মৃত্যুনীল নদের আখ্যান, পর্ব- ২



তাশরিক-ই-হাবিব (অনূদিত)
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সাতিপি ইয়ামোসের সঙ্গে আলাপ করছিল।  তার গলা এমনই উচ্চকণ্ঠের যে তা খুব কমই বৈচিত্র্যপূর্ণ মনে হয়।

“তুমি অবশ্যই নিজেকে জাহির করবে, যা আমি স্পষ্ট বলছি। তুমি নিজেকে গুটিয়ে রাখলে কখনোই কেউ তোমাকে গুরুত্ব দেবে না। তোমার বাবা বলেন যে এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে এবং কেন তুমি সেসব করোনি? এবং তুমি তাতেই জো হুজুর জো হুজুর করো! তুমি কিছুই না ভেবে তার কথায় সায় দাও আর ওপরওয়ালাই জানেন, সেসব করা আদতে অসম্ভব! তোমার বাবা তোমাকে বাচ্চা, দায়িত্বজ্ঞানহীন বালকের মতোই ভেবে তেমন আচরণ করেন। যেন তুমি আইপির বয়সী!”

ইয়ামোস শান্তভাবে বলে:

“আমার বাবা আমাকে অন্তত আইপির মতো একইভাবে দেখেন না!”

“না, আসলেই তেমন।” সাতিপি নতুন বিষ প্রয়োগে এবার উদ্যমী হলো, “তিনি ঐ বখাটে ছোকরার ব্যাপারে তালকানা। দিনের পর দিন আইপির  বাড় বেড়েই চলেছে। সে যেখানে যেমন খুশি চড়ে বেড়ায় এবং কাজে সাহায্য করে না এবং এমন ভান করে যে তাকে যে কাজ করতে বলা হয়, তা তার জন্য খুবই পরিশ্রমের! ব্যাপারটা অপমানজনক!  এসবই ঘটছে কারণ সে জানে যে তোমার বাবা তাকে লাই দেবে এবং তার পক্ষে থাকবে। তোমার ও সোবেকের এ ব্যাপারে শক্ত হওয়া উচিত।”

ইয়ামোসে ঘাড় বেঁকায়।

“কোনটা ভালো?”

“তোমার জ্বালায় আমি পাগল হয়ে যাবো, ইয়ামোস - তা-ই তো তুমি চাও! তুমি একটা ভীতুর ডিম! তোমার সাহস বলে কিছু নেই। তুমি মেয়েদের মতো মেনিমুখো। তোমার বাবা যা বলেন তাতেই তুমি সঙ্গে সঙ্গে নাচো!”

“আমি সবসময়ই বাবার অনুগত।”

“ঠিক তাই, সেকারণেই তিনি সেই সুযোগ নেন। তুমি মেনিমুখো হয়ে সব দায় হজম কর আর যেসবের দায় তোমার নয়, সেসব বোঝাও বয়ে বেড়াও। তোমারও কথা বলা উচিত এবং সোবেক তাকে যেভাবে জবাব দেয়, সেভাবেই জবাবও দেয়া উচিত। সোবেক কাউকে ভয় পায় না।”

“তা ঠিক। তবে মনে রেখ সাতিপি, বাবা আমাকে বিশ্বাস করেন, সোবেককে নয়। বাবা তার ওপর ভরসা করতে পারেন না। সবকিছুর ব্যাপারে  চূড়ান্ত মত আমি দেই, সোবেক নয়।”

“এবং সেকারণেই এ জমিদারিতে তুমি অংশীদার হিসেবে থাকতেই পারো! যখন তোমার বাবা জমিদারির বাইরে থাকেন, তখন তুমি তার প্রতিনিধিত্ব কর। এমনকি তখন পৌরোহিত্যের দায়ও তোমার ওপর বর্তায়। সবকিছুর ভার তোমার ঘাড়ে চাপে অথচ তোমার কোনো স্বীকৃত কর্তৃত্বই নেই। পুরো ব্যাপারটার বন্দোবস্ত ঠিকঠাক হওয়া দরকার। তুমি এখন মধ্যবয়সী সংসারী মানুষ। এটা মেনে নেয়া যায় না যে তোমার সঙ্গে বাচ্চাসুলভ আচরণ করা হবে।

ইয়ামোসে সন্দিহানভাবে বলে:

“আমার বাবা নিজেই বৈষয়িক তদারকি পছন্দ করেন।”

“ঠিক তাই। এ ব্যাপারটা তাকে আনন্দ দেয় যে এ বাড়ির সবকিছুই তার ওপর নির্ভরশীল থাকুক - এবং এভাবেই প্রতিটি মুহূর্ত কাটুক! এর ফলে ব্যাপারটা খারাপের দিকে যাচ্ছে। তিনি এবার বাড়ি এলে তুমি তাকে অবশ্যই শক্তভাবে চেপে ধরবে আর তাকে অবশ্যই স্পষ্টভাবে জানাবে যে তুমি জমিদারির অংশিদারিত্ব চাও, যার বন্দোবস্ত লিখিতভাবে সম্পন্ন হবে।”

“তিনি শুনবেন না।”

“তুমি তাকে শুনতে বাধ্য করবে। ওফ, আমি যদি মরদ হতাম! তোমার জায়গায় আমি থাকলে দেখিয়ে দিতাম কত ধানে কত চাল! কখনোবা আমার মনে হয়, আমি একটি মহিলাকে বিয়ে করেছি।”

ইয়ামোসে জ্বলে ওঠে।

“আমি দেখব কী করা যায় - আমি সম্ভবত এ ব্যাপারে বাবার সঙ্গে কথা বলব - তাকে জিজ্ঞেস করব -”

“তুমি জিজ্ঞেস করবে না - তুমি অবশ্যই দাবি জানাবে! সবকিছুর পর, তার চাবুক তোমার হাতেই রয়েছে। এখানে তুমি ছাড়া অন্য কেউ নেই, যার কাছে সে এ জমিদারির তদারকির দায়িত্ব চাপাতে পারে। সোবেক এখনো যথেষ্ট অবাধ্য, তোমার বাবা তাকে বিশ্বাস করেন না, আর আইপি বয়সে খুব কাঁচা।”

“সেজন্যই হোরিকে রাখা হয়েছে।”

“হোরি এ পরিবারের কেউ নয়। তোমার বাবা তার বিবেচনায় ভরসা করেন কিন্তু তাই বলে নিজের কর্তৃত্ব তার হাতে তুলে দেবেন না। কিন্তু আমি দেখছি যে তুমি নিতান্তই মেনিমুখো আর সস্তা। তোমার শিরায় রক্ত  নয়, যেন দুধ বইছে!  তুমি আমার বা আমাদের বাচ্চাদের কথা ভাবো না। তোমার বাবা মারা যাবার আগ পর্যন্ত আমরা কি প্রাপ্যটুকু বুঝে পাব না!

ইয়ামোস ভারী গলায় বলে:

“তুমি আমাকে তাচ্ছিল্য করছ, তাই না সাতিপি?”

“তুমি আমাকে রাগাচ্ছ।”

“শোনো, আমি তোমাকে বলেছি যে বাবা বাড়ি এলে আমি তাকে এসব ব্যাপারে জানাব। প্রতিজ্ঞা করছি।”

সাতিপি দম চেপে ধরে বলে ওঠে :

“হ্যা- কিন্তু তুমি কীভাবে বলবে? মরদের মতো, নাকি ইঁদুরের মতো?”

২.

কাইট তার ছোট বাচ্চা আঙ্কের সঙ্গে খেলছিল। বাচ্চাটি সবে হাঁটতে শুরু করেছে এবং কাইট তাকে হাসিমুখে তানানানা করতে করতে উৎসাহ দিচ্ছিল। কাইট বাচ্চাটির সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে সামনের হাতটি বাড়িয়ে রেখেছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না অনিশ্চিতভাবে পা বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বাচ্চাটি তার মায়ের বাহুতে ধরা দিচ্ছিল।

কাইট পুরো ব্যাপারটি সোবেককে দেখাতে চাইছিল, কিন্তু অচিরেই সে বুঝে উঠল যে সে এদিকে মনোযোগী নয় বরং কপাল কুঁচকে বসে ছিল।

“আহ সোবেক, তুমি দেখছ না। সোনামণি, তুমি তোমার বাবাকে বলে দাও যে সে দুষ্টুমি করছে তোমার কা-কারখানা না দেখে।”

সোবেক  বিরক্তভরা কণ্ঠে খেঁকিয়ে ওঠে:

“আমি অন্য কিছু ব্যাপারে ভাবছি, সেসব নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে।”

কাইট তার গোড়ালির হিল পেছনে ফেরায়,  তার ঘাড়ের ওপর ফেলে রাখা মসৃণ চুলগুলো সোজা করে। বাচ্চাটির আঙুলগুলো তাকে ধরে রেখেছিল।

“কেন? কোথাও কি ঝামেলা হয়েছে?”

কাইটের কথাতেও মনোযোগ ছিল না। প্রশ্নটা যেন দায়সারাভাবে করা হয়েছে।

সোবেক রেগে গিয়ে বলে:

“সমস্যা এটাই যে আমাকে বিশ্বাস করা হয় না। আমার বাবা একজন বৃদ্ধ, তার চিন্তা ভাবনা একেবারেই সেকেলে ধরনের, এবং জমিদারির প্রতিটি ব্যাপারে তার খবরদারি করা চাই - তিনি আমার ভরসায় কিছুই ছেড়ে দিতে চান না।”

কাইট তার মাথা নামিয়ে অস্পষ্টভাবে প্রতিবাদ করে-

“আসলেই, এটা খুব খারাপ ব্যাপার।”

ইয়ামোস যদি আরেকটু সাহসী হত আর আমাকে সমর্থন করত তবে বাবাকে বাগে আনা তেমন কঠিন হত না। কিন্তু সে আসলে ভীতুর ডিম। বাবা চিঠিতে তাকে যেসব নির্দেশ দেন, সে সবই ঘাড় গুঁজে পালন করে।”

কাইট বাচ্চার গলায় থাকা জপমালা ঝাঁকাতে  ঝাঁকাতে বলে :

“আসলেই, ঠিক বলেছ।”

কাঠের ব্যাপারে আমি অবশ্যই আমার বিবেচনা বাবাকে জানাব তিনি বাড়ি এলে। এটা ঢের ভালো হয়েছে তেলের বদলে শনবাবদ দাম গ্রহণ করায়।”

“আমি নিশ্চিত, তুমি ঠিক কাজই করেছ।”

“কিন্তু  বাবা তার গৎবাধা পথের বাইরের যে কোনো ব্যাপারেই বাধা দেন। তিনি হম্বিতম্বি করবেন, আমি তোমাকে তেলের দামে এ ব্যবসা করতে বলেছিলাম। আমি জমিদারিতে না থাকলে সবকিছুই ভুলভাবে করা হয়। তুমি একটি বোকা বালক, যে কিছুই করতে জানো না। আমার বয়স কত, সে ব্যাপারে তিনি কী মনে করেন? তিনি বোঝেন না যে আমি আমার কালের পূর্ণাঙ্গ একজন মানুষ এবং তিনি বিগত হচ্ছেন! তার নির্দেশ এবং তার দৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিক এমন যে কোনো লেনদেনের মানে হলো আমরা ব্যবসায় উন্নতি করতে পারি না অথচ আমরা তা করছি। ধনী হতে হলে কিছু ঝুঁকি তো নিতেই হবে! আমার দূরদৃষ্টি ও সাহস আছে, বাবার কোনোটিই নেই।”

বাচ্চার ওপর চোখ রেখে কাইট ধীরগলায় বলে :

“তুমি খুব বেপরোয়া ও চালাক, সোবেক।”

“কিন্তু তিনি যদি বাড়ি সংক্রান্ত কিছু সত্য ব্যাপারে এখন জানতেন এবং তাতে দোষ খুঁজে বের করে আমাকে নাকাল করতেন, তবে বেশ হত! আমাকে যদি নিজের মতো করে চলার সুযোগ দেয়া না হয়, আমি এসবে থাকব না। বরং চলে যাব।”

কাইট বাচ্চাটির দিকে হাত বাড়ায়, তার দিকে মাথা ঘুরিয়ে পাকড়াও করার ভঙ্গিতে বলে-

“চলে যাবে? কোথায় যাবে তুমি?”

“যে কোনো জায়গায়!  এটা মেনে নেয়া আমার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার যে একজন উচ্ছৃঙ্খল, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ আমাকে কোনোভাবেই নিজের মতো কাজ করার সুযোগ দিচ্ছেন না। তাহলে আমি কী করব?”

“না, কাইট কৌশলী ভঙ্গিতে বলে “আমি বলছি সোবেক, না।”

সোবেক স্ত্রীর দিকে তাকায়, কাইটের কণ্ঠস্বর খেয়াল করে তার উপস্থিতি বুঝতে পারে।  সে তার স্ত্রীর প্রতি এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে কোনো ব্যাপারে আলাপের ক্ষেত্রে কাইট যে মানুষ হিসেবে নিজস্ব অস্তিত্ব বহন করে, তারও যে নিজস্ব চিন্তা করার সামর্র্থ্য আছে, তা সে ভুলেই বসেছিল।

“তুমি কী বলতে চাও, কাইট?”

“আমি এটাই চাই যে তুমি বোকামি করবে না। পুরো জমিদারির মালিকানা তোমার বাবার নামে - জমি, সেচব্যবস্থা, গবাদি পশু, কাঠ, শনের খেত - সব। তোমার বাবার মৃত্যুর পর এসবই তোমাদের হবে তোমার আর ইয়ামোসের আর আমাদের বাচ্চাদের। তুমি তোমার বাবার সঙ্গে ঝগড়া করলে এবং চলে গেলে তখন তিনি তোমার ভাই ইয়ামোসে ও আইপির মাঝে তা ভাগ করে দিতে পারেন। তাছাড়া তিনি আইপিকে অত্যধিক ভালোবাসেন। আইপি তা জানে বলেই কাজে লাগানোর ধান্দা করে। তুমি আইপির হাতের খেলনা হবে না। এটা তাকে খুব ভালো সুবিধা দেবে, যদি তুমি ইমহোটেপের সঙ্গে ঝগড়া করে চলে যাও। আমাদের অবশ্যই বাচ্চাদের দিকটা নিয়ে ভাবতে হবে।”

সোবেক তার দিকে তাকায়, তারপর বিস্ময়ের হাসি হাসে।

“একজন নারীকে আগেভাগে কখনোই বোঝা যায় না। আমি আগে টের পাইনি, কাইট, যে তুমি এত বুদ্ধিমতি।”

কাইট আন্তরিকভাবে বলে:

“তোমার বাবার সঙ্গে ঝগড়া কর না। তার কথার জবাব মুখে মুখে দিও না। আর কটাদিন সবুর কর।”

“তুমি বোধহয় ঠিকই বলছ, কিন্তু এই অবস্থা কয়েক বছর যাবত চলতে পারে। বাবা চাইলে আমাদেরকে তার জমিদারীতে অংশীদার করে নিতে পারে।”

কাইট মাথা নেড়ে বলে

“তিনি তা করবেন না। কারণ তিনি একথা বলতে ভালোবাসেন যে আমরা তার ঘাড়ে চেপে খাই, তার ওপর ভর করে বেঁচে আছি, তিনি না থাকলে আমাদের বাঁচবার জো নেই।”

 সোবেক কৌতূহলভরে তাকে দেখে।

“তুমি আমার বাবাকে তেমন পছন্দ কর না, কাইট।”

সে প্রসঙ্গে কথা বলার বদলে কাইট বাচ্চার প্রতি মনোযোগ দেয়।

“এসো, সোনামণি, - দেখ, এই যে তোমার পুতুল।”

সোবেক তার বাঁকানো কালো চুলের দিতে তাকায়। তারপর খানিকটা বিভ্রান্ত মুখে সে ফিরে যায়।

৩.

এশা তার নাতি আইপিকে ডেকে পাঠিয়েছে। সেই সুদর্শন কিশোর যৌবনে পদার্পণ করছে, চেহারাতে অসন্তোষের ভাব প্রবল। পাশে দাঁড়ানো তরুণকে বৃদ্ধা বেশ তীক্ষ্ম কণ্ঠে শাসাচ্ছিলেন। তার চোখজোড়া ম্লান আর ইদানীং তেমন ভালোভাবে দেখতে না পেলেও এখন সেগুলো যেন জ্বলছিল.

“আমার কানে এসব কী আসছে?” তোমার হাজারটা বায়না, এটা করবে না, ওটা করবে না! তুমি গবাদি পশুর দেখাশোনা করতে চাও, ভালো কথা। কিন্তু তুমি ইয়ামোসের সঙ্গে যেতে চাও না, খেতের কাজের তদারকিও করবে না, এ কেমন কথা? তোমার মতো একটা বাচ্চা ছেলে যখন এসব বায়না করে, তার ফল  কী হয়, জানো?”

আইপি অদ্ভুতভাবে বলে :

“আমি কচি খোকা নই। আমি বড় হচ্ছি, তবে কেন আমাকে ছেলেমানুষ ভাবা হবে? আমাকে কাজের হুকুম দেয়া হবে আর নিজের মতো করে কাজ জন্য কোনো  ভাতাও আলাদাভাবে পাব না! ইয়ামোস আমাকে সবসময় কাজের হুকুম দেয়! সে কি ভাবে?”

“সে তোমার বড় ভাই আর তোমার বাবা জমিদারিতে না থাকলে এর দায়িত্ব ইয়ামোসের ওপর অর্পিত।”

“ইয়ামোস নির্বোধ - ধীরগতির নির্বোধ। আমি তারচেয়ে ঢের চালাক। সোবেকও বোকা কারণ সে খুব ফুটানি মারে যে ভারী বুদ্ধিমান!  বাবা চিঠি লিখে জানিয়েছেন যে আমি আমার পছন্দসই কাজ করতে পারব।”

“ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়” বিরক্তিসহ এশা বলে।

“আর আমি যদি আরো বেশি খাবার ও পানি না পাই আরি তিনি যদি শোনেন যে আমি অসন্তুষ্ট  এবং  কেউ আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি, তিনি ক্ষিপ্ত হবেন।”

কথা বলার সময় সে চতুর, বাঁকানো হাসি হাসে।

“তুমি অকালে পেকেছ”, এশা সজোরে বলে। “ ইমহোটেপকে ব্যাপারটা জানাতে হয়।”

“না.  দাদী, তুমি তাকে এসব বলবে না।”

তার হাসি বদলে যায়। কিছুটা দুঃখভারাক্রান্তভাবে সে অনর্থকই বলে :

“এ বাড়িতে শুধু তোমার আর আমার মাথায় খানিকটা ঘিলু আছে।”

 “তোমার বিদ্বেষ!”

“আমার বাবা তোমার ওপর ভরসা করেন - তিনি জানেন, তুমি বিচক্ষণ।”

“তা হতে পারে - আসলে ব্যাপারটা ঠিক তেমন -  কিন্তু আমি তোমার কাছ থেকে এসব শুনতে চাই না।”

আইপি হাসে।

“তুমি আমার পক্ষে থাকলে ভালো হত, দাদী।”

“এই পক্ষাপক্ষির মানে কী?”

“বড় দুই ভাই খুবই বিরক্তিকর। তুমি তা জানো না? অবশ্যই জানো। হেনেট তোমাকে সবকিছু বলে।  সাতিপি যেভাবে আর যতভাবে সম্ভব দিনরাত ঘ্যানঘ্যান করে ইয়ামোসের হাড় মাংস জ্বালিয়ে খায়। আর এদিকে সোবেক গাধামি করেছে কাঠ কেনার ব্যাপারে  আর বাবা বাড়ি এসে তা জানলে ভয়ানক ক্ষেপে যাবে। তুমি দেখো দাদী, দুয়েক বছরের মধ্যেই আমি বাবার জমিদারির অংশীদার হয়ে যাব আর তারপর আমি যেভাবে চাইব, বাবা সবকিছু সেভাবেই করবে।”

“তুমি, পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য হয়ে এভাবে ভাবছ?”

“ বয়স নিয়ে ভাবার দরকার কী! বাবার হাতে পুরো জমিদারির ক্ষমতা আছে আর আমি জানি, তাকে কীভাবে বাগে আসতে হবে!”

“এসব ধান্দাবাজি ছাড়ো!”

আইপি নরম গলায় বলে:

“দাদী, তুমি তো বোকা নও! তুমি বেশ ভালোই জানো, বাবা ওপরে যতই হম্বিতম্বি করুক, ভেতরে ভেতরে খুবই দুর্বল মানুষ!”

আইপি হঠাৎ কথা বলা বন্ধ করে। সে খেয়াল করে, দাদী মাথা তুলে তার কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে চেয়ে আছে। সে নিজের মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পায়, হেনেট তার ঠিক পেছনেই চুপিসারে এসে দাঁড়িয়েছে।

“তার মানে ইমহোটেপ একজন দুর্বল মানুষ”- হেনেট তার মৃদু ঘ্যাঙানো সুরে বলে, “তিনি মোটেই খুশি হবেন না, আমার মনে হয়, তুমি এই কথা বলেছ জেনে।”

আইপি অকারণে দ্রুত হেসে পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করে।

”কিন্তু তুমি তাকে বলবে না, হেনেট। ... এখন বলো তো আমাকে ... প্রতিজ্ঞা করছ, প্রিয় হেনেট ...”

হেনেট এশার দিকে পিছলে যায়। সে তার গলা মৃদু চড়ায়।

“অবশ্যই, আমি কখনো চাই না কোনো ঝামেলা পাকাক ... তুমি তা জানো, আমি তোমাদের সবার কথাই ঘাড়গুঁজে মেনে চলি। আমি কখনোই কোনোকিছু বারবার করি না, যদি না মনে হয় যে এটা আমার কাজ”

“আমি দাদীকে খোঁচাচ্ছিলাম, ব্যাপারটা ¯্রফে এটুকুই!” আইপি বলে। আমি বাবাকে বলব। তিনি নিশ্চয়ই বুঝবেন যে আমি মোটেই  গুরুত্বসহযোগে ব্যাপারটা সম্পর্কে বলিনি।

সে তীক্ষè দৃষ্টিতে হেনেটের দিকে চেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে চলে যায়।

 হেনেট তার দিকে চেয়ে এশাকে বলে-

“দারুণ একটা ছেলে - মরদ হয়ে উঠছে। আর কেমন টাস টাস করে কথাগুলো বলে গেল!”

এশা সতর্কভাবে বলে:

“সে বিপজ্জনকভাবে কথা বলে। তার মাথায় যেসব ছাইপাস ঘুরছে, সেসব আমার মোটেই পছন্দ নয়। আমার ছেলে আস্কারা দিয়ে তাকে মাথায় তুলেছে।”

“কে-ই বা তেমনটি করবে না! এমন নজরকাড়া, সুঠাম ছেলে।”

“ সুদর্শন হতে হলে মনটাও তেমন হতে হয়!” তীক্ষ্ম কণ্ঠে এশা বলে।

খানিকটা সময় চুপ করে ধীর গলায় এশা বলে:

“হেনেট - আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে।”

“ কেন, এশা? কেন তুমি এত ভাবছ? যা হোক, কর্তা দ্রুতই বাড়ি ফিরবেন এবং সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে।”

“তাই নাকি? আমার বিশ্বাস হয় না!”

খানিকটা সময় চুপ থেকে সে আবার বলে:

“আমার নাতি ইয়ামোস বাড়িতে আছে?”

“আমি খানিক আগে তাকে বারান্দার দিকে আসতে দেখেছি।”

“ যাও, তাকে গিয়ে বল, আমি তার সঙ্গে কথা বলব।”

হেনেট চলে যায়।  সে বারান্দায় এসে ইয়ামোসকে দেখে তাকে এশার খবর জানায়।

ইয়ামোস তখনই দাদীর ঘরে আসে।

এশা হঠাৎ বলে:

“ইয়ামোস, খুব দ্রুতই ইমহোটেপ এখানে আসবে।”

ইয়ামোসের শান্ত মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

“তাহলে তো বেশ ভালো হয়।”

“সবকিছুই তার পক্ষে আছে? বিষয়গুলোর বন্দোবস্ত করা হয়েছে?”

আমার বাবা যেভাবে বলেছেন,  আমার সাধ্যমতো সেভাবেই সবকিছু করা হয়েছে।

“আইপির ব্যাপার কী?”

ইয়ামোস দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

“বাবা একেবারেই অসচেতন, যা আইপি খুব ভালোই জানে। এটা তার জন্য শুভ কিছু বয়ে আনবে না।”

“তুমি অবশ্যই এ ব্যাপারে ইমহোটেপকে স্পষ্ট করবে।”

ইয়ামোস সন্দিহান হয়ে ওঠে।

এশা দৃঢ়ভাবে বলে ওঠে:

“আমি তোমার পাশেই আছি।”

“ কখনো কখনো”, ইয়ামোস দীর্ঘশ্বাস জড়ানো গলায় বলে, “চারপাশে বাধা ছাড়া আর কিছুই যেন দেখা যায় না। কিন্তু বাবা আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন করণীয় সম্পর্কে। তিনি যা যা করতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন, তার অনুপস্থিতিতে সেসব করা কঠিন - কারণ আমার হাতে কোনো কর্তৃত্বই নেই, যদিও তার প্রতিনিধি হিসেবেই শুধু আমি আছি।”

এশা ধীরে বলে:

“তুমি ভালো ছেলে - বিনয়ী ও সজ্জন। তুমি দায়িত্ববান স্বামীও; তুমি সেই প্রবাদটি আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছ - একজন পুরুষের অবশ্যই তার স্ত্রীকে ভালোবেসে সংসার রচনা করা উচিত, যেন সে সেই নারীর সান্নিধ্য উপভোগ করতে পারে এবং ভরণপোষণ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বন্দোবস্ত করতে পারে এবং যতদিন তারা বেঁচে থাকে, যেন একে অন্যের মন জয় করে  চলতে পারে। কিন্তু এ কথার আরেকটা অর্থও আছে - তাকে সংসার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে নাক গলানোর সুযোগ না দেয়া। আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম, আমার নাতি, তবে আমি অবশ্যই এ ব্যাপারে ভাবতাম।

ইয়ামোসে তার দিতে তাকায় গভীর দৃষ্টিতে, তারপর সেখান থেকে চলে যায়।

আরও পড়ুন: মৃত্যুনীল নদের আখ্যান, পর্ব- ১

   

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;

চতুর ঘুঘু



শরীফুল আলম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

নেশাখোরের মত কখনো কখনো খিলখিল করে হাসি
প্রথমত দহন উষ্ণতায় ,
তারপর সুবিশাল শূন্যতায় ,
কখনো কখনো ছুঁয়ে ফেলি সাজানো প্রতিমা
জীবনের দাবী ,
তবে আপাতত গন্তব্য বলে কিছু নেই আমার
কবিতার অবয়ব এখনো যেটুকু আছে
তাকে আমি রঙ্গের উৎসবই বলি
কিম্বা যেটুকু আছে তা জীবনের দাবী ।

ক্রমাগত অন্তর্গত দ্বন্দে
অবাধ্য ভাষা এখন প্রাচীর তোলে
প্রসারিত মৃত্যুর কথা বলে ,
আমি তার গল্পের শেষটা জানার চেষ্টা করি
রাতের গহ্বর থেকে তোলে আনি মৃত্যুর পরোয়ানা ,
কিন্তু অস্পষ্টতা কিছু থেকেই যায়
আবার নিজে নিজেই বলি
আমার জলভূমিতে আবার কিসের নিঃসঙ্গতা ?

স্বপ্নবাসর ? সে এক চতুর ঘুঘু
আমি তার ক্ষণিকের হটকারীতা বুঝতে পারি
এমনকি চোখ বুজে
আমি ভুলে যাই তার সন্ধ্যার ঘায়েল
যেন দেখেও দেখিনা
বিনা মোহে সারারাত অহেতুক তার অহংকার
নিরর্থক বাজি ধরে সে
অর্কিড নিরালায় আমিও একা থাকি
ভাঙ্গা চোরা রাত জেগে থাকে আমার পাশে
মনে হয় চোখ দিয়ে ছুঁয়ে দেখি তার ঢাকাঢাকি
ফিরতি নজরে সেও আমায় দেখে
আমার মিষ্টি কবিতার মতই
আমিও থমকে যাই পাখীর ডাকে
দূর দরিয়ায় তখন উলুধ্বনি শংখ বাজে ,
ইচ্ছে হয় নাগরদোলায় আবার গিয়ে দুলি
আর জানই তো কবিরাই প্রেমে পড়ে
কবিরাও চুমু খায়
সুন্দরী পেলে তাঁরাও শুয়ে পরে।

*************************
শরীফুল আলম ।
২১এপ্রিল । ২০২৪ইং
নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।

;

শিশু সুভাষচন্দ্রের চেতনায় স্বদেশপ্রেমের উন্মেষ যেভাবে



উৎপল আইচ
-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ছবি: সংগৃহীত

-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে আমরা প্রায় সকলেই বৃহত্তর ভারতবর্ষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক বলে মানি এবং শ্রদ্ধা করি। তাঁর তুলনাহীন দেশপ্রেমের সামগ্রিক পর্যালোচনা শুধু একটা নাতিদীর্ঘ রচনার পরিসরে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাই বালক-কিশোর সুভাষচন্দ্রের জীবনে দেশাত্মবোধের অঙ্কুরোদয় আর তার উন্মেষই এই রচনার উপজীব্য থাকলো।

১৯০২ সালের জানুয়ারি মাসে ৫ বছর বয়স থেকে ১৯০৮ সালের ডিসেম্বর মাস অবধি, অর্থাৎ প্রায় ১২ বছর বয়স অবধি, দীর্ঘ ৭ বছর, সুভাষচন্দ্র ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত কটকের প্রটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে পড়াশুনা করেন। বিলিতি আদর্শে নিয়ন্ত্রিত এই স্কুলের বেশির ভাগ ছাত্রই ছিল ইউরোপীয় কিংবা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। যদিও এই স্কুলে খুব ভালো ইংরেজি শেখানো হতো, আসল প্রচেষ্টা ছিল ছাত্রদের মনেপ্রাণে ইংরেজ করে গড়ে তোলার। তাই বাইবেলের উপর খুব জোর দেওয়া হত। তাছাড়া গ্রেটবৃটেনের ইতিহাস ও ভূগোল, ল্যাটিন ইত্যাদি শেখানো হতো। সেই স্কুলে সংস্কৃত বা অন্য কোন ভারতীয় ভাষা শেখাবার প্রশ্নই উঠে না। তবে পড়াশুনার সাথে সাথে স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিয়মানুবর্তিতা এবং ভদ্র-ব্যবহারকে শিক্ষার বড় অঙ্গ বলে মনে করতেন।

এই স্কুলে প্রবেশের কয়েক বছর পরই বালক সুভাষচন্দ্র বঙ্গভঙ্গ-জনিত দেশের রাজনৈতিক নবজাগরণের ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছিলেন। প্রথম দিকে না বুঝতে পারলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটাও অনুভব করতে পারলেন যে তাঁদের বাড়ির বা তাঁদের সমাজের জীবন আর স্কুলের জীবন একদম ভিন্ন ধরণের। সুভাষচন্দ্র এও জানলেন যে ভারতীয়রা পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থানাধিকারী হলেও শুধুমাত্র ভারতীয় বলে স্কলারশিপ-পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাছাড়া, ইউরোপীয় এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছেলেরাই ভলান্টিয়ার কোর-এ যোগ দিতে পারে, বন্দুক ব্যবহার করা শিখতে পারে যা ভারতীয় ছাত্রদের জন্য নিষিদ্ধ।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘অ্যান ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এইসব ছোটোখাটো ব্যাপার থেকেই আমাদের চোখ খুলতে শুরু হল, বুঝলাম যে এক বিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় হিসাবে আমরা কতটা আলাদা’ (“Small incidents like these began to open our eyes to the fact that as Indians we were a class apart, though we belonged to the same institution.”) । সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীর শুরুতেই লিখেছেন যে তাঁর মন স্পর্শকাতর এবং তিনি একজন অন্তর্মুখী ব্যক্তি। (“I was and still remain an introvert.”) সুভাষচন্দ্র সেই আত্মজীবনী অসুস্থ অবস্থায় ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে দশদিনে অস্ট্রিয়ার ব্যাডগাসটেন-এ অবস্থানকালে লিখেছিলেন। তিনি সেখানে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য গিয়েছিলেন।

আত্মজীবনীতে তিনি আরও লিখেছেন, “সব কিছু বিচার করে আমি এখন একজন ভারতীয় বালক বা বালিকাকে এরকম স্কুলে পাঠাবো না। সে নিশ্চিত সুসমন্বয়ের অভাবে এবং তজ্জনিত অশান্তিতে ভুগবে, বিশেষতঃ সে যদি স্পর্শকাতর স্বভাবের হয়। (“Considering everything, I should not send an Indian boy or girl to such a school now. The child will certainly suffer from a sense of mal-adaptation and from consequent unhappiness, especially if he or she is of a sensitive nature.”)

১৯০৯ সালের জানুয়ারি মাসে সুভাষচন্দ্র কটকের র‍্যাভেন্-শ কলেজিয়েট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে (এখনকার হিসাবে সপ্তম শ্রেণিতে) ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি চার বছর পড়াশুনা করে ১৯১৩ সালের মার্চ মাসে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। সুভাষচন্দ্র বসু যখন র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন তখন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী বেণীমাধব দাস। সুভাষচন্দ্রের বয়স তখন ১২ বছর। কিশোর সুভাষ তার আগে এক বর্ণও বাঙলা পড়েননি। এদিকে তাঁর সহপাঠীরা সবাই বাঙলায় পারদর্শী ছিল। কিন্তু চরম অধ্যবসায়ী সুভাষ এক বছরের মধ্যেই বাঙলাটা রপ্ত করে ফেলেন। সংস্কৃতের ব্যাপারও একই কথা বলা যায়। এই নতুন স্কুলে তাঁর বন্ধুও জুটে যায় যেটা প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে হয়নি।

সুভাষচন্দ্র ছিলেন নিরহংকারী এবং প্রচারবিমুখ মহাপুরুষ, তাই অনেক কথা বিস্তারিতভাবে আত্মজীবনীতে লেখেননি বা হয়তো আত্মপ্রশংসা হবে মনে করে এড়িয়ে গেছেন। র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে তাঁর বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন শ্রী চারুচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সুভাষচন্দ্রদের প্রতিবেশীও ছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য যে চারুচন্দ্র তাঁর স্মৃতি রোমন্থন করে শ্রী সুবোধচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়ে “সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবন” নামে একটা বই লিখে গেছেন। তাঁর কাছ থেকে আরো অনেক তথ্য জানা যায়। এছাড়া অন্যান্য সূত্র থেকেও কিছু নতুন তথ্য জানা যায় এবং কিছু তথ্যের সমর্থন মেলে।

প্রথম ভর্তি হবার দিন সুভাষচন্দ্র কোট-প্যান্ট পরে র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে গিয়ে দেখতে পান যে সমস্ত শিক্ষক এবং অন্যান্য সব ছাত্ররা দেশীয় পোশাক পরে আছেন। তার পরদিন থেকে তিনিও ধুতি-পাজ্ঞাবি পরে স্কুলে যেতে শুরু করেন। সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে ক্ষুদিরাম বসুর নাম উল্লেখ না করে লিখেছেন যে ১৯০৮ সালে যখন প্রথম বোমা নিক্ষেপ করা হয় তখন চারদিকে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাঁদের মধ্যেও সাময়িক উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে এও লিখেছেন যে সেসময় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে, স্বদেশি জিনিস ব্যবহারের পক্ষে মিছিল ও আন্দোলন চলছিল এবং তাঁরা কিছুটা সেদিকে ঝুঁকেছিলেন, কিন্তু বাড়ির নিষেধ থাকায় রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। তবে তাঁরা বিপ্লবীদের ছবি কেটে কেটে পড়ার ঘরে টাঙিয়ে রাখতেন। এক আত্মীয় পুলিশ অফিসার দেখে ফেলায় সেগুলোও পরে অপসৃত হয়েছিল এবং এতে তাঁদের মন খারাপ হয়েছিল।

আমরা “সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবন” গ্রন্থ থেকে জানতে পারি যে, ১৯১১ সালের ১১ আগস্ট তারিখে র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র (বর্তমান নবম শ্রেণি) সুভাষচন্দ্র নিজ উদ্যোগে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির তৃতীয় বাৎসরিক স্মরণ দিবস উপযুক্ত ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালন করেছিলেন স্কুলে এবং র‍্যাভেন্শ কলেজ ও স্কুল হোস্টেলে। সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাব মত সব ছাত্ররা উপবাস করে এই পূণ্য দিনটি অতিবাহিত করেছিল সেদিন। অবশ্য এর পরিণতি ভালো হলোনা; ডিভিশনাল কমিশনারের কাছে খবর পৌঁছে যায় আর ফলস্বরূপ ম্যাজিষ্ট্রেট এই বিষয়ে তদন্ত করে প্রধান শিক্ষক শ্রীবেণীমাধব দাসকে কটক থেকে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে বদলি করে দেয়।

র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সুভাষচন্দ্র শিক্ষক শ্রীবেণীমাধব দাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্য। তিনি প্রধান শিক্ষককে মনেপ্রাণে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেন। যেহেতু বেণীমাধববাবু দ্বিতীয় শ্রেণির নীচে কোন ক্লাস নিতেন না তাই অধীর আগ্রহে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠার জন্য অপেক্ষায় থেকে যখন সেই সুযোগ সুভাষচন্দ্র পেলেন তখন তাঁর সে ভাগ্যও দীর্ঘস্থায়ী হলো না। তবে এই কয়েক মাসের মধ্যেই শ্রী বেণীমাধব দাস ছাত্র সুভাষের মধ্যে একটা নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে দিয়ে গেলেন।

এই বিচ্ছেদ সুভাষের জন্য খুব বেদনার হয়েছিল কিন্তু তাঁর সাথে বেণী মাধবাবুর চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রইল। সুভাষচন্দ্র আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, প্রকৃতিকে কিভাবে ভালবাসতে হয়, প্রকৃতির প্রভাবকে জীবনে কিভাবে গ্রহণ করতে হয় তা মাস্টারমশাই শ্রী বেণীমাধব দাসই তাঁকে শিখিয়েছিলেন। প্রকৃতি তো দেশমাতৃকারই অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ। কিন্তু মাস্টারমশাই যে তাঁকে স্বদেশপ্রেম শিখিয়েছেন তা অবশ্য স্পষ্ট করে সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেননি। হয়ত ১৯৩৮ সালে ছাপা বইতে তেমন কিছু কথা লিখে বেণীমাধব বাবুকে ইংরেজ-পুলিশের কুনজরে পড়তে দিতে চাননি।

বেণী মাধববাবুর বদলির কিছুদিন পর থেকেই সুভাষচন্দ্র বয়ঃসন্ধিজনিত কিছু মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলেন। সৌভাগ্যবশতঃ ঠিক এই সময়ই তিনি কটক শহরে নবাগত এক আত্মীয়ের বাসায় অপ্রত্যাশিতভাবে স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী পেয়ে যান এবং তা অতি উৎসাহে পড়ে ফেলেন। সুভাষচন্দ্র বুঝতে পারেন যে এই জিনিষই তিনি এতদিন ধরে খুঁজছিলেন এবং এগুলোর মধ্যেই তিনি তাঁর মানসিক অশান্তির সমাধান খুঁজে পেলেন। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের আদর্শই সুভাষচন্দ্র হৃদয়ঙ্গম করে নিলেন, যার মূল কথাটা হল, “আত্মনঃ মোক্ষার্থম জগৎহিতায় চ” অর্থাৎ ‘মানবজাতির সেবা এবং আত্মার মুক্তি’।

মানবজাতির সেবা বলতে স্বামী বিবেকানন্দ স্বদেশের সেবাও বুঝিয়েছেন। স্বামীজীর প্রধান শিষ্যা এবং জীবনীকার ভগিনী নিবেদিতা আমাদের জানিয়েছেন যে, মাতৃভূমিই ছিল স্বামী বিবেকানন্দের আরাধ্যা দেবী। আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র আরও লিখেছেনঃ ‘একটি বক্তৃতায় স্বামীজী বলেছেন, “সদর্পে বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী, আমার ভাই।”

নেতাজী সুভাষচন্দ্র লিখেছেন যে তাঁর বয়স যখন ১৫ ছুঁই ছুঁই, ঠিক তখন বিবেকানন্দ তাঁর জীবনে প্রবেশ করলেন; বিবেকানন্দের প্রভাব তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিল এবং তিনি স্বামী বিবেকানন্দের পথই বেছে নিলেন। বিবেকানন্দের সাথে সাথে তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রতিও সুভাষচন্দ্র আকৃষ্ট হলেন এবং কটকে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভক্তবৃন্দের একটা সংগঠন গড়ে তুললেন। সেই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল অধ্যাত্মচর্চা করা আর দুঃস্থের সেবা করা। স্কুল ছাড়ার সময় যত এগিয়ে আসছিল, সুভাষের মধ্যে ধর্মভাব আর মানবসেবা করার প্রবণতা ততই বেড়ে যাচ্ছিল। লেখাপড়ায় আর মন বসছিল না।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শিশু সুভাষ (দণ্ডায়মান, ডান থেকে প্রথম)

এরপর ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে মহাসপ্তমীর দিন কৃষ্ণনগর থেকে মাস্টারমশাই শ্রী বেণীমাধব দাসের পরিচয়পত্র নিয়ে হাজির হলেন সুভাষেরই সমবয়সী একই (ফার্স্ট) ক্লাসের ছাত্র শ্রী হেমন্তকুমার সরকার। হেমন্ত কলকাতার একটা রাজনৈতিক দলের সভ্য ছিলেন যাদেরও আদর্শ ছিল আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং দেশসেবা। সেই প্রথম সুভাষ ও তাঁর কটকের বন্ধুরা প্রথমবারের মত কলকাতার রাজনৈতিক প্রেরণার আস্বাদন পেলেন। হেমন্তের কাছে তাদের দলের নানাবিধ কাজের বর্ণনা শুনে সুভাষচন্দ্র মুগ্ধ হলেন।

হেমন্ত একদিন সুভাষের দলের ছেলেদের দেশের প্রতি তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে অনুপ্রাণিত করে একটা আবেগময় বক্তৃতাও দিলেন। এইসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সাথে তাঁর নিবিড় সখ্যতাও গড়ে উঠল। চারদিন কটকে থেকে বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় হেমন্তকুমার পুরী চলে গেলেন এবং কলকাতায় ফিরে গিয়ে তাঁর দলের প্রধানকে সব জানালেন। সেই দলনেতা চিঠির মাধ্যমে কটকের এই দলটার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং কয়েক বছর এই যোগাযোগ ছিল।

হেমন্তকুমার পরে তাঁকে লেখা সুভাষের বেশ কিছু চিঠি প্রকাশ করেন যার থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর কৈশোরের এবং যৌবনের অনেক কথা জানা যায়। তিনি তাঁর বিখ্যাত “সুভাষের সঙ্গে বারো বছর (১৯১২ – ১৯২৪)” বইতে জানান যে, সুভাষের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময়ই তাঁদের মধ্যে স্থির হয়েছিল যে পাশ করে তাঁরা চাকরি করবেন না এবং সুভাষ আই-সি-এস আর হেমন্ত আই-ই-এস-এ ঢুকে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে চাকরি-মোহগ্রস্ত বাঙালীর সামনে আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।

১৯১৩ সালের ১ মার্চ সুভাষচন্দ্র আর হেমন্তদের ম্যাট্রিক পরীক্ষা শুরু হয়। দুজনেই তাঁদের এই নূতন বন্ধুত্বের আর নতুন জীবনের আলোড়নে পড়াশুনায় তেমন মন দিতে পারেন নি। সুভাষচন্দ্র তো তারও আগে থেকেই পড়াশুনায় অমনোযোগী হয়ে গিয়েছিলেন। তৎসত্ত্বেও সুভাষ ৭০০-র মধ্যে ৬০৯ নম্বর পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। পরীক্ষার পর আগের পরিকল্পনা মত সুভাষচন্দ্র কিছুদিনের জন্য হেমন্তের কাছে কৃষ্ণনগরে যান।

কলকাতার দলের কয়েকজন সদস্যও সেখানে আসেন এবং তাঁরা সদলবলে পলাশী, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি ঐতিহাসিক স্থানগুলি দেখতে বের হন। পলাশীতে তাঁরা দেখতে পান যে সেই আম্রকানন আর নেই আর লর্ড কার্জনের আদেশে বিজয় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। হেমন্ত নবীনচন্দ্র সেনের “পলাশীর যুদ্ধ” আবৃত্তি করতে করতে যখন নবাব সিরাজদৌল্লার সেনাপতি মোহনলালের মুখনিঃসৃত অংশে আসেন তখন সুভাষচন্দ্র আর চোখের জল চেপে রাখতে পারেন না। তাঁর দলের সেই ভ্রমণ সাতদিনে সমাপ্ত হয়েছিল।

এরপর সুভাষচন্দ্র কলকাতায় এসে তাঁর বড় দাদাদের মত প্রেসিডেন্সি কলেজে আই এ ক্লাসে ভর্তি হলেন ১৯১৩ সালের জুলাই মাসে। তখন তাঁর বয়স সাড়ে ষোল। ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই তিন মাসের গ্রীষ্মের বন্ধ হয়ে যায়। সেই তিন মাসে তিনি কলকাতার সেই দলটাকে খুঁজে বার করলেন আর পছন্দমত কিছু নতুন বন্ধুও জুটিয়ে ফেললেন। কটকের পরিবেশ আর কলকাতার পরিবেশে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

অবশ্য এর প্রায় বছর দেড়েক আগে স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার সমাপ্ত হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছে তবে তার জন্য বঙ্গ প্রদেশকে (বাংলা প্রেসিডেন্সিকে) অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। হিন্দী-উড়িয়া-অসমীয়া-ভাষী অঞ্চলগুলোকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে আর ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তবে এই স্বদেশী আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং এজন্য সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের তৎপরতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

সুভাষের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে এসময় সুভাষচন্দ্র শ্রীঅরবিন্দের লেখা ও চিঠিপত্র পড়ে তাঁর প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের কিছু ছাত্রদের মধ্যেও এই বিপ্লবী চিন্তাধারা সক্রিয় ছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্র কলকাতায় এসেছিলেন মানবসেবা আর আধ্যাত্মিক উন্নতির সঙ্কল্প নিয়ে, যদিও তাঁর মধ্যে বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতি ছিল এবং স্বদেশচিন্তা তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করত। আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র লিখে গেছেন, ‘কলেজ-জীবনে প্রবেশ করবার সময় জীবন সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিল। বুঝেছিলাম যে জীবনের একটা উদ্দেশ্য আছে এবং এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য নিয়মিত শরীর ও মনের অনুশীলনের প্রয়োজন।’

এসময় তাঁর সাথে কয়েক মাস আগে প্রয়াত বিখ্যাত কবি, নাট্যকার, গীতিকার, স্বদেশী-সংগীতস্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপ কুমার রায়ের বন্ধুত্ব হয়। দিলীপ কুমার রায় সুভাষচন্দ্রের সমবয়সী ছিলেন এবং সেবছরই প্রেসিডেন্সি কলেজে আই-এস-সি ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁরা কাছাকাছিই থাকতেন। সুভাষ একদিন দিলীপকুমারের বাড়ীতে এসে দিলীপকুমারকে তাঁর উদ্যোগে কলেজে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিতর্কসভায় যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেই প্রথম পরিচয়ের বর্ণনা খুবই সুন্দর।

সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন যে, আমাদের দেশে তর্ক-বিতর্কের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে কারণ স্বাধীনতার জন্য বড় বড় বক্তার, বাক-যোদ্ধার খুব প্রয়োজন। শ্রী দিলীপকুমার রায় তাঁর “আমার বন্ধু সুভাষ” বইতে লিখেছেন যে তিনি বলেছিলেন, রামকৃষ্ণ তো বলে গেছেন তর্ক দিয়ে সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। সুভাষচন্দ্র উত্তরে বলেছিলেন, “তিনি কি বলেছিলেন তাতে আমাদের দরকার কি? ... আমাদের গড়ে তুলতে হবে ভবিষ্যৎকে। কেন, আপনার বাবা কি বলেননিঃ ‘চোখের সামনে ধরিয়া রাখিয়া অতীতের সেই মহা আদর্শ, জাগিব নূতন ভাবের রাজ্যে রচিব প্রেমের ভারতবর্ষ?” দিলীপকুমার আশ্চর্য হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘তাঁর কবিতা আপনার মনে আছে?’ উত্তরে সুভাষের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, “অন্তরে গাঁথা আছে।”

সুভাষের দলের সকলেই ব্রহ্মচর্যের ব্রত নিয়েছিলেন। দলের প্রধান লক্ষ্য ছিল ধর্ম আর জাতীয়তাবাদের সমন্বয় ঘটানো – শুধু চিন্তায় নয় কাজের মাধ্যমে। তাঁর দলের ছেলেরা নতুন নতুন ভাবধারার সন্ধানে দর্শন, ইতিহাস, জাতীয়তাবাদের উপর বই খুঁজে খুঁজে পড়তেন এবং নিজেদের মধ্যে তা আলোচনা করতেন। তাছাড়া নতুন সদস্য সংগ্রহ করতেন এবং নামকরা লোকদের সাথে আলাপ পরিচয় করতেন। এছাড়া সাধু-সন্তদের সন্ধানে থাকা এবং ছুটির সময় তীর্থস্থানে তাঁদের সন্ধান করাও একটা কাজ ছিল। ১৯১৩ সালে বড়দিনের ছুটিতে তাঁরা দলবেঁধে গিয়ে কলকাতা থেকে ৫০ মাইল দূরে শান্তিপুরে কিছুদিন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী হয়ে বাস করেছিলেন। ১৯১৪ সালে তাঁরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাথেও দেখা করতে গিয়েছিলেন। বেলুড় রামকৃষ্ণ মঠ ও অন্যান্য জায়গায় প্রায়ই যেতেন। দক্ষিণ কলকাতার অনাথ ভাণ্ডার দরিদ্র সেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য রবিবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থ ও চালডালও সংগ্রহ করেছেন।

সেসময় কলেজে অধ্যাপকদের পড়ানো সুভাষচন্দ্রের একঘেয়ে লাগতো। এই একঘেয়েমি কাটানোর জন্য জনহিতকর কাজে মেতে থাকতেন। বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা, বন্যা বা দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য টাকা তোলা, সহপাঠীদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়া–এই ধরণের কাজ তাঁর ভালো লাগত। প্রথম বছরের কলেজের ছুটিতে কটক গিয়ে কাছের একটা গ্রামে কলেরা হওয়ায় সে গ্রামে রোগীর শুশ্রূষা করতেও যান। সেই এক সপ্তাহে তিনি দেশের দারিদ্র্য, মৃত্যুর তাণ্ডবলীলা আর নিরক্ষরতার অভিশাপ প্রত্যক্ষ করেন। কলকাতায় ফিরে এসে ষাট মাইল দূরে কৃষ্ণনগরে এক উদাসী পাঞ্জাবী শিখ তরুণ সাধুর সন্ধান পেয়ে হেমন্তকে নিয়ে পায়ই তাঁর কাছে যেতে শুরু করেন। সেই সন্ন্যাসীকে দেখে সুভাষের মনে দীক্ষা নেবার ইচ্ছা জাগে।

১৯১৪ সালের গরমের ছুটির সময় সুভাষচন্দ্র প্রায় দুমাস গুরু খুঁজতে উত্তর ভারতের প্রায় সবকটা তীর্থস্থান ঘুরে বেড়ান। বাড়িতে শুধু একটা পোস্টকার্ড পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন মাত্র। এই তীর্থভ্রমণের সময় হিন্দু সমাজব্যবস্থার মূল গলদগুলি তাঁর কাছে ধরা পড়ে। অবশ্য অনেক প্রকৃত ধার্মিক সন্ন্যাসীরও দর্শন পান। সেখান থেকে ফিরে এসে কিছুদিনের মধ্যেই সুভাষচন্দ্র টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হন। সেবার তাঁর ৬৩ দিন জ্বর ছিল। জ্বর সেরে গেলে সুভাষচন্দ্র স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে কার্সিয়াং গিয়ে এক মাস থেকে আসেন। এরপর ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে হেমন্ত ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হন এবং সুভাষ কৃষ্ণনগরে গিয়ে বন্ধুর সেবা করেন। এসব গোলযোগে পড়াশুনার ব্যাঘাত হওয়ায় ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফল ভাল হলনা। তবুও ১৯১৫ সালে তিনি ফার্স্ট ডিভিশনে আই এ পাশ করেছিলেন এবং দর্শনে অনার্স নিয়ে একই কলেজে বি এ ভর্তি হলেন।

কৈশোরে সুভাষচন্দ্র বসু

১৯১৬ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাস সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনে একটা তাৎপর্যপূর্ণ সময়। তখন তাঁর বয়স ১৯ বছর। ঘটনাটা সবার জানা। অনেকেই এই সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখেছেন। তাই খুব সংক্ষেপে সেই ঘটনাটার বিবরণ দিয়ে এই লেখাটা শেষ করব। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন এডওয়ার্ড ফারলে ওটেন। এই ইংরাজ অধ্যাপক ছিলেন I.E.S. (ইন্ডিয়ান এডুকেশান সার্ভিসের সদস্য) এবং বর্ণবিদ্বেষী। তিনি ১৯১৫ সালে ইডেন হিন্দু হোস্টেলে আমন্ত্রিত হয়ে ভাষণ দেন এবং সেই বক্তৃতায় ভারতীয়দের সম্বন্ধে খারাপ মন্তব্য করেন। অসন্তুষ্ট হলেও তাঁকে সভাপতি করে ডেকে আনা হয়েছে বলে ছাত্রেরা সেদিন কোন গোলযোগ করেনি। কিন্তু ১০ জানুয়ারি ১৯১৬ তারিখে তিনি কয়েকজন ছাত্রকে কলেজের বারান্দায় ধাক্কা দেন।

ছেলেরা যেহেতু থার্ড ইয়ার অর্থাৎ বি এ ফার্স্ট ইয়ারের ছিল এবং সুভাষচন্দ্র সেই ক্লাসের প্রতিনিধি ছিলেন, তিনি অধ্যক্ষ মিঃ এইচ আর জেমসের কাছে গিয়ে প্রতিবাদ জানান। অধ্যক্ষ মিঃ জেমস জানান, যেহেতু অধ্যাপক ওটেন ইন্ডিয়ান এডুকেশান সার্ভিসের সদস্য তাই তিনি অধ্যাপক ওটেনকে শাসন করতে পারবেন না। পরদিন ছাত্ররা ধর্মঘট শুরু করে এবং ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন কর্তৃপক্ষ ওটেনকে চাপ দিলে ওটেন ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলেন। কিন্তু প্রায় একমাস পর ওটেন একই কাজ করে ফেলেন।

যদিও সেবারের ছাত্রটি আই এ ফার্স্ট ইয়ারের ছিল, সুভাষচন্দ্র ছাত্র-প্রতিনিধিদের মিটিংয়ে জানান, এই অধ্যাপককে এভাবে শোধরানো যাবে না এবং তাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্র-প্রতিনিধিদের সভায় তাঁর এই প্রস্তাব অনুমোদিত হয় এবং পরদিন, ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯১৬, মিঃ ওটেন কলেজের করিডোরে প্রহৃত হন। এই ঘটনার জন্য সুভাষচন্দ্র এবং শ্রী অনঙ্গ মোহন দাম কলেজ ও ইউনিভারসিটি থেকে বহিষ্কৃত হন। যদিও সুভাষচন্দ্র নিজে মিঃ ওটেনকে প্রহার করেননি, তিনি নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে চুপ করে থাকেন। সত্যি বলে দায়িত্ব এড়িয়ে বহিষ্কার এড়াতে রাজি হন না।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ছোটবেলায় প্রথমে তিনি ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে মিশেছেন। তারপর তিনি নিজের দেশের সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হন। যখন তিনি স্কুলে পড়েন তখন বিভিন্ন প্রদেশের ছেলেদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। মুসলমানদের সম্বন্ধে উদারতার জন্য তাঁর ছেলেবেলার অভিজ্ঞতাই বহুল পরিমাণে দায়ী। তাঁদের কটকের বাড়ী ছিল মুসলমান এলাকায় এবং প্রতিবেশীরা বেশীরভাগই ছিল মুসলমান। তাঁর বাবাকে সবাই খুব শ্রদ্ধা করতেন।

তাঁরাও মুসলমানদের উৎসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। তাঁদের বাড়ীর কাজের লোকেরা অনেকেই মুসলমান ছিলেন এবং তাঁরাও সুভাষচন্দ্রদের খুব অনুরক্ত ছিলেন। স্কুলে মুসলমান শিক্ষক আর ছাত্রদের সাথেও তাঁদের খুব সৌহার্দ্য ছিল। মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করা ছাড়া কোন ব্যাপারেই তিনি কোন প্রভেদ দেখতেন না। এই জন্যই আজাদ হিন্দ ফৌজে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টান-সব ধর্মাবলম্বীরা এক হয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পেরেছিল।

বাল্যকাল আর কৈশোর ছিল সুভাষচন্দ্রের প্রস্তুতির সময়। যে দেশপ্রেম তাঁর পরবর্তী জীবনে প্রস্ফুটিত হয়েছে, তার ব্যাপকতা, গভীরতা, বিস্তীর্ণটা ইত্যাদি বুঝতে হলে তাঁর বাল্যকাল আর কৈশোরকে ভাল করে জানতেই হবে। যারাই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনী অধ্যয়ন করেছেন তাঁরাই একমত হবেন যে তিনি এই উপমহাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক।

পূর্বেই বলেছি, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মধ্যে কোন প্রাদেশিক, ধার্মিক বা জাতপাতের সঙ্কীর্ণতা ছিল না। তিনি মনে করতেন, ধর্ম যার যার নিজস্ব ব্যাপার। তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে দেশের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন এবং তাঁর এই দেশপ্রেম কৈশোরেই অঙ্কুরিত হয়েছিল। এমনকি তিনি যে আই.সি.এস পাস করে তা থেকে পদত্যাগ করবেন তাও সেই কৈশোরেই স্থির করে ফেলেছিলেন। বালক-কিশোর সুভাষচন্দ্রই পরে নেতাজী হয়ে আমাদের দেশকে ইংরেজের হাত থেকে স্বাধীন করেছিলেন।

সেসময়কার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এ্যাটলি নিজমুখে একথা স্বীকার করে গেছেন। শুধু দুঃখের কথা এই যে কিছু স্বার্থান্বেষী নেতার জন্য যে অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন নেতাজী দেখেছিলেন, তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। আজ এত বছর পর নেতাজীর আকাঙ্ক্ষিত বৃহত্তর ভারতের প্রয়োজনীয়তা কিছুটা হলেও আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। নেতাজীর জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা, কার্যকলাপ সব একটি মাত্র আবেগ দ্বারাই সঞ্চালিত হয়েছে এবং তা হচ্ছে দেশপ্রেম।

অহিংসার পূজারি গান্ধীজী পর্যন্ত তাঁকে “Patriot of Patriots” আখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছেন। নেতাজীর দেশপ্রেম নেলসন ম্যান্ডেলা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে। আজও ভারতবাসী এবং বাঙালী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর তুলনাহীন দেশপ্রেম থেকে অনুপ্রাণিত হন। যতদিন মানবজাতি থাকবে এবং দেশপ্রেম আলোচিত হবে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জনক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নাম পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে। জয়তু নেতাজী।।

লেখক: সাবেক কুটনীতিক ও ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু, নয়াদিল্লি; ভারত। ইমেল: [email protected]

;

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;