা সুযোগ খুঁজে বিদেশে চলে যাবার। এবং অভিভাবকের অর্থের জোরে স্কলারশীপ ছাড়াই বিদেশে চলে যেতে পারে এবং চলেও যায় তাদের গন্তব্যে।

এর ফলে দেশের সম্পদ দেশের কাজে লাগে না। বরং তাদের বিদেশে পড়াশুনার অর্থ জোগাতে দেশে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিপুল পরিমাণে অবৈধ কালো টাকা প্রয়োজন জন্মে। তা বিভিন্ন উপায়ে উপার্জিত হয় ও তা অবৈধভাবে পাচার হয়ে যায়। এর কোন সরকারি পরিসংখ্যান আমাদের জানামতে নেই। যারা দেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় রত তাদের বিরাট অংশ বাংলা মাধ্যমে পড়াশুনা করেন। তাদের অনেকের কোন স্কলারপিপ থাকে না। আর্থিক চাপে অনেকে গবেষণায় অমনোযোগী হয়ে উঠেন। আমাদের দেশে পরীক্ষায় নকল, অসদুপায় অবলম্বন করা একটি সামাজিক ব্যাধি। দুর্নীতি, জালিয়াতি, চুরি ডাকাতি ইত্যাদি আমাদের মজ্জাগত ও মানসিক ব্যাপার। এদেশে যার যত বেশী সম্পদ, পেশী ও কুবুদ্ধি আছে তিনি তত বড় অপরাধ করতে কুণ্ঠিত হন না। এ ঢেউ শিক্ষা সেক্টরে আরো প্রকট। আমাদের আপাদমস্তক অনৈতিকতার ছড়াছড়ি দেখে শিক্ষার্থীরা কীভাবে ভাল হবার উপায় খুঁজবে? দেশের কাকে দেখে নৈতিকতা শিখবে?

কিছু মানুষ অবৈধ উপায়ে সবকিছু অর্জন করতে চায়। এজন্য তারা ভাল নীতিকে ট্যারা চোখে দেখে। এজন্য অনেকে অর্থ ও ক্ষমতাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে টিকে থাকতে চায়। কেউ কেউ আবার টাকা খরচ করে বড় ডিগ্রী কিনে তা অর্জনের নামে ব্যবহার করতে আগ্রহী। সহজ পন্থায় বড় বড় ডিগ্রী প্রদানের জন্য অনেক সাইনেবোর্ডধারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠন রাতারাতি গজিয়ে উঠেছে। যাদের পড়ার কক্ষ নেই, জমি, ল্যাবরেটেরি, খেলার মাঠ কিছুই নেই। আবাসিক এলাকার ভাড়া বাসায় বা মার্কেটের ছাদে অনেকের শিক্ষাপ্রদানের ব্যবস্থা। এর জন্য দেশের নানা স্থানে পদে পদে পদে জালিয়াত, দালাল এবং ঘাটে ঘাটে তাদের অসৎ দোসররা ওঁত পেতে থাকে।

এককালের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামধারী ঢাবি শিক্ষকের গবেষণায় যখন জালিয়াতি ধরা পড়ে তখন আর কাকে কি বলার থাকে? পাবলিক পরীক্ষায় জালিয়াতির দায়ে প্রতিটি কেন্দ্রে কতজনকে বহিষ্কার করা হয় তার পরে কেউ কি তাদের খোঁজ রাখেন? শিক্ষকের নিজের ডিগ্রী নকল হলে তিনি অন্যদের কি পড়াবেন? পাহারাদার নিজে চোর হলে তো কথাই নেই।

অধুনা নোট ছাড়াও টেক্সট বইও নকল করা হয়। বই মেলায় কতটি নকল বই এলো-গেল, বিক্রি হলো, তা কি ধরার কোন অবকাশ আছে? কারণ বাংলাভায় এজন্য কোন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বা আধুনিক প্রযুক্তিসম্বলিত সফটওয়্যার অদ্যাবধি তৈরি হয়নি।

ইংরেজিতে একাডেমিক চৌর্যবৃত্তি যাচাই করার জন্য ডুপলিচেকার, পেপার রেটার, প্লেজারেজমা, কপিলিক, প্লাগস্কান, কোয়েটেক্সট, স্মল এসইও, টারনিট ইন, আইথেনটিকেট, ইউনিচেক, নোপ্লাগ, গ্রামারলি, উরকুন্দ  ইত্যাদি নানা নামের সফটওয়্যার বাজারে প্রচলিত। যেগুলো অনলাইনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আমরা ভাড়ায় ইংরেজি ভাষার চৌর্যবৃত্তি যাচাই করার জন্য ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু বাংলা ভাষার নকল বা একাডেমিক চৌর্যবৃত্তি যাচাই করার জন্য প্রযুক্তিসম্বলিত সফটওয়্যার নেই। তাই বই, গবেষণা, এমনকি বাংলায় লেখা এমফিল বা পিএইচডি থিসিসের আসল-নকল যাচাই বা জালিয়াতি ধরার কোন ব্যবস্থা নেই।

যদিও এই এ্যন্টি-প্লেজারিজম সফটওয়্যার বা একাডেমিক নকল বা চৌর্যবৃত্তি যাচাই করার কম্পিউটার প্রযুক্তিকে কেউ কেউ শতভাগ গ্যারান্টি দিতে নারাজ তথাপি এর মাধ্যমে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তেলা যায় তা সবাই স্বীকার করবেন। বিশেষ করে মানুষকে কিছুটা পাঠমূখী ও গবেষণামূখী করার জন্য এই সফটওয়্যার বিশেষ ভূমিকা রাখতেই পারে।

কোন লেখার আসল-নকল যাচাই করা যায় এবং যাচাই করা হবে এই প্রসঙ্গ থাকলেই শিক্ষার্থীরা সাবধান হয়ে বইমুখী হবে এবং ভাল পড়ুয়া হয়ে উঠতে পারে।

পাশাপাশি যারা গবেষণা পেপার ও থিসিস মূল্যায়ণের কাজ করেন তাদের কাজের সময় ও চাপ কমে যাবে। ভাল মানের নির্ভেজাল রিপোর্ট প্রাপ্তি সহজ হবে। তাই আমাদের প্রযুক্তিবিদগণকে অচিরেই বাংলায় একাডেমিক নকল বা চৌর্যবৃত্তি যাচাই করার কম্পিউটার প্রযুক্তি সম্বলিত সফটওয়্যার উদ্ভাবনে এগিয়ে আসাটা জরুরি।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

   

মে দিবস: শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য, অধিকার ও উন্নয়নের প্রতীক



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রতি বছর ১ মে বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য, অধিকার ও উন্নয়ন উদযাপন করা হয়। ২০২৪ সালে আমরা ১৩৮তম মহান মে দিবস উদযাপন করেছি। এই দিনটি শ্রমিক শ্রেণির দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের স্মরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের সময় শ্রমিকেরা অমানবিক পরিবেশে দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে বাধ্য হতেন। তাদের ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র এবং কাজের সময়সীমা দেওয়া হতো না। এই অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শ্রমিকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করেন।

১৮৮৬ সালের ১ মে, আমেরিকার শিকাগোতে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার দাবিতে শ্রমিকেরা ধর্মঘট শুরু করেন। এই ধর্মঘট পরবর্তীতে সহিংসতায় পরিণত হয়; যার ফলে অনেক শ্রমিক নিহত ও আহত হন। এই ঘটনার স্মরণে ১ মে বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে উদযাপন করা হয়।

বাংলাদেশেও মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার ও সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত, বাংলাদেশের শ্রমিকেরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য অসংখ্য আন্দোলন ও সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন।

বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। কিন্তু দেশটি চরম বৈষম্যের সম্মুখীন। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান, শ্রমিকদের শোষণ, কর্মসংস্থানের অভাব, ন্যূনতম মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব- এই সব সমস্যা শ্রমিক শ্রেণির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

এই বৈষম্যপূর্ণ পরিস্থিতিতে, মে দিবসের তাৎপর্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই দিনটি শ্রমিকদের দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের স্মরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লড়াইকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্য সুবিধা, ছুটির অধিকার- এই সব দাবি আদায়ের জন্য শ্রমিকেরা অনেকদিন ধরেই সংগ্রাম করে আসছেন।

চরম বৈষম্যযুক্ত সমাজে, শ্রমিকদের লড়াই এখনো চলমান। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, শ্রম আইন বাস্তবায়ন, শিশুশ্রম বন্ধ করা- এই সব দাবি আদায়ের জন্য শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কার্যকর শ্রম আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি- এই সব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে পারে।

শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও তাদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করার জন্য সমাজের সব স্তরের মানুষের ভূমিকা রয়েছে। শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতি ও শ্রদ্ধাশীল আচরণ, শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি। তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত এবং তাদের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করা উচিত।

শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা চালানো উচিত। এটি শ্রমিকদের তাদের অধিকার সম্পর্কে জানতে এবং তা আদায়ের জন্য পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে। শ্রমিকদের সংগঠনকে সমর্থন করা উচিত, যাতে তারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আরো শক্তিশালী হতে পারে।

‘মে দিবস’ শুধু একটি ছুটির দিন নয়, বরং এটি শ্রমিক শ্রেণির দীর্ঘদিনের লড়াই ও আত্মত্যাগের প্রতীক। চরম বৈষম্যযুক্ত সমাজে, মে দিবস শ্রমিকদের ঐক্য ও সংহতির বার্তা প্রচার করে।

এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও তাদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করার জন্য এখনো অনেক কিছু করার আছে। সরকার, নিয়োগকর্তা, শ্রমিক ও সমাজের সব স্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি ন্যায়সঙ্গত ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

মে দিবস শুধু অতীতের স্মরণ নয়, ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতিও বহন করে। এই দিন আমরা শ্রমিকদের অবদান ও সংগ্রামকে স্মরণ করি। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রত্যয় জানাই এবং আরো ন্যায়সঙ্গত ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাই।

বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব এখনো বিদ্যমান। শ্রমিকেরা তাদের চাকরি, মজুরি ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং কর্পোরেট লোভের ফলে শ্রমিক শ্রেণির ওপর নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে।

শ্রমিকদের ঐক্য হলো তাদের অধিকার আদায়ের মূলশক্তি। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন আন্দোলনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের দাবি আদায় করতে পারবে। শ্রমিকদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করার জন্য ন্যায্য মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা অপরিহার্য।

শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। কার্যকর শ্রম আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, পেনশন ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা উচিত।

শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন করা তাদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা উচিত। এছাড়াও শ্রমিকদের অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

জলবায়ু পরিবর্তন শ্রমিক শ্রেণির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পরিবেশবান্ধব শিল্প ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি শ্রমিকদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে। শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের এই নতুন সুযোগ গ্রহণে সহায়তা করা উচিত।

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও কর্পোরেট লোভ শ্রমিক শ্রেণির জন্য একটি বড় হুমকি। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও কর্পোরেট লোভের বিরুদ্ধে লড়াই করে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করা সম্ভব।

১৩৮তম মে দিবস শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য, অধিকার ও উন্নয়নের প্রতীক। এই দিনটি শ্রমিকদের দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের স্মরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায় এবং জীবন-যাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব।

মে দিবস শ্রমিকদের ঐক্য ও সংগ্রামের দিন। এই দিন আমরা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তাদের অবদানকে স্মরণ করি। শ্রমিকদের ন্যায্য কর্মপরিবেশ, মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যেতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করে আমরা একটি আরো উন্নত ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে পারবো।

এই মে দিবসকে সামনে রেখে আসুন, আমরা শ্রমিকদের ঐক্য ও সংগ্রামের মন্ত্র ধারণ করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি!

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

;

মহান মে দিবসের পরম্পরা ও বর্তমান বাংলাদেশ

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



ড. মিল্টন বিশ্বাস
ছবি: নূর এ আলম

ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

 

মহান মে দিবসের রক্তাক্ত ইতিহাস উনিশ শতকের অন্যতম ঐতিহাসিক ঘটনা। ঘটনাটি আমেরিকার শিকাগো শহরের কিন্তু পর্যায়ক্রমে তার প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বব্যাপী প্রসারিত। ইতিহাসের রেকর্ড থেকে দেখা যায়, ১৮৮৬ সালের মে মাসে শ্রমিক হত্যাকাণ্ড এবং তার প্রতিবাদে সমাবেশ ও সমাবেশে বোমা হামলা প্রভৃতি ঘটনার বিচার ও বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে সমগ্র পৃথিবীতে পরবর্তী কয়েক দশক নিন্দার তপ্ত হাওয়া বয়ে যায়। ফলে ১ মে দিনটিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। আন্দোলকারীরা হত্যা-নির্যাতনের পরও তাদের দাবি নিয়ে প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রেখেছিল। ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালের আন্তর্জাতিক দ্বিতীয় কংগ্রেস এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষিত হবার পর থেকে অনেক দেশে দিনটি শ্রমিক শ্রেণি কর্তৃক উদযাপিত হয়ে আসছে।

রাশিয়ায় এবং পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হবার পর মে দিবস এক বিশেষ তাৎপর্য অর্জন করে। জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শাখা হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের অধিকারসমূহ স্বীকৃতি লাভ করে। আইএলও কতগুলি নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠা করে এবং সকল দেশে শিল্পমালিক ও শ্রমিকদের তা মেনে চলার আহবান জানায় এবং এভাবে শ্রমিক ও মালিকদের অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। বাংলাদেশ আইএলও কর্তৃক প্রণীত নীতিমালায় স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। ১৯১৫ সালে প্রথম দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের নিয়ম জারি করা হয় উরুগুয়ে। পরে সারা বিশ্বে শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজের নিয়ম চালু হয়। মে দিবসের লড়াইয়ে আট ঘণ্টার শ্রমদিবস, মজুরি বৃদ্ধি, কাজের উন্নততর পরিবেশ ইত্যাদি দাবি ছিল- তা এখন উন্নত বিশ্বে পুরোপুরি অনুসরণ করা হচ্ছে।

২.
শ্রমিকের স্বাধীনতায় একদা বিশ্বাসী রাশিয়ার যুদ্ধংদেহি আচরণে বিশ্বের তাবৎ দেশ আজ আতঙ্ক ও দিশেহারা গ্রহের বাসিন্দা। পৃথিবীর যে শতাধিক রাষ্ট্র খুব গুরুত্বের সঙ্গে মহান মে দিবস পালন করে তারাও আজ শঙ্কিত। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই দিনটিকে লেবার ডে বা ওয়ার্কার্স ডে হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। অসংখ্য দেশে এই দিনটিতে ছুটি থাকে। মে দিবস শ্রমিকদের দাবি আদায় করার সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জনের স্মৃতিকে সম্মান দেখানোর দিন। এদিন একজন শ্রমিক উন্নততর জীবনের স্বপ্ন দেখে। কারণ মে দিবস সমগ্র বিশ্বকে বৈষম্য ও শোষণমুক্ত একটি সমাজ উপহার দিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা শ্রমজীবী মানুষের জন্য অভিশাপ বয়ে এনেছে। যুদ্ধের অভিঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য উন্নত দেশগুলোতে কল্যাণকর ব্যবস্থায় সহযোগিতা করা সম্ভব।

পক্ষান্তরে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সেই তুলনায় মেহনতি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যেমন, বাংলাদেশের ৫০ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক শহরকেন্দ্রিক (যদিও এদেশের শ্রমিকদের মাত্র ১৫ শতাংশ শহুরে-শ্রমিক হিসেবে কাজ করে), এছাড়া আছে দিন এনে দিন খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ এবং কৃষিখাতে জড়িত বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এসব স্বল্প আয়ের মানুষকে সংকট থেকে রক্ষা করা যেমন জরুরি তেমনি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য তাদের কাজে লাগানোও প্রয়োজন। তাছাড়া চিকিৎসা সেবাখাতে শ্রমজীবী নারী-পুরুষের চাহিদা করোনা সংকটে অনেক বেশি ছিল। চিকিৎসক-নার্সদের পাশাপাশি হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়, আয়া, ক্লিনার করোনা মোকাবেলায় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে। অর্থাৎ সংকটময় মুহূর্তে চিকিৎসাসেবায় শ্রমজীবী মানুষের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এদিক থেকে এবারের মে দিবস আলাদা তাৎপর্য বহন করছে। এজন্য ২০২২ সালেরও স্লোগান হওয়া দরকার- ‘বাঁচলে শ্রমিক বাঁচবে দেশ’।

৩.
বাংলাদেশের শ্রম আইনে আছে- সপ্তাহে ছয়দিন শ্রমিকরা কাজ করবে, প্রতিদিন আট ঘণ্টার বেশি নয়। দুই ঘণ্টা ওভারটাইম কাজ করানো যেতে পারে, কিন্তু কোনোক্রমেই তার বেশি নয়, অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই ১০ ঘণ্টার অতিরিক্ত একজন শ্রমিকের কর্মঘণ্টা হতে পারবে না। এই অতিরিক্ত দুই ঘণ্টার জন্য শ্রমিককে দ্বিগুণ মজুরি দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই মিল কর্তৃপক্ষ জোর করে অর্থাৎ শ্রমিকের সম্মতি ব্যতিরেকে ওভারটাইম কাজ করাতে পারবে না। শ্রমিককে জোর করে ১৬/১৮ ঘণ্টা কাজ করানো কিংবা ওভারটাইমে দ্বিগুণ মজুরি না দেওয়া অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। শ্রম আইনে আছে, কারখানার পরিবেশ স্বাস্থ্যকর ও মানবিক হতে হবে। দৈহিক নির্যাতন, গালিগালাজ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা যেন সেখানে না থাকে। শ্রম আইন লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধানও রয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা ২ কোটি ৩৩ লাখ, হোটেল রেস্তোরাঁ ও দোকানে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ৮২ লাখ, কারখানা শ্রমিকের সংখ্যা ৭৫ লাখ। এর মধ্যে ৫০ লাখ শ্রমিক পোশাক কারখানায় কাজ করে। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে বেশ কয়েকটি জেলায় শিশু শ্রমিকদেরও দেখা মেলে। এছাড়া সড়ক ও জনপথ, নির্মাণ, বস্ত্র (সূতা তৈরি ও বুনন), ট্যানারি, জাহাজ ভাঙা, পোল্ট্রি ও চিংড়ি (প্রক্রিয়াজাতকরণ), চাতাল (ধান কল), কৃষি ও মৎস্যখাতে শ্রমিক আছে। সেবা খাতে দোকান-শ্রমিক এবং যানবাহন মেরামত কারখানার শ্রমিকরাও গুরুত্বপূর্ণ। নির্মাণখাতের পাথর উত্তোলন ও পাথর ভাঙার এবং ইট ভাটার শ্রমিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এদেশে মানবেতর পরিবেশে বহু নারীশ্রমিক কাজ করে। মাটি কাটা ও ইট ভাঙার কাজে, চাতাল ও মাছ প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে এসব নারীদের দেখা যায়। আবার প্রবাসী নারী শ্রমিকদের এদেশের রেমিট্যান্সে অবদানও স্বীকৃত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি নারী শ্রমিক গেছে ১০টি দেশে; প্রায় ৯ লাখ নারী শ্রমিক আছে সেসব দেশে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটি তথ্য মতে ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া নারী শ্রমিকের সংখ্যা হলো- সৌদি আরব- তিন লাখ ৩২ হাজার ২০৪ জন, জর্ডান- এক লাখ ৫৫ হাজার ৪১১, সংযুক্ত আরব আমিরাত- এক লাখ ৩০ হাজার ৫৭১, লেবানন- এক লাখ ছয় হাজার ৮৪০, ওমান- ৮৬ হাজার ১৩২, কাতার- ৩২ হাজার ২৫৯, মরিশাস- ১৭ হাজার ৯২৩, কুয়েত- নয় হাজার ১৯, মালয়েশিয়া- ছয় হাজার ৬৩৮ এবং বাহরাইনে চার হাজার ২৯০ জন নারী শ্রমিক। বাংলাদেশে সব মিলে ৬ কোটি শ্রমিক আছে। এসব শ্রমিকদের প্রধান সমস্যা নিপীড়ন, নিখোঁজ ও দুর্ঘটনায় মৃত্যু। সমুদ্র মৎস্যখাতে শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি নিখোঁজ হয়। দুর্ঘটনার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, ভবন ধসের ঘটনা, উপর থেকে পড়ে যাওয়া, বজ্রপাত, অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু হয়ে থাকে প্রতিবছর। অন্যদিকে তৈরি পোশাক খাতে ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ১১ বছরে প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক নিহত হয়েছে। তবে ২০১৮ থেকে শ্রমিকদের অপমৃত্যু বহুলাংশে কমে এসেছে। লেখাবাহুল্য, মৃত শ্রমিকদের পরিবার ও সন্তানরা অসহায় হয়ে পড়ে, তাদের দেখার কেউ থাকে না। তারা বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে পারে না।

৪. গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি যে পর্যায়ে উত্তীর্ণ করা হয়েছে তাকে সন্তোষজনক না বললেও আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে । আওয়ামী লীগ সরকারের চেষ্টায় শিশুশ্রম নিষিদ্ধ ও শ্রম আইন বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে পোশাক শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি এবং কৃষি শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করার ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য কাজ। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ইতোমধ্যে জেনেছে যে, বাংলাদেশ শ্রম আইন ও ইপিজেড আইন সামঞ্জস্যপূর্ণ, এখানে সংগঠন করতে শ্রমিকদের বাধা দেওয়া হয় না, দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ছাঁটাই ও পুলিশি হয়রানি এখানে অনুপস্থিত। উপরন্তু শ্রমমান পরিদর্শনে (ইন্সপেকশন) যথার্থ বিধান রয়েছে। মূলত অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্সসহ অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতকল্পে বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ শ্রমমান এবং শ্রমিকদের সুরক্ষায় সচেতনতা বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় সংকটের সমাধান হচ্ছে ধীর গতিতে। এজন্য সব খাতের দিকে নজর দেওয়া দরকার।

অবশ্য ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর শেখ হাসিনা সরকারের উদ্যোগে পোশাক কারখানাগুলোর পরিবেশে যে পরিবর্তন এসেছে তা বেশ স্পষ্ট সেখানে কর্মরত শ্রমিকের কাছেও। আগে গার্মেন্টসগুলোতে দুর্যোগ মোকাবেলায় ট্রেনিং হতো না। এখন বেশ কিছু কারখানায় বছরে একাধিক ট্রেনিং হচ্ছে। আগুন লাগলে কী করতে হবে, কখনোবা অন্যান্য করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে মালিক পক্ষ। বেতন-বোনাস নিয়েও আগের মতো ‘টালবাহানা’নেই। শ্রমিকদের কোনো সমস্যা হলে এখন ম্যানেজমেন্টের কাছে অভিযোগও করা যায়। আসলে বিদেশি ক্রেতাদের দুটি জোট অ্যাকর্ড ও এলায়েন্সের চাহিদা মেনে ফায়ার সেফটি, ইলেক্ট্র্রিক্যাল সেফটি, বিল্ডিং সেফটি সবকিছু নতুন করে আধুনিক পদ্ধতি মেনে পোশাক-কারখানা সচল রাখতে হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং অন্যান্যদের রচনার সূত্রে দেখা যায়, ১৯৭১ এর আগে পাকিস্তান আমলে পাটকল, বস্ত্রকল ও চিনিকলে শ্রমিকদের পদচারণায় মুখরিত ছিল। এসব বড় বড় শিল্প কারখানা স্বাধীনতার পরে লাভের মুখ না দেখতে পারলেও এদেশে ছোট ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যাপকহারে। গার্মেন্টেসের পাশে এই নতুন কলকারখানার শ্রমিকরা শ্রমবাজারে নতুন। আর সব মিলে নারীশ্রমিকের সংখ্যা এখন অনেক। কিন্তু পোশাক কারখানাকে ঘিরে কোনো শ্রমিক কলোনি গড়ে উঠে নি। যেমন জুট মিল কিংবা টেক্সটাইল মিলকে ঘিরে অতীতে কলোনি থাকত। শ্রমিকরা এখন বাস করে শহরের বস্তিতে, কারখানা সংলগ্ন অনুন্নত জায়গায়। অথচ একসময় পাট ও বস্ত্র শিল্পের শ্রমিকদের জন্য থাকার কলোনি, চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদির ব্যবস্থা ছিল। তবে শ্রমিকের ঘর ভাড়া, ওষুধ ও চিকিৎসা খরচ, নূন্যপক্ষে চারজনের এক পরিবারের জন্য মাসিক ৮ হাজার টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে।
৫.
১ মে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে মেহনতি মানুষের জেগে ওঠার দিন। অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাবি আদায়ের লড়াইয়ের দিন। এটি ঐক্যের দিনও- সকল শ্রমজীবী মানুষ তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করার মাধ্যমে উন্নয়নমুখী কাজের জয়যাত্রাকে এগিয়ে নেবার শপথ ঘোষণার দিন এটি। ১ মে থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ভবিষ্যতে সকল ন্যায্য দাবি আদায়ের মাধ্যমে শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস। করোনাশূন্য-বিশ্বে শিল্প-কারখানার কর্মপরিবেশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা বজায় থাকলে কৃষি ও রপ্তানি খাতে শ্রমজীবী মানুষের অবদান হবে স্মরণীয়।

লেখক : অধ্যাপক,বাংলা বিভাগ; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল:[email protected]

;

শ্রমিক কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



ড. আতিউর রহমান
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

শ্রমিক কল্যাণ নিয়ে এই আলোচনাটি এমন একটি সময়ে তুলছি যখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি দানা বেধেছে। প্রথমে করোনাজনিত অর্থনৈতিক অচলাবস্থা এবং তার ওপর রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ও অন্যান্য ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি নিঃসন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষত বাইরের এই সঙ্কটগুলোর কারণে আমাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত সঙ্কটগুলোও নতুন করে প্রকট হয়ে ধরা দেয়ায় সম্ভবত বিগত ১০-১৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম এতো বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

বলা বাহুল্য যে এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও যে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি মোটামুটি ছয় শতাংশের আশেপাশেই প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে এর পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখে চলেছে আমাদের প্রবাসী আয়ের প্রবাহ, আমাদের কৃষি উৎপাদন এবং সর্বোপরি আমাদের রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো। এই প্রেক্ষাপটে তাই শ্রমিক কল্যাণ নিয়ে ভাবনা ও আলোচনা বিশেষ প্রাসঙ্গিক। কারণ আপতকালিন সময়ে শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ করা গেলেই সঙ্কট উত্তরণে আমাদের শ্রমঘন শিল্প খাত থেকে প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক সুফল পাওয়া সম্ভব। দিনশেষে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শিল্পেই। সেই পথেই বাংলাদেশ এখন হাঁটছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো-সহ মেগা প্রকল্পগুলো পুরোপুরি চালু হয়ে গেলে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি আরও গতিময় হবে। আর সেই সুবাদে শ্রমিকের কর্মসংস্থান ও সুযোগ-সুবিধেও বাড়বে।

স্বল্পমেয়াদে এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে তো বটেই এমন কি দীর্ঘতর মেয়াদে শ্রমিকবান্ধব অর্থনৈতিক বিকাশের পথ-নকশা তৈরির ক্ষেত্রেও শ্রমিক কল্যাণ বিষয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর এ বিষয়ক দর্শন ও চর্চাগুলো আমাদের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমরা সচরাচর যে সমস্ত দেশকে উন্নত হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি তাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে বাংলাদেশের মতো যে সমস্ত স্বল্পোন্নত দেশে দ্রুত সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিকাশের পথে এগিয়েছে তাদের বাস্তবতার বিশেষ ফারাক রয়েছে। এই পার্থক্যের বিষয়ে সচেতন না থাকলে শ্রমিক কল্যাণের নামে এমন নীতি প্রণিত হতে পারে যাতে করে স্বল্পোন্নত অর্থনীতিতে শিল্পের বিকাশই বাধাগ্রস্ত হবে। আর তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে শ্রমিকদেরই।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা লগ্নেই এ বিষয়ে নীতি-সংবেদনশীলতা দেখা যায়। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর মতে শ্রমিক স্বার্থ বিষয়ে উন্নত দেশগুলোর স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ না করে নিজস্ব বাস্তবতার বিষয়ে সচেতন থেকে বাংলাদেশের শ্রমনীতি প্রণিত হওয়ায় আমাদের শিল্প খাতের বিকাশ সহজতর হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতের ১৯৪৭ সালের ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্ট’-এ শ্রমিক নিয়োগ বিষয়ে ব্যাপক কড়াকড়ি ছিল। ভারত এই আইনটি নিয়েই স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। অন্যদিকে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে যখন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এ দেশে যাত্রা শুরু করে ঐ আইনটি ছাড়াই। ফলে বাংলাদেশের শিল্পোদ্যাক্তারা সহজেই বেশি সংখ্যক সস্তা শ্রমিককে নিয়োজিত করতে পেরেছিলেন। এতে একদিকে কম মূল্যে বিশ্ব বাজারে পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে বেশি সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগ দেয়ার ফলে কর্মসংস্থান বেড়েছে এবং অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সুফল বেশি বেশি বণ্টন করা সম্ভব হয়েছে।

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর শ্রম আইনের কড়াকড়ি সঙ্গত কারণেই বঙ্গবন্ধু অনুসরণ করেননি। কেননা সে সময় সদ্য-স্বাধীন দেশে ঐ অর্থে উদ্যোক্তা শ্রেণীই ছিল না। এমন কড়াকাড়ি আরোপ করলে নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণীর বিকাশই বন্ধ হয়ে যেতো। তবে স্বাধীন দেশের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু ঠিকই শ্রমিকের কল্যাণ ও স্বার্থের যথাযথ অগ্রাধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তির কথা বলা হয়েছে: “রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশ সমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা”। ১৫ (খ) অনুচ্ছেদে কর্ম ও মজুরির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে: “কর্মের অধিকার অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসংগত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার; যুক্তিসংগত বিশ্রাম বিনোদন ও অবকাশের অধিকার।” ৩৪ অনুচ্ছেদে জবরদস্তি- শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে: “সকল প্রকার জবরদস্তি শ্রম; এবং এই বিধান কোনোভাবে লংঘিত হইলে আইনত; দণ্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে।” বঙ্গবন্ধু নিখাদ আন্তরিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকারের বিষয় অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

সংবিধানে শ্রমিক অধিকারের এহেন স্বীকৃতি ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে ছিলো বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা সে সময় দেশীয় উদ্যোক্তা শ্রেণীর অনুপস্থিতির কারণে বড় শিল্পগুলো ছিলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন ঐ সব কারখানায় পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা নিঃসন্দেহে সংবিধানের নির্দেশনা মেনে চলার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানাধীন কারখানার পরিচালকদের চেয়ে বেশি তৎপর হবেন- এমনটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানার কারখানার প্রতি শ্রমিকদের দায়িত্বশীলতাও বেশি হবে, কেননা তারাও এক অর্থে এই কারখানার মালিক।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজেই ১৯৭২-এর ১৯ জুলাই আদমজীনগরে শ্রমিক সমাবেশে বলেছিলেন- “ ... ফ্যাক্টরি এখন আর আদমজী নাই, ফ্যাক্টরি এখন আর বাওয়ানীর নাই, ফ্যাক্টরি এখন আর দাউদের নাই, ফ্যাক্টরি এখন হয়েছে সাড়ে সাত কোটি লোকের সম্পত্তি। ... আপনারা প্রোডাকশন বাড়াবেন, আপনারাও খাবেন আর ঐ যে গরীব কৃষক, যাদের টাকায় এই কল-কারখানা গড়ে উঠে। তারাও এ টাকার ভাগ পাবে ...।”

শ্রমিক কল্যাণ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে আরও ভালোভাবে বুঝতে ফিরে যেতে হবে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের সময়ে। একেবারে যে সময় বঙ্গবন্ধু একজন তরুণ রাজনীতিকি সে সময়টায়। ঐ সময়ে শ্রমিক স্বার্থ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাগুলো সবেচেয়ে স্পষ্ট প্রতিফলন পাওয়া যায় তাঁর ১৯৫২ সালে চীন সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থটিতে। গণমুখী রাষ্ট্রে কৃষক আর শ্রমিকের স্বার্থই যে মূখ্যতম অগ্রাধিকারের বিষয় হওয়া উচিৎ ছিলো তরুণ বঙ্গবন্ধু সে বিষয়ে সদাসচেতন ছিলেন। তাই তরুণ বয়সে গণচীন সফরে গিয়ে নানকিংয়ের কৃষি ফার্মের মতোই আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করেছিলেন সাংহাইতে অবস্থিত বৃহৎ কাপড়ের কলের ব্যবস্থাপনা।

প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে তাঁরা এই কলটি পরিদর্শন করেছিলেন। কমিউনিস্ট দেশেও মিলটি একটি কোম্পানি হিসেবে পরিচালিত হচ্ছিল। একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক তা চালাচ্ছিলেন। তার মানে চীনে সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় নি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মিলেই মিলটি চালাচ্ছিলেন। মিলগুলো জাতীয়করণ না করেও এমন ব্যবস্থা করা হয়েছিল যে সকল পক্ষই লাভবান হতে পারেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন- “সরকারকে হিসাব দাখিল করতে হয়। যে টাকা আয় হবে তা শ্রমিকদের বেতন, তাদের বাসস্থানের বন্দোবস্ত, চিকিৎসার জন্য ব্যয় করতে হবে। আর যা বাঁচবে তা দিয়ে মিলের উন্নতি করতে হবে। আর যারা মালিক তাদের লভ্যাংশের কিছু অংশ দেয়া হয়।” তিনি আরও সন্তুষ্ট হয়েছিলেন এই দেশে যে মেয়ে শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্য শিশু যত্ন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। যুবক শ্রমিকরা কয়েকজনে মিলে বাড়িতে বাস করার সুযোগ পেয়েছেন। শ্রমিকদের জন্য আলাদা হাসপাতালের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা স্কুলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সফর শেষে শ্রমিক ও মালিকদের পক্ষ থেকে তাদের সংবর্ধনা দেয়া হয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি উভয়ে বলেন, “আমরা শ্রমিক ও মালিক পাশাপাশি দেশের কাজ করছি। মিলটা শুধু মালিকের নয়, শ্রমিকের ও জনসাধারণেরও। আজ আর আমাদের মধ্যে কোনো গোলমাল নাই। আমরা উভয়েই লভ্যাংশ ভাগ করে নেই। শ্রমিকের স্বার্থও আজ রক্ষা হয়েছে, মালিকের স্বার্থও রক্ষা হয়েছে।” (আমার দেখা নয়াচীন, পৃষ্ঠা ৭০)।
তরুণ বয়সে বিপ্লবোত্তর চীনে শ্রমিকদের ক্ষমতায়িত করার কৌশলগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভবিষ্যতে নিজে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলে শ্রমিক কল্যাণে কি করবেন তার পথ-নকশাই হয়তো সে সময় তিনি দাঁড় করাচ্ছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তি কালে বৃহৎ শিল্প যখন রাষ্ট্রীয়করণ করেছিলেন তখন কারখানা ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তাঁর নেয়া উদ্যোগগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে এমনটিই মনে হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই ১৯৭৩-এ আদমজীনগরের ভাষণে (আগে উল্লিখিত) বক্তৃতায় বলেছিলেন- “প্রত্যেকটা কল-কারখানা আপনাদেরই (শ্রমিকদেরই) করতে হবে। সেভাবেই ম্যানেজমেন্ট বোর্ড হবে।

সরকারের থাকবে, কর্পোরেশনের থাকবে আর শ্রমিকদের প্রতিনিধি থাকবে ... আপনারা শ্রমিকরা ভোট দিয়ে পাশ করে দিবেন, দুইজন আপনার, একজন ব্যাংকের, একজন গভর্নমেন্টের, একজন হলো আপনার জুট কর্পোরেশনের। পাঁচজনে বসে কল-কারখানা চালাবেন। ... আপনাদের কলে যা আয় হবে, তার একটা অংশ আপনাদের শ্রমিকদের জন্য ব্যয় হবে, আরেক অংশ জনগণের জন্য ব্যয় হবে। সরকারের কাছে যাবে।” শ্রমিকদের কল্যাণের ভার এভাবেই তিনি শ্রমিক প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। রাষ্ট্রের হাতে রেখেছিলেন শ্রমিকদের ক্ষমতায়িত হওয়ার পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব। বাংলাদেশের তখনকার বাস্তবতায় এই পদ্ধতিটি সত্যিই সময়োপযোগি ছিল।

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিতেও এই ধারাবাহিকতা তিনি রক্ষা করেছিলেন। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কার্যক্রমকে বেগবান এবং অংশগ্রহণমূলক করতে সে সময় সকল মহকুমাকে ডিস্ট্রিক্ট-এ রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর প্রতিটি থানার সার্বিক তদারকির জন্য একটি করে ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাবনা ছিল তাঁর। আর সেই কাউন্সিলে আলাদা করে শ্রমিকদের প্রতিনিধি রাখার পরিকল্পনা দিয়েছিলেন তিনি, যাতে করে থানাভিত্তিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াতেও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হতো।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) কমিটিতে তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- “এক বছরের মধ্যে থানা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল করতে হবে। সেখানে বাকশালের রিপ্রেজেন্টেটিভ থাকবে, কৃষকদের রিপ্রেজেন্টেটিভ থাকবে, শ্রমিকদের থাকবে, যুবকদের থাকবে, মহিলাদের থাকবে।” অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনায় আলাদাভাবে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার এই প্রচেষ্ট থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পরিক্রমায় অংশীজন হিসেবে শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যে একান্ত জরুরি সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশেষ সংবেদনশীল।

নীতি-নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ ও তাদের বৃহত্তর কল্যাণ নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণগুলো বিষয়েও বঙ্গবন্ধু বিশেষ সচেতন ছিলেন। কখনো ধর্ম, কখনো জাতীয়তা, কখনো কে কোন জেলা থেকে আগত- ইত্যাদি ইস্যু তুলে শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার মাধ্যমে শ্রমিক কল্যাণ প্রায়শই ব্যাহত হয়েছে পাকিস্তান শাসনামলে। আর শ্রমিকদের মধ্যে এই বিভেদ বিরাজ করলে জাতীয় রাজনীতিতে বিশেষ শক্তি হিসেবে শ্রমিকদের অংশগ্রহণও বাধাগ্রস্ত হয়। পূর্ব বাংলার শ্রমিকরা যেন জাতীয় রাজনৈতিক অধিকারের আন্দোলনে কার্যকর শক্তি হিসেবে সামনে আসতে না পারে সে জন্য পাকিস্তানী অপশাসকরা প্রায়শই এ দেশের শ্রমিকদের মধ্যে এ ধরনের বিভেদ তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।

১৯৫৪-তে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ঐক্যজোট যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক নির্বাচনে জয়ী হয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করার পরপরই তাই আদমজীতে শ্রমিকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির পায়তারা দেখা গিয়েছিলো। সে সময় বঙ্গবন্ধু কনিষ্ঠতম মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। নির্বাচনে জয় কিংবা মন্ত্রীত্ব পাওয়া উদযাপনের পরিবর্তে শপথ নিয়েই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন ঐ দাঙ্গা নিরসন করতে। স্বাধীনতা উত্তর কালেও এহেন বিভেদ বৃহত্তর শ্রমিক কল্যাণ ও জাতীয় অগ্রগতির পথে হুমকি তৈরি করতে পারে- এমন আশঙ্কা বঙ্গবন্ধুর ছিলো। তাই বার বার শ্রমিকদের বিভেদের রাজনীতি থেকে বিরত থাকার উদাত্ত আহ্বান তিনি জানিয়েছেন।

আগেই আদমজীনগরে শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে তাঁর দেয়া যে ঐতিহাসিক ভাষণের কথা উল্লেখ করেছি সেখানেও এ বিষয়টি তিনি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন- “আদমীজতে রক্ত আমি দেখেছি, ১৯৫৪ সালের রক্ত আমি দেখেছি। মন্ত্রী হয়েছিলাম, শপথ নিয়েছিলাম, মন্ত্রীর দ্বার থেকে সোজা আমি ’৫৪ সালে এই পথে দৌড়াইয়া আদমজীতে আসার চেষ্ট করি। তখন তোমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। ... মন্ত্রী হয়ে আদমজীতে এসেছিলাম, সে জন্য মন্ত্রিত্ব ডিসমিস করে সমস্ত মন্ত্রী থেকে বাদ দিয়ে আমাকে জেলে নিয়েছিল। ... যদি আমার শ্রমিক ভাইদের মধ্যে আজকে (স্বাধীন বাংলাদেশে) এই কথা হয়- ওমুক নোয়াখালীরে, ওমক ঢাকার, ওমক কুমিল্লার, ওমক ফরিদপুরের- এর আগে কি আমার মৃত্যু ভালো ছিল না? বলেন আপনারা ওয়াদা করতে হবে যে, আমরা এক, আমরা বাঙালী ...।”

বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আজও শ্রমিকদেরকে ঐক্যবদ্ধ রাখা একই রকম জরুরি। এখনও দেশ-বিরোধী চক্র শ্রমিকদের বিপথগামী করে তথাকথিত শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষূণ্ন করতে তৎপর হতে পারে। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ অনুসরণ করা একান্ত জরুরি। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির ভিত্তিকে মজবুত করতে শ্রমিকরা যে ভূমিকা রাখছেন তার স্বীকৃতি বার বার দিতে হবে। একই সঙ্গে কোন স্বার্থান্বেষী মহল যেন শ্রমিকদের ব্যবহার করে আমাদের অর্জনগুলো ধুলিস্মাত করতে না পারে তার জন্য শ্রমিকদের সচেতন করে তুলতে হবে।

আশার কথা ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হারানোর পর বহু ত্যাগের বিনিময়ে হলেও দেশ আবার বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই ফিরেছে। এই নতুন অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শ্রমিক কল্যাণকে তিনিও একই রকম অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছেন। চ্যালেঞ্জিং সময়েও তাই জাতীয় মজুরি কমিশনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো হচ্ছে (সর্বশেষ বেড়েছে গত বছর)।

বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে শ্রমিক স্বার্থের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অর্জন অবশ্য এসেছে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে। ইতোমধ্যে বিশ্বের শীর্ষ পরিবেশবান্ধব আরএমজি কারখানাগুলোর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক (২০৯টি) বাংলাদেশি হওয়ায় এক্ষেত্রে যে বাংলাদেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে তা বলাই যায়। আরও বিপুল সংখ্যক কারখানা এখন সবুজ হওয়ার পথে । বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সবুজ অর্থায়নের কৌশল গ্রহণ করে এই সবুজ রূপান্তরকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। শোভন কর্মসংস্থানের বিষয়টি এখন গুরুত্ব পাচ্ছে।

আশার কথা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে সবুজ কারখানার সংখ্যা বাড়ছে বলেই শোভন কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়ছে। রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর আমাদের আরএমজি খাত নিয়ে অনেকেই শঙ্কায় পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সকল অংশীজনে মিলে কমপ্লায়েন্ট কারখানার পরিবেশ উন্নয়নে মনোযোগ দেয়ায় সেই আশঙ্কা সত্য হয়নি। বরং কাজের পরিবেশ উন্নত করার সুবাদে আমাদের সুনাম বেড়েছে।

বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়িত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কারখানার লভ্যাংশ শ্রমিক কল্যাণে ব্যয়ের পরিকল্পনা সে সময়কার শ্রমিক প্রতিনিধিরা করতে পারছিলেন। আজ রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা হাতে গোণা। শিল্প মূলত ব্যক্তি খাত নির্ভর। তবে ব্যক্তি খাতের দেয়া কর থেকে সরকারের যে আয় হয় তার একটি অংশ শ্রমিক পরিবারগুলোর কল্যাণে বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নিশ্চয় ব্যয় করা যায়। ফলে আজকের পরিবর্তিত বাস্তবতাতেও বঙ্গবন্ধুর দর্শন বাস্তবায়িত করা খুবই সম্ভব। শ্রমিকদের ক্ষমতায়িত করতে কেবল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি-কেন্দ্রিক ভাবনাই ভাবতে হবে এমন নয়।

আজও আমাদের দেশের অধিকাংশ শ্রমিকই অদক্ষ। শিল্প খাতের আধুনিকায়ন (অটোমেশন), আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তি প্রতিযোগিতা, এবং সর্বোপরি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে অদক্ষ শ্রমিকেরা বাড়তি ঝুঁকিতে রয়েছেন। তাদেরকে দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ করে দেয়ার মাধ্যমেও তাদের ক্ষমতায়ন করা সম্ভব। এভাবে বঙ্গবন্ধুর শ্রমিক কল্যাণের দর্শনের মূল সুরটি ঠিক রেখে পরিবর্তিত বাস্তবতার উপযোগি করে নতুন করে শ্রমিক কল্যাণের পথ-নকশাই আমাদের দাঁড় করাতে হবে।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

;

মে দিবস: মধ্যসত্ত্বভোগীরা যেন সুবিধাভোগী না হয়

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: নূর এ আলম

ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

সমাজ বদলের কারিগর মহামতি কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস দুজনেই জার্মান বংশোদ্ভূত। তৎকালীন প্রুশিয়ায় তাঁদের জন্ম ও প্রাথমিক জীবন কাটলেও পরবর্তীকালে তাঁদের সমাজ বদলের চিন্তাধারা ও রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য উভয়কেই দেশান্তরি হতে হয়। প্রবাসেও তাঁরা সক্রিয় থাকেন এবং তাঁদের শ্রেণি-সংগ্রাম ও সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র মতবাদ বিশ্বের বুকে একটি স্থায়ী অবদান রাখতে সমর্থ হয়। তাঁরা উভয়েই ছিলেন পড়ুয়া ও অধ্যবসায়ী। ছিলেন একাধারে অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক, সাংবাদিক, লেখক, সমাজবিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ ও বিপ্লবী মতাদর্শের ধারক ও বাহক। তাঁরা একক এবং যৌথভাবে অজস্র প্রবন্ধ ও পুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশ করেছেন। তার মধ্যে ডাস্ ক্যাপিটাল এবং এন্টি ডুরিং এর মত গভীর মতাদর্শ প্রকাশ করার বই রয়েছে। কিন্তু উভয়ের যৌথভাবে লেখা কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার নামের প্রকাশনা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দেয়।

প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারাদের ঘামে শ্রমে ও রক্তে সভ্যতা ও সমাজের বিকাশ। কিন্তু তাঁরা মানবেতর জীবন যাপন করে সভ্যতার চাকা ঘোরান। বিশাল এই সর্বহারা শ্রেণির শ্রমের ফল ভোগ করেন স্বল্পসংখ্যক ধনিক বুর্জোয়া শ্রেণি। এই সমীকরণ যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে। কারণ বুর্জোয়া শ্রেণি একতাবদ্ধ এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা তাদের পক্ষে। বিপরীতে সর্বহারা শ্রেণির একতাবদ্ধ হওয়ার পক্ষে অজস্র বাধা। মার্ক্স ও এঙ্গেলস সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে শ্রেণি সংগ্রামকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে সর্বহারা শ্রেণি সরকার গঠন না করা পর্যন্ত বুর্জোয়া শাসক শ্রেণির শোষণ থেকে তাঁদের মুক্তি নেই। পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত পুস্তিকা সমূহের অন্যতম কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার শেষ হয়েছে বিশ্বের প্রলেতারিয়েতের প্রতি এক উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে। শৃঙ্খল ছাড়া সর্বহারা শ্রেণির হারাবার কিছু নাই। জয় করার জন্য রয়েছে সারা দুনিয়া।

১৮৪৮ সালে এই ইস্তাহার প্রকাশিত হওয়ার পর মার্ক্স ও এঙ্গেলস ১৮৬৪ সালে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি (International Workingmen's Association) গঠন করেন। এই সংগঠন প্রথম ইন্টারন্যাশনাল নামে পরিচিত হয়।লক্ষ্য ছিলো ন্যায্য দাবি সমূহ আদায়ে সর্বহারা শ্রেণীর ঐক্য স্থাপন। সেই সময় এই ঐক্যের প্রয়োজন ছিল প্রকটভাবে অনুভূত। এখানে আমাদের জাতির জনকের একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করি। তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুই শিবিরে বিভক্ত -শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’

শোষিত মানুষের দাবি আদায়ের সংগ্রামে ‘দুনিয়ার মজদুর - এক হও’ স্লোগানটি একটি হাতিয়ার হিসাবে পরিচিতি পায়। আজ অবধি শ্রমজীবী মানুষের যেকোনো আন্দোলন, সংগ্রাম, সভা, মিছিলে এই স্লোগানের শক্তিশালী ব্যবহার আমরা দেখতে পাই। এই আন্দোলন সংগ্রামের হাত ধরেই পরবর্তী কালে মে দিবস, প্রলেতারিয়েত শ্রেণির দাবি আদায়, এমনকি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আবির্ভূত হওয়া ইত্যাকার ঐতিহাসিক ঘটনার সৃষ্টি। মে দিবসের ইতিহাস প্রাচীন। মধ্যযুগের ইউরোপে এই দিনটি বসন্ত উৎসব হিসাবে পালিত হত। ইউরোপে এই দিনটি বসন্ত ও গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ের। এই সময়েই নানা বর্ণের পুষ্পপল্লবে শোভিত হয়ে পৃথিবী অপরূপা হয়ে ওঠে। আনন্দোৎসবের উপযুক্ত এই সময়ে, তাই দেশে দেশে মে দিবস পালিত হত সাড়ম্বরে। সেই দিনটিই ইতিহাসের কালচক্রে পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবসে।

এবারে আসি সেই ইতিহাসে। প্রাচীন কালে সমাজ ছিল কৃষিভিত্তিক। সেই আদিকাল থেকেই ভূমি মালিক ও তাদের জমিতে কাজ করা দরিদ্র কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে শোষক-শোষিতের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কৃষি কাজকে সহজতর করার জন্য প্রয়োজন অনুভূত হয় কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতির। অন্যদিকে লজ্জা নিবারণ ও পরিধেয়, উপাদেয় খাদ্য প্রস্তুত করা, বাসস্থান তৈরি ও চিকিৎসা উপকরণের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার আবিষ্কার হতে থাকে।

উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু রাখার জন্য দৃশ্যপটে আবির্ভাব হয় শ্রমিক শ্রেণির। জনসংখ্যা বিস্তার ও ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে ভোক্তা সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাল মিলিয়ে চলতে থাকে উৎপাদন বৃদ্ধি। উদ্ভব হতে থাকে নতুন নতুন প্রযুক্তির। প্রয়োজন হতে থাকে বৃহত্তর সংখ্যায় শ্রমিকের। শিল্প বিপ্লবের সাথে সাথে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে প্রযুক্তির ও উৎপাদনের। বিকাশ ঘটতে থাকে অসংগঠিত শ্রমিক শ্রেণির।

শাসন ক্ষমতা ও উৎপাদন প্রক্রিয়া ও উৎপাদনের যাবতীয় মাধ্যম করায়ত্ত থাকে ধনিক বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে। নির্মম শোষণ চলতে থাকে শ্রমজীবী মানুষের ওপর। তাঁদের পরিশ্রমে উৎপাদন হয় কৃষি ও শিল্প পণ্য। অথচ তাঁদের জীবন যাপন থাকে মানবেতর পরিবেশ ও পর্যায়ে। অপরদিকে ধনবান শ্রেণি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগের মাধ্যমে যাবতীয় প্রবৃদ্ধির ভাগীদার হয়। বিলাসবহুল জীবন যাপন ও অর্থে বিত্তে ফুলে ফেঁপে ওঠে তারা।

শ্রমিকদের কোনও নির্দিষ্ট শ্রমঘন্টা ছিল না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো। মজুরি ছিল অপ্রতুল। বসবাসের ব্যবস্থা ছিল অস্বাস্থ্যকর। ব্যক্তিগত জীবন ও আমোদ প্রমোদের ছিল না কোনও সুযোগ। নিরাশায় ভরা ছিল তাঁদের জীবন। চরম অসন্তোষ বিরাজ করত তাঁদের মনে। কর্ম ঘন্টা কমানো এবং উন্নততর জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করার জন্য তাঁদের দাবি কারো কানে পৌঁছাতো না। তাঁরা অসংগঠিত থাকার কারনে তাঁদের দাবী শক্তিশালী ভাবে উপস্থাপন করতে তাঁরা পারতেন না। জানা যায় যে ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেনে একবার শ্রমিকদের জন্য আট ঘন্টার কর্মদিবস চালুর ঘোষণা করা হয়েছিল। তা কিন্তু বলবত হয়নি কখনও।

১৮১৭ সালে স্কটল্যান্ডের একজন নীতিবান ও শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল শিল্পপতি রবার্ট ওয়েন এক যুগান্তকারী প্রস্তাব আনেন। তিনি শ্রমজীবীদের জন্য দিনের চব্বিশ ঘণ্টাকে সমান তিন ভাগে বিভক্ত করে প্রতি ভাগ যথাক্রমে শ্রম, মনোরঞ্জন ও বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট করার কথা বলেন। শ্রমিক শ্রেণির জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ এই প্রস্তাব সামনে রেখে তাঁরা তাঁদের চাহিদাকে তুলে ধরে সংগঠিত হতে থাকেন। তাঁদের চাহিদা ছিল আট ঘন্টার কর্মদিবস, সহজ জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় নিম্নতম মজুরি ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করার সুযোগ। শিল্পবিপ্লবের ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে শিল্প শ্রমিকরা সংগঠিত হতে থাকেন তাঁদের দাবী সমূহ আদায়ে।

শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস থেকে জানা যায় ১৮৫৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার পাথর-রাজমিস্ত্রিদের সংগঠন সর্বপ্রথম বৃহৎ আকারের আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয় আট ঘন্টা কর্মদিবসের দাবি প্রতিষ্ঠায়। এরপরই ১৮৬৪ সালে মার্ক্স-এঙ্গেলসের নেতৃত্ব প্রথম ইন্টারন্যাশনাল যাত্রা শুরু করে। আন্তর্জাতিক ভাবে শ্রমিক শ্রেণি সংগঠন বিকশিত হওয়ার একটি প্লাটফর্ম হিসেবে তা কাজ করে।দেশে দেশে ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠায় সর্বহারা শ্রেণি একাট্টা হতে থাকে। বিশেষ করে আট ঘন্টা শ্রম দিবসের দাবি প্রধান ও প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়।

এরপরের ঘটনা একাধারে মর্মান্তিক ও মাইলফলক সৃষ্টিকারী। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে তারিখে আমেরিকার শ্রমিক ফেডারেশন (American Federation of Lobour) আট ঘন্টা কর্মদিবসের দাবিতে শিকাগো নগরীতে সর্বাত্মক শ্রমিক ধর্মঘটের ডাক দেয়। এঁদের সাথে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল এরও একসময় যোগসূত্র ছিল। নীতিগত বিভক্তির কারনে কার্ল মার্ক্স প্রথম ইন্টারন্যাশনালের প্রধান কার্যালয় ইউরোপ থেকে আমেরিকায় স্থানান্তর করেন এবং ১৮৮১ সাল নাগাদ এই সংস্থার কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে যায়।

যাহোক পহেলা মে ১৮৮৬ এর ধর্মঘট তাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে এমনটা অনুমান করে কলকারখানার মালিক বুর্জোয়া শ্রেণি সহযোগী রাষ্ট্রশক্তিকে নিয়ে শ্রমিক আন্দোলনের সকল কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে। শ্রমিক শ্রেণি এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং প্রতিদিনই বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। ৪ মে তারিখে তাঁরা বড় ধরনের শোভাযাত্রা করার প্রস্তুতি নিয়ে শিকাগো হে মার্কেটের কাছে সমবেত হন। অপরদিকে মালিক পক্ষ রাষ্ট্র ক্ষমতার সহায়তায় আন্দোলনে বাধা দেয়ার জন্য বিপুল সংখ্যায় পুলিশকে সংঘবদ্ধ করে। এই পর্যায়ে ঘটে একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা।পুলিশ অবস্থানে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়।

কে বা কারা এটি ঘটিয়েছে তা ঐ সময় বা পরবর্তী কালেও নিরূপিত হয়নি। নিজেদের মধ্যে হতাহতের ঘটনা ঘটায় পুলিশ বাহিনী উত্তেজিত হয়ে উঠে শ্রমজীবীদের অবস্থানে গুলিবর্ষণ করে। সংঘর্ষ বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং ঐদিন মোট এগারজন মৃত্যু বরণ করেন। আহত হন আরও প্রায় দেড় শত জন।হতাহত উভয়পক্ষের ই ছিল। পুলিশ বাহিনী এরপর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বহু শ্রমজীবী ও তাঁদের নেতারা গ্রেফতার হন।মামলা দায়ের করে নেতাদের বিচার করা হয়। তাঁদের মধ্যে চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।সাজাপ্রাপ্তদের কেউ কেউ ঐদিন অকুস্থলে ছিলেন না এবং কোনো ভাবে অংশগ্রহণ ও করেন নাই।

এই ঘটনার স্মরণে প্রতি বছরই শ্রমিকরা হে মার্কেট ঘটনার স্মরণে মে মাস ব্যাপি বিভিন্ন কার্যক্রম চালাতে থাকেন। ১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনালের প্রথম সন্মেলনে প্রতি বছর ১ মে তারিখে হে মার্কেট আন্দোলনের স্মরণে বিশ্বের সব জায়গায় আট ঘন্টা কর্মদিবস চালুর জন্য আন্দোলন সংঘটিত করার সিদ্ধান্ত হয়। প্রতি বছরই দেশে দেশে এই দাবি জোরদার হতে থাকে। ১৯০৪ সালে দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনালের ৬ষ্ঠ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় আমস্টারডামে।

সেখান থেকে বিশ্বের সকল শ্রমিক সংগঠনের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানো হয় সক্রিয় ভাবে বৃহৎ আন্দোলন গড়ে তুলে আট ঘন্টার কর্মদিবসের দাবীকে সফল করার। সাথে সাথে ১ মে তারিখকে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী দিবস হিসাবে পালন করা এবং এই দিন নিজেদের মধ্যে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রেখে আট ঘন্টা কর্মদিবস চালুর দাবি ও অন্য সকল ন্যায্য দাবি শক্তিশালী ভাবে উপস্থাপন করা। ফলশ্রুতিতে এই জনপ্রিয় দাবি শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য দাবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতোমধ্যে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গোটা বিশ্ব যুদ্ধ উন্মাদনায় মেতে ওঠে এবং অন্য সকল আন্দোলনে ভাঁটা পড়ে।

১৯১৭ সালে রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রচন্ড ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে যুদ্ধ পরিত্যাগ করার জন্য শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত জনতার প্রবল চাপের মুখে পড়ে। প্রবল প্রতাপান্বিত জার শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ পরিত্যাগ করেও শেষ রক্ষা করতে পারেন নি। মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে সর্বহারাদের দল কমিউনিস্ট পার্টি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করে। ১৮৪৮ এ কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহারে করা মার্ক্স ও এঙ্গেলস এর ভবিষ্যৎ বাণী বাস্তবে রূপ নিল। গোড়াপত্তন হলো সোভিয়েত রাশিয়ার।

পরবর্তীকালে রাশিয়ার একসময়ের অঙ্গ দেশসমূহ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা হয়। ক্ষমতায় আসার পরপরই সোভিয়েত দেশে আট ঘন্টা কর্মদিবস চালু হয়। শ্রমজীবী শ্রেণির দল তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তাই তাঁদের অপরাপর ন্যায্য দাবিগুলোও মেনে নেয়া হয়। শুরু হলো বিশ্বব্যাপী আট ঘন্টা কর্মদিবস চালু হওয়া। ১৯১৮ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। ১৯১৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা (International Labour Organisation বা সংক্ষেপে ILO) গঠিত হয়। সেখানে মালিক, শ্রমিক, সরকার, অর্থনীতিবিদ, সমাজকর্মী সহ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট শ্রণি পেশার প্রতিনিধিত্ব ছিল। ১৯২০ সালে আই এল ও বিশ্বব্যাপী আট ঘন্টা কর্মদিবস চালুর সিদ্ধান্ত নেয়।

১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পায়। সেই থেকে ধীরে ধীরে পৃথিবীর সকল দেশেই আট ঘন্টা কর্মদিবস চালু হতে থাকে। উল্লেখ্য মে দিবসে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী দিবসের আন্দোলন গোড়াপত্তনের দেশ আমেরিকায় ১৯৩৮ সালে আট ঘন্টা কর্মদিবস ও ৪৮ ঘন্টার কর্মসপ্তাহ চালুর আইন হয়। অবশ্য ১৯৪০ এ নতুন আইন করে ৪০ ঘন্টার কর্মসপ্তাহ চালু করেন তাঁরা। এখন বিশ্বের বহু দেশেই ৪০ ঘন্টার কর্মসপ্তাহ চালু হয়েছে।

মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী দিবস ইতিহাসের শোকাতুর দিনের ভাবগাম্ভীর্য ও বহন করে। আবার এটি আনন্দের দিনও বটে।দিনটি শ্রমজীবী মানুষের বিজয়ের দিনও। এই দিনটি উদযাপনের নানা কার্যক্রম দেশে দেশে। শোভাযাত্রা, সভা, সেমিনার, আনন্দোৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ভোজ, আতশবাজি ইত্যাদি নানা অনুষঙ্গে পালিত হয় এই ঐতিহাসিক দিনটি।

মহান মে দিবস - অমর রহে!
দুনিয়ার মজদুর - এক হও!

শ্রমিক আন্দোলন যেন শ্রমিকদের হাতিয়ার হিসাবে থাকে। মধ্যসত্ত্বভোগীরা যেন এই আন্দোলনের সুবিধাভোগী না হয় এই আকাঙ্খা জানাই। পৃথিবীর সকল শ্রমজীবীর প্রতি শুভকামনা।

লেখক: প্রাবন্ধিক

;