ছাপানো কাগজের কদর কমাটা ভয়ানক কষ্টের



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সেদিন রিটায়ার্ড এক স্যার তার নাতিকে বললেন, আমি এখনও বেশ সুস্থ আছি রে বন্ধু। আবার লেখাপড়া করতে চাই। তোমাদের ড্রাইভার এলে বলো- অফিস থেকে তোমার বাবাকে নিয়ে বাসায় ফেরার সময় আমার জন্য দুটো বলপয়েন্ট কলম ও কিছু সাদা কাগজ কিনে আনতে। কাগজ-কলম কেনার কথা শুনে নাতি তো হেসে অস্থির। তোমাকে না কতদিন আগেই বলেছি আমার ডেস্কটপে বসে টাইপিংটা প্রাকটিস করো। তখন আমলে নিলে না। কতবার বললাম, আমি শিখিয়ে দিই, তুমি শেখো। তুমি আজীবন বিছানায় শুয়ে কানে বিবিসি রেডিও নিয়ে কাটিয়ে দিলে। কম্পিউটার চালানোটা শিখলে আজ করোনার সময় বিবিসি-তে রেডিও শুনতে হতো না, আর লেখার জন্য কাগজ-কলমও চাইতে হতো না।

তুমি জানো যে, ভোয়া বাংলা সার্ভিস বন্ধ হয়ে গেছে? কবে জানি বিবিসি-বাংলাও বন্ধ হয়ে যায়। কারণ আজকাল রেডিও শোনার সময় কোথায়? শুধু গাড়ির ড্রাউভাররা বা চালকরা পথের একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্য রেডিও শোনে। তারা এফএম রেডিও ফুর্তি শোনে আর গাড়ি চালায়। গাড়ির মধ্যেও টিভি-সিডিতে সিনেমা দেখে। দাদু, তুমি যে এখনও কোন যুগে বাস করছ! তোমার নিয়মিত খবরের কাগজও তো এখন আর দিতে আসে না। কাগজওয়ালারাও জানে না কবে দিতে পারবে খবরের ছাপানা কাগজ। কারণ, করোনার ডেল্টা ভেরিয়েন্টের কালো থাবায় মানুষর মধ্যে ধরেছে ভীষণ মরণভীতি। দেখছ না- এই ভবনের মালিক খবরের কাগজ ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।

বিপদে পড়ে গেছে প্রকাশনা সংস্থাগুলো। করোনাকালের অনেক পূর্বেই লেখার কাজ দখল করেছিল কমিম্পউটার কম্পোজ। কিন্তু ছাপানোর কাজ চলছিল বরাবরের মতই। বই, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, জার্নাল, কার্টুন, পোস্টার, সিনেফ্লেক্স সবকিছুই ছাপানোর অর্ডার আসতো। লেখক, প্রকাশক, কর্মচারী, শ্রমিক সবাই ব্যস্ত সময় পার করতো। রাত পোহালেই ঘরের দরজায় পৌঁছিয়ে দিতে হবে ছাপানো সংবাদের কপি। কাগজের মধ্যে কালি দিয়ে ছাপানোর অক্ষরে কোন কিছু না দেখলে কি বিশ্বাস করা যায়?

করোনার মধ্যেও ছাপানো কাগজ চলল বেশ কয়েকমাস। কিন্তু মানুষের হাতের স্পর্শে করোনা চলাচল করে আরেকজনের দেহে ঢুকে যায়-এই ধারণা প্রচারের সাথে সাথে ছাপানো কাগজের ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেল। বাজারের ব্যাগ ঘরের বাইরে রেখে ফসফসানি স্যানিটাইজার দিয়ে বায়ু গোসল করানো শুরু হলো। এমনকি সবজি, কলা, পান ইত্যাদি সাবান দিয়ে ধুয়ে খাওয়া শুরু করলো ভীতু মানুষ।

ভয়টা মরণের। কেউই মরতে চাইনা। হকার পেপার দিয়ে গেলে বারান্দায় ফেলে রাখা শুরু হলো। দুদিন গত হলেও কেউ আর সেই সংবাদপত্র স্পর্শ করতে চাইতো না। কারণ, কতজন যে ওই কাগজটা ইতোমধ্যে স্পর্শ করেছে কে জানে? সেটা আমি ছুঁলে যদি আমাদের পরিবারের কিছু হয়ে যায়! হকারকে বলে দেয়া শুরু হলো- আগামীকাল থেকে পেপার বন্ধ থাকবে। তবে এ মাসের পুরো বিল পাবেন।

সেই যে পেপার রাখা বন্ধ হলো অদ্যাবধি আর নেবার সাহস কুলালো না এই ভবনের কারো। এমনকি এলাকার সবাই বাসায় পেপার রাখা ছেড়ে দিল। বেকার হয়ে গেল হাজার হাজার হকার-শ্রমিক। তাদের পোষ্যদের কি ঘটতে লগলো তা কি আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে? করোনাকালে কাগজ-কালির ব্যবহার কমে গেল, এতে এসব পণ্যের মূল্য কমে যাবে, কারখানা, ছাপাখানা বন্ধ হয়ে যাবে। একাজে পেশাদারী ও র্নিভরশীলরা পথে বসে যেতে পারে-বিষয়টা খুব কষ্টকর, খুব কুৎসিৎ মনে হচ্ছে।

শুধু কি তাই? আজকালা ছাপানো বই, অফিসের জরুরি চিঠি, জমির দলিল ইত্যাদিও মানুষ ভয়ে ছোঁয় না। হাতে ধরার আগে দ্রব্যটা ও নিজের হাতটা স্যানিটাইজ করে নেয়। গ্লাভস ও মাস্ক পরে নেয়। চশমা পরে তারপর দূর থেকে দেখে আর কথা বলে।

অফিসের চিঠি স্কান করে ইমেইলে পাঠায় অথবা মেসেঞ্জারে, টুইটারে দেয়। পাশে বসে থাকলেও ছবিতে শেয়ার-ইট করে। করোনা যেমন নাছোড়বান্দা, মানুষও তেমনি আজব চিজ!

সবচেয়ে খারাপ কাজ হয়েছে দৈনিক পেপার বিলি বন্ধ হয়ে যাওয়া। প্রথমেই কাগজ শ্রমিক ও হকারদের ভাত মেরেছে করোনা।

সংগে এই পেশার সাথে জড়িত লক্ষ লক্ষ মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছে। করেনার আগ্রাসী রূপ ও দীর্ঘমেয়াদী আগ্রাসন। প্রকাশকদের বিলের অর্থ বাকী থাকতে থাকতে এখন তামাদি হয়ে গেছে। টাকা না পেয়ে প্রকাশকগণ পথে বসে গেছেন। লেখকদের সম্মানী বন্ধ হয়ে গেছে। নিজের জমা টাকা খরচ করে অথবা ধার-দেনা করে এখন বিপদে আছেন তারা। বাকীতে বই ছেপে সাপ্লাই দিয়ে টাকা উঠাতে না পেরে কর্মচারীদের বিল দিতে পারছেন না প্রকাশনা মালিকরা। এইভাবে কম্পোজার, ডিজাইনার, বাঁধাইকার, শ্রমিক, হকার সবার বিল বন্ধ। কারো পেটে ভাত নেই। পেটে ক্ষুধা থাকলে কি আর ভাল কাজ করা যায়?

প্রেস চলছে না, থান কাগজ বিক্রি হচ্ছে না, পেপার মিলের কাগজ স্তুপ হয়ে পড়ে আছে। এসব কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষের জীবন-জীবিকা চলছে না। তাদের আত্মার আর্তনাদ শোনাবে কাকে? এই কদর্য সময়ে গুরুত্ব দিয়ে সেগুলো শুনবেই বা কে?

বিকল্প উপায়ে দৈনিক পত্রিকা বের হচ্ছে এখন। কিন্তু সেখানে কৌশলে দশজনের কাজ একজন দিয়েই সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে। যাদের টেকনিক্যাল জ্ঞান নেই বা আধুনিক কম্পিউটার সিস্টেমের সাথে পরিচিত নন তারা কি পরিবারশুদ্ধ না খেয়ে মারা যাবেন?

এ কোন দুনিয়া এলো? চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আশীর্বাদের সময় করোনা নামে সে কে এলো, বিধি-নিশেধের নির্দেশনা নিয়ে- এটা করোনা, সেটা করোনা, ওটা করা যাবে না- আরো কতকিছু বাহানা!

করোনার বিধিনিষেধ কি তাহলে এসেছে মানুষের স্বভাবিক জীবনের গতিকে থমকে দিতে? নাকি উন্নয়নের গতিতে বাগ্ড়া দিতে? মানুষ দিন দিন এত অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছে কেন?

প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের কথা আমরা জেনেছি। তখন বহু নন্ টেকনিক্যাল মানুষ বেকার হয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল বেশ ধীরলয়ে। সেই সুযোগে তারা মাঠের কাজে লেগে যায়। কৃষি, কয়লা খনি, স্বর্ণ খনি, মোটর শ্রমিক, জেলে ইত্যাদি হয়ে পেশা বদলায়। কিন্তু করোনার প্রভাব এটা কী মেসেজ দিচ্ছে? চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অজুহাতে শ্রমজীবি নিম্ন আয়ের মানুষকে রোগে-শোকে ডুবিয়ে, সময় না দিয়ে গোষ্ঠীশুদ্ধ কবরে পাঠানোর ব্যবস্থা করে চলেছে।

অনেকে বলেন. করোনাকারের আশীর্বাাদ হলো- দ্রুত ডিজিটাল পদ্ধতিতে মানুষকে এডাপ্ট করা। কিন্তু এজন্য ডিজিটাল প্রশিক্ষণ নেবার সময় দিল কই? আর সবাই যদি একই প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজে লেগে যায় তাহলে এত কাজ করারা স্থান বা ফিল্ড কই? কাজের সুযোগহীনতা নব্য বেকারত্ব তৈরী করেছে করোনাকালীণ ডিজিটাল সিস্টেম।

ডিজিটাল সিস্টেম এত দ্রুত বদলায় যে, তার সাথে সমাযোজন করতে সবাই পারঙ্গম নয়। যেমন, ২০২১ সালে বাজারে আসা কম্পিউটার পুরাতন মডেলের ইউএসবি, মাউস, সিডি, ফ্লপি, এসডি, নতুন অ্যাপস্ কিছুই চিনে না। সেগুলো আধুনিক সফটওয়্যার ছাড়া আপডেট করতে পারে না। নতুন প্রযুক্তি ও ডিভাইসের মূল্য এত বেশী যে তা কেনা সবার সাধ্যে কুলায় না। ইন্টারনেট থেকে বিনামূল্যে আসল কোন সফটওয়্যার বা অ্যাপস্ আপলোড করা যায় না। নকল বা চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে করলে সেটা দিয়ে কাজের ফলাফল ভুল বা শুন্য হবার সম্ভাবনা থাকে।

যাহোক্, যা বলতে চাচ্ছিলাম- করোনাকালে কাগজ-কালি ও পড়াশুনার কাজকর্ম সবকিছু নিত্যনতুন ডিভাইস বা কম্পিউটারের কব্জায় চলে গেছে। নেট দুনিয়ায় আমরা গুগল বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে পত্রিকা, ছবি, গবেষণা রিপোর্ট, ভিডিও সবকিছু পাচ্ছি। ওপেন এডুকেশন রিসোর্সে শিক্ষার্থীরা সুবিধা নিতে পারছে লাইসেন্সের মাধ্যমে। অথেনটিক, তথ্যবহুল পাঠ্যপুস্তক বা টেক্সটবই বিহীন ইন্টারনেট সোর্স হলে সেটা শুধু সময় নষ্ট আর ফাঁকিবাজি করা শেখাবে। সেগুলো দিয়ে জ্ঞান আহরণ হবে না। জ্ঞান আহরণের জন্য চাই ভাল পাঠ্যপুস্তক। আজকাল লাইসেন্স সম্বলিত নামকরা প্রকাশনা সংস্থার ‘সফট বুকে’-ও জেনুইন তথ্য আপলোড করা হয়ে থকে। যার সবকিছু ‘ওপেন এডুকেশন রিসোর্স’ (ওইআর) নয়। অনলাইনে একটি ভাল টেক্সটবুকের সফটকপি কম পয়সায় বা ফ্রি লাইসেন্সে অ্যাকসেস্ পেতে যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া তাতে অজ পাড়াগাঁয়ে বিদ্যুৎবিহীন পরিবেশে ধরিগতির নেটে নিজের পয়সায় একজন স্বল্প মেগাবাইট কেনা দরিদ্র শিক্ষার্থীর এত অর্থ ব্যয় করারা সুযোগ কোথায়?

আজকাল অনেক জেনুইন হার্ড কপির সফট ভার্সন তৈরী করে আপলোড করে নানা ব্যবসা শুরু হয়েছে। সেগুলোতে ক্লিক করলে শুধু সারমর্মটা ফ্রি দেখতে দেয়। গোটা কপি পেতে হলে  মাস্টার কার্ড বা ভিসা কার্ডে মূল্য পরিশোধ করতে বলে। যা আমাদের মত দরিদ্র দেশের সিংহভাগ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে অধিগ্রহণ অসম্ভব ব্যাপার। এমনকি আমাদের শিক্ষণকগণেরও এসব কার্ড নেই বা তত অর্থ খরচ করার সামর্থ্য নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অনলাইনে ‘জেনুইন সফটবুক’ বা জার্নাল প্রাপ্তি- এটা বিত্তশালীদের কারবার।

কোন কিছু সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করার জন্য যার হার্ডকপি বা ছাপানো কপিরও বড় প্রয়োজন। এজন্য দেশীয় প্রকাশনা সংস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মূল বই না থাকলে আপনি ইন্টারনেটে কী আপলোড করবেন? ভুল ভরা আনঅথারাইজড ইন্টারনেটের তথ্য শুধু কপি-পেষ্ট করে আপনি কী শিখবেন বা শেখাবেন? পাঠদানের তথ্য সঠিক কি-না তা কীভাবে যাচাই করবেন? আজকাল অসংখ্য ‘ওপেন এডুকেশন রিসোর্স’(ওইআর) ভুলে ভরা। গবেষণা বা ড্রিগ্রীর কাজের সেমিনার, কনফারেন্স না করে অনেকেই মনগড়া পেপার লিখে মাত্র ১০০ ডলার ফি দিয়ে ভূঁইফোড় অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশ করিয়ে প্রমোশন বাগিয়ে নিচ্ছেন। লোভী দুষ্ট চক্রের কিছু মানুষের প্রচেষ্টায় সেগুলো যাচাই না করেই নেটে আপলোড করে দেয়া হচ্ছে। তবে অনেক দামী জার্নালে এসবের উদ্বৃতি দিলে আনঅথারাইজড চিহ্নিত করে বাতিল করে দেয়া হচ্ছে। এজন্য ফায়ারওয়ালবিহীন অবাধ অনলাইন নির্ভর পাঠদানে এখন নানা জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

বিদ্যুৎ না থাকলেও কুপির আলোতে বই পড়া যায় কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকলে ডিভাইসে চার্জ থাকেনা, নেট চলে না। নেট দুনিয়া অচল হয়ে গেলে এবং ছাপানা কিছু না থাকলে বা মাথায় কিছু স্মরণে না এল দুনিয়াটা অসাড় মনে হবে। তখুনি ঘোর অমানিশা এসে গ্রাস করবে। আমি কোন নৈরাশ্যবাদী কথা বলছি না- শুধু বলতে চাচ্ছি সুষম উন্নয়নের কথা। যা কিছু উন্নয়ন করা হবে তাতে যেন সব মানুষের আ্যকসেস্ থাকে এবং দেশের সব মানুষ খেয়ে পরে সম্মান নিয়ে বাঁচার সুযোগ পায়। একজন মাটিকাটা শ্রমিক, রিক্সা শ্রমিক, সেলাই শ্রমিক, বই বাঁধাই শ্রমিক, প্রকাশক, আমলা. ব্যবসায়ী, শিক্ষক, জেলে, কুলি, ব্যাংকার, কারখানা মালিক, সৈনিক, কবি বা একজন গৃহকর্মী সবার নিকট এই করোনাকালে কি কাগজ-কালির কাজ-কারবার সমান? তা মোটেও নয়। সেটা কারো আপন কব্জার মধ্যে রাখাও সম্ভব নয়। ডিজিটাল ডিভাইসের প্রাচুর্যের এই সময়ে সেটা আরো চরম সত্য প্রকাশ করে চলেছে। মানুষে মানুষে আয় বৈষম্য করেনাকালে মানুষে মানুষে ডিজিটাল বৈষম্যকে আরো প্রকট করে তথ্য প্রাপ্তি ও সে অনুযায়ী চলার পথকে আরো দুস্তর করে ফেলছে। গত দুবছরে এ অবস্থা চলতে চলতে আমাদের সমাজে চরম আর্থ-সামাজিক ও মানসিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে গেছে। এখন দায়িত্ব হলো এসবের মধ্যে সার্বিক বৈষম্য কমানো। বিশেষ করে মৌল-মানবিক চাহিদার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা জরুরি। করোনা ও ডেঙ্গির এই ভয়াবহ সময়ের নিয়ন্ত্রণহীন আবর্তে মানবিক বৈষম্যের সমতা বিধানের জন্য ছাপানো সংবাদপত্রের সাথে জড়িত সহ সবাইকে দ্রুত বিশেষ প্রণোদনা দিতে না পারলে সামাজিক বিশৃংখলা অবশ্যম্ভাবী। এছাড়া অফিসিয়াল কাগজ কালির কাজ-কারবার বা ডিজিটাল ডিভাইসের নিত্য-নতুন তথ্যে অধিগ্রহণ কার কব্জায় তা চিন্তা না করে এসময়ে বিনামূল্যে জরুরি খাদ্য ও ওষুধের সরবরাহ করে স্বজনহারাদের করুণ কান্না ঠেকানো অতি জরুরি।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: [email protected]

   

বেনজীরের পেছনে আরও কত বেনজীর?



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের আয় বহির্ভূত বিপুল সম্পদের জব্দ করা নিয়ে বেশ শোরগোল চলছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের আদেশে গেল বৃহস্পতিবার (২৩ মে) সাবেক এই দুর্দণ্ড-প্রতাপ পুলিশ কর্মকর্তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেওয়ার পর রোববার (২৬ মে) ‘খোঁজ পাওয়া’ আরও সম্পদ জব্দের আদেশ আসে। বাংলাদেশ পুলিশের একজন সাবেক মহাপরিদর্শকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ এ ভাবে ক্রোকের এ ঘটনাকে বিরল বললেও অত্যুক্তি হবে না। বেনজীরের বিপুল সম্পদের ‘খোঁজ’ পাওয়া এবং আদালতের দুটি পৃথক আদেশে সম্পত্তি ক্রোকের খবর নিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিম-লে ইতিমধ্যেই বিস্তর আগ্রহ এবং আলোচনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য কিংবা স্যোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা-বিতর্ক যখন তুঙ্গে তখন কিছু প্রশ্নও সমান্তরালে বেশ দাঁনা বাধছে।

দেশের ২৮তম পুলিশ প্রধান ছিলেন বেনজীর আহমেদ। আইজিপি, র‌্যাব প্রধান কিংবা ডিএমপি কমমিশনারের মতো পদে থাকাকালীন সময়ে বেনজীর আহমেদের যে তৎপরতা-বক্তব্য গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমরা শুনে এসেছি, তাতে কেউ কখনো ভাবতেই পারেনি এই পুলিশ কর্মকতার সম্পদ নিয়ে এমন টানাহেচড়া হতে পারে। আইজিপি হিসাবে মেয়াদ শেষের দিকে এসে বেনজির আহমেদের একটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হয়েছিল রাজধানীর কৃষিবিদ মিলনায়তনে। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে ওই পাঠ উন্মোচন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক।

সেই অনুষ্ঠানে আইজিপি’র গ্রন্থের পাঠ উন্মোচনে সরকারের দুই মন্ত্রীসহ ‘বিশিষ্ট’ অতিথি আলোচকগণ প্রশংসায় ভাসান বেনজীর আহমেদকে। যেখানে তাঁর মেধা-সততা ও পেশদারিত্ব নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করে বক্তারা যেসব কথা বলেন, তাতে বেনজীর বাংলাদেশ পুলিশের সবচেয়ে যোগ্য ও সক্ষম পুলিশ প্রধান। লেখকের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বেনজীর আহমেদ তার দীর্ঘ বক্তৃতায় নিজেকে সৎ ও দেশপ্রেমিক এবং সরকারের কতটা অনুগত তা বলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এই সময়ে এসে আয় বহির্ভূত সম্পদের খোঁজ ও তা জব্দ করা নিয়ে কেবল এই জিজ্ঞাসাটিই প্রবল হচ্ছে যে, আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো কত দুর্বল! একজন ব্যক্তির উত্থানের এই দীর্ঘ পটভূমিতে এত দিন রাষ্ট্র কি তবে ঘুমিয়ে ছিল?

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা যখন পেশাদারিত্বের জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে রাষ্ট্রপতি পদক, প্রধানমন্ত্রী পদক, পুলিশ পদক-শুদ্ধাচার পদকসহ অসংখ্য সম্মান ও স্বীকৃতিতে ভূষিত হন; তখন সেই কর্মকতার বিরুদ্ধে অবসরের পর এত গুরুতর অভিযোগ আমাদের কাঠামোগত দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে তুলে। এখন পর্যন্ত বেনজীর আহমেদের জব্দকৃত যে পরিমাণ সম্পদের তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে তাকে যদি গড় হিসেবে দেখা হয়, তবে প্রতিদিন যে আয় তিনি করেছেন বলে ধরে নেওয়া যায়, তা আলাদীনের চেরাগের চেয়েও কম আশ্চর্যের নয়।

সাম্প্রতিক বেনজীর ইস্যুতে ক্ষমতাসীন, বিরোধী দল কিংবা আইনজীবীদের তুলনামুলক যে বক্তব্য এসেছে তাতে পরস্পরবিরোধী চরিত্রটিই দৃশ্যমান হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পুলিশের যেসব কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক অভিলাষ লক্ষ্য করা গেছে, বেনজীর আহমেদ তাদের মধ্যে অন্যতম। পুলিশ প্রধান হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে বিতর্ক উসকে দিতে দেখা যেত বেনজীরকে। যখন তিনি অবসরে গেলেন-শোনা যাচ্ছিল, অচিরেই কোন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ‘প্রাইজ পোস্টিং’ পাবেন। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি ঘটলো না। আমরা দেখেছি, এই কর্মকর্তার অবসরের পর তাঁর নিরাপত্তার জন্য পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়।

আমরা অনেক সাবেক আইজিপিদের অবসরের পর গুরুত্বপূর্ণ পদে ফের পদায়নের দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। অনেককে রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ সংসদ সদস্যও হয়েছিলেন। কিন্তু বেনজীর আহমেদের মতো এতটা দুর্দ- প্রতাপ ও রাজনৈতিক অভিলাষী কর্মকর্তা কেন সেই সুযোগ পেলেন না-তা নিয়েও নানা মত রয়েছে। বলা হচ্ছে, পুলিশ বাহিনীতেই তার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক ছিল এমন কর্মকর্তারা চান না তিনি ফের প্রভাবশালী হয়ে উঠুন। বেনজীরে দ্বারা কোন কারণে নিগৃহীত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কর্মরত কর্মকর্তাদের যোগাযোগও এই ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে-এমন তথ্য কেউ কেউ সামনে আনছেন।

কিন্তু যদি রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করা হয় যে, আমাদের দেশে ‘বেনজির’ এই বেনজীর আহমেদ কি একজনই? অনেকেই দাবি করেছেন-দেশে এমন বেনজীরের সংখ্যা অনেক। কেবল খবরে এলেই তাদের নিয়ে আলোচনা করা হয়। কিন্তু দেশে আর্থ-সমাজিক অসমতার নিরিখে যদি চিন্তা করা হয়; বাংলাদেশের স্বল্প সংখ্যক মানুষের হাতে সিংহভাগ সম্পদ পূঞ্জীভূত হয়ে আছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় নামক যে শব্দের সঙ্গে এক শুভঙ্করের ফাঁকি জড়িয়ে আছে, এটি বলা অসঙ্গত হবে না যে এমন ‘বেনজির’ আলাদীনের চেরাগ কা- এ পেছনে দায়ী। সমাজে মধ্যবিত্ত-নি¤œমধ্যবিত্ত কিংবা ছিন্নমূল মানুষের জীবনে দারিদ্র ও অসহায়ত্বের যে ছাপ পরিলক্ষিত হয় তার কার্যকারণ হিসাবেও এসব দৈত্যদের উত্থানকে দায়ী করেন সমাজবিজ্ঞানী ও বিশ্লেষকরা।

আমরা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের সময়েই এমন আলাদীনের চেরাগের দৌলতে ফুলে ফেঁপে উঠা সরকারি কর্মচারীদের দেখে থাকব। কিন্তু যেসব তথাকথিত ক্ষমতাধরদের ছত্রছায়ায় কিংবা আষ্কারায় এই বেনজীরদের উত্থান ঘটে, তারা কি তবে আড়ালেই থেকে যাবেন। জনগণের করের টাকায় প্রতিপালিত সরকারের কর্মচারীরা যখন জনগণকে শুষে নিয়ে সামন্তবাদী জমিদারদের মতো চরিত্রধারণ করে বিপুল ভূ-স্বামী বনে যান তখন ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ কথাটি আর ধোঁপে টিকে না।

লোকপ্রবাদ আছে, ‘গাঁজাখোরের বিচার হবে/করবে বিচার আফিম যে খায়’। বেনজীর ইস্যুতে দৃশ্যমান সত্যটি সেই লোকপ্রবাদেরই প্রতিধ্বনি। জনগণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোতে প্রশাসন কিংবা নীতিনির্ধারকদের জাবাবদিহিতার জায়গাটি যে গুরুত্ব বহন করে, সংশ্লিষ্টটদের সেই বিষয়ে ততোটাই অনীহা। বহু বার ডাকঢোল পিটিয়ে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মচারীদের ‘সম্পদের হিসাব’ দেওয়া নিয়ে হইচই শুনলেও ক’দিন যেতেই তা নিশ্চুপ হয়ে যায়। দুর্নীতি ও সুশাসনের প্রশ্নে সব কিছুই যেন একটা চোর-পুলিশ খেলা চলে। দীর্ঘ সময়ে ধরে এ রীতি চলমান থাকায় এই প্রবণতা এখন গাঁ সওয়া হয়ে গেছে। এবং এভাবেই এটি একধরণের সামাজিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে জনগণের মনন ও মূল্যবোধকেও দুর্নীতি মনষ্কতায় ভরিয়ে তুলেছে। সে কারণেই হয়ত আলদীনের চেরাগে ভর করে সম্পদের কুমির বনে যাওয়া ব্যক্তিরা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে, হঠাৎ ঘুমে ভেঙে উদয় হওয়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর তৎপরতা লক্ষণীয়। যদিও দুদক দীর্ঘ সময়ে ওই ব্যক্তির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, একটি বাক্যও বলেনি। তা সত্ত্বেও আদালতের আদেশে বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পদ জব্দের বিষয়টি একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে রাষ্ট্রের সম্পদে পরিণতে হলে এমন অজস্র ব্যক্তির সম্পদ জব্দ করার পথ প্রশস্ত হবে। কিন্তু ‘বৈপ্লবিক’ এই প্রবণতা কতদূর পর্যন্ত টিকে থাকবে বা টিকিয়ে রাখা যাবে তা দেখার অপেক্ষায় সাধারণ মানুষ।

;

এমপির নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টের জোর



কবির য়াহমদ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সবুজ, নীল ও লাল; বাংলাদেশে এই তিন রঙের পাসপোর্ট রয়েছে। সরকারি চাকরিজীবী ও সর্বসাধারণের জন্যে সবুজ পাসপোর্ট, সরকারি কাজে কর্মকর্তারা বিদেশ সফরে গেলে নীল পাসপোর্টের ব্যবহার হয় এবং অন্য পাসপোর্টটির রঙ লাল।

এই লাল রঙের পাসপোর্ট ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য ও তাদের স্পাউস (স্বামী-স্ত্রী) এই পাসপোর্ট পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন।

লাল রঙের পাসপোর্ট পেয়ে থাকেন উচ্চতর আদালতের বিচারপতি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রধান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বিদেশে বাংলাদেশি মিশনের কর্মকর্তারা। লাল রঙের এই পাসপোর্টধারীরা দেশে-দেশে অন-অ্যারাইভাল ভিসা পান। এর অন্য বিশেষত্ব হচ্ছে, ডিপ্লোম্যাটিক বা কূটনৈতিক পাসপোর্ট সব দেশেই লাল রঙয়ের হয়ে থাকে।

পাসপোর্টের রঙয়ের প্রসঙ্গের অবতারণা মূলত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ভ্রমণে গিয়ে বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্যের হত্যাকাণ্ড। ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার চিকিৎসা ও বন্ধুর মেয়ের বিয়ের জন্যে ভারতে গিয়ে খুন হয়েছেন। গত ১২ মে তিনি সড়কপথে ভারতে যান। গিয়ে ওঠেন তার পরিচিত এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে। আগেও যখনই কলকাতা গেছেন তখনও ওই বাড়িতে উঠতেন তিনি বলে জানা গেছে।

১৩ মে চিকিৎসার কথা বলে ওই বাড়ি ত্যাগ করেন বলে পশ্চিমবঙ্গের থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিতে (জিডি) উল্লেখ করেন স্বর্ণ-কারবারি গোপাল বিশ্বাস আর ১৬ মে তারিখ আনোয়ারুল আজীম আনারের ব্যক্তিগত সহকারীর মোবাইল ফোনে সবশেষ কল আসে বলে জানা গেছে।

ভারতে যাওয়ার এক সপ্তাহ এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার তিনদিন পর আনোয়ারুল আজীম আনারের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভারতে গিয়ে তিনি ‘নিখোঁজ’। হয়ত তাৎক্ষণিক বিভিন্ন মাধ্যম ও দপ্তরে এই সংবাদ গেছে, তবে সংবাদমাধ্যমে এই খবর এসেছে ১৯ মে।

ওইদিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ‘আনোয়ারুল আজীম আনারকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই’ মন্তব্য করে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘আমাদের এনএসআই কাজ করছে। ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো হয়েছে। উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নাই’।

মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘তিনি (আনোয়ারুল আজীম) পুরানা মানুষ, একজন সংসদ সদস্য বুঝেশুনেই তো চলেন। পাশের দেশ ভারতে গেছেন। এমন তো না মিয়ানমার গেছেন, যে মারামারি লেগেছে। আমার মনে হয় এসে পড়বেন।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে আশ্বস্ত করার বার্তা ছিল। ছিল প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে প্রবল বিশ্বাস। ‘এমন তো না মিয়ানমার গেছেন’ এই মন্তব্যে ভারত সম্পর্কে যে প্রবল আস্থার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তিনি, দেখা গেল তার উল্টো ফল! নিখোঁজের পর এখন জানা গেছে, ভারতে গিয়েই খুন হয়ে গেছেন আনোয়ারুল আজীম আনার এবং খুনের ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভারতে এমপি আনারকে খুন করেছে বাংলাদেশিরাই। এই ঘটনায় কোনো ভারতীয় সম্পৃক্ত নাই বলে তার দাবি।

ভারতের কেউ হয়ত এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত নয়, তবে ঘটনাস্থল যখন ওখানে তখন কি সত্যিই দায় এড়ানো যায়!

প্রথমে খবর এসেছিল সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের একটি ভবন থেকে। পরে জানা গেছে, তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। মরদেহের সন্ধান চলছে। এরই মধ্যে দেশে-বিদেশে অন্তত পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভারতীয়দের কেউ নয়, বাংলাদেশিদের দ্বারা খুন হয়েছেন আনোয়ারুল আজীম আনার। বিষয়টির তদন্ত চলছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভাষায় বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে তদন্ত শেষ! অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই আবার নিখোঁজের সংবাদ প্রকাশের পর পরই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘তিনি পুরানা মানুষ, একজন সংসদ সদস্য বুঝে শুনেই তো চলেন। আমার মনে হয় এসে পড়বেন।’ বাস্তবতা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত তার ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। মন্ত্রীও বলছেন, খুন হয়েছেন।

সংবাদমাধ্যমে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের অতীত বের হয়ে আসছে ক্রমশ। জানা যাচ্ছে, তিনি আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ওয়ারেন্টভুক্ত ছিলেন। হুণ্ডি কারবার, চোরাচালান ও পাচারের অভিযোগে ইন্টারপোল তার বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি করেছিল। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে, এমপি হয়ে তিনি সেই নোটিস প্রত্যাহার করিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বিভিন্ন সূত্র বলছে, স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে তিনি ওই এলাকায় শুরু করেছিলেন, বিকশিত হয়েছিলেন বিএনপির আমলে আর জনপ্রতিনিধি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের আমলে। পেয়েছিলেন সব জায়গা থেকে ‘দায়মুক্তি’। এখন তাই অতীতকে ভুলে আমরা ব্যস্ত শোকপ্রকাশে। মানবিক শোকের প্রকাশ যদিও দোষের নয়, তবু সত্য অপরাধ তামাদি হয় না কখনো।

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের এমন মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত। বিদেশে বিশেষ করে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্রে বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্যের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উদ্বেগজনক। যদিও এটা তার সরকারি সফর নয়। তিনি একাই গিয়েছিলেন ভারতে। চিকিৎসা, ব্যবসা কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া, যে কারণেই হোক এই সফরটা ব্যক্তিগত হলেও তার পরিচিতি এখানে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য। তিনি দেশের লাল রঙের পাসপোর্ট ব্যবহার করে থাকেন। পৃথিবীর প্রতি দেশের ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টের রঙ লাল। এই হিসেবে তার এই বিদেশ সফরও দুই দেশের কারো অজানা থাকার কথা নয়।

ভারতে বাংলাদেশের সংসদ সদস্যের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একাধিক মন্ত্রী বিষয়টির মধ্যে প্রতিবেশী দেশকে আমলে নিতে চাইছেন না। বিএনপি মহাসচিব খোঁচা দিয়েছেন, ‘বন্ধুরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব’ নিয়ে। এখানে ভারতকে আড়াল করার চেষ্টা, সামনে আনার চেষ্টার মধ্যে রাজনীতি এবং ভারতপ্রেম ও বিদ্বেষ আছে তাদের তবে এখানে তাদের দায় নেই কোনো এটা বলার সময় কিন্তু আসেনি এখনো। আগবাড়িয়ে তাদেরকে দায় দেওয়া ও দায়মুক্ত করার এই প্রচেষ্টা অপ্রয়োজনীয়। এটা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের যোগাযোগ, সম্পর্ক ও তদন্তের বিষয়।

ভারতের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক। বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের অগ্রগতি সবখানে দেশটির সহায়তা ও অংশগ্রহণ আছে। এই সত্যিকে স্বীকার করেও প্রশ্ন রাখা যায়, সীমান্তে নাগরিক মরে গুলিতে, আর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের এমপি কেন মরবেন আততাতীয় হাতে! এখানে কি ওই দেশের কোনো দায় নেই! সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তিনি যখন ভারত প্রবেশ করলেন তখন তার পাসপোর্ট সূত্রেই ভারত জানতে পেরেছে দেশটিতে একজন সংসদ সদস্য প্রবেশ করেছেন। এগুলো অতি-স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে যখন কোনো বিদেশি ভিআইপি প্রবেশ করেন, তখন কি নানা সংস্থা, কর্তৃপক্ষ অপ্রকাশ্য হলেও সক্রিয় হয় না! নজরদারি, নিরাপত্তাসহ বিবিধ দিক দেখার বিষয় এখানে প্রাসঙ্গিক। ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টের জোর তো এখানে!

প্রাথমিক তথ্যের সূত্র ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, বাংলাদেশিদের দ্বারা কলকাতায় হত্যাকাণ্ডের শিকার সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। এই মন্তব্য কি আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরুর আগে তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে দেওয়ার মতো মন্তব্য হয় না! চূড়ান্ত তদন্তেও যদি এটা প্রমাণ হয়, তবু প্রশ্ন রাখাই যায়, বাংলাদেশিরা ভিন দেশে গিয়ে এত বড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার সময়ে কি টের পাবে না দেশটির নানা বাহিনী, সংস্থা! এখানে কি সত্যি দায় থাকছে না তাদের!

ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টধারী বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মরদেহ এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি। অথচ প্রথমে জানা গিয়েছিল মরদেহ উদ্ধারের কথা। দেশটির একটা অভিজাত এলাকায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া একদল আততায়ী খুন করেছে, মরদেহ সরিয়ে নিয়েছে, খুনের ঘটনা নিশ্চিতের আগে সন্দেহভাজনরা গ্রেফতার হয়ে গেছে, প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রের ‘দায় আছে দায় নেই’ আলোচনাও শুরু হয়ে গেছে—এত সব ঘটনা ঘটেছে, দ্রুততম সময়ে। এগুলো রহস্যজনক!

হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে ঘটে যাওয়া এত সব ঘটনার রহস্য উন্মোচনও জরুরি।

কবির য়াহমদ: অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর,বার্তা২৪.কম

;

কার হাতে গাজাবাসীর রক্তের দাগ!



ড. মাহফুজ পারভেজ
কার হাতে গাজাবাসীর রক্তের দাগ!

কার হাতে গাজাবাসীর রক্তের দাগ!

  • Font increase
  • Font Decrease

একতরফা ইসরায়েলি হামলায় গত অক্টোবর (২০২৩) থেকে প্রায় ৩৭ হাজার মৃত্যু ঘটেছে গাজায়। হামলা এখনো অব্যাহত। নিহতদের বেশির ভাগই নারী, শিশু, বৃদ্ধ, সাধারণ নাগরিক। নিহত হয়েছেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অসুস্থ মানুষ, ত্রাণকর্মী, আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বেচ্ছাসেবী, চিকিৎসক, নিরীহ ও নিরপেক্ষ মানুষজন।

ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজায় মৃত্যুর মহোৎসবের দায় কার! কার হাতে লেপ্টে আছে সহস্র গাজাবাসীর রক্তের দাগ! কোনো ভণিতা ও কৌশলে এড়ানো সম্ভব হবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়বদ্ধতার! শাঠ্য-ষড়যন্ত্রে আড়াল করা যাবে, হত্যাকারীর রক্তলোলুপ-কুৎসিত চেহারা!

গাজায় নিজেদের হামলা, গণহত্যা ও দখলদারিত্বকে যতই হামাসবিরোধী আন্দোলন বলে দেখানো চাক ইসরায়েল, আসলে তা চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ ও সাফ গণহত্যা। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এই বার্তা দিয়ে সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার আবেদন জানিয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)-র চিফ প্রসিকিউটর করিম খান। আন্দোলন হচ্ছে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শত শত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।

কিন্তু সেই দাবির বিরোধিতা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, 'গাজায় যা হচ্ছে, তা কিছুতেই গণহত্যা নয়'। যদিও বাইডেন বিরোধীদের দাবি, গাজার ব্যাপারটিতে কার্যত চোখ বুজে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট। 'গণহত্যাকারী জো’ তকমাও জুটেছে তার। গণহত্যাকারী নেতানিয়াহুকে নির্লজ্জভাবে সমর্থন করে বাইডেন নিজের হাতে গাজাবাসীর রক্তের দাগ লাগাতেও পিছপা হননি।

গণহত্যাকারী নেতানিয়াহুকে নির্লজ্জভাবে সমর্থনকারী বাইডেনের সুরে কথা বলেছেন, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকও। আইসিসি-র দাবির বিরোধিতা করে তিনি বলেছেন, 'করিমের এই আবেদন মধ্য এশিয়ায় শান্তি আনতে পারবে না।' তাহলে শান্তি আনবে আরো মৃত্যু ও গণহত্যা! মনে মনে নেতানিয়াহু, বাইডেন, ঋষি সুনক আরো যুদ্ধ, আরো গণহত্যা, আরো রক্ত, আরো মৃত্যুই চাইছেন! গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের মুখোশের আড়ালে তারা আসলে গণহত্যাকারীর দোসর।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)-র চিফ প্রসিকিউটর করিম খানের দাবি, ২০২৩-এর ৭ অক্টোবর থেকে হামাস ও গাজার সংঘর্ষে মানবতা বিপন্ন। নির্বিচারে প্রাণ হারাচ্ছেন গাজার নারী-পুরুষ-শিশু। ত্রাণটুকুও পৌঁছচ্ছে না। তাই, প্রয়োজন আগ্রাসীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার।

নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে মূলত গণহত্যা, মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য অপরাধ, যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সেখানে মামলা করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, মামলা করেন গাজায় আক্রান্তদের আইনজীবীরাও। মামলায় গণহত্যা প্রমাণিত হয়েছে। নেতানিয়াহু অপরাধী হয়ে গ্রেফতারের মুখোমুখি।

গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন অপরাধীদ্বয়: নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট। তাদের পক্ষে সুর মেলান ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগও। ছুটে এসে আপত্তি জানিয়েছে আমেরিকা ও ব্রিটেন। তবে হঠাৎ করে সুর বদলে আইসিসিকে সমর্থন করে ফ্রান্স ও বেলজিয়াম। গাজার সরকারি সংবাদমাধ্যম দফতর ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনও করিমের আবেদনকে স্বাগত জানিয়েছে।

গণহত্যা থেকে চোখ সরিয়ে দিতে নেতানিয়াহুর দাবি, আসলে করিম ফের ইহুদি-বিদ্বেষ জাগিয়ে তুলতে চাইছেন। তিনি ‘আধুনিক যুগের অন্যতম প্রধান ইহুদি-বিদ্বেষী’। তিনি বলেন, 'দ্য হেগের আইনজীবী কীভাবে গণতান্ত্রিক ইসরায়েলের সঙ্গে রক্তপিপাসু হামাসের তুলনা করছেন! ইসরায়েলি বাহিনী স্রেফ আত্মরক্ষার খাতিরে লড়াই করছে। আর হামাস নির্বিচারে অপহরণ করে খুন ও ধর্ষণ করেছে আমার ইসরায়েলি ভাই-বোনেদের।' প্রায় একই সুরে গ্যালান্টের দাবি, ইসরায়েলের হকের লড়াইকে অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করতে চাইছেন করিম। এদেরই অভিন্ন সুর শোনা যাচ্ছে, বাইডেন ও ঋষি সুনকের কণ্ঠে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)-র চিফ প্রসিকিউটর করিম খান যেদিন এই গ্রেফতারি পরোয়ানার দাবি জানান, সেদিনই হোয়াইট হাউসে ‘ইহুদি ঐতিহ্য মাস’ সংক্রান্ত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, ‘আমি স্পষ্টভাবে একটা কথাই বলতে চাই। ইসরায়েল রাষ্ট্র আর হামাসের মধ্যে কোনো তুলনাই হয় না। আমরা আইসিসি-র প্রস্তাব সম্পূর্ণ খারিজ করে দিচ্ছি।’ ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচও বলেন যে, ইহুদিদের প্রতি এই ধরনের তীব্র বিদ্বেষ দেখা গিয়েছে, একমাত্র নাৎসি জার্মানিতেই।

হামাসের পাল্টা দাবি, 'নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়টিতে বেশ দেরি করে ফেললো আন্তর্জাতিক আদালত। আর তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। বরং ইসরায়েলি অপরাধের তুলনায় হামাস কিছুই করেনি।'

একদা ইসরায়েলসমর্থক ফ্রান্স ও বেলজিয়াম ৩৭ হাজার গাজাবাসীর মৃত্যু পর অবশ্য এক বিবৃতি প্রকাশ করে করিমকে সমর্থন জানিয়েছে। ফ্রান্সের মতে, ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষা’র খাতিরে বহু নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর বিচার প্রয়োজন। একই সুর বেলজিয়ামের। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলোও।

করিম ও তার সহযোগীদের দাবি, হামাস মৌলিক মানবাধিকারকে খর্ব করেছে। ইসরায়েলও আত্মরক্ষার নামে আন্তর্জাতিক মানবতার আইন না মেনে নির্বিচারে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই কারণেই গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রয়োজন। গণহত্যা থামানো ও গণহত্যাকারীকে আইনের আওতায় আনা দরকার।

এত কিছুর পরেও থেমে নেই ইসরায়েলি গণহত্যা। থেমে নেই গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত নেতানিয়াহুর প্রতি বাইডেন ও ঋষি সুনকের উলঙ্গ সমর্থন। এমনকী, গণহত্যার তাণ্ডবে মদমত্ত ইহুদি নেতা নেতানিয়াহু গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়েও দর্পিত চিৎকারে ঘোষণা করেছেন, 'তার জীবদ্দশায় আলাদা রাষ্ট্র হবে না প্যালেস্টাইন।' কিন্তু তার এই দম্ভোক্তি ব্যর্থ হওয়ার পথে।

বরং আশার কথা হলো, কতিপয় যুদ্ধোন্মাদ ছাড়া মানবিক বিশ্বনেতৃত্ব একবিংশ শতকের নব্য-হিটলার, হন্তারক নেতানিয়াহুর বন্য-হুঙ্কারে কান দেয়নি। আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও স্পেন ঘোষণা করেছে, 'আমরা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছি। আমরা এখন সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য জাতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করব। আমরা নিশ্চিত যে, আগামী সপ্তাহে আরো অনেক দেশ এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণে আমাদের সাথে যোগ দেবে।' গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শান্তির আশা ব্যক্ত করেছেন দেশ তিনটির শীর্ষ নেতারা।

আজকে না হলেও ভবিষ্যতে কোনো একদিন বিশ্ব ঠিকই চিহ্নিত করবে কার হাতে ছিল গাজাবাসীর রক্তের দাগ। কারা ছিলেন গণহত্যাকারীর দোসর-সমর্থক, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী। আর কারা ছিলেন শান্তির পক্ষে ও গাজা গণহত্যাকাণ্ডের বিপক্ষে।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

সব নিষেধাজ্ঞা ভিসানীতির অধীন নয়



কবির য়াহমদ
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে অভিযোগ, সেটা দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ এবং দুর্নীতির সহায়তা।

যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তিনি তার ভাইকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি এড়াতে সহযোগিতা করেছেন। অন্যায়ভাবে সামরিক খাতে চুক্তি বা ঠিকাদারি পাওয়া নিশ্চিত করতে তিনি তার ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। নিজের স্বার্থের জন্য সরকারি নিয়োগের বিনিময়ে ঘুষ নিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে সোমবার (২০ মে) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞার কথা জানানো হয়।

দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের বিবৃতিতে বলা হয়, উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার কারণে আজিজ আহমেদকে ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট, ফরেন অপারেশন অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্টের ৭০৩১ (সি) ধারার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে পররাষ্ট্র দপ্তর। এর ফলে আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য হবেন।

নিষেধাজ্ঞার পর প্রতিক্রিয়ায় সমস্ত অভিযোগকে অস্বীকার করে আজিজ আহমেদ বলেছেন, ‘নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি যদিও ব্যক্তিগত, তবে বর্তমান সরকারের সময়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই ঘটনাটি সরকারকেও কিছুটা হেয় করে।’

এদিকে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, এই নিষেধাজ্ঞা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন ভিসানীতির অধীন নয়, দেশটির অন্য আইনে। দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘এটা সেনাবাহিনীর বিষয়।’

এটা সত্যি যে, জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেটা নির্বাচনকেন্দ্রিক ভিসানীতির অধীন নয়। মার্কিন ভিসানীতি ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের অধীন। কিন্তু জেনারেল আজিজকে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা ফরেন অপারেশন অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্টের অধীন।

ম্যাথিউ মিলার তার বিবৃতিতে আইনের বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। নির্বাচনকে প্রভাবিত কিংবা বাধা প্রদান বিষয়ে মার্কিনিরা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে যে ভিসানীতি দিয়েছিল, এর অধীনে এখন পর্যন্ত কাউকে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। আজিজ আহমেদকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের বিশ্বাসকে ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে।

নিষেধাজ্ঞা মানে ভিসানীতির নিষেধাজ্ঞা নয়। এটা দুর্নীতির অভিযোগে। এই ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ঘোষণা আছে বাংলাদেশের।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখানে যথার্থই বলেছেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দুর্নীতি দমন, সন্ত্রাস দমনসহ অন্যান্য বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করছি। আমরা দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রেও একসঙ্গে কাজ করবো। সরকার-দলের অনেকেই দুর্নীতিতে জেলে গেছেন, যাচ্ছেন সেটাও নিষেধাজ্ঞা-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় উল্লেখ করেছেন হাছান মাহমুদ এবং এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অবগত করেছিল বলেও দাবি তার।

জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদকে দেওয়া নিষেধাজ্ঞায় তার ভাইকে শাস্তির থেকে পরিত্রাণের যে উল্লেখ সেটা দেশবাসীর অবিদিত নয়। এনিয়ে আগে প্রতিবেদন হয়েছে দেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমে। প্রতিবেদন হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায়।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ নামে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করে, যেখানে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ এবং তার ভাইদের কর্মকাণ্ডের উল্লেখ ছিল।

যদিও সরকার এর প্রতিবাদ করেছিল। প্রতিবাদ করেছিল সেনা সদর দপ্তর। ওই প্রতিবেদনের অন্যতম কুশীলব ছিলেন ডেভিড বার্গম্যান, তাসনিম খলিল, জুলকারনাইন সায়ের খান নামের ব্যক্তিরা।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) প্রতিবাদলিপিতে তাদের পরিচয় হিসেবে উল্লেখ করা হয় যথাক্রমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দণ্ডিত, অখ্যাত নেত্র নিউজ-এর প্রধান সম্পাদক ও মাদকাসক্তির অপরাধে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি হতে বহিষ্কৃত একজন ক্যাডেট হিসেবে। অর্থাৎ সেনা সদর দপ্তরের ছিল কড়া প্রতিক্রিয়া।

জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ যে সব দায়িত্বে ছিলেন, সেগুলো ছিল রাষ্ট্রের অতি-গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তার সাবেক পদ-পদবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও রাষ্ট্রের সম্মানের প্রশ্ন জড়িত। তাই, এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিজিবি-সেনাবাহিনী তাদের সাবেক প্রধানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আনীত অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য দেবে নিশ্চয়ই।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলছেন, ‘এটা সেনাবাহিনীর বিষয়’, তখন এই মুহূর্তে আমাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এছাড়া অভিযুক্ত ভাইকে বাঁচাতে সত্যি কি কোনো অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল, ওই ঘটনায় কি আইনের কোনো ব্যত্যয় হয়েছিল, এনিয়েও ব্যাখ্যা আমরা আশা করি আইন মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে।

অসত্য তথ্য দিয়ে ভাইদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করার যে অভিযোগ উঠেছে, সেটারও ব্যাখ্যা আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।

সাবেক সেনাপ্রধান যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষিদ্ধ হয়েছেন—এই সংবাদের কয়েকটা দিক রয়েছে। প্রথমত অভিযোগগুলো সত্যি কিনা, সত্যি হলে রাষ্ট্রের করণীয় কী, অসত্যি হলে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে! অভিযোগগুলো যদি সত্যি হয়, তবে আইনি প্রতিবিধান করা উচিত রাষ্ট্রের। অসত্যি হলে উচিত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রতিবাদ জানানো।

যদিও এখানে ব্যক্তি আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের শাস্তির কথা বলছে যুক্তরাষ্ট্র তবুও বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এই অপমান গিয়ে পড়ে রাষ্ট্রের ওপরও।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় দুর্নীতি দমনে রাষ্ট্রের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের একসঙ্গে কাজ করার যে প্রত্যয়, সেটা আমরা অনেকবারই শুনেছি, এবারও শুনলাম। তবে এই প্রত্যয় কেবল মুখের বুলি আর সাদা-কালো হরফের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাও উচিত নয় আমাদের।

বেঁচে থাকতে কাউকে যুক্তরাষ্ট্রে যেতেই হবে এমন না। পৃথিবীর সবার জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রের গমন নয়, এটা আরো অন্য অনেক কিছুর মতো ছোট্ট এক ঘটনা।

তবে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার মতো ফরমান জারি যে কারো জন্য অপমানের! হোক না সেটা ব্যক্তি পর্যায়ের। তবে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এবং দেশে স্পর্শকাতর একাধিক বাহিনীর সাবেক প্রধান হিসেবে এটা রাষ্ট্রের জন্যও অপমাননাকর।

সত্যি যদি দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে থাকেন জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ তবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিষেধাজ্ঞাতেই শাস্তি সীমিত থাকা উচিত হবে না। প্রচলিত আইনে তাকে বিচারের আওতায় আনার সুযোগ থাকলে সেটা গ্রহণ করতে হবে।

সাবেক সেনাপ্রধান যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন। এর আগে পুলিশের সাবেক নয় কর্মকর্তা যারা র‍্যাবে ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এসেছিল। এই তালিকাটা কেন দীর্ঘ হচ্ছে, এখানে কি অস্বীকার তত্ত্ব নেই! এই অস্বীকার তত্ত্ব-পদ্ধতি যখন কাজে আসেনি আগে, তখন এই পথে পা না বাড়ানোই উচিত হবে আমাদের। এখানে যেখানে থাকা দরকার বিভিন্ন বাহিনীর বিভাগীয় ভূমিকা, তেমনি দরকার রাষ্ট্রীয় ভূমিকাও। কারণ, ব্যক্তির নামে এসব নিষেধাজ্ঞা আসলেও নাগরিক হিসেবে তাদের সবাই বাংলাদেশের।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নিষেধাজ্ঞাবিষয়ক বিবৃতির পর একশ্রেণির মানুষের মধ্যে আনন্দ লক্ষণীয়। এই আনন্দের কারণ রাজনৈতিক। অনেকেই ভাবছেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক এই নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু সব নিষেধাজ্ঞা ভিসানীতির অধীন নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা দুর্নীতি সম্পৃক্ততায় বিচারিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত কিংবা প্রভাবিত এবং আর্থিকখাত সংশ্লিষ্ট। নির্বাচনকেন্দ্রিক ভিসানীতির অধীন হোক আর দুর্নীতির কারণে হোক ব্যক্তির নামের হলেও এখানে আদতে অপমানিত বাংলাদেশই।

দেশের এই অপমানে রাজনৈতিক-বিভক্তির আনন্দ অপ্রত্যাশিত, একইসঙ্গে ব্যক্তিগত শাস্তি এবং ‘স্বীকার করলে ভাবমূর্তি-সংকট’—এমন আশঙ্কায় এড়িয়ে যাওয়াও হবে অনাকাঙ্ক্ষিত!

কবির য়াহমদ: অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর,বার্তা২৪.কম

;